রূপসায় লেবু চাষে আকরাম হোসেনের উদ্যোগ
মোঃ আবদুর রহমান
লেবু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। পৃথিবীর সর্বত্রই লেবুজাতীয় ফল অত্যন্ত সমাদৃত। বাংলাদেশের লেবুজাতীয় ফল বলতে প্রধানত কমলালেবু, মাল্টা, এলাচিলেবু, বাতাবিলেবু, কাগজি লেবু, পাতিলেবু প্রভৃতিকে বোঝায়। স্বাদে ও গুণে এ জাতীয় ফল যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি পুষ্টিমানেও অতুলনীয়। লেবুজাতীয় ফল আমাদের দেহের নানা উপকারে আসে। এ জাতীয় ফল ভিটামিন ‘সি’ এর উৎকৃষ্ট উৎস। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ‘সি’ এর গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং ভিটামিন ‘সি’সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণে আমাদের প্রতিদিন লেবুজাতীয় ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা একান্ত অপরিহার্য।
লেবু চাষ করে প্রথমবারই সফল হয়েছেন মোঃ আকরাম হোসেন (৬২)। তিনি রূপসা উপজেলার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা। বসতবাড়ির পতিত জমিতে সুগন্ধি জাতের লেবু চাষ করে অধিক ফলন ও দাম পেয়ে আকরাম হোসেন দারুণ খুশি। প্রায় চার বছর আগে সৃজিত বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ রঙের লেবু। তার এমন সাফল্য দেখে এলাকার অনেক মানুষ লেবু চাষে উৎসাহিত হয়েছেন।
সরেজমিন আকরাম হোসেনের সাথে এ কথা হলে। জানা যায়, গত চার বছর আগে তিনি আষাঢ় মাসে ৫০ শতক জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে একশ’ সুগন্ধি লেবু (পাতি লেবু) এর চারা রোপণ করেন। তিনি বলেন, উঁচু ও মাঝারি উঁচু প্রকৃতির দো-আঁশ মাটি লেবু চাষের জন্য উপযুক্ত। চারা রোপণের আগে জমিতে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছামুক্ত ও সমতল করে জমি তৈরি করে ৩.৫ মিটার দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ৩.০ মিটার পর পর ৫০ সেমি. চওড়া ও ৫০ সেমি. গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত তৈরি করা হয়। এরপর প্রতি গর্তের ওপরের স্তরের মাটির সাথে ১০ কেজি গোবর, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি ও ১০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত পুণরায় ভরাট করা হয়। সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে ৮-১০ দিন পর গর্তের ঠিক মাঝখানে এক বছর বয়সের লেবু চারা রোপণ করা হয়। গর্তে চারা রোপণ করার পর চারদিকের মাটি হাত দিয়ে হালকাভাবে চেপে বসিয়ে দিয়ে চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিয়ে গর্তের মাটি ভালো করে ভিজিয়ে দেওয়া হয়।
আকরাম হোসেন আরো জানান, লেবু চারা রোপণের তিন মাস পর অর্থাৎ গাছের নতুন শিকড় মাটিতে লেগে যাবার পর প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমওপি ও ১০ গ্রাম দস্তা সার গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে প্রথম উপরিপ্রয়োগ করা হয়। এরপর চারা রোপণের দশ মাস পর প্রতি গাছে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি, ২০ গ্রাম বোরন ও ১০ দস্তা সার গাছের গোড়ার চারদিকে (গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সেমি. দূরে) ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সার প্রয়োগের পর গাছের গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। তাছাড়া নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে চারার গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করা হয় এবং মাটিতে রসের অভাব হলে লেবু গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। লেবুগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় গাছের যাতে পানি না জমে সেজন্য নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। লেবুর প্রজাপতি পোকার কীড়ার কবল থেকে লেবুর পাতা রক্ষার জন্য এমিথ্রিন প্লাস (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ০২ গ্রাম) এবং পাতার দাগ রোগ (এ্যানথ্রাকনোজ রোগ) প্রতিরোধের লক্ষ্যে টিল্ট-২৫০ ইসি (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ০৫ মিলি মিটার) নামক ছত্রাকনাশক লেবু বাগানে নিয়মিত স্প্রে করেছেন বলে আকরাম হোসেন জানান। এভাবে তিনি লেবু চারাগুলোর নিবিড় পরিচর্যা করেন। এতে চারাগুলো তরতর করে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৫০ শতক জমিতে লেবু চাষে চারা ক্রয়, গর্ত তৈরি, সার ও অন্যান্য খরচ মিলে তার প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। চারা রোপণের এক বছরের পর থেকেই আকরাম হোসেনের স্বপ্নের লেবু গাছে ফল ধরা শুরু হয়। বাগানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট লেবু গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় লেবু। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আকরাম হোসেন জানান, প্রতিটি গাছে ৮০-৯০টি করে ফল ধরেছে। চারা রোপণের পরবর্তী বছরই তিনি ৪০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেছেন। বর্তমানে এ বাগান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪৫-৫০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করছেন বলে আকরাম হোসেন জানান।
অন্যান্য কৃষক ভাইদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যাদের খালি জায়গা-জমি আছে, আপনারা তা ফেলে না রেখে লেবুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগান এবং যত্ন নেন। তাহলে দেখবেন এই ফল গাছ একদিকে আপনাকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিবে, অপরদিকে দিবে ফরমালিন মুক্ত ফল খাওয়ার সুযোগ। আর সর্বোপরি আপনি হবেন এই ফল গাছের মাধ্যমে স্বাবলম্বী। এজন্য দরকার পরিশ্রম ও অধ্যবসায়।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ উপজেলার দেবীপুর গ্রামের মোঃ আকরাম হোসেন বসতবাড়ির আঙ্গিনার পতিত জমিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেবু বাগান করে সফল হয়েছেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমরা তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে আসছি। এ ছাড়া লেবুসহ মাল্টা, আম ও অন্যান্য ফল চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও সহযেগিতা প্রদান করা হচ্ছে। আর প্রতিটি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ চাষিদের পাশে থেকে লেবুসহ বিভিন্ন ফল ও ফসল চাষে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিয়ে চলেছেন।
লেবু চাষে খরচ কম, লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। চারা লাগানোর এক বছর পর থেকেই ফলন পাওয়া যায়। সঠিক পরিচর্যা করলে একবার চারা রোপণের পর একাধারে অন্তত ১০-১৫ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। সারা বছরই লেবুর চাহিদা রয়েছে। দেহের প্রতিরোধে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ এই লেবু অনেক উপকারী বলে বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পাইকাররা বাগানে এসেই কিনছেন লেবু। তাই বাজারজাত করার বাড়তি ঝামেলা নেই। লেবুর ভালো দাম পেয়ে দেবীপুর গ্রামের আকরাম হোসেন অনেক খুশি। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন এলাকা থেকে আগ্রহী চাষিরা তার এই বাগান দেখে লেবু চাষে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
পুষ্টিগুণ ছাড়াও লাভজনক ও অর্থকরী ফলের মধ্যে লেবু অন্যতম। তাই আকরাম হোসেনের মতো সবাইকে লেবু চাষের উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এতে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে।
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (অবঃ) উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা। মোবাঃ ০১৯২৩৫৮৭২৫৬; ই-মেইল:rahman.rupsha@gmail.com