Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কিশোর-কিশোরীদের-বয়ঃসন্ধিকালে-স্বাস্থ্য-ও-পুষ্টি

কিশোর কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি

ড. যাকীয়াহ রহমান মনি১ মোঃ মাহফুজুর রহমান২

বয়ঃসন্ধিকাল  একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারা, যেখানে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে বড় পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। এই পরিবর্তনগুলো তাদের শারীরিক বৃদ্ধি, পুষ্টির চাহিদা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। বয়ঃসন্ধিকাল সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এই সময়ে সঠিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা কিশোর-কিশোরীদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। অপুষ্টি বা অতিরিক্ত পুষ্টির কারণে এই সময় নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- পুষ্টির অভাব কিশোর-কিশোরীদের শরীরে আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিনের ঘাটতি, যা হাড়ের গঠন, পেশি শক্তি, এবং সামগ্রিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ করে। অপরদিকে, অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ স্থ’ূলতা, ডায়াবেটিস, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এই সময়ে শারীরিক ব্যায়াম কিশোর-কিশোরীদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শারীরিক ব্যায়াম শুধু শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে না, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, হাড় ও পেশির শক্তি বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতেও সহায়ক। সঠিক পুষ্টি, ব্যায়াম এবং সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সফল হতে পারে।
শারীরিক বৃদ্ধি ও পুষ্টি চাহিদা
বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক বৃদ্ধি দ্রুতগতিতে ঘটে, যার জন্য কিশোর-কিশোরীদের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীরের চর্বি ও পেশীর বণ্টন পরিবর্তিত হয়। যেমন- মেয়ে কিশোরীদের ক্ষেত্রে শারিরীক গঠন এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে পেশির বৃদ্ধির হার বাড়ে। এ ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের জন্য বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন হয়, যা তাদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং বিকাশকে সহায়তা করে।
ক্যালোরির চাহিদা : বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের দৈনিক ক্যালোরির চাহিদা বেড়ে যায়, যা তাদের শরীরের বৃদ্ধি ও সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত, কিশোরদের দৈনিক ২২০০ থেকে ৩২০০ ক্যালোরি প্রয়োজন হয় এবং কিশোরীদের ক্ষেত্রে ১৮০০ থেকে ২৪০০ ক্যালোরি প্রয়োজন হয়। ক্যালোরির সঠিক পরিমাণ গ্রহণ না করলে বা অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- ওজনাধিক্য বা অপুষ্টি দেখা দিতে পারে। 
প্রোটিন : প্রোটিন কিশোর-কিশোরীদের পেশি ও টিস্যুর বৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাংস, মাছ, ডিম, ডাল, বাদাম এবং দুধ জাতীয় খাবার রয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরদের দৈনিক ৫২ গ্রাম এবং কিশোরীদের ৪৬ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন হয়।
ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ : বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের জন্য ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন ও শক্তির জন্য, আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনের জন্য, এবং ভিটামিন ডি ক্যালসিয়ামের শোষণ ও হাড়ের বৃদ্ধির জন্য জরুরি। বয়ঃসন্ধিকালে আয়রনের চাহিদা বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি হয়, কারণ এই সময়ে মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয়, যা রক্তের আয়রন কমিয়ে দেয়।
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের গুরুত্ব : মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন- জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম, এবং ফোলেটের চাহিদাও বয়ঃসন্ধিকালে বেড়ে যায়। এগুলো শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে যা ডিএনএ সংশ্লেষণ, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা, এবং স্নায়ুতন্ত্রের উন্নত করে।
পুষ্টি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ : বয়ঃসন্ধিকালের সময় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। প্রক্রিয়াজাত খাবার, উচ্চ চিনি, এবং ফাস্ট ফুডের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়, যা অপুষ্টি এবং স্থ’ূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু এই সময়ে ডায়েটিং, শরীরের ওজন নিয়ে উদ্বেগ এবং সামাজিক চাপের কারণে অনেক কিশোর-কিশোরী ভুল পুষ্টি অভ্যাস গ্রহণ করে।
ঋতুস্রাব ও পুষ্টি : মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাবের শুরুতে শরীরে আয়রন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে। এটি ক্লান্তি, অবসাদ এবং শরীরের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই মেয়েদের জন্য আয়রন-সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- পালংশাক, লাল মাংস, ডাল এবং ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি : বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক স্বাস্থ্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় কিশোর-কিশোরীরা মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং আত্মমর্যাদা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। পুষ্টির অভাব বা অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন- ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ও কার্যকারিতা উন্নত করে এবং ভিটামিন বি গ্রুপ মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।
ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রম : শারীরিক ব্যায়াম ও কার্যক্রম কিশোর-কিশোরীদের শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম শরীরে ক্যালোরি খরচ, পেশি শক্তিশালীকরণ এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। তাছাড়া, ব্যায়াম ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে এবং হাড়ের গঠন উন্নত করে।
বয়ঃসন্ধিকালে শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পেশীগুলি আরও শক্তিশালী হয়। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম যেমন সাইক্লিং, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা এবং অন্যান্য অ্যারোবিক ব্যায়াম পেশীর বিকাশে সহায়ক হয়। বিশেষত হাই ইম্প্যাক্ট ব্যায়াম যেমন দৌড়াানো এবং জাম্পিং, হাড়ের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপকারী।
শারীরিক ব্যায়াাম ব্রেইনে এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, যা              প্রাকৃতিক মুড বুস্টার হিসেবে কাজ করে। ফলে, কিশোর-কিশোরীরা উদ্বেগ এবং বিষণœতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ব্যায়াম হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং পরবর্তী জীবনে সুস্থ হার্টের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।
ব্যায়ামের ধরন ও সময়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) অনুযায়ী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ মিনিটের মাঝারি থেকে তীব্র শারীরিক কার্যকলাপ করা উচিত। এর মধ্যে সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন পেশি ও হাড় শক্তিশালী করার ব্যায়াম অর্ন্তভুক্ত করা উচিত।
সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব
সমাজ ও সংস্কৃতি বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক সময় পরিবার, বন্ধু এবং মিডিয়ার প্রভাব তাদের খাদ্যাভ্যাস ও শরীরের প্রতি ধারণা পরিবর্তন করে। তাই পুষ্টি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক পুষ্টি শিক্ষা : বয়ঃসন্ধিকালের সময় কিশোর-কিশোরীদের সঠিক পুষ্টি শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের খাদ্যাভ্যাস, শরীরের পরিবর্তন, এবং পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। পুষ্টি শিক্ষা তাদের খাদ্যাভ্যাস উন্নত করতে সহায়তা করে এবং তাদের স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে সতর্কতা 
ধূমপান ও মাদকাসক্তি কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বয়ঃসন্ধিকালে কৌতূহল, সামাজিক চাপ, এবং সঙ্গীদের প্রভাবের কারণে অনেক কিশোর-কিশোরী ধূমপান, মদ্যপান বা মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ ধরনের অভ্যাস শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে মাদকাসক্তি মানসিক সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক ও একাডেমিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে, কারণ এই সময়ে শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। তবে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন- স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের সামনে থাকা চোখের সমস্যা এবং স্থ’ূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং ভিডিও গেমের অতিরিক্ত ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায় এবং একাডেমিক চাপের কারণে অনেক কিশোর-কিশোরী পর্যাপ্ত ঘুম পায় না। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ফলে মনোযোগের অভাব, মেজাজের পরিবর্তন এবং শিক্ষা বা খেলার ক্ষেত্রে পারদর্শিতার হার কমে যাওয়া। এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে সাইবার বুলিং, আত্মবিশ্বাসের সংকট, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে পারে। যদিও শারীরিক ব্যায়াম কিশোর-কিশোরীদের জন্য উপকারী, তবে অনিয়মিত বা অতিরিক্ত ব্যায়াম তাদের স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অতিরিক্ত ব্যায়াম শরীরকে ক্লান্ত করে  ফেলে, পেশী এবং জয়েন্টের ক্ষতি ঘটায় এবং হাড়ের গঠন ব্যাহত করতে পারে। অন্যদিকে ব্যায়ামের সম্পূর্ণ অভাবও শরীরের ওজন বৃদ্ধি, স্থ’ূলতা এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে সঠিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। এই সময়ে পুষ্টির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পুষ্টি শিক্ষা এবং সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারবে, যা তাদের পরবর্তী জীবনে সুস্থ ও সুখী জীবনযাপনের জন্য সহায়ক হবে। এছাড়াও বয়ঃসন্ধিকালের সময় শারীরিক ব্যায়াম কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত ব্যায়াম তাদের শরীরকে শক্তিশালী, সুস্থ এবং সক্রিয় রাখে, যা তাদের পরবর্তী জীবনে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে। (তথ্যসূত্র : ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ ২০২০.)

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পুষ্টি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। ২এক্সিকিউটিভ (পুষ্টিবিদ), রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ, বারোবাড়িয়া,ধামরাই, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৬৩৪৩৫২