Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জাতীয়-ইঁদুর-দমন-অভিযান-২০২৪

জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান ২০২৪
জনাব মোঃ ছাইফুল আলম
কৃষিই বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রাণ। অনাদিকাল থেকে এদেশের মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে আসছে। কৃষি খাতে বর্তমানে নিয়োজিত জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১৮ লক্ষ ৩০ হাজার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ (ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪)। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১-৭২ সালে এ দেশের মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। এভাবেই একদিকে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ, বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। আধুনিক প্রযুক্তি ও সঠিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুকৌশলে বালাই সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতাসহ প্রকৃতির বৈরী প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে মাঠপর্যায়ে কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলাই কৃষকের মূল লক্ষ্য। মাঠ থেকে শুরু করে গোলাঘর পর্যন্ত কৃষকের অন্যতম শক্র ইঁদুর। রোডেনশিয়া বর্গের মিউরিডি পরিবারের এই ছোট্ট প্রাণীটি বিশ্বের অনিষ্টকারী প্রাণীদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। সব ধরনের খাদ্যে অভ্যস্ত হওয়ার সামর্থ্য ও অত্যধিক প্রজনন ক্ষমতার দরুন পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজনে দক্ষতা এই বর্গের সাফল্যের মূল কারণ। 
ইঁদুর অত্যন্ত চতুর, নিশাচর ও নীরব ধ্বংসকারী প্রাণী। বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। সারা পৃথিবীতে ১৭০০টির বেশি ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি আছে। এর মধ্যে ২০-২৫টি প্রজাতি অনিষ্টকারী জাত হিসেবে চিহ্নিত (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর)। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা গিয়েছে। 
ইঁদুরের চোয়ালের ওপর-নিচে মিলিয়ে মোট দুজোড়া লম্বা ধারালো দাঁত থাকে। একে বলে কৃদন্ত (ওহপরংড়ৎ), যা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো বাটালির মতো। জোড়া দাঁত চোয়ালের সাথে সরাসরি যুক্ত এবং এই জোড়া দাঁতে রূট ক্যানেল না থাকায় সামনের কৃদন্তগুলো আজীবন বাড়তে থাকে। এই বর্ধিষ্ণু দাতঁকে স্বাভাবিক রাখতেই এরা প্রতিনিয়ত কাটাকাটি করে। ইঁদুর যে পরিমাণ ভক্ষণ করে তার দশগুণ কেটে নষ্ট করে। আমাদের দেশে যে ইঁদুরগুলো দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে বাদামি ইঁদুর, গেঁছো ইঁদুর, বাতি বা সেলই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, কালো বড় ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রাণী। এরা যে কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বংশধরের সৃষ্টি করতে পারে। এরা সন্তান জন্ম দেয়ার দুই দিনের মাথায় আবারও গর্ভধারণ করতে পারে। গর্ভধারণ কাল ১৮-২২ দিন। ইঁদুর বছরে ৬ থেকে ৮ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ৪ থেকে ১২টি বাচ্চা দিতে পারে। তিন মাসের মধ্যে বাচ্চা বড় হয়ে আবার প্রজননে সক্ষম হয়ে উঠে ।
মানুষের সঙ্গে ইঁদুরের লড়াইয়ের ইতিহাস খুব পুরনো। ইঁদুর সাধারণত তিনভাবে মানুষের ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত মাঠের কৃষিশস্য খেয়ে, দ্বিতীয়ত গুদামজাত খাদ্যশস্য ভোগ ও কলুষিত করে; তৃতীয়ত মানুষ এবং পশুপাখির মারাত্মক রোগের জীবাণু বহন করে। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জরপব জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব (ওজজও) ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ১১টি দেশকে চিহ্নিত করেছে। ফসলের মোট ক্ষতির বিবেচনায় ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন।  দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে প্রতি বছর ইঁদুর দেশে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ধান ও গমের ক্ষতি করে থাকে যার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুদামজাত শস্য ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ইঁদুর মাঠের শাকসবজি, দানাজাতীয়, মূলজাতীয়, ফলজাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবার এরা গুদামঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে (প্রায় শতকরা ২০ ভাগ)। তাছাড়া ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে, ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর খামার প্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে থাকে। গবাদিপশু ও পোল্ট্রিতে ইঁদুর কমপক্ষে ৪৫টি রোগের বাহক হিসেবে স্বীকৃত, যেমন- সালমোনেলোসিস, পাস্তুরেলোসিস, লেপ্টোস্পাইরোসিস, সোয়াইন ডিসেন্ট্রি, ট্রাইকিনোসিস, টক্সোপ্লাজমোসিস এবং জলাতঙ্ক (মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ তথ্য দপ্তর নিউজ পোর্টাল)। ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে পরের দুই শতাব্দী ধরে চলা জাস্টিনিয়ান প্লেগ মহামারিতে সারা পৃথিবীর প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ) প্রাণ হারায়। এই প্লেগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর। আবার ১৩৫০ সালে দ্য ব্ল্যাক ডেথ নামে খ্যাতি পাওয়া বুবোনিক প্লেগে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশেও কিছু কিছু রোগ ইঁদুরবাহিত দেখা গেছে, যেমন লেপটোস্পাইরোসিস। রাসুল (সা.) এই ইঁদুরের ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। হজরত  আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সূত্রে হাফসা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচ প্রকার প্রাণী হত্যা করায় তার কোনো দোষ নেই। যেমন : কাক, চিল, ইঁদুর, বিচ্ছু ও পাগলা কুকুর।’ (বুখারি, হাদিস : ১৭০৯)
ইঁদুরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৯৮৩ সাল থেকে ইঁদুর দমন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এবারও বিগত অভিযানের ন্যায় ‘ইঁদুর দমন অভিযান ২০২৪’ এর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করি এ অভিযানে সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পাবে। 
ইঁদুর দমন  অভিযান  ২০২৪ এর  উদ্দেশ্য
 কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম এসব ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা;
 কৃষি কর্মীদের মাধ্যমে ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাপনাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোঁড়ায় পৌঁছানো;
 ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
 আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখা;
 গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা;
 রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর দমনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
 ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা;
 সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের ব্যাপারে জোর দেয়া।
অভিযানের সময় ও উদ্বোধন
প্রতি বছর এক মাসব্যাপী ইঁদুর দমন অভিযান সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর দমন অভিযান, ২০২৪ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করা হবে। গত বছরের অভিযানের  ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর দমনকারীদের মাঝে পুরস্কার  প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলা  পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদ/জেলা পরিষদ/প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যান/ পৌরসভার চেয়ারম্যান/ মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/উপজেলা চেয়ারম্যান/তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করতে হবে।
ইঁদুর দমনে পুরস্কার প্রদান
জাতীয় ইঁদুর দমন অভিযান ২০২৪ বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক  পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হবে। অঞ্চলে অতিরিক্ত পরিচালকগণ  নিজ  অঞ্চলের পুরস্কার পাবার যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই-বাছাইপূর্বক মনোনয়নের তালিকা সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে সদর দপ্তরে প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ও অঞ্চল পর্যায়ের পুরস্কারের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রদান করা হয় যা জাতীয় কমিটির মাধ্যমে  চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গত বছরের ইঁদুর নিধকারীদের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে ৫টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হবে। যারা পুরস্কারের  জন্য নির্বাচিত হন তাদের ক্রমানুসারে  ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে।
ইঁদুর আমাদের বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ। তাই ইঁদুর দমনের পদ্ধতি হতে হবে পরিবেশসম্মত, যাতে অন্যান্য উপকারী জীবের কোন ক্ষতি না হয়। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। ইঁদুর দমনে আধুনিক ও কার্যকরী উপকরণ এবং প্রশিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই। ইঁদুর সামাজিক প্রাণী, দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং দলগতভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। এছাড়া এরা সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে। তাই ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। ইঁদুর দমনের কার্যকরী কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন। ইঁদুর দমনের বিভিন্ন কলাকৌশল ও অন্যান্য বিষয় সকলকে অবহিত করার জন্য এ পুস্তিকায় বিষয়গুলো সহজ তথা সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করা যায় এ সমন্বিত ইঁদুর দমন কার্যক্রম সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে ইঁদুর দমনকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করবে এবং আমাদের মাঠ ফসল, গুদামজাত শস্য, ঘরবাড়ি অন্যান্য সম্পদ ও অবকাঠামো রক্ষায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
 
লেখক : পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি  সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৫৫০২৮৭২৩, ই-মেইল :dppw@dae.gov.bd