Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

ছোলার-ফলছেদক-পোকার-আক্রমণ-ও-প্রতিকার

ছোলার ফলছেদক পোকার আক্রমণ ও প্রতিকার
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
ছোলা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ডাল। আবহমানকাল থেকেই ছোলা রমজান মাসে মুসলিমদের ইফতারির একটি অন্যতম প্রধান উপকরণ। রমজান মাস ছাড়াও ছোলা প্রতিদিন বিকেলের নাশতায় মুখরোচক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ছাড়াও ছোলা বিভিন্ন রকম বেকারি আইটেম, মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অঙ্কুরিত ছোলাও পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে অনেক মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে, যা ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, এন্টিঅক্সিডেন্ট প্রভৃতি খনিজ উপাদানে ভরপুর। বর্তমানে দেশে ২২ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ২৯ হাজার মেট্রিক টন ছোলা উৎপাদিত হচ্ছে (কৃষি ডাইরি, ২০২৪)। অথচ রমজান মাস বাদে অন্য মাসগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে এ চাহিদা ১০-১২ গুণ বেড়ে যায় এবং যা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। প্রতি বছর ১.৫ লক্ষ টন ছোলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং রমজান মাসে চাহিদা অনুযায়ী এ আমদানি ২ লক্ষ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে (জাতীয রাজস্ব বোর্ড, ২০২৪)। ছোলার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ২০১১-২০১২ মৌসুমে ছোলা আবাদ ছিল ৭১ হাজার হেক্টর, উৎপাদন ছিল ৮০ হাজার মেট্রিক টন, ফলন ১১৫০ কেজি/হেক্টর (কৃষি ডাইরি, ২০১৩)। কিন্তু ২০২২-২৩ মৌসুমে আবাদ কমে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার হেক্টর, উৎপাদন ২৯ হাজার মেট্রিক টন এবং ফলন ১৩১৮ কেজি/হেক্টর (কৃষি ডাইরি, ২০২৪)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ছোলার আবাদ এলাকা ও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে গেলেও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক ও উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কারণে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ শীতকালীন অন্যান্য উচ্চমূল্যের ফসলের সাথে প্রতিযোগিতা, রোগ ও ফলছেদক পোকার আক্রমণ, বৈরী আবহওয়ার প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ছোলার উৎপাদন এলাকা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। তবে এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি অন্তরায় হচ্ছে- ফলছেদক পোকার আক্রমণ। দেশে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ফলছেদক পোকার আক্রমণে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ ফল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গড়ে ৪০০ কেজি/হেক্টর ফলন কমে যায় (রহমান ১৯৯০)। সুতরাং ফলছেদক পোকার আক্রমণ থেকে ফসলকে সুরক্ষার জন্য পোকা পরিচিতি, ক্ষতির ধরন ও প্রকৃতি এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল সম্পর্কে কৃষকসহ সংশ্লিষ্টদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন, যা নি¤েœ উল্লেখ করা হলো-
পোকা পরিচিতি, ক্ষতির ধরন ও প্রকৃতি 
মা পোকা অর্থাৎ স্ত্রী মথ সাধারণত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাতের বেলা (রাত ৯.০০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত) গাছের পাতার নিচের পৃষ্ঠে, ফুলের কুঁড়িতে বা ছোট ফলের গায়ে ২-৬টি করে হলুদাভ সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে ২-৪ দিনের মধ্যে কীড়া বের হয়ে ডগার কচি পাতা, ডগা, ফুলের কুঁড়ি ও ফুল খেতে থাকে। সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়রি মাস পর্যন্ত ফল বা পড আসার পরে ফলের ভেতর ছিদ্র করে ভেতরের বীজ খেয়ে ফেলে। খাওয়ার সময় এরা ফলের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেহটা বাইরে রাখে। আবার অনেক সময় কীড়াগুলো বীজ খেয়ে ফলের ভেতরেই বসে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, কীড়া দশায় একটি কীড়া ২৫-৪০টি পর্যন্ত ফল খেয়ে নষ্ট করতে পারে। কীড়াগুলো ৬টি দশায় খোলস বদলিয়ে বড় হয়। একটি পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কীড়া ২৫-৩৬ মিমি. লম্বা হয়। এদের দেহের উভয় পাশে এবং পৃষ্ঠ দেশে লম্বালম্বি সুস্পষ্ট রেখা দেখা যায়। কীড়াগুলো দেখতে সবুজ, হলুদাভ সবুজ, বাদামি সবুজ, অথবা বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। তবে মাঠে সাধারণত সবুজ রংয়ের কীড়াই বেশি দেখা যায়। কীড়া দশা ১০-১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়। পুত্তলি ধাপ প্রায় ৫-৬ সেন্টিমিটার মাটির গভীরে সম্পন্ন হয় এবং ১০- ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে পূর্ণাঙ্গ পোকায় (মথে) পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক পোকা গাঢ় বা হালকা বাদামি বর্ণের মাঝারি আকারের মথ। এরা প্রায় ২৮-৪২ দিনের মধ্যে জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
একক দমনব্যবস্থা ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায় না বলে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। 
উপযুক্ত বা সঠিক সময়ে ফসল বপন করতে হবে অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে ফসল বুনলে গাছের সর্বোত্তম বৃদ্ধি হয় এবং পোকার আক্রমণও কম হয়।  
 যেহেতু খাওয়ার সময় এরা ফলের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেহটা বাইরে রাখে সেহেতু ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পতঙ্গভুক পাখি (যেমন- শালিক, ফিঙ্গে ইত্যাদি) বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে পোকার সংখ্যা কমানো যায়।
 গবেষণায় দেখা যায় যে, ছোলার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে গম, সরিষা, ধনিয়া, তিসি, কুসুমফুল ইত্যাদি ফসল চাষ করলে ৪৫-৬০ ভাগ পর্যন্ত ফলছেদক পোকার আক্রমণ কমানো যায়। এতে করে একদিকে যেমন সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায় আবার অন্যদিকে বিরূপ আবহাওয়ায় ফসলহানির ঝুঁকিও কমানো যায়। 
 সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে (হেক্টরে ১০০টি) পুরুষ মথকে ধরে স্ত্রী মথের সাথে মিলিত হতে না দিয়ে সহজেই ফলছেদক পোকার সংখ্যা কমানো যায়।
 প্রতি সপ্তাহে একবার করে ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা (ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ) ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা (ব্রাকন হেবিটর) পর্যায়ক্রমিকভাবে মুক্তায়িত করে ডিম ও কীড়াকে ধ্বংস করে আক্রমণের তীব্রতা কমানো যায়।
 আক্রান্ত গাছে কীড়া ছোট থাকা অবস্থায় নিউক্লিয়ার পলিহেড্রসিস ভাইরাস হেক্টরপ্রতি ৫০০ লার্ভাল ইকুইভ্যালেন্ট হারে ৭ দিন পর পর ৩ বার ¯েপ্র করে পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 
 ছোলা ক্ষেত মনিটর করে আক্রমণের তীব্রতা মারাত্মক হতে পারে এমন মনে হলে ১০০% গাছে ফল আসলে প্রথমবার এবং এর ৭-১০ দিন পর দ্বিতীয়বার, এরপরে প্রয়োজনে তৃতীয়বার থায়ামিথক্সাম+ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল এর মিশ্রণ কীটনাশক যেমন- ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউ জি প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে কার্যকরিভাবে ফলছেদক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 
 
লেখক: মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল : ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫, ই-মেইল :comhossain.draltaf@gmail.com