কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মোঃ মামুন হোসেন
পৃথিবীর যে কোন দেশেই কৃষি পণ্য বা খাদ্যপণ্য রপ্তানির পূর্বতম শর্ত হচ্ছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য হতে হবে। রোগ ও পোকার আক্রমণ থাকবে না বা কম হবে, আর এই সবই নির্ভর করে মাটির স্বাস্থ্যের উপর অর্থাৎ মাটির ব্যবস্থাপনার উপর। মাটি যদি দূষিত থাকে, রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি বেশি, ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি তাহলে সেই মাটির ফসল রপ্তানি করা যায় না। মাটি ভালো না হলে কোন ধরনের সার্টিফিকেশন ও পাওয়া যাবে না, যা রপ্তানিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ফল ও সবজি রপ্তানির যতগুলো পরীক্ষা বা সার্টিফিকেশন দরকার তার প্রত্যেকটাতেই মাটি পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। তাই মাটি যদি ভালো না থাকে তাহলে রপ্তানি প্রায় অসম্ভব।
নদীমাতৃক এবং কৃষিনির্ভর সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি মূলত কৃষি ও মাটি কেন্দ্রিক। মাটিতে বা মাটির নিচে বসবাস করে খুদে প্রাণীদের এক বিশাল জগৎ, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রায় ২৫ শতাংশ। যেখানে মানুষ উদ্ভিদ প্রজাতির সম্পর্কে ৮০ শতাংশ জানতে পেরেছে, সেখানে মাটির অণুজীব সম্পর্কে কেবল ১ শতাংশ জানতে পেরেছে। এই বৈচিত্র্যময় ক্ষুদে প্রাণীরা উদ্ভিদ, ফসল ও আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া সারা পৃথিবীর জীব সমূহের প্রায় ৯০ ভাগই জীবনচক্রের কোন না কোন অংশ মাটিতে অতিবাহিত করে। কৃষি ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ভূমির উপর প্রাকৃতিকভাবে ১ ইঞ্চি পরিমাণ মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫০০-১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মাবার মাধ্যম তা নষ্ট হচ্ছে।
মাটি ছাড়া কৃষি অকল্পণীয় । মাটি দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের আধার। মাটিতে ধারণকৃত পানি উদ্ভিদেরও খাবার, আবার প্রাকৃতিক পানি পরিশোধনেও মাটি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে।
সাস্টেনেবল মাটি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে মাটির অবক্ষয়-এর কারণে ফসলের ফলন ১০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সুরক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। খাদ্য, জ্বালানি, ফাইবার এবং ঔষধি পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি মাটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে- মানবজাতির একক বৃহত্তম বিপদ - জৈব-রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে বায়ুম-লে কার্বন সংরক্ষণ করে এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে।
মাটি আমাদের জীবনধারণের লক্ষ্যে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে খাদ্য এবং বিভিন্ন পরিবেশগত পরিষেবা সরবরাহ করে। অন্যান্য জৈব উপাদানগুলোর মতো মাটিও জীবন্ত সম্পদ, মাটিরও অক্সিজেন, খাদ্য, জলের প্রয়োজন হয় এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে।
আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশ আসে মাটি থেকে। ২০৫০ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খাবার উৎপাদন করা যেতে পারে।
আয়তনে ছোট, ঘনবসতি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশ হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের সোনাফলা উর্বর মাটি এবং কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম। আর তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, চাষের জমির উপযুক্ত ব্যবহার এবং অতিমাত্রায় সার ও কীটনাশকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে ফসলি জমি প্রায় ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর। পৃথিবীর মোট ভূখ-ের প্রায় ১০ শতাংশ জায়গায় ফসল আবাদ হলেও বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার দক্ষতা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। নিবিড় চাষাবাদের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে একেবারে প্রথম সারিতে।
মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, উপকারী অণুজীবের সক্রিয়তা কমে যায়, মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, ফসলের ফলন ও গুণগতমান কমে যায় এবং ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কৃষি বিপ্লবের ডাক কৃষকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি কৃষির উন্নয়নে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষির উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষক দরদি, আর বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কোন জাদুর বলে নয় ,কৃষক দরদি মনবতার মা মাননীয় প্রধানন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে ফসল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এক ইঞ্চি মাটিও যেন কৃষি উৎপাদনের বাইরে না থাকে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এর কারণে বছরে ০.৪ শতাংশ ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। পাহাড়ি অঞ্চলে মৃত্তিকা ক্ষয়ের মাত্রা বেশি তা প্রায় ১২ শতাংশ। আর একটি সমস্যা হচ্ছে ইট ভাটা, এটি বেড়েই চলছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন বা ংঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদেও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে, জলাভূমি সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষি জমিতে ৫ শতাংশ হারে জৈব পদার্থের থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। মাটিতে দূষণ রোধ করতে জনসাধারণের সচেতনতাই হতে পারে টেকসই সমাধান।
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল হচ্ছে মাটি। সুস্থ মাটির একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে মাটির জীববৈচিত্র্য। বিজ্ঞানের ভাষায় মাটির জীববৈচিত্র্য হলো মাটিতে বসবাসকারী উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ জীবসম্ভার এবং সেগুলোর সমন্বয় গঠিত বাস্তুতন্ত্র। মাটিতে বসবাসকারী অসংখ্য অণুজীব, ছত্রাক, প্রটোজোয়া ইত্যাদি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একদিকে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, অন্যদিকে আবাদি জমি কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ফলন ২০-৩০% বৃদ্ধি পাবে।
‘ল্যান্ড কেয়ার অস্ট্রেলিয়া’ মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী অলাভজনক সংগঠন। সরকার, করপোরেট পার্টনার, কৃষক, পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সারা বছর। দান-অনুদানের অর্থের সঙ্গে দেশপ্রেম মিশিয়ে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে মৃত্তিকাকে বাঁচানোর জন্য। ‘গ্লোবাল ল্যান্ড কেয়ার’, ল্যান্ড কেয়ার ইউরোপসহ অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে মৃত্তিকা, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য। আমাদের দেশে মৃত্তিকা, কৃষি, পানি কার্যক্রম নিয়ে সংগঠন ও পলিসি ফোরাম প্রয়োজন।
বাংলার মৃত্তিকার ‘কার্বন ক্রেডিট ভ্যালু’ কত, কেউ কি হিসাব করেছেন? নিবিড় চাষাবাদের ফলে মৃত্তিকা কার্বন হ্রাস পাচ্ছে অব্যাহতভাবে। জৈব পদার্থের আশঙ্কাজনক মাত্রাতেও থেমে নেই নিষ্ঠুর পীড়ন। পুষ্টি ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ‘টপ সয়েল’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। নগরায়ণের আগ্রাসনে এই অমূল্য টপ সয়েল চলে যায় ইটভাটার চিতানলে। ইটভাটার দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় পুষ্টিসমৃদ্ধ উর্বর টপ সয়েল। নির্জীব মাটি অভিশাপ দিয়ে যায় সভ্যতাকে, মানুষকে, মানুষের নির্লিপ্ততাকে। মৃত্তিকা কার্বন সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এখনই।
মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য পৃথিবীজুড়ে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং সবাইকে একসাথে নিয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া হতে প্রাকৃতিক লাঙল কেঁচো ও অন্যান্য পোকামাকড়ের কথা। মাটির সাথে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সম্পর্কিত। তাই আমাদের চিরন্তন স্লোগান হোক ‘মাটি বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও, বাঁচাও সোনার দেশ’। আসুন, আমরা প্রিয় মৃত্তিকা ছুঁয়ে গেয়ে উঠি ‘মোরা মৃত্তিকা ভালোবাসী, মাটির আঁচলে সোনাঝরা রোদে ফসলের সঙ্গে হাসি’।
লেখক : úোস্টহার্ভেস্ট এন্ড কোয়ালিটি এসুরেন্স ¯েপশালিস্ট, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, মোবাইল : ই-মেইল :mamun@hortex.org