Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষিতে-বায়োইনফরমেটিক্স-বাংলাদেশ-প্রেক্ষাপট

কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্স
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
ড. মোঃ আবদুল আউয়াল
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ, যেখানে দেশের ৪২% প্রান্তিক জনগণের জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে কৃষিতে প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, যেমন- পরিবর্তনশীল জলবায়ু, খরা, লবণাক্ততা, পোকামাকড় এবং রোগবালাই। এ সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন, যেখানে বায়োইনফরমেটিক্স (ইরড়রহভড়ৎসধঃরপং) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বায়োইনফরমেটিক্স হলো একটি আধুনিক প্রযুক্তি যা জীববিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও গণিতের সম্মিলনে গঠিত। এটি জীববিজ্ঞান বিষয়ক বিশাল তথ্যসমূহকে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশাল ডিএনএ ডেটা বিশ্লেষণ করে জিনোমের নকশা উন্মোচন করা, জিনোমের মধ্যেকার জিনসমূহ শনাক্ত করা, জিনের কার্যকারিতা নিরূপণ করা, প্রোটিনের স্ট্রাকচার প্রেডিকশন করা এবং জিন এক্সপ্রেশন ডেটার বিশ্লেষণও বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে করা হয়। কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার ফসলের জাত উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ, জেনেটিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 
বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রয়োগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এরই মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সম্পন্ন হয়েছে ও কিছু নতুন প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয়েছে। 
পাটের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের    কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রথম প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম ও তার গবেষণা দলের নিরলস প্রচেষ্টায় ২০১০ সালে প্রথম তোষা পাটের জিনোম উন্মোচিত হয়। এরপর একে একে দেশি পাট, মহিষ, ইলিশ, কাঁঠাল, পাটের রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোম আবিষ্কৃত হয়। এ সকল জিনোম থেকে ডাটা মাইনিং ও বায়োইনফরমেটিক্সের টুলস ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যভিত্তিক জিনের শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের নার্সভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কাজ চলমান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এগিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরণের অনেক গবেষণার সাথে জড়িত। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে মিলে ফসল ও প্রাণীর জেনোমিক গবেষণা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ধান, পাট, গম এবং মাছের জেনোমিক গবেষণা উল্লেখযোগ্য। 
বাংলাদেশের জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (নার্স) ভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়নে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করছে যা অধিক ফলনশীল, নতুন রোগ প্রতিরোধী ও খরা, লবণাক্ততাসহনশীল জাত উদ্ভাবনে মূল ভূমিকা পালন করছে। কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধে বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণের জন্য জেনেটিক মার্কার এবং বায়োইনফরমেটিক্স ভিত্তিক ডাটাবেস ব্যবহৃত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ে পয়েন্ট অফ কেয়ার টেস্টিং উদ্ভাবন করেছে, যা বাণিজ্যিকিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। এ উদ্ভাবনের ফলে দ্রুততম সময়ে ও মাঠপর্যায়ে এ রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। 
বাংলাদেশের কৃষির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফসলের জেনেটিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং নতুন জাত উদ্ভাবনে বায়োইনফরমেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বিভিন্ন আবহাওয়াগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। 
বাংলাদেশে কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, বায়োইনফরমেটিক্সের জন্য উচ্চমানের তথ্যপ্রযুক্তি ও জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনও সীমিত। এক্ষেত্রে, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান বিনিময় করা যায়। এ ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য পুস্তকে বায়োইনফরমেটিক্সকে সংযুক্ত করা ও উচ্চশিক্ষায় বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স চালু করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং কম্পিউটিং অবকাঠামোর অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নতমানের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং ডাটাবেস সিস্টেমের অভাব গবেষণা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রে এখনও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। বাংলাদেশে বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। এজন্য ডেটা সেন্টার এবং ক্লাউড সিস্টেম উন্নয়ন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন না থাকায় বায়োইনফরমেটিক্সের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারি এবং বেসরকারি খাতে গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। চতুর্থত, বাংলাদেশে বায়োইনফরমেটিক্সের উপর পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। ফলে, এই শাখায় দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স এবং গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। আবার, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এটি গবেষকদের গবেষণা কাজে সহায়তা করবে এবং   কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়ক হবে। পঞ্চমত, বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণায় সুস্পষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা নেই। সেজন্য, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত, যা কৃষির উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সঠিক ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য। এসবের মাধ্যমে     কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নিম্নোক্ত অগ্রগতি সম্ভব হবে। যেমন-
খাদ্য নিরাপত্তা : বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার মাধ্যমে খাদ্য ফসলের জিনোম তথ্য ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল, খরা, লবণাক্ততা, রোগ এবং পোকামাকড় প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে।
ফসলের উন্নয়ন : বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে ফসলের জিনোমিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এটি উচ্চফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং প্রতিকূল পরিবেশসহনশীল ফসলের জাত উন্নয়নে সহায়তা করে। বাংলাদেশের ধান, গম, পাট, এবং আলুর মতো প্রধান ফসলের জিনোমিক ডেটা বিশ্লেষণ করে, নতুন এবং উন্নত জাত উন্নয়ন করা যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : ফসলের রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধে বায়োইনফরমেটিক্স বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফসলের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর জিনোমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে, তাদের কার্যপ্রণালী এবং প্রতিরোধের উপায় বের করা যায়। এটি কৃষকদের জন্য কার্যকরী রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে। এ ছাড়া, এটি ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং         কৃষকের আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : মাটির স্বাস্থ্য এবং উর্বরতা বাড়াতে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করা যায়। মাটির মাইক্রোবিয়াল কমিউনিটির জিনোমিক বিশ্লেষণ করে মাটির স্বাস্থ্য মূল্যায়ন এবং উন্নত করার উপায় বের করা যায়। মাটির পুষ্টি উপাদানের অভাব নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশগত স্থায়িত্ব : বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে পরিবেশগত সমস্যার সমাধান এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বায়োইনফরমেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
মাছ চাষ : বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করে মাছের জিনোমিক ডেটা বিশ্লেষণ করে উন্নত প্রজাতির মাছ উদ্ভাবন এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন : গবাদি পশুর জিনোমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়। বিশেষ করে গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব। বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার করে ফসলের জাত উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এভাবে বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল-০১৭১৩৫১৬২১৭, ই-মেইল-maawal70@gmail.com