সংরক্ষণশীল কৃষির চাষ ব্যবস্থাপনা
ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক
কনজারভেশন এগ্রিকালচার (সিএ) বা সংরক্ষণশীল কৃষি একটি সমন্বিত চাষ ব্যবস্থাপনা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, কনজারভেশন এগ্রিকালচার তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত : ১) জমিতে চাষ কম দেওয়া, ২) ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে রেখে আসা, ৩) লাভজনক শস্যপর্যায়। প্রথম মূলনীতি এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, জমি চাষের পরিমাণ মোট জমির ২৫ ভাগের কম হতে হবে তা ফালি চাষ বা শূন্য চাষের দ্বারা করা সম্ভব। দ্বিতীয় মূলনীতির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে জমিতে ফসলের অবশিষ্টাংশ কমপক্ষে ৩০ ভাগ রেখে আসতে হবে যাতে করে জমিতে বীজ বোনার পর পরিমাপ করা হলেও মোট জমির ৩০ থেকে ৬০ ভাগ অংশ নাড়ার অবশিষ্ট অংশ এর দ্বারা আবৃত থাকে। তথা সারা বছরই জমির বেশির ভাগ অংশ কোন একটি ফসল অথবা ফসলের অবশিষ্ট অংশ দ্বারা আবৃত থাকবে। তৃতীয় মূলনীতির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে এই পদ্ধতিতে একটি লাভজনক শস্যপর্যায় অনুসরণ করতে হবে যাতে করে একই ফসল এ ধারায় বারবার না আসে। সংরক্ষণশীল কৃষির ধারণাটি আসে ১৯৩০ সালে আমেরিকাতে সংঘটিত ধুলিঝড়ের পর। তখন বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেন কৃষির মাটি সংরক্ষণের জন্য এমন কোন বিষয়টি জরুরি কিন্তু তা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ প্রেক্ষিতেই ১৯৪০ সালে প্রথম বীজবপন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় সরাসরি চাষ ছাড়া জমিতে বীজ বপনের জন্য। সেই তখন থেকে শুরু হওয়া সংরক্ষণশীল কৃষির ধারণাটি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে এটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের প্রায় ৭৫ ভাগ জমিতে সংরক্ষণশীল কৃষি বা সিএ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকাতে প্রায় ৭০ ভাগ জমিতে ও উত্তর আমেরিকাতে প্রায় ৩৫ ভাগ জমিতে সিএ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যদিও এশিয়াতে এর পরিমাণ নগণ্য (৩.১৫%), তবুও সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সিএ চাষ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পৃথিবীর মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় ১৫ ভাগ। বাংলাদেশেও প্রায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে সিএ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ হটস্পট রয়েছে, যা আনফেবারেবল ইকো সিস্টেমের মধ্যে। কিন্তু এখানে উন্নত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষের আওতায় আনার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তার মধ্যে লবণাক্ত অঞ্চলে ১.০৬ মিলিয়ন হেক্টর, খরা অঞ্চলে ৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর, জলাবদ্ধ অঞ্চলে ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর, চরাঞ্চলে ০.৮২ মিলিয়ন হেক্টর, হাওরাঞ্চলে ০.৮৬ মিলিয়ন হেক্টর এবং পাহাড়াঞ্চলে ১.৮১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সুযোগ রয়েছে।
দেশের প্রায়ই ১১.০৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জমির পুষ্টির স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাদ্যের জোগান দিতে ২০৫০ সালে ১৫ থেকে ১৬ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত দানাদার ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন পড়বে। অন্যদিকে জমির ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এসব জমির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধি উভয়টি অর্জন করার লক্ষ্যে সংরক্ষণশীল কৃষি বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশেও ক্রমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সিএ চাষ পদ্ধতিতে যদিও প্রথম এক দুই বছরেই উৎপাদন বৃদ্ধি হতে দেখা যায় না কিন্তু প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে ফলন কম হয় না। উপরন্তু পর পর তিন বছর এ পদ্ধতি ব্যবহার করার পর থেকে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলন বৃদ্ধি হতেও দেখা যায়। এ পদ্ধতিতে ফসল বপন বা রোপণে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে কম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। আমরা জানি এক লিটার জ্বালানি ডিজেল পোড়ালে ২৬ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড বাতাসে নিঃসরণ হয়। ফলে সিএ চাষ পদ্ধতি একটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস পাবে এবং পরিবেশ নির্মল হবে। সিএ চাষ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রেও অচাষকৃত জমিতে ধান বপন বা রোপণ করা হয়ে থাকে। অচাষকৃত জমিতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষের ফলে ৭০ ভাগ জ্বালানি, ৫০ ভাগ শ্রমিক এবং ১০ থেকে ১৫ ভাগ পানি সাশ্রয় করা সম্ভব। সিএ চাষ পদ্ধতিতে বছরের বেশির ভাগ অংশই ফসল অথবা ফসলের নাড়া দ্বারা আবৃত থাকায় জমিতে দিবারাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্যের পরিমাণ কম হয় ফলে মাইক্রো এনভাইরনমেন্ট উত্তম ফলন এর উপযোগী থাকে।
বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে এ চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়া আংশিকভাবে সারা দেশেই বিনা চাষ বা স্বল্পচাষের ব্যবহার বাড়ছে। বিনাচাষে রসুন চাষ চলনবিল এলাকা থেকে শুরু হয়ে এখন দক্ষিণের লবণাক্ত এলাকাতেও ছড়িয়ে পরেছে। বিনা চাষের রিলে পদ্ধতিতে সরিষা ও ডালজাতীয় ফসলের চাষ লাভজনক বলে প্রতীয়মান হওয়ায় তা সারা দেশেই ছড়িয়ে গিয়েছে। আমন ও বোরো ধানের মাঝে এ রিলে পদ্ধতিতে সহজেই আরেকটা ফসল ঘরে তোলা যাচ্ছে যাতে করে ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে। রাজশাহী, রংপুর ও নীলফামারীতে আলু চাষের পরে যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্প চাষে বোনা আউশ বা লেট বোরো বা ব্রাউস ধানের আবাদ লাভজনক বলে কৃষক সমাদৃত হয়েছে। বিনা চাষের আলু কৃষককে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। এমনকি খুলনার লবণাক্ত এলাকাতেও বিনা চাষে আলু ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এই পদ্ধতির ব্যাপক সম্প্রসারণ করা গেলে লবণাক্ত অঞ্চলে আলু চাষ করে কৃষকের আর্থসামজিক উন্নয়ন করা যাবে।
গবেষণার জন্য আরো অনেকগুলো বিষয়ের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা দরকার যেমন জমি সমতল করার জন্য লেজার ল্যান্ড লেভেলার এর ব্যবহার বৃদ্ধি করা, সিএ চাষ পদ্ধতির জন্য উপযোগী জাত বাছাই করা, ফসলের অবশিষ্ট অংশ ব্যবস্থাপনা ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সিএ চাষ পদ্ধতির উপযোগী সার সুপারিশ মালা তৈরি করা। এসব বিষয়কে নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে।
সিএ হলো মাটির জৈব কার্বন বাড়ানোর একটি জাদুকরী অস্ত্র। মাটির জৈব কার্বন ব্যাপক চাষ, নিবিড় ফসলের ধরন এবং উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহারের কারণে হ্রাস পাচ্ছে। সিএ এর সুবিধাগুলো এমন একটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হতে পারে যেখানে বছরের পর বছর ধরে পুরো শস্যবিন্যাসে সিএ অনুশীলন করা হচ্ছে। সিএ বিশ্বব্যাপী কাজ করলেও বাংলাদেশে খুব সীমিত সঠিক শস্যবিন্যাসভিত্তিক ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নব্বইয়ের দশক থেকে সিএ নিয়ে কাজ করছে, তবে সিএ অনুশীলনের ঋতুভিত্তিক আংশিক প্রয়োগের কারণে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়নি। সিএ প্রধানত রবি (শুষ্ক শীত) মৌসুমে উচ্চভূমির ফসলের জন্য অনুশীলন করা হয় এবং পরবর্তী মৌসুমে প্রচলিত চাষ ব্যবহার করে ধানের ফসল চাষ করা হয়। সুতরাং, সিএ-এর প্রভাব দৃশ্যমান নয়। অতএব, কৃষক, ছাত্র, গবেষক এবং নীতিনির্ধারকদের দ্বারা সিএ কার্যক্রমের সুবিধা পর্যবেক্ষণ এবং জ্ঞান বৃদ্ধির সুযোগ খুব কম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) গাজীপুরে একটি সংরক্ষণ কৃষি পার্ক (ঈঅ পার্ক) স্থাপন করেছে। সিএ পার্ক নামে সংরক্ষণশীল কৃষি নিয়ে গবেষণার প¬াটফরমে বিভিন্ন ডিসিপি¬নের বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে এই বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রায় ১ হেক্টর জমিতে নিবিড় গবেষণা চলমান রয়েছে। এখানে সৌর সেচপাম্প ব্যবহারসহ আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সমন্বিত চাষ ব্যবস্থার সফলতার পথ খোঁজা হচ্ছে। বিগত তিন বছর একই জমিতে সিএ চাষ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে মাটির স্বার্থের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া আগাছার প্রবণতা কমেছে। ফলে বিনা চাষে বা স্বল্প চাষের মাধ্যমে ধান-ভুট্টা, ধান-সরিষা-পাট, ধান-সরিষা-মুগডাল, ধান-ধান-ধান কেন্দ্রিক ফসলধারায় লাভজনক ও জমির স্থাস্থ্য সুরক্ষাকর উপায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। ফলে গাজীপুরের এই সিএ পার্ক কৃষক, গবেষক ও পলিসি প¬্যানারদের পরিদর্শন ও এ ব্যাপারে জ্ঞানলাভের সুযোগ তৈরি করেছে। এই ধারাবাহিকতায় কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার সারা দেশে আরো ১৪টি সিএ পার্ক স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিএ পার্কের কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের উপযোগী খামার যন্ত্রপাতি সম্পর্কিত পরিষেবাগুলো এক বাতায়নে সহজে তুলে খরার জন্য একটি সিএ ওয়েবসাইট (www.camachinery.org) চালু করা হয়েছে। এই ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে সিএ ভার্চুয়াল প¬্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সিএ জ্ঞান ভা-ার প্রস্তুত করা হচ্ছে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২৬৩৫৫০৩, ই-মেইল :arshadulfmpe@gmail.com