Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

আম সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা

আম সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত নিরাপদ ব্যবস্থাপনা
ড. মো. শরফ উদ্দিন
আম এদেশের একটি জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। কিন্তু সরবরাহকাল মাত্র ৩-৪ মাস। তবে এই সময়ের পরও বাজারে আম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর মূল্য অধিক (৪০০-৬০০ টাকা প্রতি কেজি) হওয়ায় অধিকাংশ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ হতে জানা যায়, আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ৩০ ভাগের উপরে এবং এর বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে আমাদের কৃষক শ্রম ও অর্থ খরচ করে যে পরিমাণ আম উৎপাদন করেন তার প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ আম নষ্ট হয় বা এ গুলো হতে নায্যমূল্য পাওয়া যায় না। যদি ক্ষতির পরিমাণ টনে বলতে চাই তাহলে ৩.৫-৪.০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় যে পরিমাণ আম উৎপাদন হয় তারচেয়েও বেশি পরিমাণ আম নষ্ট হয়। যেহেতু আমাদের দেশে জমির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে, সেক্ষেত্রে নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোই বেশি কাম্য। আমের সংগ্রহ হতে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত কী ক্ষতিটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং আম সংগ্রহ হতে শুরু করে ভোক্তা খাওয়া পর্যন্ত সকলে সতর্ক হলে এই অনাকাঙ্খিত ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আম হতে ভালো স্বাদ পেতে হলে সঠিক পরিপক্বতায় আম সংগ্রহ করা উচিত। আমকে আমরা দু’অবস্থায় সংগ্রহ করতে পারি যেমন: কাঁচা এবং পাকা অবস্থায়। আমগাছ হতে আম দু’ভাবে সংগ্রহ করা যায়, হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক ব্যবহার করে। আম গাছের উচ্চতা কম হলে আম সহজেই হাত দ্বারা সংগ্রহ সম্ভব। কিন্তু গাছ বড় হলে বা উচ্চতা বেশি হলে বাঁশের তৈরী আম সংগ্রাহক বা ঠুসি (সধহমড় যধৎাবংঃবৎ) ব্যবহার করা হয়। গাছ থেকে কখন আম সংগ্রহ করতে হবে সে সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরী। পরিপূর্র্ণ পুষ্টতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা উচিত নয়। পরিপূর্ণভাবে পুষ্ট (সধঃঁৎব) হলে আমের উপরের অংশ অর্থাৎ বোঁটার নিচের ত্বক সামান্য হলুদাভ রঙ ধারণ করবে। আমের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০১ - ১.০২ এর মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ পরিপক্ব আম পানিতে ডুবে যাবে। প্র্রাকৃতিকভাবে দু একটা পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে এবং পাখি আধাপাকা আম ঠোকরাবে। আম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন: বেশিরভাগ আমে পরিপক্বতা এলেই গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে, আাম এমনভাবে সংগ্রহ করতে হবে যেন কোন আঘাত না পায়, গাছ থেকে আম সংগ্রহের ১৫/২০ দিন পূর্বে আমগাছে কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক ¯েপ্র্র করা বন্ধ করতে হবে। আমকে কিছুক্ষন উপুড় করে রাখতে হবে যাতে আঁঠা ঠিকমত ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগতে পারে, গাছের নীচ থেকে আম দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে এবং বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে দফায় দফায় আম সংগ্রহ করাই ভাল।
বাছাইকরণ বা গ্রেডিং
সংগৃহীত আমের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বাছাইকরণ একান্ত প্রয়োজন। আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকা দ্বারা আক্রান্ত এবং গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখতে হবে কারণ এসব আম খুব তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। দূরবর্তী বাজারে প্রেরণের জন্য স্বাভাবিক, উজ্জ্বল এবং পরিপুষ্ট আম বাছাই করে প্যাকিং করা উচিত। যে কোন ফল প্যাকিং এর আগে ছোট, মাঝারি এবং বড় এই তিন ভাগে ভাগ করা উচিত যাতে প্যাকিং, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়।
রাইপেনিং চেম্বারের মাধ্যমে আম পাকানো
ইথিলিন প্রয়োগের সঠিক উপায় ও পদ্ধতি হলো গ্যাসীয় পদ্ধতিতে ইথিলিন প্রয়োগ, আর এ জন্য সারা বিশে^ স্বীকৃত উপায় হচ্ছে রাইপেনিং চেম্বার তৈরি করে তার মধ্যে ফল রেখে ইথিলিন প্রয়োগ করে ফল পাকানো। রাইপেনিং চেম্বারে ইথিলিন গ্যাস ব্যবহার করে প্রত্যেকটি জাত ৭-১০ দিন পূর্বে পাকানো সম্ভব। পৃথিবীর অনেক আম উৎপাদনকারী দেশে রাইপেনিং চেম্বারে আম পাকানো পদ্ধতিটি বহুল প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি। রাইপেনিং চেম্বার ব্যবহার করে কাঙ্খিত ফলাফল পেতে অবশ্যই রাইপেনিং চেম্বারের মুলনীতি ভালোভাবে জানা এবং তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা উচিত। বিভিন্ন দেশে ফল পাকার জন্য একটি ইটের তৈরী ঘর ব্যবহার করা হয় যা রাইপেনিং চেম্বার নামে পরিচিত। রাইপেনিং চেম্বার হল হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি ঘরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও এর ভিতরের ইথিলিন গ্যাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিপক্কতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এখানে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়স্ত্রণের মাধ্যমে ফলের পরিপক্কতাকে ধীর বা তরান্বিত করা হয়। অপর দিকে এখানে ইথিলিন গ্যাস প্রয়োগের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো সম্ভব হয়।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য কৃষিপণ্যে বা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ সংক্রান্ত কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ফল পাকাতে ইথোফেন ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ণয়, মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিরসন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ইথোফেনের রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশ নিরূপণে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মাঠপর্যায় থেকে ফলের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে ২৫০-১০০০০ পিপিএম ইথোফেনে প্রয়োগ ও তার অবশিষ্টাংশের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, টমেটো, আমসহ বিভিন্ন ফলে ইথোফেন প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইথোফেনের অবশিষ্টাংশ যা থাকে তা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত/অনুমোদিত মাত্রার (২ পিপিএম) নিচে চলে আসে, যা মানবদেহের জন্য নিরাপদ। এখানে উল্লেখ্য, সঠিক উপায়ে ও মাত্রা ব্যবহার করে আম পাকানো হলে ইথোফেন শতভাগ নিরাপদ এবং তা কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে না।
প্যাকিং
আম সংগ্রহের পর ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর জন্য আমের যে ব্যবস্থাপনা হয় তাকে প্যাকিং বলে। আম দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকিং একান্ত প্রয়োজন। আম সামান্য আঘাতে ক্ষত হতে পারে এবং এতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। আম প্যাকিং এর সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত। সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো প্লাষ্টিকের ক্রেটে আম পরিবহন করা। প্লাষ্টিক ক্রেট এর গায়ে খবরের কাগজ দিয়ে লাইনিং করে এবং প্রতিটি আমকে টিসু পেপার বা খবরের কাগজ দ্বারা মুড়িয়ে দেওয়া ভালো। প্র্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে ফলের নাম, জাতের নাম, প্রাপকের নাম ইত্যাদি লিখে রাখা উচিত। প্যাকিং এর আগে আমকে গরম পানিতে ট্রিটমেন্ট করলে আমের সংরক্ষণকাল ৫-৭ দিন বৃদ্ধি পায় এবং আমের রঙ কিছুটা হলুদ হয় এবং বেশ কিছুদিন রোগমুক্ত থাকে।
পরিবহন
আমাদের দেশে প্রধানত: সড়ক পথেই আম পরিবহন করা হয় কারণ এতে সময় কম লাগে। তাছাড়া বাগান থেকে বাজারে আম পরিবহনের জন্য রিক্সা, ভ্যান, নৌকা ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়। আম পরিবহনে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যানবাহনে আম উঠানো, নামানো ও পরিবহনের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন ফলের গায়ে বা প্যাকেটে আঘাত না লাগে।
পরিবহনে বেশি সময় নষ্ট না করাই ভাল। কারণ তাতে আম পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পরিবহন শেষে প্যাকেট খোলা ও আম গুদামজাত করা উচিত।
গাদাগাদি করে আম পরিবহন করলে নিচের আমে বেশি চাপ পড়ে ও আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গুদামজাতকরণ
গাছ থেকে আম সংগ্রহ পর বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আমকে গুদামজাত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কোন ফল গাছ থেকে সংগ্রহ পরও তার মধ্যে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তাই আম গুদামজাত করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
যে ঘরে আম রাখা হবে তা অবশ্যই বাতাস চলাচলের উপযোগী ও শীতল হতে হবে। প্রয়োজনে ইলেকট্রিক ফ্যান বাবহার করা যেতে পারে।
আর্দ্র আবহাওয়ায় ও বদ্ধ ঘরে আম তাড়াতাড়ি পাকে এবং সহজে পঁচন ধরে যায়। তাই পাকা আম বেশি দিন গুদামে সংরক্ষণ না করে তাড়াতাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজারজাতকরণ
যে কোন জিনিস বাজারজাতকরণ একটি সুন্দর শিল্প। দক্ষ ব্যবসায়ীগণ বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসামগ্রীকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন যাতে ক্রেতাসাধারণ অতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। আম বাজারজাতকরণের সময় নিম্নলিখিত নিয়ম মেনে চলা উচিত।
কোন আমে পঁচন দেখা মাত্রই আলাদা করে রাখতে হবে, কারণ এর জীবাণু অন্যান্য সুস্থ আমকে সংক্রমণ করতে পারে। ছোট, মাঝারি ও বড় তিন সাইজের ফল বাছাই করে বাজারজাত করতে হবে।
আম রপ্তানি
বিবিএস ২০২১ অনুসারে আম চাষাবাদের আওতাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৯৫২৮৩ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন ১২.২২ লাখ মেট্রিক টন। অপর দিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক দেশে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে আম চাষা হচ্ছে। যার বাৎসরিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ও বিদেশে এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন আমের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এতে আমের রপ্তানিও বাড়বে। রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে দেশি বাজারে আমের কদর বাড়বে এবং আম চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদেশে ভালো আমের উৎপাদন যে হারে বাড়ছে রপ্তানির পরিমাণ (১৬০, ৫৮০,৬৬৫, ৩০৯, ২৩২, ৩০৯, ২৭৯, ১৬২২, ১৭৩৮ মেট্রিক টন) আশানুরুপভাবে বাড়ছে না। অথচ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আম রপ্তানি করা হলে প্রতি বছর ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান উৎপাদনের ২ ভাগ আম রপ্তানি করা সম্ভব হলে ২০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হবে।

লেখক : উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল-sorofu@yahoo.com