Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বিএলআরআই উদ্ভাবিত মুরগির জাত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ)

বিএলআরআই উদ্ভাবিত মুরগির
জাত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ)
ড. শাকিলা ফারুক১ ড. কামরুন নাহার মনিরা২ মো: রাজিউল ইসলাম৩

সুস্থ, সবল ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষের কোন বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ায় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট মাংসের চাহিদার শতকরা ৪০-৪৫ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য দৈনিক ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করা প্রয়োজন। বর্তমানে মুরগির মাংসের অর্ধেকের বেশি আসে বাণিজ্যিক ব্রয়লার থেকে যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। কিন্তু বৈশি^ক আবহাওয়া ও জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পোল্ট্রি শিল্পের উপর দৃশ্যমান। ফলে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় দেশি আবহাওয়া উপযোগী অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করা জরুরি। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ দেশীয় জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ধারাবাহিক সিলেকশন ও ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশীয় পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী মুরগির এই জাতটির নামকরণ করা হয়েছে বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ)।
 ব্রিডিং (ইৎববফরহম) শুরুর ইতিহাস
বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার যৌথ উদ্যোগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল লাইভস্টক ব্রিডিং সেন্টার, ওকাজাকি জাপান চার (০৪)টি মুরগির বিশুদ্ধ লাইন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) বিনামূল্যে প্রদান করে। সে সময় থেকে এ লাইনগুলো সিলেক্টিভ ব্রিডিং-এর মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ ধারাবাহিক দশ (১০) জেনারেশন পর্যন্ত সিলেকশন ও ব্রিডিং-এর মাধ্যমে বিএলআরআই কর্তৃক উন্নয়নকৃত দেশি জাতের মেইল লাইন এবং দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজিত বিদেশি জাতের ফিমেল লাইন ব্যবহার করে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনশীল মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশীয় পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী মুরগির এই জাতটির নামকরণ করা হয়েছে বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) নামে। বিএলআরআই উদ্ভাবিত মাংস উৎপাদনকারী এই জাতটি পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায় উপযোগী, রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং মাংসের স্বাদ দেশি মুরগির ন্যায়। মাংসের স্বাদ ও পালকের রং দেশি মুরগির ন্যায় মিশ্র বর্ণের হওয়ায় বাজার চাহিদা ও বাজারমূল্যও প্রচলিত সোনালী ও অন্যান্য জাতের ককরেল মুরগির তুলনায় বেশি।
সুবর্ণ প্যারেন্টস মুরগির উৎপাদন ক্ষমতা
পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার কারণে বর্তমানে খোলা শেডে মুরগি পালন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, রোগবালাই এর প্রাদুর্ভাব ও পারিপাশির্^ক অবস্থা বিবেচনা করে জাত নির্বাচন করা উচিত। এ সকল বিষয় বিবেচনা নিয়ে দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজিত ফিমেল লাইন এবং উন্নত দেশি জাতের মেইল লাইন সিলেকশন ও ব্রিডিং-এর মাধ্যমে কৌলিকমান উন্নয়ন করে সুবর্ণ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা আমাদের দেশীয় আবহাওয়ায় সহজেই পালন করা যায়। এই জাতের কৌলিকমান এমনভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে যাতে ক্ষুদ্র খামারি ও বাণিজ্যিক খামারি লাভবান হতে পারে। বিএলআরআই এর গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ে বাণিজ্যিক খামারে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।
সুবর্ণ মুরগির প্যারেন্টসের ফিমেল লাইনের উৎপাদন দক্ষতার তুলনামূলক চিত্র
সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির তুলনামূলক উৎপাদন দক্ষতা
বিএলআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত সুবর্ণ মুরগির সাথে অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির উৎপাদন দক্ষতা তুলনা করা হয় এবং সুবর্ণ মুরগির ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। নি¤েœ সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির তুলনামূলক উৎপাদন দক্ষতা (গড় ওজন, মোট খাদ্যগ্রহণ এবং খাদ্য রূপান্তর হার)।
সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির উৎপাদন দক্ষতার তুলনামূলক চিত্র (০-৫৬ দিন)
আয় ও ব্যয়ের হিসাব
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লক্ষ  শিক্ষিত বেকার রয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোক্তা এতগুলো মানুষের চাকরি দেয়া সম্ভব নয়। তাই এই বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি নিজেদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে বিশেষভাবে কেউ যদি পোল্ট্রি সেক্টরে উদ্যোক্তা হতে চায়, তাহলে তার জন্য বিএলআরআই উদ্ভাবিত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) জাতটি আদর্শ হতে পারে। কেননা এই মুরগি দেশীয় আবহাওয়ায় উদ্ভাবিত হওয়ায় এর রোগবালাই কম, আমাদের দেশের তাপমাত্রার সাথে খাপখাওয়ানো, দেশি মুরগির মতোই এর উৎপাদন খরচ কম এবং মাংস দেশি মুরগির মত স্বাদ যুক্ত হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া মানুয়ের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন পোল্ট্রি থেকে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী যেমন- চিকেন গ্রিল, চিকেন নাগেট, চিকেন বল, চিকেন সুপ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করছে। এভাবে একদিকে যেমন বেকার যুবকদের বেকারত্ব দূর হচ্ছে, অন্যদিকে নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্য বেকার যুবকদের এসব পোল্ট্রি খামারে কাজের সুযোগ হচ্ছে। বিএলআরআই-এ পরিচালিত গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, আট সপ্তাহ পর্যন্ত ১০০০টি সুবর্ণ জাতের মুরগি এক ব্যাচ লালন-পালন করে বাজার মূল্যভেদে প্রায় ৪৫-৬০ হাজার টাকা তথা বছরে অন্তত ৪টি ব্যাচ পালন করলে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।
পরিবেশের উপর প্রভাব
বৈশি^ক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বিশে^র ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব কমবেশি সব খাতের উপরই দৃশ্যমান। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় পোল্ট্রি প্রজাতি পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যদিকে দেশের ব্রয়লার-লেয়ারের সব জাতের প্যারেন্টস বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে মুরগির কাক্সিক্ষত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই দিক বিবেচনা করে বিএলআরআই উদ্ভাবিত মাংস উৎপাদনকারী জাত বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী এবং উৎপাদনের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। তাছাড়া, খামারের বিষ্ঠা দিয়ে বায়োগ্যাস করা যেতে পারে এবং বায়োগ্যাসের উপজাত জৈবসার হিসেবে বিভিন্ন ফসল, খাদ্যশস্য ও ঘাস উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নতুন উদ্ভাবিত মাংসল জাতের মুরগি (সুবর্ণ) খামারি পর্যায়ে সম্প্রসারণ সঠিকভাবে করতে পারলে একদিকে স্বল্পমূল্যে প্রান্তিক খামারিগণ অধিক মাংস উপাদনকারী জাতের বাচ্চা পাবেন, অন্যদিকে আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। উদ্ভাবিত এ জাতটি দেশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষসহ অন্যান্য পুষ্টির চাহিদা পূরণে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (রুঃ দাঃ) ও বিভাগীয় প্রধান, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২২০৫২২৩ ই-মেইল : shakila_bari@yahoo.com