সবজি চাষে বদলে যাওয়া
গ্রামের গল্প
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
ঢাকার অদূরে অবস্থিত সাভার উপজেলাকে কিছুতেই যেন চিরাচরিত উপজেলার মাপকাঠিতে মাপা যায় না। এখানে এখনও গ্রাম আছে বললে হয়তো অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে। নামে বেনামে হাজারো আবাসন কোম্পানির দৌরাত্ম্যে এখন সবুজের দেখা পাওয়া ভার। তবুও এখানকার কৃষকেরা যেন দৃঢ়প্রত্যয়ে কৃষি কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। অল্প সময়ে লাভবান হওয়ার মতো কৃষি পণ্যে ঝুঁকছেন তারা। এর তালিকায় আছে রঙ বেরঙের বাহারি ফুল, চায়নিজ সবজি ইত্যাদি। চাইনিজ সবজি উৎপাদন করে সাভারের গ্রামগুলো এখন চায়না গ্রাম নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
সাভারের তেঁতুলঝোড়ার দক্ষিণ মেইটকা ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এখন চায়না গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আদি পেশা কৃষিকে তারা ধরে রেখেছিল ধান চাষের মাধ্যমে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তারা অল্প সময়ে ফসল আসার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় সবজি চাষকে। ক্রমান্বয়ে তা চায়না সবজি চাষের দিকে মোড় নেয়। চাহিদা বাড়তে থাকায় আশপাশের গ্রামের কৃষকরাও যুক্ত হয়েছেন এসব সবজি চাষে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, চট্টগ্রামসহ পার্শবর্তী বিভিন্ন স্থানে বাজার সৃষ্টি হওয়ায় এ সবজি চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন কৃষকরা। দেশে চাইনিজ খাবারের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে চাহিদা বাড়তে থাকে চায়নিজ সবজির। তাই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষকেরা নিজে করছেন এ সবজি চাষ একই সাথে অন্যকে দিয়ে যাচ্ছেন উৎসাহ।
তেঁতুলঝোড়া গ্রামের কৃষক মো: কোব্বাত হোসেন। কৃষক মোঃ কোব্বাত হোসেনকে সবজি চাষে লাভ কেমন হয় প্রশ্নের উত্তরে জানান, প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে সবজি উৎপাদন করছেন। তার ক্ষেতে শোভা পাচ্ছে ব্রোকলি, রেড ক্যাবেজ, ক্যাপসিক্যাম, লেটুস, স্যালোরি, থাই জিনজার, পার্সলি, বিটরুট, সুইটকন, বেবিকর্নসহ রঙ বেরঙের চাইনিজ সবজি। উচ্চমূল্যের এ ফসলগুলোতে বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ৩০,০০০ টাকা। তিনি বিঘাপ্রতি সবজি বিক্রয় করেন ৬০,০০০ টাকার। লাভ হয় ৩০,০০০ টাকা। বার্ষিক আয় ২৫ লক্ষ টাকা। অনুরূপভাবে কৃষক মো: সোহরাব হোসেন সবজি চাষ করছেন ৭০-৮০ বিঘায়। তার বার্ষিক আয় ৮-১০ লক্ষ টাকা। কৃষক মো: সোহরাব হোসেন সবজির চাষাবাদ বিশেষ প্রযুক্তির সম্পর্কে জানান ব্রোকলির ক্ষেত্রে ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর) মাসে তার বীজ বপন করেন। কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যে (মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) জমিতে চারা রোপণ করেন। সার হিসেবে জৈবসার দেন। হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ১২-১৫টন/হেক্টর। রবি মৌসুমে বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেটুসের চাষ করে থাকেন। লেটুসের জীবনকাল সাধারণত ৫০-৫৫ দিন। লেটুসের জন্য হেক্টরপ্রতি ১০ টন গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ৭৫ কেজি টিএসপি এবং ১০০ কেজি এমওপি সার দিয়ে থাকেন। লেটুসের ফসল সংগ্রহের সুনির্দ্দিষ্ট কোন সয়ম নেই। মাথা বাঁধার পর এটি সংগ্রহ করতে হয়। হেক্টরপ্রতি এর ফলন ২০-৩৫ টন।
লেমনগ্রাস একটি সুগন্ধিযুক্ত ওষধি উদ্ভিদ। এ্ই উদ্ভিদ থেকে সাইট্রাল নামক একটি তেল পাওয়া যায়। প্রায় সবধরনের মাটিতে এটি সফলভাবে চাষ করা যায়। লেমনগ্রাস গাছ বেশি সেচের প্রয়োজন হয় না। একবার লেমনগ্রাস চাষ করলে প্রায় ৫ বছর ফসল পাওয়া যায়। প্রতি বছর ফসল ৪-৫ বার কাটা যায়।
সাভারে অন্যান্য সবজির মধ্যে সুপরিচিত এবং অধিক ব্যবহৃত ফসল হলো ক্যাপসিকাম। ক্যাপসিকাম সাভারে প্রচুর পরিমাণ হয়ে থাকে। সাধারণত আশি^ন (অক্টোবর) মাসে বীজ বপন করে কার্তিক (নভেম্বর) মাসে চারা রোপণ করলে ক্যাপসিকামের ভালো ফলন পাওয়া যায়। মানসম্মত ক্যাপসিকাম উৎপাদনের জন্য ১৬-২৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও শুষ্ক পরিবেশ প্রয়োজন। রাতের তাপমাত্রা ১৬-২১ সেলসিয়াসের কম বা বেশি হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল ঝরে পড়ে, ফলন ও মান কমে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই ফলন হয় না। অক্টোবর মাসে বীজ বপন করে নভেম্বর মাসে চারা রোপণ করলে দেখা যায় যে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারি পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারনে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এজন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনি, পলি হাউস, পরিভিনাইল হাউজে গাছ লাগালে রাতে ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের অপেক্ষা বেশি থাকে।
সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ক্যাপসিক্যাম চাষের জন্য উত্তম। সাধারণত ক্যাপসিক্যামের প্রতি এক গ্রাম বীজে ১৪০টি বীজ থাকে। প্রতি হেক্টরে বীজের প্রয়োজন ২৩০ গ্রাম এবং চারার প্রয়োজন ৩০,০০০। বীজ রোপণ করার জন্য বীজগুলোকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সুনিষ্কাশিত উঁচু বীজতলায় মাটি মিহি করে ১০২ সেমি. দূরে দূরে বীজ বপন করে হালকাভাবে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজতলায় প্রয়োজনানুসারে ঝাঝরি দিয়ে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে। সধারণত বীজ গজাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। বীজ রোপণের ৭-১০ দিন পর চারা ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৯১২ সেমি. আকারের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পটিং মিডিয়াতে ৩:১:১ অনুপাতে যথাক্রমে মাটি, কম্পোস্ট ও বালু মিশাতে হবে। পরে এগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে স্থানান্তরিত করতে হবে। জমিতে সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা ৪৫৪৫ সেমি. দূরত্বে রোপণ করতে হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ক্যাপসিক্যাম চাষের জন্য গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, জিংক সালফেট ১২ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হয়। জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর, টিএসপি, জিঙ্ক সালফেট, জিপসাম এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া ও এমওপি পরবর্তীতে দুইভাগ করে চারা লাগানোর ২৫ এবং ৫০ দিন পরে প্রয়োগ করতে হবে। ক্যাপসিক্যাম সাধারণত পরিপক্ব অবস্থায় মাঠ থেকে উঠাতে হয়। সাধারণত সপ্তাহে একবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের পর ঠা-া বা ছায়াযুক্ত স্থানে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। ফল সংগ্রহের সময় প্রতিটি কা-ে সামান্য পরিমাণ বোটা রেখে দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যা করলে হেক্টর প্রতি ক্যাপসিকামের ফলন হয় ১৫-২৫ টন।
ক্রমান্বয়ে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ। তিলোত্তমা নগরীতে আজ তিলধারণের ঠাঁই নেই। তবু নিজের একখ- ঠিকানার খোঁজে মানুষ ছুটছে অবিরাম। ঢাকার আশেপাশে তাই চলছে আবাসন কোম্পানির আগ্রাসন। এরপরেও এখানে যখন বহুমূল্যেও ফসল ফলে এটা আমাদের জন্য সুখের বটে। সাভারের আনাচে কানাচে যেখানেই এক টুকরো জমি আছে সেখানেই হচ্ছে ফসলের চাষ। উচ্চমূল্যের এই ফসল একদিকে যেমন স্থানীয় চাষিদের জীবনমান উন্নত করছে অপরদিকে দেশের কৃষিকে করছে সমৃদ্ধ। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন কৃষি উদ্যোক্তা হচ্ছে যা আমাদের জন্য একটি আশার হাতছানি। এসব তরুণ উদ্যোক্তা, কৃষক সকলকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই সমৃদ্ধির পথে।
লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৬৮৪০, ই-মেইল :dhaka@ais.gov.bd