Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

গ্রীষ্মকালীন-শিম-উৎপাদন-প্রযুক্তি

গ্রীষ্মকালীন শিম উৎপাদন প্রযুক্তি
অধ্যাপক  ড. মো: শহীদুল ইসলাম
শিম বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি ফসল, যা প্রধানত শীতকালে চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতে শীতকালে অন্তত একটি হলেও শিমের মাচা দেখতে পাওয়া যায়। সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, ঈশ্বরদী, পাবনাসহ প্রায় সকল জেলাতে শিম বাণিজ্যিকভাবে চাষ হতে দেখা যায়। শিম একটি আমিষসমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি যার ফুল ও ফল ধারণ খাটো দিবসের  উপর নির্ভর করে। ফসলটি আলো সংবেদনশীল  হওয়ায় এর প্রাপ্যতা প্রধানত শীতকালে সীমাবদ্ধ। এ ফসলের অধিকাংশ জাতের বীজ যখনই বপন করা হোক না কেন, এদের ফুল ছোট দিবস না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ এর আগে ফুল বা ফল ধরে না। তবে কিছু কিছু আগাম জাত রয়েছে সেগুলোও সাধারণত আগস্ট মাসের আগে বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। এ জাতগুলোর ফুল ও ফল ঝরে পড়ার প্রবণতাও অনেক বেশি। যেহেতু শিম একটি আমিষ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি তাই গ্রীষ্মকালীন সময়ে এ ফসলটি চাষ করতে পারলে আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব।
শিমের পুষ্টিমান
শিম খেতে সুস্বাদু ও একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। ১০০ গ্রাম ভক্ষণোপযোগী কচি শিমে ৮৫ গ্রাম জলীয় অংশ, আমিষ ৩.৮ গ্রাম, শ্বেতসার ৮.০ গ্রাম, আঁশ ১.৮ গ্রাম, ¯েœহ ০.৭ গ্রাম,  ক্যারোটিন ৪৮ আইইউ, থায়ামিন ০.১ মি.গ্রা., রাইবোফ্লাবিন ০.০৬ মি.গ্রা., নায়াসিন ০.৭ মি.গ্রা., ভিটামিন সি ৯.০ মি.গ্রা.,  ক্যালসিয়াম ২১০ মি.গ্রা. এবং লৌহ ১.৭ মি.গ্রা.। পুষ্টিমানের হিসেবে জাত, উৎপাদন মৌসুম, মাটির গুণাগুণ, এলাকাভেদে কিছুটা পার্থক্য হতে পারে।
গ্রীষ্মকালীন শিমের জাত
বাংলাদেশে শিমের বেশ কয়েকটি জাত গ্রীষ্মকালে চাষ হয়ে থাকে। জনপ্রিয় জাতগুলো হলো- সিকৃবি শিম-১ (সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিম-১), সিকৃবি শিম-২, বারি  শিম-৭, ইপসা শিম-২ ইত্যাদি। শিম একটি শীতকালীন সবজি তাই গ্রীষ্মকালীন বা ফটো-ইনসেনসিটিভ (আলো অসংবেদনশীল) শিমের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা হয়। এজাত উদ্ভাবনে সংকরায়নের পর সেগ্রিগেটিং বংশধর থেকে একক গাছ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথমত বেশ কিছু জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে ভ্যারিয়াবিলিটি  (বৈচিত্র্যতা) তৈরি করে ভ্যারিয়েশন থেকে ৬ বছর একক গাছ যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে ৬-৭ টি অগ্রবর্তী লাইন নির্বাচন করা হয়, যা গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালে ফুল ও ফল ধারণে সক্ষম। অতপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিটিউট থেকে বারি শিম-৭ নামে একটি জাত উৎপাদনের জন্য মুক্তায়ন করা হয়। পরবর্তীতে অধিকতর গবেষণা কর্ম সম্পাদন শেষে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ নামে দুটি জাত কৃষক পর্যায়ে উৎপাদনের জন্য নিবন্ধিত হয়। সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ জাত দুটি মার্চ-এপ্রিল মাসে বা শীতের পরপর বপন করলে ৮০-৮৫ দিন পর অর্থাৎ জুন-জুলাই মাস থেকেই কচি ফল আহরণ শুরু হয়। কম বৃষ্টিবহুল অঞ্চল ও উপকূলবর্তী অঞ্চলসহ দেশের সব এলাকায় চাষ করা যায়। জাতগুলোর ভালো ফলাফল পাওয়ার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। জাত দুটির বৈশিষ্ট্যাবলী নি¤েœর সারণি দ্রষ্টব্য।
সিকৃবি শিম-১

গ্রীষ্মকালীন শিম চাষের উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি ও জলবায়ু : বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি গ্রীষ্মকালীন শিম চাষের জন্য খুব উপযোগী। ফসলটি দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। এঁটেল মাটিতে চাষ করলে পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জমি তৈরি : মূল জমি ৪-৫ বার চাষ দিয়ে তৈরি করতে হয়। এরপর নির্দিষ্ট মাপের উঁচু বেড তৈরি করে তাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত বা পিট তৈরি করে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হয়।
একক বা দ্বৈত সারি পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালে শিম চাষ করা যায়। সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধার জন্য প্রতিটি বেড ১৫-২০ সেমি. উঁচু ও ১.০ বা ২.০ মি. প্রশস্ত করতে হয়। বেড কাজের সুবিধা অনুযায়ী লম্বা করে নেওয়া যায়।
একক সারি পদ্ধতিতে ১.০ মিটার প্রস্থের ১৫ সেমি. উঁচু বেড তৈরি ও বেডের উভয় পাশে ৫০ সেমি. ড্রেন রাখতে হবে যাতে সহজেই বৃষ্টির পানি বের হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি বেডের মধ্যে ১.৫ মিটার দূরে দূরে ৪০দ্ধ৪০দ্ধ৪০ সেমি. সাইজের পিট বা গর্ত তৈরি করে গর্তে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করে বীজ বা চারা রোপণের উপযোগী করতে হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা ও ফসল উত্তোলন সহজ হয়।
সার প্রয়োগ : শিম লিগুমিনেসী (ডাল) পরিবারের সবজি বলে এটি বাতাস থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে বিধায় নাইট্রোজেন জাতীয় সারের পরিমাণ কম লাগে। নিচে প্রতি শতাংশ জমিতে সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি সারণি দ্রষ্টব্য। মাটির উর্বরতাভেদে সারের মাত্রা কম বেশি হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের মাটি অম্ল প্রকৃতির হওয়ায় প্রতি শতক জমির জন্য ৪.০ কেজি ডলোচুন বীজ বপন বা চারা রোপণের ২০-২৫ দিন আগে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেচ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
বীজ বপন : গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালে শিম চাষের জন্য মার্চ বা এপ্রিল মাসে প্রস্তুতকৃত জমিতে সরাসরি বীজ বপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটি গর্তে ৩টি করে বীজ দিতে হয়। তবে পলিব্যাগে চারা তৈরি করা উত্তম। প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের দূরত্ব লাইন থেকে লাইন ১.৫ -২.০ মিটার ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১.৫ মিটার হলে ভালো হয়। পলিব্যাগের ১০-১২ দিন বয়সের চারা রোপণ করা উত্তম। এসময় মাটিতে রস না থাকলে পানি দিতে হয়।
খুঁটি/মাচা দেওয়া : শিম একটি লতানো জাতীয় উদ্ভিদ এবং বেয়ে উপরে উঠার জন্য সাপোর্ট বা ঠেকনা প্রদান করতে হয়। শিম চাষে মাচা তৈরিতে বাঁশ, সুতলী, রশি, তার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাচার পরিবর্তে গাছের গোড়ায় শাখা প্রশাখাযুক্ত বাঁশের আগা পুঁতে শিম চাষ বেশ কার্যকর। এক্ষেত্রে লম্বা বেডের দুইপ্রান্তে মোটা বাঁশ পুঁতে তার দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। গাছের গোড়ায় পুঁতে দেওয়া বাশের আগা  তারের সাথে আটকিয়ে দিতে হয়। এতে শিমের পরিচর্যা ও শিম আহরণ বেশ সুবিধাজনক।       
পরিচর্যা : চারা গজানোর ৮-১০ দিনের মধ্যে প্রতি গর্তে দু’টি করে চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়। গাছের গোড়াসহ বেডের মাটি কোদাল দিয়ে উল্টিয়ে দিতে হবে। এসময় আগাছা তুলে ফেলতে হয়। বেশি বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হয়। মাটিতে রস না থাকলে ১০-১২ দিন পর পর জমিতে সেচ প্রদান করতে হয়। গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে পুরাতন পাতা ও ফুলবিহীন শাখা কেটে ফেলা উত্তম।
ফসল সংগ্রহ :  গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো বছরের যে সময়ই বপন করা হোক না কেন বীজ বপনের ৪৮-৫০ দিনের মধ্যেই ফুল ফোটে এবং বীজ বপনের ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে শিম উত্তোলন শুরু হয়। ৫-৭ দিন পর পর কচি শিম মাঠ থেকে তোলা হয়ে থাকে। 
রোগ ও পোকামাকড় : গ্রীষ্মকালে শিম চাষে যে সকল রোগ ও পোকামাকড় দেখ যায় তাদের লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থাপনা নি¤েœ বর্ণনা করা হলো :
শিমের ভাইরাস রোগ
এ রোগে কচি ডগা ও পাতা হলুদ হতে থাকে। জাব পোকা দিয়ে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ রোগ দমনে আক্রান্ত গাছ বা ডগা পাতা ইত্যাদি তুলে পুতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শিমের ভাইরাস রোগ দমনে এ পদ্ধতিটি খুব কার্যকরী। বাহক পোকা দমনে গাছের বয়স ২০ দিন হলে ৭-১০ দিন পরপর দু-তিন বার কীটনাশক যেমন- অ্যাডমায়ার, রিপকর্ড ইত্যাদি স্প্রে করে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকনো যায়। তবে ফুল ও ফল ধারণের পর কীটনাশক প্রয়োগ না করাই উত্তম।
কা-ের গোড়া পচা রোগ
গাছের গোড়ায় আর্দ্রতা বা পানি জমলে ছত্রাকের আক্রমণে গোড়া পচা রোগ দেখা দিতে পারে। ছত্রাকনাশক যেমন অটিস্টিন বা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
জাবপোকা
জাবপোকা গাছের নতুন ডগা, পাতা, ফুল, ইত্যাদিও রস চুষে খায়। গাছের বৃদ্ধি ও ফলনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এ পোকা মোজাইক জাতীয় ভাইরাস রোগ ছড়াতে সহায়তা করে। মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠা-া আবহাওয়ায় জাবপোকার বংশবৃদ্ধি পায়। 
এ পোকা দমনে প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত লতা, পাতা, ডগা বা ফল সংগ্রহ করে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে যা অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি। এক কেজি আধাভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেই দ্রবণ বা সাবান গোলা পানি (১০ লিটার পানিতে ২ চা চামুচ গুঁড়া সাবান) স্প্রে করে এ পোকার আক্রমণ কমানো যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে স্বল্পমেয়াদি বিষক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক যেমন- ম্যালাডান (২ মিলি/লিটার পানি) বা পিরিমর ৫০ ডিপি (১ গ্রাম/ লিটার পানি) ৭-১০ দিন পরপর দুইবার স্প্রে করতে হবে। তবে ফলন্ত গাছে স্প্রে না করায় উত্তম।
শিমের ফল ছিদ্রকারী পোকা
এ পোকার কীড়া ফুল ও কচি ফল ছিদ্র করে ভিতরের শাঁস নষ্ট করে ফেলে। ফুল কচি ফল ঝরে পড়তে দেখা যায়। পোকাটি দমনের জন্য একদিন পর পর আক্রান্ত ফুল ও ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। শিমের ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে অন্তঃবাহী কীটনাশক শিম সংগ্রহের পর স্প্রে করতে হবে এবং বিষ প্রয়োগের দুই সপ্তাহের মধ্যে খাওয়ার জন্য কোন শিম সংগ্রহ করা যাবে না।
ফলন : গ্রীষ্মকালে শিম চাষ করলে প্রতি শতকে ৪৫-৫৫ কেজি (১২-১৪ টন/হেক্টর) কচি শিম সংগ্রহ করা যায় যা শীতকালের চেয়ে কিছুটা কম হলেও উচ্চমূল্যের কারণে সে ক্ষতি পূরণ হয়।
বীজ উৎপাদন : গ্রীষ্মকালীন শিম জাতের বীজ উৎপাদন একটি গুরুত্ব বিষয়। গ্রীষ্মকালে চাষকৃত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ সমীচীন নয়। এত করে জাত ডিজেনারেশনের মাধ্যমে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্রীষ্মের অধিক তাপ ও আর্দ্রতা বীজের গুণাগুণ নষ্ট করে। তাই শীতকাল বীজ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত সময়। এজন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মাঠে বীজ বপন করতে হয়। শিম শুকে গেলে গাছ থেকে কয়েক বারে সংগ্রহ করে বীজ বের করে রোদে ভালো করে শুকাতে হবে। এরপর কোন পাত্র বা ব্যাগে সেভিন পাউডার, শুকনো বীষকাটালি পাতা বা নিমপাতা সহযোগে রাখা যেতে পারে। বীজ প্যাকেটবদ্ধ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়।

লেখক : উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট,ই-মেইলshahidul.hrt@sau.ac.bd; মোবাইল: ০১৯১৬৬৬২৪২১।