Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনায় ছাই ব্যবহার

জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনায় 
ছাই ব্যবহার
মুন্সী আবু আল মো. জিহাদ
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। পাশাপাশি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বিদ্যমান প্রযুক্তির সাহায্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে এ উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মাটির উর্বরতা সমস্যার কারণে কৃষি জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনুৎপাদনশীল থেকে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনতে আবাদি জমি বা বাড়ির আঙিনা সর্বত্রই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ১৯৬০ এর দশকে, সবুজ বিপ্লবের সূচনার সাথে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পূর্বের কৃষি নীতি অনুসরণ করার জন্য, কিছু কৃষক রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু করে। কোন কোন কৃষক আবার রাসায়নিক সার ও জৈবসার উভয়ই ব্যবহার করা শুরু করে, এ ছাড়াও অধিকাংশ কৃষক রক্ষণশীল হওয়ায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করেনি। রাসায়নিক সার প্রয়োগ করায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় বটে কিন্তু মাটির উর্বরতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
রাসায়নিক সার প্রবর্তনের আগে, বাংলাদেশের কৃষি জমিকে উর্বর করার জন্য সারের জৈব উৎসের (প্রাণিজ সার, ছাই, ফসলের অবশিষ্টাংশ এবং গৃহস্থালির বর্জ্য) উপর স¤পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। খামারের অথবা বসতবাড়ির বায়ো-মাস এ্যাশ তথা ছাই একটি চমৎকার জৈব কীটনাশক এবং উচ্চ পুষ্টি উপাদানের কারণে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি হতে পারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)র দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি হাতিয়ার। যেখানে ক্ষুধাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, উন্নত পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা তথা কৃষিকাজে লাগসই প্রযুক্তি ও পদ্ধতির প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাদেশে উন্নত ফসল উৎপাদন এবং একইসাথে মাটির উর্বরতা হ্রাসের বর্তমান চ্যালেঞ্জ সমাধানে ছাইয়ের বহুমাত্রিক ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে সমূহ সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য  কৃষিকাজে ছাই ব্যবহার প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি স্বস্তিদায়ক সমাধান। পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্রাকৃতিক ও কৃষি সম্পদের রক্ষা করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত সহনশীলতা অর্জন করা। যদিও উত্তরের উন্নত দেশগুলো এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জৈব কৃষিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান বিদ্যমান, বাংলাদেশে জৈব কৃষিতে এমন কোনও মান নেই। বলা হয়ে থাকে আদর্শ মাটিতে কমপক্ষে ৩.৫ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি জৈব পদার্থ থাকা বাঞ্ছনীয়, অথচ বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থ রয়েছে ২ শতাংশের চেয়েও কম। তারপরেও বর্তমানে সারা দেশে কৃষিতে সীমিত আকারে ছাই ব্যবহার করা হচ্ছে মূলত জৈবসার ও জৈব কীটনাশক হিসেবে। যদিও একসময় ছাইকে নিতান্তই এক প্রকার আবর্জনা এবং অপ্রয়োজনীয় হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এটি রাসায়নিক সার ব্যবহারের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবেও কার্যকর এবং সামাজিকভাবেও স্বীকৃত। 
কৃষি জমিতে ছাই ব্যবহারের উপকারিতা
ছাই মূলত মাটি শুষ্ক ও ঝুরঝুরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। দোআঁশ মাটি এবং মাঝারি নিচু জমি যেখানে জলাবদ্ধতা সমস্যার হুমকি রয়েছে সেখানে ছাই ব্যবহার সবচেয়ে উপযুক্ত। এছাড়া মাঝারি উঁচু ও উঁচু জমি হওয়া সত্ত্বেও ময়মনসিংহ ও রাজশাহী অঞ্চলের বেশকিছু স্থানে ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি ও উদ্যান জাতীয় ফসল উভয় ক্ষেত্রেই ছাইকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসকল জমি উঁচু হওয়ায় সাধারণত বন্যার কোনো সুযোগ নেই। আলগা মাটি এবং কাদামাটি উভয় ধরনের মাটিই এখানে পাওয়া যায়। মাঝারি বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা এই মাটিকে যথেষ্ট উর্বর করে তোলে। টাঙ্গাইল জেলায় এসব ছাই বেশির ভাগই সবজি বাগানে ব্যবহৃত হয়। আজকাল, আবাদি জমিতে ছাইয়ের কিছু উপকারী প্রভাবের কারণে কৃষিক্ষেত্রে ছাই সার ব্যবহার আশ্চর্যজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে ধান ক্ষেত এবং বাড়ির উঠানে সবজি চাষাবাদে এটি একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ সার এবং বালাইনাশক হতে পারে। গবেষনায় দেখা গেছে যদি প্রতি একরে পাঁচ টন ছাই প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি প্রায় এক টন ক্যালসিয়াম প্রয়োগ করবে। ক্যালসিয়ামের তুলনায়, অন্যান্য পুষ্টি উপাদান অনেক কম পরিমাণে উপস্থিত থাকে। কাঠের ছাই প্রায় চার শতাংশ পটাশিয়াম এবং দুই শতাংশের কম ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং সোডিয়ামের যোগান দেয়। সময়ের সাথে সাথে, ফসলের ফলন বজায় রাখার জন্য মাটিতে ফসফরাস এবং পটাশিয়াম যোগ করতে হবে। তদুপরি ছাই পটাশিয়ামের জোগান দেয় বলে পটাশ সারও তুলনামূলক কম ব্যবহার করা যায়। 
অল্প সংখ্যক প্রকাশিত গবেষণায় এটি দেখানো হয়েছে যে দোআঁশ মাটিতে ছাই যোগ করা হলে তা জৈবপদার্থ উৎপাদনে সীমিত প্রভাব ফেলে, যদি না অতিরিক্ত নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। কাঠের ছাইয়ের পানি শোষণের সময় কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, ছাই মূলত হাইড্রোফিলিক এবং অক্সাইডের হাইড্রেশনের রাসায়নিক পরিবর্তনের সাথে সমসাময়িকভাবে কৈশিক ক্রিয়া দ্বারা ছিদ্রগুলোতে পানি শোষণ করে। তবে বাংলাদেশে ছাই ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার উপর অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক গবেষণা রয়েছে। “বোরো ধান চাষে মাটিতে ছাই ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব” শিরোনামে গবেষণালব্ধ ফলাফলে (অপ্রকাশিত) দেখা যায়, ছাই ব্যবহারকারী কৃষকদের নিট আয় এবং আয়-ব্যয় অনুপাত সাধারণ কৃষকদের তুলনায় যথাক্রমে প্রায় ১.৫৫ গুণ ও ১.১৭ গুণ বেশি। মূলত ছাই ব্যবহারে রাসায়নিক সারের খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক লাভবান হয়।
ছাই ব্যবহার মাটির জন্য ক্ষতিকর কোন পদার্থ নেই।
ছাই-এর সাথে হলুদ ও চুন মিশিয়ে গাছের উপর স্প্রে করলে গাছকে বিভিন্ন রোগ ও কীটপতঙ্গ থেকে বাঁচানো যায়। কাঠের ছাই জৈবসার রূপে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করতে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ছাই পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম কার্বনেটের উৎস হিসেবে কাজ করে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট মাটির অ¤¬ত্ব প্রশমনে ক্ষারকরূপে কাজ করে থাকে। 
বাগানের মাটিতেও ছাই ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া ছাই কিছুটা ফলন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। মাটিতে দুর্গন্ধ হওয়া রোধ করতে ছাই বিশেষ উপকারী (বিশেষ করে কম্পোস্ট করার ক্ষেত্রে)। ছাই মাটির এসিডিটি কমাতে সাহায্য করে।
ছাই এর সবচেয়ে সাধারণ উৎস হচ্ছে, জ্বালানি হিসাবে পোড়ানো গোবর, ফসলের খড় (ধান, গম ইত্যাদি), ডালপালা, পাতা, পাটের কাঠি, বাঁশ, ধানের তুষ, আগুন কাঠের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিভিন্ন চালকলে প্রাপ্ত ধানের ভুসি ছাই সুপরিচিত একটি কৃষি বর্জ্য পদার্থ। তবে যেহেতু বেশিরভাগ ছাই বাড়ি থেকেই সরবরাহ করা হয় সেহেতু ছাইয়ের জন্য খরচ খুব কম হলেও বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারের  মতো ছাইয়ের জোগান দেওয়া সম্ভবপর নয়। অধিকাংশ কৃষকেরই এ বিষয়ে কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান নেই। স¤পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে, শুধুমাত্র বংশাণুক্রমিকভাবে দেখে আসা প্রযুক্তি হিসেবেই সীমিত পরিসরে ছাই ব্যবহার করে আসছে বছরের পর বছর । কখনও কখনও ছাই এর পুষ্টিগুণ স¤পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞানের কারণে এটি ব্যবহারে বাধা হতে পারে। 
বিবিধ ইতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ছাইয়ের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। নমুনা পরীক্ষায় কাঠের ছাইতে ভারী ধাতুও পাওয়া যেতে পারে বলে ধারনা করা হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষগার বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বের করা জরুরি। 
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কে ২০২১ সালে এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ২০২২ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান সরকার কৃষি বিষয়ক গবেষণার সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে ছাইয়ের মধ্যে মাটির স্বাস্থ্যগত কোন কোন বিষয় জড়িত, এতে কি কি সম্ভাবনা ও ঝুঁকি রয়েছে তা চিহ্নিত করে এবং ঝুঁকিগুলোকে সুযোগে রুপান্তর করার মাধ্যমে বসতবাড়ির এই আবর্জনাকে স¤পদে পরিণত করা যেতে পারে। সহজলভ্য এই ছাই-কৃষির মাধ্যমে রক্ষনশীল কৃষি নিশ্চিত করা সহজ হবে। পাশাপাশি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে নাজুক কৃষি ব্যবস্থার আশু সমাধান ত্বরান্বিত হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৬৮০৩২৬০২৫,    ই-মেইল :zihad327@gmail.com