Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

উন্নত-জাতসমৃদ্ধ-পাটশাকের-বছরব্যাপী-চাষাবাদ-প্রযুক্তি

উন্নত জাতসমৃদ্ধ পাটশাকের বছরব্যাপী চাষাবাদ প্রযুক্তি
ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাটের পাতার বহুল ব্যবহার প্রচলিত আছে। পাট সাধারণত বর্ষা মৌসুমের ফসল, তখন বেশির ভাগ এলাকায় পাটশাক সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেশের দুটি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যথা বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরই) ও বাংলাদেশ পরমাণু  কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাটের চারটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যা প্রচলিত আঁশ হিসেবে চাষকৃত জাতের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ ফলন দেয়। পাটশাকের পুষ্টিগুণ, সুস্বাদুতা ও ঔষধিগুণের বিষয়াদি নিয়ে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ ও ব্যাপক প্রচারণা করা গেলে ভবিষ্যৎ পুষ্টি ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে।
পাটশাকের উন্নত জাতসমূহ
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ দেশি পাটশাকের একটি উন্নত জাত। এ জাতটি খাট, বেশি পাতা বিশিষ্ট ও মিষ্টি স্বাদযুক্ত। এ জাতের গাছ সম্পূর্ণ সবুজ এবং পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের। জাতটি সমগ্র বাংলাদেশে বপন উপযোগী। এ ছাড়া জাতটিতে আমিষ, আঁশ, ভিটামিন-সি, অ্যাশ, কার্বহাইড্রেট এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (ভিটামিন-এ) বিদ্যমান। এ জাতটি থেকে কোন প্রকার আঁশ পাওয়া যায় না। কারণ গাছটি খুবই খাট। দেশি জাত হওয়া সত্ত্বেও এ জাতের পাতা মিষ্টি স্বাদযুক্ত হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অন্যান্য জাতের চেয়ে বেশি। এ জাতের পাট গাছের বয়স ৩৫-৪০ দিন হলে তখন থেকেই শাক খাওয়া যায়। প্রথমে ছোট চারা গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের ডগা ছিঁড়ে শাক খাওয়া যায়। ডগা খাওয়ার কিছুদিন পর শাখা-প্রশাখা থেকে কচি পাতা বের হলে সেগুলোও শাক হিসেবে খাওয়া যায়। এভাবে বেশ কয়েকবার শাক সংগ্রহ করা যায়। বিজেআরআই পাটশাক-১ একবার চাষ করে দীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত শাক সংগ্রহ করা যায়। বাড়ির ছাদে/বারান্দায় কয়েকটি টবে পাটশাক চাষ করে ছোট পরিবারের শাকের চাহিদা সহজেই পূরণ করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর পাতার ফলন প্রায় ৩.০-৩.৫০ টন/হেক্টর। মাঠ পর্যায়ের ফলাফলের ভিত্তিতে বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ সারা দেশে চাষযোগ্য সবচেয়ে ভাল জাত। 
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর তুলনায়   আকারে ছোট। ম্যাড়াশাক (লাল) নামে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে পরিচিত। এটিকে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কৃষকের নিকট জনপ্রিয়।  এ জাতের পাটশাকে আমিষ, ভিটামিন-সি, আঁশ এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (ভিটামিন-এ) পাওয়া যায়। এ জাতের পাটগাছ গাছের কা-, পাতার বৃন্ত ও শিরা গাঢ় লাল। পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের ও মিষ্টি স্বাদযুক্ত। এ জাতটি মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের শেষ (ফাল্গুন মাস থেকে মধ্য কার্তিক) পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে মার্চ থেকে জুলাই এর শেষ (মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য শ্রাবণ) পর্যন্ত সময়ে বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ এর পাতার ফলন প্রায় ৩.০০-৩.৫০ টন/হেক্টর।
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ আকার বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর তুলনায় ছোট। গাছের কা-, পাতার বৃত্ত ও শিরা গাঢ় সবুজ। পাতা মিষ্টি স্বাদযুক্ত ও গাঢ় সবুজ বর্ণের। এ জাতটিও  বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে জনপ্রিয়। জাতটি আমিষ, ভিটামিন-সি, আঁশ, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ (ক্যারোটিন) এবং আঁশ সমৃদ্ধ। এ জাতটি ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের শেষ পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত সময়ে বীজ বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। পাট গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে শাক সংগ্রহ করা শুরু হয়। তবে এ জাতে দ্রুত ফুল এসে যায় বলে এক বা দুই ধাপেই শাক সংগ্রহ করতে হয়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ এর ফলন ৩.০-৪.০ টন/হেক্টর। তবে বীজ বপনের সময় ভেদে ফলনের তারতম্য হতে পারে। 
বিনা দেশি পাটশাক-১ : বিনা পাটশাক-১ জাতটি খাটো। এ জাতটি থেকে কোনো প্রকার আঁশ পাওয়া যাবে না। অন্যান্য জাতের চেয়ে পাতার সংখ্যা ও আয়তন বেশি। পাতা দেখতে গাঢ় সবুজ ও সতেজ; ফলে বাজারে চাহিদা বেশি। শাক-পাতার ফলন হেক্টরে প্রায় সাড়ে তিন টন। অন্যান্য জাতের তুলনায় এ জাতটির পাতায় ভিটামিন-এ পরিমাণ বেশি (১০,৭০০ মাইক্রোগ্রাম/ ১০০গ্রাম)। এ জাতটি বপন করার ৩০ দিনের মধ্যে পাটশাক তোলা যায়। তবে এ জাতটির পাতার শাক অন্যান্য যে কোন জাতের তুলনায় তিতা বেশি। 
বপনের সময়
পাটশাক চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ২৪-৩৭০ সে.। তাই ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাস ব্যতীত বছরের যে কোন সময় সবজি হিসেবে পাট পাতার উৎপাদন করা সম্ভব। ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি (ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে আগস্ট মাস) সময়ের মধ্যে বীজ বপন করলে ফলন বেশি হয়। তবে  ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পাটশাক চাষাবাদের জন্য বর্তমানে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করা হচ্ছে। তবে বৃষ্টির সময় বপন না করা উত্তম। 
চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত জমি
পানি জমে থাকে না এ রকম সব ধরনের দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তবে বেলে দো-আঁশ থেকে এঁটেল মাটিতে পাটশাক চাষ করা যায়। এ ছাড়া বাড়ির আঙ্গিনা ও উর্বর অনাবাদি প্রান্তিক জমিতে চাষ করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় পাটশাক চাষ করা যায়।
জমি তৈরি
মাটির প্রকারভেদে আড়াআড়ি ৩-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে এবং আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে পরবর্তীতে সেচ প্রয়োগ, পানি নিষ্কাশন ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। 
বীজহার
সারিতে বপন করলে ৬-৭ কেজি/হেক্টর, ছিটিয়ে বপন : ৮-১০ কেজি/হেক্টর। প্রতি ১০ কেজি বীজে ২৫ গ্রাম ভিটাভ্যাক্স-২০০ বা ব্যাভিস্টিন ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজ শোধনের জন্য মাত্রানুযায়ী ছত্রাকনাশক (প্রতি ১০ কেজি বীজে ২৫ গ্রাম ভিটাভ্যাক্স-২০০ বা ব্যাভিস্টিন) মিশিয়ে একটি বদ্ধ পাত্রে ৪৮ ঘণ্টা রাখা আবশ্যক। বীজ ছোট বিধায় বীজের সংগে ছাই বা বালি মিশিয়ে ছিটালে হিসাবমতো বীজ ছিটানো যায়। ছিটিয়ে ও সারিতে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব  ৩০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৫-৬ সেমি.। সারিতে বীজ বপন করলে গাছের পরিচর্যা করা সহজ হয় এবং এত ফলনও বৃদ্ধি পায়। গাছ বেশি ঘন হলে চারা গজানোর পর আংশিক পাতলা করে দিতে হবে। 
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
জমি তৈরির সময় হেক্টরপ্রতি ৪ টন গোবর সার প্রয়োগ করা খুবই প্রয়োজন। হেক্টরপ্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি ডিএপি এবং ৪০ কেজি এমওপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হয় (ইউরিয়া ব্যতীত)। অর্ধেক ইউরিয়া সার শেষ চাষের সময় এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার চারা গজানোর ১২-১৫ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগের পরপরই জমি মালচিং করে দিতে হবে। অথবা চারা গজানোর ৮-১০ দিন পর থেকে বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে (১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া) ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ইউরিয়া সার ছিটানোর সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে সার পাতার সাথে লেগে না থাকে। তবে সার প্রয়োগের পর ৭-১০ দিন পর্যন্ত শাক খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। সারের মাত্রা মাটির প্রকার ও এলাকাভেদে ভিন্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে থানা নির্দেশিকা বা জাতীয় সার নির্দেশিকার মাত্রা অনুসরণ করা যেতে পারে।  
পরিচর্যা
অধিক শাক উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিড়ানী ও পাতলাকরনে অবহেলা করলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ফলে শাকের ফলন কমে যায়। জমি আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ মাসে বৃষ্টি কম হয় বিধায় জমির জোঁ অনুযায়ী সেচ ও আঁচড়া দিতে হবে। আবার বর্ষাকালে জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় ড্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। চারা গজানোর দুসপ্তাহ পর থেকে কিছুদিন পর পর ঘন চারা উঠিয়ে ফেলা দরকার। দফায় দফায় ঘন চারা উঠিয়ে শাক হিসেবে খাওয়া চলে। শাকের জন্য চাষকৃত জমিতে খুব একটা পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা যায় না। জমিতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা দিলেও আপদনাশক প্রয়োগ না করাই উত্তম। কীটনাশক/বালাইনাশক প্রয়োগ করার প্রয়োজন হলে কীটনাশক/বালাইনাশক প্রয়োগ করার ১০ দিন পর শাক উত্তোলন এবং খাওয়া যেতে পারে।  
পাটশাক সংগ্রহ
পাট গাছের বয়স ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে হলেই তখন থেকেই শাক খাওয়া যায়। প্রথমে গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের সংখ্যা কমে গেলে গাছের ডগা ছিঁড়ে শাক খাওয়া যেতে পারে ডগা খাওয়ার কিছুদিন পর শাখা-প্রশাখা থেকে কচি পাতা বের হলে এগুলোও শাক হিসেবে খাওয়া যাবে। এভাবে অনেকবার শাক সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে ফলন কম হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটশাকগুলো একবার চাষ করে দীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত শাক সংগ্রহ কর যায়। বাড়ির ছাদে কয়েকটি টবে পাটশাক চাষ করে ছোট পরিবারের শাকের অভাব পূরণ করা যায়। তবে উদ্ভাবিত চারটি পাটশাকের মধ্যে বিজেআরআই দেশী পাট শাক-১ বছরব্যাপী চাষের জন্য উত্তম।   
বছরব্যাপী পাটশাক চাষের কৌশল
যেহেতু পাটশাক চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ২৪-৩৭০ সে., সেহেতু তীব্র শীত ব্যতীত অর্থাৎ ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাস ব্যতীত বছরের যে কোন সময় সবজি হিসেবে পাট পাতার উৎপাদন করা সম্ভব। পাট গাছের বয়স ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে হলেই তখন থেকেই শাক খাওয়া শুরু করতে হবে। প্রথমে গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের সংখ্যা কমে গেলে গাছের ডগা ছিড়ে পাটশাক খেতে হবে। কিছুদিন পর শাখা-প্রশাখা থেকে কচি পাতা বের হলে অর্থাৎ ডগা খাওয়ার সপ্তাহখানেক পরে শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ ও মালচিং করতে হবে। এবং শাখা-প্রশাখা থেকে বের হওয়া  কচি পাতাগুলো ৩৫-৪০ দিনের মদ্যে শাক হিসেবে খাওয়া যাবে। এভাবে তিনবার পাটশাক খাওয়ার পর জমি চাষ দিয়ে পাটগাছকে মাটির সংগে মিশিয়ে দিতে হবে। এবং ১৫-২০ দিনপর চাষ দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ গোবর ও সার প্রয়োগ করে পুনরায় পাটশাকের বীজ বপন করতে হবে। এভাবে একই জমিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হতে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বীজ বপন করে সারা বছর (ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাস ব্যতীত) পাটশাক চাষ করা সম্ভব।

লেখক : চিফ সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১৬৭৪৯৪২৯, ই-মেইল :mmamondal@gmail.com