Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

পাহাড়িদের-খাদ্যে-বাঁশকোড়লের-ব্যবহার-টেকসই-করতে-করণীয়

পাহাড়িদের খাদ্যে বাঁশকোড়লের 
ব্যবহার টেকসই করতে করণীয়
  মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
পার্বত্য অঞ্চল রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এ তিন জেলায় প্রায় ১৩টি উপজাতি রয়েছে। তারা একরকম বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেই বসবাস করে আসছে। উপজাতিরা সাধারণত নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করে। তারা স্বল্প পরিসরে বসবাস করে থাকলেও পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে এদের ভাষার সকীয়তা লক্ষণীয়। উপজাতিদের ভাষা স্বতন্ত্র হলেও খাদ্যাভ্যাস একই রকম। চাকমাসহ বেশ কয়েকটি উপজাতি এরি মধ্যে শহরকেন্দ্রিক হয়েছে এবং আধুনিক যোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে উন্নত জীবন যাপন করেছে। এদের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন হয়েছে। তবে যারা এখনো পাহাড়ে আদিম জীবন যাপন করে, তারা নিরাপদ ও বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে কম অবগত। পাহাড়িদের খাবারে মসলার ব্যবহার খুবই কম, তবে মরিচের ব্যবহার একটু বেশি। ছুড়ি, হাঙ্গরসহ নানা হরেক রকমের শুঁটকিও পছন্দ। চিংড়ি ও শুঁটকি দ্বারা তৈরি নাপ্পি পাহাড়িদের খুব পছন্দ। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সবজি, ভাজি, মাশরুম ও মাছের ভর্তা খাদ্যাভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ঢেঁকিশাকও পাহাড়িদের পছন্দ। হালকা খাবার, সবজি সিদ্ধ যেমনি তারা খায় তেমনি ঝালযুক্ত মাছ, মাংসও খায়। পাহাড়িরা শুকরের মাংস, শামুক, ঝিনুক ও ছোট্ট মাছ খেয়ে থাকে। মসলাজাতীয় গাছ হলুদের ফুল যা পাহাড়িরা ভাজি করে খায়। শিমুল ফুলও তারা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এ ছাড়া কচি বাঁশের গোড়া যা ‘বাঁশকোড়াল’ নামে পরিচিত তা তাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস এর অন্তর্ভুক্ত। বাঁশকোড়ল সাধারণত ভাজি, সবজি ও ডালে প্রদান করা হয়। 
পাহাড়িদের প্রতিদিনের খাদ্যে বাঁশকোড়ল বিভিন্নভাবে থাকে। তাই বাঁশের কচি অংশ বা বাঁশকোড়ল স্থানীয় বাজারসমূহে প্রতিদিন ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখা যায়। ভাজিতে বাঁশ, ডালের সাথে বাঁশ, তরকারিতে বাঁশ, সবজিতে বাঁশ ইত্যাদি বিভিন্ন খাবারে কচি বাঁশ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া মাছ, মুরগী ও বিরিয়ানি রান্নায় বড় মোটা বাঁশ রান্নার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিকন বাঁশের চোঙ্গায় পর্যটকদের চা পান করতে দেওয়া হয়। পাহাড়ে বাঙালি পর্যটকদের গমন বাড়ছে। শীতে প্রচুর পর্যটক পাহাড়েই গমন করে এবং পাহাড়িদের প্রচলিত খাদ্য গ্রহণ করছে। তাই খাদ্যে প্রতিনিয়ত বাঁশকোড়লের ব্যবহার বাড়ছে। 
পাহাড়ে বাঁশের ব্যবহার বহুমুখী। বাঁশ দিয়ে ঘড়, মাচা, শাকো, বেড়া, উপকরণ তৈরি এবং  জ্বালানি শিল্প ও খাদ্যে ব্যবহার অন্যতম। পাহাড় হতে বাঁশ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত বাঁশের ব্যবহার বাড়ছে কিন্তু জোগান কমছে। যেহেতু নতুন বাঁশ জন্মানোর সাথে সাথে তা কেটে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ও বাণিজ্যিক ব্যবহার হচ্ছে, সে কারণে বাঁশের পাহাড়ি এলাকায় বাঁশের বংশবিস্তারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ে বাঁশের সংকট দেখা দিবে। বর্তমানে শহর বা গ্রামাঞ্চলে বাঁশের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার কমে গেলেও পাহাড়িরা এখনো বাঁশের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে। এ ছাড়া কাগজ উৎপাদন শিল্পে বাঁশের ব্যবহার ছিল। বর্তমানে এর সংকট চলছে তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পক্ষে এই বাঁশের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার সম্ভব হবে না। বাঁশের ব্যবহার টেকসই করতে হলে বাঁশের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। সেজন্য বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর বংশবিস্তার ও গবেষণায় জোড় দিতে হবে। বিশেষ করে টেকসই উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিমিত্তে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি ও সর্বোপরি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ভূমির ক্ষয়রোধ পাহাড় ধসা হ্রাসে স্থানীয় বাঁশের সংরক্ষণ এবং বংশবিস্তার করতে হবে। শিল্প, ভোগ ও অন্যান্য ব্যবহার বিবেচনা করে গবেষণায় উপযুক্ত বাঁশের জাত নির্বাচন করে চাহিদা অনুযায়ী বংশবিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিল্প ভোগের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাধু জাত, শিল্পের জন্য দ্রুত বর্ধনশীল এবং পারিবারিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে উপযুক্ত বাঁশের জাত নির্বাচন অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ উপযোগ পেতে বিশেষায়ন অত্যন্ত জরুরি। আর এই সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য চাই পরিকল্পনা, গবেষণা, অংশীজনদের সহিত আলোচনা এবং তাদের প্রয়োজন পর্যালোচনা এবং লক্ষ্য অর্জনে প্রকল্প গ্রহণ করে টেকসই বাঁশ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পাহাড়ি সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও ভোগ দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করার লক্ষ্যে বাঁশের মূল তথা কচি বাঁশ বা বাঁশকোড়াল ক্রয়-বিক্রয় সীমিত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা যদি ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারেন তবেই বাঁশের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার সম্ভব হবে। পাহাড়িদের মেনুতে বাঁশকোড়ল দীর্ঘস্থায়ী হবে। 
গ্রামীণ উপজাতিদের নিরাপদ খাদ্যাভ্যাসের চর্চার অভাব রয়েছে। অসচেতনতা, অশিক্ষা ও আর্থিক অসঙ্গতি প্রভৃতির কারণে উপজাতীদের মধ্যে এসব সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। নিরাপদ খাদ্যাভ্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হলো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ পানি। অসচেতনতা, অশিক্ষা ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিয়মিত গোসল, হাত ধোয়া, সাবান ব্যবহার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন  কাপড় পরিধান, চুল ও নখ কাটা ইত্যাদি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। এ ছাড়া অধিকাংশ উপজাতি বন্যপ্রাণী শুকর, কুকুর, বিড়ালসহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী লালন করে। এসকল প্রাণীর স্পর্শ পরবর্তী যে স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত তাও যথাযথাভাবে পালন করা হয় না। ফলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং নিরাপদ খাবার গ্রহণ তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। শীত মৌসুমে নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা কম থাকে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সর্বত্র নিরাপদ পানি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আর নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা পর্যাপ্ত না থাকায় গৃহস্থালি উপকরণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, খাবার উপকরণ যথাযথভাবে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ধুয়ে রান্না করা ও রান্না পরবর্তী ধোয়ার কার্যক্রম সম্ভব হয় না। খাদ্য নিরাপদতার স্বার্থে খাদ্য উৎপাদন হতে শুরু করে খাদ্য গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হয়। এজন্য পারিবারিক শিক্ষা ও আর্থিক সঙ্গতির মাধ্যমে অধিকাংশ গ্রামীণ উপজাতিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

লেখক : উপসচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawserul 1173@gmail.com