ইঁদুরের পরিবেশসম্মত
দমন কৌশল
ড. এস এম মিজানুর রহমান
ইঁদুরবিষয়ক কিছু টুকরো চমকপ্রদ খবর দিয়েই শুরু করা যাক! ২০২১ সালের মধ্য-মার্চে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ইঁদুরের আক্রমণকে সেখানকার কর্তৃপক্ষ ‘অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য সংকট’ হিসেবে অভিহিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। এ ইঁদুর বৃষ্টি (সরপব ৎধরহ) কৃষকের শতভাগ ফসলহানি ঘটানো ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এমনকি অতিষ্ঠ হোটেল মালিকেরা তাদের ব্যবসাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ সংকট সামাল দিতে নীতিনির্ধারকেরা সেদেশে আইনিভাবে নিষিদ্ধ অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ‘ব্রোমাডায়োলোন’ পূর্ণব্যবহারের জন্য ৫০ ভাগ ভর্তুকি সহকারে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সরকার উদ্ভূত সংকট দ্রুত নিরসনে তীব্র বিষ ইঁদুরনাশক জিংক ফসফাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষের কার্যকরী উপাদানের মাত্রাকে দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বছর কয়েক আগে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদু বুহারির লন্ডনে কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থাকাকালীন রাজধানী আবুজাতে তার সরকারি দপ্তরটির বিভিন্ন আসবাবপত্র ইঁদুরকুল এমনভাবে তছনছ ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে, দেশে ফিরে তিনি কিছুকাল বাসা থেকে অফিস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত ৩৭.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন দানাদার ফসল ও ৩.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন শাকসবজির মধ্যে মোট ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (মোট উৎপাদিত ফসলের ৪%) ফসল সাবাড় ও ধ্বংস করেছিল ইঁদুর। বছর কয়েক আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনকে এক সুতোয় গাঁথা ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নান্দনিক অলওয়েদার বা সব ঋতুর সড়ক, যেটি ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, সেটির প্রতিরক্ষা দেয়াল ইঁদুরের কবলে পড়ে এর ভিত দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ ধরনীতে মানুষের পরই সবচেয়ে সফল স্তন্যপায়ী প্রাণি হিসেবে ইঁদুরকে বিবেচনা করা হয়। স্বল্প-প্রজনন চক্র সুবিধা-সম্পন্ন হওয়ায় পরিণত এক ইঁদুরযুগল প্রতি ২১ দিন অন্তর অন্তর নতুন বংশধর উৎপাদন করতে সক্ষম। ভিন্ন ও বৈরী পরিবেশেও ইঁদুরের সমভাবে প্রজনন সক্ষমতার একটি উদাহরণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রায় ছয় বছর ইঁদুরের শুক্রাণুকে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের চেয়ে ১৭০ গুণ বেশি মাত্রার বিকিরণে উন্মুক্ত রেখেও পরবর্তীতে সে শুক্রাণুর সাথে অনিষিক্ত ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে অতি সম্প্রতি জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির সুকুবা স্পেস সেন্টারের বিজ্ঞানীরা ১৬৮টি বাচ্চা ইঁদুর জন্মদান করাতে সক্ষম হয়েছেন। অবিরত কাটাকুটি ছাড়াও ক্রমাগত বিষ্ঠা ত্যাগ করে ইঁদুর মাঠ ও গুদামজাত ফসল, গৃহস্থালি সামগ্রী, বাণিজ্যিক স্থাপনা, কৃষি খামার, কলকারখানা, গবাদিপশুর খামার ইত্যাদিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। মানুষের দেহে লেপ্টোস্পাইরোসিস, প্লেগ, স্ক্রাব ও মিউরিন টাইফাসসহ নানা প্রাণিবাহিত (ুড়ড়হড়ঃরপ) প্রাণঘাতী রোগ ছড়ায়। তাছাড়া ফ্লি, আঠালির পোষক হিসেবে কাজ করে পোষা প্রাণি ও মানুষের প্রভূত ক্ষতি করে।
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাকে প্রধানত দুইভাবে ভাগ করা যায়। অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত দমন এবং বিষ প্রয়োগ বা রাসায়নিক দমন পদ্ধতি। এ নিবন্ধে পরিবেশসম্মত দমন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
আদিকাল থেকে কোন প্রকার বিষ বা বিষটোপ ছাড়া ইঁদুর দমন প্রচেষ্টা চলে আসছে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাধিক্য ঘটলে বিষ বা বিষটোপ ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তবে যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে দমনব্যবস্থা নেয়া শ্রেয়।
পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা
চাষাবাদ পদ্ধতি : জমি তৈরির সময় ন্যূনতম ১৮ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিয়ে, আইল ছেঁটে ছোট বা চিকন রেখে, আইলের সংখ্যা কমিয়ে, নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করে, ইঁদুর-সৃষ্ট গর্ত দূর করে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ৬ ইঞ্চি উচ্চতা ও ৮ ইঞ্চি প্রশস্ততা বিশিষ্ট আইল তৈরি করলে ইঁদুর আইলে গর্ত করে বসবাস করতে পারে না। ইঁদুর আক্রমণপ্রবণ অঞ্চলে ‘শূন্য কর্ষণ কিংবা ‘ন্যূনতম কর্ষণ পরিহার করতে হবে। আখ লম্বা হয়ে বাতাসে ঢলে পড়লে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে। তাই আখ বান্ডল বা গোছা করে বেঁধে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, আহার, বাসস্থান ও পানি এ তিনের যে কোনো একটির অভাব হলে ইঁদুর স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়।
শস্যাবর্তন পদ্ধতি বা শস্যপর্যায় অবলম্বন : গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ধান-আখ-গম শস্যচক্র ইঁদুরের বিস্তার ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ ধান-গম শস্য ব্যবস্থায় ধান কর্তন শেষে ইঁদুর পার্শ্ববর্তী আখক্ষেতে গমন করে এবং আখ কর্তন শেষ হলে পুনরায় গমক্ষেতে ফিরে এসে বাধাহীন জীবনচক্র চালিয়ে যায়। তাই ভিন্ন শস্যপর্যায় অবলম্বন করলে ইঁদুরের স্বাভাবিক বিস্তার ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। ইঁদুর শুকনোর চেয়ে ভেজা মাটি অধিক পছন্দ করে বিধায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়ায় ধান কিংবা গমের স্থলে অন্য কোনো উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যোগ করলে ইঁদুরের আক্রমণ হ্রাস পায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে : বসতবাড়ি, রান্নাঘর, ভা-ার, খাদ্য গুদাম, বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুরপাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীরপাড় ও জমির চারপাশের ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার, অবাঞ্ছিত আগাছা ও ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নির্মূল করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। খড়ের গাদা মাটি হতে ১৮-২৪ ইঞ্চি উঁচুতে মাচা তৈরি করে স্থাপন করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা হ্রাস পায়। মুরগির বিষ্ঠা মুরগির শেড থেকে দূরে রাখলে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমে যায়।
শস্যসূচি মেনে চলে বা একযোগে চাষাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে : মাঠে সবাই মিলে একসাথে ফসল রুয়ে, বুনে ও কেটে আনলে দীর্ঘদিন মাঠে খাবার না পেয়ে ইঁদুরের জন্মহার হ্রাস পেলে পরোক্ষভাবে তা ইঁদুর দমনে সহায়ক হবে। কারণ, ইঁদুর আগাম বোনা ফসলে আহার্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে আগে আক্রমণ করে কিন্তু উক্ত ফসল কর্তন শেষে তদসংলগ্ন অন্য নাবি ফসলে স্থানান্তরিত হয়। তাই বিস্তৃত এলাকায় একই সাথে একই সময়ে পরিপক্ব হওয়া জাত বপন বা রোপণ করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা কমে।
ভৌত ও যান্ত্রিক দমন
ইঁদুরের ফাঁদ পেতে : বসতবাড়িতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরা একটি চিরায়ত আদি দমন পদ্ধতি। কৃষকেরা নিজস্ব উদ্ভাবনী কায়দায় বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার তৈরি ফাঁদ কিংবা বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ফাঁদ ব্যবহার করে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমন করেন। এ সমস্ত ফাঁদে টোপ হিসেবে শুঁটকি মাছ, নারিকেলের টুকরা, কলা, বিস্কুট, রুটি, আম, আলু, চালভাজা ইত্যাদির সাথে কার্বন ডাইসালফাইড মিশ্রিত করে ব্যবহার করলে দ্রুত ভালো ফল পাওয়া যায় (৫০-৬০% বেশি)। ফাঁদে স্ত্রী বা পুরুষ ইঁদুরের মলমূত্র, গায়ের গন্ধযুক্ত টোপ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ফাঁদ ব্যবহার কৌশল ও তা স্থাপনের স্থান নির্ধারণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অন্যথায় ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইঁদুরের আকার-আকৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করা সমীচীন। যেমন- ঘরের নেংটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ দিয়ে বড় আকৃতির মাঠের ধেড়ে কালো ইঁদুর ধরা সম্ভব নয়। এসব ফাঁদ ইঁদুরের চলাচলের পথ বা আনাগোনাবহুল স্থান যথা- ঘরের কিনারায়, দেয়ালের পার্শ্বে, মাচায়, চালের উপর বা গর্তের কাছাকাছি স্থাপন করতে হয়। মাঠে ইঁদুরের টাটকা গর্তের উঠানো মাটির ৩০ সেমি. দূরে টোপসহ ফাঁদ পাততে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ফাঁদে ধৃত ইঁদুর যথাশীঘ্রই সম্ভব সরানো হয় এবং পুরাতন, খারাপ ও মোল্ডযুক্ত টোপ সরিয়ে নতুন টোপ দেওয়া হয়। প্রয়োজনানুযায়ী ফাঁদের সংখ্যা কম হলে সাফল্য হ্রাস পায়। কোন কোন ফাঁদে ইঁদুর ধরা পড়ার সময়ই যাঁতাকলে আটকে মারা যায়। এগুলোকে মৃত্যু-ফাঁদ বা মরণ-ফাঁদ বা কেচিকল বলে। আবার কোন কোন ফাঁদ যেমন-বাঁশের ফাঁদ, বাক্সের ফাঁদ বা শেরম্যান ফাঁদ, তারের খাঁচার ফাঁদ বা ওয়ান্ডার ফাঁদে ইঁদুর জীবন্ত ধরা পড়ে বলে এগুলোকে ‘জীবিত অবস্থায় ধরা ফাঁদ’ বলে। শেরম্যান ফাঁদ টিনের বা লোহার পাত দ্বারা তৈরি এবং এতে স্প্রিং নিয়ন্ত্রিত কপাট আছে। অন্যদিকে ওয়ান্ডার ফাঁদ তারজালি দিয়ে তৈরি এবং তা দ্বারা একসাথে একাধিক ইঁদুর ধরা যায়। ইঁদুরের ফাদ ভীতি কাটানোর জন্য প্রথম ২-৩ দিন এ ফাঁদের মুখ খোলা রেখে স্থাপন করা হয়। ধৃত জীবন্ত ইঁদুর পানিতে ডুবিয়ে মেরে এবং মৃত ইঁদুরসমূহ মাটির গভীরে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। ফাঁদ ইঁদুরের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ কাজে সহায়তা করে, যাতে প্রজাতির ধরন ও ঘনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
আঠা ব্যবহারের মাধ্যমে : সাধারণত র্১দ্ধর্১ আকারের কাঠবোর্ড, মোটা শক্ত কাগজ, টিন, হার্ডবোর্ড ইত্যাদিতে একপ্রকার আঠার প্রলেপ দিয়ে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য লোভনীয় খাবারের টোপসহ ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় রাখা হয়। খাবারের লোভে ইঁদুর আঠার সংস্পর্শে এসে লোমসহ আটকে চলৎশক্তিহীন হয়ে মারা পড়ে। মৃত ইঁদুর পশমসহ শীঘ্রই সরিয়ে নিয়ে নতুন আঠার প্রলেপ লাগিয়ে পুনঃস্থাপন করা যায়। বাজারে ‘ঘড় জধঃ’, ‘জধঃ এষঁব’, ‘অষষ ঞৎধঢ়’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক নামে আঠাসমূহ বেশ কার্যকর ও সমাদৃত।
গর্তে পানি ঢেলে অথবা ধোঁয়া দিয়ে : পানির উৎস সহজ হলে ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে শ্বাসরোধ করে বা পিটিয়ে ইঁদুর নিধন কার্যকরী। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ কাজটি বেশ সোৎসাহেই করে থাকে। গর্তে গরম পানি ঢাললে ইঁদুর তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসে। গমের ক্ষেতে দিনের বেলায় সেচ দিলে গর্তের ইঁদুর বের হয়ে আসে। সেচ দেওয়ার সময় জমির চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে পিটিয়ে ইঁদুর নিধন করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকনা মরিচ-পোড়া ধোঁয়া বা খড় জ্বালানো ধোঁয়া ইঁদুরের গর্তে ঢুকিয়েও ইঁদুর দমন ফলদায়ক। পানি বা ধোঁয়া প্রয়োগ করার সময় গর্তের মুখগুলো জাল দিয়ে ঢেকে দিলে ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে জালের ভেতর আটকা পড়ে পালাতে পারে না। একসাথে অনেক লোক মিলে দলবদ্ধভাবে এ ব্যবস্থা নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাঠে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হলে সেচের পানি দ্বারা কয়েকদিন প্লাবিত রেখে ইঁদুর দমন করা যায়।
গর্ত খনন করে : ইঁদুরের গর্ত লম্বায় ১৫ মিটারের বেশি এবং গভীরতায় প্রায় ১ মিটার হয়ে থাকে। তাই জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয় না। তবে ফসল কর্তনের পর মাঠে বা ক্ষেতের আইলের গর্তের মাটি খুঁড়ে ইঁদুর নিধন করা যায়। কিছু আদিবাসীর খাবার মেন্যুতে ইঁদুর একটি উপাদেয় খাদ্য।
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে/ইঁদুর প্রতিরোধক্ষম ব্যবস্থা : দালানকোঠা, ঘরবাড়ি ও খাদ্যগুদামে দরজা-জানালা, গ্রিল, পাইপের খোলা মুখ ও অন্যান্য ইঁদুর প্রবেশ্য স্থানের ফাঁক-ফোকরে ধাতব পাত বা তারজালি লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং চলাচল প্রতিহত করা সম্ভব। পানির ট্যাপের ছিদ্র, ভাঙা ড্রেন সর্বদা মেরামত করতে হবে যাতে ইঁদুরের জন্য পানি সহজলভ্য না হয়। ঘরে ড্রাম, মটকা, টিনের পাত্র ইত্যাদিতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্যসামগ্রী সংরক্ষণ করলে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সম্ভব হলে শস্যাধারের মেঝে পাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে নারিকেল, সুপারিসহ অন্যান্য ফলদ বৃক্ষে মাটি হতে ২-৩ মিটার উপরে গাছের খাঁড়া কা-ের চারদিকে ৪৫-৬০ সেমি চওড়া টিনের মসৃণ পাত শক্ত করে আটকাতে হবে যাতে ইঁদুর উপরে উঠতে না পারে। এক গাছের সাথে অন্য গাছের সংযোগ থাকতে পারবে না।
বৈদ্যুতিক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে : ইঁদুরের চলাচলের পথে অল্প বিদ্যুতায়িত তারের বেড়া স্থাপন করে ইঁদুর দমন সম্ভব। ইঁদুর তারের বেড়ার সংস্পর্শে আসলে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়। তবে এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় অধিকতর সাবধানতা আবশ্যক। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাধীন প্লটে এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
জৈবিক দমন
কেবল পরিবেশ বিধ্বংসী রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে ইঁদুর নিধনযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয়। তাই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে পরিবেশবান্ধব জৈবিক দমনের দিকে। পরভোজী প্রাণীর মধ্যে দিবাচর শিকারি পাখি যেমন- ঈগল, তিলা বাজ, হেরিয়াল চিল; নিশাচর শিকারি পাখি যেমন- লক্ষী পেঁচা, ব্রাউন হক আওল (ঙষি); স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন- বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, পাতি শিয়াল, খেঁকশিয়াল, বাগডাস, বেজি; সরীসৃপ যেমন- সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি দৈনিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইঁদুর শিকার করে ইঁদুরের আধিক্য কমায়। একটি লক্ষ্মী পেঁচা প্রতি রাতে ১-৬টি (গড়ে ১.৫৮টি) ইঁদুর শিকার করে। কিন্তু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় ও অবৈধ শিকারিদের উৎপাতে প্রকৃতিতে এসব উপকারী প্রাণির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান ও অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ইঁদুরভুক উপকারী প্রাণিকুলের নির্বিচার নিধন বন্ধে ও সংরক্ষণে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফসল ক্ষেতে পাখি বসার ডাল পুঁতে দিলে এদের ইঁদুর ধরা সহজ হয়। গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল দ্বারাও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অণুজীবীয় জৈবিক দমনের অংশ হিসেবে প্রটোজোয়া পরজীবী ঞৎুঢ়ধহড়ংড়সধ বাহধংর যা গবাদিপশুতে ট্রিপ্যানোসোমিয়াসিস রোগ সৃষ্টি করে তা পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণাগারে ঘরের ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর দমনে শতভাগ সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাণিবাহিত রোগ বিষয়ে গঠিত কমিটি মানুষ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় এ অনুজীবঘটিত ইঁদুরনাশকের ব্যবহারিক প্রয়োগে সতর্কতা জারি করেছে। বিভিন্ন বহিঃপরজীবী যেমন-মাকড়, আঠালি, ফ্লি, উঁকুন শুধু ইঁদুরের রক্ত শোষণ করে না, এদের দেহে নানা রোগ-জীবাণুর সংক্রমণও ঘটায়। তাছাড়া অন্তঃপরজীবী হিসেবে ইঁদুরের দেহে ২০০টিরও বেশি প্রজাতির ফিতাকৃমি ও সুতাকৃমি শনাক্ত হয়েছে।
ইঁদুর আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বিরাট হুমকি। ইঁদুর দমনে কোন একক পদ্ধতি শতভাগ কার্যকর নয়। আমাদের কাছে এমন কোন হ্যামিলিনের মোহন বাঁশিও নাই যাতে নিমিষেই ইঁদুরের বংশকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। ইঁদুরের আচরণগত জটিলতা ও পরিবেশে অধিক অভিযোজন ক্ষমতার কারণে প্রচলিত দমন পদ্ধতিসমূহ কম ফলদায়ক। ইঁদুরের উচ্চপ্রজনন ক্ষমতার কারণে দমন পদ্ধতি শেষে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট জনসংখ্যা এবং দমনের আওতার বাইরের এলাকা থেকে অনুপ্রবেশেকারী সদস্যগণ থেকে ইঁদুর শীঘ্রই পূর্ব জন-ঘনত্বে ফিরে আসে। তাই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমনে একইসাথে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। তাছাড়া এদেরকে শুধুমাত্র কৃষি-আপদ হিসাবে বিবেচনা না করে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, নগর কর্তৃপক্ষ, রেল মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে সম্পৃক্ত করে আদর্শ পরিচালন পদ্ধতি (ঝঙচ) অনুসরণপূর্বক সফলভাবে ইঁদুর নিধন সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭; মোবাইল : ০০৮৮-০১৭১২১২৭০৭৭, ই-মেইল:smmizanur@gmail.com; smmizanur@sau.edu.bd;