Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষি পর্যটন

স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষি পর্যটন
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম
বর্তমান প্রজন্ম বিশেষ করে শহরের অনেক ছেলেমেয়ে ভাত খায় ঠিকই কিন্তু কিভাবে ধান হয় তা হয়তো কখনো দেখেনি। কৃষক কিভাবে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করে ফসল ফলাচ্ছে, পুকুরে মাছ ধরছে, কৃষাণীরা কিভাবে ঢেঁকিতে ধান ভাঙছে, উঠান ঝাড়– দিচ্ছে তা হয়তো শুধু টিভিতে দেখলেও বাস্তবে উপলব্ধি করেনি অনেকেই। সকালবেলা ফুল কুড়ানো, মাটির চুলায় রান্না করে খাওয়া এসবই শহুরে মানুষদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হলেও বাস্তবে এসব দেখা সুযোগ করে দিতে পারে কৃষি পর্যটন। যদিও আমাদের গ্রামগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছোঁয়া লেগেছে। 
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের পরে তিনি তার গ্রামে বসবাস করবেন বলে একাধিক সময় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখনই আমি রাজনীতি থেকে অবসর নেবো, আমি আমার গ্রামে চলে যাবো এবং এটিই আমার সিদ্ধান্ত’ (আনছার ভিডিপির ৩৯তম জাতীয় সমাবেশ)। কৃষি পর্যটন হতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে এক ব্যতিক্রম আইডিয়া, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসু বিশ্ববাসীর সামনে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করে পর্যটন শিল্পকে আরো লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠা সম্ভব।
কৃষি পর্যটনের মাধ্যমে পর্যটকরা গ্রামীণ কৃষির ঐতিহ্য, দর্শন, সংরক্ষণ ও উক্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা উপলব্ধি করতে পারবে খুব সহজে। এই জাতীয় পর্যটন গ্রামীণ সংস্কৃতির স্থায়িত্বকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারে। ভ্রমণকারীরা আবিষ্কার করবে জীবনের নতুন গল্প। এরই মধ্যে বান্দরবনের লামা, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ইকোভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান, দিনাজপুরের লিচু বাগান, স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগান, যশোরের ফুলের বাগান, নরসিংদীর লটকন বাগান-এমন আরও অসংখ্য কৃষি পর্যটন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের জন্য এই জায়গাগুলো এরই মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করে ফেলেছে। যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রগুলো আরো প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। 
আমরা যারা গ্রামের জন্মগ্রহণ করেছি আমাদের কাছে গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের এখন সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বাড়ছে দিন দিন। মানুষ শিকড়মুখী হতে চায়, পুকুরে সাঁতার কাটতে চায়, নিজ হাতে মাছ ধরতে চায়, গাছ থেকে ফল-ফলাদি পেড়ে খেতে চায়। যতই দিন যাবে মানুষ অর্গানিক আর বিষমুক্ত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই কারণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ ওয়েবসাইট বা অ্যাপস ঘেঁটে তার আশপাশের কৃষি ও কৃষ্টির দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে চাইবে। আর তরুণ উদ্যোক্তারা এই সুযোগটি লুফে নিতে পারে ব্যবসার জন্য। এতে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ ছাড়া ভোক্তার কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে।
বরগুনা কৃষি পর্যটন বিকাশে নতুন উদ্যোক্তাদের সাফল্যের  মাঠ পর্যায়ের ট্র্যাভেল শো শুরু করেছে। বরগুনা জেলার গ্রামগঞ্জে আনাচে-কানাচে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। বড় বড় কৃষি খামার দেখার মতো একটি গ্রাম।  সারাদিনের ভ্রমণের জন্য অনেক জায়গা আছে। ছুটির দিনে শহরের ইট পাথর থেকে মাটির রাস্তা ধরে কোন একটি গ্রামে সারা দিনের জন্য ভ্রমণ করার বরগুনায় অনেক জায়গায়। সেসব জায়গায় যাওয়ার জন্য ‘জল তরণী’ ভ্রমণ সেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোথায় যাবে, কি খাবে, কি দেখবে,  কিসে যাবে, সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে জল তরণী।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দত্তরাইল গ্রামে পাহাড়-টিলা ঘিরে গড়ে উঠেছে কৃষি পর্যটন। সারি সারি উচু-নিচু পাহাড়-টিলা। ভাঁজে ভাঁজে আনারস, কমলা, মাল্টা আর লেবু গাছ। আছে কাজুবাদাম আর কফিগাছও। টিকিট কেটে মানুষজন ফলবাগানে ঢুকছে, ঘুরছে, দেখছে। টিলায় বসে অনেকেই কিনে খাচ্ছে টাটকা আনারস আর লেবুর জুস। কেউ কেউ কিনে ব্যাগ ভরে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতেও। এসব টিলা আগে অনাবাদি ছিল। গত দুই বছরে দৃশ্যপট বদলে যায়। পতিত পাহাড়-টিলা ভরে গেছে আনারসের চারায়। এখন আনারস বিক্রি করেই কোনো কোনো চাষি বছরে কোটি টাকা আয় করছে। এসব ফলবাগানের উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই প্রবাসী।
ঢাকার অদূরেই কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে গ্রিনারি এগ্রোর খামার। ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল কয়েকটি পুকুর। এসব পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছ। মাছের খাবারে কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয় না। পাশেই রয়েছে সবজিক্ষেত। মৌসুমভেদে শাক ও সবজি ফলানো হয় এখানে। আরও উৎপাদন হয় মৌসুমি ধান ও গম। রয়েছে দেশীয় ফলের সমাহার। আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, ডাব- কী নেই এখানে।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পূর্ব খ- গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ও সেলিনা হোসেন দম্পতি ২০২০ সালে প্রথমবার দেশে টিউলিপ ফুল ফুটিয়ে সাড়া জাগিয়েছিল।        বিস্তৃত জায়গাজুড়ে শুধু বাহারি রঙিন ফুলের খেলা। এ যেন দেশের বুকে এক টুকরো নেদারল্যান্ডস। নয়নাভিরাম টিউলিপ বাগান দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। বাগানে টকটকে লাল, গাঢ় হলুদ, হালকা  বেগুনি, পিংকসহ ছয় রঙের বাহারি সব টিউলিপ ফুলের সমারোহ। নানা রঙের টিউলিপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আকর্ষণীয় এই ফুলের বাগানটি দেখতে এরই মধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরের বড় কর্মকর্তারা ঘুরে গেছে।
এই আমের মৌসুমে রংপুরের বদরগঞ্জে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দেখলাম সেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ আম কিনতে এসেছে। গাছগুলোতে ঝুলছে থোকায় থোকায় পাকা আম। আমের ভারে নুয়ে পড়ছে গাছ ডালপালা। বিমুগ্ধ হয়ে ছবি তুলছে অনেকে! আর আমরা বাগান মালিকের অনুমতি নিয়ে গাছ থেকে পাকা আম পেড়ে খাচ্ছি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। 
বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষ বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতির স্বীকৃতি পেয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে। বিশ্ব ঐতিহ্যের এই স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ইউনেস্কো, জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক তহবিল (জিইএফ) যৌথভাবে এই           স্বীকৃতি দেয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ফুল চাষ, প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান চাষ, পাহাড়ে জুমচাষ এবং একসঙ্গে ধান ও মাছ চাষের পদ্ধতি বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতির সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন অঞ্চলকে অবশ্যই মূলধারার পর্যটন খাতের স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন এবং এসব স্থান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত। নীতিমালা প্রণয়নের সুবিধার্থে এবং পর্যটন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।          কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতি কাঠামোতে কৃষি পর্যটন স্বীকৃত। 
সরকারের কৃষি বিনিয়োগের পাশাপাশি কৃষি পর্যটনে কিভাবে      কৃষকদের সম্পৃক্ত করা যায়, তাদের কৃষিভিত্তিক পর্যটনের ওপর ট্রেনিং, কৃষি পর্যটনে আপামর জনসাধারণকে উদ্বুুদ্ধকরণ, এর জাতীয়ভিত্তিক প্রচারণার মাধ্যমে কৃষি পর্যটনকে জিডিপি আয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। জাতীয় কৃষি নীতিমালা ২০১৮ এবং জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ২০২০ কৃষি পর্যটনকে উন্নত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনার কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে।
কৃষি সভ্যতার বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় কৃষি, শিল্প ও          সংস্কৃতির। এই ঐতিহ্য পর্যটনে ব্যবহৃত হতে পারে সহজেই। কৃষিতে পর্যটন যোগ করা হলে কৃষক এবং গ্রামীণ এলাকার জন্য বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব, যা গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবিকা নির্বাহে অবদান রাখতে পারে।
এগিয়ে যাক বাংলাদেশের কৃষি, এগিয়ে যাক বাংলাদেশের পর্যটন। 

লেখক : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ই-মেইল : সনধংযরৎঢ়ৎড়১৯৮৬@মসধরষ.পড়স, মোবাইল : ০১৩০৩-৭০৬৮২০