Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ছোট-মাছের-বড়-পুষ্টিগুণ

ছোট মাছের বড় পুষ্টিগুণ  
ড. ডেভিড রিন্টু দাস১ শাহনাজ পারভিন২
নদীমাতৃক আমাদের এই দেশে অসংখ্য জলাশয় আছে। এসব জলাশয় ছোট-বড় মাছে ভরপুর। মিঠাপানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এগুলোকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। মূলত রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, আইর, বোয়াল, ইলিশ, পাঙ্গাস, চিতল এগুলো বড় মাছের তালিকায় রয়েছে। মাঝারি আকারের মাছের মধ্যে ফলি, মাগুর, শিং, বেলে, কই, তেলাপিয়া, বাটা ইত্যাদি এবং ছোট মাছের তালিকায় মলা, ঢেলা, বাতাসি, পিয়ালি, কাজলি, পুঁটি, টেংরা, দারকিনা. কাঁচকি, চান্দা, খলিশা, গোচি অন্যতম। আমাদের দেশের জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ পাওয়া যায়। এরই মধ্যে প্রায় ১৫০ প্রজাতিরও বেশি ছোট মাছ রয়েছে। এসব ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণ ম্যাক্রো এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট আছে। বিভিন্ন ভিটামিন (যেমন-এ, ডি, ই, কেসহ বি কমপ্লেক্স) এবং মিনারেল (যেমন- ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, আয়োডিন ইত্যাদি এর অন্যতম) সরবরাহকারি এই ছোট মাছ। এসব মাছে বিদ্যমান ভিটামিন ও মিনারেল মানব শরীরের জন্য সহজ পাচ্য এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। 
ছোট মাছ 
সাধারণত যেসব মাছ পরিপক্ব অবস্থায় ২৫ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে সেসব মাছ গুলোকে ছোট মাছের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়। তবে কিছু ছোট মাছ আছে যেগুলো ২৫ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চি এর বেশি বাড়তে পারে (যেমন: শিং মাছ)। প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক খাবার, বাসস্থান ও উপযুক্ত পরিবেশের সাথে বিভিন্ন জলাশয়  (যেমন: নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ধানক্ষেত, প্লাবনভূমি ইত্যাদি) ছোট মাছের জন্য আদর্শ প্রজনন ও লালন পালন ক্ষেত্র তৈরি করে। এরা অগভীর, সরু জলে প্রজনন করতে পারে, দ্রুত অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়ে যেতে পারে। বর্ষাকালে তাদের প্রাচুর্য বাড়ে বিশেষ করে যখন জলাশয়গুলোতে সর্বোচ্চ পানি বৃদ্ধি পায়। 
সহজলভ্য প্রজাতি 
পুঁিট, টেংরা, দারকিনা, খলিশা, চাঁন্দা, কই, টাকি, শিং, গোচি এসব ছোট মাছ সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে। আমাদের দেশের মিঠা পানির জলাশয়গুলোতে পর্যাপ্ত ছোট মাছ রয়েছে। জেলেরা তাদের বাড়ির কাছের জলাশয় থেকে এসব ছোট মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। 
ছোট মাছের সার্বিক পুষ্টিগুণ 
ছোট মাছে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও শক্তিতে ভরপুর। বিভিন্ন ধরনের সমৃদ্ধময় পরিবেশে বসবাস করার কারণে ছোট মাছের মধ্যে সবথেকে বেশি পুষ্টি উপাদান থাকে। এছাড়াও ছোট মাছের প্রায় সব অংশই খাওয়া হয় এজন্য পুষ্টিগুণটা আরও ভালোভাবে পাওয়া যায়। 
পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ
ভিটামিন এ এর উপর ভিত্তি করে ছোট মাছের বিভিন্ন প্রজাতিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারযোগ্য মাছের অংশ হতে প্রাপ্ত ভিটামিন এ এর পরিমাণ সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
সারণি ১ : উল্লেখযোগ্য কিছু ছোট মাছের ভিটামিন এ এর পরিমাণ 
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা খাবারযোগ্যে ছোট মাছের অংশে ক্যালসিয়াম এবং আয়রন এর পরিমাণ (সারণি-২ দ্রষ্টব্য)। 
সারণি ২ঃ উল্লেখযোগ্য কিছু ছোট মাছের ক্যালসিয়াম এবং আয়রন এর পরিমাণ 
মানবদেহে ছোট মাছের গুরুত্ব 
পুষ্টিসম্মৃদ্ধ ছোট মাছ শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। ছোট মাছ মলা, ঢেলা, দারকিনায় পর্যাপ্ত খনিজ ও ভিটামিন (যেমন: আয়রন ও ফলিক এসিড) শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করে। ছোট মাছ নারী, গর্ভবতী নারী ও দুগ্ধবতী নারীদের অপুষ্টি প্রতিরোধ করে। এছাড়া মাতৃত্বকালীন, নবজাতক এবং শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করে এবং স্থায়ী অন্ধত্ব প্রতিরোধ করে পাশাপাশি অন্যান্য রোগের পুষ্টি পূরণ করে।   
হুমকির মুখে ছোট মাছ 
বর্তমানে দেশীয় ছোট মাছগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। ছোট মাছের প্রাচুর্যতা কমে যাওয়ার নিমোক্ত কিছু কারণ উল্লেখযোগ্য
 নির্বিচারে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ ধরা;
 ধ্বংসাত্মক মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহার;
 অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ;
 প্লাবনভূমি অঞ্চলের জলাশয়গুলো পলিমাটি দিয়ে ভরাট হওয়া;
 কৃষি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার;
 জলাশয়ে শিল্প-কারখানার বজ্র নিষ্কাশন;
 জলাশয়কে কৃষি জমিতে রূপান্তর;
 মানুষের সচেতনতার অভাব।
হুমকির প্রতিকার 
 কালের বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে অনেক প্রজাতির ছোট মাছ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ও কিছু বিলুপ্তের পথে।
 ছোট মাছ বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সংরক্ষণে প্রথমে আমাদের বিলুপ্তের বিভিন্ন কারণগুলো চিহ্নিত করে এর প্রতিকার করতে হবে।
 বর্তমানে কৃত্রিম প্রজনন একটি অন্যতম প্রযুক্তি যার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে এবং প্রকৃতিতে এর প্রার্চুজতাও বৃদ্ধি হচ্ছে।
 চাষাবাদ প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো।
 ছোট মাছ সংরক্ষণে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
ছোট মাছ সংরক্ষণে বিএফআরআই ভূমিকা 
ছোট মাছ সংরক্ষণে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঋজও) সর্বদা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে আসছে। 
া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঋজও)  বিপন্ন ও দেশী প্রজাতির মাছের উপর গবেষণা করে ৩৯টি মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ও উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
া ইঋজও কর্তৃক উদ্ভাবিত কিছু উল্লেখযোগ্য ছোট মাছ বাতাসি, পিয়ালি, ঢেলা, জাত পুঁটি, দারকিনা, খলিশা, গুলশা প্রভৃতি।
া এছাড়াও ইঋজও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত লাইভ জিন ব্যাংক এ প্রকৃতিতে সংকটাপূর্ণ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে। যাতে প্রকৃতিতে মাছের সংকট দেখা দিলে লাইভ জিন ব্যাংক হতে মাছ নিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছকে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণ করা যায়।  
প্রকৃতপক্ষে ছোট মাছ স্বাদে ও পুষ্টিগুণে অনন্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের খাবারের মূল অংশ হলো মাছ। বাঙ্গালির খাবার টেবিলে ছোট মাছের অনুপস্থিতি মানে পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহ কমে যাওয়া। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া মানে অনেকাংশ মানুষের খাদ্যকে প্রভাবিত করা। ছোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে যেমন অপুষ্টি দূর হয় তেমনই গ্রামীণ জনগণের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে।  
 
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার, বগুড়া, মোবাইল : ০১৭১৮৫৪৩৩৮৭, ই- মেইল : etee2407@gmail.com