Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে কৃষক সেবা

ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের 
মাধ্যমে কৃষক সেবা
ড. মো: নূরুল হুদা আল মামুন
ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার ভাংনামারির চর এলাকার মোঃ ভুলু মিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের জমিতে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আগে জমিতে এলাকার অন্যান্যদের মত অনুমান কইরা অনেক বেশি সার দিতাম। কতেক সার আদৌ দিতাম না । এতে ভাল ফলন পাইতাম না। অহন ভ্রাম্যমাণ মাটির গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা কইরা সার দেই। এতে আগে চেয়ে খরচ কম লাগে আবার অনেক বেশি ফলন পাই’। 
অনুরূপভাবে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার একজন আদর্শ কৃষক আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া। তিনি বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ফরিদপুর মৃত্তিকা গবেষণাগারে গিয়ে ও ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করিয়ে দানা পিয়াজে, ধানের জমিতে স্যারদের পরামর্শে সার দেই। আমি ভাল লাভবান হয়েছি’। 
একইভাবে জামালপুর জেলার চর যথার্থপুর গ্রামের আদর আলী বিগত কয়েক বছর ধরে মাটি পরীক্ষা করে সার দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চর যথার্থপুর গ্রামে প্রচুর সবজি চাষ হয়। আমাদের এলাকায় কেউ মাটি পরীক্ষার বিষয় জানত না, পরে জামালপুর গবেষণাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সবজি চাষ করি। আমরা কম সার দিয়ে ভাল ফলন পাচ্ছি’। 
ভুলু মিয়া, আদর আলী আর ওয়াদুদ মিয়ার  মতো অনেক স্মার্ট চাষিরা এখন নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে ফসল আবাদ করেন। এমন সফলতার গল্প এখন সারা দেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ স্থায়ী মৃত্তিকা গবেষণাগার আবার কেউ ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করছেন। আসুন এ সফলতার পেছনের রহস্যটা জেনে নেওয়া যাক। 
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার প্রয়োজন তেমনি সব গাছেরও খাবারের প্রয়োজন হয়। আমরা জানি, যে কোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যেসব খাদ্যোপাদানের দরকার হয় তার মধ্যে ১৭টা খাদ্যোপাদান অত্যন্ত জরুরি। যদিও ১৭টি খাদ্যোপাদানের বাইরে আরো অনেক উপাদান আছে, তবে সেগুলো বিশেষভাবে জরুরি নয়। ১৭ টি খাদ্যোপাদানের মধ্যে মাত্র ৩টি খাদ্য প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ পেয়ে থাকে। গাছ আলোর উপস্থিতিতে বায়ুম-ল থেকে কার্বন ও অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং পানির মাধ্যমে হাইড্রোজেন নিয়ে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে। গাছের বৃদ্ধি ও জীবন চক্রের উন্নতি অর্থাৎ ফুল ফলের মাধ্যমে পরিসমাপ্তির জন্য আরো ১৪টি পুষ্টি উপাদান আবশ্যক যা শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাগনেসিয়ামকে ম্যাক্রো বা প্রাথমিক জরুরি খাদ্য উপাদান বলা হয়। এ ছাড়া অনুখাদ্য হিসেবে লোহা, বোরন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, তামা, মলিবডেনাম, নিকেল ইত্যাদিও উদ্ভিদ মাটির থেকে খনিজ লবণের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। 
ক্রমাগতভাবে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির শতকরা ৭৫ ভাগ তার উর্বরতা হারিয়েছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয় ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সাথে ফসফরাস যুক্ত হয়। এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয় ১৯৬০ সালের দিকে। ১৯৮০ সাল থেকে সালফারের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরণ ঘাটতি দেখা দেয়। এখন আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরণ, ম্যাগনেসিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর         কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদান তথা সার প্রয়োগ করে এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার বা সার দেওয়া দরকার। একজন কৃষক বহু বছর ধরে চাষ করছেন, বছরের পর বছর একটার পর একটা ফসলের চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। প্রতিটি চাষের সময় নানা রকমের রাসায়নিক সারের ব্যবহার করছেন। মাঝে মধ্যে জৈবসারও দেয়া হচ্ছে যদিও তা প্রয়োজনের চেয়েও কম মাত্রায়। বেশির ভাগ কৃষক জৈবসার ব্যবহার কম করে থাকেন, ফলে মাটির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহার করছেন না। ফলে দিনের পর দিন এভাবে চলার ফলে জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে, ফলে ফলন কম হচ্ছে।
মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব : যে মাটিকে কেন্দ্র করে চাষাবাদ করা হচ্ছে তার স্বাস্থ্যের খবর রাখছেন না অনেকেই। এর জন্য দরকার নিয়মিত কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করা। মাটি পরীক্ষা করলে জানা যাবে কী কী খাদ্যোপাদান কী পরিমাণে আছে। কী পরিমাণে বাড়তি সার বা খাদ্য উপাদান দিতে হবে। এমনও দেখা যায় বছরের পর বছর মাত্রানুযায়ী নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম জমিতে দেওয়া হচ্ছে-কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেল ফসফেটের মাত্রা অতি উচ্চ, পটাশের মাত্রাও অনেক বেশি-আবার অন্যান্য খাদ্যোপাদানের মাত্রা বেশ কম রয়েছে। কৃষক ফসল অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় মাত্রায় সারের ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পর জানা যায় বেশ কিছু সারের অপব্যবহার হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি জমির বছরে অন্তত একবার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব না হলে কমপক্ষে       ৩-৪ বছর পরপর মাটি পরীক্ষা করা উচিত। এর ফলে শুধু সারের অপব্যবহারই কমবে তাই নয়, সেইসাথে বেশি মাত্রায় বারবার সারের ব্যবহারে জমিতে সেইসব খাদ্যগুণ জমে অন্য খাদ্যকেও অগ্রহণযোগ্য করে দেয়। মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি হয়। বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমতে থাকে ফলে ফসলের ফলন কমে যায় এবং মাটি মৃত হয়ে যায়, যেমন মরুভূমির মাটিকে মৃত মাটি ধরা হয়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য জানার পর সুষম সার ব্যবহার করলে শুধুমাত্র যে অর্থের সাশ্রয় হবে তা নয়, মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, পরিবেশ ভাল থাকবে। যখন জানা যাবে মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি তলানিতে নেমেছে, তখন মাটি ও ফসল বাঁচাতে কৃষক উঠে পড়ে লাগলেও মাটির স্বাস্থ্য পুনুরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ১৫-২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এসব কারণে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।
কোথায় মাটি পরীক্ষা করা যায় : প্রধানত মাটির ঢ়ঐ (অম্ল/ক্ষারের পরিমাণ), ঊঈ বা লবণের পরিমাণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, বোরন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশে দুই ধরনের গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করা হয়। স্থায়ী গবেষণাগার এবং ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা গবেষণাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড দেওয়া হয় । কৃষি মন্ত্রণালয় অধীন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ৭টি বিভাগীয় গবেষণাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার রয়েছে। বিভাগীয় এসব গবেষণাগারগুলো ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং বরিশাল অবস্থিত। আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলো ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাংগাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাংগামাটি এবং পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এসব স্থায়ী গবেষণাগারের মাধ্যমে বছরের যে কোন সময়ে ৬৩ টাকার বিনিময়ে মাটির প্রায় সকল উপাদান পরীক্ষা করা যায়।
এ ছাড়া জনগণের দোরগোড়ায় কৃষক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ১৯৯৬ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী যমুনা, তিতাস, তিস্তা, রূপসা, মধুমতি, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, করতোয়া, এবং কীর্তনখোলা নামে ১০টি ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার চালু রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ এসব পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বছরের রবি ও খরিপ এই দুই মৌসুমে সরেজমিন মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এ সময় এসব ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগার থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত ৩-৫ দিন) অবস্থান করে এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলের সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড প্রদান করা হয়। এসব উপজেলার আগ্রহী কৃষকরা নমুনা প্রতি মাত্র ২৫ টাকা হারে নির্ধারিত ফি প্রদান করে (যদিও মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণের প্রকৃত খরচ ৪৪০ টাকা মাত্র) মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম মাত্রার সার সুপারিশ কার্ড নিতে পারেন। মাটি পরীক্ষার জন্য সঠিক নিয়মে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দিতে হয়। সংগৃহীত ওই মৃত্তিকা নমুনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করে সার সুপারিশ কার্ড প্রণয়ন ও বিতরণ করে থাকেন।  
পরিশেষে, দেশের কৃষি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগারের মাধ্যমে সরেজমিন দ্রুত মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। এ ভাবে মৃত্তিকা সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখা আমাদের একান্ত কর্তব্য। 

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর। মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৯৫০৯, ইমেইল :nhalmamun@gmail.com