মৎস্য বর্জ্যরে বাণিজ্যিক ব্যবহার
ও রপ্তানি সম্ভাবনা
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বর্তমানে দেশে বছরে ৪৫ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মাছের বর্জ্যও তৈরি হচ্ছে। সাধারণত একটা মাছের দৈহিক ওজনের ২০-২৫% বর্জ্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তাহলে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত মাছ থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ বর্র্জ্য তৈরি হয়। এই মৎস্য বর্জ্যকে যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায় তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশের দূষণ কমিয়ে আনা যাবে, অন্য দিকে উৎপাদিত এসব বর্জ্যগুলো মানসম্পন্ন উপজাতপণ্য হিসেবে রূপান্তরিত করতে পারলে তা থেকে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। মাছের বাজারে বিক্রীত মাছ কাটিয়ে নেবার সময় মাছের আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, পটকা, ফুলকা, চিংড়ি মাছের মাথা ও খোলসসমূহ ইত্যাদি বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রক্রিজাতকরণ কারখানায় বিশেষ করে চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছের মাথা, লেজ, আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি ইত্যাদি বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব বর্জ্যকে যদি সঠিক উপায়ে বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে মূল্যবান পণ্যে রূপান্তরিত করা যায় তবে এসব উপজাত পণ্য থেকে অর্থ উপার্জন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। মাছের বর্জ্যসমূহে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, তেল, ফাইবার ও অনান্য জৈব উপাদান বিদ্যমান থাকে, যেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারায় একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এগুলোর পচনের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় সব মাছ বাজারেই মাছ কেটে বিক্রি হয় ফলে এসব বাজারে বিপুল পরিমাণ মৎস্য বর্জ্য উৎপাদিত হয়, এসব বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ করার পাশাপশি বিভিন্ন প্রকার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্য বর্জ্যকে সম্পদে এ রূপান্তরিত করা সম্ভব। মৎস্য বর্জ্য থেকে উৎপাদিত এসব মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্যের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা আমাদের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। মৎস্য বর্জ্যসমূহ থেকে উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য কিছু পণ্যের পরিচিতি, ব্যবহার ও উৎপাদন কলাকৈৗশল তুলে ধরা হলো।
মাছের আঁইশ ও আঁইশ থেকে উৎপাদিত পণ্যসমূহ
মাছের সারা শরীরজুড়ে বিস্তৃত আবরণ হলো আঁইশ, যা মাছ কাটার পর সাধারণত ফেলে দেওয়া হয় কিন্তু এই মাছের আঁইশ একটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য বর্জ্য যা আমিষ ও ক্যালসিয়ামে ভরপুর। মাছের আঁইশে সাধারণত ৬৫-৬০ শতাংশ আমিষ, ৩০-৪০ শতাংশ হাইড্রোক্সি পেপটাইট থাকে। মাছের আঁইশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কোলাজেন/কোলাজেন পেপটাইট, হাইড্রোক্সি পেপটাইট, জৈবসার, ঔষুধের ক্যাপসুল আবরণ, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন প্রকার মহামূল্যবান দ্রব্য ঊৎপাদন করা সম্ভব। কোলাজেন হাড়, ত্বক এবং প্রাণীর সংযোগকারী টিস্যুতে উপস্থিত একটি তন্তুযুক্ত প্রোটিন। মাছের আঁইশে প্রধানত কোলাজেন থাকে এবং এই কোলাজেনে সোডিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম এই খনিজ লবণগুলো পাওয়া যায়। গড়ে মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ বর্জ্যের ৩০%-ই হলো প্রোটিন কোলাজেন। কোলাজেনে তুলনামূলকভাবে উচ্চ পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে যেমন- গ্লাইসিন, প্রোলিন এবং হাইড্রোক্সপ্রোলিন যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কোলাজেনকে নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈবিকভাবে সক্রিয় পেপটাইড হিসেবে রূপান্তর করা যায়, যা ফার্মাসিউটিক্যাল, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ/সংরক্ষণ শিল্পের জন্য দরকারী। মাছের আঁইশ থেকে উৎপাদিত হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট জৈবিকভাবে নিরাপদ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এটি সস্তা কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত। হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট মানুষের দেহের মধ্যে দাঁত এবং হাড় গুলিতে পাওয়া যায়। হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট এবং ক্যালসিয়াম ফসফেট ভিত্তিক উপকরণ হাড় প্রতিস্থাপনের জন্য টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। মাছ বাজারে বর্জ্য হিসেবে পরিচিত মাছের আঁইশ ফেলে না দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনিতীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
মাছের ত্বক ও মাছের ত্বক থেকে উৎপাদিত পণ্য সমূহ : মাছের আঁইশের নিচে মসৃণ যে আবরণ দেখা যায় তা হলো মাছের ত্বক। মাছ বাজারে মাছ কাটার সময় অনেক ক্রেতা মাছের চামড়া বা ত্বক ছুলে নেন, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় ফলে প্রচুর পরিমাণ মাছের ত্বক উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশের যে সকল কোম্পানি প্রক্রিয়াজাতকরণ মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করে তাদের দৈনিক বিপুল পরিমাণ মাছের ত্বক উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছের ত্বক সাধারণত আমাদের দেশে তেমন কোন কাজে না লাগলেও বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিছু মাছের ত্বক সরাসরি আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চামড়া দ্রুত রিকভারিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে যেমন-তেলাপিয়া। মাছের ত্বক প্রক্রিয়াজাতকরণ করে যে শুষ্ক চামড়া উৎপাদিত হয় তার বিদেশে বৃহৎ রপ্তানি বাজার রয়েছে। মাছের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রকম অর্নামেন্টাল কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন-মহিলাদের পোশাক, ব্যাগ, প্যান্টসহ বিভিন্ন পণ্যের আকর্ষণীয়তা বাড়াতে মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়া ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও মাছের ত্বক নির্দিষ্ট সেপে কেটে মেরিনেটিং করে মোখরোচক চিপস বানানো যায় যা একদিকে পুষ্টি জোগাবে অন্যদিকে মৎস্য বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
মাছের নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা, কাঁটা ও পাখনার ব্যবহার : মাছ বাজারে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে বর্জ্য উৎপাদিত হয় তা হলো মাছের নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, ফুলকা ও রক্ত। শুধু মাছ বাজার না, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি, শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র সহ যেখানেই মাছ কাটা হয় সেখানেই বিপুল পরিমাণ মাছের নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা, পাখনা, রক্ত ও অনান্য বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মাছের নাড়িভুঁড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে একদিকে মাছের তেল এবং অন্যদিকে ফিশমিল উৎপাদন করা হ্য়। মাছ থেকে উৎপাদিত তেল ও ফিশমিল মাছ, মুরগি, গরু, হাঁসসহ অন্যান্য প্রাণির খাদ্যে আমিষ ও চর্বির উৎস্য হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে ফিশ অয়েল বা মাছের তেল এবং ফিশমিলের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ পণ্য গুলোর দেশের ফিডমিলগুলোতে যেমন চাহিদা রয়েছে অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা আছে। মাছের রক্ত, নাড়িভুঁড়ি দিয়ে ফিশ সাইলেজ নামক এক ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান উৎপাদন করা হয় যা প্রাণি খাদ্যে ব্যবহার করে প্রাণির পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, এছাড়াও মাছের সকল বর্জ্য পচন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উন্নতমানের সার তৈরি করা হয় যা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে অধিক ফলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মাছের বর্জ্যরে কোন অংশই ফেলনা নয় তাই এগুলোর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করা এখন সময়ের দাবি।
বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছের পাখনার বিদেশে রপ্তানি সম্ভাবনা ব্যাপক। হাঙ্গরের পাখনা খুবই মূল্যবান একটি মৎস্য পণ্য যা বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মাছের পাখনা সাধারণত উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মাছের ফেলে দেওয়া কাটাগুলোকে যদি প্রক্রিয়াজাত করে পাউডার করা যায় তাহলে এটির দেশে ও বিদেশে ক্যালসিয়াম, মিনারেলস ও ফসফরাসের উৎস্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মাছের বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বায়ো ডিজেল, আঁঠাসহ বিভিন্ন প্রকার মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন করা যায় যেগুলোর ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে।
মাছের পটকা ও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিছু মাছের পটকা সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চীনে এগুলো ফিশ মাও নামে পরিচিত এবং স্যুপ এ পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও কোলাজেনের উৎস হিসাবে খাদ্য শিল্পে মাছের পটকা ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত মাছের পটকা থেকে ৮০% পর্যন্ত কোলাজেন প্রোটিন পাওয়া যায়। এমনকি মাছের পটকা থেকে একটি শক্তিশালী, পানি প্রতিরোধী আঠা তৈরি হয় এবং মাছের পটকা থেকে অপারেশনের সেলাই করার সুতা তেরি করা হয়, যা মানুষের শরীরের কাটা স্থান শুকানোর সাথে সাথে শরীরের সাথে মিশে যায় ফলে সুতা কাটার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ থেকে মাছের পটকা সাম্প্রতিক সময়ে শুকানো অবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজাতিভেদে ৪০-৬০ হাজার টাকা কেজি দরে রপ্তানি হচ্ছে।
চিংড়ির ও কাঁকড়ার খোলকের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও রপ্তানি সম্ভাবনা : আমাদের দেশের মাছ বাজার, চিংড়ি ও কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাসমূহে ও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ব্যাপক চিংড়ির খোলক খাওয়ার অযোগ্য পণ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। চিংড়ি ও কাঁকড়ার এসব ফেলে দেওয়া অংশে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে তাই এগুলো অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ির ফেলে দেওয়া খোলক থেকে কাইটিন ও কাইটোসেন নামক মূল্যবান ঔষধি গুণসম্পন্ন পণ্য উৎপাদিত হয় যার বিদেশে রপ্তানি সম্ভাবনা ব্যাপক। চিংড়ি ও কাঁকড়ার খোলক ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় এগুলো গুঁড়ো করে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন করা যেতে পারে। চিংড়ির খোলক থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আলাদা করে ইতোমধ্যে আম, লিচু, আনারসহ বিভিন্ন গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক রাসায়নিক প্রস্তুত করা হচ্ছে যা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাজারে বাড়ছে মাছের চাহিদা ফলশ্রুতিতে বাজারে মৎস্য বর্জ্যরে উৎপাদন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। উৎপাদিত মৎস্য বর্জ্যরে সিংহভাগই ফেলে দেওয়া হয় বা পুঁতে ফেলা হয়। মাছের কোন অংশই ফেলনা নয় তাই সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মৎস্য বর্জ্যগুলোকে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। মৎস্য বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহার করতে গেলে অসংখ্য কল-কারখানা গড়ে উঠবে যেখানে প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থান হবে অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হবে। মৎস্য বর্জ্যসমূহের সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব যেগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদশিক মুদ্রা আয় করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪-৫৬২৬১৫৩