গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আধুনিক পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
উত্তম কৃষি চর্চা বা (এঅচ) হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করে। উত্তম কৃষি চর্চায় এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা করা হয়, যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য হয়ে থাকে। এটি একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয় যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে। এ সকল নিরাপদ মানদ- নিশ্চিতে বিশেষ করে ফসল মাঠে নির্দিষ্ট মানদ- অনুযায়ী নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদনের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য নীতিমালা বা পদ্ধতিই হলো বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা।
উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হলো- নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন ফসলের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণ; পরিবেশ সহনীয় ফসল উৎপাদন নিশ্চিতকরণ এবং কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধন; খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা; ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানসম্পন্ন উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা।
আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী এবং বাণিজ্যিক ফসল। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে এ ফলটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আম উৎপাদনকারী এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই আমের উপর নির্ভরশীল। প্রধান প্রধান আম উৎপাদনকারী এলাকা যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, সাতক্ষীরা ইত্যাদি জেলাগুলোর ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সাথে জড়িত থাকে। বর্তমানে যে ফলগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে আম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিবিএস ২০২৩ সালের তথ্য মতে এদেশে ১২.০৭ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা এর তথ্য অনুযায়ী এদেশে আম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৩.৫ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমাদের দেশে আমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ঠ। এরপরও বাজারে গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আমের অভাব রয়েছে। ফলে আম রপ্তানি পরিমাণ আশানুরূপভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভালোমানের গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের এখনই উপযুক্ত সময়। এখন থেকে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন করা সম্ভব হলে ভালোমানের আম উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে।
আম বাগানের যত্ন ও পরিচর্যা
বারোমাসী জাতের আম বারি আম-১১ এবং কাটিমুন প্রায় সারা বছরই বাগানে থাকে এবং এসব জাতের যত্ন-পরিচর্যা মৌসুমি জাতের মতো নয়। সুতরাং এ জাতগুলো নিয়ে আলাদা ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
ডালপালা ছাঁটাইকরণ : আম সংগ্রহের সাথে সাথেই এ কাজটি করার জন্য আম চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। গাছের মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা, অন্য গাছের ভেতরে প্রবেশ করেছে এ সকল ডালপালা এবং গাছের আকৃতি সুন্দর রাখতে বড় ডালপালার কিছু অংশ কর্তন করতে হবে। এ ছাড়াও গাছের ক্যানোপি অত্যন্ত ঘন হলে গাছের ভেতরের কিছু ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। আম সংগ্রহ করার পর মুঞ্জুরীটি গাছে লেগে থাকলে সেটি অপসারণ করতে হবে। এর ফলে গাছে দ্রুত নতুন কুশি জন্মাবে। আম সংগ্রহ করার পর একটি গাছে যত বেশি নতুন কুশি আসবে ততই পরের মৌসুমে ফুল আসার সম্ভবনা বেশি। জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে একটি ফলবান গাছে যত বেশি কুশি আনা যাবে ততই মঙ্গল। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে আম চাষাবাদের ক্ষেত্রে ডালপালা ছাঁটাইকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু বেশিরভাগ চাষি এ বিষয়টি জানেন না অথবা গুরুত্ব দিয়ে সময়মতো কাজটি করেন না। গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রুনিং ও ট্রেনিং এর গুরুত্ব রয়েছে।
আগাছা পরিষ্কার : আগাছা আম গাছের খাদ্যে ভাগ বসায় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ আম বাগানগুলো এসময় আগাছা দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করলে সারা বছর আম বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আম বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে রোগবালাই এর আক্রমণ অনেক কমে যায় এবং উৎপাদিত ফলের গুণগত মান ভালো হয়। আম গাছের গোড়ায় এবং আমবাগানে যাতে আগাছা না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগাছা দমন করতে বাগানে লাঙ্গল বা টিলারের সহায্যে মাঝে মাঝে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : আমবাগান হতে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সময়মত সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি গাছে প্রতি বছর কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পুষ্টি উপাদানের উপর। সব ধরনের মাটিতে সারের চাহিদা সমান নয়। সুতরাং মাটির অবস্থাভেদে সারের চাহিদা কম-বেশি হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চায় আম বাগানে সার প্রয়োগের পূর্বে মাটির পুষ্টি উপাদান বিশ্লেষণের পর মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ফলে কোন উপাদানের ঘাটতি হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে।
চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সুষম সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। চারা রোপণের পূর্বে প্রতিটি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি, জিপসাম ৩১৩ গ্রাম, জিংক সালফেট ২৮ গ্রাম এবং বোরিক এসিড ৫৯ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এরপর ভালোভাবে গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর গর্ত ভরাট করে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। ভালোভাবে পচন সম্পন্ন হলে পুনরায় গর্তের মাটি ওলট-পালট করে গর্তের মাঝখানে কলমের চারা লাগাতে হবে। এরপর গাছের বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে (সারণি দ্রষ্টব্য)।
সারণি : গাছের বয়স অনুযায়ী সারের পরিমাণ
মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ কম/বেশি হলে এ মাত্রাটি সমন্বয় করে প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : বয়সভেদে নির্ধারিত সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বোরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ জাতভেদে ফল যখন ফল মটর দানার মতো হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের কমপক্ষে ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশি হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
সেচ প্রয়োগ পদ্ধতি
আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে সেচের পানি যেন দূষিত না হয় বা পানিতে কোন ভারী ধাতু দ্বারা সংক্রমিত না হয় সেটি নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণত গভীর নলকূপের পানি সেচ কাজের জন্য ব্যবহার করা যায়। খরা মৌসুমে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের প্রয়োজন পড়ে না। গবেষণা করে দেখা গেছে আম গাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাৎ গাছের গোড়ার চারিদিকে ১ মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মতো করে বেসিন তৈরি করে সেচ প্রয়োগ করলে সেচে পানির পরিমাণ কম লাগে এবং গাছ বেশির ভাগ পানি গ্রহণ করতে পারে।
বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ প্রয়োগকৃত জায়গা কচুরিপানা দ্বারা ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেওয়া উত্তম। কারণ কোন কোন সময় দেখা গেছে, এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হয় ফলে মুকুলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করা যেতে পারে ফলে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হবে এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
ধ্যারা বা পরগাছা : আমাদের দেশে আমগাছে দুই ধরনের পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আম গাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা আমগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শেকড় থাকে না, তারা শেকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাস জাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আম পাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায় না তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধারণ করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায়। এ সময়ে পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্থায় থাকে ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিতে খায় কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটাস্থানে রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ও ফল আসার আগেই সেটি ছাঁটাই করা উচিত।
বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা শুধুমাত্র গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদন নিশ্চিত করেনা অধিকন্তু কর্মীর স্বাস্থ্য, পরিবেশগত এবং লাভজনক উৎপাদন নিশ্চিত করে। এ দেশে নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন আমের উৎপাদন বাড়াতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল:sorofu@yahoo.com