Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদনে আমাদের করণীয়

বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদনে আমাদের করণীয়
ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ
বাঁধাকপি একটি জনপ্রিয় ও উৎকৃষ্ট শীতকালীন সবজি। বাঁধাকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ পাওয়া যায় যা শিশুর অন্ধত্ব রোগ নিবারণের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ভিটামিনের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ শিশু অন্ধ হয়ে যায়। পুষ্টির দিক দিয়ে বাঁধাকপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ২২০০০ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপির চাষ করা হয়, যার মোট উৎপাদন মাত্র ৩,৮৪,০০০ টন। অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে গড়ে ফলন হয় মাত্র ১৮ টন। বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এই সবজিটি পাওয়া যায়। তবে শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে এই সবজি আবাদে প্রচুর কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয়। বেশি পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো দুটি পাতা খেকো পোকা। প্রাথমিক অবস্থায় যদি এই পোকার আক্রমণ হয় তবে বাঁধাকপির মাথা বাঁধতে পারে না ফলে ঐ বাঁধাকপি গাছটি নষ্ট হয়ে যায়। বাঁধাকপির ফলন কম হওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে পাতা খেকো (খবধভ-বধঃরহম) দুটো পোকার আক্রমণ। এই পোকা দুটোর নাম হচ্ছে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ  এবং প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার , এরা বাঁধাকপির প্রচুর ক্ষতি করে।
পোকা এবং ক্ষতির বর্ণনা : ডায়মন্ড-ব্যাক মথের পূর্ণ বয়স্ক পোকা একটি ছোট আকারের মথ যার পিঠের উপরে ডায়মন্ডের মত দাগ আছে। এ জন্য একে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ বলে। প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলারের পূর্ণ বয়স্ক পোকাও মাঝারি আকারের ধূসর রংয়ের একটি মথ। এ দুটো পোকা শুধু কীড়া অবস্থায় বাঁধাকপির ক্ষতি করে। অন্যদিকে প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার বাঁধাকপি ছাড়া আরও অনেক ফসল যেমন : ফুলকপি, তামাক, আলু, মিষ্টিআলু, বাদাম, টমেটো, মরিচ, মটর, কাউপি, পাট ও কচুতে আক্রমণ করে থাকে। ডায়মন্ড-ব্যাক মথ-এর পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী মথ বাঁধাকপি বা ফুলকপির পাতার নিচের দিকে একটি একটি করে বা একত্রে ২-৩টি করে ডিম পাড়ে। তাপমাত্রা কমবেশি হলে ৩-৮ দিনে ডিম ফুটে কীড়া বের হয় এবং কীড়াগুলো প্রথম দিকে যে পাতায় স্ত্রী মথ ডিম পেড়েছিল সেই পাতা বা তার আশে-পাশের পাতা কুড়ে কুড়ে খায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে কীড়াগুলো বাঁধাকপির মাঝ-পাতায় চলে যায় এবং বাঁধাকপি যখন বাঁধতে শুরু করে তখন মাঝের পাতাগুলো কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। ফলে বাঁধাকপির পাতা বাঁধতে পারে না, অথবা অসম্পূর্ণভাবে বাধে। এইভাবে পাতা খেয়ে কীড়াগুলো পূর্ণঅবস্থায় পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক কীড়াগুলো প্রায় ৮ মিমি. লম্বা হতে পারে, গায়ের রং সবুজ এবং পেট একটু মোটা হয়। পুত্তলী থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মথ বেরিয়ে আসে। ডায়মন্ড-ব্যাক মথ-এর কীড়া একইভাবে ফুলকপি আক্রমণ ও ক্ষতি করে থাকে।
প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলারের স্ত্রী-মথ বাঁধাকপির পাতার নীচের দিকে গুচ্ছাকারে, অর্থাৎ একসাথে অনেকগুলো ডিম পাড়ে যা বাদামি রঙের লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। ডিম থেকে ৩-৪ দিনের মধ্যে কীড়া বের হয় এবং একসাথে সব কীড়াগুলো পাতা কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। ফলে, বাঁধাকপির নিচের পাতাগুলো অনেক সময় ঝাঝরা হয়ে যায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে কীড়াগুলো ক্ষেতের অন্যান্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাঁধাকপির মাঝখানের পাতা খাওয়া শুরু করে। ফলে, বাঁধাকপির পাতা বাঁধতে পারে না বা অসম্পূর্ণভাবে বাঁধে। তাপমাত্রার হেরফেরের কারণে দুই থেকে তিন সপ্তাহে কীড়াগুলো পূর্ণঅবস্থায় আসে এবং ক্ষেতের মাটির মধ্যে শক্ত কোকুনের ভেতরে পুত্তলিতে পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক কীড়াগুলো প্রায় ৪০-৪৫ মিমি. লম্বা হয় গায়ের রং কালো এবং পিঠে আড়াআড়িভাবে হলদে-সবুজ ডোরা কাটা দাগ থাকে। পুত্তলি থেকে ১০ দিন পর পূর্ণবয়স্ক মথ বেরিয়ে আসে।
কৃষকের ব্যবহৃত বর্তমান দমন পদ্ধতি : ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার-এর ক্ষতি থেকে বাঁধাকপি ও ফুলকপি রক্ষার জন্য কৃষকগণ বর্তমানে শুধুমাত্র কীটনাশক ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি দু-সপ্তাহ অন্তর তারা বিষাক্ত কীটনাশক ফসলের উপর স্প্রে করে থাকেন। কীটনাশক দিয়ে কিছু দমন হলেও, সন্তোষজনভাবে পোকা দমন হয় না। কারণ, প্রথমাবস্থায় কীড়াগুলো পাতার নিচে থাকে বলে স্প্রেকৃত কীটনাশক কীড়ার গায়ে লাগে না, ফলে বেশিরভাগ কীড়া বেঁচে যায়। দ্বিতীয়ত: কীড়াগুলো যখন বাঁধাকপি বা ফুলকপির মাঝখানে চলে যায়, তখন পাতার আড়ালে থাকে বলে কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে না। ফলে, বেঁচে থাকা কীড়াগুলো খুব সহজেই বাঁধাকপি বা ফুলকপি ক্ষতি করতে থাকে। তৃতীয়ত: বারবার কীটনাশক ব্যবহার করার দরুন কীড়াগুলো কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাঁধাকপি বা ফুলকপি ফসলে যে সমস্ত কীটনাশক ব্যবহার হয় তার প্রায় প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে ডায়মন্ড ব্যাক মথ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে পড়েছে। চতুর্থত: বারবার বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এ দুটো পোকার প্রাকৃতিক শক্র (ঘধঃঁৎধষ বহবসরবং) মারা যায়। ফলে, ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটাপিলার-এর সংখ্যা বিনা বাধায় বাড়তে থাকে। সব কীটনাশকই মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কীটনাশক ব্যবহারের পর এর বিষাক্ততা বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে থেকে যায় এবং এসব সবজি খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া যেসব কৃষক কীটনাশক প্রয়োগে করেন তাদেরও নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।
আইপিএম পদ্ধতিতে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার দমন ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ আইপিএম সিআরএসপি (ওচগ ঈজঝচ) প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের ক্ষেতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে কীটনাশক ব্যবহার না করে আইপিএম (ওচগ) পদ্ধতির মাধ্যমে এই পোকা দু’টো সন্তোষজনকভাবে দমন করা যায়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত ও বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদন করা যায় এবং বেশি ফলন পাওয়া যায়।  অন্যদিকে বাঁধাকপির চারা লাগাবার ৩-সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে বাঁধাকপির ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করে ঐ কীড়াগুলো সহজেই হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলা যায়। হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলার পরও যে সমস্ত কীড়া বেঁচে থাকে তারা প্রাকৃতিক শক্রর (বোলতা জাতীয় প্যারাসিটয়েড) আক্রমণে মারা যায়। আমাদের দেশের কৃষকগণ প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২-৩ বার বাঁধাকপির ক্ষেত পরিদর্শন করে থাকেন। এই পরিদর্শনের সময় কপি গাছের পাতা উল্টিয়ে দেখতে হবে কোন কীড়া আছে কি না; থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে মেরে ফেলতে হবে। এইভাবে ৩-৫ বার কীড়া ধরে মেরে ফেলতে পারলে কীটনাশক ব্যবহারের কোন প্রয়োজন হয় না। তবে, পোকার আক্রমণ যদি অত্যন্ত বেশি হয় তাহলে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক এক বা দুবার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে আইপিএম পদ্ধতিতে ব্যবহারের ফলে বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদন করা যায় যা আমাদের স্বাস্থের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল :  ই-মেইল : bahauddinahmed57@yahoo.com