Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সোনালি আঁশের রূপালি কাঠি

সোনালি আঁশের রূপালি কাঠি
কৃষিবিদ জান্নাতুল ফেরদৌস
পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল মুখ্য। আমাদের দেশের মতো এত ভালো মানের পাট পৃথিবীর আর কোথাও উৎপন্ন হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একাধিক ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘পাট সম্পদ থেকে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের প্রাপ্য, তা থেকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা আমাদের বঞ্চিত করছে। লড়াই করে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে।’ স্বাধীনতার পর জুট অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে প্রাক্তন জুট অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে পুনর্গঠন করা হয়। পাট দেশি  ও তোষা দু’প্রজাতির হয়ে থাকে। পাট গাছের ছাল থেকে আহরিত আঁশ ‘পাট’ নামে পরিচিত যা বাংলাদেশের সোনালী আঁশ নামে সমাধিক পরিচিত। মনে করা হয় সংস্কৃত শব্দ ‘পট্ট’ থেকে পাট শব্দের উদ্ভব হয়েছে।
আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পাটবস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে মহর আলীর পাটের শাড়ি, হাজার বুটিক পাটের শাড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদিনের সারাজীবনে আগুন পাটের শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাট বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। পাটখড়ি থেকে বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা পারটেক্স আবিষ্কার করেছেন।
পাট উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের অবস্থান শীর্ষে এবং বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৭.২৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদন হয় ৮৪.৩২ লাখ বেল পাট। দেশের প্রায় ৫০ লাখ কৃষক পাট চাষের সঙ্গে জড়িত। দেশে মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩-৪ ভাগ আসে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে । তৈরি পোশাকশিল্পের পরই পাট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট চাষের ফলে পাটের পাতা পচে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈবসার সরবরাহ করে। পাটশাক যেমন মুখরোচক, তেমনি স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। এর মাংসল বৃতি থেকে আচার, জ্যাম, জেলি, জুস, ঠা-া পানীয় তৈরি করা হয়ে থাকে। এছারা চুকুরের পানীয় চা এর মতো পান করা হয়ে থাকে যা বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৭৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপন্ন হয়।
পাট চাষে একদিকে সোনালি আঁশ, অন্যদিকে রূপালি কাঠি দুইয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। পাটকাঠি এত দিন গ্রামে রান্নার কাজে জ্বালানি ও ঘরে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে।
পাটের আঁশ থেকে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, পর্দার কাপড়, গয়না, অলংকারসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য, যা দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পাট পণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। এছাড়া পাট দিয়ে নন্দন ও রুচিশীল ফ্যাশন্যাবল বা সৌন্দর্যমন্ডিত পণ্য, দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী সামগ্রী, নানা প্রকারের হ্যান্ডিক্রাফট, হোম টেক্সটাইল পার্টেক্স বোর্ড ইত্যাদি বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বে গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত  করতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে।
পাট থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ও বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির যে অমিত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, যাতে রূপকথার সোনার কাঠি- রূপোর কাঠি ছোঁয়ার মতো বাস্তব জীবনেও সোনালি আঁশের রূপালি কাঠির ছোঁয়ায় আমাদের দেশ পৌঁছে যাক সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫২৯৯৯১৪৯ ই-মেইল : jannatul@bjri.gov.bd