গাভীর ওলান প্রদাহকে ম্যাস্টাইটিস বা ওলান ফোলা বা ওলান পাকা রোগ বলে, ডেইরি শিল্পের প্রধান ৪টি মারাত্মক সমস্যার মধ্যে (১) ম্যাস্টাইটিস (২) অনুর্বতা (৩) গিরা ফোলা (৪) ক্ষুরা রোগ। ম্যাস্টাইটিস একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। ম্যাস্টাইটিস রোগ অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ রোগে-
দুধ উৎপাদন কমে যায়।
চিকিৎসা খরচ খুব বেশি।
অনেক সময় গাভী সুস্থ হয় না, ফলে বাদ দিতে (Culling) হয় বা গাভী মারা যায়।
অসুস্থ গাভীকে সেবা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত লেবার খরচ হয়।
ম্যাস্টাইটিস রোগে আক্রান্ত গাভীর দুধের উপাদান পরিবর্তন হয়ে যায়, যেমন- দুধে ল্যাকটোজ, চর্বি, ক্যাসিন ও ক্যালসিয়াম কমে যায়, বিপরীতে সোডিয়াম, ক্লোরাইড ও রক্তের আমিষ বৃদ্ধি পায়। এ রোগ একটি গাভীর যে কোনো সময় হতে পারে তবে বাছুর প্রসবের পরেই বেশি আক্রান্ত হয়।
কারণ : বিভিন্ন প্রকারের ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, মাইকোপ্লাজমা ও ভাইরাস।
সংক্রমণ : যদি শেডের মেঝে দীর্ঘ সময় স্যাঁতসেঁতে ও ভিজা থাকে ওলানের বাঁট কলুষিত মেঝে, দুধ দোহনকারীর হাত, দুধ দোহনের যন্ত্রের মাধ্যমে জীবাণু সরাসরি ওলানে সংক্রামিত করতে পারে। ওলানে বা বাটে আঘাতজনিত কারণে ক্ষত, ক্ষুরারোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষত বা দীর্ঘ সময় ওলানে দুধ জমা থাকলেও এ রোগ হতে পারে। বাঁটের মধ্যে কোনো শলা বা কাঠি প্রবেশ করালেও গাভী এ রোগে আক্রান্ত হবে।
লক্ষণগুলো : অতি তীব্র রোগে ওলান হঠাৎ করে লাল হবে, শক্ত হবে ও ফুলে যাবে। হাত দ্বারা স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে। ওলানে প্রচ- ব্যথা থাকে, গায়ে জ¦র থাকে। পানির মতো দুধ, পুঁজ বা রক্তযুক্ত দুধ বের হবে। ওলানে পচন ধরতে পারে। দুধ কালো কাপড়ে ছাঁকলে জমাট বাঁধা দুধ ধরা পড়বে। গাভী খাদ্য গ্রহণ করবে না। অনেক সময় আক্রান্ত ওলানে গ্যাংগ্রিন হয়ে (ফুলে) যায়। গাভীর মৃত্যুও হতে পারে। সেপটিসেমিয়া ও টাক্সিমিয়ার কারণে গাভী মারা যায়।
সুপ্ত সংক্রমণ এমন ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো দুধে ও ওলানে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। তবে দুধ উৎপাদন কমে যায়। দুধে ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান থাকে এবং দুধের উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়।
পুরাতন ওলান প্রদাহ এমন ক্ষেত্রে দুধ উৎপাদন কমে যাবে, ছানা বা জমাট বাঁধা দুধ দেখা যায়। ওলান ক্রমে শক্ত হয়ে যায়। গাভীর খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। ২-১টি বাঁট চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দুধে চোখে পড়ার মতো তেমন পরিবর্তন ঘটে না। দীর্ঘদিন পর পর অথবা একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর ওলানে প্রদাহের লক্ষণ প্রকাশ পায়। দুধে শ্বেত কনিকা ও সোসাইটিক কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুরাতন ওলান প্রদাহযুক্ত গাভী খামারের জন্য খুবই ক্ষতিকর কারণ, ওই গাভী সুস্থ গাভীকে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
চিকিৎসা : খুব দ্রুত রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। বিলম্বে এ রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিয়ে -
উন্নতমানের Antibiotic ইনজেকশন দিতে হবে মাত্রা মতো ৪-৫ দিন।
উন্নতমানের প্রদাহনাশক বা স্টেরওয়েড জাতীয় ইনজেকশন দিতে হবে।
উন্নতমানের Teat infusion আক্রান্ত বাঁটে প্রয়োগ করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর পর ৩-৪ দিন।
Povidon Iodin / ভালো মানের জীবাণুনাশক মাত্রামতো পানিতে মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার ওলান ধুয়ে দিতে হবে।
অন্যান্য চিকিৎসা প্রটোকল প্রদান করতে হবে।
ওলান প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ : চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম পন্থা, একটি ডেইরি ফার্মে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা অনুসরণ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বাঁটের স্বাস্থ্যসম্মত বিধিব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। ভালো স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান হতে হবে। জীবাণুমুক্ত দুধ দোহনব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। ওলান ও বাঁটের স্বাস্থ্য ও যেকোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
খুব দ্রুত এ রোগ শনাক্ত করতে হবে এবং দ্রুত উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। অসুস্থ গাভীকে আলাদা জায়গায় রাখতে হবে।
শুষ্ক ও গর্ভবর্তী গাভীকে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও সেবা দিতে হবে। গাভীর ক্ষেত্রে (বকনা বাদে) দুধ দোহনের শেষ দিনে বাঁট সিল করে দিতে হবে।
বার বার এ রোগে আক্রান্ত (২-৩ বার) গাভী, (Chronically ofteted) যেগুলোকে সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব হচ্ছে না সেগুলোকে বাতিল (Culling) করতে হবে। এ জাতীয় অসুস্থ গাভী রোগের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে ফলে খামারের সুস্থ গাভীতে ছড়াতে সাহায্য করবে। সফল জনকভাবে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের এটাই একমাত্র পন্থা।
দৈনিক দুধ দোহনের মেশিন পরীক্ষা করতে হবে ও খামারের ওলান প্রদাহ রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
একটি দুগ্ধ খামারে ওলান প্রদাহ রোগ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত স্বাস্থবিধি মেনে চলতে হবে-
গাভীকে কাঁচা ঘাসসহ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য দিতে হবে;
শেডের মেঝে পরিষ্কার করে ২-৩ দিন পর পর Disinpectant দিয়ে Sprey করতে হবে। মেঝেতে কোনো প্রকার গর্ত থাকা যাবে না।
বিজ্ঞান সম্মতভাবে গাভীর শেড বা ঘর তৈরি করতে হবে।
দুধ দোহনের আগে ওলান ধুয়ে নিয়ে হবে এবং প্রতিটি গাভী দোহনের আগে দোহনকারীর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। অসুস্থ গাভীকে সবার শেষে দোহন করতে হবে।
দোহনকারীর শরীর, হাত পরিষ্কার করতে হবে, হাতের নখ অবশ্যই ছোট রাখতে হবে।
দুধ দোহনের পর ওলান ধুয়ে তারপর জীবাণুনাশক ওষুধে বাঁট চুবাতে হবে।
Povidon iodin (Povin/Povisep) = 0.5-1.00%
Hypochlorid = 4.0%
Chlorite aceted = 0.5%
দুধ দোহনের পর গাভীর পেঁছন অংশ ধুয়ে দেয়া (Back glash)।
দোহনের পর কাঁচা ঘাস খেতে দিতে হবে যাতে করে গাভী ১-২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে বাঁটের দুধ নালী সংকুচিত হয়ে যাবে, ফলে জীবাণু প্রবেশ করতে পারবে না।
গাভীকে দৈনিক ১-২ ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে।
(১০) কিছু দিন পর পর দুধ পরীক্ষা করে এ রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা দিতে হবে।
(১১) বাটের ভেতরে শক্ত কাঠি বা Teat Syphon) না ঢুকানোই উচিত।
সন্ধি প্রদাহ
গাভীর পায়ের গিরা ও ক্ষুর ফুলে যাওয়া ও প্রদাহকে সন্ধি প্রদাহ বলে। একটি বাণিজ্যিক দুগ্ধ খামারে ৪টি ক্ষতিকর রোগের মধ্যে গিরা ফোলা রোগের অবস্থান তৃতীয়তম। গিরা ফোলা রোগে হাড়, মাংস ও গিরার অন্যান্য অংশ আক্রান্ত হয়ে থাকে। অর্থনৈতিকভাবে রোগটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ-
দুধ ও মাংস উৎপাদন কমে যায়।
এ রোগে চিকিৎসা খরচ বেশি।
সুস্থ না হলে অল্প বয়সেই গাভীকে বাদ (Pre-mature Culling) দিতে হয় ফলে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।
যে কোনো বয়সে গিরা ফোলা রোগ হতে পারে তবে ৫ বছর বয়সের বেশি বয়সী গাভীতে বেশি হয়। এটি জেনেটিক রোগ নয়। গিরা ফোলা রোগ দুই প্রকারের যথা-
(ক) অপ্রদাহিক (Noninflamatiory) ডিজেনারেটিভ গিরা ফোলা-এ ক্ষেত্রে ২-৪টি গিরা একসঙ্গে ফুলে যায়। কিন্তু ব্যথা থাকে না।
(খ) জীবাণুঘটিত অস্থি সন্ধি প্রদাহ।
গিরা ফোলা রোগের তথ্য নিম্নরূপ-
৯২% পেছনের পা আক্রান্ত হয়,
৬৫% বাহির পাশের ক্ষুর আক্রান্ত হয়,
১৪% ভেতরের ক্ষুর আক্রান্ত হয়,
২৮% ক্ষেত্রে গাভী খোঁড়াবে,
২২% White line Commonset,বঃ,
কারণগুলো :
সাধারণত দুগ্ধবতী গাভীর শরীরে বিভিন্ন প্রকারের খনিজ পদার্থের ঘাটতি, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অভাব ও অসমতার (৩:১) কারণে হতে পারে।
Micoplasma, Preumonia, Mastitis, Arthritism I Neval ill সংক্রমণ হলে হতে পারে।
E Coli, Sfreptococcus, Salmonella, Typhimomim সংক্রমণের ফলে হতে পারে।
গিরা ও টেনডন-এ কোনো আঘাত বা ঘষা খেয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হলে হতে পারে।
বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে হতে পারে।
গাভীর পায়ের ক্ষুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে এবং দীর্ঘদিনের Necrotic Pododermatitis অথবা Sole ulcer অথবা White line disease হলে হতে পারে।
বেশি করে শুধুমাত্র দানাদার খাদ্য খাওয়ালে হতে পারে।
ক্ষুরারোগে (FMD) আক্রান্ত হওয়ার পর যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা না হলে, ক্ষুরের উপরের গিরা আক্রান্ত হতে পারে।
এগুলো ছাড়াও কিছু সহযোগী কারণ রয়েছে যেমন-
আরামদায়ক মেঝে না হলে- অর্থাৎ উঁচু নিচু গর্তযুক্ত মেঝে বা বেশি ঢালু মেঝে ইত্যাদি।
যদি গাভীকে খুব কষ্ট করে শুয়ে থাকতে হয়।
গাভীকে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে বা হাঁটালে হতে পারে।
জায়গার তুলনায় বেশি গরু এক জায়গায় রাখলে (over Crowding) হতে পারে। বিছানা ভালো না হলে Carpal Joint, Stifle Joint, Pelvis, Brisket, Shoulder-এ ঘষা লেগে ক্ষতের সৃষ্টি করে যা পরে জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়ে সন্ধি প্রদাহের সৃষ্টি করে।
ব্যয়াম না করালে; সর্বদা ঘরে বেঁধে রাখলে গিরার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা লোপ পায়।
গিরার যে কোনো সমস্যা দেখা মাত্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে।
লক্ষণগুলো :
পায়ের গিরা ফুলে যাবে, উল্লেখযোগ্য ব্যথা থাকবে।
গাভীর কর্মতৎপরতা কমে যাবে।
হাঁটাচলা করতে কষ্ট পাবে, শুতে এবং ওঠার সময় কষ্ট হবে।
গিরা গরম মনে হবে এবং টিপ দিলে পরিবর্তন বুঝা যাবে।
সর্বদা গাভী পা কম নড়াতে চাবে।
রুচি কমে যাবে, জাবর কাটাও কমে যাবে, শ্বাস ও হৃদযন্ত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
গাভীর ওজন কমে যাবে, দুধ উৎপাদন কমে যাবে।
গাভীর উর্বরতা কমে যাবে এবং বাচ্চা দিতে সময় বেশি লাগবে।
ডিজেনারেটিভ টাইপ গিরা ফোলার ক্ষেত্রে ব্যথা থাকবে না।
চিকিৎসা :
Immertion or thorough glushing - ২ সপ্তাহ।
উন্নত মানের Antibiotic যেমন-Inj Tylocin, Inj-Penicillin+ Stneptopen, Inj, Ampicillin, ইত্যাদি গিরার মধ্যে প্রয়োগ করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ অস্থিসন্ধিতে সুষ্ঠু রক্ত চলাচল হয় না, মাত্রামতো ৪-৫ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যথানাশক ওষুধ যেমন- Asprin, Inj- Ketoprofen, Inj Prednisolon, Inj-Phenay 1-Butazon, Inj Tolfamin ইত্যাদি মাত্রা মতো ৩-৪ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতিরোধ :
সঠিক নিয়মে মেঝে তৈরি করতে হবে।
প্রয়োজনে রাবারের তৈরি ম্যাট বা বিছানা ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিদিন ১-২ ঘণ্টা করে গাভীকে ব্যায়াম করাতে হবে। সম্ভব হলে মাঠে ছেড়ে দিয়ে ঘাস খাওয়াতে হবে।
পায়ের ক্ষুর বেড়ে গেলে পরিমাণ মতো ছেঁটে (Foot triming) দিতে হবে। মাঝে মধ্যে ব্রাশ করে পায়ের ক্ষুর পরিষ্কার করে দিতে হবে।
গাভীকে Anti xident, I Phytochemicalসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য ও কাঁচা ঘাস খেতে দিতে হবে। ফলে গিরা শক্তিশালী হবে ও গিরার ক্ষতিকে মেরামত করবে।
প্রয়োজনে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি খেতে দিতে হবে।
গাভী ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে হবে।
কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
* উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর