Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

স্বাস্থ্যসম্মত-ও-নিরাপদ-শুঁটকি-উৎপাদন

স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন
এ. এম. ফরহাদুজ্জামান১ মেহেদী হাসান ওসমান২ মোঃ সুজন খান৩ মোঃ নেয়ামুল হাসান শোভন৪ 
বাংলাদেশ জলজ সম্পদে পরিপূর্ণ। প্রাচুর্য ভরা এই সম্পদ আরও প্রাচুর্যময় হয়ে ওঠে আবহমান বাংলার চিরাচরিত ঋতু বিচিত্রতার মিশেল বন্ধনে। বর্ষার পর যখন পানি নেমে যায় তখন স্বাদুপানির এলাকায় মাছ ধরার ধুম পড়ে। একযোগে প্রচুর মাছ ধরা পড়ায় টাটকা মাছ বিপণনের পাশাপাশি মাছ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে এক বিশাল জনগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিল, হাওর, বাঁওড় এলাকায় স্বল্পমেয়াদ নির্ভর শুঁটকিমাছ ব্যবসায়ীরা মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। এ কাজে নারীকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো যা নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শুঁটকিমাছ উৎপাদনে সম্ভাবনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সামুদ্রিক মাছের শুঁটকির চাহিদা ও আগ্রহের পাশাপাশি স্বাদু পানির মাছের শুঁটকির প্রতি সব শ্রেণির ভোক্তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রঙ, স্বাদ ও গন্ধে স্বাদুপানির মাছের শুঁটকির একটি নিজস্বতা আছে, যা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এ ছাড়াও রুচিবর্ধক ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারগুলোর মধ্যে শুঁটকি অন্যতম।
শুঁটকি মাছের গুরুত্ব : আবহমানকাল থেকেই বাংলায় শুঁটকি তৈরির প্রচলন এবং শুঁটকি মাছের বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। পুষ্টিগুণ হিসেবেও শুঁটকি মাছের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ১০০ গ্রাম শুঁটকিমাছ হতে প্রায় ৬২ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম উপকারী ফ্যাট এবং প্রচুর পরিমাণে ‘ভিটামিন এ’ ও ‘ভিটামিন ডি’ পাওয়া যায়। তাজা মাছের তুলনায় শুঁটকিতে ক্ষণিজ লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাজা মাছের তুলনায় শুঁটকি মাছের দামও অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাই স্বল্পপরিসরে শুঁটকি উৎপাদন ও বিক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। স্বল্পখরচে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরির অস্বাস্থ্যকর দিকগুলো : প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ আহরণের পর তা সরাসরি রোদে শুকনো হয় যার ফলে মাছে নোংরা, ময়লা, ধুলা, কাদা ইত্যাদি থেকেই যায়। উন্মুক্ত পরিবেশে শুকানোর ফলে কুকুর, বিড়াল, মাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের সংক্রমণ ঘটে থাকে। কখনো কখনো শুঁটকিমাছে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, যার ফলে তা খাবার উপযোগী থাকে না। বাসি বা পচা মাছ হতে তৈরিকৃত শুঁটকি গুণগত মানসম্পন্ন হয় না।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া : স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাছ আহরণ থেকে শুরু করে মোড়কজাত ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উত্তম ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ধাপে সতর্কতার সাথে গাইডলাইন অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
প্রয়োজনীয় উপকরণসূহ : স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন করতে প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে- সংগ্রহকৃত সতেজ মাছ; মাছ ধোয়ার জন্য পরিষ্কার পাত্র বা বাকেট; ছুরি, চাকু ও চপিং বোর্ড; লবণ; মশারি; ৭.৫ ফিট দৈর্ঘ্য, ৪ ফিট প্রস্থ এবং ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের মাচা; মাচার ওপর বিছানোর জন্য ছোট মেশের নেট; শুঁটকিমাছ সংরক্ষণের জন্য পলিথিন প্যাকেট ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর্যায়ক্রমিক ধাপসমূহ  
া  স্থানীয় বাজার বা পুকুর/বিল/নদী হতে মাছ আহরণ বা সংগ্রহের পর উত্তমরূপে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ধুয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বরফ আবৃত করতে হবে;
া  শুঁটকি তৈরির সময় অবশ্যই সতেজ মাছ ব্যবহার করতে হবে। কোন অবস্থাতেই বাসি বা পঁচা মাছ ব্যবহার করা যাবে না। সংগ্রহের সাথে সাথে মাছগুলোকে প্রয়োজন (প্রজাতি/পুরুত্ব/গুণগত মান) অনুসারে বিভিন্নভাগে আলাদা করা যেতে পারে;
া সংগৃহীত মাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে তার আইশ ও নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করতে হবে এবং পুনরায় পরিষ্কার পানি দিয়ে উত্তমরূপে ধৌত করতে হবে। অতপর তা পরিষ্কার চালুনির ওপর রেখে মাছের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে ফেলতে হবে;
া  পানি ঝরানোর পর মাছগুলোকে ১৫-২০ মিনিট ৬-১০% লবণ পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে;
া  মাছগুলোকে লবণ পানি হতে উত্তোলন করে পুনরায় চালুনির ওপর রেখে মাছের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে ফেলতে হবে;
া এরপর মাছগুলোকে মশারির অভ্যন্তরে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মাচায় স্থানান্তর করে সরাসরি সূর্যালোকে উত্তমরূপে শুকাতে হবে। মাছের প্রজাতি, মাছের আকার, সূর্যালোকের উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত বায়ু প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে শুঁটকি তৈরি হতে ৪-৬ দিন সময় লাগে। উত্তমরূপে শুকানোর পর উৎপাদিত শুঁটকিতে পানির পরিমাণ ২০% এর কম হতে হবে। মাছগুলোকে সমানভাবে শুকানোর জন্য প্রয়োজনে কয়েকবার উল্টিয়ে দিতে হবে। ৭.৫ ফিট দৈর্ঘ্য, ৪ ফিট প্রস্থ এবং ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের মাচায় এক একবার ৫ কেজি মাছ শুঁটকি তৈরি করা যায়; এবং
া  উৎপাদিত শুঁটকি বায়ুশূন্য পলিথিনে মোড়কজাত করে ঠা-া ও শুষ্কস্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে এক কেজি সতেজ মাছ থেকে প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রাম শুঁটকি উৎপাদন করা যায়।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকিমাছ উৎপাদনে করণীয় বিষয়সমূহ :
ক্স শুঁটকি তৈরির সময় সর্বদা স্বাস্থ্যসম্মত বিধি অনুসরণ করা উচিত। ব্যবহার্য সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে ও পরে ভালোভাবে পরিষ্কার করা উচিত এবং এতে ক্লোরিন পানি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়;
ক্স মাছ শুকানোর আগে লবণ দ্রবণে চুবিয়ে নিলে মাছে মাছি ও পোকামাকড় আক্রমণ কম হয়;
ক্স শুঁটকিমাছ সঠিকভাবে শুকানো উচিত, যাতে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি না থাকে; পানির পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে শুঁটকির গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয়; এবং
ক্স উন্মুক্ত স্থানে শুঁটকি মজুদ বা গুদামজাত না করে বায়ু নিরোধক পাত্রে শুঁটকি গুদামজাত করা উচিত। এ ছাড়া বায়ু নিরোধক পলিথিন ব্যাগও ব্যবহার করা যায়।
মলা মাছের শুঁটকি হতে সম্ভাব্য আয়-ব্যয় : একটি বাঁশের মাচা (৭.৫ ফুট দ্ধ ৪ ফুট দ্ধ ৩ ফুট)- ১০০০/- টাকা, প্লাস্টিকের বাকেট ১টি- ৫০০/- টাকা, ছুরি বা চাকু ১টি- ২৫০/- টাকা, চপিং বোর্ড ১টি- ২৫০/- টাকা, মশারি ও নেট ১টি-৫০০/- টাকা, মটকা ২টি-১০০০/- টাকা (মোট স্থায়ী ব্যয়- ৩৫০০/- টাকা), মলামাছ ৫ কেজি- ১০০০/- টাকা, লবণ ১ কেজি- ১৫/- টাকা, পলিথিন প্যাকেট ২৫০ গ্রাম- ১০/- টাকা (মোট পরিচালন ব্যয়- ১০২৫/- টাকা)। ৫ কেজি সতেজ মলামাছ থেকে প্রায় ১.৭৫/- কেজি মলা শুঁটকি উৎপাদন করা যায়। প্রতি কেজি মলামাছের শুঁটকি ১২০০/- টাকা টাকায় বিক্রয় করা হলে ১.৭৫ কেজি শুঁটকির বিক্রয়মূল্য হবে ২১০০/- টাকা। অর্থাৎ, ৪র্থ সাইকেল থেকে উদ্যোগটি লাভ-ক্ষতির সাম্যাবস্থা (ব্রেক ইভেন পয়েন্ট) অতিক্রম করবে। পরবর্তীতে ৪-৬ দিনের একটি সাইকেলে নিট মুনাফা হবে (২১০০-১০২৫)= ১০৭৫/- টাকা।
 
লেখক : ১ব্যবস্থাপক, ২-৩উপব্যবস্থাপক; ৪সহকারী ব্যবস্থাপক, মোবাইল নম্বর: ০১৭২১২২১৯৮৮; পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা