Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

মিশ্র-ফল-চাষে-সমৃদ্ধ-দিনাজপুর-উদ্যোক্তাদের-মুখে-হাসি

মিশ্র ফল চাষে সমৃদ্ধ দিনাজপুর 
উদ্যোক্তাদের মুখে হাসি
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
উত্তরের শেষ সীমানার একটি গ্রাম। গ্রামের সামনের পিচঢালা পথের পাশে হঠাৎ যেন দেখা মেলে এক সবুজ সম্ভারের। চারপাশে ধানক্ষেতের মাঝে মনে হয় এক টুকরো অরন্য প্রবেশ করেছে। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলেই প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। হরেক রকম রঙ-বেরঙের ফল ও সবজির এক টুকরো স্বর্গরাজ্য বলে মনে হয় প্রায় দুই একরের এই জায়গাটিকে। 
বলছিলাম দিনাজপুরের বীরগঞ্জে অবস্থিত তাসনিয়া এগ্রোফার্মিং এন্ড রিসার্চ সেন্টারের কথা। যার স্বত্ব¡াধিকারী কৃষিবিদ ইমরুল আহসান। পেশায় সহকারী উদ্যান উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইমরুল আহসানের স্বপ্নগুলো যেন তার এই বাগানে বাস্তবের মুখ দেখেছে। ইমরুল আহসানের বাগানে দেখা মেলে হরেক প্রজাতির আম, মাল্টা, কমলা, আপেল, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, জাম্বুরা, নারিকেল, সফেদা, আমড়া, কামরাঙ্গা, মিষ্টি তেঁতুলসহ নানা প্রজাতির ফল। এ ছাড়া আছে নানারকম মৌসুমি সবজি, করেছেন মাছ চাষ, হাঁস-মুরগী পালনসহ নানাবিধ             কৃষিকাজ। 
চাকরির পাশাপাশি এমন  বাগান করার কথা কেন তার মাথায় আসলো আর কিভাবেই বা তিনি এটা পরিচর্যা করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন খুব ছোটবেলা থেকেই তার গাছের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। বড় হয়ে পড়াশোনা করেছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে। চাকরিও করেন কৃষি বিভাগে। এগুলো যেন তাকে গাছের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। সহধর্মিণীও কৃষিবিদ দুজনে মিলে গড়ে তোলেন এই শখের খামার। প্রাথমিক অবস্থায় শখ থাকলেও বর্তমান এ বাগান ঘিরে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অনেক মানুষের।
বাগান তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে তিনি জানান অধিকাংশ ফলগাছ যেহেতু স্থায়ী ধরনের তাই দেখে শুনে ফলগাছ লাগানো প্রয়োজন। গাছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সুস্থ সবল ভালো গঠনের চারা/কলম নির্বাচন করা প্রয়োজন। বর্ষার আগে ফলগাছ লাগানো উত্তম। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধা থাকলে সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। ঝড় বাতাসে গাছের গোড়া যাতে নড়ে না যায় এজন্য গাছের গোড়ায় শক্ত খুঁটি দেওয়া দরকার। গাছের ঠিকমতো বৃদ্ধি ও ফলদান ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে ও বর্ষার শেষে ফলগাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা উচিত। একই সাথে মাটিতে রস কম থাকলে সেচ প্রয়োগ করা উচিত। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় সার না দিয়ে কিছুটা দূরে প্রয়োগ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, ফল বাগান সবসময় আগাছামুক্ত রাখা দরকার। পানি দেওয়ার ফলে গোড়ার মাটির উপরিভাগ শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে মাটিতে বাতাস চলাচল করতে শিকড় ছড়াতে এবং মাটিতে রস সংরক্ষণ ব্যাহত হয়। এজন্য গাছের গোড়ার চারিদিকে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটি আলগা রাখা প্রয়োজন। গাছ লাগানোর শুরু থেকেই গাছের গোড়ায় গজানো অতিরিক্ত ডালসহ রুগ্ন দুর্বল অফলন্ত ডাল নিয়মিত ছাটাই করতে হবে। বাগানে সীমিত আকারে প্রয়োজনানুসারে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেন তিনি। নিয়মিত বাগানের আশেপাশের ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করেন যার ফলে রোগ ও পোকামাকড় কম হয়। বাগানে তিনি সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পোকা দমন করেন। তিনি তার বাগানে যেসব গাছে কলম করেছেন সেটির প্রথম বছরের ফুল ভেঙে দেন যাতে গাছ দুর্বল না হয়ে যায়। এ ছাড়া বাগানে ফুল ফল ঝরা কমানো এবং ফল ধরতে সহায়তার জন্য গাছে ফুল আসার ২৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার ফ্লোরা স্প্রে করেন।
ইমরুল আহসানের বাগানে নানা প্রজাতির আমের দেখা মেলে। হাড়িভাঙ্গা, আ¤্রপালি, বারি-৩, বারি-৪, ল্যাংড়া, ব্যানানা, সূর্যডিম, মিয়াজাকি, আশ্বিনা, ফজলি, গৌরমতি, মল্লিকাসহ নানারকম আমের সমারোহ। তিনি তার বাগানের অনেক পুরনো অনুন্নত গাছকেও উন্নত জাতে রূপান্তর করেছেন। তার কাছে জানতে চাই কিভাবে তিনি অনুন্নত গাছকে উন্নত জাতে রূপান্তর করেছেন। 
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান তিনি ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অনুন্নত আম গাছের সমস্ত শাখা-প্রশাখা কেঁটে দেন। পরর্বতীতে জুন-জুলাই মাসে যখন নতুন ডাল গজায় সেখানে তিনি ভিনিয়ার/ক্লেফট পদ্ধতিতে উন্নত জাতের কলম করেন। কলমের নিচ থেকে কুশি বের হলে সেগুলো তিনি নিয়মিত অপসারণ করেন। তিনি জানান এভাবে প্রায় ২-৩ বছরের মধ্যে অনুন্নত আম গাছ উন্নত জাতে রূপান্তিত হবে।
 নিরাপদ বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য তিনি ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে। তিনি জানান, আমের আকার যখন মার্বেলের সাইজের হয় তখন তিনি ফ্রুট ব্যাগিং শুরু করেন। দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ তিনি ব্যাগিংয়ের জন্য ব্যবহার করেন। ব্যাগিং করার পূর্বে তিনি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করেন। তিনি বলেন, আম ব্যাগিং করলে রোগ পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা যায় এবং আম সংগ্রহ করার পর ১০-১৫ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায় এবং ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়া আম বাগানে তিনি বিভিন্ন আন্তঃফসল চাষ করেন। যেমন- টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক প্রভৃতি। এতে করে বাড়তি মুনাফা অর্জন হয় বলে তিনি জানান।
আমের রেশ কাটতে না কাটতে বাগানে শুরু হয় মাল্টা ও কমলার ধুম। নানা জাতের সুমিষ্ট স্বাদের কমলা শোভা পায় তার বাগানে। স্বাদে বর্ণে গন্ধে অতুলনীয় এই কমলার বাজারমূল্য বেশ ভালো বলে তিনি জানান।
কিভাবে কমলা চাষে ভালো ফলন পেতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন চারা রোপণের ৩-৪ মাস পর থেকে তিনি নিয়মিত সার দেওয়া শুরু করেন। প্রতি গাছে তিনি প্রায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে ৫০ সেমি. দূরে চারদিকের মাটি কুপিয়ে সেখানে ছিটিয়ে দেন। এরপর তিনি সেচ দেন। মাঘ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসে তিনি এ সার প্রয়োগ করেন। এ ছাড়াও বছরে দুইবার জিংক সালফেট, তুত ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট মিশিয়ে পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করেন তাতে গাছ সুস্থ ও সতেজ থাকে। এতে ফলন বাড়ে এবং ফলের স্বাদ ভালো হয় তার প্রতিটি গাছে ৩০০-৮০০টি ফল ধরে। প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রয় করে গাছ প্রতি তার আয় হয় প্রায় ৮০০০ টাকা। এদেশে কমলা গাছে ভালো ফলন না হওয়ার পেছনে দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন ইমরুল আহসান। বাগানে সার প্রয়োগ ও যতেœর অভাব হলে বাগানে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকারক ফসল, রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়। এ ছাড়া ম্যাগনেসিয়াম তামা ও দস্তার অভাব মাটি থেকে সার চুইয়ে চলে যাওয়া, জৈবসার ব্যবহার না করা, সময়মতো সেচ না দেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কমলার আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে দিনাজপুরের মাটিতে খুব ভালো মানের কমলা পাওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
ইমরুল আহসানের স্বপ্ন ছিল একটি জার্মপ্লাজম সেন্টার তৈরি করার। যেখানে নানা প্রজাতির গাছ থাকবে। সেই স্বপ্ন্ পূরণে তিনি তার এগ্রো ফার্মটি নানা রকম ফল, সবজি দিয়ে সাজিয়েছেন। তার বাগানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো আপেল।
তার বাগানে দেখা যায় থোকায় থোকায় ঝুলছে ভিনদেশি আপেল। ৩ বছর বয়সি গাছগুলোর উচ্চতা প্রায় ৮-১০ ফুট। ডালে ডালে সবুজ আপেল যেন এক বিস্ময় তৈরি করেছে স্থানীয় মানুষের মাঝে। সামার রাম্বু, হরিমন, কাশ্মিরি এনা, অস্ট্রেলিয়ানসহ প্রায় ১২ প্রজাতির আপেল গাছ আছে তার বাগানে। আপেল নিয়ে রীতিমতো  গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। গত বছর তার গাছে খুব অল্প সংখ্যক আপেল ধরেছিল কিন্তু এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিটি গাছ যেন আপেলের ভারে নুইয়ে পড়েছে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য তার বাগানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দর্শনার্থীর চাপ। বাংলাদেশে এত সুন্দর আপেল হতে পারে এ যেন অনেকের কাছে বিষ্ময়। ইমরুল আহসান জানান সঠিক পুষ্টি উপাদান ও কিছু হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করে এবার তার আপেলের বিপুল ফলন হয়েছে। তিনি জানান আপেলের জন্য তাপমাত্রা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব জায়গায় আপেলের চাষ সম্ভব হবে না। আপেল চাষের জন্য চিলিং তাপমাত্রা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ ১০০-৪০০ ঘণ্টা তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা।
লো চিলিং অর্থাৎ ১০০ ঘণ্টার নিচে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবুজ আপেলটা হয়, যা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষযোগ্য। দেশের ফলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ইমরুল আহসান আপেল নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
দেড় একরের তাসনিয়া এগ্রো ফার্ম এন্ড রিসার্চ সেন্টারে আছে ৭০ রকমের ফলের ৫০০ প্রজাতির গাছ। কৃষিবিদ দম্পতি হিসেবে কৃষির প্রতি ভালোবাসা ছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। তাই তা চাকরির পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বিশাল বাগান। সে সাথে নার্সারিও গড়ে তুলেছেন যাতে করে মানুষ সঠিক জাতের গাছ কিনতে পারেন। শখ ভালোবাসা দায়িত্বশীলতা পাশাপাশি অনেক লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন ইমরুল আহসান। তার অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু তিনি ঢেলে দিতে চান কৃষির পেছনে। তাকে দেখে উৎসাহী হয়ে বাগান করেছেন অনেকেই। বিনামূল্যে তাদের তথ্যসেবা দিয়ে যান তিনি। তার স্বপ্ন এই দিনাজপুরের মাটি একদিন ফলের রাজধানী। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি তৈরি হবে খাঁটি সোনায়। বাংলাদেশ হবে ফল ফসলে সমৃদ্ধ।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৬৮৪০; ই-মেইল :Dhaka@ais.gov.bd