Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ
ও সম্ভাবনা
মুহাম্মদ শফিকুল হক আকন্দ
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে কৃষি। এদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৭ ভাগ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১) এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রায় ৪১ ভাগ জনশক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১)। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, মাটির উর্বরতা, সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, উৎপাদন সহায়তা, সেচ সম্প্রসারণ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে চলছে এক দুর্বার গতিতে আর এজন্যেই এটি আজ বিশ্বের কাছে এক বিশয়। সমস্ত পৃথিবীতে বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে  তৃতীয়,  মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে সপ্তম আর আম উৎপাদনে অষ্টম। উল্লেখ্য, দানাদার ফসল, ফল ও সবজি উৎপাদনের বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পারলেও ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় মাত্র ১২ শতাংশ। তাই এখনই সময় ভোজ্যতেল উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার।
ভোজ্যতেলের প্রয়োজনীয়তা
মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম ফ্যাট বা চর্বি। এই ফ্যাট দেহের তাপশক্তি উৎপাদন, মস্তিষ্কের বিকাশ, বিভিন্ন হরমোনের উৎপাদন, চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় ভিটামিন শোষণ (এ,ডি,ই,কে) এবং ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। মূলত ফ্যাট দেহের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা ফ্যাট মানেই খারাপ, অস্বাস্থ্যকর। এ ধারণাটা ঠিক নয়। মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অপর দিকে, খারাপ ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাটজাতীয় খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর।   
মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো দেহের কোষের বিকাশ, কোলেস্টেরলের মাত্রা স্থিতিশীল রাখা এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। অ্যাভোকাডো, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল (ক্যানোলা/সরিষা, জলপাই, চীনাবাদাম, তিলের তেল) মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের ভালো উৎস। অন্যদিকে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রধানত উদ্ভিজ্জ তেল (সূর্যমুখী, তিল, সয়াবিন, কর্নওয়েল) ও সামুদ্রিক মাছে পাওয়া যায়। এই ফ্যাট খাওয়ার ফলে এলডিএল (খউখ) কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। খারাপ ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাটজাতীয় খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই ফ্যাট খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএলের পরিমাণ বাড়ায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (ঐউখ) কমিয়ে দেয়। চর্বিযুক্ত মাংস, ক্রিম, বাটার, চিজ, পাম অয়েল, নারকেল তেল, ফ্রাই করা খাদ্যে এই ফ্যাট বেশি পাওয়া যায়।
ফ্যাট শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তাই ফ্যাটজাতীয় খাবারকে একেবারে বাদ না দিয়ে, ভালো ফ্যাট গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং খারাপ ফ্যাট বর্জনের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের ইতিহাস
বাংলাদেশে তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো সরিষা। এ ছাড়া দেশে সূর্যমুখী, তিল, চীনাবাদাম, তিসি, কুসুমফুল, সয়াবিন ইত্যাদি চাষাবাদ হয়ে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে দেশে উৎপাদিত সরিষার তেল দিয়েই ভোজ্যতেলের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ হতো এবং সরিষার তেল ছিল বাঙালির ঐতিহ্যের একটা অংশ। পরবর্তীতে আশির দশকে জাতিসংঘের রিলিফ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দেশে সয়াবিন তেলের ব্যবহার শুরু হয়। তাছাড়া দেশে উফশী বোরো ধানের আবাদ বাড়তে থাকায় সরিষার আবাদ কমতে থাকে। এ ছাড়াও, সরিষার তেলে বিদ্যমান ইরুসিক এসিড নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করা হয়। ফলে সরিষার তেল থেকে সরে গিয়ে মানুষ সয়াবিন তেলের দিকে বেশি ঝুঁকে পরে। প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেলে যে সমস্ত গুণাগুণ থাকা দরকার যেমন-সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগের নিচে থাকা, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের উপরে থাকা এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ এর অনুপাত ১:২ থাকা এগুলো সবই সরিষার তেলে বিদ্যমান রয়েছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি ও আবাদ পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসেবে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পামতেল এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়। এতে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের দেশে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী হতে প্রাপ্ত ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ মে. টন অর্থাৎ আমাদের দেশীয় চাহিদা দাঁড়ায় মোট ২৪ লাখ মে. টন। অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই এখনো আমদানি নির্ভর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৬.১০৬ হে: জমিতে ৮.২৪৩ লাখ মে.টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। অপরদিকে চীনাবাদাম ০.৯৫ লাখ হে: জমিতে ১.৭১ লাখ মে.টন, তিল ০.৬৫১ লাখ হে: জমিতে ০.৭৭১ লাখ মে.টন, সয়াবিন ০.৭৯১ লাখ হে: জমিতে ১.৪২২ লাখ মে.টন, সূর্যমুখী ০.০৯২ লাখ হে: জমিতে ০.১৬ লাখ মে.টন এবং অন্যান্য  তেলজাতীয় ফসল ০.০১২ এবং ০.০১৪ লাখ মে.টন। যা থেকে দেখা যায় যে, সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তেলজাতীয় ফসল। বাংলাদেশে সয়াবিন ও বাদাম চাষ হলেও এ দুটো ফসল থেকে তেল নিষ্কাশন এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানোর জন্য সরিষার আবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত আশার কথা যে, বর্তমানে ভোজ্যতেল ব্যবহার নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ার ফলে সরিষার তেল জনপ্রিয় হচ্ছে এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনে পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো সঠিক পরিকল্পনামাফিক তেলজাতীয় ফসলের আবাদে সমম্বিত ব্যবস্থাপনার অভাব। বাংলাদেশের আবাদি জমির মাত্র শতকরা ৩ ভাগ জমিতে তেল ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে রোপা আমন চাষ না করার ফলে সময়মতো সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়াও মানসম্মত তেল ফসলের বীজের অপর্যাপ্ততা, বাদাম ও সয়াবিনের বীজ কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণের সমস্যা,  প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেলজাতীয় ফসলসমূহ আবহাওয়া, আর্দ্রতা, জলাবদ্ধতা এবং রোগবালাইয়ের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে দুর্বল অবকাঠামো ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উক্ত সম্ভাবনাসমূহ বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সমম্বিত উদ্যোগ। এক্ষেত্রে রোপা আমন, সরিষা ও বোরো ধানের উচ্চফলনশীল এবং স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার, লবণাক্ততা সহনশীল সূর্যমুখী ও সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যমান বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করেও তেলজাতীয় ফসলের আবদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশে রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসের আওতায় প্রায় ২০ লাখ হে: জমি রয়েছে (সূত্র : ডিএই)। উক্ত শস্যবিন্যাসে স্বল্পজীবনকালের (১১০-১১৫ দিন) আমন মৌসুমে ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫ বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২২ দ্বারা চাষ করে সরিষার মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি জাত (৮০-৮৫ দিন) বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭ অথবা বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ চাষ করে পরবর্তীতে বোরো ধান চাষ করে সরিষার আবাদি এলাকা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ ছাড়া রোপা আমন-পতিত-আউশ এবং রোপা আমন-পতিত-পাট জমিতে বারি সরিষা-১৮ জাত অন্তর্ভুক্ত করে আবাদি এলাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরিষার ফলন অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় (যেমন- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম) সূর্যমুখী ও সয়াবিন, চর এলাকায় (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ) বাদাম, তিল, সূর্যমুখী ও সরিষা, হাওর এলাকায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সরিষা এবং পার্বত্য এলাকায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়ি) সরিষা, তিল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে উফশী বীজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া বর্তমান সরিষার জমিগুলোর প্রায় ৩০% জমিতে টরি-৭, মাঘী, ডুপিসহ অন্যান্য দেশী জাতের আবাদ হচ্ছে এগুলো কে বারি সরিষা ১৪, ১৭ ও ১৮, বিনাসরিষা- ৪, ৯ ও ১১ জাত দ্বারা স্থানীয় জাত প্রতিস্থাপন করার পাশাপাশি সুষম সার (বিশেষ করে বোরন, সালফার) ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি তেলজাতীয় ফসলের জমিতে মৌচাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্ভব।
বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে, মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষিতে এক দুর্বার গতি সঞ্চারিত হয়েছে। যার ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় তিন বছরমেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফলে আগামী তিন বছরে দেশের ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমপক্ষে ৪০% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আসুন আমরা সকল স্তরের জনগণ সরকারের এহেন কার্যক্রমে সহায়তা করার মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে দেশের টাকা দেশেই রাখি, সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।  

লেখক : মনিটরিং অফিসার (অতিরিক্ত উপপরিচালক), তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১১১৮৫২৩২, ই-মেইল : shafiqdae@yahoo.com