Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আমের সংগ্রহত্তোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মাননিয়ন্ত্রণ

আমের সংগ্রহত্তোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মাননিয়ন্ত্রণ
কৃষিবিদ খোন্দকার মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
আম ক্লাইমেক্টেরিক জাতীয় ফল সংগ্রহত্তোর অবস্থায় শারীরবৃত্তীয় ও গুণগত কার্যক্রম চলমান থাকা বৈশিষ্ঠ্যের জন্য দ্রুত পচনশীল হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে আমের চাহিদা প্রচুর। আম সংগ্রহ করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারজাতকরণ বা ব্যবহৃত না হলে দ্রুত পেকে যাওয়া, গুণগত মানের অবনতি হয় এবং গন্ধ ও স্বাদসহ পুরো ফলটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া গ্রীষ্মম-লীয় ফল হওয়ায় নিম্ন তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ করলে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় রোগ এবং আমের খোসায় ঠা-াজনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়, পরবর্তীতে যা শাঁসেও ছড়ায় এবং পচন ধরে আম খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যায়।  
নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় সংগৃহীত পরিপক্ব আম দ্রুত পাকে এবং খুব কম সময়ে নষ্ট হয়ে যায় বা অনুজীবের দ্বারা রোগে আক্রান্ত হয়। অনুজীবের সংক্রমণ দ্রুত পাকা আমের নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ এবং সংগ্রহ স্থান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন ও সরবরাহ সীমিত করার জন্য দায়ী।
সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনায় আমের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের প্রভাবকসমূহ
পরিপক্বতা : ফল হিসেবে আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময়ে আকৃতি, দৃঢ়তা ও রং এর ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, যখন উদ্বায়ী যৌগগুলো কিছু ক্ষেত্রে আবদ্ধ ও কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত হয়। শর্করাসমূহ এবং ফলের রং আমের পরিপক্বতার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য সূচক হিসেবে কাজ করে। আম ফলের পরিপক্বতা ছয়টি পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।
পর্যায়-১ (অপরিপক্ব) বোঁটার কাছে সরু, খোসা বা ত্বক খসখসে ও রুক্ষ ও শক্ত; পর্যায়-২ (অকালপক্ব) বোঁটার কাছে ফলের উপরের অংশ সরু, কিন্তু পর্যায়-১ এর তুলনায় ত্বক কিছুটা অসমতল কিন্তু শক্ত; পর্যায়-৩ (আগাম পরিপক্ব) বোঁটার কাছে ফলের উপরের অংশ ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে সমতল, মসৃণ ত্বক ও ফলের নীচের দিক সামান্য বাঁকা; পর্যায়-৪ (কাঙ্খিত পরিপক্ব) ফলের গঠন উপরে-নিচে সম্পূর্ণ, নিচের দিকে (নাকের অংশ) সম্পূর্ণ ও ত্বক সামান্য মসৃণ; পর্যায়-৫(পরিপক্ব) ফল পাকার পর্যায়ে উপনীত তবে প্যাকিং এর জন্য বেশি পাকা, ফল সম্পূর্ণরূপে গঠিত, রং; পর্যায়-৫(অতি পরিপক্ব) : ফল সম্পূর্ণ পাকা, রং গাঢ়, শাঁস নরম, বোঁটার কাছে পচন শুরু হয়।
সাধারণভাবে, আম পাকা এবং আমের গুণগত মান নির্ভর করে আমের পরিপক্বতা পর্যায়ের উপর এবং এজন্য আমের  সংগ্রহকালের প্রভাব ব্যাপক। বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে যেখানে সংরক্ষণ, পরিবহন ও আমের জীবনকাল জড়িত সেখানে সবুজ অবস্থায় পরিপক্ব পর্যায়ে ফল সংগ্রহ করা উচিত, যখন আম শারীরবৃত্তীয়ভাবে পুষ্ট এবং ক্লাইমেকট্রিক পর্যায় শুরুর আগের ধাপে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি আমের পরিপক্বতা ও গুণগতমান নির্ণয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্পেকট্রোস্কোপি বা ইনফ্রারেড এর কাছাকাছি আলো ব্যবহার করে এবং ইলেক্ট্রনিক নোজ ব্যবহার করে উদ্বায়ী ও গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি দ্বারা আমের পরিপক্বতা নির্ণয় করা হয়।
ফলের পুষ্টি ও স্বাদ : আমে আমিষ, শর্করা, খনিজ ও ভিটামিনসহ প্রায় সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। আমে প্রতি ১০০ গ্রামে (শাঁসে) ৭৬৫ আন্তর্জাতিক একক ভিটামিন এ থাকে, যা এ সময়ের অন্য ফলের চেয়ে অনেক বেশি। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত উপকারী। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আমের শাঁসে ২৭.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন এ ও সি উভয়ই অ্যান্টি অ্যক্সিডেন্ট হিসেবে শরীরের মুক্ত যৌগগুলোর (ফ্রি র‌্যাডিকেল) কার্যক্রম প্রতিরোধ করে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
যে কোন ফলের স্বাদ শর্করা ও ফলের মধ্যকার অম্ল বা  এসিডের সাথে সম্পর্কিত। আমের প্রধান দ্রবণীয় শর্করার মধ্যে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ এবং সুক্রোজ। আম পাকার পর্যায়ে ফ্রুকটোজ ও গ্লুকোজের চেয়ে সুক্রোজ বেশি কার্যকর থাকে। অন্যদিকে, অপরিপক্ব আমে প্রচুর জৈব এসিড বিশেষত সাইট্রিক এসিড উপস্থিত থাকে। আম পাকার প্রাথমিক পর্যায়ে যখন অ্যালানিন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন এই সাইট্রিক এসিড এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আবার যখন আম ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় কিংবা নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়, তখন আমের মধ্যকার দ্রবণীয় কঠিন পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও বিভিন্ন এসিডের পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তাই, আমের মধ্যকার শুষ্ক পদার্থ ও শর্করার সাথে আমের গুণগতমানের বিশেষ সম্পর্কের জন্য ভোজ্য অংশ বা শাঁসের স্বাদে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।  
ফলের দৃঢ়তা : আম যতই পাকার পর্যায়ে যায় ততই তার দৃঢ়তা হারায়, যা ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। কখনো কখনো এই দৃঢ়তা ফলের সংরক্ষণকালীন সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে ফলের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য অনেক উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি বা কৌশল ব্যবহার করা হয়। সাধারণভাবে পেনেট্রোমিটার ব্যবহার করে আমের শাঁস ও আঁটির দৃঢ়তা পরিমাপ করা হয়। এতে কাঁচা বা অপরিপক্ক (বেশি শক্ত), আধা পাকা বা পরিপক্ব (কম শক্ত) এবং কাঙ্খিত পরিপক্ব বা পাকা (নরম) আমের দৃঢ়তা বুঝা যায়। অর্থাৎ আম কৃত্রিমভাবে পাকানো হলে, এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করলে তা জানা যেতে পারে। ঔধৎরসড়ঢ়ধং এবং করঃঃযধবিব (২০০৭) সঠিকভাবে ফলের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য একটি দ্রুত কার্যকর পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন, যা আমের কোষ প্রাচিরের কাঠামোর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কম তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ দৃঢ়তা বজায় রাখার জন্য উপকারী। অন্য একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১৪ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস (বি. দ্র. : ক্ক দিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সামান্য কম বা বেশি তাপমাত্রা বুঝায়) তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা পাকা আম সংরক্ষণের ১৪ দিন পরে দ্রুত দৃঢ়তা হারিয়ে নরম হয়ে যায়। আবার, অন্য আরেকটি পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্ক৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা আমের দৃঢ়তা, একই সংরক্ষণ সময়ে ১৪ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেশি অনুকূল অর্থাৎ আমের দৃঢ়তা বেশি থাকে।
শ^সন ও ইথিলিন : আমে সাধারণত উচ্চ হারে শ^সন হয় এবং ফল পাকার সময় ইথিলিন নিঃসরণ করে। এর ফলে আমের সংরক্ষণকালীন সময় কমে যায়। আম সংগ্রহ করার পরপরই শ্বসনের মাত্রা বেড়ে যায়। যদি আমে সামান্য আঘাতও লাগে বা ক্ষত সৃষ্টি হয় তাহলে শ্বসনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। একটি পরীক্ষায় সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস). ১৭ দিনের আম সংরক্ষণকালে ইথিলিনের উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হসড়ষ/শম/য সর্বোচ্চ দেখা গেছে। ঝেং ও অন্যরা (২০০৭) আরেকটি পরীক্ষায় দেখতে পান যে, সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস) ১০ মিনিটের জন্য ৫ মিমি অক্সালিক এসিড দ্রবণে ডুবিয়ে রাখলে ইথিলিন উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে অক্সালিক এসিড প্রয়োগ করে আমের অভ্যন্তরস্থ ইথিলিন উৎপাদন কমিয়ে রাখা যায়। এতে আম পাকতে সময় নেয় বা দেরি হয়। আবার (১৩ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় হিমাগারে রাখা আমের অভ্যন্তরস্থ বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয় যায় বলে ইথিলিন উৎপাদন হার কমে গিয়ে আমের পাকার সময় কিছুটা দীর্ঘ হয়। তাই, বাংলাদেশে হিমাগারে আম সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে পরিপক্ব আম সংগ্রহ, বাছাই, মোড়কীকরণ ও পরিবহন এবং হিমাগারের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সংগ্রহ থেকে শুরু করে হিমাগারে রাখা এবং পরবর্তীতে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে তাপমাত্রাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না বলে দীর্ঘদিন আম সংরক্ষণ সম্ভব হয় না।  
ঠা-াজনিত ক্ষত : আম নিম্ন তাপমাত্রার প্রতি অতি সংবেদনশীল। ৭-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় আমের ত্বক এবং পরবর্তীতে শাঁস সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা পরিপক্বতা, জাতের ভিন্নতা ও সময়কালের উপর নির্ভর করে। ঠা-াজনিত ক্ষতের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে খোসায় গর্ত হওয়া, অসমানভাবে পাকা, কটু গন্ধ হওয়া এবং খোসা ও শাঁস পঁচে যাওয়া। তাই, আমের দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য ঠা-াজনিত ক্ষতই প্রধান সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৫ক্ক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ করা হলে ৩ সপ্তাহ পরে আমে ঠা-াজনিত ক্ষত দেখা দেয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ঠা-াজনিত ক্ষত সম্ভবত ফলের ত্বকের কোষ প্রাচিরের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটায়। তাই হিমাগারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ৩ সপ্তাহের বেশি সময়ের পরে পরিপক্ব আম সংরক্ষণ সম্ভব হয় না।
ফল পচা  : আম ফল পচনশীল, বিশেষ করে পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করলে, ফলে কোন আঘাত লেগে ক্ষত সৃষ্টি হলে বা ত্বক ফেটে গেলে, নিম্ন তাপমাত্রায় ঠা-াজনিত ক্ষত হলে বা ফলে ব্যাকটেরিয়াজনিত কালো দাগ (ব্ল্যাক স্পট) বা ছত্রাকজনিত (অ্যানথ্রাকনোজ) রোগের সংক্রমণ হয়। পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি থাকলে আম ফলের শ^সন হার বেড়ে যায়। এতে আমে পচন ধরে ও পুরো ফলই পচে যেতে পারে। আম সংগ্রহকালে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে, যা সংরক্ষণকালে বা পরিবহনকালে আমে পচন ধরায় এ কারণে আমের বাজার মূল্য কমিয়ে দেয়।
সংগ্রহত্তোর সতর্কতা : আম সংগ্রহ করার পরে সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া করা উচিত। সংগ্রহ পরবর্তী বাছাই, পরিষ্কারকরণ ও মোড়কীকরণ আমের জীবনকাল বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাগুলো সম্পন্ন না হলে ফলের ওজন কমে যাওয়া, ত্বকের রং গাঢ় হওয়া, শাঁসের রং বাদামি হওয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ ত্বরান্বিত হয়। এজন্য সাবধানে ডাল থেকে বোঁটাসহ আম সংগ্রহ করা উচিত। আম মাটিতে পড়ে যেন ফেটে না যায়, বোঁটা ভেঙ্গে কষ বের না হয়, কোনভাবেই যেন আমের কষ ত্বক বা খোসায় না লাগে সেসব বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সংগ্রহ করার পর বোঁটা ভেঙে আমগুলোকে ৪-৫ ঘণ্টা উপুর করে রাখলে কষ ঝরে যায় এবং আমের খোসায় লাগে না। এরপর আমের আকার ও রংয়ের ভিত্তিতে বাছাই করে শ্রেণিকরণ ও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্লাস্টিক ক্রেট বা ফাইবার বোর্ডের বাক্সে নরম কাগজে মোড়কীকরণ করে পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করতে হয়।         
গরম পানিতে শোধন : ৫৫-৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে কাক্সিক্ষত পরিপক্ব আম ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে আমের শ^সন বাধাগ্রস্ত ও অভ্যন্তরস্থ বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার কারণে আম পাকার সময় ১০-১৪ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা যায়। জামব্রানো ও ম্যাটেরানো ১৯৯৮ সালে এক পরীক্ষায় দেখেন যে, পরিপক্ব আম ৩৮ বা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে সংরক্ষণ করলে ঠা-াজনিত ক্ষত থেকে আম রক্ষা পায়। আবার ম্যাককোলাম ও অন্যরাও ১৯৯৩ সালে প্রায় একই রকম একটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখেছিলেন যে, ৩৮ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে ৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে আম ১১ দিন পর্যন্ত ঠা-াজনিত ক্ষতের লক্ষণ ছাড়াই সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সংরক্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে কম বলে মনে করা হয়। হাঁড়িভাঙ্গাসহ অন্যান্য জাতের আম পুষ্ট বা পরিপক্ব হওয়ার শুরুতেই ৫৫-৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখার পর তুলে শুকিয়ে ১০-১২ দিন পর্যন্ত সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়, এতে রোগ ও পোকার আক্রমণও হয় না। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দীর্ঘদিন হিমাগারে আম সংরক্ষণের সময়কাল নির্ধারণে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
অতিবেগুনি রশ্মির ব্যবহার : অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ ব্যবহার করে ছত্রাক ও ব্যকটেরিয়ার উপর সরাসরি রোগজীবাণু প্রতিরোধি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেক ফলের বিশেষ করে আমে জীবনকাল বা শেল্ফ লাইফ বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি আম ফলের উপর অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ রশ্মি প্রয়োগে আমের অভ্যন্তরস্থ এনজাইমগুলোর কার্যক্ষমতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি এবং জীবনকাল দীর্ঘায়িত করে। অনুরূপ আরেকটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, আম সংরক্ষণের ১০ মিনিট আগে অতিবেগুনি রশ্মির প্রয়োগ আমের পচন কমানোর কার্যকর পদ্ধতি এবং গুণগত মান রক্ষার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। উপরন্তু, অতিবেগুনি রশ্মির প্রয়োগ টাটকা আমের সকল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা উন্নয়নেও একটি উত্তম কৌশল বলে বিবেচিত।
নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ : সংগ্রহ পরবর্তী আমের মধ্যকার শারীরবৃত্তীয় বিপাক প্রক্রিয়া ধীর করতে, গুণগত মান বজায় রাখতে, পচন কমাতে এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে নিম্ন তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আম সংরক্ষণ বেশ কার্যকর পদ্ধতি। ঠা-াজনিত ক্ষত এড়িয়ে আমের জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রাখা ও কার্বেন্ডাজিম জাতীয় যেকোন ছত্রাকনাশকযুক্ত পানিতে আম শোধন করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে ফল দেরিতে পাকে ও রোগযুক্ত আমের জীবনকাল দীর্ঘায়িত হয়।   
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আম সংরক্ষণ
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংরক্ষণের শর্ত হলো-অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড এর ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা অনুপাত নিয়ন্ত্রণ। আম সংরক্ষণে তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড এবং আমের ভিন্ন ভিন্ন জাতের উপর এগুলোর প্রভাব নিয়ে বিভিন্নভাবে গবেষণা চলমান রয়েছে। সেসব গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে, ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ বা ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত এবং অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড-এর ঘনত্বের উপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ ৩৮দিন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন জাতের আম সংরক্ষণ করা সম্ভব। আসলে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ আমের ছত্রাকজনিত পচনের বিস্তার রোধ বা সীমিত করে, গুণগত মান বজায় রাখে (রং উজ্জ্বল করে, সুস্বাদু করে, মোট দ্রবণীয় কঠিন পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়) এবং সংগ্রহ পরবর্তী জীবনকাল বৃদ্ধিতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালে একটি পরীক্ষায় দেখেছেন যে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে (৩% অক্সিজেন+৯৭% নাইট্রোজেন) বা ৩% অক্সিজেন+১০% কার্বনডাই অক্সাইড+৮৭% নাইট্রোজেন) আম পাকার সময় দেরি করিয়ে দেয় এবং আমের গুণগত মান উন্নত করে।
আম সংরক্ষণে জীবনকাল বৃদ্ধি এবং সুগন্ধ, স্বাদ ও গঠন পরিবর্তন রোধে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ অক্সালিক এসিড, স্যালিসাইলিক এসিড বা ভোজ্য আবরণের প্রলেপ গুণগতমান নিশ্চিতের পাশাপাশি শ^সন ও রোগজীবাণুজনিত পচন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে বিশেষভাবে কার্যকর বলে বর্তমান সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।  
সম্প্রতি আম পাকার সাথে সম্পর্কিত জিন (ঢ়ঞঐগঋ ও ঊঞজ-১) নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেখা গেছে যে, আম পাকার সময় শাঁসে (মেসোকার্পে) এদের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার আমের কোষে ক্ষত সৃষ্টি হলে গঊঞজ১ সজঘঅ  জিনদ্বয়-এর মাত্রা ক্ষণস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ এইসব জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে আম পাকার সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে। তাই এগুলোর কার্যকারিতা ও ফলাফল আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমের জীবনকাল বা সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির জন্য জেনেটিক রূপান্তরে কাজে লাগালে ভবিষ্যতে আম শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ, সংযুক্তঃ সরেজমিন উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৮১৮৭১৯৪৫৩, ই-মেইল : সংনধযঁষ৬৫@মসধরষ.পড়স