গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আম
বাগানের যত্ন-পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম একটি জনপ্রিয় ও পছন্দনীয় ফল এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। দেশে ও বিশ^ বাজারে এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মৌসুমে এদেশ হতে তিন হাজার একশত মেট্রিক টন আম পৃথিবীর ৩৬টি দেশে রপ্তানি হয়েছে। এ দেশে যে পরিমাণ জমিতে ফলের চাষ হয় তার শতকরা ৪০ ভাগ জমিতেই আমের চাষাবাদ হয়। তুলনামূলকভাবে লাভজনক হওয়ায় আমের চাষাবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে পরিমাণ জমিতে আমবাগান আছে তার তুলনায় ফলন কম। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রতি একক জমিতে গড় ফলন কম। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ফলনের ব্যপক তারতম্য দেখা যায়। যেমন: চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে আমের ফলন অন্য এলাকায় চেয়ে অনেক বেশি। উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটু যত্নবান হলেই আমের ফলন কয়েকগুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। যেমন- আমগাছ হতে আম সংগ্রহের পর হতে শুরু করে পরবর্তী ফুল আসা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অনেক আমচাষি অসময়ে এসে ভাল ফলনের জন্য পরামর্শ চান। তাদের ধারণা আমগাছে মুকুল বের হওয়ার কিছুদিন পূর্বে থেকে যত্ন নিলেই ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। আসলে বিষয়টি এই রকম নয় বরং যত্ন নিতে হবে আম সংগ্রহ করার পর পরই। আমগাছ হতে আম সংগ্রহ করার পর রোগাক্রান্ত বা মরা ডাল পালা একটু ভাল অংশসহ কেঁটে ফেলতে হবে। ডালপালা এমনভাবে ছাঁটাই করতে হবে যেন গাছের ভেতরের অংশে সর্বাধিক পরিমাণ সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে। গাছের ভেতরমুখী ডালে সাধারণত ফুল-ফল হয় না, তাই এ ধরনের ডাল কেটে ফেলতে হবে। সাধারণত ডগার বয়স ৫-৬ মাস না হলে ওই ডগায় ফুল আসেনা। আগামী বছরে একটি গাছে কি পরিমাণ ফলন হতে পারে তা আগস্ট মাসেই ধারণা পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে গাছে যতবেশী নতুন ডগা বের করা যায় ততই উত্তম।
এরপর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে সুষম সার প্রয়োগ। আমবাগান হতে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সময়মতো সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি গাছে প্রতি বছর কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পুষ্টি উপাদানের উপর। সব ধরনের মাটিতে সারের চাহিদা সমান নয়। সুতরাং মাটির অবস্থাভেদে সারের চাহিদা কম-বেশি হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে।
চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। বয়সভিত্তিতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।
প্রয়োগ পদ্ধতি
বয়সভেদে নির্ধারিত সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বোরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ জাতভেদে ফল যখন ফল মটর দানার মত হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের কমপক্ষে ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশি হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগের পর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। খরা মৌসুমে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের প্রয়োজন পড়ে না। গবেষণা করে দেখা গেছে আম গাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাৎ গাছের গোড়ার চারিদিকে ১ মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মতো করে বেসিন তৈরি করে সেচ প্রয়োগ করলে সেচে পানির পরিমাণ কম লাগে এবং গাছ বেশির ভাগ পানি গ্রহণ করতে পারে।
বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ প্রয়োগকৃত জায়গা কচুরিপানা দ্বারা ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেওয়া উত্তম। কারণ কোন কোন সময় দেখা গেছে, এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হয় ফলে মুকুলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করা যেতে পারে ফলে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হবে এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
আগাছা দমন
আগাছা আম গাছের খাদ্যে ভাগ বসায় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। আম গাছের গোড়ায় এবং আমবাগানে যাতে আগাছা না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগাছা দমন করতে বাগানে লাঙ্গল বা টিলারের সহায্যে মাঝে মাঝে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম বার বর্ষা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে এবং দ্বিতীয় বার বর্ষা শেষ হয়ে আসার পর পরই জমিতে চাষ দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
ধ্যারা বা পরগাছা
আমাদের দেশে আমগাছে দুই ধরনের পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আম গাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা আমগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শেকড় থাকে না, তারা শেকড়ের মত এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাস জাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আম পাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায় না তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধারণ করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায়। এ সময়ে পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্থায় থাকে ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিতে খায় কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটাস্থানে রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ও ফল আসার আগেই সেটি ছাঁটাই করা উচিত।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বাগানের রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা। সঠিক ব্যবস্থাপনা সময়মত না নিলে আমের ফলন কখনও কখনও শূন্যতে নেমে আসতে পারে। ভাল গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের জন্য বাগানে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করতে হয়। গবেষণার ফলাফল হতে দেখা গেছে, ফুল আসার পূর্বে থেকে আম সংগ্রহ পর্যন্ত ৩-৪টি ¯েপ্রই যথেষ্ঠ। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরও ১/২টি ¯েপ্র করা লাগতে পারে। প্রথম ¯েপ্রটি করা হয় মুকুল বা পু®পমঞ্জরি বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে (সাইপারমেথ্রিন/ কার্বারিল/ ল্যামডা সাইহ্যালাথ্রিন/ ইমিডাক্লোপ্রিড) গ্রুপের কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে সমস্ত গাছ ধুয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছে বসবাসকারী হপার পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হতে আমকে রক্ষা করা যাবে। আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফোটবে না তখন দ্বিতীয়বার (একটি কীটনাশক ও সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক) একত্রে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে ফলে পু®পমঞ্জরির বৃদ্ধি ও ফুটন্ত ফুলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং আমের গুটি মটরদানার সমান হলে তখন তৃতীয়বার কীটনাশকের সাথে মেনকোজেব (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে)/কার্বেনডাজিম (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) গ্রুপের ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ¯েপ্র করতে হবে। কারণ আমের গুটি বাঁধার পর এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দেখা যায় ফলে গুটির উপর কালো কালো দাগ হয় ও পরে গুটি ঝরে পড়ে। আমের মুকুলের ফুল ফোটার পর কোন অবস্থাতেই ¯েপ্র করা যাবে না। আমের পরাগায়ন প্রধানত মাছি ও মৈামাছি দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ফুল ফোটার পর কীটনাশক ¯েপ্র করলে মাছি মারা যেতে পারে এবং আমের পরাগায়ন ও ফলধারণ মারাত্মকভাবে ব্যহত হতে পারে। বর্তমানে বাগানে পরাগায়নে সহায়তাকারী কীটপতঙ্গের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ¯েপ্রর ফলে এমনটি হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার, কোন বাগানে ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মাছি পোকার আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ¯েপ্র করে পোকা দুইটিকে সম্পূর্ণভাবে দমন করা কঠিন। এইক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকরী এবং লাভজনক। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ ও পোকার আক্রমণ শতভাগ কমানো যায়। তবে ¯েপ্র করার সময় যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন করে নির্দেশিত মাত্রায় উপযুক্ত সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমের বৃদ্ধি পর্যায়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে। উপরন্তু ঘন ঘন কীটনাশক ¯েপ্র করার ফলে আমগাছ ও আমের বিভিন্ন সমস্যা হতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও অধিক মাত্রায় ¯েপ্র করার ফলে আমের গুণগতমান কমে যায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। সঠিক বাগান ব্যবস্থাপনা না করে শুধুমাত্র ¯েপ্র করে আমে ফলন বাড়ানো সম্ভব নয়।
নিরাপদ আম চাষের ব্যাপারে সঠিক পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মী বা আম গবেষণা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। একই কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বার বার ¯েপ্র্র না করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উচিত কারণ একই ঔষধ বার বার ¯েপ্র্র করলে পোকা বা রোগের জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে। কুয়াশাছন্ন আবহাওয়া ও প্রখর রৈাদ্রে ¯েপ্র না করাই উত্তম। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন মধ্যে গাছে কোন বালাইনাশক ¯েপ্র্র করা উচিত নয়। সম্পূর্ণ ফুল ফোটা শেষ হলে মাটির অবস্থা বুঝে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। মৌসুমী বৃষ্টি আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত আমগাছে প্রতি মাসে একবার সেচ দেওয়া উত্তম। উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিলেই ভালোমানের আম উৎপাদন সম্ভব হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৪৯