Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বাংলাদেশে অর্কিড চাষাবাদের সফলতা

বাংলাদেশে অর্কিড চাষাবাদের সফলতা
তাহসীন তাবাসসুম
প্রতিনিয়ত দেশে অর্কিড জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে বাড়ছে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও। এটির চাষ বাড়িয়ে যেমন কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। তেমনি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে অনেকেই অর্কিড চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধি, ঔষধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অর্কিডের জনপ্রিয়তা এখন বাড়ছে।
চাষাবাদের উপর ভিত্তি করে অর্কিড প্রধানত দুই প্রকার। 
পার্থিব বা ঞবৎৎবংঃৎরধষ : যা অন্যান্য ফুলের মতো মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে যেমন- ফায়াস, সিমবিডিয়াম, লেডি স্লিপার ইতাাদি।
আর এক প্রকার হচ্ছে পরাশ্রয়ী বা ঊঢ়রঢ়যুঃরপ : যা অন্য কোন গাছের শাখা বা কা-ের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে ও বাতাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে যেমন- ডেনড্রোবিয়াম, ভ্যান্ডা, এরিডিস ইতাাদি।
পার্থিব অর্কিডের ক্ষেত্রে টব, গামলা বা ঝুলন্ত বাস্কেটে চাষ করা যায়। ভেতরের তলদেশে কয়লা, খোয়া অথবা ঝামার টুকরা স্থাপন করতে হয় এবং এর উপরে নারিকেলের ছোবড়ার টুকরা ছড়িয়ে দিয়ে প্রয়োজন মতো পানি সেচ দিতে হয়। 
পরাশ্রয়ী অর্কিড বিশেষ ধরনের কাঠের বা মাটির টব অথবা বাঁশের ঝুড়িতে চাষ করা যায়। মরা কাঠের ওপর জন্মানোর ক্ষেত্রে আম, জারুল বা কড়ই গাছে রশি দিয়ে সঙ্গে নারিকেলের ছোবড়াসহ বেঁধে দেয়া যেতে পারে। 
অর্কিড ছায়াযুক্ত সুনিষ্কাশিত কিন্তু স্যাঁতসেঁতে জমিতে চাষ করা যায়। প্রখর সূর্যের আলোতে এ ফুল ভালো হয় না। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য জমিতে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয়, যেন ৪০-৬০% সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। গাছের ফুল কাটার পর প্রতিটি গাছ থেকে পার্শ্বীয়ভাবে সাকার বের হয়। এই সাকারগুলো গাছে লাগানো অবস্থায় যখন শেকড় বের হয়, তখনই গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মূল জমিতে লাগানো যেতে পারে। বিভাজন প্রক্রিয়ায় গাছ থেকে সাকার সংগ্রহ করে অথবা টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারা তৈরি করে জমিতে লাগাতে হয়। সাকারগুলো লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হয়, যাতে এগুলো মাটিতে লেগে যায়। পরবর্তীতে আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে সেচ দিতে হবে। অর্কিডের চারদিকে বাতাস সব সময় আর্দ্র রাখতে হয়। 
অর্কিড গাছে সার দেবার ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ টন গোবর/কম্পোস্ট, ৩ টন কোকোব্লক, ১৭৫ কেজি টিএসপি এবং ১৫০ কেজি এমওপি সার মাটিতে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ২১০ কেজি ইউরিয়াকে সমান তিন ভাগ করে গাছ রোপণের ৩০-৪৫ দিন পর প্রথম ভাগ এবং ৬০-৭৫ দিন পরে দ্বিতীয় ভাগ এবং শেষ ভাগ স্পাইক আসার পূর্বে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া অর্কিড গাছের নিয়মিত ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সমৃদ্ধ ২০: ২০:২০ অনুপাতে মিশ্র সার প্রয়োগ বেশ উপযোগী। ১ গ্রাম সার ১ লি. পানির সাথে মিশিয়ে খুব সকালে গাছের পাতা, ডগা ও শিকড়ে স্প্রে করতে হয়। 
সারা বছর জাতভেদে অর্কিডের ফুল ফোটে তবে দেশীয় অর্কিড মার্চ-মে মাসে সর্বাধিক পাওয়া যায়। কিছু কিছু ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড বছরে ২-৩ বার ফোটে। প্রতি হেক্টরে প্রথম বছর ৮ হাজার স্টিক, দ্বিতীয় বছর ১৫ হাজার স্টিক এবং তৃতীয় বছর ২৫ হাজার স্টিক পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রতি বছর গাছ থেকে চারা রেখে ২-৫টি সাকার সংগ্রহ করা যায়। ফুলের স্থায়িত্বকাল বাড়ানোর জন্য ২-৩% সুক্রোজ কার্যকরী। বৃষ্টির সময় অথবা ভেজা অবস্থায় ফুল চয়ন করা উচিত নয়। ফুল সংগ্রহের পর পরই এর ডাটার গোড়া পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ফুল বেশি দিন সতেজ থাকে। 
ফুলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এটি এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য পণ্য যার মূল্য হাজার হাজার কোটি ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল উৎপাদিত হয়। বিশ্বে অর্কিডের ৩০ হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। সবুজে ভরপুর আমাদের এ উষ্ণম-লীয় দেশে প্রায় ৮০টির অধিক অর্কিড প্রজাতি রয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে কয়েক হাজার কোটি ডলারের অর্কিড বাণিজ্য হয়। এর  বেশির ভাগই করে থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ড প্রতি বছর ৫০টি দেশে ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের অর্কিড রপ্তানি করে। এছাড়াও হল্যান্ড ভারত, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুরও অর্কিড ফুল রপ্তানিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অনসিডিয়াম, মোকারা, ভ্যান্ডা, ক্যাটেলিয়া, এরিডিস নামে বিভিন্ন অর্কিড প্রজাতির চাষ হচ্ছে। এ দেশের আবহাওয়াও অর্কিড চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী (িি.িধরং.মড়া.নফ)। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী অর্কিডের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। উদহারণস্বরূপ : ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুলমা। এই গ্রামটিতে দীপ্ত অর্কিড লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান রীতিমতো বিশাল এলাকাজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন করছে। এমনকি এই বাগানে অর্কিডের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য একটি গবেষণাগারও আছে। সেখানে প্রতি বছর এক লাখ চারা উৎপাদন করা হয়। ফুল ও চারা বিক্রি করে প্রতি বিঘায় মুনাফা হয় গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি। এই প্রতিষ্ঠানটি দুলমা গ্রামে ১২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন করছে। প্রতি বছর ৪০-৫০ লাখ টাকার অর্কিডের চারা ও ফুল বিক্রি করেন তারা। এ বাগানের অর্কিডের ক্রেতা মূলত রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজারেও নিয়মিত ফুল ও চারার চালান যায়। (যুগান্তর নিউজ- ৪ এপ্রিল,২০১৯)।
প্রতি সপ্তাহে দুবার রাজধানীতে অর্কিডের চালান আসে। প্রতি চালানে গড়ে ৫ হাজার অর্কিড ফুল এবং ৫০টির মতো চারাগাছ কেনেন পাইকারেরা। প্রতিটি ফুলের দাম বাগান পর্যায়ে ২০ টাকা এবং গাছের দাম জাতভেদে ৩০০-৫০০ টাকা। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪০-৫০ হাজার টাকার অর্কিড চারাগাছ ও ফুল রাজধানী ঢাকাতেই আসে।
দীপ্ত অর্কিড লিমিটেডের গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ শরীফ উদ্দিন আহমেদ জানান, দিন দিন অর্কিডের চাহিদা বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করতে পারলে এ ব্যবসা বেশ লাভজনক। তিনি আরো বলেন, প্রথম বছরে একটি চারায় দুটি করে ফুল ফোটে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম বছরে ফোটে চারটি করে ফুল। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ফুল ফোটানো সম্ভব হবে। প্রতিটি ফুলের মূল্য ২০ টাকা ধরলে পাঁচ বছরে মোট আয় হবে ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর পাঁচ বছরে নিট মুনাফা হবে ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া বছরে মুনাফা পাওয়া যাবে ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ঠিক একইভাবে পাহাড়েও অর্কিড চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে অর্কিড চাষ করা গেলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এছাড়া বিদেশে অর্কিড রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব হবে। 

লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭২০২৫২৭৬৫, ই-মেইল : ংঁনযধঃযধংযরহ@মসধরষ.পড়স