কেশর আলুর বাণিজ্যিক ব্যবহার
ড. শাহানা পারভীন
কেশর আলু একটি কন্দালজাতীয় ফসল। প্রচলিত অর্থে ফল না হলেও এটি ফল অথবা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এর ব্যবহার অথবা খাদ্যাভ্যাস খুব একটা না থাকলেও মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় এর চাষ হয় এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রহ করা হয়। উৎপাদনশীলতা কম এবং অধিক পচনশীল হওয়ায় এর বাজার ব্যবস্থা অপ্রতুল। অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক বিক্রিয়া, ফসল সংগ্রহের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, অতিরিক্ত অংক্ররোদগম হওয়া, শুকিয়ে যাওয়া এবং ব্যকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে কেশর আলু প্রচুর পরিমাণে অপচয় হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর অপচয় রোধ এবং বাজার মূল্য উন্নত করা সম্ভব।
ফল হিসেবে সরাসরি অথবা জুস হিসেবে কিংবা সালাদ হিসেবে এটি খাওয়া যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জেলি, কেক অথবা বিস্কুট তৈরি করেও খাওয়া যায়। এটি পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, শর্করা ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য। এতে প্রায় ১০.৩% শর্করা এবং ১.৩% অপরিশোধিত আঁশ রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে এর উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য জুস থেকে জেলি অথবা পাউডার থেকে কেক অথবা বিভিন্ন রকমের বিস্কুট তৈরি করা যেতে পারে।
কেশর আলুর জুস প্রস্তুতকরণ
জেলি তৈরির জন্য প্রথমে জুস তৈরি করতে হয়। জুস তৈরির জন্য সতেজ ও পরিপক্ব কেশর আলু ভালোভাবে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করতে হবে। টুকরোগুলো সমপরিমাণ পানির সাথে প্রায় ১০ মিনিট ফুটাতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে -১০০ সে. তাপমাত্রায় ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। এই জুস দিয়ে জেলি তৈরি করা যাবে। জেলির গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষার জন্য কেশর আলুর জুসের সাথে বিভিন্ন অনুপাতে গাজর, আম এবং কমলার জুস মিশিয়ে জেলি তৈরি করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
গাজরের জুস তৈরির জন্য সতেজ, পরিপক্ব গাজর খোসা ছাড়িয়ে, পরিষ্কার করে ধুয়ে টুকরা করে, সমপরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে ১০ মিনিট জ্বাল করতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে কেশর আলুর জুসের মতো -১০০ সে. তাপমাত্রায় ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। আমের জুস তৈরির জন্য অক্ষত, পরিপক্ব, পাঁকা আম ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে, চেপে পাল্প বের করতে হবে। আমের পাল্প মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে প্রায় ১০ মিনিট ৮০-৮৫০ সে. তাপমাত্রায় পাস্তুরিত করার পর জেলি তৈরির জন্য প্রস্তুত হবে। কমলার জুস তৈরির জন্য অক্ষত, পরিপক্ব ও পাকা কমলা ভালোভাবে ধুয়ে আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে। এরপর যান্ত্রিক নিষ্কাশনকারী দিয়ে রস বের করতে হবে। মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে প্রায় ১০ মিনিট ৮০-৮৫০ সে. তাপমাত্রায় পাস্তুরিত করার পর জেলি তৈরির জন্য প্রস্তুত হবে।
কেশর আলু, গাজর, আম এবং কমলার জুসের উপাদানসমূহ তুলনা করলে দেখা যায় যে, কেশর আলুতে প্রায় ৪% টিএসএস রয়েছে যেখানে গাজরে রয়েছে প্রায় ৬%, কমলাতে ১২% এবং আমে রয়েছে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৬%। কেশর আলুতে পানির পরিমাণ প্রায় ৮৪.৬%, গাজরে ৮৫%, আমে ৭৬.৬% এবং কমলাতে রয়েছে প্রায় ৮৯.৪%। দেখা যাচ্ছে আমে সব থেকে কম এবং কমলাতে সব চেয়ে বেশি পানি রয়েছে। গাজর, আম এবং কমলার তুলনায় কেশর আলুতে চিনির পরিমাণ কম। মোট চিনি (রিডিউসিং এবং নন-রিডিউসিং) প্রায় ২.৫% রয়েছে কেশর আলুতে, গাজরে ৪.৩২%,আমে ১০.৭% এবং কমলাতে প্রায় ৯.৯৪%। অম্লতার পরিমাণও কেশর আলুতে সব চেয়ে কম। যেমন- এতে অম্লতার পরিমাণ প্রায় ০.০২%, পক্ষান্তরে গাজরে ০.০৪%, আমে ০.৪৫% এবং কমলাতে প্রায় ০.৫৪% অম্লতা রয়েছে। পিএইচ মাত্রা পরিক্ষা করলে দেখা যায়, কেশর আলুর পিএইচ মাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬.৫। গাজরের জুসে প্রায় ৬.০, আমের জুসে ৪.৩ এবং কমলার জুসে ৪.৫ পিএইচ মাত্রা পাওয়া গেছে। এসকরবিক এসিডের পরিমাণ কেশর আলুর জুসে তলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে। এর পরিমাণ মাত্র ১০ মি.গ্রা./১০০গ্রা.। গাজর, আম এবং কমলার জুসে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৫, ৪১ এবং ৪০ মি.গ্রা./১০০গ্রা.। এ ছাড়া কেশর আলু, গাজর, আম এবং কমলার জুসে অ্যাসের পরিমাণ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ০.৬%, ০.৯%, ০.৯% এবং ০.১%।
কেশর আলুর জেলি প্রস্তুতকরণ
জেলি প্রস্তুতের জন্য জুস এবং চিনি ৪৫:৫৫ অনুপাতে মিশিয়ে অল্প তাপে জ্বাল করতে হয়। কেশর আলুর জুস ১০০ ভাগ, কেশর আলুর জুস এবং গাজর, আম এবং কমলার জুস যথাক্রমে ৯০:১০, ৮০:২০, ৭০:৩০ অথবা ৫০:৫০ অনুপাতে মিশিয়ে প্রায় ১৩টি সংমিশ্রণের মাধ্যমে ১৩ রকমের জেলি তৈরি করে এর গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষা করা হয়েছে। জুস জ্বাল করার সময় মাঝে মাঝে নাড়তে হবে। ফুটন্ত তাপমাত্রা যখন ১০৪.৫-১০৫০ সে. এর মত হবে এবং জুস পরিমাণ মতো ঘন হবে তখন এসিড এবং পেকটিন দিয়ে নেড়ে নামিয়ে ঠা-া করে বোতলজাত করতে হবে। জেলির গুণাগুণ পরীক্ষা করে এতে টিএসএস এর মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৪.০%-৬৭.৫% এর মধ্যে। পানির পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৯.৯৫-৩১.৯৫% এর মধ্যে। মোট চিনির পরিমাণ প্রায় ৬৪.২-৬৬.৫%। অম্লতার পরিমাণ প্রায় ০.৮-০.৯৯%। পিএইচ মাত্রা পাওয়া গেছে প্রায় ২.৯-৩.২৫ এর মধ্যে। এসকরবিক এসিড এবং অ্যাস এর পরিমাণ যথাক্রমে ১.৩২-২.৯৫% এবং ০.২৯-০.৪২% পাওয়া গেছে।
কেশর আলুর পাউডার প্রস্তুতকরণ
সতেজ এবং পরিপক্ব কেশর আলু ভালোভাবে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করতে হবে। টুকরোগুলো সমপরিমাণ পানির সাথে প্রায় ১০ মিনিট ফুটাতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে কেবিনেট ড্রায়ারে ৭০০ সে. তাপমাত্রায় শুকাতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত এর আর্দ্রতা ৩-৫% এ পৌঁছে। শুকনো পাল্প গ্রাইন্ডারে পাউডার করে পলিথিলিন ব্যাগ এ প্যাকেটজাত করতে হবে।
প্লেইন কেক এবং বিস্কুট প্রস্তুতকরণ
গমের ময়দা এবং কেশর আলুর পাউডার বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে প্লেইন কেক এবং বিস্কুট প্রস্তুত করে এর গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষা করা হয়েছে। কেশর আলুর পাউডার এবং গমের ময়দার মিশ্রণের বিভিন্ন অনুপাত হলো: ১০:৯০, ২০:৮০ এবং ৩০:৭০। প্লেইন কেক তৈরির জন্য কেশর আলুর পাউডার, গমের ময়দা এবং বেকিং পাউডার পরিমাণ অনুযায়ী মিশ্রণ করতে হবে। আলাদা পাত্রে চিনি, বাটার ওয়েল, স্কিম মিল্ক, ডিম, এসেন্স, লবন ভালোভাবে মিশাতে হবে। উভয় মিশ্রণ পুনরায় মিশ্রণ করে ওয়াক্সড পেপার দিয়ে মোড়ানো পাত্রে ঢেলে ইলেকট্রিক ওভেন এ ১৭৭০ সে. তাপমাত্রায় প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ মিনিট বেক করতে হবে। ঘরের তাপমাত্রায় প্রায় ১০ মিনিট ঠা-া করার পর স্লাইস করে পরিবেশন উপযোগী হবে।
বিস্কুট তৈরির জন্য কেশর আলুর পাউডার, গমের ময়দা এবং বেকিং পাউডার পরিমাণ অনুযায়ী মিশ্রণ করতে হবে। আলাদা পাত্রে চিনি, ডালডা, ঘি, স্কিম মিল্ক পাউডার, ডিম, এসেন্স, লবন ভালোভাবে মিশাতে হবে। সমস্ত মিশ্রণ ইলেকট্রিক মিক্সচার মেশিনে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রায় ৫ মিনিট স্থির রাখতে হবে। ডো ভালোভাবে হয়ে গেলে বিস্কুটের আকার বানাতে হবে। প্রায় ১০ মিনিট বিস্কুটগুলো স্থিরভাবে রাখার পর ইলেকট্রিক ওভেন এ ২০৫০ সে. তাপমাত্রায় হালকা বাদামি রং হওয়া পর্যন্ত বেক করতে হবে। বিস্কুটগুলো ঠা-া করে প্যাকেটজাত করতে হবে।
তৈরিকৃত প্লেইন কেক এ প্রায় ৩১.৫-৩১.৮১% আর্দ্রতা পাওয়া গেছে। অ্যাস পাওয়া গেছে ২.০২-২.০৭%। ফ্যাট, প্রোটিন এবং শর্করা পাওয়া গেছে যথাক্রমে প্রায় ২৮.৪%, ১২% এবং ২৫.৪৫%। পক্ষান্তরে বিস্কুট এ প্রায় ২.৮৭-২.৯% আর্দ্রতা পাওয়া গেছে। অ্যাস পাওয়া গেছে প্রায় ১.৩০-১.৪০%। ফ্যাট, প্রোটিন এবং শর্করা পাওয়া গেছে যথাক্রমে প্রায় ১৫.৫%, ৮% এবং ৭২%।
সংবেদনশীল স্বাদ প্যানেল পরীক্ষণ
সংবেদনশীল স্বাদ প্যানেল পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে, প্রায় ১৫%, ৭৭% এবং ৮% জেলি যথাক্রমে অসাধারণ, ভালো এবং মোটামুটি ভালো খাদ্য পণ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। কোনো জেলির নমূনা খারাপ বলে বিবেচিত হয়নি। কেশর আলু এবং গাজরের জুস ৮০:২০ অনুপাতে তৈরিকৃত জেলি এবং কেশর আলু এবং আমের জুস ৫০:৫০ অনুপাতে তৈরিকৃত জুস চমৎকার খাদ্যপণ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। প্লেইন কেক এর ক্ষেত্রে ৬৭% এবং ৩৩% কেক যথাক্রমে অসাধারণ এবং মোটামুটি ভালো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। অপরপক্ষে, বিস্কুট এর ক্ষেত্রে, ৬৭% এবং ৩৩% বিস্কুট যথাক্রমে ভালো এবং মোটামুটি ভালো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কেশর আলুর জুস দিয়ে অথবা কেশর আলুর জুসের সাথে গাজর, আম এবং কমলার জুস বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে তৈরিকৃত জেলির একটি সুন্দর সম্ভাবনা হয়েছে। গমের ময়দার সাথে ২০% পর্যন্ত কেশর আলুর পাউডার মিশিয়ে অসাধারণ কেক এবং ভালো মানের বিস্কুট তৈরি করা য়ায়। এভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কেশর আলুর অপচয় রোধ করা যাবে।
লেখক : এসএসও, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। মোবাইল : ০১৬৭২০৪১৪৮২, ই-মেইল :parveenboori98@yahoo.com