Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি

অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি
মো: আনোয়ারুল হক
আলু বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম একটি সবজি ফসল। ভাতের পর দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। বর্তমানে অন্য যে কোন শস্যের চেয়ে আলুর ফলন অনেক বেশি হয়। বাংলাদেশে এখন কম বেশি ৪০টি জাতের আলুর চাষাবাদ হচ্ছে। ১৯৯৫-১৯৯৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। ১৯৮০ সালে আলু উৎপাদন হতো মাত্র ৯ লক্ষ মে. টন। অথচ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪.৬৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১১০.০০ লক্ষ মে. টন আলু উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে রপ্তানি করা হয় মাত্র ৮৪,২৪৩ মে. টন। সারা বছরে ভোগ চাহিদা ৭৭ লক্ষ মে. টন। চাহিদার তুলনায় দেশে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ প্রায় ৩০-৩৫ লক্ষ মে. টন। কিন্তু সারাদেশে মোট উৎপাদনের বিপরীতে ৩৯৪টি হিমাগারের সংরক্ষণ সুবিধার পরিমাণ মাত্র ৩১.৫৮ লক্ষ মে. টন।  
কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আলুর অধিক উৎপাদন হলেও কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসানের গ্লানি। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি, হিমাগারে সংরক্ষণের উচ্চ-ব্যয়, বসতবাড়িতে রাখার জায়গার অভাব এবং নগদ অর্থের প্রয়োজনে আলু চাষিরা ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতি বছর কম মূল্যে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়। উল্লিখিত মজুদ ও রপ্তানির তথ্য হতে এটি স্পষ্ট যে, অবশিষ্ট প্রায় ৮১.৯৬ লক্ষ মে.টন এর অধিক আলু কৃষক নিজ বাড়িতে যেনতেনভাবে সংরক্ষণ করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চকি, মাটি, বস্তা বা ঘরের আনাচে কানাচে মার্চ হতে জুন পর্যন্ত স্তূপ করে রাখে। ফলে ইঁদুর, পোকা মাকরের আক্রমণ ও ওজন হ্রাসসহ প্রায় ১৫-২০% সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হয়।  
প্রতি কেজি আলুর হিমাগারে সংরক্ষণ বাবদ ব্যয় ৬.০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। হিমাগার ভাড়ার সাথে পরিবহন, বস্তা ক্রয়, লোডিং, আনলোডিং ও ওজন বাবদ অতিরিক্ত ৪.০০ টাকা খরচ হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় (৬+৪)= ১০.০০ টাকা। বর্তমানে আলুর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ১০.০০ টাকা। এছাড়া হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য চাষিদেরকে যে ঋণ দেওয়া হয় তার সুদও পরিশোধ করতে হয়। ফলে আলুচাষিদের ন্যূনতম প্রতি কেজি আলু ২৫.০০-৩০.০০ টাকা বিক্রয় না করলে কোনভাবেই লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।  
এ অবস্থার উত্তরণের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে “আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন” প্রকল্পের মাধ্যমে অধিক আলু উৎপাদনকারী ১৬টি জেলায় বসতবাড়িতে স্বল্প খরচে ৪৫০টি অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণপূর্বক অনুরূপ ঘর নির্মাণে উদ্বুদ্ধকরণ, আলু সংরক্ষণ কৌশল পদর্শন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অহিমায়িত পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ ইতোমধ্যে আলু চাষিদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।  
বসতবাড়ির উঁচু, খোলা ও আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে দেশীয় প্রযুক্তিতে বাঁশ, কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার দ্বারা (২৫′দ্ধ১৫′) ফুট সাইজের আলু সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ করে আলু সংরক্ষণ করা যায় ফেব্রুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত। আলু সংরক্ষণের জন্য স্বাভাবিক তাপমাত্রা আংশিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রঙিন ঢেউটিনের ছাউনির নিচে ককশিট মডেল ঘরে ব্যবহার করতে হবে। মাটি থেকে ২.০ ফুট উঁচুতে বাঁশ দিয়ে তৈরিকৃত মাচা ৫৪টি ১০ ইঞ্চি ইটের পিলারের উপরে স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আলু সংরক্ষণের সময় মডেল ঘরের মাঝ বরাবর ০৫ ফুট পর পর একটি করে বাশের গ্যাসপাইপ স্থাপন করতে হবে। মডেল ঘরে আরও অধিক পরিমাণে বাতাস চলাচল করার জন্য বিশেষ কারিগর দ্বারা নির্মিত বাঁশের উন্নতমানের দৃষ্টিনন্দন বেড়া দিতে হবে। কৃষক খুব সহজে যেন ঘরে আলু সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্য বিশেষ সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মডেল ঘরটি ৩০ মে. টন ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট হওয়ায় এর মূল অবকাঠামো যাতে ১৫-২০ বছর পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকে সেই বিবেচনায় সিমেন্টের পিলারের সংখ্যা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।
মডেল ঘরে চাষিরা আলু সংরক্ষণের পরবর্তী সময়ে (অফসিজনে) মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, ভুট্টার আস্ত মোচা, পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ করতে পারবে। আলু উত্তোলনের পর এবং হিমাগারে মজুদকৃত আলু খালাসের মধ্যবর্তী (ফেব্রুয়ারি/মার্চ-মে/জুন) স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ না করে বসতবাড়িতে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করলে কৃষক উত্তোলন মৌসুম অপেক্ষা অধিক ম্ল্যূ প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।
মডেল ঘর নির্মাণ ও আলু সংরক্ষণে সতর্কতা : বসতবাড়িতে সুবিধাজনক উঁচু ও খোলা এবং আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে ঘরটি নির্মাণ করতে হবে যেখানে কোনরূপ স্যাঁতসে্যঁতে ভাব না থাকে; পর্যাপ্ত বতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে; উত্তোলনকৃত আলু সঠিকভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে কাটা, ফাটা, অপরিপক্ব, রোগযুক্ত ও ছাল ওঠা আলু না থাকে; সূর্যের অধিক তাপ ও বৃষ্টির পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে; আলু সংরক্ষণের ৩ (তিন) দিন পূর্বে পোকা মাকড় ও সুতলি পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হবে; মডেল ঘর নির্মাণের পূর্বে উক্ত স্থানে ন্যূনতম ১২-১৩ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি কেটে নিয়ে কমপ্যাক্ট করে নিতে হবে। যাতে অতি বৃষ্টিতে ঘরের কোন ক্ষতি না হয়; মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের সময় বস্তাবিহীন অবস্থায় মাচা হতে ৫ ফিট উঁচু পর্যন্ত ২৫-৩০ মে. টন আলু সাধারণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হবে।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্প। খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৫৭৮৬৮২৮৭, ই-মেইল :shahadatbau@gmail.com