বাংলাদেশে বেবীকর্ন চাষের সম্ভাবনা এবং উপযোগিতা
ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা
বেবীকর্ন একটি উপাদেয়, পুষ্টিকর ও কোলেস্টেরল মুক্ত সবজি এবং স্বল্পমেয়াদি অর্থকরী ফসল। ইহা ভুট্টার কচি মোচা যা সিল্ক বের হওয়ার পূর্বেই হ্ারভেস্ট করা হয় (অর্থাৎ ভুট্টার পরাগায়নের পূর্বেই) বেবীকর্নকে দুইধরনে (উঁধষ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব) ফসল হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ বেবীকর্ন থেকে একই সাথে বেবীকর্ন/কচি মোচা এবং ফডার/সাইলেজ পাওয়া যায়। বেবীকর্ন উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড ও চায়না অন্যতম। বাংলাদেশেও বেবীকর্নের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। তবে বাংলাদেশে কোন কোন জেলায় বেবীকর্নের আবাদ শুরু হয়েছে যার বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক পাইকারি বাজার ও চেইনসপগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় খাদ্য হিসেবে ভুট্টার প্রচলন বেশি।
বেবীকর্ন একটি কম-ক্যালোরি, কম-কোলেস্টেরল যুক্ত এবং উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ সবজি। বেবীকর্ন ভিটামিন এ, বি, ইসহ পটাসিয়াম, ফলিক এসিড এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থের ভালো উৎস। সাধারণভাবে একটি বেবীকর্নের মোচাকে একটি ‘ডিম’ এর সাথে তুলনা করা হয়। বেবীকর্ন বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ তাই এটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ। ফলে বেবীকর্নের পুষ্টিগুণ কয়েকটি উচ্চমূল্যে সবজির সাথে তুলনা করা হয়। বেবীকর্নের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স স্বাভাবিক ভুট্টার চেয়ে কম যা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী। তাজা/ফ্রেশ, হিমায়িত এবং টিনজাত বেবীকর্ন -এর চাহিদা আমাদের দেশে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ফ্রেশ বেবীকর্ন তরকারি, আচার, সুপ পোলাও, বিরিয়ানি, মিক্সড সবজি, সালাদ এবং বিভিন্ন ¯œ্যাক্সস তৈরিতে ব্যবহার করা যায় যা খাদ্যের পুষ্টিমান ও স্বাদ বৃদ্ধি করে। বেবীকর্ন পানি, লবণ, চিনি, সিরকার দ্রবণে বায়ুরোধী ক্যানেও পাওয়া যায়, যা অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা যায়।
বেবীকর্ন আদর্শ ফডার বেবীকর্ন গাছ থেকে তৈরি ফডার/সাইলেজ নরম, মজাদার, সহজ পাচ্য। তাই বেবীকর্ন গবাদিপশুর খামার এবং দুগ্ধ খামারেও সরাসরি অথবা সাইলেজ হিসেবে ব্যবহার হয়। বেবীকর্ন গাছের সবুজ ফডার দুগ্ধ-দায়ী গাভীর জন্য বিশেষভাবে উপকারী। তাছাড়া গাছের স্টক, শুকনা পাতা, মোচার খোসা ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি ভুট্টা তথা বেবীকর্ন আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বেবীকর্ন এবং সাধারণ ভুট্টার চাষ পদ্ধতি প্রায় একই। মিষ্টি ভুট্টা বা ফিল্ড কর্ন দুটো থেকেই বেবীকর্ন উৎপাদন করা যায়। তবে বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য ভালো জাত নির্বাচন করা জরুরি। বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য বিশেষ জাত ব্যবহার করা উত্তম। গত ২০২০ সালে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিডব্লিউএমআরআই হাইব্রিড বেবী কর্ন-১ নামে একটি বেবীকর্নের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বেবীকর্ন চাষে ব্যতিক্রমী বিষয়গুলি নিম্নরূপ:
গাছের সংখ্যা বেশি রাখতে হয়
নাইট্রোজেন সারের মাত্রা বেশি
ডিটাসেলিং অর্থাৎ টাসেল বের হওয়ার সাথে সাথে অপসারণ করা
সিল্কিং এর ১-৩ দিনের মধ্যে কচি মোচা হারভেস্ট করা, ইত্যাদি।
মানসম্পন্ন বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য ডিটাসেলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ভুট্টা বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হয়। ডিটাসেলিং করলে প্রায় ১৮% বেশি বেবীকর্ন উৎপাদন হয়। মৌসুম ও এলাকাভেদে বেবীকর্নের জীবনকাল ২-৩ মাস অন্যদিকে স¦াভাবিক ভুট্টার জীবনকাল ৪ মাস বা তার অধিক। সাধারণত মোচার আকার ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ব্যস ১.০-২.০ সেন্টিমিটার হলে বাজারজাতকরণের জন্য উপযুক্ত। বেবীকর্ন অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাই ২-৩ দিন পর পর বেবীকর্ন সংগ্রহ করতে হয়। ফ্রেশ বেবীকর্ন খোসাসহ বাজারজাত করা যায়। তবে খোসা ছাড়ানো বেবীকর্ন পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার ও সমআকারের বেবীকর্ন প্যাকেজিং করে চেইনশপে বাজারজাত করতে হয়। হেক্টরপ্রতি বেবীকর্ন মোচার ফলন ৬ টন বা এর উপরে এবং সবুজ ফডারের ফলন প্রায় ৩০ টন। বেবীকর্ন একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ায় বিভিন্ন ফসল বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বেবীকর্ন ফসল বছরে ৩-৪ বার উৎপাদন করা সম্ভব।
বেবীকর্ন উৎপাদন এবং এর বাজার সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে বেবীকর্নের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বেবীকর্ন সাধারণত ফ্রেশ/টাটকা হিসেবে ব্যবহার হয় তবে হিমায়িত এবং টিনজাত কর্ন এর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার এবং রফতানির বাজার বেশ বড়। বাংলাদেশেও বেবীকর্নের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে বেবীকর্ন আমদানি করা হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে দেশেই বেবীকর্ন উৎপাদন করা সম্ভব। বেবীকর্নের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দেশের কয়েকটি জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে বেবীকর্ন আবাদ শুরু হয়েছে। তবে ফ্রেশ/টাটকা বেবী কর্ন এর বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক কয়েকটি চেইন সপ বা পাইকারি বাজারের মধ্যেই সীমিত।
দেশে ক্রম বর্ধমান গবাদিপশু ও দুগ্ধ খামারের চাহিদা মেটাতে ফডার/সাইলেজের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। গবাদিপশুর উন্নত মানের ফডার বা সাইলেজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেবীকর্নের সম্ভবনা যথেষ্ট। বেবীকর্নের বহুবিধ গুণগত ও পুষ্টমান এবং অন্যান্য সুবিধার কারণে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বেবীকর্নের আবাদ বৃদ্ধি পেলে বেবীকর্ন উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পুষ্টিগুণে ভরপুর বেবীকর্নের আবাদ বৃদ্ধিকল্পে নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, প্রাণী সম্পদ বিভাগ কর্তৃক যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ফলে একদিকে যেমন দেশে পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখবে এবং অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ সবুজ ফডার এবং সাইলেজ উৎপাদিত হবে, যা বিভিন্ন গবাদিপশু ও দুগ্ধ খামারে ব্যবহার হবে। মার্কেট চেইন এর সাথে যুক্ত করে বেবীকর্ন উৎপাদন নীতিমালা গ্রহণ করা হলে কৃষকেরা বেবীকর্ন উৎপাদনে আগ্রহী হবে। এ ছাড়া বেবীকর্ন উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সাইলেজ উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে কৃষক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে বেবীকর্ন ফসল হয়ে উঠতে পারে কৃষকের জন্য একটি অর্থকরী ও বাণিজ্যিক ফসল।
লেখক : প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সিনিয়র স্পেশালিস্ট (কেজিএফ), মোবাইল : ০১৭১২-২২৬৭৫৫, ইমেইল : ncdbarma@gmail.com