প্রচলিত
সারের তুলনায় ন্যানো সারের উপকারী প্রভাব
ড. মো: শহিদুল ইসলাম
ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির মাইক্রো ফ্লোরা বা উপকারী অণুজীব দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের কার্যক্ষমতা কমে যায়, অনেক সময় তারা মারাও যায়। মাটির রাসায়নিক এবং ভৌতিক গুণাবলি বিনষ্ট হয়, ফলে মাটির উর্বরতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। রাসায়নিক সারের ব্যবহার ১৯৫২ সনে ২৬৯৮ টন অ্যামোনিয়াম সালফেটের মাধ্যমে শুরু হয়ে বর্তমানে তা ৬৬ লক্ষ টনে পৌঁছেছে। এর মাধ্যে ইউরিয়া ২৭ লক্ষ টন, টিএসপি ও ডিএপি মিলে ২৩.৫ লক্ষ টন, মিউরেট অফ পটাশ ১০ লক্ষ টন, জিপসাম ১.৫ লক্ষ টন দস্তা সার ১.৫ লক্ষ টন, বোরণ সার ৪০ হাজার টন এবং অন্যান্য সকল (অ্যামোনিয়াম সালফেট, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, এনপিকেএস) মিলে ১.৬ লক্ষ টন ব্যবহৃত হচ্ছে।
সার ব্যবহারের তধ্য অনুযায়ী দেখা যায় ইউরিয়া সারের ব্যবহার ব্যাপক। ইউরিয়া সার প্রতিক্রিয়াশীল হ্্ওয়ার ফলে ইহার প্রয়োগে মাটির গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরিবেশ দূষিত হয় এবং মাটির স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১০০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে যে অম্লতার সৃষ্টি হয় তা প্রশমিত করার জন্য ৭৪ কেজি চুন ব্যবহার করতে হয়। রাসায়নিক সার পানিতে দ্রবণীয় হওয়ার কারণে প্রয়োগের পরে চোয়ায়ে মাটির নিচে চলে যায়। বেলে মাটিতে চোয়ানো প্রক্রিয়া অনেক বেশি। আবার কোন কোন সারের যেমন টিএসপির ফসফেট আয়ন অম্লীয় মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম এবং লৌহ পুষ্টি উপাদানের সহিত স্থিরকরণ প্রক্রিয়ায় সহজলভ্যতা হারিয়ে ফেলে।
চুনযুক্ত ক্ষারীয় মাটিতে মাইক্রোনিয়ট্রিয়েন্ট দস্তার সহজলভ্যতা এমনিতেই কম, আবার ফসফেট আয়নের সহিত আবদ্ধ হলে লভ্যতা বহুলাংশে কমে যায়। এ মাটিতে পটাশিয়াম আয়ন স্থিরকরণ প্রক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই সহজেই অনুমেয় বিভিন্ন মাটিতে রাসায়নিক সার হতে গাছের নিকট পুষ্টির প্রাপ্যতা সমান নয়। মাটির প্রকারভেদে সারের সুপারিশ ভিন্নতর হয়ে থাকে। এটা এখন সময়ের দাবি, এমন সার উদ্ভাবন করা দরকার - যা হবে পরিবেশবান্ধব এবং অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ - যা গাছকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মৃক্তিকা পরিবেশে পুষ্টি উপাদান সব সময় সরবরাহ করতে পারবে।
ন্যানো সারের উপকারী প্রভাব
ন্যানো সার এমন একটি সার যা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যাবহার করে তৈয়ার করা হয়েছে। প্রচলিত সারের তুলনায় এ সারের অনেক উপকারী প্রভাব রয়েছে যা নি¤েœ বর্ণনা করা হল।
পুষ্টির শোষণ বৃদ্ধি : ন্যানো সার গাছের শিকড় দ¦ারা পুষ্টি শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ন্যানো আকারের কণাগুলোর একটি বৃহত্তর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল রয়েছে যা উদ্ভিদের শিকড়গুলোর আরও মিথষ্ক্রিয়া করতে দেয় যার ফলে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং আরও তাদের মতো অন্য পুষ্টি উপাদানের উন্নত গ্রহণকে সহজতর করে।
উন্নত পুষ্টি দক্ষতা : প্রচলিত সারগুলো প্রায়শই লিচিং, উদ্বায়ীকরণ এবং রানঅফের মতো সমস্যায় ভোগে, যার ফলে পুষ্টির অদক্ষ ব্যবহার এবং পরিবেশ দূষণ হয়। ন্যানো সারগুলো থেকে পুষ্টি আয়ন ধীরে ধীরে এবং সুনির্দিষ্টভাবে মুক্ত হয়, যার ফলে পুষ্টির অপচয় কম হয় এবং পরিবেশগত খারাপ প্রভাব বহুলাংশে কমে যায়।
লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টি সরবরাহ : ন্যানো প্রযুক্তি ন্যানো আকারের ক্যারিয়ারের মধ্যে পুষ্টির এনক্যাপসুলেশন সক্ষম করে এবং নির্দিষ্ট উদ্ভিদ টিস্যুতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পুষ্টি সরবরাহ করে। ফলে গাাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এতে সারের অপচয় অনেক কম হয়।
বর্ধিত পুষ্টির স্থায়িত্ব : ন্যানো সার পুষ্টির স্থায়িত্ব উন্নত করতে পারে, মাটির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং অণুজৈবিক ক্রিয়াকলাপ বা কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করে। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে যে সকল অবক্ষয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে,
তা দূরীভূত হয়। এ বর্ধিত স্থিতিশীলতা উদ্ভিদে পুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করে। ফলে টেকসই বৃদ্ধি সম্ভব হয় এবং উৎপাদন বেড়ে যায়।
পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস : পুষ্টির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ক্ষতি হ্রাসের মাধ্যেমে ন্যানো সার পরিবেশ দূষণ হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। দূষণের এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টির প্রবাহ থেকে পানির দূষণ এবং সার উৎপাদন ও প্রয়োগ থেকে গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন।
কাস্টমাইজযোগ্য ফর্মুলেশন : ন্যানো প্রযুক্তি কণার আকার, আকৃতি এবং পৃষ্ঠের বৈশিষ্টগুলোর সুনির্দিষ্ট নিয়স্ত্রণের অনুমতি দেয়, নির্দিষ্ট ফসলের চাহিদা এবং মাটির অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য করে কাস্টমাইজড সার তৈরি করতে সক্ষম করে। এ নমনীয়তা সর্বোত্তম পুষ্টি সরবরাহ এবং উদ্ভিদ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে কৃষির উৎপাদনশীলতা সর্বাধিক বৃদ্ধি করে।
টেকসই কৃষির সাথে সামঞ্জস্য : ন্যানো সার টেকসই কৃষির সকল উপকরণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি সমর্থন করে। এ সার দক্ষ পুষ্টি সরবরাহ করে টেকসই কৃষি মাধ্যমে অধিক খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখতে পারে।
প্রয়োগকৃত মাত্রা কমানো : ন্যানো সারের বর্ধিত দক্ষতা এবং গাছের লক্ষ স্থানে সরবরাহের কারণে প্রয়োগমাত্রা প্রচলিত সারের সুপারিশ মাত্রার চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ কমানো যেতে পারে। এটি কৃষকদের জন্য ব্যয় সাশ্রয়ী এবং পরিবেশগত প্রভাব আরও হ্রাস করতে পারে।
সহজভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সূচকে প্রচলিত এবং ন্যানো সারের তুলনামূলক চিত্র সারণি দ্রষ্টব্য।
যদিও ন্যানো সার কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, টেকসই কৃষির নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং দূষণ থেকে মাটিকে রক্ষা করে, তথাপি মাটির স্বাস্থ্য, উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বাস্তÍÍতন্ত্রের গতিশীলতার উপর উহার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো পুরাপুরি বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ সারের ব্যাপক প্রচলন করতে হলে কৃষকের সামর্থ্য, অ্যাকসেযোগ্যতা এবং নিয়ন্ত্রক অনুমোদন প্রয়োজন। এ চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং শিল্প ষ্টেকহোল্ডদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গবেষণা এবং উন্নয়ন শক্তিশালী, পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত এবং এ সারগুলোর নিরাপদ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত প্রবিধান প্রণয়ন করা অত্যান্ত জরুরি।
লেখক : প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ই-মেইল : dmsislam12@gmail.com মোবাইল : ০১৭১৩০০২১৮০