রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলাগুলো পাহাড়ি ফসল আবাদের মাধ্যমে সুফল আহরণে একেকটি ‘গোল্ডেন মাইন’। এখানকার বসবাসরত আদিবাসীদের আধুুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও পরিকল্পিতভাবে সব পাহাড়ি অঞ্চল চাষের আওতায় আনা গেলে বাংলাদেশের শস্য ভা-ারে বিপুল পরিমাণ সম্পদ যোগ হবে। ফলে অভ্যন্তরীণ পুষ্টিকর ফসলের চাহিদা পূরণ করে আগামী দিনের খাদ্য রপ্তানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এককালে দেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমি ‘আনটাচড গোল্ডেন মাইন’ হিসেবে দীর্ঘকাল পড়েছিল। বিগত এক যুগে সেচ সুবিধা, রাস্তাঘাট, পরিকল্পিত ফসল আবাদ, ক্রপিং প্যাটার্নের পরিবর্তন ও ক্রপিং ইনটেনসিটি অতি মাত্রায় বৃদ্ধির ফলে আগের তুলনায় বর্তমানে ফসল উৎপাদন ৮-১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এলাকার আর্থসামাজিক ও পরিবেশের উন্নয়নে ব্যাপক সুফলের প্রভাবে তথায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে, পৃথিবীতে এটি একটি অনন্য মডেল হিসেবে শস্য ভাণ্ডারে দ্রুত রূপান্তরের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। একইভাবে পাহাড়ি জেলাগুলোর ‘আনটাচড গোল্ডেন মাইনের’ প্রকৃত সুফল আহরণের প্রয়োজনীয়তা এ সময়ের অন্যতম দাবি, যা এ দেশে আরও একটা নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
বিরাজিত পরিস্থিতি
কালের প্রভাবে এখানে যে নানা ধরনের মূল্যবান বেশি বয়স্ক বনজ সম্পদ ছিল তা আর দৃশ্যমান হয় না। কিছুটা এ সম্পদ নিধন হয়েছে অভাবী আদিবাসীদের দ্বারা। আর বড় আকারে বৃক্ষ নিধনে যাদের অবদান তারা মূলত বনরক্ষক, বড় মাপের আমলা কিংবা নেতৃস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ যা কারও অজানা নেই। উল্লেখ্য রাবার, পামঅয়েল, চা, কফি, নারিকেল, কমলা ইত্যাদি বাগান সৃষ্টির নামে অনেক পাহাড়ি জমি বেদখল হয়েছে। অথচ সেসব বাগানের উপস্থিতি ও প্রাপ্ত সুফল দৃশ্যমান নয়। তবে সময়ের ব্যবধানে চাষাবাদে আশার আলো রূপে জুম চাষ, ফল, সবজি ও অন্যান্য ফসল আবাদে বেশ কিছু আধুনিকায়নের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব ধরনের প্রচলিত ফসল আবাদ ও উন্নয়নে করণীয় দিকগুলোর কিছু অংশ নিম্নে প্রদত্ত হলো-
জুম চাষ : জুম চাষ প্রবণতা ইদানীং অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা হেড কোয়ার্টারসের নিকটস্থ ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা আছে এমন এলাকায় জুম চাষ নেই বললেই চলে। দূর-দুরান্তে অনেকটা গহিন অরণ্যে যতটুকু জুম চাষ লক্ষ করা গেছে তথায়ও আধুনিকতার ছোঁয়া দৃশমান হয়। জুমে প্রচলিত জাতের (কবরোক, গ্যালং, চুড়ই, তুরকী, আমেই, কুপালী) ধানের পরিবর্তে নতুন আধুনিক জাত ব্রি ধান৩, ২০, ২১ ও ২৬সহ নেরিকা জাত স্থান পেতে চলেছে। জুমে খুব ভালো জাতের তিল চাষ দেখা গেল, উচ্চতায় প্রায় ৭-৮ ফুট। এছাড়াও মিষ্টিকুমড়া, মারফা (শসা), চিনাইল, বরবটি, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, ভুট্টা, যব, চুকুর, মরিচ, বেগুন, সুজি, ধনিয়া, আদা, হলুদ ইত্যাদি মৌসুমি ফসলসহ মাঝে মাঝে এগুলোর ফাঁকে লম্বা জাতের পেঁপে, বাংলা কলার চাষ বেশ দেখা যায়।
ফল চাষ : বিভিন্ন ধরনের ফল বাগান সৃষ্টির উদ্যোগ অহরহ দেখা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফল চাষ পরিস্থিতি নিম্নে প্রদত্ত হলো-
আনারস : আনারস চাষ প্রবণতা বেড়েছে। আগে মূলত ওপর থেকে নিচের দিকে সারি করে অনাকাক্সিক্ষত পদ্ধতিতে আনারস লাগানো হতো। এখন তাতে পরিবর্তন এসেছে, প্রকৃত নিয়মে আড়াআড়িভাবে পাহাড়ের কন্টুরে আনারস লাগানো হচ্ছে এবং তাতে পরিচর্যা গ্রহণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যা আগে দেখা যেত না। রাস্তাঘাট, পরিবহন, বাজার ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাগানির এ ফলের মোটামুটি ভালো মূল্য পাচ্ছে।
* লেখক বিগত ১০-১৩ অক্টোবর ২০১৫ চার দিনব্যাপী রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলার পরিস্থিতি সরেজমিন ঘুরে দেখার আলোকে প্রতিবেদনটি লেখেন।
কলা : পাহাড়ের অন্যতম ফসল কলা। আগে অনেকটা নিম্নমানের চাঁপাকলা কম যত্নে আবাদ করা হতো। এখন দৃশ্য অনেকটা পাল্টাচ্ছে। তদস্থলে বাংলাকলা আবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। তাতে চাষিরা ফলন এবং মূল্য উভয়ই বেশি পাচ্ছে। অনেকটা সমতলে কিছু সাগরকলা এবং তরকারি কলার আবাদ লক্ষ করা গেছে। নরসিংদীতে এক ধরনের উন্নত মানের বাংলা কলা যা ‘গ্যাঁড়া কলা’ নামে প্রচলিত এটি এবং সবরি কলা চাষের উদ্যোগ নেয়া যায়।
পেঁপে : পাহাড়ি এলাকায় লম্বা জাতের বহু বছরজীবী এক জাতের পেঁপে চাষ প্রচলন আছে। মূলত বসতবাড়ি ও জুমের ফাঁকে সীমিত আকারে এ ফলের চাষ চলছে। একবার লাগালে ৬-৭ বছর ফলদানে সক্ষম। মিষ্টি, বড় জাতের এ পেঁপের ব্যাপক হারে চারা তৈরি করে পাহাড় এলাকায় সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সমতলেও এ জাতটি ছড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে এ জাতের পেঁপের চারা তৈরি করে এর সুফল সর্বত্র ছড়ানো দরকার।
আম : আম্রপালি জাতের বাগান স্থাপনে পাহাড়ি এলাকায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়া ও মাটিতে রসের অভাবের কারণে এ আমের মিষ্টতা বেশি, যা অন্য জেলাতেও যথেষ্ট সমাদৃত। বাগানি আমের ভালো দাম পাচ্ছে, আবাদে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। এখানে সীমিত আকারে রাঙ্গুয়াই নামক আমের বারমিজ জাতটির সম্প্রসারণ হচ্ছে। তবে অতি আগাম (গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, বৈশাখী) ও অতি নাবি (আশ্বিনা, বারি-৪, গৌড়মতি) জাতের আবাদ সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আম ও আয় প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
লটকন : লটকন একটা হাইভ্যালু ফসল, এ ফল রপ্তানির সুবিধাও আছে। প্রথম ৩-৪ বছর ছায়া/আধা ছায়ায় চাষ করা যায়। এ ফল গাছের খুব একটা বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না। পার্বত্য জেলার অনেক বাগানের আধা ছায়া যুক্ত স্থানে এ ফল চাষের প্রচুর সুযোগ আছে বিধায় ১৫-২০ ফুট দূরত্বে এ ফল বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
কমলা, মাল্টা ও অন্যান্য লেবুজাতীয় ফল : পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর মাল্টা-কমলা, বাতাবি ও অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের আবাদ দেখা যায়। বিভিন্ন জাতের কমলা গাছের ঠিকমতো পরিচর্যা ও খাবারের অভাবে কাক্সিক্ষত ফলন দেখা গেল না। এ অবস্থার উন্নয়নে করণীয় দিকগুলো হলো-
নতুন গাছ লাগাতে হলে স্স্থু সবল স্টকে সুস্থ উন্নত জাতের সায়ন দিয়ে তৈরি কলম হতে হবে। কমলা গাছের লাগানো চারা লম্বায় বেশি বাড়ার প্রবনতা আছে বিধায় গাছ ৪-৫ ফুট লম্বা হলে আগা কেটে (এপিক্যাল ডমিনেন্সি রোধ) দিয়ে সুন্দর ক্যানোপি তৈরি করে নিতে হবে। পরিদর্শনকালে বারি মাল্টা-১, পাকিস্তানি মাল্টা ও কমলা এবং সাজেক জাতের কমলা চাষ বেশি লাভজনক বলে চাষিদের অভিমত। কাজেই নতুন বাগান সম্প্রসারণ-সৃষ্টিতে এ জনপ্রিয় জাত গুলোর আবাদ গুরুত্ব বেশি দিতে হবে।
নতুন সম্ভাবনাময়ী ফল চাষ : আম, বাতাবি, পেয়ারা, কাঁঠাল, বেল, কদবেল, জলপাই, জামরুল, সফেদা, শরিফা ইত্যাদি বিভিন্ন ফলের সীমিত সংখ্যক জাতের বাগান সৃষ্টির কাজ লক্ষ করা গেছে। এ ব্যবস্থায় নতুন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী জাতগুলোর তেমন প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে না। আমের ক্ষেত্রে মূলত আম্রপালি ও রাঙ্গুয়াই জাত প্রাধান্য পাচ্ছে। তথায় গৌড়মতি, বান্দিগুড়ি, হাঁড়িভাঙ্গা, সূর্যপুরী, তোতাপুরি, লক্ষণভোগ, গোবিন্দভোগ, আশ্বিনা, নানডকমাই, বারি-৪, ব্যানানা ম্যাংগো ইত্যাদি নতুন প্রচলিত জাতগুলোর সীমিত সংখ্যক মাতৃগাছ লাগিয়ে এলাকায় কিছু নতুন জাত আবাদের প্রচলন করা প্রয়োজন। নাটোরের বনলতা জাতের কদবেল কলম, স্থানীয় ভালো জাতের বেলের কলম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফলের আধুনিক জাতের ফল সম্প্রসারণে শৌখিন বাগানিদের টার্গেট করে অগ্রসর হতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্প সহায়তায় আধুনিক জাতের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে মাতৃবাগান সৃষ্টির দায়িত্ব হর্টিকালচার সেন্টারগুলোকে অবশ্যই নিতে হবে এবং পরবর্তীতে সেগুলোর চাষ জনপ্রিয় করতে হবে।
বারোমাসী সজিনা চাষ : বারোমাসী সজিনা পার্বত্য জেলায় সম্প্রসারণের জন্য অতি উপযোগী। খরা সহিষ্ণু এ সবজি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে কিছু সংখ্যক বারোমাসী সজিনা পরিদর্শনকালে চোখে পড়েছে। সেগুলোর পারফরম্যান্স খুব ভালো। ডাল লাগানোর অথবা কাটিং তৈরির জন্য মার্চ/এপ্রিল মাস অতি উপযোগী। ডাল বা কাটিং ছাড়াও বারোমাসী সজিনার বীজ থেকে তৈরি চারা রোপণে সম্প্রসারণ প্রাধান্য দিতে হবে। খাদ্য, পুষ্টি ও বাড়তি আয়ের জন্য বারোমাসী সজিনা সম্প্রসারণ অতি গুরুত্ব বহন করে।
চিবিয়ে খাওয়া আখ : পরিদর্শনকালে প্রায় সব উপজেলাতেই নানা জাতের চুয়িং আখ চাষ লক্ষ করা গেছে। স্থানীয় বাজার ও রাস্তার ধারে এ আখ প্রচুর বাজারজাত হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসী, ছেলেমেয়ে পরম আনন্দে তা চিবুতে দেখা গেছে। এর বাজারদরও মোটামুটি ভালো। এ অর্থকরী ফসলটির ব্যাপক সম্প্রসারণ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। প্রচলিত জাতগুলো থেকে অতি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী জাতগুলো চিহ্নিত করে তা শোধন করে রোগবালাই মুক্ত কাটিং রোপণে চাষিদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র তাদের কয়েকটি চিবিয়ে খাওয়া জাতের আখ তথায় সম্প্রসাণের উদ্যোগ নিচ্ছে, এটা ডিএই এর সহায়তায় বেগবান করা জরুরি।
পাহাড়ের ক্ষয়রোধ : পাহাড়ে ঢালু অংশে আদা, হলুদ, কাসাবা, ওলকচু, মুখিকচু ইত্যাদি মূলজাতীয় ফসল আবাদ প্রবণতা দেখা গেছে। সমতল অংশে এ ধরনের ফসল আবাদ করা যাবে। এগুলো পাহাড়ের ঢালে চাষ অব্যাহত রাখলে ভূমিক্ষয় হয়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে অন্য ফসল আবাদের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে।
গাছের ট্রেনিং প্রুনিং : কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবু জাতীয় গাছসহ সব ফল গাছের ট্রেনিং প্রুনিং এর মাধ্যমে কা- ও কাঠামো সুন্দর করে তৈরি করা প্রয়োজন। কাঁঠাল, জাম, আমড়া ইত্যাদি ধরনের গাছের কাণ্ডে হবে ১০x - ১৫x ফুট। তাতে মূল্যবান কাঠ প্রাপ্তি ও লম্বা গাছের নিচে ছোট আকারের ফল গাছ (কমলা, মাল্টা) লাগানোর সুবিধা হবে। কোনো প্রকার গাছের গোড়া থেকে গজানো একাধিক কা- রাখা যাবে না। কাঁঠাল গাছের কা- ও বড় ডাল পালায় যে অংশে কাঁঠাল ধরে তা থেকে গজানো ডাল ও পরিত্যক্ত কাঁঠালের বোঁটার অংশ অবশ্যই অগাস্ট/সেপ্টেম্বর মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। এ ব্যবস্থায় গাছে ফলন ডাবল হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আম, লিচু, কমলা, মাল্টা সব ধরনের ফল গাছ নিয়মিত ট্রেনিং প্রুনিং করা দরকার। ফল গাছের রোগাক্রান্ত, অফলন্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা নিয়মিত ছাঁটাই করে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হবে এবং গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বাড়বে।
মালচিং পদ্ধতি : গাছের গোড়া থেকে র্৩র্ -র্৪র্ দূরে খড়-কুটো, লতা-পাতা, আবর্জনা শুকিয়ে নিয়ে বর্ষার শেষ ভাগে খরা মৌসুমে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে গাছের গোড়া ঠাণ্ডা থাকবে, মাটিতে রস সংরক্ষিত হবে, পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈবসার হিসেবেও কাজ করবে। তবে বর্ষাকালে মালচিং না দিলেও চলে। পার্বত্য জেলাগুলোতে এ পদ্ধতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
সেচ ব্যবস্থা : খরা মৌসুমে বাগানে মাঝে মাঝে সেচ দেয়া হলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো হবে ও ফলন বাড়বে। তবে আম গাছে নভেম্বর হতে শুরু করে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সেচ দেয়া যাবে না। খরা মৌসুমে সেচ ব্যবস্থার পাশাপাশি বর্ষায় বাগানে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে। বাগানে মাঝে মাঝে কিছুসংখ্যক গর্ত তৈরি করে রাখলে তাতে পানি সংরক্ষণ করা যাবে। অধিকন্তু, এখানে বাগানের আগাছা ও পরিত্যক্ত সব ধরনের ডালপালা, লতাপাতা ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হলে পরবর্তীতে তা জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
রেইন ওয়াটার হারভেস্ট : হিল এলাকায় যেখানে যতটুকু সুবিধা আছে তথায় রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অন্যদের এ কাজে অনুপ্রাণিত করে এলাকা বিশেষে চরম পানি সংকট সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। সাজেকে কয়েকশ পরিবার কর্তৃক বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নিজ চক্ষে প্রত্যক্ষ করি। সেগুলোর আলোকে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বনে তা জনপ্রিয় করা অত্যাবশ্যক।
খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্রে রেইন ওয়াটার হারভেস্টের একটা মডেল আছে, সেটাও অনুসরণ করা যেতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় বয়ে যাওয়া ছোট ছোট পানির নহরে বাঁধ দিয়ে বর্ষার পানি সংরক্ষণ করে শুকনা মৌসুমে তা সেচের কাজে ব্যবহার করে বাগান থেকে প্রচুর ফল আহরণ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ইসরাইল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া ও চীনে এ ধরনের পাহাড়ি পরিবেশে এভাবে বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করে তা সৌরশক্তি চালিত সেচ পদ্ধতিতে পাহাড়ের অনেক উঁচুতে সৃষ্ট বাগানে সফল ভাবে ফল উৎপাদন করছে।
বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা : রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির অনেকগুলো বাজার (মাইসছড়ি, মহলছড়ি, দিঘীনালা, বাঘাইহাট, মাতলং, রুইলুই, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, জালিয়াপাড়া) ঘুরে দেখে ক্রেতা বিক্রেতাদের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। ছোট রাস্তার ধারে প্রচুর পাহাড়ি ফসল বেচা কেনা চলছে। হাটে বসা ও চলাফেরা করা অতি কষ্টকর। এসব গুরুত্বপূর্ণ হাটগুলোর সংস্কার করে রাস্তা ছেড়ে বর্ধিত পরিসরে বেচাকেনার সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যাবশক। পরিবহনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। আছে শুধু চাঁদের গাড়ি নামক এক ধরনের জিপ যার ধারণক্ষমতা ১০-১২ জন হলেও তাতে অমানবিকভাবে ৩০-৪০ জন যাত্রী ঠাঁসা অবস্থায় উঠানামা করে। একেবারে না হলেও অন্তত নসিমন-করিমন জাতীয় পরিবহন ব্যবস্থা তথায় চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলে মাইলের পর মাইল ভারী দ্রব্যাদি নিয়ে সেখানকার মহিলাদের কষ্টের চলাচল অনেকটা লাঘব হত।
এম. এনামুল হক*
* প্রাক্তন মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৯১৭০৫৫২০৫
জলবায়ুর পরিবর্তনে বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যস্ত। আর সে কারণে পরিবেশ এখন সবার দুশ্চিন্তার খোরাক। প্রয়োজনীয় দুইমুঠো খাবারের জন্য পুরো বিশ্বে পরিবেশবান্ধব কৃষি এখন সময়ের জ্বলন্ত ইস্যু, পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য এক অংশ জৈব কৃষি। জৈব কৃষি এমন এক কৃষি ব্যবস্থা যেখানে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদার্থের পুনঃচক্রায়ন যেমন কম্পোস্ট ও শস্যের অবশিষ্টাংশ, ফসল আবর্তন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জমি চাষাবাদের মাধ্যমে মাটি ও ফসলের উত্তম অবস্থা বজায় রেখে সুস্থ সবল বিষমুক্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন বেড়েছে অথচ মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা শক্তি কমছে, উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটিতে ও কৃষিপণ্যের কুপ্রভাব পড়েছে। এ কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক রাখতে, বালাইনাশকের প্রভাবে যাবতীয় স্বাস্থ্যহানী কমাতে, পরিবেশকে সংরক্ষণ করে পরবর্তী বংশধরদের জন্য উপযোগী করতে, বালাইনাশকের মাধ্যমে পরিবেশ দূষিত হওয়া রোধ করতে, পৃথিবীর বুকে নিরাপদ জীবনযাপন পরিবেশ সংরক্ষণ ও মাটির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য জৈব কৃষি ব্যবস্থার একান্ত প্রয়োজন। মোট কথা আমাদের নির্মল পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য পরিবেশবান্ধব কৃষি আবশ্যকীয়ভাবে দরকার। আর এ জৈব কৃষির মূলনীতি হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী পুষ্টির পুনঃচক্রায়ন, বিষমুক্ত উর্বর ও উৎপাদিকা শক্তি সম্পন্ন মাটি তৈরি করা, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করে বালাই ব্যবস্থাপনায়, ব্যাপকহারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও উন্নয়ন। জৈব কৃষিতে বিভিন্ন ব্যবস্থা অনুসরণ করে ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ খাদ্য উৎপাদন ও পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। বংশানুগতভাবে সমন্বিত ও সুষ্ঠু হয় এমন গাছপালা ফসল নির্বাচন করা। এ ধরনের কিছু পদ্ধতি হলোÑ সারিবদ্ধ ফসল, বেড়া ফসল, মিশ্র বা আন্তঃফসল, সাথী ফসল, শস্য পর্যায়, আচ্ছাদন ফসল, সবুজ সার, মালচিং বা আচ্ছাদন, কৌশলী ফসল, প্রতিরোধী ফসল, সহায়ক ফসল এসব।
জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের জৈবসারের উৎস হচ্ছে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, জৈবিক নাইট্রোজেন সংযোগকারী বা বিএনএফ উদ্ভিদ ও জৈব উৎস হতে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থসমূহ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা, ছাই। তাছাড়া পচানো তরল গোবর ও কিছু পচা সবজি জমিতে প্রয়োগ করা হয়। জৈব কৃষিতে কিছু কিছু পাতা, কা-, ডাল, মূল বা বাকলের রস কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের কিছু গাছ হলো ধুতরা, ভেন্নার তেল, রেড়ি, বন্যতামাক, পেঁপে, শিয়ালমুথা, আফ্রিকান ধৈঞ্চা, বিশকাটালি, নিম, নিশিন্দা, অড়হর, তুলসীপাতা, ডোলকলমি, টমেটো-গাছপাতা, ল্যান্টানা, মেক্সিকানগাঁদা, পাটের বীজ, নিম, মেহগনি এসব। ভেষজ গাছপালার আছে বহুবিধ ব্যবহার। অনেক প্রকার গাছ-গাছড়া আছে যেগুলো পশুপাখির নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। যেমন পশুর চর্মরোগে বন্য তামাকের পাতা ঘষে দেয়া, গ্লিরিসিজিয়া পাতা পানিতে সিদ্ধ করে সে পানি গরুর উকুন ও আঠালি দমনে ব্যবহার করা যায়। তুলসীপাতা দিয়ে আমের পোকা দমন করা যায়।
অধিক ফসল ফলন পেতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। বালাইনাশন তথা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া যায় না বলে চাষিরাও এসবের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল এবং প্রায় সব মৌসুমে ব্যবহার করে। যথেষ্ট বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, মাটির গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে, উদ্ভিদ-ফসলে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে, বাদ যাচ্ছে না জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যহীনতা। বালাইনাশকের মধ্যে কীটনাশক আবার বেশি ব্যবহৃত হয় কেননা এর প্রাপ্যতা আর পোকার পরিচিতি অনেক বেশি এবং দীর্ঘদিনের।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে টোটাল কৃষি ব্যবস্থাই পাল্টে গেছে। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চাষাবাদ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ প্রযুক্তি কৌশল বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হচ্ছে। কিন্তু এটাতো ঠিক স্থানীয় ও উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তি ও ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা তাপমাত্রার তারতম্য, বৃষ্টিপাতের ধারার পরিবর্তন, দিনের দৈর্ঘ্য মোটকথা প্রকৃতির হেয়ালিপনা। আবহাওয়া জলবায়ুর তারতম্যের ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা, পোকা বহনকারী রোগ বিভিন্ন ফসলে আক্রমণ করছে, যার ফলে ফলন কমে যাচ্ছে। চাষিরা ভালো ফলন না পেয়ে অভিযোজন বা খাপ খাওয়ানোর কৌশলসমূহ স্থায়ীভাবে ব্যবহার করছে না। কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফসল, ফল, শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল ভালো ফলন দেয়া শুরু করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে আর তা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে চাষিরাও প্রচলিত অভিযোজন কৌশল পরিবর্তন করছে।
পরিবেশসম্মত বা পরিবেশবান্ধব কৃষি বাস্তবায়ন করতে হলে জৈব কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। জৈব কৃষিতে জৈবসার, জৈব বালানাশক, জৈব ব্যবস্থাপনা প্রধান। জৈবিক বালাইব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগ দমনের জন্য সমন্বিত বালাই দমনব্যবস্থা, উপকারী বন্ধু পোকার ব্যবহার, পোকার সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা। আইসিএম-আইপিএম পদ্ধতির মাধ্যমে কীটনাশকের ব্যবহারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকখানি কমে যাবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে সমন্বিত বালাইদমন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে ফসলে বালাই দমন দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। জৈবিকভাবে ফসলের বালাই দমন আইপিএমের একটি লাগসই প্রযুক্তি যা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জৈবিক পদ্ধতিতে বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় যে সব উপাদান-পণ্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো উপকারী বন্ধু পোকার লালন ও পোকার সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা।
উপকারী বন্ধু পোকা এবং ফেরোমন তৈরি এতদিন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা পর্যায়ে ছিল কিন্তু ২০০৫ সনের গোড়ার দিকে উজবেকিস্তান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের কৃষি বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের কয়েকজন কৃষিবিদদের নিকট উপকারী বন্ধু পোকার বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হস্তান্তর করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় একজন বৃটিশ বিজ্ঞানী কিছু পোকার সেক্স ফেরোমন উৎপাদন কৌশল হাতে কলমে শিখিয়ে দেন। তখন থেকেই যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উপকারী বন্ধু পোকা ব্রাকন, ট্রাইকোগ্রামা, লেডিবার্ড বিটল ও গ্রিনলেস উইং ও পোকার সেক্স ফেরোমন উৎপাদন। গত দশক থেকে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম এর মাধ্যমে উপকারী বন্ধু পোকা এবং ফেরোমন ফাঁদ এর সমন্বয়ে যে বালাই দমন প্যাকেজ তা মাঠ পর্যায়ে কতটুকু সফল ও কার্যকরী পদ্ধতি তা যাচাই করাই ছিল সে গবেষণার মূল লক্ষ্য। সফল গবেষণার পর উপকারী বন্ধু পোকা ও ফেরোমন ব্যাপকভাবে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইপিএম পদ্ধতি দেশের বিভিন্ন ফসল উৎপাদন এলাকায় উপকারী বন্ধু পোকা ব্রাকন, ট্রাইকোগ্রামা, লেডিবার্ড বিটল ও গ্রিনলেস উইং ও পোকার সেক্স ফেরোমন কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আস্তে আস্তে এগুলো গ্রহণ করেছে এবং এর সুফল বিস্তৃত হতে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতির চাষাবাদে উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইাশক বিশেষ করে কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে করে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কমছে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা অন্য দিকে এসব রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব মাটিতে ও কৃষি পণ্যে পড়ছে। বিশেষ করে মাটি, পানি বায়ুসহ আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ দারুণভাবে দূষিত হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশবান্ধব কৃষি, নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জীবনযাপন সর্বোচ্চ গুরুত্বের মধ্যে পড়ছে। পরিবেশ সুসম্মত রেখে মাটির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের কৃষি এখন একটি পরিবর্তনশীল ব্যবস্থার দিকে নেয়া একান্ত আবশ্যক। এ চাহিদাকে সামনে রেখে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ ও দূষণমুক্ত পরিবেশে সব ফসল উৎপাদনের জন্য আইপিএম-আইসিএম এ কর্মসূচি জরুরি। কেননা এগুলো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে Sir Albert Howard জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব থিম মাথায় রেখে ভারতে জৈব বিষয়ে কাজ করেন। এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে জৈব কৃষির জনক নামে অভিহিত করা হয়। জৈবিক বালাইব্যবস্থাপনা কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্মিলিতভাবে মাঠে সফল গবেষণা চালায়। ফলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব কৃষির জন্য জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কৃষকগণ বালাই ব্যবস্থাপনায় শুধু বালাইনাশকের ওপর নির্ভর করেন। অপরিকল্পিত মাত্রা ও কৌশলে রাসায়নিক ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কৃষককে জানানো হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও মানব স্বাস্থ্যহানী থেকে রক্ষাকল্পে জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাইব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে নেই।
পোকার সেক্স ফেরোমন হলো এক ধরনের জৈব রাসায়নিক বা সেমিকেমিক্যাল পদার্থ যা কোনো প্রজাতির স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিসৃত হয় একই প্রজাতির পুরুষ পোকাকে প্রজনন কাজে আকৃষ্ট করার জন্য। সেক্স ফেরোমনের সবচেয়ে বড় দিক হলো এটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত জৈব পদার্থ যা জীব ও পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি করে না। ইদানীং দেশের কিছু কিছু অঞ্চলের কৃষকরা সেক্স ফেরোমেন ব্যবহার করে রাসায়নিকমুক্ত শাকসবজি উৎপাদন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই না তারা প্রমাণ করেছেন সারা বাংলায় এ প্রযুক্তি অনায়াসে চালু করা যাবে আমাদের সবার জন্য ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ করে বিদেশে শাকসবজি ফলমূল রফতানির জন্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধানের পাশাপাশি সবজি উৎপাদন সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেননা রাসায়নিক বিহীন শাকসবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের বাজারে রপ্তানির কার্যক্রম আমাদের কৃষিকে আরও সমৃদ্ধি করতে পারে, নিজেদের লাভ করে বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে চলছে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা- সহযোগিতামূলক গবেষণা সহায়তাকারী কার্যক্রম। বাংলাদেশের বিএআরসি, বারি, ব্রি, বিজেআরআই, বিএসআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। আমরাতো জানি সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা বা আইপিএম মূল উদ্দেশ্য হলো-
০ বালাইয়ের আক্রমণ থেকে ফসলের ক্ষতি কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো;
০ ফসল চাষে কৃষকের আর্থিক উপার্জন বাড়নো;
০ বিভিন্ন ধরনের ফসলে বিষাক্ত বালাইনাশকের অহেতুক ব্যবহার কমানো বা রোধ করা;
০ ফসল, মাছ ও হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য কৃষি ফসল ও পণ্যের ওপর বালাইনাশকের সম্ভাব্য বিষাক্ততা রোধ করা;
০ কৃষি ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার গবেষণা, উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা;
০ সামগ্রী জীববৈচিত্র্য এবং মানবস্বাস্থ্য সংরক্ষণ করা;
০ সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত প্রদানে উৎসাহ প্রদান করা।
সবজি চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। গত এক দশকে সবজি চাষের জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কিন্তু পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য সবজি চাষিরা জেনে বা না জেনে যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার করেন। যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, বেগুনের পোকা বা অন্যান্য বালাই দমনের জন্য বেগুন চাষিরা প্রতি মৌসুমে প্রায় ১৫০ বার বা প্রতিদিন কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। অন্যান্য সবজি ফসলেও তাঁরা প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করেন। এর ফলে পোকার মধ্যে কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছে, যে কারণে বারবার কীটনাশক ব্যবহার করেও পোকা দমন হচ্ছে না এবং সবজি চাষের খরচ উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে সবজি চাষিদের আয় কমে যাচ্ছে। এছাড়া কীটনাশকের বিষাক্ততার জন্য চাষির স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে এবং যারা এসব কীটনাশক প্রয়োজনকৃত সবজি খাচ্ছেন তাদের দেহের মধ্যে কীটনাশকের বিষক্রিয়া প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ যে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করার দরুন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সবজি রপ্তানি করার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ যাবৎ যেসব সবজি ফসলের জন্য আইপিএমের মাধ্যমে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো হচ্ছেÑ বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স, শিম ও বিভিন্ন কুমড়া জাতীয় সবজি। বর্তমানে পুরো বাংলাদেশে আইপিএমের কার্যক্রম চলছে। গত ৩/৪ বছরে আইপিএমের কার্যক্রমের মাধ্যমে সবজি ফসলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রযুক্তি সফলতা অর্জন করেছে এবং বিভিন্ন এলাকার চাষিরা সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তা হলো-কলম/চারা ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগ দমন। ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, বেগুন ও টমেটোর একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর রোগ, যা সহজে দমন করা যায় না। ফলে চাষিদের বেগুন ও টমেটো ক্ষেতের প্রায় ৫০ ভাগ গাছ এ রোগের আক্রমণে মারা যায় ফলে আর্থিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ রোগ প্রতিরোধী বেগুন ও টমেটোর কলমের চারা ব্যবহার করলে বেগুন ও টমেটোর গাছ এ রোগে খুব কম আক্রান্ত হয় বা মোটেই আক্রান্ত হয় না। গাজীপুর ও যশোর এলাকায় কৃষকের মাঠে বেগুনের চারা কলম ব্যবহার করে চাষিরা প্রায় ২ থেকে ৪ গুণ বেশি ফলন পেয়েছেন এবং প্রায় ৩ গুণ বেশি অর্থ আয় করেছেন। টমেটোর চারা কলম ব্যবাহর করে গাজীপুর এলাকার চাষিরা প্রায় দেড় গুণ বেশি ফলন ও অর্থ আয় করেছেন।
উদহারণস্বরূপ বলা যায়, কুমড়া জাতীয় বিভিন্ন ফসলের মাছি পোকা একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা। এ পোকা কুমড়া জাতীয় ফসলের যেমন-মিষ্টিকুমড়া, করলা, শসা এসবের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে এবং ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফসলের ভেতরে খেয়ে ফল নষ্ট করে ফেলে। পোকার আক্রমণের কারণে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যায়, যা কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালোভাবে দমন করা যায় না এবং এজন্য চাষিরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফেরোমন এবং মিষ্টিকুমড়ার ফাঁদ ব্যবহার করলে মাছি পোকা আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদের মধ্যে পড়ে এবং মারা যায়। ফলে ফসল এ পোকার আক্রমণ থেকে ব্যাপকভাবে রক্ষা পায়, পরিবেশসম্মত উপায়ে কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করা যায়। অনেক এলাকায় মিষ্টিকুমড়া, শসা ও করলা ফসলে এ ফাঁদ ব্যবহার করে চাষিরা ১ থেকে ৩ গুণ বেশি ফলন পেয়েছেন। চাষিরা সেক্স ফেরোমনকে জাদুর ফাঁদ নামে অভিহিত করেন।
জৈব কৃষির আওতায় মুরগির পচনকৃত বিষ্ঠা ও সরিষার খৈল ব্যবহারে মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি ফসলের মাটিবাহিত রোগ দমন করা যায়। সবজি ক্ষেতের মাটিতে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ও কৃমি বাস করে, যারা সবজির গাছ নষ্ট করে বা মেরে ফেলে। মুরগির বিষ্ঠা ও সরিসার খৈলের মধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে, যা বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও কৃমিকে মেরে ফেলে এবং সাথে সাথে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। গাজীপুর, লালমনিরহাট ও কুমিল্লা এলাকায় বিভিন্ন সবজি যেমন বাঁধাকপি, শসা, বেগুন, টমেটো এসব ফসলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসলের ক্ষেতে বিভিন্ন রোগ ও কৃমির আক্রমণ ৫০ থেকে ৯০ ভাগ কমে গেছে এবং ফসলের সার্বিক উন্নতিসহ দেড় থেকে ২ গুণ বেশি ফলন হচ্ছে।
সঠিক সময়ে আগাছা দমন পদ্ধতির মাধ্যমে বেশি লাভ কার যায়। চাষিরা সব সময় তাদের সবজি ক্ষেত আগাছামুক্ত রাখতে গিয়ে ৫ থেকে ৬ বার আগাছা পরিষ্কার করেন। এর ফলে সবজি চাষের খরচ অনেক বেড়ে যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতবার আগাছা পরিষ্কার না করে ফসলের বাড়বাড়তি ও আগাছা জন্মানোর সময় বিবেচনা করে মাত্র দুইবার আগাছা পরিষ্কার করা হলে যেমন সঠিকভাবে আগাছা দমন করা যায় তেমনি ফসলের ফলনও ভালো পাওয়া যায়। মোট কথা বীজ বপন আর চারা রোপণের পর অন্তত ৩০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত জমি বা ফসল আগাছামুক্ত রাখতে পারলেই যথেষ্ট। গাজীপুর এলাকায় এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষিরা তাদের বাঁধাকপি, বেগুন, ঢেঁড়স ও টমেটো ক্ষেতে আগাছা দমনের খরচ ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ কমাতে পেরেছেন এবং আর্থিকভাবে প্রায় দেড় গুণ বেশি লাভবান হয়েছেন।
বিভিন্ন এলাকায় কয়েক প্রজাতির পাতা খেকো পোকা বাঁধাকপি ও ফুলকপি ফসল নষ্ট করে ফেলে। এসব ফসলের ফলন ও গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চাষিরা কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালো ফল পান না। এসব পাতা খেকো পোকা আক্রমণের প্রথমাবস্থায় যদি আক্রান্ত পাতার পোকাগুলো হাত দিয়ে ২ থেকে ৩ বার মেরে ফেলা হয় তাহলে পোকার আক্রমণ কম হয় ও কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না এবং ভালো ফলন পাওয়া যায়। গাজীপুর, যশোর ও কুমিল্লা এলাকায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষিরা সাফল্যজনক ভাবে বাঁধাকপির পাতা খেকো পোকা দমন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং কীটনাশক ব্যবহার করার তুলনায় বেশি ফসল ও অর্থ লাভ করেছেন। পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এমন জাত ব্যবহার করা একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও লাভজনক পদ্ধতি। গত কয়েক বছর মাঠ পরীক্ষার মাধ্যমে এমন কয়েকটি বেগুনের জাত শনাক্ত করা হয়েছে যারা ডগা ও ফলের মাজরা পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। বাউ বেগুন এর মধ্যে একটি।
ক বছর আগেও আইপিএম কেউ গ্রহণ করতে চাইতো না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এবং আবশ্যকীয়তার জন্য আইপিএম এখন আমাদের ফসল উৎপাদনে জরুরি বাস্তবায়নযোগ্য বিষয় হয়েছে। সাথে যোগ হয়েছে আইসিএম বা সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা। এটি ভালো ও প্রশংসনীয় লক্ষণ। সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা আরও বিস্তৃত হয়ে বাংলার কৃষি অনেক এগিয়ে যাবে। আমরা সকলে কৃষিজীবী কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং অন্য সবাই পরিবেশকে সুসম্মত রাখার সব চেষ্টা বাস্তবায়ন করব এবং জৈব কৃষির আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে সকলে মিলে সকলের তরে হয়ে কাজ করব। তবেই কাজের কাজ অনেক হবে। আমাদের কৃষি সুসংহত হয়ে সমৃদ্ধ হোক এটা আমাদের সবার কামনা। কথায় আছে সমন্বিত বালাই দমন গুণের নাইকো শেষ, কম খরচে অধিক ফলন সুস্থ পরিবেশ। পরিবেশ সুসমুন্নত করে আমরা বেশি উৎপাদন করব গ্রহণ করব কাজে লাগাব এবং দেশকে পরিবশ সম্মত উৎপাদন দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করব। কেননা কৃষিই সমৃদ্ধি। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার। এ হোক আমাদের সম্মিলিত প্রাণের অঙ্গীকার।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। subornoml@yahoo.com/gmail.com
কলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল যা সারা বছর পাওয়া যায়। কলাকে প্রাচীন সাহিত্যে কদলি বলা হতো।
কলাগাছ, কলাপাতা, কলাগাছের শিকড় ও কলা সবই উপকারী। কলাগাছ ও কলাপাতা শুধুমাত্র পশু খাদ্য নয়। এদের আছে আশ্চার্যজনক ভেষজ গুণ। রোগ নিরাময়ে অদ্বিতীয়।
কলার পুষ্টিগুণ প্রচুর। কলা উপাদেয় খাদ্য। কাঁচা পাকা দুই অবস্থায়ই খাওয়া যায়। কলায় রয়েছে জলীয় অংশ ৭০ গ্রাম, আঁশ ০.৫ গ্রাম, খাদ্য শক্তি (কিলোক্যালরি) ১০৯, আমিষ ০.৭ গ্রাম, চর্বি ০.৮ গ্রাম, শর্করা ২৫.০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১.০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ২৪ মিলিগ্রাম। নারিকেল ছাড়া আর কোনো খাদ্যেই কলার মতো খাদ্যশক্তি নেই। তাই যে কোনো সময় পরিশ্রান্তে অথবা শক্তিক্ষয়জনিত অবস্থায় কলা আহার করলে শরীর পুনরায় কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। নারিকেলে ৩৫.৫৭ গ্রাম চর্বি থাকে। যদিও নারিকেলের শর্করা মাত্র ১০.২২ গ্রাম। নারিকেলে খাদ্য শক্তি ৩৭৬ কিলোক্যালরি। যা প্রচলিত ফলের মধ্যে সর্বোচ্চ। দৈনিক খাদ্য তালিকায় সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিনের খাবারে অন্তত ৬০ গ্রাম ফলাদি থাকা বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে খাবারে আপনার পছন্দের যে কোনো কলা থাকতে পারে।
কলা চাষ : বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যেসব জাতের আবাদ হচ্ছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হচ্ছে বারিকলা-১ ও বারিকলা-২ (আনাজিকলা), অমৃতসাগর, সবরি, চম্পা, কবরি, মেহেরসাগর, বীচিকলা অন্যতম।
মাটি : পর্যাপ্ত রোদযুক্ত ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত উঁচু জমি কলা চাষের জন্য উপযুক্ত। উর্বর দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উত্তম। চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছামুক্ত করে নিতে হবে।
চারা রোপণ : কলার চারা বছরে ৩ সময়ে রোপণ করা যায়। ১ম রোপণ কাল : আশ্বিন-কার্তিক সবচেয়ে ভালো সময়। ২য় রোপণ কাল : মাঘ-ফাল্গুন ভালো সময়। ৩য় রোপণ কাল : চৈত্র-বৈশাখ মোটামুটি ভালো সময়।
চারার দূরত্ব : সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ মিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ২ মিটার।
গর্ত তৈরি : চারা রোপণের মাসখানেক আগেই গর্ত খনন করতে হবে। গর্তের আকার হবে ৬০ সেমি. চওড়া ও ৬০ সেমি. গভীর। গর্ত তৈরি হয়ে গেলে গোবর ও টিএসপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরে রাখতে হবে।
চারা রোপণ : রোপণের জন্য অসি তেউড় উত্তম। অসি তেউরের পাতা সরু, সুঁচালো এবং অনেকটা তলোয়ারের মতো, গুড়ি বড় ও শক্তিশালী এবং কা- ক্রমশ গোড়া থেকে ওপরের দিকে সরু হয়। তিন মাস বয়স্ক সুস্থ সবল তেউড় রোগমুক্ত গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
সার ও সার প্রয়োগ পদ্ধতি
অর্ধেক গোবর জমি তৈরির সময় এবং অবশিষ্ট অর্ধেক গর্তে দিতে হবে। অর্ধেক টিএসপি একই সঙ্গে গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর ৪ ভাগের ১ ভাগ ইউরিয়া, অর্ধেক এমপি ও বাকি টিএসপি জমিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এর দুই থেকে আড়াই মাস পর গাছ প্রতি বাকি অর্ধেক এমপি ও অর্ধেক ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। মোচা বের হওয়ার সময় অবশিষ্ট ৪ ভাগের ১ ভাগ ইউরিয়া জমিতে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
কলা গাছের পরিচর্যা : চারা রোপণের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে তখনই সেচ দেয়া উচিত। এছাড়া শুকনো মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচ দেয়া দরকার। বর্ষার সময় কলা বাগানে যাতে পানি জমতে না পারে তার জন্য নালা থাকা আব্যশক। মোচা আসার পর গাছপ্রতি মাত্র একটি তেউড় বাড়তে দেয়া ভালো।
রোগ ও প্রতিকার : কলা গাছের প্রধানতম রোগগুলো হচ্ছে পানামা, বানচিটপ ভাইরাস, সিগাটোকা ও কলার দাগ রোগ।
পানামা রোগ প্রতিকারের জন্য আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছের তেউড় হিসেবে চারা ব্যবহার করা যাবে না।
বানচিটপ ভাইরাস রোগ প্রতিকারের জন্য আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। গাছ উঠানো আগে জীবাণু বহনকারী ‘জাব পোকা’ ও ‘থ্রিপস’ কীটনাশক ওষুধ দ্বারা দমন করতে হবে। সুস্থ গাছেও কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
সিগাটোকা রোগ আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফলতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি লিটার টিল্ট ২৫০ ইসি ১ গ্রাম ব্যাভিস্টিন মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর গাছে ছিটাতে হবে।
বিটল পোকার আক্রমণে কলার গায়ে বসন্ত রোগের দাগের মতো দাগ হতে দেখলে কলার মোচা বের হওয়ার সময় ছিদ্রবিশিষ্ট পলিথিন ব্যাগ দিয়ে মোড়ে দিতে হবে। এছাড়াও অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। যে কোনো ধরনের রোগের প্রতিকারের জন্য রোগ আক্রান্ত মাঠে বার বার কলা চাষ করা যাবে না।
ফসল সংগ্রহ : কলার চারা রোপণের ১১-১৫ মাসের মধ্যেই সাধারণত সব জাতের কলা পাকার উপযুক্ত হয়। প্রতি হেক্টরে ১২-১৫ টন কলার ফলন পাওয়া যাবে।
কলা ও কলা পাতার ভেষজ গুণ
ক. রোগ নিরাময়ে কলার ব্যবহার
১. শুষ্ক কাশিতে : একটি পাকা কলা চটকে অল্প পানিতে মিশিয়ে হালকা গরম করে সেটাকে ছেঁকে নিয়ে সেই পানিটা সকাল ও বিকালে কয়েক দিন খেলে উপশম হবে। তবে প্রতিদিন নতুন করে তৈরি করতে হবে।
২. সন্ধিযুক্ত গলক্ষতে : গলায় ব্যথা, লাল দেখায়, কর্ণমূল পর্যন্ত ব্যথা, মনে হয় যেন গলায় ঘা হয়েছে, গলার স্বর ভাঙা ভাঙা; এ ক্ষেত্রে একটা পাকা কলা ১ কাপ পানি দিয়ে চটকে গরম করে ছেঁটে নিয়ে সকালে এবং নতুন করে তৈরি করে বিকালে খেতে হবে। মাসখানিক খেলেই উপশম হবে।
৩. কৃমিতে : ১ চা-চামচ কলাগাছের শিকড়ের রস সকালে খালি পেটে ১ সপ্তাহ খেতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ৩-৪ চা-চামচ, কিশোর বয়স্কদের ২ চা-চামচ আর শিশুদের ১ চা-চামচ খাওয়াতে হবে।
৪. প্রদর রোগে : ১টা কাঁচাকলা চাকা চাকা করে কেটে রাত্রে ১ গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খালিপেটে সেই পানি খেলে মাসখানিকের মধ্যে প্রদর রোগ সেরে যাবে।
৫. ডায়রিয়াতে : কাঁচাকলা দুই তিনটা খোসাসহ দুই-টুকরো করে কেটে অল্প পানিকে সিদ্ধ করে কলার ভর্তা ৪-৫ বার খেলে দাস্ত বা বেশি পায়খানা বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি খাবার স্যালাইনও চলবে।
৬. প্রসূতির কাঁচা নাড়ি শুকাতে : প্রসবের পর শরীরকে ঝরঝরে করার জন্য কাঁচা কলা পুড়ে ভর্তা করে ভাত খেতে দিতে হবে।
খ. কলাপাতার ব্যবহার
কলাগাছের সবুজ পাতার রস, মোচা, থোড় সবই প্রয়োজনীয়। সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, কোষ্ঠবদ্ধতা, আমাশয়, রক্তদুষ্টি, অম্লগ্যাস, উচ্চরক্তচাপ, লিভারের দোষ হলে কলাপাতার রস উপকারী। ইউরোপ ও অন্যান্য উন্নত দেশে কলাপাতার সাহায্যে বহু রোগের চিকিৎসা করা হয়। ফরাসি ডাক্তাররা শোথ, যক্ষ্মা;, আন্ত্রিক, আমাশয় ও অতিসারে কলাপাতার রস খেতে বলেন।
না-কচি, না-শক্ত বিবর্ণ পাতা অর্থাৎ সবুজ পাতা বেটে বা থেঁথলে ছেঁকে সকালের দিকে আধা কাপ খেতে হবে। নুন, চিনি ইত্যাদি মিশিয়ে খাওয়া চলবে না। কলাপতায় থাকে ক্লোরোফিল। ক্লোরোফিল পেটে গেলে অন্ত্রের ঘা, লিউকোমিয়া, চর্মরোগ হয় না। কলাপাতার সবুজ রস রক্ত পরিষ্কার করে।
শরীরের কোথাও ক্ষত, চর্মরোগ হলে কলাপাতার রস ঘষে লাগালে উপকার হয়। ব্রঙ্কাইটিস, নেফ্রাইটিস, রক্তক্ষরণ, জমা সর্দিতে কলাপাতার রস খুবই কার্যকরী। প্লুরিশি, কাশি, ক্ষয়রোগ ও থুথুর সঙ্গে রক্ত পড়লে সবুজ কলাপাতার রস প্রতিদিন ভোরে আধাকাপ পরিমাণ খেলে ভীষণ উপকার হবে। কচি কলাপাতা বেটে প্রলেপ দিলে কীট দংশন, হুল ফোটা, কাটায় উপকার হবে।
সর্বপ্রকার দাঁতের ব্যথায় ‘প্ল্যান্টাগো’ (যা কলাপতা থেকে তৈরি হয়) হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা সুনামের সঙ্গে ব্যবহার করে আসছেন। প্যান্টাগোর মাদার তুলার দ্বারা দাঁতের গোড়ায় বাহ্যিক ব্যবহারে দাঁত ব্যথা আরোগ্য হয়। দন্তশূল, কর্ণশূল, কাটা, পোড়া, আঘাতাদি, সর্পদংশন, ইরিসিপেলাস ইত্যাদি নানাবিধ রোগে প্যান্টাগো সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়। গলগ-, ফুলে উঠা, জ্বর, শিরপীড়া সারাতে প্যান্টাগো ব্যবহৃত হয়।
কানের ব্যথায় : কলাগাছের মাঝের গোল অর্থাৎ খুলে যায়নি, সেই পাতাকে থেঁতো করতে হবে। রস নিংড়ে নিয়ে একটু গরম করতে হবে। ওই রস ২ ফোঁটা একবার কানে দিলেই বেদনা কমে যাবে। প্রয়োজনে আবার দিতে হবে।
সাবধানতা : কাঁচাকলা উপাদেয় ও সুস্বাদু তরকারি হলেও তরকারিতে খেলে কোষ্টকাঠিন্য দেখা দিতে পারে এবং পেটে বায়ু জমতে পারে। মোচা ও থোড়ের তরকারি সবসময় খেলে কিডনিতে পাথর সৃষ্টি হতে পারে। কারণ এদের মধ্যে অক্সালিড এসিড বিদ্যমান। পাকা কলা বেলা ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে খাওয়া উচিত। যখন তখন পাকা কলা খেলে ক্ষতি হতে পারে। কলা ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে, গিলে খেতে নেই। পাকাকলা মুখের লালাতেই হজম হয়।
সারের নাম প্রতি গাছে সারের পরিমাণ
গোবর-আবর্জনা সার ১৫-২০ কেজি
টিএসপি ২৫০-৪০০ গ্রাম
এমপি ২৫০-৩০০ গ্রাম
ইউরিয়া ৫০০-৬৫০ গ্রাম
কৃষিবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম*
* রীতা হোমিও হল, পালপাড়া (জামে মসজিদের সামনে), বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ
বায়ো-পল্লীর (Bio-Village) ধারণাটা অতি সম্প্রতি মানুষের মাথায় এসেছে। কাজও হচ্ছে। এ প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির নামে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের কারণে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যে বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর হিসেবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। এ ধারণার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তিগুলোর সন্ধান ও ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকে। ভারতের সিকিম রাজ্যসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশ বায়ো-ভিলেজ ধারণার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি সুন্দর পরিবেশবান্ধব টেকসই জীবিকা নির্বাহ এবং স্বাস্থ্যবান্ধব খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টিতে ভালো ফল পেয়েছে।
কুমিল্লা মডেল এবং কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি
কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন মডেলের মূল বিষয়টা ছিল শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে এবং আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। ফলে গ্রামীণ জনগণের মাঝেও মানবিক মৌলিক অধিকারগুলোর চাহিদা বেড়ে যাবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সেবা চাহিদা বাড়বে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষার চাহিদা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য চহিদাগুলোও বেড়ে যাবে। অপরদিকে আয় বৃদ্ধির ফলে এগুলো ব্যবহারের সামর্থ্যও বৃদ্ধি পাবে। ফলাফল শিল্পায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রসার ও উন্নয়ন ঘটবে।
পরিবর্তন হয়েছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ সনে জনসংখ্যা ছিল ৭.৫০ কোটি। তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ৩০ লাখ টন। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে এখন বাংলাদেশ পাশের দেশগুলোতে চাল রপ্তানি করছে। এ অবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু রাসায়নিক প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করতে যেয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে অধিক Land Degradation হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। প্রায় ১৬ কোটি লোকের খাদ্য সংস্থান করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার, মাটির নিচ থেকে অধিক হারে পানি উত্তোলন ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবে দেশটা মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আবার সময়ের ব্যবধানে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। ষাট দশকে দেশ রাসায়নিক কৃষির প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছিল। একদিকে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলা, কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে খাদ্য আমদানি এবং সর্বোপরি বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য ভবিষ্যৎ খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার প্রয়োজন থেকেই রাসায়নিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা থেকে বেড়ে যাওয়া ১৬ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনটি চেতনা মানুষের মাঝে প্রাধান্য পেয়েছে-
ক. মানব শরীরে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক প্রযুক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
খ. পরিবেশের ওপর এগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া
গ. জলবায়ু পরিবর্তনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ হিসেবেও প্রমাণিত।
মানুষের সচেতনতা ও চিহ্নিত বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোর বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জৈব কৃষি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জৈব কৃষি পণ্যের চাহিদা ইতোমধ্যে বিরাট আকার ধারণ করেছে। সচেতন ভোক্তা সমাজ রাসায়নিক উপায়ে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে জৈবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মূল্য বেশি দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে উৎপাদিত কৃষি পণ্যটি যে জৈব তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এর জন্য বাজারজাতকরণ ব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তিবর্গের সততার প্রশ্নটি জড়িত। কারণ জৈবিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে কৃষি পণ্যটি উৎপাদন করা হলো ঠিকই। কিন্তু অধিক মুনাফার লোভে বাজারজাতকরণ ব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তিবর্গ যদি পণ্যগুলো সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে তবে পুরো উদ্যোগই নিশ্চিতভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেখানেও জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং পল্লী উন্নয়নের পদক্ষেপে এ পরিবর্তন-সমন্বয় আনতে হবে।
বায়ো-পল্লী : উদ্দেশ্য কী হবে?
এ লক্ষ্যে প্রথমে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। যে ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করা হবে সেগুলো চিহ্নিত করে কাজে হাত দেয়া যেতে পারে। এটি হতে পারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিআরডিবি এবং পল্লী উন্নয়ন একাডেমির একটি সমন্বিত বায়ো-পল্লী স্থাপন প্রকল্প।
ক. বায়ো-পল্লী স্থাপনের লক্ষ্যে প্রাথমিক অবকাঠামো সৃষ্টি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ;
খ. দেশের প্রতিটি গ্রামকে সমবায়ের মাধ্যমে বায়ো-পল্লীতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে;
গ. রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের স্থানে জৈবসার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পাশাপাশি জৈবিক পদ্ধতিতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করা;
ঘ. সমবায় বাজারজাতকরণের মাধ্যমে জৈবিক উপায়ে উৎপাদিত পণ্যের জন্য কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এর জন্য সমবায় মার্কেটিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে এবং সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি পণ্য মার্কেটিংয়ের জন্য সমবায় সমিতিগুলোকে সহায়তা প্রদান সম্প্রসারিত করতে হবে;
ঙ. সমবায়ের মাধ্যমে বায়ো-পল্লী সৃষ্টির জন্য একটি জাতীয় জৈব-কৃষিনীতি প্রণয়ন করতে হবে।
কার্যক্রম গ্রহণ
ক. রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিরূপ প্রভাবগুলো নিয়ে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে। পাশাপশি জৈবসার তৈরি ও ব্যবহার পদ্ধতি এবং জৈব উপায়ে বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এগুলোর উপকারিতা নিয়েও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
খ. জৈব কৃষি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৌলিক অবকাঠামো সৃষ্টি ও জাতীয় জৈব খামার বা বায়ো-পল্লী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি উৎপাদিত জৈব কৃষি পণ্যের যথাযথ মূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। বায়ো-পল্লী স্থাপনের লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে বায়ো খামার স্থাপন এবং পারিবারিকভাবে পরিচালিত কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
গ. স্থানীয়ভাবে জৈবসার উৎপাদন, জৈবিক উপায়ে রোগবালাই দমন কৌশল ইত্যাদি উৎপাদনের কৌশল ও রসদের উৎসগুলো চিহ্নিত করে কৃষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
ঘ. উৎপাদিত জৈব কৃষি পণ্যের মার্কেটিংয়ের জন্য পৃথক সমবায় সমিতিভিত্তিক কৃষি বাজারজাতকরণ কর্মসূচি হাতে নিয়ে সমবায় সমিতিগুলোকে আর্থিকসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা দিতে হবে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষি পণ্য সংরক্ষণের কৌশল রপ্ত করানোর জন্য প্রশিক্ষণ অবশ্যই থাকতে হবে।
যেভাবে পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে
ক. জৈবসার বা জৈবিক উপায়ে রোগবালাই দমন কৌশলের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকগুলোর চেয়ে কম হবে তা প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে কৃষকদের দেখিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের পরিমাণ ও বায়ো পদ্ধতিতে উৎপাদনের পরিমাণ যে কোনোক্রমেই কম হবে না, প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে তাও দেখিয়ে দিতে হবে। সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি কৃষককে বায়ো-কৃষক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
খ. স্থানীয়ভাবে যেসব উপকরণ রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে কিভাবে জৈবসার প্রস্তুত, কিভাবে জৈবিক উপায়ে রোগবালাই দমন করা যায় এবং উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্যাকেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।
গ. সচেতনতা ও ধারণার ঘাটতি চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বায়ো-কৃষক তৈরি করতে হবে।
ঘ. স্কুল-কলেজের কৃষি বিষয়ক পাঠ্য পুস্তকগুলোতে বায়ো-কৃষির ধারণা দিতে হবে। যাতে লেখাপড়া করার সময় থেকেই ছাত্ররা বায়ো-কৃষির ধারণা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে।
ঙ. জৈব সার তৈরি বা অন্যান্য বায়ো প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সহজ শর্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম নিতে হবে এবং কাঁচামাল সংগ্রহের ওপর ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
যা করা প্রয়োজন
ক. জৈব উপায়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের যথাযথ মূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
খ. রাসায়নিক সারের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করে সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম হাতে নিয়ে জৈবসার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ সমবায়ের মাধ্যমে বায়ো-সার উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করত এগুলোতে বিনিয়োগ করা। উপজেলা পর্যায়ে ইতোমধ্যে স্থাপিত কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
গ. ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রগুলোকে গ্রামওয়ারি Data Base তৈরির দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
ঘ. বিআরডিবি-জাইকা কর্তৃক পরিক্ষীত Link Model কে সম্প্রসারিত এবং আরও Component Include করে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওপরে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি ‘সম্পূর্ণ জৈব কৃষি রাষ্ট্র’ অর্থাৎ ‘বায়ো-বাংলাদেশ’ এ রূপান্তরের ভিশন অর্জনে অবশ্যই সক্ষম হবে। য়
কৃষিবিদ খুরশীদ আলম*
* প্রাক্তন যুগ্ম পরিচালক (আরইএম), বিআরডিবি, ঢাকা
বাংলাদেশের কৃষিতে ফল ও সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফলের মাছি পোকা (fruit fly) এক মারাত্মক সমস্যা। সবজি বা ফল যখন একটু বড় হয়ে উঠে ঠিক তখনই মাছির মতো দেখতে এ পোকাটি কোমল ফলের গায়ে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ফলে ফলটি আর সঠিকভাবে না বেড়ে বিকৃত আকার ধারণ করে থাকে। এতে উৎপাদন কমে যায় এবং বাজারমূল্য পাওয়া যায় না। সাধারণত এ মাছি পোকা কুমড়া জাতীয় বিভিন্ন ফসলে যেমন- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি ফসলে বেশি আক্রমণ করে থাকে। ফলের মধ্যে আম, ডুমুর, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই, এভোকেডো, পিচ ইত্যাদি ফলে এ মাছি পোকা দেখা যায়।
এক জরিপে দেখা যায়, কুমড়াজাতীয় ফসল ও আম ফসল উৎপাদনে এ মাছি পোকা বছরে প্রায় ৬৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করে। সাধারণত কৃষকরা ফলের মাছি পোকা দমনের জন্য প্রচুর ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে পরিবেশের ক্ষতির সাথে সাথে কৃষক ও ভোক্তাদের শরীর ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কীটনাশক ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের আক্রমণে ধীরে ধীরে শরীরে নানা রকম ব্যাধি যেমন- ক্যান্সার, কিডনি সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এছাড়া অতিরক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পোকার অনেক প্রজাতি কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা ধীরে ধীরে অর্জন করে।
এ মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য ইদানীং একটি প্রযুক্তি কাজ শুরু করেছে যার নাম আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতি (attract and kill)। এ পদ্ধতিতে কখনোই প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক স্প্রে বা কোনো রাসায়নিক প্রদানের অনুমতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখা হয় না। ফলে ফল ও সবজিগুলো বিষাক্তহীন ও নিরাপদ থাকে। ফল সবজি পাড়ার পর রাসায়নিক পরীক্ষায় শূন্য ভাগ রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। এ পদ্ধতির আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে মাছি পোকা ছাড়া অন্য উপকারী ও অপকারী পোকা মারা যায় না। অর্থাৎ শুধু ক্ষতিকারক মাছি পোকাই মারা যায়। এতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।
এ পদ্ধতির সফলতা আরও বেড়ে যায় যখন পুরুষ ও স্ত্রী পোকার জন্য আলাদা ফর্মুলেশনে আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতিতে গাছের ডালে বা কাণ্ডে কিছুদূর পর পর সামান্য পরিমাণে নিয়ন্ত্রিতভাবে ফেরোমন মিশ্রিত কীটনাশক বা বেইট দিয়ে পোকা দমন করা হয়। এভাবে স্ত্রী ও পুরুষ পোকা আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে তাদের বংশবৃদ্ধি লোপ পায় এবং আক্রমণ কমে যায়। কুমড়া জাতীয় সবজি ফসল যেমন- করলা, লাউ, চালকুমড়া, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা ইত্যাদি মাছি পোকা দমনের জন্য cuetrac প্রযুক্তি এবং zonatrac প্রযুক্তিতে ফলের মাছি পোকা দমন করা হয়। এ প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হচ্ছে-
ক. কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না;
খ. ছোট বা বড় উভয় বাগানেই এটি ব্যবহার করা যায়;
গ. উৎপন্ন পণ্য নিরাপদ ও বিষাক্তহীন হয়;
ঘ. প্রযুক্তিটি এক ফসলে একবার ব্যবহার করলেই হয়;
ঙ. শ্রমিক কম লাগে।
প্রাথমিক মাঠ পরীক্ষায় দেখা যায় যে, আকর্ষণ ও দমন পদ্ধতিতে যে কোনো একটি স্ত্রী বা পুরুষ পোকা দমনের ক্ষেত্রে ৯৭% মাছি পোকা দমন হয়। এবং সম্পূর্ণ ফসলকালীন সময়ে একই অবস্থা বিরাজ করে। আমাদের দেশের দিনাজপুর জেলার বিরল ও বীরগঞ্জ গ্রামের করলা চাষিদের নিয়ে এ পরীক্ষা করে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলা সবজির ক্ষেত্রে বালাইনাশক ব্যবহার না করে এই নবীন প্রযুক্তি cuetrac ব্যবহার করে কৃষকরা সবজির মাছি পোকা প্রায় ৯৭% দমিয়ে রাখতে পেরেছেন। বর্তমানে এ প্রযুক্তির কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য বিএআরআই, ACI Formulation Ltd, EPRC এবং দেশের চাষিদের সাথে একসাথে কাজ করছেন। বিগত মার্চ ২০১৫ মাস বিএআরআইয়ের ড. নূরল আলম, সিএসও করলা ও আম ফসলে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতার পরীক্ষা শুরু করেছেন।
এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাসেল আইপিএমের সুনাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনায় রাসেল আইপিএমের বিজ্ঞানীরা গত ৫ বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় এ নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ফলের মাছি পোকা দমন করে আসছেন। তাদের এ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যুক্তরাজ্য সরকার অনুমোদন করে ২০১১-২০১২ সনে তাদের কুইনস পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্য সরকার এ মাছি পোকা দমন প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ, নেপাল, তানজানিয়া এবং কেনিয়াতে Innovate UK এর মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা করছেন।
আগামীতে বাংলাদেশের চাষিরা এ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কুমড়াজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। এতে করে ইউরোপে এ সবজি রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউরোপের বাংলাদেশীরা তাদের সাধের লাউ, চালকুমড়া, শসা, করলা, পটোল, ইত্যাদি সবজিগুলো নিরাপদ ও বিষমুক্ত অবস্থায় পেতে পারেন।
মো. মোসারফ হোসেন*
* অতিরিক্ত পরিচালক (অব.), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
মরিচ একটি প্রধান মসলা জাতীয় ফসল। কাঁচামরিচ সবজি ও সালাদ হিসেবে এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি ও তরকারিতে ব্যবহৃত হয়। শুকনা মরিচ গুঁড়া করে তরকারি, বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় ও মুখরোচক খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ক্যাপসিসিন নামক পদার্থের কারণে মরিচ ঝাল হয়ে থাকে। মরিচ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সিসহ পুষ্টির সব উপাদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান। কিন্তু মরিচ উৎপাদনে রোগবালাই একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেক বৃদ্ধি পাবে।
১. রোগের নাম : ঢলে পড়া বা গোড়া ও মূল পচা
রোগের বিস্তার : মাটি ও পানির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ
১. এ রোগটি নার্সারিতে হয়ে থাকে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। কম নিষ্কাশনযুক্ত ভিজা মাটিতে এ রোগ হয়ে থাকে।
২. বীজ বপনের পর বীজই পচে যেতে পারে অথবা চারা মাটি থেকে উঠার আগেই মারা যেতে পারে।
৩. বীজ অংকুরোদগমের পরেই কচি চারার গোড়ায় পানিভেজা দাগ পড়ে ও পরে কুঁচকে গিয়ে চারা ঢলে পড়ে ও মারা যায়।
৪. মারাত্মক আকারে আক্রান্ত হলে নার্সারির সব গাছ ২-৪ দিনের মধ্যে মরে যেতে পারে।
রোগের প্রতিকার
১. সুনিষ্কাশিত উঁচু বীজতলা তৈরি করতে হবে।
২. বীজ বপনের ২ সপ্তাহ আগে ফরমালডিহাইড দ্বারা বীজতলা শোধন করতে হবে।
৩. ট্রাইগোডারমা দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
৪. প্রোভেক্স-২০০ অথবা রিডোমিল গোল্ড (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে।
৫. বীজ ৫২০ঈ তাপমাত্রায় গরম পানিতে ৩০ মিনিট রেখে শোধন করে নিয়ে বপন করতে হবে।
৬. কিউপ্রাভিট অথবা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে ্ করতে হবে।
২. রোগের নাম : ফিউজারিয়াম ঢলে পড়া
রোগের লক্ষণ
১. ছত্রাক গাছের নিচের দিকে কাণ্ডে আক্রমণ করে এবং গাঢ় বাদামি ও ডুবা ধরনের ক্যাংকার সৃষ্টি করে।
২. ক্রমে এ ক্যাংকারজনিত দাগ কাণ্ডের গোড়াকে চারদিকে হতে বেষ্টন করে ফেলে।
৩. গাছের অগ্রভাগের পাতা হলুদ হয়ে যায়, পরে সব গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
৪. স্যাঁতসেঁতে মাটিতে কাণ্ডের গোড়া সাদা অথবা নীলাভ ছত্রাক স্পোর দ্বারা আবৃত হয়ে পড়ে।
৫. গাছ লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভাসকুলার বান্ডল বিবর্ণ দেখা যাবে।
৬. রোগের অনুকূল অবস্থায় ১০-১৫ দিনের মধ্যে গাছ সম্পূর্ণরূপে ঢলে পড়ে, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায় ২-৩ মাস সময় লাগতে পারে।
রোগের প্রতিকার
১. একটু উঁচু জমিতে মরিচ চাষ করতে হবে।
২. প্রতি কেজি বীজের জন্য প্রোভেক্স-২০০ অথবা ব্যভিস্টিন ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
৩. সম্ভব হলে ফরমালিন দ্বারা মাটি শোধন করতে হবে।
৪. জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
৫. জমিতে উপযুক্ত পরিমাণে পটাস সার প্রয়োগ করলে রোগ অনেক কম হয়।
৬. নীরোগ বীজতলার চারা লাগাতে হবে।
৭. রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৮. শিকড় গিঁট কৃমি দমন করতে হবে কারণ এটি ছত্রাকের অনুপ্রবেশে সাহায্য করে।
৯. ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে ¯েপ্র করতে হবে।
৩. রোগের নাম : আগা মরা/ক্ষত/ফল পচা
রোগের বিস্তার : বীজ, বিকল্প পোষক এবং গাছের পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। আর্দ্র আবহাওয়া ও অধিক বৃষ্টিপাত এ রোগ বিস্তারে সহায়তা করে।
রোগের লক্ষণ
১. মরিচ গাছের নতুন ডগা, ডাল, ফুলের কুঁড়ি, ফল এ রোগে প্রথম আক্রান্ত হয়।
২. এ রোগের আক্রমণে গাছের আক্রান্ত অংশ যেমন পাতা, কাণ্ড ও ফল ক্রমে ওপর হতে মরতে থাকে এবং গাছ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে।
৩. গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফল ধারণক্ষমতা কমে যায়।
৪. ফলের ওপর গোলাকার কালো বলয় বিশিষ্ট গাঢ় ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ফলকে পচিয়ে দেয়।
৫. আক্রান্ত ফল ঝরে পড়ে।
৬. ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে গাছ দ্রত মরে যায়।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ ও সবল ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. প্রোভেক্স-২০০ বা ব্যভিস্টিন (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
৩. পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. গাছের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও আশপাশের ধুতুরা জাতীয় গাছ একত্র করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
৫. রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ¯েপ্র করতে হবে।
৪. রোগের নাম : অলটারনারিয়া ফল পচা
রোগের বিস্তার : বীজের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার ঘটে থাকে।
রোগের লক্ষণ
১. কেবল মাত্র পরিপক্ব ও পাকা ফলে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
২. প্রথমে ফলের উপরিভাগে বিশেষ করে অগ্রভাগের দিকে বড় আকারের উপবৃত্তাকার থেকে ডিম্বাকৃতি দাগ পড়ে।
৩. দাগগুলোর বহির্ভাগে হলদে ধূসর ও অভ্যন্তর ভাগে বাদামি কালো রঙ ধারণ করে।
৪. দাগগুলো পরে বিস্তৃতি লাভ করে।
৫. আক্রান্ত ফলের বীজ কালো রঙ ধারণ করে।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ ও সবল ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. প্রোভেক্স-২০০ (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে।
৩. গাছের পরিত্যক্ত অংশ ও আগাছা একত্র করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
৪. রোভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
৫. রোগের নাম : চুয়ানিফোরা পাতা পচা
রোগের বিস্তার : উচ্চ তাপমাত্রা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। বায়ু দ্বারা রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ
১. চারা ও বয়স্ক গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতা, ফুল-ফল আক্রান্ত হয়।
২. প্রথমে পাতায় পানি ভেজা দাগ হয়। পাতা দ্রুত পচতে থাকে।
৩. আক্রমণ গাছের আগা থেকে নিচের দিকে নামতে থাকে।
৪. আক্রান্ত গাছের পাতা ও ডাল কালো রঙের হয়ে থাকে।
৫. রোগের প্রকোপ বেশি হলে এবং অনুকূল আবহাওয়ায় ৫-৭ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ গাছটি মারা যায়।
৬. সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করলে আগা ও ডালে ছত্রাকের মাইসেলিয়াম খালি চোখে দেখা যায়।
৭. ফলনের প্রচুর ক্ষতি হয়। ১০০% পর্যন্ত ফলনের ক্ষতি হতে পারে।
রোগের প্রতিকার
১. ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. জমিতে অতিরিক্ত সেচ দেয়া যাবে না।
৩. গাছ আক্রান্ত হওয়া মাত্রই ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
৬. রোগের নাম : সারকোস্পোরা পাতায় দাগ
রোগের বিস্তার
১. রোগটিবীজ বাহিত। অর্থাৎ বীজের মাধ্যমেও ছড়ায়।
২. গাছের পরিত্যক্ত অংশ হতে রোগের জীবাণু বায়ু, পানি প্রভৃতির মাধ্যমে এক জমি হতে অন্য জমি অথবা এক গাছ হতে অন্য গাছে ছড়ায়।
৩. ৬০%-এর বেশি আর্দ্রতা ও ২৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
রোগের লক্ষণ
১. আক্রমণের শুরুতে পাতায় প্রথমে গোলাকার আকারের বাদামি দাগ দেখা যায়।
২. পরবর্তীতে দাগটি ধূসর বা সাদা কেন্দ্র বিশিষ্ট হয় এবং কেন্দ্রের চারিদিকে খয়েরি রঙ ধারণ করে।
৩. অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে পাতার ওপর বড় আকারের দাগ সৃষ্টি হয়।
৪. পরে আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ শুকিয়ে যায় ও দাগের মাঝখানে ছিদ্র হয়ে যায়।
৫. আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সম্পূর্ণ পাতাই ঝলসে যায় ও ঝড়ে পড়ে।
৬. এ প্রকার দাগ ফলেও দেখা যায়।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ ও নিরোগ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের অবশিষ্টাংশ এবং আর্বজনা পুড়ে ফেলতে হবে।
৩. একই জমিতে বার বার মরিচ চাষ না করে অন্য জমিতে চাষ করা।
৪. অতিরিক্ত সেচ পরিহার করা এবং জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
৫. প্রতি কেজি বীজে ২.০-২.৫ গ্রাম ব্যভিস্টিন দিয়ে বীজ শোধ করতে হবে।
৬. আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ব্যভিস্টিন ১ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৭. রোগের নাম : ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতায় দাগ
রোগের বিস্তার : ব্যাকটেরিয়া শীতকালে মাটিতে থাকে। এটি পোকামাকড়, কৃষি যন্ত্রপাতি, শ্রমিক ও বৃষ্টির পানির মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
১. গাছের পাতার নিচে প্রথমে ছোট গোলকার থেকে অসমান পানি ভেজার মতো লেসইন দেখতে পাওয়া যায়।
২. স্পটগুলো ফুলে ওঠে এবং এর কেন্দ্র কালো রঙ ধারণ করে।
৩. পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়।
৪. সবুজ ফল আক্রান্ত হয় এবং এগুলো বাদামি হতে কালো হয়।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ ও রোগ মুক্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. নিড়ানির সময় যেন গাছ ক্ষত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে ফেলতে হবে।
৪. এক লিটার পানির মধ্যে ৩ গ্রাম কপার অক্রিক্লোরাইড (কুপ্রভিট) মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
৫. রোগের প্রাথমিক অবস্থায় এক লিটার পানিতে সানভিট বা কুপ্রভিট ৭ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
৮. রোগের নাম : ব্যাকটেরিয়াজনিত ফল পচা
রোগের বিস্তার : গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, বৃষ্টির ছটা, পোকা ও উদ্ভিদের রোগাক্রান্ত অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
১. কাণ্ডের নিকট থেকে প্রথমে ছোট নরম পচা দাগের সৃষ্টি হয়।
২. ফলে কোনো কারণে পোকা বা পাখির আক্রমণে কোনো ক্ষত সৃষ্টি হলে সেখানে জীবাণুর আক্রমণ হয়।
৩. এ নরম পচা দাগগুলো খুব দ্রুত ফলে আক্রমণ করে।
৪. ফলের ভেতরের অংশ খুব নরম মনে হয়।
৫. আক্রমণের কিছু দিনের মধ্য পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। পরে সম্পূর্ণ ফল পচে যায়।
৬. ফলকে দেখতে পানিতে ভর্তি থলের মতে দেখা যায়।
৭. ফলের ত্বক ফেটে পানি ফলের ভেতর হতে বের হয়ে গেলে ফল শুকিয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ ও রোগ মুক্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. আক্রান্ত লতা-পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
৩. শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
৪. এক লিটার পানির মধ্যে ৩ গ্রাম কপার অক্রিক্লোরাইড (কুপ্রভিট) মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
৫. যেহেতু এটা মরিচ সংগ্রহের পরে এ রোগে বেশি হয়। সেহেতু অতি যত্ন সহকারে বীজ সংগ্রহ করতে হবে যাতে মরিচে কোনো ক্ষতি না থাকে।
৬. পাখির আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য জমিতে মাঝে মাঝে খুঁটি পুতিয়ে তার সাথে কালে রঙের নাইলন (ক্যাসেটের ফিতা) বেঁধে রাখতে হবে। এতে পাখির বিচরণ কম হবে।
৭. প্রাথমিক অবস্থায় ১ লিটার পানির মধ্যে সানভিট (কপার অক্রিক্লোরাইড) ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।
৯. রোগের নাম : পাতা কুঁকড়ানো
রোগের বিস্তার : বাহক পোকা (সাদা মাছি- Bemisia tabaci), থ্রিপস ও পোষক উদ্ভিদের মাধ্যমে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
১. আক্রান্ত গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় এবং স্বাভাবিক পাতার তুলনায় পুরু হয়।
২. পাতাগুলো ছোট গুচ্ছাকৃতির হয়।
৩. গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
৪. গাছের পর্বগুলো কাছাকাছি হয় ও গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে।
৫. গাছে অতিরিক্ত ডালপালা জন্মায় ও ঝোপের মতো হয়।
৬. ফল ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং ফল আকারে ছোট ও কুঁকড়ানো হয়।
রোগের প্রতিকার
১. সুস্থ গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
২. রোগাক্রান্ত চারা কোনো অবস্থাতেই লাগানো যাবে না।
৩. চারা অবস্থায় বীজ তলা মশারির নেট দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
৪. রোগাক্রান্ত গাছ ও আশপাশের পোষক উদ্ভিদ তুলে ধ্বংস করতে হবে।
চারা অবস্থা থেকে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে বাহক পোকা দমনের জন্য স্প্রে করতে হবে।
ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া। মোবাইল : ০১৯১১-৭৬২৯৭৮
ইদানীংকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, হোম ইকনোমিক্স কলেজসহ কিছু স্থানে ছাতরা পোকা বা জায়েন্ট মিলিবাগের ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ছাতরা পোকা যা ইংরেজিতে গবধষু ইঁম নামে পরিচিত, আকৃতিতে অনেক বড় বলে এদের Giant mealy bug বলে অভিহিত করা হয়। Giant mealy bug এর বৈজ্ঞানিক নাম Labioproctus polei (Green), এরা Hemiptera বর্গের Cocciedae পরিবারভুক্ত। এ পোকাটি বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশে এ পোকার উপস্থিতি এবং আক্রমণের বিষয়ে ড. এম জহুরুল আলম তার Insect and mite pests of fruits and fruit trees in Bangladesh (East Pakistan) and their control শীর্ষক বইতে ৫২ বছর আগে লিপিবদ্ধ করেছেন (প্রথম প্রকাশ ১৯৬২, পুনঃপ্রকাশ ১৯৭৪)। জায়েন্ট মিলিবাগের বিস্তৃতি কেবল বাংলাদেশে নয়, এদের ভারতের সুদূর পাঞ্জাব থেকে আসাম অঞ্চল পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ পোকা কাঁঠাল, কড়ই, আম, পেয়ারা, বট, লেবু ও পেঁপেসহ ৬২ প্রজাতির গাছে আক্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশে এদের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল, কড়ই ও আমগাছে পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত এ পোকার আক্রমণ মাত্রা ব্যাপক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় না আবার প্রতি বছর দেখাও যায় না। তবে অনুকূল আবহাওয়া (শুকনা, উষ্ণ এবং বেশ কিছু দিন বৃষ্টিপাতবিহীন আবহাওয়া) পেলে এদের ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ হতে পারে। ২০০৭ সনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ২০১০-১১ সনে বাঁশেরহাট, দিনাজপুর এবং ২০১৩-১৪ সনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে এদের ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগ বিভিন্ন স্থানে এ পোকার ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ পরিলক্ষিত হওয়া মাত্র পোকাগুলো শনাক্তকরণসহ প্রয়োজনীয় দমন ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করাসহ করণীয় বিষয়াদির ওপর ব্যবস্থা নিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বর্তমানে চলমানও রয়েছে।
জায়েন্ট মিলিবাগের জীবন চক্রের অপ্রাপ্তবয়স্ক (নিম্ফ দশা) অবস্থায় স্ত্রী পোকা ক্ষতি করে থাকে। স্ত্রী নিম্ফ দেখতে ডিম্বাকার, চেপ্টা এবং এদের শরীর সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে। পুরুষ পোকা একজোড়া কালো পাখাযুক্ত। এ পোকার জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এরা কেবলমাত্র ডিম অবস্থায় অধিকসময় (৫-৭ মাস) পর্যন্ত কাটায় এবং বাকি সময় (সাধারণত নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত) সক্রিয় থাকে (নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায়)।
স্ত্রী ছাতরা পোকা
জীবন চক্র
এদের জীবন চক্রে ৩টি ধাপ দেখা যায়। ধাপগুলো হলো ডিম, নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ। পুরুষ পোকা একজোড়া পাখাযুক্ত হলেও স্ত্রী পোকা পাখাবিহীন। স্ত্রী পোকা ১৫ মিমি. লম্বা, এদের শরীর নরম, রসালো ও চেপ্টা প্রকৃতির। এদের রঙ কিছুটা লালচে হলেও বহিরাবরণ সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকায় সাদা মনে হয়। মার্চ-মে মাসে মিলনের পর স্ত্রী পোকা গাছ থেকে নেমে আসে এবং এপ্রিল-মে মাসে মাটির ৫-১৫ সেমি. গভীরতায় গুচ্ছাকারে ৩০০-৫০০টি ডিম পাড়ে। রেশমি থলেতে (silken purses) ডিমগুলো আবৃত থাকে। ডিমগুলো সাধারণত ১.০ মিমি লম্বা এবং ০.৭ মিমি চওড়া হয়ে থাকে। সদ্য পাড়া ডিম দেখতে ডিম্বাকার ও উজ্জ্বল গোলাপি রঙের, সময়ের সাথে সাথে তা ধূসর বর্ণ ধারণ করে।
ডিম পাড়ার বিশেষত্ব হলো এরা ১-২ সপ্তাহ যাবত বিভিন্ন ধাপে গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে অতঃপর স্ত্রী পোকা মারা যায় এবং মৃত পোকার শরীরে ডিম লেগে থাকতে দেখা যায়। এরা জুন মাস পর্যন্ত ডিম দেয় এবং নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয়। সদ্য ফোটা নিম্ফের ৭০-৮০% গাছ বেয়ে উপরে উঠে এবং বাকি ২০-৩০% গাছের নিচে ইতঃস্তত ঘোরাফেরা করে এবং ঘাস বা বাগানের ছোট ছোট গাছে অবস্থান করে। কাঁঠাল বা আমের ফুল ফোটা শুরু হওয়ার পর হতে (সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে) এরা গাছ বেয়ে উপরে উঠে যায়। এ সময় এরা দলবদ্ধভাবে গাছে উঠে পরবর্তীকালে মুকুল ও কচি ডগার রস খেয়ে ৩টি নিম্ফ দশা সম্পন্ন করে। স্ত্রী পোকা সাধারণত ১৫-৩৫ দিনে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
ক্ষতির প্রকৃতি ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
এ পোকা আক্রান্ত গাছের বাড়ন্ত ডগা এবং মুকুল থেকে রস চুষে খায় এতে কচি ডগা ও মুকুল শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারন বিঘœ সৃষ্টি করে। ফল ধারণ করলেও খুবই দুর্বল হয়, সামান্য বাতাসেই কচি ফল ঝড়ে পড়ে। সাধারণত এরা দলবদ্ধভাবে থাকে এবং ডগা ও মুকুলের বোঁটায় এমনভাবে গাদাগাদি করে থাকে যে আক্রান্ত ডগাটিই আর দেখতে পাওয়া যায় না। আক্রমণ মারাত্মক হলে এদের নিঃসৃত মধুরসে শু্যঁটিমোল্ড রোগ হয় ফলে পাতা কালো হয়ে যায় বলে ঠিকমতো খাদ্য তৈরি হয় না এবং আক্রান্ত গাছ অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির হয় এবং গাছে ফলন অত্যন্ত কমে যায়।
এ ধরনের ছাতরা পোকার অপ্রাপ্ত বয়স্ক নিম্ফ বেশ কয়েকটি পরজীবী পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এদের মধ্যেPhygadeuon sp. (Ichneuminidae), Getonides perspicax Knal Ges Rodolia fumida এর কীড়া অন্যতম। পরজীবী পোকার ব্যাপক আক্রমণের ফলে প্রতি বছর এর আক্রমণের হার কমবেশি হতে দেখা যায়। এমনকি এক বছর এর ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হলেও পরবর্তী বছর কোনো ধরনের আক্রমণ নাও হতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১. বাগানে জন্মানো আগাছা ও অন্যান্য পোষক উদ্ভিদ তুলে বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. গ্রীষ্মকালে (বিশেষত সেপ্টেম্বর-অক্টেবর মাসে) বাগান ভালো করে চাষ দিতে হবে বা পূর্ববর্তী বছরে আক্রান্ত গাছসমূহের গোড়ার মাটি কোদাল দিয়ে আলগা ও এপিঠ-ওপিঠ করে দিতে হবে যাতে মাটির নিচে থাকা ডিম উপরে উঠে আসে এবং পাখি ও অন্যান্য শিকারী পোকার কাছে তা উন্মুক্ত হয়, তাছাড়া রোদে পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
৩. যেহেতু নিম্ফগুলো গাছ বেয়ে ওপরে উঠে তাই নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হতেই গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ১ মিটার উঁচুতে ৮-১০ ইঞ্চি চওড়া প্লাস্টিকের পিচ্ছিল ব্যান্ড গাছের চতুর্দিকে আবৃত করে দিলে এরা বার বার ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করে পরিশ্রান্ত হয়ে মারা যায়। অনেক সময় প্লাস্টিকের পিচ্ছিল ব্যান্ডের নিচের অংশে নিম্ফগুলো জমা হয়। এ অবস্থায় এদের সহজেই পিটিয়ে বা একসাথে করে আগুনে পুড়িয়ে মারা সম্ভব অথবা জমাকৃত পোকার উপর কীটনাশক ¯েপ্র করে দমন করা যায়। এসময় নিম্ফগুলোকে গাছে উঠা হতে নিবৃত করতে পারলে এ পোকার আক্রমণ পুরোপুরিভাবে দমন করা সম্ভব।
৪. যদি কোনো কারণে নিম্ফগুলো গাছ বেয়ে উপরে উঠে যায় তবে শুধুমাত্র গাছের আক্রান্ত অংশে (Spot application) সংস্পর্শ ও পাকস্থলী (Contact and stomach) কীটনাশক বিধি মোতাবেক প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তবে প্রাথমিকভাবে অল্প কিছু পরিমাণ নিম্ফ গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেলে কেবলমাত্র গুঁড়া সাবান মিশ্রিত পানি (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে) স্প্রে করে এ পোকার আক্রমণ রোধ করা সম্ভব। তবে ব্যাপকভাবে আক্রমণের ক্ষেত্রে কীটনাশক প্রয়োগের বিকল্প নেই। যেহেতু এ পোকাটির বহিরাবরণ ওয়াক্সি পাউডার জাতীয় পদার্থ দিয়ে সুরক্ষিত থাকে সেহেতু পরীক্ষিত কীটনাশক ছাড়া এটি দমন করা দুরূহ। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ক্লোরপাইরিফস (ডারসবান ২০ ইসি বা এ জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি. হারে) এবং তার ৩-৪ দিন পর কার্বারাইল (সেভিন ৮৫ এসপি বা এ জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) আক্রান্ত অংশে ¯েপ্র করতে হবে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার এভাবে স্প্রে করলে এ পোকা সম্পূর্ণভাবে দমন করা সম্ভব।
ছাতরা পোকার ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণের ফলে সৃষ্ট অন্যান্য অসুবিধাগুলো
যেহেতু এ পোকাটি লোকালয়ে অবস্থিত বিভিন্ন কাঁঠাল, কড়ই বা আমগাছে আক্রমণ করে থাকে সেহেতু এদের ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণের ফলে জনমনে অনেক সময় ভীতির সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত যখন সদ্য ফোটা নিম্ফ গাছ বেয়ে উপরে উঠে অথবা ঘাস বা বাগানের ছোট ছোট গাছে ইতঃস্তত ঘুরাফেরা বা অবস্থান করে এবং পরে এপ্রিল-মে মাসে স্ত্রী পোকাগুলো দলবদ্ধভাবে গাছ থেকে মাটিতে নেমে আসে তখন এরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে স্ত্রী পোকাগুলো ডিম পাড়ার জন্য অধির থাকে বলে উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে এরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এক্ষেত্রে জনমনে ভীতির সঞ্চার হওয়ার কোনো কারণ নেই, কারণ এ পোকাটি অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। মানুষের শরীরে ক্ষতিসাধিত হয় এ রকম কোনো উপাদান এ পোকাটির মধ্যে নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্ত্রী পোকাগুলো যেহেতু উড়তে পারে না সেহেতু এদের ঝাঁটা বা অন্য কিছুর সাহায্যে একসাথে করে পুড়িয়ে ফেলা বা একটু গভীর (কমপক্ষে এক-দেড় ফুট) গর্ত করে পুঁতে ফেলা উচিত। যেসব স্থানে এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় সে স্থানগুলোতে পরবর্তী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা দরকার এবং সদ্য ফোটা নিম্ফ গাছ বেয়ে উপরে উঠা শুরু করা মাত্রই উপরে বর্ণিত দমন ব্যবস্থাপনাগুলো প্রয়োগ করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার প্রথম হতে সাবধানতা অবলম্বন করলে এপোকা দমন করা মোটেই কঠিন নয়। নিম্ফ গাছ বেয়ে উপরে উঠা শুরু করা মাত্রই প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেয়া বা যোগাযোগ করা একান্তভাবে প্রয়োজনীয় (এক্ষেত্রে কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, টেলিফোন নং: ৯২৫৬৪০৪, ৯২৫৭৪০০, মোবাইল: ০১৭১১ ৯০৭৮৮৬ বা উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, টেলিফোন নং ৯১৩১২৯৫ এ যোগাযোগ করা যেতে পারে)।
ড. সৈয়দ নূরুল আলম*
* মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাকৃগই, গাজীপুর
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষত আমিষের চাহিদা মেটাতে মৎস্য সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমকালীন বিশ্ব প্রায় সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ও চাহিদার কারণে সবক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। নতুন প্রযুক্তির বিকাশ অনেক প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি দিয়েছে কিন্তু এসব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের অভাবে বিকাশশীল দেশগুলোর মধ্যে আমরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। এ দেশে আগের তুলনায় মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পেলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেশের সব জলাভূমিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা গেলে মৎস্য সম্পদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সারা বিশ্বের উৎপাদন কৌশল এখন বাণিজ্যভিত্তিক। কম শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জন এর মূল লক্ষ্য। মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই। বিশ্বের সব দেশে এখন আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নত জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। গড়ে উঠেছে উন্নত মৎস্য খামার।
কৃত্রিম প্রজনন মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ব্যাপক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের মৎস্য চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রজননের মাধ্যমে সরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে। পুষ্টিহীনতা দূর করতে বর্তমানে সারা দেশে যে পরিমাণ মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদিত হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি জনগণকে উদ্যোগী হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে আরও বেশি করে মৎস্য খামার যা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে। এমনি একটি প্রযুক্তির নাম ‘পতিত পুকুরে মৎস্য চাষ’ যা আমাদের দারিদ্র্যমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রযুক্তি যেমন সহজ তেমনি দরিদ্র জনগণের জন্য উপযোগী। এ দেশের বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবী এবং গ্রামে বাস করে। মৎস্য চাষ এসব গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক আয় রোজগারের একটি অংশ। প্রতি বাড়ির আনাচে-কানাচে পতিত পুকুরে মৎস্য চাষ করা যায়। মৎস্য চাষে যে মনমানসিকতা প্রয়োজন এ দেশের মানুষের তা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু এদের পরিকল্পিত উপায়ে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধ করা।
মৎস্য চাষ প্রযুক্তি অত্যন্ত সহজ। এর সাহায্যে আমাদের দেশের শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোকজন স্বাবলম্বী হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মৎস্য চাষে যে মনমানসিকতা প্রয়োজন এ দেশের মানুষের তা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু এদের পরিকল্পিত উপায়ে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধ করা।
মৎস্য চাষ প্রযুক্তি অত্যন্ত সহজ। এর সাহায্যে আমাদের দেশের শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোকজন স্বাবলম্বী হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মৎস্য চাষের জন্য প্রয়োজন উন্নত জাতের বা রোগমুক্ত পোনা, যা দ্রুত বাড়তে পারে। কিছু নিয়ম অনুসরণের মাধ্যমে মাছের পোনা কয়েক মাসের মধ্যে দ্রুত বাড়তে পারে।
জমিতে আগাছা থাকলে যেমন ফসল ভালো হয় না তেমনি পুকুরে ছোট ও রাক্ষুসে মাছ থাকলে ফলন ভালো হয় না। রাক্ষুসে মাছ হলো শোল, গজার, টাকি প্রভৃতি। এরা মাছের বাচ্চা খেয়ে ফেলে তাই মাছ চাষের শুরুতে পুকুরের সব পানি শুকিয়ে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করতে হবে। তলায় বেশি কাদা থাকলে তা তুলে মেরামত করা যেতে পারে। বড় গাছের ছায়া পুকুরে পড়লে ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। পুকুরের গভীরতা এমন হতে হবে যাতে শুকনো মৌসুমে অন্তত সাড়ে তিন হাত পানি থাকে। প্রথম অবস্থায় পুকুরে চুন দিতে হবে। প্রথমে একটি পাত্রে চুন ফুটিয়ে ঠা-া হয়ে গেলে পানি মিশ্রিত চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুনের মাত্রা প্রতি শতাংশে এক কেজি, পুকুরে চুন দেয়ার পাঁচ দিন পর সার দিতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক উভয় ধরনের সার পুকুরে দেয়া দরকার। জৈবসার হিসেবে গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা দেয়া যায়। প্রতি শতাংশে এসব সারের মাত্রা ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ৬৫ গ্রাম এবং এমপি ২০ গ্রাম। জৈব ও রাসায়নিক এ দুই ধরনের সার একসাথে একটি পাত্রে পানির মধ্যে ভালোভাবে গুলে নিতে হবে। তারপর এ সার সব পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর তৈরি হওয়ার ১০-১৫ দিন পর ১০-১৫ সেন্টিমিটার সাইজের সুস্থ ও সবল পোনা ছাড়তে হবে। পুকুরের বিভিন্ন গভীরতায় ভিন্ন ভিন্ন গভীরতায় খাবার খায়। এজন্য বেশি উৎপাদন পেতে হলে পুকুরে একসঙ্গে ৭-৮ ধরনের মাছ ছাড়তে হয়। বিভিন্ন ধরনের পোনার আকার সমান হলে ভালো হয়। শুধু প্রাকৃতিক খাবারে মাছের ফলন ভালো হয় না। এজন্য পোনা ছাড়ার পর দিন থেকে খাবার দিতে হবে। মাছের মোট ওজনের শতকরা ২ ভাগ হারে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে। যেমন পুকুরে বিভিন্ন মাছের মোট ওজন যদি ১০০ কেজি হয় তবে প্রতিদিন মাছের খাবার দিতে হবে ২ কেজি। যে পরিমাণ খাবার দিতে হবে তার অর্ধেক হবে কুঁড়া এবং বাকি অর্ধেক হবে সরিষার খৈল ও চালের কুঁড়া যা একটি হাঁড়িতে এক রাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। পর দিন সকালে খৈল ও কুঁড়া দিয়ে গোল বল বানাতে হবে। খাবার দেয়ার আগে পুকুরের চার কোণায় চারটি হাঁড়ি বসিয়ে দিতে হবে। এ হাঁড়িগুলোর মুখ বড় হওয়া দরকার। হাঁড়িগুলো পানিতে এক মিটার (২ হাত) নিচে রাখলে ভালো হয়।
বর্ষা পরবর্তী মাছ চাষ : প্রতি বছরের মতো এবার বর্ষা মৌসুমে নদ-নদীর উপচেপড়া এবং অতি বৃষ্টিতে জমা পানিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠ-ঘাট জলাবদ্ধতার রূপ নিয়েছে। বর্ষা চলে যাওয়ার পরে এসব স্থানে ৪/৫ মাস কিছু কিছু জায়গায় প্রায় বছর ধরে পানিবদ্ধ থাকে। তাই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে এ জলার উপযুক্ত ব্যবহার তথা মাছ চাষ করেও আর্থিক সঙ্গতি লাভ করা সম্ভব। ইতঃপূর্বে এ জাতীয় বিল থেকে রুই জাতীয় মাছ ছাড়াও চিতল, বোয়াল, ফলি, পাবদা, রয়না, বাঁশপাতা, মলা, ঢেলা ইত্যাদি মাছ এবং প্রচুর পরিমাণে মাগুর, কৈ, শিংসহ প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ উৎপন্ন হলেও বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব এবং কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য তা শূন্য হয়ে পড়েছে। যে কারণে সুষ্ঠুভাবে মাছ চাষ করে বিশাল এ পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ২২ ভাগ উৎপাদন সম্ভব এবং প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
ব্যবস্থাপনা : বিলে সাধারণত স্থানীয় মালিকানা এবং সরকারের খাসজমি বিদ্যমান থাকে। সে কারণে সরকার স্থানীয় বেকার যুবক ও দরিদ্র ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দল গঠন করে এবং তাদের প্রশিক্ষণ আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে মাছ চাষ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
যেভাবে মাছ চাষ করতে হবে : বন্যাকবলিত এলাকায় মাছ চাষের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যায়। যেমন-
১. পেন তৈরির মাধ্যমে : বড় বড় বিলের কিছু এলাকা নিয়ে বাঁশ, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি দিয়ে মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল সৃষ্টি করে তার চারপাশে বেড়া বা জাল দিয়ে পেন তৈরি করা যায়। এরপর রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ সরিয়ে ৫/৮ ইঞ্চি পরিমাপের পোনা প্রতি শতাংশে ২২০টি (রুই ও রুইজাতীয়) ছাড়া যায়। এ পদ্ধতির মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনার দেহের মোট ওজনের ৩ ভাগ হারে খৈল, ভুষি, কুঁড়া প্রভৃতির সমন্বয়ে খাবার প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে।
২. খাঁচা তৈরির মাধ্যমে : প্লাবিত জলাশয়ের গভীর স্থানে খাঁচা তৈরি করে মাছ উৎপাদন করা যায় তবে এ পদ্ধতিতে তেলাপিয়া বা নাইলোটিকার চাষ করলে কম খরচে অধিক উৎপাদন আশা করা যায়।
৩. কাঠা বা কমর তৈরির মাধ্যমে : কাঠা বা কমর তৈরির মাধ্যমে গাছপালার ডাল দিয়ে মাছের আবাসস্থল তৈরি করে দিতে হয়। পশুর ভুঁড়ি এবং তার বর্জ্য অংশ দিয়ে কাঠা দিলে মাছগুলো আশ্রয় ও খাদ্যের আশায় এখানে একত্র হয়। এছাড়া গাছপালার ঝাঁক থেকে সৃষ্ট শ্যাওলা খেয়ে মাছ বড় হতে থাকে। প্রতি তিন মাস পর পর ঝাঁক তুলে বড় মাছগুলো বাজারজাত করলে আর্থিক লাভ হয় বেশি।
৪. ধানক্ষেতে মাছ চাষ : অপেক্ষাকৃত নিচু জমির পাড় দিয়ে জমিতে পানি ঢোকানোর পর পাড় মেরামত করে ধানের সাথে বা মেয়াদকালীন সময়ের জন্য ধানি জমিতে মাছ চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি শতাংশ জলাশয়ের জন্য ৩০টি সরপুঁটি, ২০টি কমন কার্প হিসেবে পোনা ছাড়তে হয়। মাছের মল সার হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় এ জমিতে ধানের ফলন বেশি হয়।
মাছ আহরণ কাল : উপরোক্ত পন্থা অবলম্বন করার পর মাছ চাষে পোনা মজুদ হতে ৩-৪ মাস অতিবাহিত হলে বড় মাছগুলো তুলে নেয়া যায়। সাধারণত ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের অর্থাৎ স্থানীয় ভাষায় হোটেল সাইজ মাছ তুলে দিয়ে নতুন করে ২০ ভাগ অধিক হারে পোনা ছাড়তে হয়। এ পদ্ধতিতে আর্থিক লাভ অপেক্ষাকৃত বেশি হয়।
আফতাব চৌধুরী*
* সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ব্লক-এ, শাহজালাল উপশহর, সিলেট
যখন কোনো গাভী সঠিক সময়ে (১৮-২১ দিন) গরম হয় ও কোনো প্রকার অসুস্থতার লক্ষণ থাকে না এবং কমপক্ষে ২ বার প্রজনন করানোর পরেও গর্ভধারণে ব্যর্থ হয় তখন তাকে বার বার গরম হওয়া গাভী বলে।
৩ বার প্রজনন করানোর পরেও গর্ভধারণে ব্যর্থ হওয়ার হার প্রায় ১০.০১%। এতে করে বাছুর প্রদানের সংখ্যা কমে যায়। বার বার প্রজনন করানো ও চিকিৎসা করানোর খরচ বেড়ে যায়। অনেক সময় উন্নত মানের গাভী অকালে বাতিল করতে হয়, ফলে খামারি মানসিক চাপে পড়েন ও অর্থনৈতিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্মে চারটি প্রধান সমস্যার মধ্যে বার বার গরম হওয়া একটি অন্যতম সমস্যা।
কারণগুলো
বাস্তবপক্ষে কিছু ক্ষেত্রে ভুল সময়ে প্রজনন করানোর ফলে হয়ে থাকে। কিছু গাভীতে প্রজনন তন্ত্রের বার্সা ও ডিম্বনালির জটিলতা ও জরায়ু সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে।
কাছাকাছি সময়ে গরম হওয়া
এ ক্ষেত্রে গাভী প্রজনন করানোর ১৭-২৪ দিনের মধ্যেই আবার গরম হয়। কারণ-১. লুটিয়াল গ্রন্থির কার্যকারিতা তাড়াতাড়ি বন্ধ হলে বা স্বাভাবিক বা নিয়মিত ঋতুচক্রের মতো করপাছ লুটিয়াম স্বল্পস্থায়ী হলে এমন হতে পারে। ২. যদি ডিম দেরিতে নিঃসরিত হয় এবং প্রজননে বীজের মান ভালো না হয়। ৩. পূর্বেই ভ্রƒণ মারা গেলে বা দুর্বল/নিম্নমানের ভ্রƒণ সৃষ্টি হলে। ৪. জরায়ুর পরিবেশ ভালো না থাকলে। ৫. Pricocious ৬. Luteolyse হলে।
জরায়ু সংক্রমণ সাধারণত ষাঁড় দ্বারা মিলনের সময়, অস্বাস্থ্যকর কৃত্রিম প্রজনন ও প্রসবের সময় ও পরে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকে।
এছাড়াও কিছু বিষয় বার বার গরম হওয়াকে প্রভাবিত করে। যেমন-ওলান প্রদাহ রোগ বার বার গরম হওয়ার হার বৃদ্ধি করে ও উৎপাদন কমিয়ে দেয়। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। বাচ্চা প্রদানের সংখ্যার ওপর। জটিল প্রসবের ঘটনা। প্রথম প্রজনন করানোর আগে চিকিৎসা দেয়া প্রভৃতি।
চিকিৎসা
১. প্রাথমিকভাবে গাভীর গরম হওয়ার সময় লিপিবদ্ধ করে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে গাভীটি কাছাকাছি সময়ে গরম হচ্ছে অথবা দেরিতে গরম হচ্ছে।
২. ৩ বার প্রজনন করানোর পরও গর্ভধারণ না করলে আবার প্রজনন করানোর আগে ভালোভাবে ভেটেরিনারি ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে।
৩. প্রজনন করানোর সময় গাভীকে ১০০-৫০০/স এহজয ১/স প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. জরায়ুতে গরম হওয়ার সময় ৮ম ঘণ্টা ও ৪তম ঘণ্টায় Penicillin (40 lac) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রতিরোধ
১. সঠিক সময়ে প্রজনন করতে হবে। গরম হওয়ার ১২ ঘণ্টা পরে ও ১৮ ঘণ্টার মধ্যে।
২. গাভী গরম হলে দুধের Progesteron level খুব কমে যায়। Progesteron এর মাত্রা নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায়।
৩. প্রজননকারীকে সতর্কতার সাথে গর্ভে বাচ্চা আছে কিনা তা দেখে নিয়ে তারপর প্রজনন করতে হবে।
৪. প্রজনন করানোর সময় গাভীকে কোনো প্রকার ধকল দেয়া যাবে না যেমন- অনেক দূর হেঁটে নিয়ে যাওয়া, খাদ্য পরিবর্তন করা ইত্যাদি।
৫. পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য দিতে হবে।
৬. ভালো বীজ ও দক্ষ প্রজননকারী দ্বারা প্রজনন করাতে হবে।
৭. প্রয়োজনে ২ বার প্রজনন করানো যেতে পারে।
৮. প্রজনন করানোর পর ৩ সেকেন্ড গাভীর ক্লাইটোরিসে ম্যাসেজ দিতে হবে।
৯. প্রজনন করানোর পর গাভীকে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখতে হবে।
ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার*
* উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, কাউনিয়া, রংপুর
পেঁপের কথা
কৃষিবিদ আহমেদ হাছিব মোল্লা*
প্রতিদিন একটি করে পেঁপে খাও
বাড়ির বাইরে বদ্দি তাড়াও,
কারিকা পাপায়া পেঁপের নাম
পুষ্টিগুণে পেঁপে ভালো অনেক তার দাম।
পেঁপে ফলের ক্যারোটিন আর সি ভিটামিন
রোগ নিরাময় পেঁপে খেলে প্রতিদিন,
চমৎকার পেঁপে ফল ঔষধিগুণে
উপকার মেলে কাঁচা পেঁপের পেপেইনে।
পেঁপে ফলে নিরাময় ডিপথেরিয়া ত্বকে যা
আরও সারে আলসার এবং একজিমা,
কিডনি ক্যান্সার অজীর্ণ রোগ
পেঁপে খেয়ে কমাও ভোগ।
অনেক রোগে পেঁপের আঠা দরকারি
প্লীহা যকৃতি রোগে পেঁপে বেশ উপকারী,
পেঁপের বিচি ধনন্তরী সব কবিরাজ কয়
বিচির গুঁড়োয় ক্রিমি মরে নাহি কোন ভয়।
বাড়ির পানে পেঁপে গাছ যদি দুটি থাকে
কাঁচা পাকা পেড়ে খেলে শরীর ভালো রাখে,
পাকা পাকা পেঁপে ফল এ ভিটামিনের রাজা
শিশুর জন্য দারুণ ভালো নিত্য খাবে তাজা।
পেঁপের চারা জোগাড় কর নার্সারিতে যেয়ে
শরীর সুস্থ টনটনেভাব পাকা পেঁপে খেয়ে,
পেঁপে ফল অনেক বল জেনে রাখ ভাই
আজই কিন্তু পাঁচটি চারা রোপণ কর তাই।
মৌসুম যখন শান্ত
মো. জুন্নুন আলী প্রামানিক**
মৌসুম যখন সহজ সরল শান্ত মেজাজে থাকে,
আকাশে বাতাসে জমিনে তখন মিষ্টি পাখিরা ডাকে।
বিচিত্র ফসলে মাঠের বুকটি শক্তি সান্তনা পায়,
কৃষাণ কৃষাণী সার্থক শ্রমের প্রাপ্তি দু’হাতে লয়,
সময় মতন বৃষ্টির জোগানে জমি সজাগ হয়,
সমস্যা থাকে না চাহিদা পূরণে সব ফসলে জয়।
শীতল বাতাস সোহাগে উড়িয়ে দিকবেদিক ছোটে,
সবুজ হাসির শখের আবাদ পূর্ণ সকল মাঠে।
বোরোর বিচিত্র কোমল চারারা দৃষ্টি ফুটিয়ে হাসে,
যতেœর যথেষ্ট প্রয়োগে কৃষক লিপ্ত ফসল চাষে।
সুযোগ সুবিধা এগিয়ে চলার পথ ধরিয়ে আসে,
ফলন অধিক নিয়ম মানায় কৃষি বারোটি মাসে।
চাঁদনী আকাশ রাতের বেলায় জ্বলে আলোর মতো,
স্বচ্ছতা প্রকাশে সুনীল শূন্যের রূপ লহরী শত।
তারকাগুলোর ছড়ানো আলোক রশ্মি মাটিতে পড়ে,
অনন্ত অসীম সীমানা তখন দৃষ্টি সীমার ধারে।
স্বাগত জানার ঘাটতি থাকে না চাষি নিমগ্ন ক্ষেতে,
ঔষধ সারের অভাব হয় না সুষ্ঠু উপায়ে দিতে।
অনেক প্রকার সবজি জমিতে নিজ গতিতে বাড়ে,
দায়িত্বে বিশুদ্ধ রাখলে সেসব পুষ্টি জোগায় জোরে।
স্নেহের বাতাস পানির আদরে নিত্য চলার পালা,
উঠানে উঠানে ফসল আসর শস্য এখন মেলা।
বন্যার কবলে খরার প্রকোপে বাধা বিপত্তি হলে,
উপায় পাওয়ার অনেক সুযোগ আছে অফিস গেলে।
সহায় জোগাড় মৌসুমি বায়ুর সেবা যখন ভালো,
উন্নত জাতের ফসল তখন ছড়ে সোনালি আলো।
আমি কৃষকের সন্তান
এস এম মোশরাফুজ্জামান মুকুল***
আমি কৃষকের সন্তান-
এ কথা বলতে নেই এতটুকু অভিমান।
সবুজ ঘেরা বাংলাদেশের
কৃষিই হলো প্রাণ।
আমি কৃষকের সন্তান।
আমি গ্রাম বাংলাকে সাজাতে চাই -
সবুজ ঘেরা স্বপ্ন দিয়ে,
ফুল ও ফসলের হাসি দিয়ে,
যে হাসিতে হাসবে আমার মা
যে হাসিতে হাসবে আমার মাতৃভূমি।
আর আমি সভ্যতার শেকড় খুঁজতে গিয়ে
থেকে গিয়েছি কৃষিতে।
আমি জীবিকার প্রয়োজনে
নিজেকে সমর্পণ করেছি মাটির কাছে।
আমি কৃষকের সন্তান -
একথা বলতে নেই এতটুকুও অভিমান।
আমার বাংলার মাঠে বসে
রকমারী সোনালি ধানের মেলা,
খাল বিল নদী জলাশয়ে
রূপালি মাছের খেলা।
কাস্তে হাতে মাথাল মাথায় গামছা কাঁধে
বাঁশের বাঁশিতে বেলা শেষে তুলি সুর
এ যে কি আনন্দ লিখি ছন্দ,
মন হয়ে যায় ভরপুর।
* অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক, ডিএই, শাহিনা মনজিল, বাড়ি নং-৪০, রোড নং-৭, মুজগুন্নী আ/এ, বয়রা, খালিশপুর, খুলনা।
** গ্রাম-বিদ্যাবাগিশ, ডাকঘর ও উপজেলা-ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম। ***রেডিও সুন্দরবন ৯৮.৮, কয়রা, খুলনা।
মো. রফিকুল ইসলাম। নালিতাবাড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি। গ্রাম-শিমুলতলা, ইউনিয়ন- বাঘবেড়। অভাব-অনটনে সংসারের ২৫ বছর বয়সী এক যুবক। সামান্য লেখাপড়া করার পর আর সুযোগ হয়নি অগ্রসর হওয়ার। জীবন যুদ্ধে নামতে হয় এ বয়সেই। চুড়ি, ফিতা, আলতা, সাবান, তেলের গাট্টি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। অর্থাৎ ফেরিওয়ালা। রফিক ফেরিওয়ালা। কিন্তু মন ভরে না রফিকের। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সবই তার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। সবই নীরবে সয়ে যেতে হয়। সংসারের খরচও মিটে না। জমানো টাকা দিয়ে ধানের ব্যবসা করে কিছু লাভ হয়। লাভের টাকা দিয়ে জমি বন্ধক নিয়ে তাতে ধানের আবাদ করেন। এভাবে কিছু কিছু করে সঞ্চয় করে কিছু জমি ক্রয় করেন রফিক। পরের বছর নালিতাবাড়ি ব্র্যাক সমিতির সদস্য হন। ভুট্টা চাষ করবেন-এ শর্তে ছয় হাজার টাকা ঋণ নেন। এ অঞ্চলে তখন ধান বা সবজি ছাড়া অন্য কোনো ফসল আবাদের কথা কেউ ভাবতেই পারত না। ব্র্যাক সমিতির দেয়া ৪ কেজি ভুট্টা বীজ দিয়ে ৫০ শতাংশ জমিতে ভুট্টা আবাদ করেন রফিক। পাশাপাশি ফেরিওয়ালাগিরিও চলে। ৫০-৬০ মণ ভুট্টা হয়। এ ভুট্টার কিছু অংশ বিক্রি করেন, কিছু খই (পপ কর্ন) বানিয়ে গ্রামেগঞ্জে বিক্রি করেন। বাকিটা খাবারের জন্য রেখে দেন। সব মিলিয়ে সে বছর তিনি ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। এবার তিনি আরও কিছু জমি কিনেন। ভুট্টা চাষে তার এ সফলতার কথা কৃষি বিভাগের নজরে আসে।
১৯৯৭ সনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে নালিতাবাড়ির ভোগাই নদীর ওপর রাবার ড্যাম নির্মিত হয়। এর আওতায় নালিতাবাড়ি উপজেলা কৃষি অফিস রফিকুল ইসলামকে পাঁচ একর জমিতে ভুট্টা ফসলের একটি ব্লক প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করতে দেয়। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রদর্শনী প্লট করার জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশকও সে সাথে দেয়া হয়। সুতরাং রফিকুল ইসলামের ভুট্টা আবাদে কোনো আর্থিক সমস্যা হয় না। নতুন কিছু করার তার সেই স্বপ্নটা এবার ডানা মেলতে শুরু করে। পুরোদমে ভুট্টা চাষে মন দেন রফিক। ফলন হয় বাম্পার। প্রায় ৬০০ মণ ভুট্টা ওঠে।
রফিক বলেন, ‘আমার ঘরে তো অত জায়গা নাই। এত ভুট্টা কোথায় রাখি? বেচতেও পারছিলাম না। বাধ্য হইয়াই ছোট্ট শোয়ার ঘরটাতেই থামার (জড়ো) করে রাখলাম। সবাই মিলা (মিলে) ভুট্টার ওপরেই বিছানা কইরা রাইত কাটাইতাম। এত ভুট্টা কোথায় কেমনে বেঁচুম (বিক্রি করব), এ চিন্তার কুল পাইতাছিলাম না।’
এ অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতায় মুরগি ও মাছের খাদ্যের কয়েকজন ব্যবসায়ীর নিকট ৫০০ মণ ভুট্টা বিক্রি করেন রফিকুল ইসলাম। এ থেকে তার প্রায় এক লাখ টাকা সঞ্চয় হয়। বাকি ভুট্টা হকারের মাধ্যমে শেরপুর, নালিতাবাড়ি, নকলা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। লাভও হয় বেশ। এর পর থেকেই রফিকুল ইসলাম সবার কাছে হয়ে ওঠেন ‘ভুট্টা রফিক’। ফেরিওয়ালার পেশাটা পুরোপুরি ছেড়ে দেন। তিনি বলেন ‘একদিন জামালপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ভুট্টা বিজ্ঞানী মাহফজুল হক আমার বাড়িতে আসেন। তার কাছ থাইকা ট্রেনিং নেয়ার সময় জানতে পারি, ভুট্টা দিয়া অনেক রকম সুস্বাদু খাবার বানান যায়। তার পরামর্শ নিয়া ঘরে ভুট্টার ছাতু, আটা, রুটিসহ নানান খাবার বানাইয়া নিজেরা খাওয়ার অভ্যাস করি। হেরপর শেরপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় কৃষি ও প্রযুক্তি মেলায় ভুট্টার তৈরি খাবারের দোকান দেই। এতে আমার সুনাম ছড়াইয়া পড়ে। কৃষি বিভাগ থাইকা বিভিন্ন সময় পুরস্কারও পাই।’
নালিতাবাড়ি পৌর কাঁচাবাজারে প্রধান রাস্তার ধারেই একটি দোকান ভাড়া নেন ভুট্টা রফিক। এখানেই তিনি শুরু করেন ভুট্টার তৈরি বাহারি খাবার বিক্রি। উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা। পাশাপাশি ভুট্টার তৈরি খাবার সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়া। তিনি সাধারণত যেসব খাবার ভুট্টা দ্বারা তৈরি করেন তা হলো - পেয়াজু, পুরি, গুলগুলি, শিঙ্গারা, ভুট্টা-ঝাল ভাজা, জিলাপি, বুরিন্দা, নিমকি, বালুসা, ছাতু, খই, আটা এসব। রফিকুল ইসলামের দরিদ্রতাকে জয় করতে ফেরিওয়ালা থেকে ধাপে ধাপে শেষ অবধি ভুট্টার তৈরি খাবারের দোকান, যে পেশা তাকে দিয়েছে পারিবারিক সচ্ছলতা, দিয়েছে সামাজিক একটি সম্মানজনক পরিচয়। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। সুযোগ করে নিয়েছেন কৃষি বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার। আজ কৃষি বিভাগের উপজেলা পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলে কর্তৃপক্ষ তাকে স্মরণ করে।
২০১২ ও ২০১৪ সনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ঢাকর ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে (বিএআরসি) বিশ্ব খাদ্য দিবসে অনুষ্ঠিত খাদ্য মেলায় ভুট্টার তৈরি খাদ্যের স্টল দিয়ে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন, সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন। নালিতাবাড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. শরিফ ইকবাল বলেন, ভুট্টা রফিক তার ভুট্টার তৈরি বাহারি খাবারের জন্য এ এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। আমি নিজেই মাঝে মাঝে তার ভুট্টার তৈরি খাবার কিনে নিয়ে আসি। ভুট্টা চাষি হিসেবে এবং নানা রকম খাবার প্রস্তুতকারক হিসেবে সে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছে। এ উপজেলাসহ শেরপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কৃষি মেলায় ভুট্টার তৈরি খাবার স্টল স্থাপন করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পেলে সে হয়তো খাদ্য বহুমুখীকরণে মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারবে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ভুট্টা ফসল ১.৭৪ লাখ মে. হেক্টর জমিতে ১১.৩৭ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ৩.১২ লাখ হেক্টরে ২১.৭৮ লাখ মে. টন এবং ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে তা ৩.৬৪ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে উৎপাদন পাওয়া গেছে ২৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি (ডিএই এর তথ্য অনুযায়ী)। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশে ভুট্টার উৎপাদন ও ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তার সিংহভাগই ব্যবহার হচ্ছে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির কারখানার কাঁচামাল হিসেবে। কিছু অংশ যাচ্ছে বিস্কুট তৈরির কারখানায়। কিন্তু এ ভুট্টা সাধারণের খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করি। এতে আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা হলেও এর ঘাটতি পূরণের প্রয়াস পাবে। উপরন্তু এ ফসল আবাদের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও সাশ্রয় হবে। রফিকুল ইসলামকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলে প্রয়োজনীয় রসদের জোগান দিয়ে পথ বাতলিয়ে দিলে হয়তো তিনি বৃহৎ পরিসরে প্যাকেটজাত খাবার তৈরি করে তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারবেন।
কাজী গোলাম মাহবুব*
* সহকারী তথ্য অফিসার (অ.দা.), কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, ময়মনসিংহ
ডা. মো. রহমত উল্লাহ
সোনাপুর, নোয়াখালী
প্রশ্ন-১ : সুপারি এবং নারিকেলের কড়া ঝরে যায়। করণীয় কী?
উত্তর : নারিকেল কচি অবস্থায় ঝরে যাওয়ার কারণ হলো নারিকেল বাগানের মাটিতে রসের অভাব হলে রোগপোকার আক্রমণ হলে, সময় উপযোগী পরিচর্যার অভাবে খাদ্য ও হরমোনের অভাব হলে।
-নারিকেল ফল ঝরা রোধ করতে হলে গাছের গোড়ায় সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
-নারিকেল বাগান বিশেষ করে গাছের গোড়া সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
-মাকড় আক্রান্ত ফল নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
-পটাশ ও বোরন সার অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।
-মাকড়নাশক ভার্টিমেক অথবা ওমাইট ১৫ দিন পর পর অনুমোদিত মাত্রায় ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
সুপারির মোচা ও কুঁড়ি ঝরা রোগটি প্রধানত গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের মোচা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা নোইন নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ চামচ হিসেবে গাছে মোচা বের হলেই ১৫ দিন পর পর ৪-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
প্রশ্ন-২ : বাউ আমের চারা কোথায় পাওয়া যায়?
উত্তর : বাউ (BAU)) আম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) জার্মপ্লাজম সেন্টারের উদ্ভাবিত জাত। এ পর্যন্ত ১৭টি আমের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। আমের চারা বাকৃবি (BAU) জার্মপ্লাজম সেন্টারে পাবেন। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি নার্সারিতে এ জাতের আমের চারা পাওয়া যেতে পারে।
আবদুল খালেক
মিঠাপুকুর, রংপুর
প্রশ্ন : পেঁয়াজের পাতায় প্রথমে বাদামি রঙের দাগ পড়ে ও পরে পাতা ওপর দিক থেকে মরে যায়। প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি পেঁয়াজের ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ দমন করতে হলে যা করণীয় তাহলো-
০ আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলা।
০ বীজ শোধন করতে হবে (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম (প্রোডেক্স ২০০ ডচ বা ২ গ্রাম ব্যভিস্টিন)।
০ রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ইপ্রোভিয়ন (রোভরাল, ইভারাল) এককভাবে অথবা ২ গ্রাম রোভরাল+ ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো. হালিম মিয়া
ধুনট, বগুড়া
প্রশ্ন : ভুট্টার চারার গোড়া বেঁকে যায়। করণীয় কী?
উত্তর : কাটুই পোকা ভুট্টা গাছের গোড়া কেটে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুট্টার চারা গাছে মাইজ মরার লক্ষণ দেখা যায়। এটি ভুট্টার ক্ষতিকারক পোকা। এ পোকা দমনে করণীয় হলো-
-আক্রান্ত জমিতে সেচ দিলে কাটুই পোকার কীড়া মাটির ওপরে উঠে আসে। তখন পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়।
-জমিতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করা।
-বিষটোপ ব্যবহার করা।
-দানাদার বালাইনাশক হেক্টরপ্রতি কার্বোফুরান ৫জি ১০ কেজি শেষ চাষে ব্যবহার করা।
-এ পোকা আক্রমণ বেশি হলে ডার্সবান বা পাইরিফস ৫ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো. বিপুল মিয়া
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : শীতকালে মাছের খাবার সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : সাধারণত শীতকালে মাছ খাবার খাওয়া কিছুটা কমিয়ে দেয় বলে মাছের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হয়। তাছাড়া এ সময় মাছের বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা যায়। এ জন্য মাছের খাবার প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। অনেক মৎস্য চাষি মনে করেন মাছের বৃদ্ধি কম হয় বলে খাবারের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে হয়তো মাছ তাড়াতাড়ি বড় হবে। এটা ভুল ধারণা। এ সময় অতিরিক্ত খাবার প্রয়োগের ফলে কিছু পরিমাণ খাবার পুকুরের পানিতে অবশিষ্ট থেকে যায় যা পরবর্তীতে পচে গিয়ে পানি দূষিত করে এবং শীতকালে মাছের ঘা, ক্ষত, পচন ইত্যাদি রোগের একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য সময়ের মতো এ সময়ও পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে সরবরাহকৃত খাবারের পরিমাণ যেন অতিরিক্ত না হয়ে যায়। এজন্য ট্রে বা পাত্রে করে পুকুরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে খাবার প্রয়োগ করে প্রতিদিন পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে সরবরাহকৃত খাবার অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে কি না। ট্রে বা পাত্রে খাবার থেকে গেলে পরবর্তী খাবার প্রয়োগের সময় পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। এভাবে পরিমাণমতো খাবার প্রয়োগ ও মাছের যত্ন নিলে মাছকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব তেমনি মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও নিশ্চিত হয়।
জিয়াউল হক
পাবনা
প্রশ্ন : মাছ জেগে থাকে বা ভেসে ওঠে। কী করণীয়?
উত্তর : অতিরিক্ত পরিমাণে সার ব্যবহার করার কারণে আপনার পুকুরের পানি গাঢ়ে সবুজ হয়ে গেছে। এজন্য পানিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছ ভেসে থাকছে। এ মুহূর্তে পুকুরে প্রতি শতকে ৩০০-৩৫০ গ্রাম করে চুন প্রয়োগ করবেন। চুন অবশ্যই পানিতে গুলিয়ে ঠাণ্ডা করে পুকুরে ছিটিয়ে দেবেন। খেয়াল রাখবেন পুকুরের পানি যেন হালকা সবুজ থাকে। গাঢ় সবুজ হয়ে গেলে পুকুরে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। চুন দেয়ার পরে অল্প পরিমাণে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট কাপড়ে পুঁটলি বেঁধে পুকুরের ২-৩ জায়গায় পানির ওপরের স্তরে ডুবিয়ে রাখবেন তাতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
ইয়াকুব আলি
কুমিল্লা
প্রশ্ন : পাঙ্গাশ মাছের পেট বড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু লম্বা হচ্ছে না। কী করণীয়?
উত্তর : চার ফিট পানির সঙ্গে আরও এক থেকে দেড় ফিট পানি বাড়িয়ে দেবেন। খাবারের সঙ্গে টেরামাইসিন ক্যাপসুলের গুঁড়া প্রতি ১ কেজি খাবারের জন্য ১ গ্রাম করে মিশিয়ে মাছকে খাওয়াতে হবে। প্রতি শতকে ৪০০ গ্রাম করে চুন পানিতে গুলিয়ে ঠাণ্ডা করে পুকুরে দেবেন। এরপর প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি সার দেবেন সাত দিন পরপর ২ সপ্তাহ।
শিহাব
দিনাজপুর
প্রশ্ন : কোয়েল পালনের সুবিধাগুলো জানতে চাই।
উত্তর : ১. কম পুঁজি নিয়ে কোয়েল খামার করা যায়।
২. আকারে ছোট বলে পালনের জায়গা খুব কম লাগে। একটি মুরগি পালনের সমপরিমাণ জায়গায় ৮ থেকে ১০টি কোয়েল পালন করা যায়।
৩. কোয়েলের রোগবালাই কম।
৪. রোগ প্রতিষেধক টিকা দেয়ার ঝামেলা কম।
৫. ৬-৭ সপ্তাহ বয়সে এরা ডিম দেয়। বছরে একটি কোয়েল ২৯০টি থেকে ৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে।
৬. কোয়েল পাখির খাদ্য চাহিদা কম অথচ খুব দ্রুত বাড়ে। প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম খাবার খায়।
৭. ১৭ থেকে ১৮ দিনে কোয়েলের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
৮. কোয়েলের মাংস ও ডিম সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। কোয়েলের দেহের ৭২% মাংস হিসেবে খাওয়া যায়। কোয়েলের মাংস চর্বির পরিমাণ কম থাকে।
৯. বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালন লাভজনক।
মাহবুব
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : গরুর ক্ষুরারোগ হয়েছে, কী করণীয়?
উত্তর : প্রতিরোধ : রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত জটিল। আক্রান্ত পশুকে আলাদা করে শুকনো স্থানে রাখতে হবে। রুগ্ণ পশুর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ক্ষুরা রোগে মৃত পশুকে ৬ ফুট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য নিকটস্থ পশু হাসপাতাল থেকে ক্ষুরারোগের প্রতিষেধক পলিজ্যালেন্ট টিকা প্রদান করতে হবে।
চিকিৎসা : পশুর মুখে ও পায়ে ঘা হলে হালকা গরম পানিতে ফিটকিরি গুঁড়া করে ১ গ্রাম ১ লিটার পানিতে বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ১ গ্রাম/ ১০ লিটার পানিতে এর যে কোনো একটি দ্বারা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে এবং মুখের ক্ষেত্রে এপথোকোয়ার পাউডার ২৫ গ্রাম করে ৩ বেলা ৫-৭ দিন জিহ্বার ওপর লাগিয়ে দিতে হবে এবং পায়ের ঘা ধোয়ার পর পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ৫০ মিলি. তারপিন তেলের সঙ্গে সমপরিমাণ নারিকেল তেল মিশিয়ে তার সঙ্গে ৫ গ্রাম ভাজা সোহাগার গুঁড়া মিশিয়ে দিনে ৪-৫ বার ব্যবহার করতে হবে।
অতঃপর
১. Sumid Vet Powder (সুমিড ভেট পাউডার) + Doxacil Vet Powder (ডক্সাসিল ভেট পাউডার) নারিকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে আক্রান্ত স্থান ভালোভাবে জীবাণুনাশক দ্বারা ধুয়ে দিনে ২ বার লাগাতে হবে।
২. Genacyn Vet 10 Injection (জেনাসিন ভেট ১০ ইনজেকশন) অথবা Ampicin Vet Injection (এমপিসিন ভেট ইনজেকশন) (গর্ভাবস্থায় থাকলে) দিতে হবে।
৩. Kop-Vet Injection (কপ ভেট ইনজেকশন) অথবা Ace-Vet Bolus (এইস ভেট বোলাস) প্রয়োগ করতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
মাঘ মাসের কনকনে শীতের হাওয়া মাঝে মধ্যে শৈত্যপ্রবাহ শীতের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে যায়। এ সময়টা কৃষির এক ব্যস্ততম সময়। আর সে জন্যই কিছুটা উষ্ণতার পরশ নিয়ে আবার আপনাদের মাঝে হাজির হচ্ছি আগামী মাসের কৃষি নিয়ে। আসুন আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই মাঘ মাসে কৃষিতে আমাদের করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো-
বোরো ধান
গম
ভুট্টা
আলু
তুলা
ডাল ও তেল ফসল
শাকসবজি
গাছপালা
প্রাণিসম্পদ
মৎস্যসম্পদ
সুপ্রিয় পাঠক, অত্যন্ত সংক্ষেপে মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো। আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের গ্রহণযোগ্যতার সমন্বয়ে কৃষিকে নিয়ে যেতে পারেন এক আলোকিত ভুবনে। কৃষির যে কোনো সমস্যায় উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে অথবা কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে কল করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আর আপনাদের মেধা, ঘাম, সচেতনতা এবং আন্তরিকতাই এ দেশের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। সোনালি মাঠ, প্রান্তর, দিগন্ত কৃষির উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত হবে। কথা হবে আগামী সংখ্যায়। সবার জন্য শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
পৌষ মাস। শীতের ফসল আর পিঠাপুলির মাস। শিশির ভেজা ঘাস আর কুয়াশার চাদরে ছেয়ে যায় গ্রামবাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। শীতের জড়তা ফুঁড়ে লাল সূর্য উদিত হয় পূর্ব আকাশে। শিশুরা চিঁড়া, মুড়ি ও পিঠা খায় আর রোদ পোহায় দলবেঁধে। কৃষকরা মাঠে যায় রবি ফসলের চাষ করতে। গ্রামীণ জীবনের এ এক চির চেনা সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। তবে সময়ের বিবর্তনে কৃষি কর্মকাণ্ডের অনেক পরিবর্তন এসেছে। হালের বলদের দেখা এখন কমই মেলে। কলের লাঙল, সেচের পাম্প, ধান-গম কাটার যন্ত্র, মাড়াইযন্ত্র প্রভৃতির প্রচলন এখন চোখে পড়ার মতো বলা যায়। কৃষি শ্রমিকের অভাব এবং উৎপাদন ব্যয়জনিত কারণে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বীজ, সার, সেচ, যত্ন চারে মিলে হয় রত্ন । এটি খনার বচন নয়; এ যুগের কৃষি প্রবচন। বচনটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করলে যা পাওয়া যায় তাহলো- ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের ব্যবহার এবং সময়মতো সার, সেচ ও যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। এখানে যত্ন-পরিচর্যা বলতে আগাছা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন করাকেই বুঝায়। তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার পারতপক্ষে রাসায়নিক পদ্ধতির বদলে জৈব পদ্ধতির প্রয়োগ বেশি করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ এতে মাটির স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকে তেমনি মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। অর্থাৎ জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্যশস্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত কোনো পদার্থ থাকে না।
চাষি ভাইয়েরা, আপনারা জানেন, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন বেড়েছে অথচ মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা শক্তি কমছে, উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটিতে ও কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এ কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক রাখতে, বালাইনাশকের প্রভাবে যাবতীয় স্বাস্থ্যহানী কমাতে, পরিবেশ সংরক্ষণ করে পরবর্তী বংশধরদের জন্য উপযোগী করতে, বালাইনাশকের মাধ্যমে পরিবেশ দূষিত হওয়া রোধ করতে, পৃথিবীর বুকে নিরাপদ জীবনযাপন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মাটির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য জৈব কৃষি ব্যবস্থার একান্ত প্রয়োজন।
আমরা আশা করি চাষি ভাইয়েরা নিজের, দেশের ও দশের স্বার্থে জৈব কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে দেশকে স্বাস্থ্য ও সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।