খাদ্য, পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের কথকতা
মোরসালীন জেবীন তুরিন
খাদ্য ও পুষ্টি দু’টি শব্দের খুব ঘনিষ্ঠতা থাকলে ও অর্থের ব্যাপকতায় এরা আলাদা। বেশ কিছুদিন আগেও খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে আলাদা করে ভাবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে হলে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিশাল জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছি না, দেশে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও মানুষ সঠিক খাদ্যাভাস ও সঠিক জীবনযাত্রা না মেনে কারণে শারীরিক মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং যার ফলে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে বিভিন্ন ডাক্তার কবিরাজের কাছে। সেজন্য আমাদের খাদ্য , পুষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে।
আমরা বেঁচে থাকার তাগিদে খাবার খেয়ে থাকি এর সাথে পুষ্টি থাকতেও পারে নাও পারে। পুষ্টি হচ্ছে এমন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যাতে গ্রহণকৃত খাদ্য পরিপাক, বিপাকে ও পরিশোষণ হয়ে শরীরের বৃদ্ধি ক্ষয়পূরণ, শক্তি উৎপাদনে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। মোট কথা পুষ্টি গ্রহণকৃত খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে পুষ্টি আমাদের শরীরের পরিচর্যা করে।
খাদ্যের উপাদানগুলোর তালিকা আমাদের জানতে হবে। খাদ্যের উপাদানগুলো হলো : শর্করা, আমিষ, তেল/ চর্বি, ভিটামিন, খনিজ, আঁশ ও পানি। এই প্রতিটি উপাদান আমাদের শরীরে বিভিন্ন কাজ করে থাকে, যেমন- শর্করাজাতীয় খাদ্য আমাদের শরীরে শক্তি জোগায় যা আমাদের কাজ করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন দানাদার খাদ্য যেমন- চাল, গম ভুট্টা, বার্লি, এ ছাড়া মিষ্টি আলু, কচু, চিনি মধু ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা আছে। আমাদের মোট ক্যালরি চাহিদার ৬০% -৭০% যেন শর্করাজাতীয় খাবার থেকে আসে। যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণটাই বেশি হয়ে থাকে, আমাদের দেশের মানুষ সর্বোপরি ৩৬৭ গ্রাম শর্করাজাতীয় খাবার খেয়ে থাকে, যেখানে শর্করা গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৩৫০ গ্রাম। এই অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণই আমাদের দেহে শক্তি জোগান শেষে তা শরীরে চর্বি রূপে জমতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে স্থূলতায় ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ শরীরে আয়রন শোষণে বাধা দেয়, যা রক্তশূন্যতার জন্য দায়ী। তাই আমাদের পরিমিত শর্করাজাতীয় খাবার খেতে হবে।
এরপরে রয়েছে আমিষজাতীয় খাদ্য, যার উৎস সাধারণত প্রাণিজ (মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদি) ও উদ্ভিজ্জ (ডাল, বীজ ইত্যাদি) হয়ে থাকে। আমাদের শরীর গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। আমিষে নাইট্রোজেন ও প্রয়োজনীয় এ্যামিনো এসিড থাকায় এই খাদ্যের গুরুত্ব শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাদ্য থেকে আলাদা। ১ গ্রাম আমিষে ৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। রিকোমেন্ডেট ডায়েটারি এলাওয়েন্স (জউঅ) অনুযায়ী শরীরের প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১.০ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। আমাদের শরীরে একসংগে ৩০ গ্রাম আমিষ হজম করতে পারে। তাই এর বেশি আমিষ এক সাথে পেটে পড়লে তা কাজে লাগবে না। আমিষজাতীয় খাদ্য বাড়ন্ত বাচ্চাদের ও গর্ভবতী মহিলাদের তুলনামূলক বেশি লাগে যেহেতু বাচ্চারা ও গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশু দ্রুত বৃদ্ধি পায়, সেক্ষেত্রে বাচ্চা ও গর্ভবতী মা তাদের প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ২-৩ গ্রাম আমিষজাতীয় খাবার খেতে পারে। আবার বয়স্ক ব্যক্তিদের পাকস্থলীতে হজমের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে তারা আমিষজাতীয় খাবার দ্রুত হজম করতে পারে না আবার তারা ভারী কাজ করে ও হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে না। তাই আমিষজাতীয় খাবার গ্রহণের পর সাথে সাথে যাতে না শুয়ে পড়ে এবং পরিমিত গ্রহণ করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এবার তেল বা চর্বি, যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল তাকে তেল আর সাধারণ তাপমাত্রা যা কঠিন তাকে চর্বি বলা হয় এই তেল বা চর্বিজাতীয় খাবারের থেকে আমরা প্রচুর ক্যালরি বা তাপ শক্তি পেয়ে থাকি। ১ গ্রাম তেল বা চর্বি থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়, যা শর্করা ও আমিষের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। দুধের সর, পনির, ডিমের কুসুম, বাদাম, সরিষার তেল, সূর্যমুখীর তেল, সয়াবিন তেল উপাদান হতে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তি পাওয়া যায়, বাচ্চারা এসব খাবার অল্প পরিমাণে গ্রহণ করে এবং তাদের মোট ক্যালরির চাহিদা পূরণ করতে পারে। তেল বা চর্বি বাচ্চাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্টে সহায়তা করে। আর প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য জনপ্রতি ৩০ গ্রাম তেল গ্রহণ করা উচিত। অতিরিক্ত ভাজা পোড়া ও তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ এসব খাবার বদহজম, স্থূলতা কোন কোন ক্ষেত্রে কারসিনোজিস সৃষ্টি করে।
আঁশ, ভিটামিন ও মিনারেলসের নির্ভেজাল ও সহজলভ্য উৎস্য হলো বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি, ফলমূল, বীজ, বাদাম, দুধ, ডিম, লাল চাল, লাল আটা, ছোট মাছ, মাশরুম ও কলিজা ও লাল মাংস।
শাকসবজি ও ফলমূল লো-ক্যালরি ও অনেক ভিটামিন ও মিনারেলস এর আধার। তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় এই ধরনের খাবার বেশি রাখা উচিত। প্রতিদিন ১০০ গ্রাম শাক, ২০০ গ্রাম সবজি, ১০০ গ্রাম টক ও মিষ্টি মিলিয়ে ১০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করা উচিত। আবার শাকসবজি যখন আমাদের প্লেটে আসে তখন আয়রন শোষণ করার জন্য শাকের সাথে লেবু বা কাঁচামরিচ রাখতে হবে। আবার লবণের আয়োডিন পরিপূর্ণভাবে পেতে হলে আয়োডিনযুক্ত লবণ ঢেকে রাখতে হবে, রান্নার শেষে লবণ দিতে হবে এবং পরিমিত (৫-৬ গ্রাম) লবণ গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত লবণ উচ্চরক্তচাপসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারের সময় বাড়তি লবণ যেমন পরিহার করতে তেমনি ভাজা লবণ গ্রহণ থেকে ও বিরত থাকতে হবে। মিষ্টিজাতীয় খাবার ও আমাদের পরিমিত (২৫ গ্রাম) গ্রহণ করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে যেন মৌসুমি ফল থেকেই প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টিজাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণ করা যায়। এ ছাড়া আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গ্রহণকৃত খাবারের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের কার্যকারিতা বাড়াতে শরীরে সূর্যের আলো ও লাগানো নিশ্চিত করতে হবে। সূর্যের আলো লাগানোর সঠিক সময় হলো সকাল ১০টা হতে বেলা ৩টা পর্যন্ত। এ ছাড়া আমাদের সব ধরনের খাবার সাথে ২-৩ লিটার নিরাপদ পানি পান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আমাদের হজম, শোষণ, আত্ত¥ীকরণ ও শরীরে তাপমাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। কোমল পানীয় পরিহার করে ফলের রস পান করা বেশি পুষ্টিসম্মত।
সর্বোপরি আমাদের সুষম খাবারের সাথে নিরাপদ খাবার গ্রহণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সঠিক শারীরিক পরিশ্রম, সঠিক বিশ্রামের ও সুস্থ চিন্তার মাধ্যমে নিজেদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারি করতে পারব।
সুস্থতা আমাদের সবার কাম্য এর জন্য আমাদের সচেতনতা, সদিচ্ছা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশ সুস্থ, কর্মক্ষম ও উন্নত জাতি সম্মিলিতভাবে গঠন করা সম্ভব।
লেখক : ঊর্ধ্বতন প্রশিক্ষক, বারটান, আঞ্চলিক কার্যালয়, সিরাজগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭২৩৬৭২১৯২, ই-মেইল :turinbsmrau@gmail.com