Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বৈশ্বিক-জলবায়ু-মোকাবিলায়-পরিবেশবন্ধু-তাল-চাষের-গুরুত্ব

বৈশ্বিক জলবায়ু 
মোকাবিলায় পরিবেশবন্ধু 
তাল চাষের গুরুত্ব
আয়েশা সুলতানা
তাল সাধারণত গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের গাছ। তালগাছ এক লিঙ্গবিশিষ্ট উদ্ভিদ অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা এবং শুধু স্ত্রী গাছেই ফল ধরে। পরাগায়নের সুবিধার জন্য ১৫/২০টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ থাকা প্রয়োজন। চারা লাগানোর ১০-১২ বছর পর গ্রীষ্মের শুরুতে স্ত্রী গাছের মোচায় ফুল আসে। প্রতি মোচায় ১০১৫টি ফল ধরে। পরিপক্ব একটি গাছ থেকে বছরে ১৫০-২৫০টি ফল পাওয়া  যায়। জাতভেদে ফল গোলাকার, রং কালো থেকে গাঢ় হলুদ হয়ে থাকে। প্রতি ফলে ২-৩টি বীজ থাকে। তালগাছ খুবই ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং দেড়শত বছরের মত বাঁচে।
সাময়িক বন্যা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু এই গাছটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন মাটিতে জন্মাতে পারে। অম্লভাবাপন্ন হালকা পলিমাটি তাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশি তাল উৎপাদন হলেও গাজীপুর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭১৪৯ হেক্টর জমিতে ১.২ লক্ষ মেট্রিক টন তাল উৎপাদন হয়েছে। পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রক্ষাকারী পরম বন্ধু তালগাছের অপ্রতুল চাহিদা মেটাতে সরকারি নার্সারিগুলোতে দেশীয় উন্নত জাতের চারা উৎপাদনের কাজ চলমান রয়েছে।
খাদ্য ও ভেষজগুণ 
তালের ফল এবং বীজ দুটিই ভক্ষণযোগ্য। কাঁচা তালের শাঁস খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। গরমে তালের শাঁস খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তালের শাঁসকে নারিকেলের মতোই পুষ্টিকর বলে পুষ্টিবিদরা বিবেচনা করেন। এতে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ফাইবার এবং খনিজ উপাদান থাকে। ক্যালরির পরিমাণ কম থাকায় তালের শাঁস ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। একই সাথে এটি ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগ থেকে আমাদের বাঁচায়। পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যা এবং হজমের সহায়ক হিসেবে প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে তালের শাঁস। এটা কোষ্টকাঠিন্য কমায় এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আলসার এবং এসিডিটি দূর করতেও সাহায্য করে এটি। গভর্বতী নারীদের হজমের জন্য এটি বেশ উপকারী। তালের শাঁস আমাদের স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে এবং শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে থাকে। বমি ভাব আর মুখের অরুচিও দূর করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তালের শাঁসে ক্যালসিয়াম থাকায় এটি দাঁতের জন্য অনেক ভালো। দাঁতের এনামেল ভালো রাখে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। তালের শাঁস হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে। কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূরীকরণে দারুণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও চোখের এলার্জিসহ অন্যান্য চোখের রোগের প্রকোপ কমাতে তাল অনেক কার্যকরী। তালের শাঁস খেলে লিভারের সমস্যা দূর হয়। এতে থাকা ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্স খাবারে রুচি বাড়াতে সাহায্য করে।
পরিবেশ রক্ষায় তালগাছের গুরুত্ব
পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ আগামী দিনের কৃষির পরমবন্ধু। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঘন ঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় তালগাছ অবদান রাখতে পারে। এছাড়া পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়তে পারে তালগাছ। তালগাছ খরা এবং বন্যা সহনশীল গাছ। এ গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছে না; তবে গুচ্ছ মূলগুলো চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং ভূমির ক্ষয়রোধ করে। তালের পাতার আগা সুচালো হওয়ায় বজ্রপাত গাছ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বৃষ্টির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বজ্রপাত হয়।  গ্রীষ্মকালের পাশাপাশি বর্ষাকালেও বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত লক্ষ করা যায়। আর বজ্রপাতে মারা যায় মাঠের কৃষক থেকে পথ চলতি সাধারণ মানুষজন। পরিবেশবিদরা মনে করেন বজ্রপাত রুখতে সক্ষম গ্রাম বাংলার এই তালগাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা; ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ ভালোভাবেই টিকে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ রয়েছে।
তাল ফল ও তালগাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আমাদের দেশে তালগাছ রাস্তার পাশে এমনকি জমির আইলের মধ্যে রোপণ করা সম্ভব। পরিবেশবান্ধব তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য যেমন আনবে তেমনি কৃষি অর্থনীতিকে করবে বেগবান। তাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় গাছ কারণ এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরি হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না। তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, পুতুল, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কু-লী ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। প্রাচীনকালে তালের কা- দিয়ে বাড়ি, নৌকা, নৌকা বাড়ি ইত্যাদি তৈরি হতো। বতর্মানে কুটির শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে তাল গাছের বিভিন্ন অংশ ব‍্যবহার করা হয়ে থাকে। পরিপক্ব একটি গাছ থেকে বছরে অন্তত ৫ হাজার টাকা আয় করা যায়।
উৎপাদন পদ্ধতি 
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই তাল ফসলের আবাদ করা যায়। তবে উঁচু জমিতে এবং ভারী মাটি তাল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। আগস্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুরু করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তালবীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃবৃক্ষ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত। ভাদ্র হতে কার্তিক মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। সারি থেকে সারি ৭ মিটার এবং চারা থেকে চারা ৭ মিটার। গর্তের আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর। গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈবসার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। বীজের মাধ্যমে তালের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। দুই ভাবে তালগাছ লাগানো যায়। সরাসরি  বীজ বপন করে  অথবা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে চারা রোপণের মাধ্যমে এর আবাদ করা যায়। বীজতলা তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় ১০ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট চওড়া বীজতলায় এক হাজার তালের আঁটি বা বীজ বসানো যায়। বীজতলার নিচের অংশে পাতলা টিনের শিট বা পুরু পলিথিন বিছিয়ে অথবা তলায় ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে সিমেন্ট বালু খোয়া দিয়ে ঢালাই করে নিলে শিকড় মাটির ভেতরে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে গজানো আঁটি সহজেই উঠিয়ে পলিব্যাগে সংরক্ষণ উপযোগী হয়। বীজতলা তৈরিকালে নিচের অংশ কম্পোস্ট/পচা গোবর ও ছাই মিশ্রিত বেলে-দো-আঁশ মাটি দিয়ে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ভরাট করে তাতে সারি করে বীজ বসাতে হবে। বীজগুলো বসানো হলে মোটা বালু ও মাটির মিশ্রণ দিয়ে প্রায় ১ ইঞ্চি (২-৩ সেমি.) পুরু করে বসানো বীজের উপরিভাগ ঢেকে দিতে হবে। বীজতলার মাটিতে নিয়মিত হালকা পানি সেচ দিয়ে ভেজাতে হবে। ৮-১০ সপ্তাহ পরে চারাগুলো আঁটিসহ উঠিয়ে পুরু শক্ত ১০ ী ১০ ইঞ্চি মাপের পলিব্যাগে অথবা পরিত্যক্ত সিমেন্টের বস্তা দিয়ে তৈরি ব্যাগে ভালো মানের পটিং মিডিয়া (বেলে  দো-আঁশ মাটি ৫০%, জৈব পদার্থ ৪০% এবং ১০% কেকোডাস্ট/করাত কলের গুঁড়া) ব্যবহার করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সেমি. লম্বা দুপাতা বিশিষ্ট চারা মাঠে রোপণ করা উচিত। তবে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে। সমতল ভূমিতে অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোই এ চারা লাগাতে হবে। 
পরিচর্যা
প্রতি বছরই বর্ষার আগে ও পরে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে প্রতি বছর সারের মাত্রা ১০% হারে বাড়িয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর পরই পানি সেচ দিতে হবে। সার প্রয়োগ ছাড়াও আগাছা পরিষ্কার, সেচ ও নিষ্কাশনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা হলে ১০-১২ বছরের মধ্যেই তাল খাওয়া যায়। তাল গাছে কোন পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা যায় না ।
ফল সংগ্রহ
মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসে ফুল আসে। মে-জুন মাস কচি তাল প্রাপ্তির উপযোগী সময়। প্রতিটা গাছে ২০০-৩০০টা কাঁচা পাকা তাল ধরে। সুস্থ সবল গাছে ১০-১৫টা তালের কাদি/ছড়া থাকে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তাল পাকা শুরু হলে   ৩-৫ সপ্তাহ পর্যন্ত ক্রামন্বয়ে পাকা ফল পাওয়া যায়। 
সর্বোপরি তালগাছ পরিবেশবান্ধব এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তালগাছের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। রাস্তার দুপাশের পতিত জমি, অনাবাদি জমি, জমির আইল, বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে তালগাছ রোপণ করে গ্রামীণ জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস সৃষ্টি করা ছাড়াও চিনি এবং গুড়ের ঘাটতি অনেকাংশ মেটানো সম্ভব। পরিকল্পনা করে তালগাছভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ হবে আগামী দিনের কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের পরম বান্ধব। 

লেখক : অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৮৬৫৩২৫৫,ই-মেইল :ayesha-sultana07@yahoo.com