Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পিট মৃত্তিকা এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব

পিট মৃত্তিকা এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব
হাছিনা আকতার
পিট হলো আংশিক ক্ষয়প্রাপ্ত গাছপালা বা জৈব পদার্থের জমে থাকা জৈব মৃত্তিকা, যাতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২০ শতাংশের অধিক (২০-৮০%)। এসব জৈব পদার্থ বিভিন্ন মাত্রায় বিয়োজিত অবস্থায় থাকে। সামান্য বিয়োজিত বা অবিয়োজিত অবস্থার জৈব অবক্ষেপকে পিট এবং অধিক বিয়োজিত জৈব অবক্ষেপকে মাক বলা হয়। পিট অবক্ষেপ বিশেষ করে এর উপরের স্তরে সঞ্চিত বিভিন্ন প্রকার গাছপালাকে শনাক্ত করা যায়, কিন্তু মাক মৃত্তিকাতে বিয়োজনের মাত্রা এমন একপর্যায়ে পৌঁছায় যে, বিদ্যমান উৎস গাছপালার অংশগুলোকেও শনাক্ত করা যায় না। অবক্ষেপিত গাছপালার অবশেষের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পিট স্থূল বা সূক্ষ্ম গঠন সংবলিত হতে পারে। অন্যদিকে অতি-বিয়োজিত মাক প্রায়ই সূক্ষ্ম গঠন সংবলিত হয়। এটি প্রাকৃতিক অঞ্চলের জন্য অনন্য, যাকে বলা হয় পিটল্যান্ডস। পিটল্যান্ড ইকোসিস্টেম ৩.৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে এবং এটি গ্রহের সবচেয়ে দক্ষ কার্বন সিঙ্ক, কারণ পিটল্যান্ড গাছপালা প্রাকৃতিকভাবে পিট থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে। বিশ্বব্যাপী  পিট, কার্বন সঞ্চয় করে ৫৫০ গিগাটন পর্যন্ত ; যা সমস্ত মাটির কার্বনের ৪২%, যদিও এই পিট মৃত্তিকা ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ৩% জুড়ে রয়েছে।
উৎস
প্রাথমিকভাবে পিট সমন্বিত মাটি হিস্টোসল নামে পরিচিত। পিটল্যান্ড, বিশেষ করে বোগ ( জলাভূমি যা মৃত উদ্ভিদ সামগ্রীর জমা হিসেবে পিট জমা করে) পিটের প্রাথমিক উৎস। এ ছাড়া, ফেন, পোকোসিন এবং পিট সোয়াম্প ফরেস্টসহ অন্যান্য জলাভূমিও পিট জমা করে। জলাভূমি অবস্থায় পিট তৈরি হয়, যেখানে বন্যা বা স্থির জল বায়ুম-ল থেকে অক্সিজেনের প্রবাহকে বাধা দেয়, পচনের হারকে ধীর করে দেয়।
বাংলাদেশে পিট মৃত্তিকা
 বাংলাদেশে পিট মৃত্তিকার পরিমাণ ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর। এসব মৃত্তিকা গোপালগঞ্জ-খুলনা অঞ্চলের নিচু এলাকাতে পাওয়া যায়। এছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমির কোন কোন হাওর এবং তদসংলগ্ন উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাদদেশীয় সমভূমিতে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন পিট মৃত্তিকা দেখা যায়। এগুলো পাললিক পিট। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পিট মজুতের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে মাদারীপুরের বাঘিয়া ও চান্দা বিল, খুলনা জেলার কোলা মৌজা, মৌলভীবাজার জেলার মৌলভীবাজার ও চাতাল বিল এবং সুনামগঞ্জ জেলার পাগলা ও চোরকাই-এর নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে পিট ক্ষেত্রগুলো ভূপৃষ্ঠে বা এর খুব কাছে বিদ্যমান। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পিট বাদামি থেকে ঘন বাদামি রঙের এবং আঁশময় ও নরম। এটি সংকুচিত হয় এবং শুকালে দৃঢ় ও ভঙ্গুর হয়। সাধারণত মৃত্তিকা পরিলেখের উপরের ৮০ সেন্টিমিটারের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এবং কখনও কখনও একই মৃত্তিকার বিভিন্ন স্তরে জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে। গাঢ় বাদামি মাক এসব মৃত্তিকার সাধারণ উপাদান। বাংলাদেশের কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল- ১৪তে অন্তর্ভুক্ত এলাকাটি শুষ্ক মৌসুমে ভিজা থাকে এবং বর্ষা মৌসুমে গভীরভাবে প্লাবিত হয়। পিট মৃত্তিকা অর্থাৎ কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল-১৪ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বেশ কিছু সংখ্যক স্বতন্ত্র নিচু এলাকা দখল করে আছে। পৃষ্ঠদেশে পিট ও মাকসহ মৃত্তিকাগুলোতে সাধারণত নলখাগড়া জন্মে।
গঠন
পিট কয়লার প্রাথমিক পর্যায় বা জাত। অম্লীয় এবং অবায়বীয় অবস্থায় উদ্ভিদের উপাদান সম্পূর্ণরূপে ক্ষয় না হলে পিট গঠন করে। সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন বিশিষ্ট বদ্ধ পানিতে উদ্ভিদাদির পচনের ফলে এটি গঠিত হয়। জলাভূমি ও আর্দ্রস্থানে বেড়ে ওঠা গাছপালা, গুল্মলতা, শৈবালের আংশিক পচন ও বিয়োজন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন একটি বাদামি অবশেষ। পিটে আর্দ্রতামূলক উপাদান ৭৫ শতাংশের বেশি, কার্বন ৬০% ও অক্সিজেন ৩০% (আর্দ্রতামুক্ত অবস্থায়)। শুষ্ক অবস্থায় এটি অবাধে জ্ব¡লে। এসব মৃত্তিকা চরম অম্লীয় এবং উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান কম থাকে। এতে শনাক্তযোগ্য উদ্ভিজ্জ কণিকা বিদ্যমান থাকলেও খনিজ নেই বললেই চলে। এটি ধীরে ধীরে আর্দ্র পরিস্থিতি তৈরি করে যা জলাভূমির এলাকাকে প্রসারিত করে দেয়।
সাধারণ ব্যবহার
   পিট একবার শুকিয়ে গেলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শিল্প ব্যবহারের জন্য, কোম্পানিগুলো পিট থেকে জল বের করার জন্য চাপ ব্যবহার করতে পারে, যা নরম এবং সহজেই সংকুচিত হয়।
    কৃষকরা গৃহের অভ্যন্তরে শীতকালে গবাদি পশুর মলমূত্র  শোষণ করতে শুকনো পিট ব্যবহার করে। পিটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পাত্রের মাটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখা, যখন এটি শুকিয়ে যায় এবং ভেজা অবস্থায় অতিরিক্ত জল প্রতিরোধ করে। পিট পুষ্টি সঞ্চয় করতে পারে যদিও এটি নিজেই উর্বর নয়।
    পিটল্যান্ড পানীয় জলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন-যুক্তরাজ্যে, জনসংখ্যার ৪৩% পিটল্যান্ড থেকে পানীয় জল গ্রহণ করে, আয়ারল্যান্ডে এই সংখ্যা ৬৮%-এ পৌঁছেছে। ডাবলিনসহ বৃহৎ শহরগুলোর জন্য জলের প্রধান উৎস হলো পিটল্যান্ড সমন্বিত ক্যাচমেন্ট।
    পিট জলাভূমি বন্যা প্রশমনের একটি প্রাকৃতিক উপায় হিসাবে কাজ করে। যে কোনো উপচে পড়া পানি পিট দ্বারা শোষিত হয়।
    পিট কখনও কখনও মিঠা পানির অ্যাকোরিয়াতে ব্যবহৃত হয়। এটি আয়ন বিনিময়কারী হিসাবে কাজ করে। এটিতে এমন পদার্থ রয়েছে ; যা উদ্ভিদের জন্য এবং মাছের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
    ইহা বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা এবং কর্দম মাটির অনুপ্রবেশ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে একে বাগানে এবং টবে ব্যবহার করা হয়। জীবাণু সার তৈরিতে বাহক বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পরিবেশগত সমস্যা
    পিট যদিও কঠোরভাবে ফসিল ফুয়েল নয় তথাপি গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণে ফসিল ফুয়েলের সাথে তুলনাযোগ্য। পিটকে ধীর নবায়নয়োগ্য শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
    পিট একটি প্রধান অগ্নি বিপদের কারণ হতে পারে, কারণ এটি হালকা বৃষ্টি দ্বারা নির্বাপিত হয় না। পিট আগুন দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বলতে পারে, অথবা অক্সিজেনের উৎস উপস্থিত থাকলে শীতের পরে মাটির নিচে ধোঁয়া উঠতে পারে এবং পুনরায় জ্বলতে পারে। এমন অনেকগুলো কারণ রয়েছে ; যা জমির কার্বন সিঙ্ক থেকে ঈঙ২ নির্গমনকে ত্বরান্বিত করে এবং ইহা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
    জমি পরিষ্কার করা যা পিট পৃষ্ঠের উপর সূর্যালোকের পরিমাণ বাড়ায়, যাতে মাটির তাপমাত্রা এবং পচনশীল অণুজীবের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। কচুরিপানা এবং চালের খড় তাজা জৈব পদার্থের প্রাপ্যতা বাড়ায় ; যা সহজেই পচে বায়বীয় অবস্থায় ঈঙ২এবং অবায়বীয় অবস্থায় ঈঐ৪গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি করে।
    পিট নিষ্কাশনের ফলে, জৈব কার্বন-যা হাজার হাজার বছর ধরে গঠিত এবং সাধারণত পানির নিচে থাকে, তা হঠাৎ করে বাতাসের সংস্পর্শে আসে। এটি পচনশীল এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়; যা বায়ুম-লে নির্গত হয়। জৈব জলাভূমি (পিট) মাটির বৃহৎ এলাকা বর্তমানে কৃষি, বনায়ন এবং পিট আহরণের জন্য নিষ্কাশন করা হয়। এটি শুধুমাত্র অনেক প্রজাতির বাসস্থান ধ্বংস করে না বরং জলবায়ু পরিবর্তনকেও ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করে।
    জ্বালানির জন্য শুকনো মৌসুমে পিট পোড়ানোর কারণে ঈঙ২ নির্গমন বৃদ্ধি পায়। সনাতন পদ্ধতিতে মাটির অম্লমান কমাতে, উর্বরতা বাড়াতে, কৃষিকাজ ও অন্যান্য কাজে পোড়ানো হয় ; যা ঈঙ২ নির্গমন বাড়িয়ে দেয়।
    নাইট্রোজেন সারের মতো সার যোগ করলে মাটির ঈ/ঘ অনুপাত কমে যায় এবং অণুজীবের দ্বারা জৈব পদার্থের পচনকে উৎসাহিত করে, এর পরে পরিবেশে ঈঙ২ মুক্ত হয়। নাইট্রোজেন সার ঘ২ঙ গ্যাস নির্গমনেও  অবদান রাখে। মাটির সঙ্গে সার বা অ্যামিলিওরেন্টস (উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিকভাবে মাটির ভৌত অবস্থা পরিবর্তন করা) যোগ করা ; যা পিটের ঢ়ঐ বাড়ায় এবং পরে পিটের পচন ত্বরান্বিত করে।  
পিট মাটির সংশোধন বা ব্যবস্থাপনা
ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় পিট মাটির ব্যাবস্থাপনা খুবই জটিল। তথাপি কিছু পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে পিট মাটির সংশোধন করা যেতে পারে। যেমন:
    যেসব স্থানে পৃষ্ঠ মৃত্তিকা এঁটেল প্রকৃতির সেখানে ব্যাপক আকারে বোরো ধানের চাষ করা যেতে পারে। পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক ও কপারের অলভ্যতাই কৃষিকাজে এসব মৃত্তিকা ব্যবহারের অন্তরায়।
    জোয়ার-ভাটা সংলগ্ন নদী থেকে পলি জমার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে এই মাটি উন্নত করা যেতে পারে। নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রন বা পললদ্বারা ঢেকে দিয়ে মৃত্তিকা সংশোধন করা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।
    মাঝারি উঁচু এবং মাঝারি নিচু জমির একটি প্লটকে কয়েকটি সাব প্লটে বিভক্ত করে দুটি প্লটের মধ্য হতে মাটি তুলে পাশের প্লটে স্থাপন করে প্লটগুলো উঁচু করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় খননকৃত পরিখায় স্থানীয় মাছের চাষ করা যেতে পারে এবং উঁচু প্লটে শাকসবজি,আখ ও ধৈঞ্চা চাষ করা যেতে পারে।
    জিওলাইট ব্যবহার করে। জিওলাইট হচ্ছে ক্ষারীয় প্রকৃতির হাইড্রেটেড ক্রিস্টালাইন এলোমিনোসিলিকেট খনিজ। অষঙ৪ এবং ঝরঙ৪ মিলে টেট্রাহেড্রাল শীট গঠন করে। জিওলাইট (চঐ-৮.৪৪) মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অম্লীয় মাটির চঐ বৃদ্ধি করে। ইহার রয়েছে-উচ্চ আয়ন বিনিময় ক্ষমতা, উচ্চ পানি ধারণক্ষমতা এবং উচ্চ অ্যাডজর্পশন ক্ষমতা। ইহা ঘঐ৪+, ঘঙ৩- এবং ক+ ধরে রাখে, ফলে লিচিং লস কম হয় এবং সার প্রয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
পরিশেষে বলা যায়, পিটল্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন এবং জল সঞ্চয়ক, নিষ্কাশনের কারণে এই কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি উদ্বেগের বিষয়। পিট ফায়ারিং কার্যকলাপ পানির টেবিলের গভীরতা  হ্রাসের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কার্বন নিঃসরণ এখন একটি আলোচিত বিষয়। পিট মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাপী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পিট গঠনের জন্য একে নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃষি জমিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জলাবদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটির ক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়নের জন্য সেডিমেন্টশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৃঢ়ভাবে এই দিকগুলোর উপর গবেষণা, পরামর্শ, প্রযুক্তিগত,  প্রণোদনা এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা পিটল্যান্ড ব্যবহারের সর্বোত্তম সুবিধার জন্য উন্নত করা আবশ্যক।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক গবেষণাগার, গোপালগঞ্জ। মোবাইল : ০১৯১১৬২১৪১৫, ই-মেইল : hasinasrdi@gmail.com