Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কাঁঠালের-ফল-ছিদ্রকারী-পোকা-দমন-ব্যবস্থা-প্রযুক্তি

কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন ব্যবস্থা প্রযুক্তি
ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ১ মোঃ মেহেদী হাসান শরীফ২
কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। আকারের দিক থেকে কাঁঠাল সবচেয়ে বড় ফল। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কাঁঠালের চাষ হয়, তবে ঢাকার উঁচু অঞ্চল, সাভার, ভালুকা, ভাওয়াল ও মধুপুর গড়, বৃহত্তর সিলেট জেলার পাহাড়ি এলাকা, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকায় সর্বাধিক পরিমাণে কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, আমিষ ও ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। দামের তুলনায় এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোন ফলে পাওয়া যায় না। কাঁচা ফল তরকারি, পাকলে ফল হিসেবে এবং বীজ, ময়দা ও তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ ভেজেও খাওয়া যায়।
কাঁঠালের এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা মাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণের কারণে এর উৎপাদন ও বিদেশের বাজারে রপ্তানি ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কাঁঠালের কিছু প্রধান ক্ষতিকর পোকার মধ্যে একটি হলো কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা। নিচে এই পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা 
পোকা চেনার উপায় : পূর্ণাঙ্গ মথের রঙ হালকা বাদামি; পাখার উপর পর্যায়ক্রমে গাঢ় বাদামি ছোট ছোট দাগ দেখা যায়; কীড়ার দেহের প্রতি খ-ে পশম বা শুঁয়া আছে; কীড়া দেখতে ধূসর বর্ণের যা ফলের আক্রান্ত অংশে পাওয়া যায় ও ক্ষতি করে।
আক্রমণের পর্যায় : ফলের বাড়ন্ত পর্যায় আক্রমণ হয়। ফেব্রুয়ারি-জুন মাসে সাধারণত এই পোকার আক্রমণ দেখা যায়। পোকা ফলের যে কোন স্থানে আক্রমণ করতে পারে। তবে বিশেষ করে ফলের বোঁটায় কিংবা দু’টি ফলের সংযোগ স্থানে আক্রমণের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকার জীবনচক্র
ডিম অবস্থায় : প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পোকার ডিম পাড়ার মাধ্যমে জীবনচক্র শুরু হয়। এই ডিমগুলো সাধারণত কাঁঠাল ফলের পৃষ্ঠে বা বাঁকলের ফাটলে পাড়ে; ডিমগুলো ছোট, ডিম্বাকার আকৃতির এবং সাদা-হলুদ রঙের হয়।
লার্ভা অবস্থায় : প্রায় ৫-৭ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ডের পর ডিম থেকে লার্ভা হয়; লার্ভা কাঁঠাল গাছের ফল বা কা-ে প্রবেশ করে এবং ভেতরে খাবার খায়; লার্ভা বাদামি মাথার ক্যাপসুলসহ ক্রিমি-সাদা রঙের হয়; তারা ফলের সজ্জার মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ করে, ফলে ক্ষতি করে এবং ফলের গুণমান হ্রাস করে।
পিউপা অবস্থায় : লার্ভা পরিণত অবস্থায় পৌঁছানোর পরে, তারা গাছ থেকে বেরিয়ে যায় এবং মাটিতে বা গাছের গোঁড়ার চারপাশে পুত্তলি দশা সম্পূর্ণ করে; পুত্তলি পর্যায় প্রায় ১০-১৪ দিন স্থায়ী হয়; পুত্তলি সাধারণত মাটির পৃষ্ঠের ঠিক নিচে লার্ভা দ্বারা নির্মিত মাটির কোষগুলোতে পাওয়া যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় : পুত্তলি পর্যায় শেষ করার পর, পূর্ণবয়স্ক পোকা মাটি থেকে বের হয়; প্রাপ্তবয়স্ক কাঁঠাল পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো পোকা হয় যাদের ডানার উপর স্বতন্ত্র চিহ্ন থাকে; এরা নিশাচর এবং রাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে; প্রাপ্তবয়স্ক পোকা কাঁঠাল গাছের পাতা এবং কোমল কা- খায়; পরবর্তী প্রজন্ম শুরু করার জন্য তারা সঙ্গী এবং স্ত্রীরাও ডিম পাড়ে।
প্রজনন চক্র : কাঁঠাল পোকার প্রজনন চক্র সাধারণত উপযুক্ত হোস্টে (কাঁঠাল গাছ) প্রাপ্যতা এবং তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশগত অবস্থার সাথে মিলে যায়; অনুকূল পরিস্থিতিতে কাঁঠাল পোকা এক বছরের একাধিক প্রজন্মের মধ্য দিয়ে যেতে পারে।
কাঁঠাল পোকার জীবনচক্র বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ যেমন : তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত দ্বারা প্রভাবিত হয়; উষ্ণতাপমাত্রা এবং উচ্চআর্দ্রতা সাধারণত তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল; তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা জলাবদ্ধতা তাদের বেঁচে থাকার প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্ষতির লক্ষণসমূহ : এ পোকার আক্রমণে ফল ছিদ্র, ছিদ্রে পোকার মল ও কালো দাগ দেখা যায়। ফল কাটলে ভেতরে কীড়া দেখা যায়; এ পোকার কীড়া বাড়ন্ত ফলের গা ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং শাঁস খেতে থাকে; আক্রান্ত ফল বেঁকে যায় বা ফেটে যায় এবং বৃষ্টির পানি ঢুকে ফল নষ্ট হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
ব্যাগিং পদ্ধতি : পরাগায়ন শেষ হয়েছে এমন ফলে পাতলা পুরাতন কিংবা নতুন যে কোন পাতলা কাপড় দ্বারা আবৃত (ব্যাগিং) করে রাখলে এ পোকা আর ফলের গায়ে ডিম দিতে পারে না এবং ফল আক্রান্ত হয় না। তবে মনে রাখতে হবে পরাগায়নের পূর্বে কোন ফলে ব্যাগিং করা যাবে না এবং একমাস পর তা খুলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সব ফলকে একই সময় ব্যাগিং করতে হবে এমন নয়। যখন যে ফলের পরাগায়ন শেষ হবে তখন সেই ফলকে ব্যাগিং করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষ পদ্ধতি : পূর্ণাঙ্গ স্ত্রীপোকা কচি ফলের গায়ে, কাঁঠাল জন্মানো উপযোগী কচি শাখার ডগায় এবং ফুলের কুঁড়িতে ডিম পাড়ে। এসময় ডিম থেকে সদ্য বের হওয়া কীড়ার কিছু সংখ্যক সুস্থ ফলকে আক্রমণ করে এবং কিছু সংখ্যক আক্রমণ শেষে বাড়ন্ত ফলের আশে-পাশের শুকনো অবশিষ্টাংশ ইত্যাদিতে লুকিয়ে থাকে। এসকল আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেললে পোকার আক্রমণ শতকরা ৯০ ভাগ কমানো যায়। এ ছাড়া ফল একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে তা শনাক্ত করে একটি সরু কাঠির সাহায্যে খুঁচিয়ে কীড়া বের করে মেরে ফেলা। আক্রান্ত অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিলে ঐ অংশ সুস্থ হয়ে উঠে। এ পদ্ধতিও পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী।
নিমতেল স্প্রে দ্বারা দমন : সাধারণত জানুয়ারি মাসে কাঁঠাল গাছে ফুল আসার সাথে সাথে এ পোকা ডিম পাড়ে। এসময় কাঁঠালের মুচি বের হওয়ার পূর্বে একবার, ৫০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ২০ দিন অন্তর আর একবার এবং ১০০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ৪০ দিন অন্তর আরও একবার মোট তিনবার ১০ মিলি নিম তেল ও ৫ মিলি মিনি স্যাম্পু ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে কাঁঠাল গাছের ফলে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা সম্ভব।
কীটনাশক স্প্রে : সাধারণত কাঁঠালে কীটনাশকের ব্যবহার হয় না। কারণ কীটনাশকের ব্যবহার পরাগায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং যা পরিবেশবান্ধব নয়। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ কীটনাশক ব্যবহার করতে চান তবে সবিক্রন ৪২৫ ইসি ২মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কাঁঠালের মুচি বের হওয়ার পূর্বে একবার, ৫০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ২০ দিন অন্তর একবার এবং ১০০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ৪০ দিন অন্তর আরও একবার মোট তিনবার স্প্রে করলে ৮০-৯০ ভাগ পর্যন্ত এ পোকা দমন করা সম্ভব।
এছাড়াও আক্রান্ত মঞ্জুরি ও ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলা; ফল বেশি ঘন থাকলে পাতলা করে দেওয়া; ছিদ্র দিয়ে বড় সুচ বা লোহার রড ঢুকিয়ে পোকা মেরে ফেলা; চিকন রড দিয়ে ছিদ্র পরিষ্কার করে এর অভ্যন্তরে কেরোসিন, পেট্রোল বা উদ্বায়ী কীটনাশক সিরিঞ্জের মাধ্যমে ঢুকিয়ে কাদা বা মোম দিয়ে ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিলে অভ্যন্তরে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় এবং পোকা মারা যায়; গর্তের মুখে প্যারাডাইক্লোরোবেনজিন প্রবেশ করিয়ে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে; সিরিঞ্জের মাধ্যমে কেরোসিন মিশ্রিত পানি বা কীটনাশক মিশ্রিত পানি ছিদ্রের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ছিদ্রের মুখ কাদা মাটি দিয়ে লেপে দিলে ভেতরে অবস্থিত পোকা মারা যাবে; সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ২ মি.লি/লি হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা; সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন: কট বা রিপকর্ড বা সিমবুস বা ফেনম বা আরিভো ১০ ইসি ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার পুরো গাছে স্প্রে করুন; ফুল আসার সময় সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিনে অন্তত   ২-৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
সাবধাণতা ও করণীয় : স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই ফল খাওয়া ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন; ফল সংগ্রহ করা শেষ হবার পর প্রতিটি গাছের ফলের বোঁটা, মরা ডাল বা রোগ বা পোকা আক্রান্ত পাতা ও ডাল অপসারণ করে অনুমোদিত একটি ছত্রাকনাশক ও একটি কীটনাশক স্প্রে করে দিতে হবে; বাগান/গাছ সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন; ফল সংগ্রহ শেষে মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডাল পালা ও অতিঘন ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। ঝরে পড়া কাঁঠাল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। কাঁঠালের সংখ্যা বেশি হলে পাতলা করে দিলে ফল বড় হয়। পাশাপাশি লেগে থাকা দুটি কাঁঠালকে কাঠি দিয়ে ফাঁকা করে দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে ছিদ্রে শিক বা বড় সুই ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে ভেতরের পোকা মেরে ফেলা যায়।
ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান প্রায়োরিটি প্রোডাক্টের উদ্যোগে কাঁঠাল উৎপাদনের প্রচার এবং এর রপ্তানি সম্ভাবনা অন্বেষণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এ ছাড়াও দেশে ওসিওপি বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধানে ও সুবিধার্থে একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কাঁঠালের মূল্য শৃঙ্খল বিশ্লেষণ,কৃষকদের জন্য সক্ষমতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, এফসিভি দ্বারা অর্থায়িত একটি বৈশ্বিক প্রকল্প এবং একটি টিসিপি প্রকল্পসহ বেশ কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

লেখক : ১অধ্যাপক ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, ২শিক্ষার্থী (এমএস), কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল : ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd