Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পুষ্টি নিরাপত্তায় খেজুরের গুড়

পুষ্টি নিরাপত্তায় খেজুরের গুড়
ড. মোছা. কোহিনুর বেগম
খেজুরের গুড় হচ্ছে প্রাকৃতিক মিষ্টি। খেজুরের  গুড়ে রয়েছে মিষ্টি স্বাদ ও পুষ্টিগুণ দুটোই। গুড় শুধুমাত্র আমাদের আকাক্সক্ষাই মেটায় না বরং অনেক থেরাপিউটিক সুবিধা নিয়ে আসে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। খেজুরের গুড়  খেজুর গাছের নির্যাস থেকে তৈরি করা হয় এবং এটি তরল বা শক্ত ব্লক  হিসেবে পাওয়া যায়। এটি একটি অপ্রক্রিয়াজাত বিশুদ্ধ চিনির রূপ।
খেজুরের গুড়ের প্রকারভেদ
নলেন গুড় : এই গুড় তৈরি করা হয় খুব ভোরে তোলা প্রথম রস থেকে। যশোরের নলেন গুড় তার স্বতন্ত্র স্বাদ  ও সতেজতার কারণে  অনেকের  হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
জিরেন গুড় : এই গুড়টি রসের দ্বিতীয় ব্যাচ থেকে তৈরি করা হয় যা ভোরবেলা প্রথম রসের পরে বের করা হয়।
ঝোলা গুড় : এই গুড় আকারে তরল। বায়ুম-লের তাপমাত্রা ২৪০ সে. এর নিচে না নামলে প্রাকৃতিকভাবে খেজুরের রসে সুক্রোজ বা চিনি তৈরি হয়না তাতে রিডিউসিং সুগার এর পরিমান বেশি থাকে। ফলে এই রস থেকে প্রস্তুতকৃত গুড় আকারে তরল হয়। আমাদের দেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং মার্চ মাসে প্রস্তুতকৃত খেজুরের গুড় আকারে তরল হয় যদিও গুড় চাষিরা রস জ্বাল দেয়ার সময় এতে চিনি মিশিয়ে তা থেকে পাটালি প্রস্তুত করে।
পাটালি গুড় : এই গুড় আকারে শক্ত। আমাদের দেশে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রস্তুতকৃত খেজুরের গুড় আকারে শক্ত হয় যা পাটালি নামে পরিচিত।
খেজুর গুড়ের পুষ্টিমাণ
চিনির স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে খেজুরের গুড় খাওয়া যেতে পারে কারণ এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম (৪১)। এটা কোনো রকম রাসায়নিক এর ব্যবহার ছাড়াই তৈরি করা হয় এবং এতে সুক্রোজ বা নিয়মিত চিনির চেয়ে কম শক্তি থাকে। খেজুরের গুড়ে প্রতি ১০০ গ্রামে ৩৮৩ ক্যালরি রয়েছে। মাত্র ২০ গ্রাম এর মধ্যে ৩৮ ক্যালরি, ৯.৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৯.৭ গ্রাম চিনি, ০.০১ গ্রাম প্রোটিন, সেইসাথে কোলিন, বিটেইন, ভিটামিন বি ১২ এবং বি ৬, ফোলেট, ক্যালসিয়াম এবং ৯.৭ গ্রাম চিনি রয়েছে ।
খেজুর গুড়ের উপকারিতা
খেজুরের গুড়ের কিছু অবিশ্বাস্য উপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
শক্তি বর্ধনকারী : খেজুর থেকে পাওয়া গুড় একটি জটিল কর্বোহাইড্রেট। সাদা চিনির বিপরীতে এটি হজম হতে বেশি সময় নেয় যা আমাদেরকে সারাদিন ধরে টেকসই শক্তি প্রদান করে।
স্বাস্থ্যকর হজম পুনরুদ্ধার করে : খেজুরের গুড়ের হজমের উপকারিতা রয়েছে। প্রতি বেলায় আহারের পরে অল্প পরিমাণ খেজুরের গুড় খাওয়া অন্ত্রের ট্র্যাক্ট পরিষ্কার করে এবং এনজাইমগুলো সক্রিয়  করে  হজমে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয় : খেজুরের গুড়ে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে। এই ফাইবারগুলো কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে সহায়তা করে।
পেশি স্বাস্থ্য উন্নত করে : বাংলাদেশে আয়রন ঘাটতি সাধারণ পুষ্টি ঘাটতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আয়রন স্বাস্থ্যকর পেশি এবং ইমিউন সিস্টেম বজায় রাখার জন্য  একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। খেজুর থেকে তৈরি গুড় লোহার একটি বড় উদ্ভিদভিত্তিক উৎস, যা দৈনিক চাহিদার ১১ মিলিগ্রাম বা ৬১% প্রদান করে।
মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে : খেজুর গুড়ের প্রাকৃতিক ঔষুধি উপাদান মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুলের জন্য দরকারী : গুড় ত্বকের জন্য উপকারী। কারণ এতে রয়েছে গ্লাইকোলিক এসিড যা ত্বকের অসঙ্গতি এবং ত্রুটিগুলি সংশোধন করতে কাজ করে। উপরন্তু এটি ত্বকের নমনীয়তা বাড়ায়, যা বলিরেখা এবং সূক্ষরেখার মতো বার্ধক্যের লক্ষণগুলোকে হ্রাস করে। গ্লাইকোলিক এসিড সুন্দর মসৃণ ত্বকের উন্নতির জন্য একটি হালকা এক্সফোলিয়েট হিসেবে কাজ করে। গুড়ে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা চুল পড়া রোধ করে। আয়রন হিমোগ্লোবিনের সংশ্লেষণে সাহায্য করে যা ত্বকের শিরাগুলোতে রক্ত প্রবাহ বাড়ায়  এবং চুলের ক্ষতি কমাতে চুলের বিকাশকে উৎসাহিত করে ।
সর্দি ও কাশির চিকিৎসা করে : ইমিউন সিস্টেমের প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া সর্দি এবং কাশি উপসর্গ সৃষ্টি করে। খেজুরের গুড় সবচেয়ে নিবিড়ভাবে যে রোগের চিকিৎসা করতে পারে তা হলো সর্দি এবং কাশি। এটি এককাপ গরম পানি বা চায়ে যোগ করা হলে তা শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার করতে এবং বেশ কয়েকটি উপসর্গ উপশম করতে সহায়তা করে। খেজুরের গুড়ে বেশ কিছু ফেনোলিক এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।
বিবিধ : খেজুরের গুড় নিয়মিত খেলে রক্তস্বল্পতা কমে এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে যা মস্তিস্কের সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে। খনিজ ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন শক্তিশালী করে।
এটিতে পটাশিয়ামও রয়েছে যার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগের উন্নতি। উপরন্তু এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, অন্যদের পাশাপাশি রক্ত সম্পর্কিত বেশ কিছু অসুস্থতা কমায়।
আমাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকাগত আইটেমগুলোর সাথে খেজুরের গুড় খাওয়ার আগে মনে রাখতে হবে যে, এই গুড় পরিমিতভাবে  খেতে হবে  কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে চিনি রয়েছে। এটি পানীয়, ডেজার্ট এবং অন্যান্য খাবারের জন্য প্রতিদিনের রেসিপিগুলোতে চিনির মতো  ব্যবহার করতে পারি ।         
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বহুগুণে ভরপুর এই মিষ্টিজাতীয় গাছটির উপর বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং কিভাবে এটি থেকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রস এবং গুড় তৈরি করা যায় এবং এর পুষ্টিমান অক্ষুণœ রাখা যায় তার উপর পরিচালিত গবেষণালব্ধ ফলাফল দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার লিটার খেজুরের রস উৎপাদিত হয়, (বিবিএস ২০২১-২২)। ৮% রিকভারী ধরে হিসাব করলে এই রস থেকে উৎপাদিত গুড়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২২০.৫৩ মে.টন। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর লক্ষ্যই হলো শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন করা।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএসআরআই, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল: ০১৭৩১৯১৯১৭৪; মেইল: kohinoorbegum.bsri@gmail.com