Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

লিচু-ফলের-গুরুত্বপূর্ণ-ব্যবস্থাপনা

লিচু ফলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মো: শাহাদৎ হোসেন
লিচু : বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন ফল এবং লিচুর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিচু গাছ একটি লম্বা চিরহরিৎ গাছ। এই গাছ থেকে রসালো শাঁসযুক্ত ছোট ছোট ফল পাওয়া যায়। ফলটির বহিরাবরণ অমসৃণ ও লালচে গোলাপি বর্ণের; যা খাওয়া যায় না। আবরণটির ভেতরে থাকে সুমিষ্ট রসাল শাঁস। লিচু গন্ধ ও স্বাদের জন্য দেশ-বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে লিচুর মোট উৎপাদন ৯০ হাজার টন। লিচু টিনজাত করে সংরক্ষণ করা যায়। 
সার ব্যবস্থাপনা
গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও কাক্সিক্ষত ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিচের ছকে দেয়া হলো :
সারের প্রয়োগ পদ্ধতি 
উল্লেখিত পরিমাণ সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার শুরুতে (ফল আহরণের পর), দ্বিতীয় কিস্তি বর্ষার শেষে (আশ্বিন-কার্তিক মাসে) এবং শেষ কিস্তি গাছে ফুল আসার পর প্রয়োগ করতে হবে।
পানি সেচ ও নিকাশ 
চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছের বেলায় সম্পূর্ণ ফুল ফোটা পর্যায়ে একবার, ফল মটরদানার মতো হলে একবার এবং এর ১৫ দিন পর একবার মোট তিনবার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সার প্রয়োগের পর সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন। অপর দিকে, বর্ষার সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে তার জন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাপনা 
পাউডারি মিলডিউ  
এ রোগের আক্রমণে লিচুর মুকুলে সাদা বা ধূসর বর্ণের পাউডারের আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত মুকুল নষ্ট হয় ও ঝরে পড়ে।
পাউডারি মিলডিউ প্রতিকার 
গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে একবার এবং একমাস পর আর একবার টিল্ট ২৫০ ইসি নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার অথবা কুমুলাক্স/সালফোলাক/ম্যাগসালফার প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফল ফেটে যাওয়া  
বাড়ন্ত ফলের ত্বক ঝলসে যাওয়া এবং ফেটে যাওয়া লিচুর একটি মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশে চাষ হওয়া লিচুর জাতগুলোর মধ্যে বোম্বাই লিচুতে ফেটে যাওয়া রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। উচ্চতাপমাত্রা, নিম্ন আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে এ সমস্যা বেশি হয়। দীর্ঘ খরার পর হঠাৎ অধিক বৃষ্টি হলে এ সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। জাত ভেদেও খোসা ঝলসে যাওয়া ও ফল ফেটে যাওয়া সমস্যার তারতম্য লক্ষ করা যায়। ক্যালসিয়াম ও বোরনের অভাবেও ফল ফাটার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া লিচু পাকার আগে উচ্চতাপমাত্রা, নিম্নমাত্রার আপেক্ষিক আর্দ্রতাসহ দীর্ঘ বৃষ্টিপাত লিচু ফাটার অন্যতম কারণ। হরমোনজনিত, পুষ্টিজনিত এবং পোকার আক্রমণ ও আঘাতজনিত কারণেও লিচু ফেটে যেতে পারে। আগাম পাকে এমন জাতের লিচু ফাটার পরিমাণ নাবি জাতের তুলনায় বেশি। 
অনেক সময় চাষিরা লিচু ফাটার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে পারেন না। সেজন্য এককভাবে কোনো চেষ্টার ওপর নির্ভর না করে ওপরের সমস্যাগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থা নিলে কার্যকরভাবে লিচুর ফাটা রোধ করা সম্ভব হবে।
ফল ফেটে যাওয়ার প্রতিকার 
লিচু গাছে বছরে তিন কিস্তিতে অর্থাৎ বর্ষার শুরুতে, বর্ষার শেষে ও শেষ কিস্তি গাছে ফুল আসার পর বয়স অনুসারে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় দিতে হবে; খরা মৌসুমে ফল ধরার পর থেকে ১০-১৫ দিন পর পর লিচু গাছে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার পর প্রয়োজনে গাছের গোঁড়ায় কচুরিপানা বা খড় দ্বারা আচ্ছাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে; প্রতি বছর গাছের গোড়ায় ক্যালসিয়াম সার (ডলোচুন ৫০ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে; ফল বৃদ্ধির সময় জিংক সালফেট ১০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ২১ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে; গুটি বাঁধার পরপরই প্লানোফিক্স বা মিরাকুলান প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে দুই মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে; বোরন সার ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে অথবা বোরিক এসিড বা সলুবোর বোরন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর তিনবার গাছে স্প্রে করতে হবে; ন্যাপথালিন এসিটিক এসিড ২৫ পিপিএম হারে এর সঙ্গে জিবারেলিক এসিড ৫০ পিপিএম হারে  মিশিয়ে ১০ দিন পর পর স্প্রে করে ফাটা রোগ রোধ করা যেতে পারে।
ফল ঝরা 
লিচুতে প্রাথমিক ফল ধারণ হার অনেক বেশি হলেও ফল ঝরে যাওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত খুব কম পরিপক্ব ফল আহরণ করা সম্ভব হয়। ধরার পর থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত ফল ঝরা চলতে থাকে। ফল ধরার ২-৪ সপ্তাহ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফল ঝরে। মাটিতে রসের অভাব, অতি উচ্চতাপমাত্রা ও ফলছিদ্রকারী  পোকার আক্রমণ ফল ঝরার প্রধান কারণ।
ফল ঝরার প্রতিকার 
নিয়মিত পরিমিত পরিমাণ সার ও সেচ প্রদান এবং ধান, গম অথবা ডালজাতীয় ফসলের খড় দ্বারা মালচিং করতে হবে। ফলছিদ্রকারী  পোকা দমন করতে হবে।
লিচুর পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা 
ফল ছিদ্রকারী পোকা 
ফল ছিদ্রকারী পোকা লিচুর অন্যতম প্রধান শত্রু। ফলের বাড়ন্ত অবস্থায় পূর্ণবয়স্ক পোকা ফলের বোঁটার কাছে খোসার নিচে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে বোঁটার নিকট দিয়ে ফলের ভেতরে ঢুকে বীজ খেতে থাকে। এতে অনেক অপরিপক্ব ও পরিপক্ব ফল ঝরে যায়। এ ছাড়া বীজ খাওয়ার কারণে করাতের গুঁড়ার মতো পদার্থ উৎপন্ন হয় এবং বোঁটার কাছে জমে থাকে। এতে ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং বাজারমূল্য হ্রাস পায়।
ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনব্যবস্থা  
বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল বাগান থেকে কুড়িয়ে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। এ পোকা দমনের জন্য রিপকর্ড/সিমবুশ/সুমিসাইডিন/ডেসিস প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ফলের মার্বেল অবস্থা থেকে শুরু করে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে ফল সংগ্রহের অন্তত ১৫ দিন পূর্বে শেষ স্প্রে করতে হবে।
মাইট বা মাকড় 
লিচু গাছের পাতা, ফুল ও ফলে এর আক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়িয়ে যায় এবং এর নিচের দিকে লাল মখমলের মতো হয়ে যায় এবং দুর্বল হয়ে মরে যায়। আক্রান্ত ডালে ফুল, ফল বা নতুন পাতা হয় না এবং আক্রান্ত ফুলে ফল হয় না।
লিচুর মাইট বা মাকড় দমনব্যবস্থা 
ফল সংগ্রহের সময় মাকড় আক্রান্ত পাতা ডালসহ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মাকড়নাশক ভারটিম্যাক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. পরিমাণ মিশিয়ে নতুন পাতায় ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
লিচু গাছের মাজরা পোকা  
এই পোকার কীড়া লিচু গাছের কা- ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত অংশ রেশমি পর্দা দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে। এরা ছাল খাওয়া শেষ করে পরবর্তীকালে কা- খেতে থাকে। অতিমাত্রায় আক্রান্ত হলে গাছের প্রাণরস সঞ্চালনে বাঁধার সৃষ্টি হয় এবং গাছের সজীবতা হ্রাস পায়। চারাগাছ আক্রান্ত হলে গাছ মারাও যেতে পারে।
লিচু গাছের মাজরা পোকা দমন ব্যবস্থা 
আক্রমণ দেখা গেলে কীড়ার তৈরি ছিদ্র পথে সুচালো আগাযুক্ত লোহার শিক ঢুকিয়ে ভেতরে লুকিয়ে থাকা কীড়া মারতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে আক্রান্ত অংশ পরিষ্কার করে এক খ- তুলা পেট্রোল, কেরোসিন, ক্লোরফর্ম ইত্যাদিতে ভিজিয়ে গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে ছিদ্রপথ কাদামাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।
বাদুর : লিচুর প্রধান শত্রু বাদুর। এরা পরিপক্ব ফলে আক্রমণ করে। ফল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থায় এক রাতের অসাবধানতায় এরা সমস্ত ফল বিনষ্ট করে ফেলতে পারে। মেঘলা রাতে বাদুরের উপদ্রব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
বাদুর দমন ব্যবস্থা   
বাদুর তাড়ানোর জন্য রাতে পাহাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সমস্ত গাছ জালের সাহায্যে ঢেকে দিয়েও বাদুরের আক্রমণ রোধ করা যায়। বাগানে গাছের উপর দিয়ে শক্ত ও চিকন সুতা বা তার টাঙ্গিয়ে রাখলে বাদুরের চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
লিচুর ভালো ফলন পেতে বিশেষ যত্ন
বোরণ ও দস্তার অভাব থাকলে অন্যান্য অনুমোদিত সারের সাথে প্রতিটি গাছে ২০ গ্রাম জিংক সালফেট এবং ১০ গ্রাম বরিক এসিড (লিচুর আটিঁ শক্ত হওয়ার পর্যায়ে) গাছের গোড়ায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত রিং বেসিন পদ্ধতিতে গাছের গোড়ায় সেচ দিতে হবে। লিচুর পোকা দমনের জন্য ফল মটর দানার আকারে হলে নাইলনের তৈরি জাল দিয়ে লিচুর গোছা বেঁধে দিতে হবে। 
ডাল ছাঁটাইকরণ : পূর্ণবয়স্ক গাছে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশের জন্য ফল সংগ্রহের পর অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। ফল সংগ্রহের সময় লিচুর মাকড় আক্রান্ত ডাল ভেঙে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গাছের মুকুল ভাঙন : কলমের গাছের বয়স ৪ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙে দিতে হবে।

লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃতসা, রংপুর; মোবাইল : ০১৭১২৬২৬২৯৬, ই-মেইল : shahadatbau@gmail.com