ইঁদুর দমনে বর্তমান প্রেক্ষাপট
ও ভবিষ্যৎ করণীয়
ড. সন্তোষ কুমার সরকার
ইঁদুরের সমস্যা পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজমান, ইঁদুরের সমস্যা সামাজিকভাবে সকলের সমস্যা। যেখানে মানুষ ও প্রাণীর উপস্থিতি আছে, সেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের লাদাখ গাছপালাবিহীন উঁচু পর্বতের রাস্তা দিয়ে এবং কেদারনাথ মন্দিরে উঁচু পর্র্বতে ইঁদুরের বসবাস দেখা যায়। সেসব স্থানে ৭-৮ মাস বরফে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও ইঁদুর ঘোরাফেরা করে। অনুরূপভাবে, খড়ের গাদায় নিচে ইঁদুর সাধারণত বাস করে। একবার গ্রামে বাড়ির খড়ের পালার নিকট দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন ব্যক্তি একপাশে অল্প খর টেনে বেড় করার সময় গোখরা সাপ দেখা গেল। এরপর লোকটি অন্য প্রান্তে খড় টেনে বের করতে সেখান থেকে একটি ছোট গুইসাপ বের হয়ে দৌড়ে পালিয়ে থাকল। খড়ের গাদার উপরে দুইটি ইঁদুরের গর্ত দেখা গেল। একই খড়ের গাদায় গুইসাপ, বিষধর সাপ ও ইঁদুরের বাস রয়েছে। খাদ্য ও বাসস্থানের প্রয়োজনে ইঁদুর এক জায়গায় বাস করছে।
ইঁদুর দমনে প্রয়োজন
ইঁদুর যেখানে থাকবে, সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের দশভাগ পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। কোথাও যদি ইঁদুর দেখা যায়, তবে সেখানে কমপক্ষে ৫টি ইঁদুরের উপস্থিতি থাকবে। ইঁদুরের দাঁত জন্মের পর হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে। দাঁতের বৃদ্ধি রোধ না করতে পারলে খাওয়া বন্ধ হয়ে ইঁদুর মারা যায়। তাই দাঁত ঠিক রাখার জন্য শক্ত জিনিস যেমন- কাঠ, বৈদ্যুতিক তার, প্লাস্টিক, কাপড়চোপড়, গাছপালা, শস্য ইত্যাদি যা পায় তা কেটে ক্ষতি করে থাকে। বাসাবাড়িতে, ঘরবাড়িতে, অফিসে, ফসলের মাঠে, হাঁস-মুরগীর খামার, ফলের বাগানে, সেচের নালায় একটি ইঁদুরই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে। অতি অল্প সময়ে একজোড়া ইঁদুর হতে বিপুল বংশধর সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি ইঁদুরের উপস্থিতি দেখা মাত্র মারতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে হলে ইঁদুর সময়মতো নিজেরই প্রতিরোধ করতে হবে।
ইঁদুর দমনে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ করণীয়
যেকোনো প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হলে দমন প্রযুক্তি ও বালাইয়ের জীবনচক্র ও পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকারক ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারটি প্রজাতি ফসল ও সম্পদের
বেশি ক্ষতিকারক। যেমন- মাঠের বড় কালো ইঁদুর; মাঠের কালো ইঁদুর; গেছো ইঁদুর এবং সলই বা বাতি ইঁদুর। এদের মধ্যে মাঠের বড় কালো ইঁদুরের সামদ্রিক অঞ্চলে ও নিচু ভূমি হাওর বাঁওড় এলাকায় এদের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। মাঠের কালো ইঁদুর বাংলাদেশে কৃষি ফসল, গুদাম, গ্রাম ও শহর এলাকাসহ সর্বত্র একটি প্রধান ক্ষতিকারক বালাই। গেছো ইঁদুর ঘরের সিলিং এবং নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছে বাস করে। গেছো ইঁদুর খাদ্যগুদামে ও সিলিংয়ে বেশি দেখা যায়। এরা গর্তে থাকে না। গ্রামের আবাস ভূমির অব্যবহিত দূরে গাছের ঝাড়ে এবং উঁচু ভূমিতে পাওয়া যায়। এরা এক গাছ হতে অন্য গাছে সহজেই যেতে পারে। সলই ইঁদুর আকারে ছোট হলেও খাদ্যশস্য ও ঘরের জিনিসপত্র এবং দানাদার শস্যের প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে। ইঁদুর দমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কম রাখা। মাঠ ফসলে সঠিকভাবে দমন প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য ইঁদুরের প্রজননের সময় জানা প্রয়োজন। প্রজনন শুরু হওয়ার আগে ইঁদুর দমন করা হলে ইঁদুরের সংখ্যা কম রাখা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ইঁদুরের প্রজনন নির্ভর করে শস্যের নিবিড়তার উপর। যেখানে বছরে একটি ধান ফসল চাষ হয় সেখানে ইঁদুরের একটি প্রজনন হয়। আবার যেখানে বছরে তিনটি ফসল হয় সেখানে ইঁদুর তিনবার প্রজনন করে থাকে। বাংলাদেশে তিনবার ধান ফসলের চাষ হয়ে থাকে, তাই ইঁদুরের তিনবার প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
নিজের ফসলের মাঠ বা ঘরবাড়ি ছাড়া দলগতভাবে কৃষকগণ ইঁদুর মারতে চায় না অথবা অভ্যস্ত নহে। ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত ইঁদুর দমন করে না। কিন্তু পোকামাকড় দমনের জন্য গুরুত্ব বেশি দেয় এবং প্রতিষেধক হিসেবে বালাইনাশক প্রয়োগ করে থাকে। এ ছাড়া ইঁদুরবাহিত রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের জনসাধারণের ধারণা অত্যন্ত কম। ইঁদুরের মলমূত্র, লোম দ্বারা মানুষ ও পশুপাখির ৩০ প্রকারের বেশি যেমন- জন্ডিজ, প্লেগ, জ্বর টাইফয়েড, কলেরা, কৃমি, চর্মরোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স বর্তমানে বিশ^জুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মাঙ্কিপক্স নাম শুনে বানরের কথা মনে হলেও ভাইরাসটি আসলে সংক্রমিত হয় ইঁদুর, বন্য কুকুর, কাঠবিড়ালি, বানর ও খরগোশের শরীর থেকে। সর্ব প্রথম এটি বানরের শরীরে আবিষ্কার হয়েছিল বলে এমন নামকরণ। ইঁদুর খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। ইঁদুরবাহিত রোগের বিষয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জোয়ারভাটা হয়, সেখানে জোয়ারের সময় আমন ধান পানির নিচে চলে যায়, তখন ফসলের মাঠের ইঁদুর গাছে, হুগলী গাছে, কচুরীপানায় ও অন্যান্য আগাছায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। জোয়ারের সময় দশমিনা বিএডিসি বীজ বর্ধন খামারের প্রতিদিন ১০০-২০০ ইঁদুর ট্যাটা দিয়া মারা হয়। মাঠের ইঁদুর সাধারণত বড় হয়, তাই ট্যাটা দিয়ে নিধন করা যায়। ভরা বর্ষার সময় আমন ফসলের পাশে ইঁদুর কচুরীপানা বা আগাছার স্তূপে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় ট্যাটা দিয়ে ইঁদুর নিধন করলে আমন ফসলে ইঁদুরের উপদ্রব কম হবে। বর্ষার প্রারম্ভে রাস্তাঘাট, বাঁধের ইঁদুর নিধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে এবং আমন ফসলে ইঁদুরের উপদ্রব ও ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। এ সব স্থানে গ্রামবাসীরা দলবদ্ধভাবে একদিন ইঁদুর মারতে হবে।
যারা ইঁদুরের মাংস খায়, তারা জীবন্ত ইঁদুর ধরে থাকে। দিনাজপুরে গর্তের ইঁদুরকে ম্যাটা ইঁদুর বলে থাকে। তাদের ভাষায় ইঁদুরের মাংস মুরগীর মাংসের চেয়ে সুস্বাদ্।ু দুপুরের রান্নার আগে মাঠে ইঁদুর ধরতে যায়। তারা অল্প সময়ে ইঁদুর ধরতে পারে। তারা গর্তের সম্পূর্ণ খুঁড়ে না। গর্তের আকার ও অল্প কিছু খুঁড়ে বুঝতে পারে কোথায় ইঁদুর অবস্থান করছে। ইঁদুরের অবস্থানের কাছে খুঁড়ে সহজে ধরে আনে। এদের ধরার কৌশল তাদের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি পাহাড়ি এলাকায় যারা ইঁদুরের মাংস খায় তারা বন থেকে ইঁদুর ধরে আনে এবং শুঁটকী করে বর্ষামৌসুমের জন্য রেখে দেয়। ইঁদুর ধরার তাদের জ্ঞান ও কলাকৌশল প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। বাগেরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর ও অন্যান্য এলাকায় কিছুলোক নারিকেল ও অন্যান্য ফলজ বৃক্ষের ইঁদুর ধরে থাকে। পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিটি ইঁদুরের জন্য ১০ টাকা নিয়ে থাকে। ইঁদুর ধরার কলাকৌশল অন্যান্য কৃষকদের মাঝে বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।
ইঁদুর বর্ষা মৌসুমে রাস্তাঘাট, রেলরোড ও বাঁধ ও বেড়িবাঁধের গর্ত খোঁড়ার ফলে ভেঙে কোটি কোটি টাকার প্রতি বছর ক্ষতি হয়। এ সকল স্থানের ইঁদুর পরবর্তীতে আমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে। বর্ষার সময় সড়কের ১০০টির বেশি ইঁদুরের গর্ত প্রতি কিমি. পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ১০০ বেশি ইঁদুর বাস করে। দুঃখের বিষয় হলো সংশ্লিষ্ট সংস্থার যেমন সড়কও জনপথ, রেলওয়ে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে ইঁদুর দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ইঁদুর দমন কলাকৌশল বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ কম থাকায় তারা বিষটোপের উপর নির্ভরশীল। ফসলের কুশি স্তরে কৃষকগণ ইঁদুর সাধারণত মারে না। ফসলের থোড় ও পাকা স্তরে ইঁদুর দমন করে থাকে। এতে দমনব্যবস্থা কার্যকর হয় না। প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হতে জনগণকে ইঁদুর দমনে উৎসাহিত করার জন্য ইঁদুর দমন অভিযান পরিচালনা করা হয়। কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ ও দক্ষ জনবল না থাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া বাস্তবে সম্ভব হয় না। এজন্য ইঁদুর জাতীয় প্রাণী দমনে কলাকৌশল উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ ইঁদুর দমন প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই দমন হতে ভিন্ন সঠিক সময়ে, সঠিক প্রযুক্তি ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একজন কৃষক বলেছেন ইঁদুর খুব চালাক, তাই তাকে মারতে হলে জ্ঞান ও বুদ্ধি বেশি হতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
ইঁদুরের দ্বারা ফসল ও সম্পদ রক্ষা করতে হলে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং করে ইঁদুরের দমনব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সবাই মিলে ইঁদুর দমনব্যবস্থা অধিক কার্যকর হয়। সারা বছর ধরে ইঁদুর দমন কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন। সবাই মিলে ইঁদুর প্রতিরোধ করি তবেই বর্তমানে দেশে ভাইরাস মাঙ্কিপক্স রোগ বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে এবং ফসল ও সম্পদ রক্ষা পাবে।
লেখক : রূপায়ণ লোটাস, ৬বি, ১৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০। মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭