বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি, যা এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৫.৯৬% এবং ৪৭.৫% শ্রম শক্তি এ খাতে নিয়োজিত। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা এখনও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। বিবিএস ২০১৪-১৫ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ১০ লাখ এবং প্রতি বছর ২০ লাখ লোক জনসংখ্যায় যোগ হচ্ছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১.৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে হবে প্রায় ২২.৫ কোটি। এ বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ আবশ্যক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের কৃষি তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য, আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন দেশ হিসেবে বিবেচিত। জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি বিষয়, যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও মানুষের ওপর। পরিবেশ, মানুষ ও জলবায়ু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। আমাদের কৃষির সাথেও পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে পরিবর্তিত পরিবেশে বদলে যাচ্ছে এ দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থা। কৃষিতে সূর্যের আলো, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতার মৌসুমভিত্তিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ফসলের ধরন, জাত, চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। এ কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে এ দেশের জনগোষ্ঠীর পুষ্টিকর খাবার ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জন্মলগ্ন ১৯৪৫ সাল থেকে প্রতি বছরের ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য এবং কৃষিও বদলাবে। প্রতিপাদ্যটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- সূর্যের শক্তি উৎপাদনে হ্রাস-বৃদ্ধি, মহাসাগরের উত্তাপ শক্তির পরিবর্তন, সমুদ্রশ্রুতের পরিবর্তন, মহাদেশসমূহের স্থান পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির দূষণ, এলনিনো ও লানিনা এর প্রভাব ইত্যাদি। মনুষ্য সৃষ্ট কারণ- শিল্প বিপ্লবের পর উনিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, বন উজার, জৈবিক পচন, কৃষিক্ষেত্রে সার ও কীটনাশকের অযাচিত ব্যবহারসহ বহুবিধ কারণে বায়ুম-লে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড, সিএফসি গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্য থেকে আগত তাপ রশ্মিকে পুনরায় মহাকাশে প্রতিফলিত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে, ফলে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। আইপিসিসির সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর বিরূপ প্রভাব। এর প্রভাবে ভূম-লের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ও এর গতি প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে, আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতু বৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের উষ্ণায়ন, বিশ্ব পানিচক্র, তুষারপাত, বরফগলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগগুলোকে মানবসৃষ্ট প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) তথ্যানুযায়ী জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই-ই বাড়বে এবং অসম বৃষ্টিপাত হবে। আইপিসিসির ৫ম সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্ব গড় তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন, পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য, তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস, বরফগলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রভাব পড়বে। বিশ্ব গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা একবিংশ শতাব্দীর শেষে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে ও বিশ্ব পানিচক্রে অসমতা পরিলক্ষিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি
বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকার কারণে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ সব সময়ই বিপদাপন্ন। বাংলাদেশের কৃষি মূলত আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি নির্ভর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মাত্রাও কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি। ইউএনডিপি বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর গ্রীষ্মম-লীয় সাইক্লোনপ্রবণ এবং ষষ্ঠতম বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসম বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি, খরা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব ও মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদি এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছে, যা মানবকল্যাণ ও জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিরূপ পরিস্থিতির সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরিবর্র্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। এ রকম অবস্থায় দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযোগী কলাকৌশল ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিত ও ক্ষয়ক্ষতি
বিগত ১০০ বছরে এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ৫৮টি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ৫০ বছরে হয়েছে ৫৩টি বন্যা, তার মধ্যে ৬টি ছিল মহাপ্লাবন। ১৫৩ বছরে হয়েছে ২০টি বড় ধরনের ভূমিকম্প। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ছোট ও বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও কালবৈশাখীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭টি, তার মধ্যে ১৫টি ছিল ভয়াবহ। এতে সম্পদের ক্ষতি হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা (বিএমডি, ২০০৭)। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্র্রস্ত হয় কৃষি খাতই। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের বন্যায় ৩২৫.৯ মিলিয়ন ডলার, ২০০৪ সালের বন্যায় আউশ ও আমন ফসলের ৪৩৫.৮৯ মিলিয়ন ডলারের খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ১৯৮৮ সালে বন্যায় খাদ্যশস্যের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২৫ লাখ টন। নভেম্বর ২০০৭ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ তার গতিপথে উপকূলের ১৮৬,৮৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণভাবে ৪৯৮,৬৪৫ হেক্টর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্র্রস্ত হয়েছে এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে ৩ বিলিয়ন ডলার (বিএমডি, ২০০৭)। শৈত্যপ্রবাহের ব্যাপ্তিকালের জন্য মানুষের জীবন ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে খরার কারণে বিগত ৫০ বছরে ২০ বার দেশ খরার ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং তীব্রতাভেদে আমনসহ অন্যান্য ফসল ২০-৬০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত খরার কারণে প্রায় ২১.৮ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে।
কৃষির ওপর মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব
উপকূলীয় অঞ্চল এবং দূরবর্তী দ্বীপসমূহের ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনাপানি প্রবেশ করার ফলে উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি লবণাক্ততার বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্র্রস্ত হয় (মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ২০০৯)। লবণাক্ততার কারণে এসব অঞ্চলের বিশাল পরিমাণ আবাদি জমি পতিত থাকে। শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ভূ-ভাগের অনেক গভীর মিঠাপানি অঞ্চলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে নদীর পানিকে আউশ ধান ও অন্যান্য আগাম খরিফ ফসলে সেচের কাজে ব্যবহারের অনুপোযোগী করে তুলছে।
কৃষির ওপর উষ্ণতা বৃদ্ধি, উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব
আশংকা করা হয় যে, বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সালে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সম্প্রতি দেশে উষ্ণ ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুই-ই কমে আসছে। বেশির ভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণ প্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন গমের ফলন খুব কমে যায় এবং উৎপাদন অলাভজনক হয়। ধানের ক্ষেত্রে ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে গেলে চিটার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে, যা ধানের ফলনকে কমিয়ে দেবে। ধানের কাইচ থোড় আসার পরপরই রাতের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে এবং এ অবস্থা ৪/৫ দিন অব্যাহত থাকলে ধান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে চিটা হওয়ার আশংকা থাকে। ধানের প্রজনন পর্যায়ে বাতাসের গড় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে ধানগাছের জন্য খুবই অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং ধানে অতিরিক্ত চিটা হয়। শৈত্যপ্রবাহের সাথে দীর্ঘ সময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল বিশেষ করে গমের পরাগায়ন (পলিনেশন) ও গর্ভধারণ (ফার্টিলাইজেশন) না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায় এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়, প্রজাতি বৈচিত্র্য কমতে পারে এবং প্রজননে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। উষ্ণতা বাড়ার ফলে গাছের প্রস্বেদনের হার বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত সেচ প্রদানের ফলে সেচের পানির অভাব হয়। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল নষ্ট হয় ও নারিকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়।
জমির উর্বরতা হ্রাস
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিক্ষেত্রে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ কৃষি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। যদিও পলির পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে কোথাও কোথাও ভূমির ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধি পায় কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় এ লাভ অপ্রতুল।
কৃষির ওপর ঘূর্ণিঝড়/সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতিকর প্রভাব
সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে মুহূর্তের মধ্যেই আক্রান্ত এলাকার ফসল, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, জীবজন্তু, ঘরবাড়ি ও মানুষসহ সবই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন ‘সিডর’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কৃষির ওপর নদীভাঙন ও ভূমি ক্ষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব
নদীভাঙনের ফলে প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। প্রতি বছরই নদীর কূল ভেঙে অনেক কৃষি জমি, বসতি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কৃষি জমি কমে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং নদীর দুই-কূলবর্তী অসংখ্য মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব ভাসমান মানুষে পরিণত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় অতিবর্ষণের সময় উঁচু এলাকার উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুয়ে ক্ষয়ে যায়, কখনও কখনও ভূমি ধস হয়। ফলে এসব এলাকার মাটি ক্রমান্বয়ে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মরুকরণসহ অন্যান্য কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটছে।
ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল এডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন ২০০৫, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯, এর ধারাবাহিকতায় নিজস্ব তহবিলে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির জন্য ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। এর আলোকে কৃষিক্ষেত্রে দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাসে পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কলাকৌশলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে, যার ফলে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শক্তিশালী হবে। এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যার ফলে দুর্যোগপ্রবণ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভালোভাবে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় অধিকতর সক্ষম হয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০১৬ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘কৃষিকথা’ প্রকাশনাটি খাদ্য ও কৃষি উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতি ও পরিকল্পনা
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি সমন্বিত উদ্যোগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায় খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের মধ্যেকার সম্পর্ক অনুধাবনের জন্য একটি নীতি গবেষণা ও বিশ্লেষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ সমীক্ষার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা দিতে পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুগুলোকে সম্পৃক্ত করা। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে ‘জলবায়ু পরিবর্তন সেল’ গঠন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন সেলের কাছে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
কৃষি ক্ষেত্রে করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রমাণিত ভালো অভিযোজন কলাকৌশলসমূহ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিছু ভালো প্রমাণিত অভিযোজন কৌশল উল্লেখ করা হলো-
● খরা এলাকায় সম্পূরক সেচের জন্য মিনিপুকুর ও পাতকুয়া (ডাগ ওয়েল) খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ;
● বোরো ধানে শুকনা বীজতলা তৈরির মাধ্যমে সুস্থ ও কোল্ড ইনজুরিমুক্ত চারা তৈরি;
● বন্যা, আকস্মিক বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পেতে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন ধান/ফসলের চাষ;
● খরা এলাকায় স্বল্প পানির চাহিদা সম্পন্ন ফসলের (গম, মুগ, মাসকলাই, ছোলা, মসুর ইত্যাদি) চাষ;
● মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কম্পোস্ট, খামারজাত সার, ভার্মিকম্পোস্ট ইত্যাদির ব্যবহার;
● ফেরোমেন ট্রাপের মাধ্যমে শাকসবজির চাষ;
● পানি সাশ্রয়ের জন্য এডব্লিউডি পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে সেচ প্রদান;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে ‘জলবায়ু পরিবর্তন সেল/দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সেল’ গঠন করার জন্য সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাসে সব স্তরের সংশ্লিষ্টদের (কৃষক, অফিসিয়াল, নীতিনির্ধারক প্রভৃতি) এ বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে আপদকালীন ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তহবিল/দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করার জন্য সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা;
● এলাকাভিত্তিক উচ্চমূল্য ফসলের (High Value Crops) আবাদ সম্প্রসারণ ও উপযোগী শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা;
● জোয়ার-ভাটা এলাকায় বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সর্জান ও ভাসমান পদ্ধতিতে পদ্ধতিতে সবজি ও ফল চাষ, ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ করা;
● চরাঞ্চলে, উপকূলীয় এলাকায় তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা, বাদাম, ফেলন, সূর্যমুখী, ভুট্টা ইত্যাদি চাষ;
● মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকম্পোস্ট, কম্পোস্ট, জৈবসার, সবুজ সারের উৎপাদন ও ব্যবহার; ভূ-উপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা;
● দুর্যোগের পূর্বাভাসে আগাম সতর্ক বার্তা প্রদান;
● দুর্যোগপ্রবণ এলাকা উপযোগী ফসল উৎপাদন পঞ্জিকা তৈরি, বিতরণ ও অনুসরণের ব্যবস্থা করা;
● সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা;
● জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা/প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন;
● দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে এলাকা উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের মাঝে ভর্তুকির মাধ্যমে বিতরণ করা;
● কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি সেন্ট্রাল নলেজ হাব তৈরি করা যেখানে অ্যাডাবটেশন ও মিটিগেশনের কৌশলসমূহ এবং আবহাওয়া ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত থাকবে।
কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি খাতে দৃশ্যমান অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১০ অনুসারে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, অতি উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও ঘন ঘন প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘটনা ঘটছে। ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড় বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন বায়োটাইপের উদ্ভবের ফলে ধান ফসলে এর আক্রমণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিডর, আইলা, রেশমি, নার্গিস এসবের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার কৃষক ও কৃষি পরিবার। আইপিসিসির মতে, বর্তমান গড় তাপমাত্রার থেকে প্রতি ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ধানের ফলন ৭-১০% কমে যাওয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা প্রায় এক মিটার বেড়ে যাওয়ার আশংকা করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত পানির মধ্যে তলিয়ে যাবে এবং প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ। অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২.০ মিলিয়ন হেক্টর জমির ধান কোনো না কোনোভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৃষ্টিপাতের ধারার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে সময়মতো বীজতলায় চারা উৎপাদন করা যায় না, ফলে ধানের রোপণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরি হয়ে যায়, তদুপরি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অসম বণ্টনের কারণে দেশের প্রায় তিন মিলিয়ন হেক্টর জমির আমন ধান বিভিন্ন মাত্রার খরার কবলে পড়ে, ফলে ধানের ফলন তথা উৎপাদন কমে যায়। গত দুই বছর আগাম কালবৈশাখীর কারণে ঝড়-শিলা বৃষ্টি ও অতি বৃষ্টির ফলে হাওর অঞ্চলে পাকা বোরো ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে। তাছাড়া আগাম রোপণকৃত ধান প্রজনন পর্যায়ে নি¤œ তাপমাত্রার (গড় তাপমাত্রা ১৫-১৭ ডিগ্রি) মধ্যে পড়ে চিটা হয়ে যায়। অন্য দিকে উঁচু অঞ্চলের ধানক্ষেত ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অতি উচ্চতাপমাত্রার কারণে স¦ল্প জীবনকালের আমন ধানের চিটার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চলের দেশ হওয়ার কারণে অতি বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমির আমন ধান এক বা একাধিক দফায় স্বল্প অথবা দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ১৯টি জেলায় প্রায় ১.২ মিলিয়ন হে. জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। এসব জমিতে স্থানীয় জাতের আমন ধান চাষ করার পর জমি পতিত থাকে। বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাসে আমন ফসলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৃষ্টি হয় লবণপানির জলাবদ্ধতা। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি আমন চাষের পর পতিত থাকে।
ক্রমহ্রাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ, আবাদি জমি ও পানি অন্যদিকে বাড়তি জনসংখ্যা তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল আউশ-আমন-বোরো ধানের জাত, ধানভিত্তিক লাভজনক শস্যক্রম/মাছ চাষ ও নিবিড়তা বৃদ্ধি (শস্য বহুমুখীকরণ), কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের সমন্বিত দমন, টেকসই মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, খামার যান্ত্রিকীকরণ, ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের অভিযোজন ম্যাপ, বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্ট্রেস এরিয়া ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে, ঔষধি ও জিংকসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন, ভালো কৃষি অনুশীলন, দেশের কৃষি অঞ্চলভিত্তিক লাগসই ধানের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তদুপরি, ব্রি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ব্রি ৪টি হাইব্রিডসহ ৮০টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়াও ১২২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রতি বছর প্রায় ১০০ টন ব্রিডার বীজ বিতরণের মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা। ব্রি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রশিক্ষণ প্রদান, রাইস নলেজ ব্যাংক, মাঠ প্রদর্শনীর পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি, প্রাইভেট কোম্পানি, এনজিও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থার সহযেগিতায় ব্রি প্রযুক্তিসমূহ মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আউশের আবাদ বৃদ্ধিকরণ : পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক এলাকায় বোরো চাষ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য উৎপাদন ঠিক রাখতে হলে আউশের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। বৃষ্টির পানি সর্বোত্তম ব্যবহার করতে আউশ চাষের দুটি ভিন্ন দৃশ্যপট বিবেচনায় রেখে সহজেই বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনের আবাদ বাড়ানো সম্ভব। প্রথমত, যেসব উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমিতে বোরো ধানের আবাদ টেকসই নয় সেখানে স্বল্প সেচে বৃষ্টিনির্ভর আউশ আবাদ করা যায়। এ ক্ষেত্রে আমনের পর উপযুক্ত রবি ফসল এবং পরে আউশ চাষ করা যায়। দ্বিতীয়ত, যেসব এলাকায় বোরো ধান কাটার পর আউশ চাষ করা সম্ভব সেসব এলাকায় রোপা আউশের আবাদ বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে স্বল্পমেয়াদি বোরোর জাত নির্বাচন করতে হবে, যাতে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আউশের চারা রোপণ সম্পন্ন করা যায়। এতে আমন চাষ ও উৎপাদন ব্যাহত হবে না বরঞ্চ প্রতি বছর ১০ লাখ টন অধিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতসমূহ যেমন ব্রি ধান২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮ ও ব্রি ধান৫৫ উল্লেখযোগ্য।
লবণ সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : ব্রি এ পর্যন্ত প্রায় ১০টির অধিক লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে বোরো মৌসুমের ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬১, ব্রিধান৬৭, এবং আমন মৌসুমের জন্য বিআর২৩, ব্রিধান৪০, ব্রিধান৪১, ব্রিধান৫৩, ব্রিধান৫৪, ব্রিধান৫৫ ও ব্রিধান৭৩ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া, লবণাক্ত এলাকায় জাতের পাশাপশি বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে যেমন- সঠিক সময়ে বপন/রোপণ, রোপণের আগে বীজতলায় Elemental সালফার, পটাশ ও দস্তা প্রয়োগ (৬:৬:২ গ্রাম/লিটার), জৈবসার বা ছাই প্রয়োগ করা, জিপসাম ও পটাশ সার ব্যবহার, মাটি ধোয়া (Soil flashing), ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ।
খরার সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : আউশ মৌসুমে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৬৫ (বোনা আউশ), আমন মৌসুমের জন্য উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬ এবং ব্রি ধান৭১ জাতগুলো আবাদের পর সহজেই দ্বিতীয় ফসল চাষ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অঞ্চলভেদে খরাসহনশীল জাতগুলো প্রবর্তন করা গেলে কাক্সিক্ষত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
বন্যা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : ব্রি এ পর্যন্ত দুইটি বন্যা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান৫২। জাত দুটি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকলেও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে কাক্সিক্ষত ফলন দিতে সক্ষম। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে ৫ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার, ১০ দিন পর বিঘাপ্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া ও ৪ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম সার প্রয়োগের ১০ দিন পর পুনরায় একই মাত্রায় ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : দীর্ঘকাল গবেষণার পর সম্প্রতি ব্রি উচ্চফলনশীল দুটি জাত ব্রি ধান৭৬ এবং ব্রি ধান৭৭ অবমুক্ত করেছে। এ জাত দুইটি স্থানীয় জাতের চেয়ে হেক্টরপ্রতি ১.৫ টন ফলন বেশি দেয়। ৩৫-৪০ দিনের চারার উচ্চতা স্থানীয় জাতের ন্যায় ৭০-৭২ সেমি. হওয়ায় জাত দুটি বরগুনা ও বরিশাল অঞ্চলে ধান উৎপাদনে অবদান রাখবে। এ ছাড়াও কাক্সিক্ষত ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.০ টন পেতে NPK Briquttee সার ব্যবহার করতে হবে।
জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও বৃহত্তর যশোরের বিশাল এলাকা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়। এই এলাকার উপযোগী জাত বিআর১০, বিআর২৩ ও বিআর৩০। ধান গাছের গোড়ার অংশ পানির নিচে থাকলেও কুশি উৎপাদন করতে সক্ষম।
টেকসই মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : ধানের জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণই শেষ কথা নয়। একটি জাতের সর্বোচ্চ ফলন পেতে হলে মাটির জৈব পদার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের বোরো মৌসুমে ১০ টন/হেক্টর ফলন দিতে সক্ষম এমন জাত রয়েছে। কিন্তু মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকায় সর্বোচ্চ ফলন ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২.০-২.৪% এর মধ্যে থাকলে সর্বোচ্চ কাক্সিক্ষত ফলন ফলানো সম্ভব। দীর্ঘ সময় ধরে ধান-ধান শস্য বিন্যাসে ২০ সেমি. নাড়া/খড় রেখে কর্তনের পর তা চাষ দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিলে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আস্তে আস্তে ২.৪% উন্নীত করা সম্ভব। তা ছাড়া জমিতে সুষম সার (জৈব ও অজৈব) ব্যবহারের মাধ্যমেও ফলন বাড়ানো সম্ভব।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা : ধান উৎপাদনে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণে ৮০% পর্যন্ত ফলনের ক্ষতি হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক গৌণ ক্ষতিকর পোকা মুখ্য ক্ষতিকর পোকা হিসেবে পুনঃআবির্ভূত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ সারা দেশে পাতা মোড়ানো পোকা ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পামরী পোকার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এজন্য নতুন নতুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের পাশাপাশি নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন এবং পরিবেশবান্ধব সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা যেমন- আলোক ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ, পার্চিং, ইকো ইঞ্জিনিয়ারিং, বোটানিক্যালস এবং উপকারী পোকা সংরক্ষণ জোরদার করার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ধানের ফলন হ্রাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো রোগবালাই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ধানের ৩২টি বিভিন্ন ধরনের রোগ শনাক্ত ও প্রতিকার ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া এবং ছত্রাকজনিত নেক ব্লাস্ট রোগ আমন ও বোরো ধানে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়াও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খোলপোড়া রোগের প্রাদুর্ভাব আমন ও আউশ মৌসুমে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। পানি স্বল্পতা বা খরার কারণে আউশ মৌসুমে টুংরো ও শিকড়গিট রোগ অত্যন্ত হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ সব রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ সমন্বিত রোগবালাই ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করেছে।
ঠাণ্ডা সহনশীল জাত ও প্রযুক্তি : শৈত্যপ্রবাহের কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে নভেম্বর-ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে বোরো বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বোরো মৌসুমে তীব্র শীতে সুস্থ সবল চারা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করেছে ব্রির বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের মতে, বোরো ধানের চারা উৎপাদনের সময় শৈত্যপ্রবাহ হলে অর্থাৎ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে চলে গেলে বীজতলা দিনে সূর্য ওঠার ৪-৬ ঘণ্টা পর স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই পলিথিন সরিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়াও বীজতলায় ২-৪ সেমি. দাঁড়ানো পানি রেখে চারাকে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব। বোরো ধানের চারা রোপণের সময় শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকলে কয়েক দিন দেরিতে অর্থাৎ শৈত্যপ্রবাহের শেষে চারা রোপণ করলে মূল জমিতে চারার মৃত্যু কমানো সম্ভব। বোরো মৌসুমে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ থেকে বীজতলা রক্ষার প্রযুক্তির পাশাপাশি ঠাণ্ডা সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান৩৬ ও ব্রি ধান৫৫ উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি : ব্রি এ পর্যন্ত কৃষি অঞ্চলভিত্তিক ৪১টি লাভজনক শস্যক্রম উদ্ভাবন করেছে। ব্রি উদ্ভাবিত শস্যক্রম অনুসরণ করে এক ফসলি থেকে দোফসলি, দোফসলি জমিকে তিন ফসলি এবং তিন ফসলি জমি চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করে শস্য চাষ নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ব্রিধান৬২-আলু-মুগডাল-ব্রি ধান৪৮ শস্যক্রমটি ঠা-াপ্রবণ রংপুর অঞ্চলের জন্য উপযোগী এবং লবণাক্ত এলাকার জন্য ঘেরের জমিতে বর্ষা মৌসুমে ধান+মাছ+মাচায় সবজির মিশ্র চাষ-সরিষা/সূর্যমুখী অত্যন্ত লাভজনক। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খরা কবলিত বৃষ্টিনির্ভর এলাকায় ব্রি ধান৫৬/৬৬/৭১-খেসারি/মসুরি/ছোলা এবং আংশিক সেচনির্ভর এলাকায় ব্রি ধান৫৬/৬৬/৭১-মসুরি/সরিষা/গম/ আলু-আউশ (ব্রি ধান৪৮) শস্যক্রম সম্ভাবনাময় এবং লাভজনক। এ ছাড়াও ধান পাট রিলে ক্রপিংয়ে ব্রি ধান৩৩ ও ব্রি ধান৩৯ অত্যন্ত উপযোগী জাত।
হাওর অঞ্চলের উপযোগী জাত উদ্ভাবন হাওরাঞ্চলে একটিমাত্র ফসল বোরো। দুঃখ কিংবা গর্ব যাই হোক- একফসলি ধান; হাওরবাসীর প্রাণ। সত্যিই বছরে একটিমাত্র ফসল হলেও বিরল বিচিত্র দেশি জাতের অনেক ধান এখনো এই হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। হাওর এলাকার উপযোগী জাত বিআর১৭, বিআর১৮ এবং বিআর১৯, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯ এবং ব্রি ধান৫৮ উদ্ভাবন করা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ করণীয় : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যেমন- বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) সাথে খাপখাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং এগুলোর চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। নতুন শস্যপর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করতে হবে। অভিযোজন কৌশল ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। লবণ সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু, ঠাণ্ডা ও তাপ সহিষ্ণু, আলোক অসংবেদনশীল ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে শস্য বিন্যাস ও শস্যপর্যায় অনুসরণ করা। রোগবালাই সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা। জলবায়ু ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস কৃষকের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, মলিকুলার ও বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির ব্যবহার করা। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, সূর্যালোক নিয়ন্ত্রিত গ্রিন হাউস খামার তৈরি করা। শস্যবীমা চালু করা। সর্জান পদ্ধতিতে সারা বছর ফল ও শাকসবজি চাষ। জলমগ্ন/হাওর এলাকায় পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা এবং কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা। ভবিষ্যৎ কৃষিকে টেকসই করার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা প্রয়োজন। পরিশেষে বলা যায়, দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সাথে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়ন ঘটানোর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কৃষির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।
ড. মো. আনছার আলী* ড. মো. শাহজাহান কবীর** ড. ভাগ্য রানী বণিক***
এম আব্দুল মোমিন**** ও মো. আবুল কাসেম*****
*পরিচালক (গবেষণা), **পরিচালক (প্রশাসন), ***মহাপরিচালক, **** সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার, ***** টেকনিক্যাল এডিটর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর
আমাদের চারপাশে যা যা আছে যেমন- বাতাস, পানি, গাছপালা, মাটি, বন জঙ্গল, পাহাড় পর্বতমালা, নদী, সাগর, মহাসাগর, পাখি ইত্যাদি সব কিছু সমন্বয়েই গঠিত হয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। অতিরিক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস ভূ-মণ্ডলের বাতাসের সাথে মিশ্রণের জন্য প্রকৃতপক্ষে ভূ-মণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা থেকে শুরু করে সমুদ্রপৃৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়, টর্নেডো, বন্যা, খরা, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসের মতো বড় বড় দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। আর এ সবই ঘটে ধীরগতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধির কারণে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়া, পানি ব্যবস্থাপনা, ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশ, মাটি, জমির ব্যবহার, জীববৈচিত্র্যের বিভিন্নতা, গাছগাছালির ইত্যাদির ওপরও প্রভাব পড়ছে। এরই মধ্যে দেশের বহু প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে আবহাওয়ার এ পরিবর্তনকে দুইভাবে চিন্তা করা যায়। প্রথমটি হলো দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে পানি নিষ্কাশনের অপ্রতুলতার সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানির প্রবেশ ঘটেছে। দ্বিতীয়ত উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, যেখানে পানির অভাবে খরার সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি-পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
পাট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ বান্ধব আঁশ ফসল। বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের জাতের পাট চাষ করা হয়। যেমন- দেশি ও তোষা। পৃথিবীর অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাটের মান উৎকৃষ্ট এবং বর্তমানে উৎপাদনের বিবেচনায় ভারতের পরে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশের পাটের অবস্থা। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭.৫ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১৬ লাখ টন পাট আঁশ উৎপন্ন হয়, যার শতকরা ৫১ ভাগ ভারী পাট কলগুলোতে ব্যবহৃত হয়, ৪৪ ভাগ কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় ও মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। গত ৭০ বা ৮০ দশকের তুলনায় বাংলাদেশে পাট আবাদের জমির পরিমাণ কমে গেলেও গত ৩-৪ বছরে এর একটি বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে পরিবেশ গত কারণে পাটের চাহিদার বৃদ্ধি ও সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধির একটা সম্ভাবনা লক্ষ করা যায়। যদিও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় পাট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফসল তবুও বিভিন্ন সমস্যা বা বাধা যেমন কৃষি জমির অভাব, মূল্যের জন্য কৃষকের অনীহা, আঁশের বাজারজাতকরণ ও পাট কলগুলোর দৈন্যদশা ইত্যাদি কারণে এ দেশের পাট ফসল তার অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৫% পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা ৪ ভাগ। প্রতি বছর পাট আঁশ ও পাট খড়ি বিক্রির কারণে কৃষকপর্যায়ে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে ।
পরিবেশ রক্ষায় পাট ফসলের গুরুত্ব
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে এক হেক্টর পাটের ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম হয়। যার জন্য বলা যায় পাট ফসল বায়ুম-লের দূষিত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে বায়ুম-লেকে পরিশোধিত করে। ফলে পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। আবার অন্য দিকে, প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন ত্যাগ করে বায়ুম-লকে শুদ্ধ করে। এ মাত্রায় বাংলাদেশের চাষকৃত পাট ফসল তার মোট চাষ এলাকার বায়ুম-ল থেকে প্রতি বছর ১০০ দিনে প্রায় ৮১১৫.১৯ হাজার টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ৫৯০০.৯৫ হাজার টন অক্সিজেন ত্যাগ করে।
বিশ্বে বছরে কমবেশি প্রায় ৪৭.৬৮ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ পাট গাছ উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৫.৭২ মিলিয়ন টন কাচা পাতা এবং ২১.৯৩ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ কা-। বর্তমান বিশ্বে পাট আঁশের উৎপাদন প্রায় ২.৯৮ মিলিয়ন টন। আঁশের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে ১.৪৩ মিলিয়ন টন শুকনা পাতা ও ৬.২০ মিলিয়ন টন শুকনা পাট কাঠি বায়োমাস হিসেবে উৎপাদিত হয়। পাটপাতা সবজি হিসেবে এবং সাথে সাথে ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে। এছাড়াও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সবুজসার তৈরির জন্য পাটের পাতার অবদান অপরিসীম।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট ফসল উৎপাদন কালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাটপাতা মাটিতে পড়ে। এছাড়াও পাট ফসল কর্তনের পর জমিতে যে পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় থেকে যায় তা পরবর্তীতে পচে মাটির সাথে মিশে সার তৈরি করে, এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সারের খরচ কম লাগে। পাতা পড়া এবং গোড়াসহ শিকড় থেকে যে পরিমাণ সার হয়, তার খাদ্য উৎপাদন মূল্যায়নে দেখা গেছে তা প্রায় ইউরিয়া ২৫১৭৪ টন, টিএসপি ৩৭৩৩ টন, এমপি ২৭৩৩ টন, জিপসাম ৩৮০৮০ টন এবং ডোলমাইট ৩০৫৪৫ টনের সমমানের। এছাড়া মাইক্রো খাদ্য উপাদান যেমন- ফেরাস সালফেট ৩৬০ টন, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১৬০ টন ও জিংক সালফেট ৩৩ টনের সমমান পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে পাট পচানোর সময় যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তাতে ৫০% থেকে ৬০% মিথেন থাকে যা থেকে বসতবাড়িতে বা শিল্প কারখানায় ব্যবহার উপযোগী জ্বালানি গ্যাস তৈরি করা যেতে পারে। পাট পচনশীল এবং পাট থেকে কোনো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয় না।
পাট থেকে পাল্প এবং কাগজ তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। খুবই উন্নতমানের কাগজ সবুজ পাট থেকে উৎপন্ন করা সম্ভব। তাছাড়া পাট কাঠি কাঠের বিকল্প হিসেবে আসবাবপত্র, পলিউড, পার্টেক্স, চারকোল ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণার ফলে জুট জিও-টেক্সটাইল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এ জিও-টেক্সটাইল নদীভাঙন রোধে, সেচ নালার ভাঙন রোধে, পাহাড়ের ধস রোধ, সেচ নালা হিসেবে ও রাস্তাঘাট তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। তাছাড়া পাটের ব্যাগ বার বার ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহারের বিবেচনায় পাটের ব্যাগ খুবই সস্তা।
আমাদের দেশের বন সম্পদ সংরক্ষণে পাট কাঠির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশের মোট ভূমির তুলনায় এখানে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে এ দেশের বনভূমির পরিমাণ শতকরা মাত্র প্রায় ৮ থেকে ৯ ভাগ। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ০.৭০ থেকে ০.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। যা থেকে কিছু পরিমাণ হলেও পাট মৌসুমে দেশের বন সম্পদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
পাটের আবাদি জমির পরিমাণ, উৎপাদন ও ফলন
বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে অধিক পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্যশস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, পাটের উর্বর আবাদি জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিপিডির এক সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত ২০০১-০২ সালের তুলনায় ২০০৬-০৭ সালে পাটের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.২৯% কমেছে কিন্তু মোট উৎপাদন ৩.১৮% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গড় ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ১২.৫০% (পাটের আবাদি জমির পরিমাণ, উৎপাদন ও ফলন। তবে ২০০৬-০৭ সালের পর থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত এ বৃদ্ধিও হার ঊর্ধ্বমুখী পাওয়া যায়, উল্লেখ্য যে, গত ২০০৯-১০ সালে এর মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল। এর প্রধান কারণ পাট চাষে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি যেমন উচ্চফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহার। সময়োপযোগী ও প্রচলিত শস্যক্রমের সাথে মানানসই তোষা পাট জাত উদ্ভাবন করার ফলে দেশে দেশি ও তোষা পাটের চাষের হার যথাক্রমে ৭০:৩০ এর স্থলে বর্তমানে প্রায় ২০:৮০ অনুপাতে এসে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনে পাট চাষের ওপর প্রভাব যদি চিন্তা করা যায়, তা হলে এর চাষ এলাকা ও উৎপাদনের দিকে লক্ষ করতে হবে। গত ৩৫ বছরের (১৯৭২-৭৩ থেকে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত) পাটের চাষ এলাকা ও আঁশ উৎপাদন এর পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৮০-৮১ সাল এ ৯ বছরকে ৭০ দশক বলা হলে এ দশকে গড় চাষ এলাকা ছিল ৪৮০.৮৩ হাজার হেক্টর এবং তখন গড় উৎপাদন ছিল ৯৫২.৩৩ হাজার টন। আবার ৮০ দশকে (১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৯০-৯১) গড় চাষ এলাকা ছিল ৪৯০.৯৩ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন ছিল ৯৭২.৩৩ হাজার টন। তবে এর পর থেকে একটু কমতে থাকে যেমন- ৯০ দশকে ও ২০০০ দশকে চাষ এলাকা ছিল যথাক্রমে, ৪৪১.৫৭ হাজার হেক্টর এবং ৪৬০.১৩ হাজার হেক্টর। তবে উৎপাদন ৯০-এর দশকের চেয়ে ২০০০ দশকে কিছুটা বেশি ছিল যথাক্রমে, যেমন- ৮৭৪.৫৯ হাজার টন ও ৯১১.৩৩ হাজার টন। এ চিত্র থেকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, পাট চাষের এলাকা, গত ৭০ দশকের চেয়ে বর্তমানে ২০০০ দশকে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, কিন্তু উৎপাদনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় ৭০ দশকে ছিল ৯৫২.৩৩ এবং ২০০০ দশকে তা দাঁড়িয়েছে ৯১১.৩৩ হাজার টন যা প্রায় কাছাকাছি। উল্লেখ্য যে, ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৪-১৫ দশকে গড় উৎপাদন এলাকা ও গড় উৎপাদন উভয়ই পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক। এর কারণ খুঁজলে অবশ্যই বলা যায় পাট চাষে কৃষকের জ্ঞান বৃদ্ধি, উন্নত জাত, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই, পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা ইত্যাদির কথা। জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সম্পর্ক চিন্তা করলে, আগে বাংলাদেশে দেশি জাতের পাট বেশি চাষ হতো, বর্তমানে হয় তোষা জাতের বেশি। আগে নিচু এলাকায় পাট চাষ হতো এখন হয় কিছুটা উঁচু এলাকায়। আগে বাংলাদেশর পূর্বাঞ্চলে ভালো পাটের চাষ হতো এখন হয় উত্তরাঞ্চলে।
পাট আঁশের উৎপাদন কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছাতে করণীয়
এখন পর্যন্ত বলা যায়, বাংলাদেশের পাট ফসল জলবায়ুর সাথে খাপখাইয়ে বহাল তবিয়তে চাষ হচ্ছে। কারণ মার্চ-এপ্রিল মাসে আগাম বৃষ্টিপাতের সাথে সাথে পাট চাষের জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মে-জুন মাসের দিকে অল্প কিছু এবং মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফলে মাটিতে রসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যা পাট ফসলের বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। পরবর্তীতে জুলাই-আগস্টের অতিরিক্ত বৃষ্টিতে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-নালা পানিতে ভরে যায়, যা পাট ফসল কর্তনের পর পচানো ও আঁশের মান্নোনয়নে সহায়ক হয়। বাংলাদেশে দেশি তোষা উভয় জাতের পাটের চাষ হয়। তবে দেশির তুলনায় তোষা জাতের পাটের চাষ বর্তমানে বেশি হচ্ছে। এর কারণ হলো পূর্বের যেসব এলাকায় দেশি পাটের চাষ হতো, তা ছিল নিচু এলাকা। বর্তমানে খাদ্যশস্যের চাহিদার জন্য ওই সব এলাকা ধান চাষের আওতায় চলে গেছে। পাট চলে গেছে তুলনামূলকভাবে উঁচু ভূমি এলাকা যেখানে বৃষ্টি নির্ভরতা বেশি। দেশি জাতের চাষ কৃষক পর্যায়ে কমে যাওয়ায় এর বীজ উৎপাদনও ব্যাহত হয় ফলে তোষার জমির পরিমাণ বাড়তে থাকে। কারণ তোষা পাটের বীজের সহজ প্রাপ্যতা।
পাট নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফসল। পাটের বীজ সাধারণত ৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় অঙ্কুরিত হয়, তবে অস্বাভাবিক অবস্থায় ২০ ডিগ্রি সে. থেকে ৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রাতেও অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে গাছ জন্মানোর পর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও পাট গাছের বৃদ্ধিতে তেমন কোনো খারাপ প্রভাব ফেলে না এবং ফলন ভালো হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত ও শুষ্ক এলাকায় অনেক অনাবাদি এবং এক বা দুই ফসলি জমি আছে, যেখানে পাট উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। এরই মধ্যে লবণাক্ত, খরা ইত্যাদি সহিষ্ণু পাট ও কেনাফ জাত বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত হয়েছে। ওই জাতগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয় ঘটাতে হবে।
পাট চাষি ও মাঠকর্মীদের জন্য পাট চাষবিষয়ক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ বেশি বেশি প্রদানের মাধ্যমে পাট ফসল চাষে আগ্রহী করে তুলতে হবে। পানি স্বল্প স্থানে পাট পচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রিবন রেটিং প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ ও বিস্তার ঘটাতে হবে। কৃষক পর্যায়ে উচ্চফলনশীল পাট জাতের বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘নিজের বীজ নিজে করি’ পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাট আঁশের বাজার মূল্য স্থিরকরণ ও প্রয়োজনে সরকারিভাবে ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকের জন্য পাট আঁশের বাজার ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে হবে। সুন্দর ও নিত্যনতুন পাট পণ্য উদ্ভাবন করে দেশের অভ্যন্তরে তার ব্যবহার বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চমূল্য বিশিষ্ট ফসল চাষের ফলে পাটের বীজ উৎপাদনের জমি হ্রাস পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সাথীফসল হিসেবে এবং বনায়ন পরিবেশে প্রয়োজনমাফিক ‘নিজের বীজ নিজে করি’ কর্ম পদ্ধতিতে পাট বীজ উৎপাদনে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতার ফলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষক পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। ফলে কৃষক আবার পাট চাষে উৎসাহিত হচ্ছে এবং পাট চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় একক আয়তনে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত পাটের জাতগুলোর ফলনশীলতা অনেক বেশি যেমন- ৪৫০০ কেজি/হে. এর ওপরে। পাটের উৎপাদনকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাতে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলো- সময়মতো বপন, অন্তর্বর্তী পরিচর্যা, সঠিক সময়ে কর্তন, পরিমিত পাতলাকরণ, উন্নত পচন ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে ভালো মানের আঁশের কাক্সিক্ষত মাত্রায় ফলন পাওয়া সম্ভব। অতএব, জলবায়ু পরিবর্তন সত্ত্বেও আমাদের কৃষি পরিবেশ পাট চাষের জন্য বেশ উপযোগী থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম* ড. রহিমা খাতুন**
মোঃ আসাদুজ্জমান*** ড. মোঃ কামাল উদ্দিন****
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, **পরিচালক (কৃষি), ***পরিচালক (কারিগরি), ****মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭
বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য এবং কৃষিও বদলাবে- Climate is Changing : Food and Agriculture are too. একেবারেই সময়ের প্রেক্ষিত। গেল বছরগুলোতে জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশের কি পরিবর্তনই না হচ্ছে। শুধু কি পরিবর্তন। ক্ষতি করছে সব। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে আমাদের কৃষির। আর কৃষির সাথে খাদ্য তো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়। গরমকাল আরও তাপময়, ক্ষণিকে আবার হঠাৎ ঠা-া। অনিয়মিত ও অসময়ে বৃষ্টি, কম সময়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি এবং এর ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও ভূমি ধস, ভূমি ক্ষয়, শুকনো মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত, বন্যার পরিমাণ ও তীব্রতা অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাওয়া, আকস্মিক বন্যা, দীর্ঘায়িত বন্যা ও খরার ফলে ফসলহানি, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নদী তীরবর্তী এলাকার ভাঙন ভূমিক্ষয়, সেচ খরচ বৃদ্ধি ও সুপেয় পানির কম প্রাপ্যতা এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফল।
প্রতিপাদ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের আগে সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য বিগত সময়ের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যগুলো এক নজরে রেখে দিলাম। ১৯৮১-৮২ সালে একই প্রতিপাদ্য ছিল সবার আগে খাদ্য (Food Comes First), ১৯৮৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা (Food Security), ১৯৮৪ সালে কৃষিতে নারী (Women in Agriculture), ১৯৮৫এ গ্রামীণ দরিদ্রতা (Rural Poverty), ১৯৮৬তে জেলে ও জেলে সম্প্রদায় (Fishermen and Fishing Communities), ১৯৮৭তে ক্ষুদ্র কৃষক (Small Farmers), ১৯৮৮তে গ্রামীণ যুবক (Rural Youth), ১৯৮৯ খাদ্য ও পরিবেশ (Food and the Environment), ১৯৯০ সালে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য (Food for the Future), ১৯৯১ জীবনের জন্য গাছ (Trees for Life), ১৯৯২ খাদ্য ও পুষ্টি (Food and Nutrition ) ১৯৯৩ মানব কল্যাণে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সমাহার (Harvesting Nature’s Diversity), ১৯৯৪ জীবনের জন্য পানি (Water for Life), ১৯৯৫ সবার জন্য খাদ্য (Food for All), ১৯৯৬ ক্ষুধা ও পুষ্টির বিরুদ্ধে সংগ্রাম (Fighting Hunger and Malnutrition), ১৯৯৭ খাদ্য নিরাপত্তায় বিনিয়োগ (Investing in Food Security), ১৯৯৮ অন্ন যোগায় নারী (Women Feed the World), ১৯৯৯ ক্ষুধা জয়ে তারুণ্য (Youth Against Hunger), ২০০০ ক্ষুধামুক্ত সহস্রাব্দ (A Millennium Free from Hunger), ২০০১ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুধামুক্তির সংগ্রাম (Fight Hunger to Reduce Poverty), ২০০২ পানি খাদ্য নিরাপত্তার উৎস (Water : source of Food Security), ২০০৩ ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি (Working together for an International Alliance Against Hunger), ২০০৪ খাদ্য নিরাপত্তায় জীববৈচিত্র্য (Biodiversity for Food Security), ২০০৫ কৃষি ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ (Agriculture and intercultural dialogue), ২০০৬ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ (Investing in agriculture for food security), ২০০৭ খাদ্যের অধিকার (The Right to Food), ২০০৮ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জলবায়ুর পরিবর্তন ও জৈবশক্তি (World Food Security: the Challenges of Climate Change and Bioenergy); ২০০৯ সালে সংকটকালীন খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন (Achieving Food Security in Times of Crisis) ; ২০১০ ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐক্য (United against Hunger); ২০১১ সংকট নিরসনে সহনশীল খাদ্যমূল্য নির্ধারণ (Food prices - from crisis to stabilit); ২০১২ কৃষি সমবায় : ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার উপায় (Agricultural cooperatives – key to feeding the world ), ২০১৩ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির জন্য টেকসই খাদ্য কৌশল (Sustainable Food Systems for Food Security and Nutrition) ২০১৪ পারিবারিক খামার : পরিবেশসম্মত প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগান ও সমৃদ্ধির মূল উৎস (Family Farmers - Feeding the world, caring for the earth) ২০১৫ নির্ধারিত হয়েছে গ্রামীণ দারিদ্র্য চক্রের অবসানে সামাজিক সুরক্ষা এবং কৃষি (Social Protection and agriculture: breaking the cycle of rural poverty). আর ২০১৬ তে প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে বদলে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য এবং কৃষিও বদলাবে (Climate is Changing : Food and Agriculture are too).
আবহাওয়া হলো কোনো স্থানের কম সময়ের বা যে কোনো মুহূর্তের বায়ুম-লীয় অবস্থা। এটি কোনো অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন ও ফলনে বিশেষ করে কৃষিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। জলবায়ু কোনো স্থানের দীর্ঘ সময়ের সাধারণত ২৫ বছর বা ততোধিক সময়ের গড় নির্দেশ করে। এটি কোনো অঞ্চলে ফসলের প্রকার ও জাত নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে সবুজ এ পৃথিবী দিন দিন উত্তপ্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ গবেষকদের অভিমত একবিংশ শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা পরিমাণ হবে এমনি, যা গত দেড় লাখ বছরেও বাড়েনি। পরের শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা আরও ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশিও বাড়তে পারে এবং ভূপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা ৮৮ সেন্টিমিটার উঁচু হবে। পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ গত ২ কোটি বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০ জনের মধ্যে একজন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। ২০২৫ সালে ৫ হাজার কোটি লোকে এমন সব দেশে বাস করবে যেখানে পানি সরবরাহ বিপদগ্রস্ত হবে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বড় শৈলশ্রেণী সামুদ্রিক উচ্চতাপে নিশ্চিহ্ন হবে। ১০০ বছর শীতকালীন প্রাকৃতিক অবস্থা এখনকার মতো থাকবে না। আগামী ২০০ বছরে পশ্চিম কুমেরুর তুষার আচ্ছাদন গলে যাওয়ার সম্ভাবনা ২০ ভাগের মধ্যে এক ভাগ। তা ঘটলে উপকূলীয় নগরগুলো নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন এবং অটোয়া থেকে সিডনি পর্যন্ত সব ডুবে যাবে। এশিয়ার গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হবে সবচেয়ে মারাত্মক। বিশ্বের প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র ৪৪ শতাংশ, জাপান ১৩ শতাংশ, জার্মানি ৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৫ শতাংশ, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া ৩ শতাংশ এবং বাকি ২৮ ভাগ অন্যান্য সবাই মিলে।
বিশ্ব জলবায়ুর এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উষ্ণতা বাড়বে এবং ৪৫০ সেন্টিমিটারের বেশি সমুদ্রস্ফীতির মুখোমুখি হবে। তখন এদেশ স্থায়ীভাবে প্লাবিত হবে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশের উপকূলীয়, নিম্নাঞ্চল অর্থনৈতিক উপযোগিতা হারাবে। জলবায়ুর এ পরিবর্তনে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাপ্রবণ এলাকায় খরার প্রকোপ আরো বাড়বে। শুধু তাই না সুন্দরবনও সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হবে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে আগামী ২০৫০ সালে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। বর্তমানে গরমকালে প্রচ- তাপদাহ এবং শীতকালে শীতের তীব্রতা এ দেশের আবহমান আবহাওয়ার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। পঞ্চগড়ে ১০-১২ বছর ধরে অস্বাভাবিক শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ধানে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। শ্রীমঙ্গল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অতীতে এদেশে প্রায় ৮ হাজার প্রজাতির ধান উৎপাদিত হতো। এখন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। আগামী ৫০ বছরে ধানের উৎপাদন এক দশমাংশ কমার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে বিলুপ্ত হতে পারে আলুর বিভিন্ন প্রজাতির এক চতুর্থাংশ। এছাড়া ২০ শতাংশের বেশি মাছের প্রজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ১৭টি নদী। ড. আইনুন নিশাতের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলো হলো- বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, সঠিক সময়ে না হওয়া, সঠিক সময়ে শীত শুরু না হওয়া, শীতের প্রকোপ কমে যাওয়া, শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া, প্রতি বছর তাপমাত্রা অল্প করে বেড়ে যাওয়া, আগাম পানি আসা, পানির চাপ বাড়া। ২০৩০ সালের বাংলাদেশের জলবায়ুর অবস্থা দাঁড়াবে গরমকালে তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে এবং শীতকালে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমবে, গরমকালে বৃষ্টিপাত বাড়বে শতকরা ১১ ভাগ কিন্তু শীতকালে কমবে শতকরা ৩ ভাগ, গরমকালে বাষ্পীভবন বাড়বে শতকরা ১৫.৮ ভাগ এবং শীতকালে বাড়বে শতকরা ০.৯ ভাগ।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশের কৃষি ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বীজের গজানো, পরাগায়ন, ফুল ও ফল ধরা, পরিপক্বতা হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোক প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সাথে ফসল চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গম, ছোলা, মসুর, মুগডালসহ কিছু কিছু ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গমের বীজ গজানোর তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কম বেশি হলে বীজ গজাবে না। গম পাকার সময়ে আর্দ্রতা বেশি ও ঘন কুয়াশা থাকলে ব্ল্যাক পয়েন্ট রোগ হবে। ফলনও কম হবে। পাট ও বোরো ফসলের ফলনও কমে যাবে মারাত্মকভাবে। টাস্কফোর্স রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১ মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে ৩ হাজার মিলিয়ন হেক্টর উর্বর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে, ২ মিলিয়ন টন ধান, গম, আখ, পাট, মটরসহ রবিশস্য উৎপাদন কমে যাবে। ব্রি’র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। ধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ হচ্ছে। কৃষক আবহাওয়া বুঝতে পারছে না। বৈশ্বিক উঞ্চায়নের কারণে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে এবং বর্তমান শতাব্দীতে বাংলাদেশে বন্যার পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ইস্যু খাদ্য নিরাপত্তা। এ পৃথিবীর গরিবদের মধ্যে আছে কৃষক, জেলে এবং গবাদিপশু পালনকারী। এরাই পরিবর্তিত জলবায়ু বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় বেশি। কেননা এরা তো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দলের মানুষ। এদের না আছে থিত নাছে ভিত। এরা বড় অসহায়। এর মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ার প্রবণতা এগিয়েই চলছে। তথ্য বলে আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯.৬ বিলিয়নে। এ বাড়তি জনসংখ্যার দুই মুঠো খাদ্য জোগানে এক বৈরী পরিবেশ আর অবস্থার মধ্যেও খাদ্য জোগানে ব্যস্ত থাকতে হবে কঠিনভাবে। আমাদের উৎপাদনশীলতা আর স্থায়িত্বকে যদি সঠিকভাবে ধরে না রাখা যায় তাহলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে যে কোনো সময়। সুতরাং সবার আগে ভাবতে হবে পরিবেশ প্রতিবেশ আর নির্ভেজাল বাঁচার সমীকরণ নিয়ে।
এ কথা তো ঠিক দিন দিন আমাদের আবাদি জমি কমছে আতংকিত হারে। আর খাদ্য চাহিদা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এ অসম সমীকরণে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঠিক রাখার জন্য আমাদের বহুমুখী সম্মিলিত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদনক ট্রেন্ডকে ঠিক রেখে সব ধরনের এবং সব পর্যয়র অপচয় রোধ করতে হবে যৌক্তিকভাবে। নৈতিকতা, নীতি উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, কর্তন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বিপণন, অবকাঠামো সবখানেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে কাক্সিক্ষত মাত্রায়। সে কারণেই বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবারের প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, সুতরাং বদলাচ্ছে আমাদের সব কিছু। বিশেষ করে আমাদের কৃষি আমাদের খাদ্য। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে দেরি না করে।
ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের যে কোনো পরিস্থিতিতে সহায়তা ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় শক্ত সময়োপযোগী করতে হবে। তখনই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা দেয়া যাবে অনায়াসে। জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ঋণাত্মক প্রভাব পড়ছে বা পড়বে। এফএও মনে করে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ পুরো পৃথিবীর মানুষকে দুই বেলা খাওয়াতে হলে আমাদের সবার খাদ্য উৎপাদন ৬০ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
সর্র্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে আমাদের সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে পরিবর্তিত জলবায়ুতে আমাদের বিভিন্ন আঙ্গিকে করণীয় কি। এর সাথে আমাদের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকের সার্বিক কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন চক্রের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যে করেই হোক চাহিদা মতো উৎপাদন, প্রয়োজন মতো পুষ্টিসম্মত খাদ্য গ্রহণ এবং পরিবেশ ঠিক রেখে সব কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় করা। তবেই আমরা আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব অনায়াসে। আমাদের প্রাণের পৃথিবী দিন দিন উষ্ণময় হচ্ছে। বরফ গলে নদী সাগরে মিশছে, নদী সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে কেবলি। এরই সাথে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। এ কারণে দুটো জিনিস বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ০১. যারা গরিব কৃষক তাদের উৎপাদন আর যাপিত জীবনের ওপর যারা অন্ন জোগায় খাদ্যের জন্য আর ০২ হচ্ছে ২০২৩ সাল নাগাদ ক্ষুধাকে নির্মূল করার কাজে আঘাত হানছে। এরই মাঝেও সুখের খবর আছে। এখনও আমরা আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি। খাদ্য অপচয়, বনায়নকে আরও বিস্তৃত করা। আমাদের উৎপাদনের মূল আধার জমি ও পানিকে দূষণমুক্ত রেখে আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়া।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি ক্ষেত্রে খাপ অভিযোজন কলকৌশল
০১. লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো, ফসলের চাষ, চিংড়ি চাষ, দ্রুত ও গভীর চাষের মাধ্যমে মাটির ক্যাপিলারি নালিকা ভেঙে দিয়ে লবণাক্ততা কমানো। এজন্য পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে; আমন মৌসুমে বিআর ২৩, ব্রি-ধান ৪০ এবং ৪১ এর চাষ। বোরো মৌসুমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ;
০২. চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, পানি কম লাগে এমন ফসলের চাষ, মালচিং ও ড্রিপ সেচের প্রবর্তন, এসআরআই পদ্ধতি অনুসরণ, অল্পচাষ বা বিনা চাষে উৎপাদন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযোগী ফসলের চাষ করতে হবে, খরাসহিষ্ণু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো। অধিক দামি সবজি জাতীয় ফসল যেমন- টমেটো, তরমুজ, শসা, মরিচের চাষ। মিনি পুকুর, প্লাস্টিক পাইপ-ফিতা পাইপের ব্যবহার বাড়ানো। আইল উঁচু করে চাষ করা। খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরি হলে নাবি ও আলোক সংবেদনশীল বিআর ২২, ২৩ ও ব্রি-ধান ৪৬ এর চাষ করা। আউশ মৌসুমে বিআর ২৪, বিআর ২৬, বিআর ২৭, ব্রি ধান৪২ ও ব্রি ধান৪৩ আবাদ করা। আমন ধান কাটার পরে খরা সহনশীল ফসল যেমন- ছোলা চাষ করা যায়। তেল ফসল হিসেবে তিলের চাষ করা যায়। এছাড়াও মাটির গভীরে বীজ বপন, আগে ভিজানো বীজ বপন, মিতব্যয়ী পদ্ধতিতে পানি সেচ, সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খরা মোকাবিলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায়;
০৩. ক. আগাম ঢল বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় ও উফশী জাতের আগাম পাকা ও স্বল্পমেয়াদের বোরো চাষাবাদ ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। প্রচলিত জাতের চেয়ে আগাম পাকে এমন ফসলের জাত চাষ, যেমন- ব্রি-ধান২৯ এর চেয়ে ব্রি-ধান২৮ পনের দিন আগে কাটা যায়। শিষ পাকা পর্যায়ে ব্রি ধান২৯ ও ব্রি ধান৩৬ এর জলমগ্নতা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এছাড়াও ব্রি ধান৪৫ চাষ করা যায় যার জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ব্রি-ধান২৯ এর ২০-৩০ দিন বয়সের চারা সঠিক সময়ে (১৫-৩০ কার্তিক) রোপণের মাধ্যমে এর জীবনকাল ১৫ দিন কমিয়ে আনা সম্ভব। স্থানীয় জাতের পশুশাইল যথেষ্ট ফলন দিতে সক্ষম।
খ. ভাসমান ধাপে ফসলের-সবজির চাষ। বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবি জাতের ধান যেমন- নাইজারশাইল, বিআর-২২ ও ২৩ এবং ব্রি-ধান৪৬ চাষ করা। দাপোগ পদ্ধতির বীজতলা তৈরি। বন্যা পরবর্তী সময়ে বেশি বয়সের চারা ঘন করে লাগানো যেতে পারে।
গ. বন্যা মোকাবিলা সক্ষম ধানের পাশাপাশি সবজি ও অন্যান্য ফসলের চাষ করা সম্ভব। ফ্রেঞ্চ শিম, মুলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, করলা, চালকুমড়া, পালংশাক, পুঁইশাক, মটরশুটি এসব চাষ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
০৪. কালবৈশাখী, ঝড়/শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত আউশ ধান বা সবুজসার প্রয়োগ করার পর রোপা আমন ধান চাষ করতে হবে। এতে অধিক ফসল নিশ্চিত করার পাশাপাশি বোরোর ক্ষয়ক্ষতি আংশিক পূরণ করা যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ক্ষতির প্রকৃতি, এলাকার মাটি বা ভূপ্রকৃতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী ফসল চাষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে আউশ মৌসুমে উফশী রোপা আউশ যেমন- বিআর ১৪, বিআর ৯, বিআর ২০, বিআর ২১, বিআর ২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এর ১ মাস বয়সী চারা বৈশাখ মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে।
০৫. তাপমাত্রা সহনশীল ফসলের জাতের চাষ করা; ০৬. নতুন শস্যপর্যায়ের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করা; ০৭. বালাইসহনশীল ফসলের চাষ করা। বালাই প্রতিরোধী জিএমও ফসলের চাষ; ০৮. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো; ০৯. আবহাওয়ার সব তথ্য ক্ষতিপ্রবণ ও আশংকাজনক এলাকাসমূহে আগাম জানানোর মাধ্যমে ফসল চাষের পরামর্শ প্রদান; ১০. নতুন শস্যপর্যায় উদ্ভাবন করা এবং এর ব্যাপক প্রচলন করা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমাদের কৃষিও খাদ্যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা আমাদের স্বাভাবিক ট্রেন্ড নিয়ে কৃষিকে আর খাদ্য নিয়ে পরিকল্পনা, উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, সংরক্ষণ এসব করতে পারছি না। এজন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে বা করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু অধিকাংশ কার্যক্রমই পাইলট আকারে গুটিকয়েক জেলা বা উপজেলায় বিস্তৃত এবং একটি সংস্থার সাথে আরেকটি সংস্থার কাজের কোনো সমন্বয় নেই। এ ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন খাপ খাওয়ানোর কলাকৌশল সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে, যা অন্য কোনো সংস্থার নেই। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে, ব্যাপক ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করলে আমাদের দেশের চাষিরা উপকৃত হবে তথা দেশ উপকৃত হবে। আমরা সক্ষম হবো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি ও খাদ্যকে টিকিয়ে রাখতে।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ ংঁনড়ৎহড়সষ@মসধরষ.পড়স
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিনের পলিতে গঠিত এক নদী মাতৃক দেশ, আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের দেশ ৪৫.৭৫ লাখ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় জলসম্পদে সমৃদ্ধ এক দেশ। জলবায়ু অনুকূলে থাকায় অদূর অতীতে আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ছিল মৎস্যে ভরপুর। সুস্বাদু, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সহজপ্রাপ্য এ মৎস্য ছিল আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যের এক উল্লেখযোগ্য অংশ, যা আমাদের ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ -এর তথ্য মতে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৬৫ শতাংশ, মোট কৃষিজ আয়ের ২৩.৮১ শতাংশ আসে মৎস্য উপখাত থেকে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ। দেশের প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ লোক জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য উপখাতের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে তথা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে আমাদের দেশের মৎস্য সম্পদ সংকুচিত হচ্ছে, কমছে বা ধ্বংস হচ্ছে আবাসস্থল, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন সুবিধা, বৃদ্ধি পাচ্ছে মরণ হার, কমছে উৎপাদন এমনকি বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে অনেক মৎস্য ও জলজ প্রজাতি। বলা যায় দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ সংকুচিত হতে হতে আজ সংকটাপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা আজ মূলত মনুষ্যসৃষ্ট কারণে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং পৃথিবীর প্রাণিকুল তথা মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা, মাত্রা ও অস্বাভাবিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে দেশের মৎস্য সম্পদের স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ আজ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্ববহ বিষয়। তাই আজ পৃথিবীর স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে সবাই তৎপর হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কম দায়ী হয়েও পরিবর্তিত জলবায়ুতে দেশের সম্পদ রক্ষার্থে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণ আমাদের জন্যও প্রয়োজন।
পরিবর্তিত জলবায়ু তথা জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change)
কোনো নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ু প্রবাহ ইত্যাদির সম্মিলিত রূপই হলো আবহাওয়া, যা অঞ্চল ও ঋতুভেদে পরিবর্তনশীল। আর দীর্ঘমেয়াদি সময়ের বা কমপক্ষে ৩০ বছরের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়ার গড় হলো জলবায়ু। এ দীর্ঘমেয়াদি সময়ের মধ্যে আবহাওয়ার গড় মানের যে পরিবর্তন হয়, তাই জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক প্রভাবক রয়েছে। এর মধ্যে তাপমাত্রাই প্রধান। মানুষের ভোগ ও জীবন-জীবিকা উন্নয়নের নিমিত্ত গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দ্বারা কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে পৃথিবীতে আসা সূর্যকিরণ গ্রিন হাউসের প্রভাবে তাপে রূপান্তরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে আবদ্ধ হচ্ছে, ক্রমাগতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের আবহাওয়ার ধরন ও ঋতুবৈচিত্র্য পাল্টে দিচ্ছে। পরিবর্তিত এ জলবায়ুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ইত্যাদি ঘটার সম্ভাবনা, মাত্রা, তীব্রতা ও ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব দুর্যোগে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদহানি হচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবিকার ওপর। আমাদের মৎস্য সম্পদও পরিবর্তিত এ জলবায়ুতে ব্যাপকহারে নেতিবাচক প্রভাবে প্রভাবিত।
মৎস্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও বিপন্নতা (Risk and vulnerability in fisheries sector) আপদ মোকাবিলার সক্ষমতার বিবেচনায় কোনো আপদ দুর্যোগে রূপান্তরিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তাই ঝুঁকি ও বিপন্নতা। পরিবর্তিত এ জলবায়ুতে দেশের সামগ্রিক কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থা, ভূমির ব্যবহার পদ্ধতি, জীবনধারণের কৌশল ও জীবিকা যেমন ঝুঁকিপ্রবণ, ঠিক তেমনই মৎস্য খাতও মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপ্রবণ ও বিপন্ন। দেশের মৎস্য খাতে সার্বিক ঝুঁকি ও বিপন্নতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
জলজ আবাস ও জীববৈচিত্র্যের ক্রমাবনতি;
মাছের প্রজনন, নার্সারি ও উৎপাদন এলাকার পর্যায়ক্রমিক হ্রাস;
প্লাবনভূমিসহ বিল ও অন্যান্য জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যাওয়া;
নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া;
ভূনিম্ন পানির স্তরের নিম্নগামিতা;
বিল-বাঁওড়ের সাথে নদীর সংযোগ বিছিন্ন হওয়া;
মাছের অভিপ্রয়াণ পথ ভরাট ও বন্ধ হওয়া;
দিন-রাত ও ঋতুভেদে তাপমাত্রার অতি পার্থক্য/বৃদ্ধি;
বৃষ্টিপাতের মাত্রা, তীব্রতা, সময় ও ধরনে পরিবর্তন;
বন্যা, খরা, ঝড়, তাপদাহ, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি এবং
ঋতুবৈচিত্র্যে, পানির গুণাগুণ এবং পরিমাণে পরিবর্তন।
মৎস্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব (Climate change impact in fisheries sector)
জলবায়ু পরিবর্তনে মৎস্য খাতে প্রভাব প্রধানত তিনটি পর্যায়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে প্রথমত উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাব; দ্বিতীয়ত, মাছ চাষের উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাব এবং তৃতীয়ত, মাছের সাথে সংশ্লিষ্ট সব মহলের জীবিকায় প্রভাব। মৎস্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় : উন্মুক্ত জলাশয়ের সার্বিক মাছ উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তনের সুস্পষ্ট বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, যা সমগ্র মৎস্য খাতের জন্য উদ্বেগজনক। উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো-
নদীসহ সব সংযোগ খালের নাব্য হ্রাস পাওয়ায় পানির প্রবাহ বন্ধ বা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া।
আবাসস্থল নষ্ট বা সংকুচিত হওয়ার কারণে প্রজনন কম হওয়ায় উন্মুক্ত জলাশয়ে নতুন মজুদ কমে যাচ্ছে।
প্লাবনভূমিসহ বিল ও অন্যান্য জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বা পানি কমে যাওয়ায় সেচে মাছ ধরার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বা জলাশয়ের মাছের বংশ ধ্বংস হচ্ছে।
পলি জমাটের হার বৃদ্ধির কারণে পানি কমে বা শুকিয়ে যাওয়ায় অভিপ্রয়াণ বা স্বাভাবিক বিচরণ বিঘিœত হচ্ছে।
উন্মুক্ত জলাশয়ে পানির অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি; তাপমাত্রার অতি পার্থক্য; বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য হওয়ার কারণে পানির ভৌত-রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলিরক্রমাবনতি হচ্ছে।
সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে নদীর উজানে লোনাপানির অনুপ্রেবেশের ফলে স্বাদু পানির জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলের মাছের প্রজননসহ স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
উপরিউক্ত বিবিধ কারণে মাছের পরিপক্বতায় ও প্রজননকাল পরিবর্তন হচ্ছে এমন কি অঞ্চলভেদে কোন কোন মাছ তাদের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় প্রজনন বিরত রাখছে।
মাছের জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, কোন কোন মাছ বিপন্ন অবস্থায় আছে যেমন- মলা, টেংরা, বজুরি, বাতাশি, শিং, পাবদা, গুলশা, আইড়, মেনি/ভেদা, রিঠা, বাঁশপাতা, কাউনিয়া, রায়েক/টাটকিনি, সরপুঁটি, জাতপুঁটি, চ্যাং, টাকি/লাটি, শোল, গজার, বাইম, গুচি, তারাবাইম ইত্যাদি। এ ছাড়াও কিছু মাছ (কাউনিয়া, এলঙ্গ, রিঠা, পাবদা, ফ্যাসা, শিলং, বাচা ও ঘাওড়া) নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
বদ্ধ জলাশয়
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানান কারণে মাছ চাষে সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে যা মৎস্য খাতের জন্য সতর্কতামূলক। মাছ চাষে উল্লেখযোগ্য প্রভাবের ক্ষেত্র ও কারণসমূহ নিম্নরূপ-
হ্যাচারির উৎপাদন ব্যবস্থা : প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি, উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা এবং দিবা-রাত্র তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে হ্যাচারিতে ব্রুড মাছসহ পোনার উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে এমনকি কোনো কোনো এলাকায় হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মাছ চাষ উৎপাদন ব্যবস্থা : পুকুরসহ চাষ উপযোগী সব জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা ও পানি ধারণকাল হ্রাস; ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া; পানির ভৌত-রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলির অবনতি এবং উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রার অতি ওঠানামার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মাছ চাষিরা বিপাকে রয়েছেন।
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ
সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে নদীর উজানে লোনাপানির অনুপ্রবেশ।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলের মাছের প্রজননসহ স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
সাগর ও উপকূলে ইলিশ মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্রের পরিবর্তন।
উপকূলীয় এলাকায় মাছের প্রজাতি বৈচিত্র্য ও প্রাপ্যতায় পরিবর্তন।
ফিশিং গ্রাইন্ড পরিবর্তন।
সামুদ্রিক মাছ অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন ও নার্সারি ক্ষেত্র পরিবর্তন ও নষ্ট।
জীবন-জীবিকা
উন্মুক্ত জলাশয়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সার্বিক মাছ উৎপাদন ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়ায় প্রতি দিনের মাছ আহরণের গড়হার ক্রমাবনতির ফলে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী যেমন- জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা বিপন্ন। দেশব্যাপী জেলে সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫% এরই মধ্যে তাদের আদি জীবিকা পরিবর্তন করে অন্য জীবিকা ধারণের চেষ্টা করছে।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে মৎস্য খাতের ঝুঁকি ও প্রভাব মোকাবিলায় করণীয়
(Stapes to address climate change impact in fisheries sector)
মৎস্য খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় ও দায়িত্ব সবারই। তাই প্রয়োজন এ খাতে স্থিতিশীল উন্নয়ন উপযোগী মৎস্য ব্যবস্থাপনা কৌশল সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা।
উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের আবাসস্থলের উন্নয়নসহ মাছের প্রাচুর্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কার্যক্রম গ্রহণ;
নদী, খাল ও বিলসহ সব প্লাবনভূমির সংযোগ খাল উন্নয়নের মাধ্যমে অবাধ পানি প্রবাহের কার্যক্রম গ্রহণ করা;
পানির গুণগতমান ও পরিমাণের ঘাটতি এবং তাপমাত্রার পার্থক্য মোকাবিলায় হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ ও কার্যক্রম গ্রহণ;
মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও দুর্যোগের ক্ষতি মোকাবিলায় প্রতিরোধমূলক ও অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণ;
বিরূপ পরিবেশে ও স্বল্প সময়ে চাষ করা যায় এমন মাছের প্রজাতির চাষ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ;
এলাকাভিত্তিক উপযোগী স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা;
জলাধার নির্মাণ ও যথাযথ ব্যবহার করা;
ভূগর্ভস্থ পানির নিয়ন্ত্রিত উত্তোলন ও পুনঃব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ;
ভূগর্ভস্থ পানি পুনঃপূরণের নিমিত্ত কার্যক্রম গ্রহণ;
উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের কৌশল নির্ধারণ;
লবণাক্ততা সহনশীল প্রজাতির চাষ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ;
মৎস্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয় সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা এবং অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণ; এবং
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন বিষয়ক অনুমোদিত অনুস্বাক্ষরিত দলিলপত্রের সাথে সমন্বয় করে নীতিমালা প্রণয়ন এবং কার্যক্রম গ্রহণ।
মৎস্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন (Adaptation in Fisheries sector due to climate change)
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষের জীবন ও জীবিকায় ঝুঁকি হ্রাস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় গৃহীত উপযোগী কৌশল হলো জলবায়ু পরিবর্তনে ‘অভিযোজন’। তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মৎস্য খাতের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের নিমিত্ত গৃহীত কৌশলই হবে মৎস্য খাতের অভিযোজন। মৎস্য খাতে উন্মুক্ত জলাশয় ও মৎস্য চাষ উভয়ের জন্যই অভিযোজন প্রয়োজন।
উন্মুক্ত জলাশয়ের উপযোগী অভিযোজন- মাছ জলজ প্রাণী, তাই এর প্রাচুর্যতা ও সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সুস্থ জলজ পরিবেশ, যা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিপন্ন হচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন উন্মুক্ত জলাশয়ে অভিযোজন উপযোগী মৎস্য ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণ, কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
উন্মুক্ত জলাশয়ে অভিযোজনের উপযোগী নিম্নের ক্ষেত্রগুলোতে অভিযোজন কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে।
জলজ আবাসস্থল উন্নয়ন ও সংরক্ষণ;
জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (আবাসস্থল উন্নয়ন ও অভয়াশ্রম স্থাপন);
মাছের মজুদ বৃদ্ধি (জলজ আবাসস্থল উন্নয়ন, অভয়াশ্রম স্থাপন ও বিল নার্সারি);
নদী, বিল, প্লাবনভূমি, বাঁওড় ও দামুস/কোলে সমাজভিত্তিক জলাশয় ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ;
সব সংযোগ খালের উন্নয়ন যাতে অবাধ পানির প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা যায়;
পানির গভীরতা বৃদ্ধি (নদী, খাল, বিল খনন/পুনখনন) এবং
মাছের সব অভিপ্রয়াণ পথ সচল ও নির্বিঘ্ন করা।
মাছ চাষে সম্ভাব্য অভিযোজন কৌশল- মাছ চাষে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ আপদ মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত করছে এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। মাছচাষে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবেলা ও ঝুঁকি হ্রাসের জন্য অভিযোজন উপযোগী চাষযোগ্য মাছ চিহ্নিতকরণ; অভিযোজন উপযোগী মাছ চিহ্নিতকরণ, এর চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ কাজগুলো অতীব জরুরি। তাই-
সব পর্যায়ে মাছ চাষে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, প্রভাব ও দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা;
কম ও বেশি তাপমাত্রা সহনশীল মাছের প্রজাতি নির্ধারণ, চাষ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ;
স্বল্প সময়ে বাজারজাতযোগ্য মাছ চাষের প্রজাতির চাষ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ;
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও দুর্যোগ বিবেচনায় নিরাপদ মাছ চাষ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং লবণাক্ততা সহনশীল প্রজাতি মাছের চাষ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ।
ইতোমধ্যেই মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমনÑ আবাসস্থল উন্নয়ন, অভায়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, উন্মুক্ত জলাশয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে মৎস্যচাষ, পোনা অবমুক্তি, বিল নার্সারি, জলবায়ু সহিষ্ণু মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করে। তাছাড়াও জেলেদের পুনর্বাসন ও ঝুঁকি মোকাবিলায় ভিজিএ ও এআইজি কার্যক্রমসহ পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
পৃথিবীর জলবায়ু আজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। এ তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে পানি বরফ, তরল ও বাষ্পীয় অবস্থায় অবস্থান করে এবং বায়ুপ্রবাহ অব্যাহত থাকে, যা চক্রাকারে পৃথিবীর সমস্ত অংশে জীবকুলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানির প্রবাহ বিদ্যমান রেখে জৈবিক ক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। অথচ বর্তমানে তাপমাত্রার অতি বৃদ্ধিতে পৃথিবীতে পানি ও বায়ুর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি/অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা প্রভৃতি আবহাওয়াজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে দেশের মৎস্য খাত ও এ খাতের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা আজ সংকটাপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের এ হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের মৎস্য খাত তথা জাতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের দায় ও করণীয় ন্যূনতম, অথচ দেশে এর প্রভাব গুরুতর। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিরোধ ও মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত দেশের সম্পদ রক্ষা করে আত্মরক্ষার কাজ আমাদেরই করতে হবে।
ড. আলী মুহম্মদ ওমর ফারুক*
*সিনিয়র সহকারী পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা
বাংলাদেশের বিপদাপন্ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে এবং আয় রোজকার বাড়াতে গবাদিপ্রাণী ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের গুরুত্ব অপরিসীম। সম্প্রতি ঘন ঘন এবং অসময়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পরিবর্তিত বন্যাকালীন পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে গবাদিপ্রাণী ও পাখির বাসস্থানের ঝুঁকি, গোখাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা এবং নানা ধরনের রোগব্যাধির আশঙ্কা। এসব ঝুঁকির অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে নিচু স্থানে গবাদিপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থল তৈরি, নিরাপদ উঁচু স্থানের অভাব, চারণভূমি প্লাবিত হওয়া, স্থানীয়ভাবে চিকিৎসক ও ওষুধপত্রের অভাব এবং প্রস্তুতি ও ঝুঁকি হ্রাস সম্পর্কে জনগোষ্ঠীর যথাযথ পদক্ষেপের অভাব ও অসচেতনতা।
উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ জেলাগুলোর পানিতে আশঙ্কাজনকভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় শুধু মানুষই নয়, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির জীবনধারণও আজ মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। লবণাক্ত পানি পান করার ফলে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে উপকূল অঞ্চলে দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের চরম অভাব। একই সাথে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা এবং তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির বাসস্থান ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনগোষ্ঠীকে নানা বিপাকে পড়তে হচ্ছে। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এসব রোগব্যাধির মধ্যে ক্ষুরা রোগ, বাদলা, তড়কা রোগ, কৃমি, রানীক্ষেত ইত্যাদি। কখনও কখনও এসব রোগ মহামারী আকার ধারণ করে এবং বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবার অভাব এবং গবাদিপ্রাণী ও হাঁস-মুরগি পালনে জনগোষ্ঠীর যথাযথ প্রস্তুতি, ঝুঁকি হ্রাস পদক্ষেপের অভাব ঝুঁকির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অভাব ও অনিয়ম; খরাপ্রবণ অঞ্চলে খরার তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে মানুষের সাথে সাথে গবাদিপ্রাণী ও পাখি পালন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খরা মৌসুমে তীব্র রৌদ্র তাপের কারণে মাঠ-ঘাট সব শুকিয়ে যাওয়ায় সবুজ ঘাসশূন্য হয়ে যায়, গবাদিপ্রাণী ও পাখির খাদ্যাভাব মারাত্মক আকার ধারণ করে। খাদ্য ঘাটতির কারণে গবাদিপ্রাণীর দুর্বলতা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, গর্ভপাত দুধ কমে যাওয়া, রক্ত স্বল্পতা ইত্যাদি স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় হিটস্ট্রোকে অনেক মুরগি মারা যায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। খরার পরে বৃষ্টি হলে নতুন গজানো ঘাসে নাইট্রেটের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ায় গবাদিপ্রাণীর নাইট্রেট বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনগোষ্ঠীর অজ্ঞতা, যথাযথ প্রস্তুতি ও ঝুঁকি হ্রাস পদক্ষেপের অভাব গবাদিপ্রাণী ও পাখি পালনে ঝুঁকির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলে।
জলবাযু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে শীতের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এ সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। প্রচণ্ড শীতের কারণে হাঁস-মুরগির বাচ্চার মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। খাদ্য গ্রহণ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। গবাদিপ্রাণী ও হাঁস-মুরগির শরীরে তীব্র পুষ্টির অভাবজনিত রোগ এবং গবাদিপ্রাণীর চর্মরোগ দেখা দেয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় এ সমস্যা কৃষক-খামারিদের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কালবৈশাখীর প্রভাব ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে চৈত্র এবং বৈশাখ মাসে দেশের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে আবার কখনও দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে প্রচ- বেগে প্রবাহিত বাতাস গবাদিপ্রাণী ও হাঁস-মুরগির আবাস স্থলকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়াসহ ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের মাধ্যমেও গবাদিপশুর ব্যাপক জীবনহানির ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হযে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাণিসম্পদের বিপন্নতা : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাজুক অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিক নির্ভরতা এ বিপদাপন্নতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অভিযোজন (Adaptation)
অভিযোজন হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যে পরিস্থিতি উত্তরণে গৃহীত কৌশলকে জলবায়ু ঝুঁকি অভিযোজন বলা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রাণিসম্পদের অভিযোজন কৌশল (Livestock Adaptation Technology to Climate Change) : আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে জলবায়ু পবির্তনের ঝুঁকি ও অভিঘাত মোকাবিলায় সব সর্বস্তরে খাপ খাওয়ানো, অভিযোজন করণীয় ও দায়িত্ব রয়েছে।
প্রাণিসম্পদর অভিযোজনে যেসব খাতকে প্রাধান্য দিয়ে কৌশল নির্ধারণ করা যায়; সেগুলো হলো-
পানি : বৃষ্টির পানি ধারণ, পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল রপ্ত করা, ব্যবহৃত পানি পুনরায় ব্যবহার, লবণাক্ততা দূরীকরণ, গবাদিপ্রাণী ও পাখির জন্য পানি ব্যবহার ।
প্রাণিসম্পদ ও কৃষি : অঞ্চলভিত্তিক দুর্যোগ সহনশীল জাতের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন সব করা। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দুর্যোগ সহনশীল জাতের প্রাণী উৎপাদন করা। যেহেতু প্রাণী উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণী ব্যবস্থাপনায় যে শস্য সরাসরিযুক্ত ওইসব শস্যের চাষকে উৎসাহিত করা, ফডার বৃক্ষ ও ফলমূলের চারা রোপণ, দুর্যোগসহনশীল ঘাসের প্রচলন, অঞ্চলভিত্তিক ঘাস উৎপাদনের প্রযুক্তিসমূহ জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করা, কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা, ভূমি ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বৃক্ষ রোপণ।
দুর্যোগ সহনশীল ক্যাট্ল ব্রিড হাইব্রিড নেপিয়ার
নেপিয়ার একটি উন্নত জাতের এবং বহুবর্ষজীবী দ্রত বর্ধনশীল ঘাস। সহজে চাষ করা যায় এবং একবার চাষ করলে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ঘাস পাওয়া যায়।
চাষ পদ্ধতি
জলাবদ্ধ স্থান ছাড়া বাংলাদেশের সব ধরনের মাটিতে এমনকি পাহাড়ের ঢালে ও সমুদ্র তীরবর্তী লবণাক্ত জমিতেও জন্মে। উত্তমরূপে চাষ করে জমি তৈরি করতে হয়। কাদামাটিতেও লাগানো যেতে পারে। বছরের যে কোনো সময় এ ঘাস চাষ করা যায় তবে উত্তম সময় হচ্ছে ফাল্গুন চৈত্র মাস। চাষের জন্য শতাংশ প্রতি ১০০ কাটিং বা মোথা প্রয়োজন হয়। রোপণের ক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইন ১.৫ ফুট বা এক হাত এবং মোথা থেকে মোথার দূরত্ব ১.৫ ফুট বজায় রাখতে হয়। জমি তৈরিতে শতাংশ প্রতি গোবর-জৈবসার ৬০-৭০ কেজি, ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি ২০০ঃ২৮০ঃ১২০ গ্রাম এবং ঘাস লাগানোর এক মাস পর ইউরিয়া ২০০-৩০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া প্রতিবার ঘাস কাটার পর ইউরিয়া ২০০-৩০০ গ্রাম প্রতি শতকে প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। খরা মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর, গ্রীষ্মকালে ৩০-৪৫ দিন পর পর এবং শীতকালে ৫০-৬০ দিন পর পর সেচ দিতে হয়। ১ম বছর ৫-৬ বার, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ বছর ৭-৯ বার ঘাস কাটা যায়।
ফলন ও লাভ
অন্যান্য ঘাসের চেয়ে এর পুষ্টিমান অনেক বেশি, এজন্য নেপিয়ার ঘাস গরুকে খাওয়ালে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, দ্রুত ওজন বাড়ে, পুষ্টির ঘাটতি কমানো যায় এবং গরুর খাদ্য খরচ কম হয়। বছরে শতাংশপ্রতি ৭০০-৯০০ কেজি ঘাস পাওয়া যায়।
ঘাসের প্রাপ্তিস্থান
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, ব্যক্তি মালিকানাধীন খামার এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার, ঢাকা।
অবকাঠামো : পুনর্বাসন, ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধক্ষম বাসস্থান ও বসতি স্থাপন, খানা পর্যায়ে এবং এলাকাভিত্তিক মজবুত এবং স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র/মাটির কিল্লা স্থাপন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ প্রতিকূল সময়ে ব্যবহারের জন্য জলাধার স্থাপন। প্রাণিসম্পদের সেবা ও সম্প্রসারণের জন্য লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক অবকাঠামো স্থাপন।
প্রাণী স্বাস্থ্যসেবা/জনস্বাস্থ্য : ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণী এবং প্রাণিজ পণ্য দূষণমুক্ত, জীবাণুমুক্ত এবং জনস্বাস্থের সহায়কভাবে উৎপাদন করা। জলবায়ুজনিত রোগ নির্ণয়, রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক রোগসমূহ মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরি করা। প্রাণী রোগ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নিবিড় টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন। প্রাণিসম্পদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ভেটেরিনারি সার্ভিসের পরিধি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করা, সার্ভিসের মান বৃদ্ধি করা এবং জনবল তৈরি করা।
অভিযোজন কৌশলে গবাদিপ্রাণী ও পাখির রোগ প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি
যোগাযোগ : পুনর্বিন্যাস ও পুনর্বাসন; প্রাণীর উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। চাহিদামাফিক রাস্তা নির্মাণ, মেরামত এবং অবকাঠামো স্থাপন করা। দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান এবং যোগাগের জন্য আইসিটি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবহার করা।
শক্তি : গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সম্ভাব্য গ্রিন হাউস গ্যাসকে রিসাইক্লিংকরে পুনঃব্যবহারের প্রচলন করা। প্রাকৃতিক নির্ভরতাকে কমিয়ে এনে সৌরবিদ্যুৎ বা রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করা। উৎপাদিত শক্তিকে রান্নাসহ পারিবারিক সব কাজে ব্যবহার করে জাতীয় গ্রিডের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
বিভিন্ন ধরনের অভিযোজন (Different Types of Adaptation)
কাঠামোগত অভিযোজন (Structural Adaptation) : এ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে প্রচলিত প্রযুক্তিগুলোর কিছুটা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে অভিযোজিত হওয়া যায়। যেমন- বন্যার জন্য গবাদিপ্রাণী ও পাখির ঘর উঁচু করা, মজবুত কাঠামো দিয়ে ঘর তৈরি করা।
অ-কাঠামোগত অভিযোজন (Non-structural Adaptation) : অনেক ক্ষেত্রে জীবন চর্চা ও ব্যবহারে পরিবর্তনের মাধ্যমেই খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজিত হওয়া সম্ভব। যেমন- ঝুকিপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে গিয়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন ।
নিবৃত্তিমূলক অভিযোজন(Anticipatory Adaptation) : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়ার আগেই অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন- বন্যার আগেই খাদ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, টিকা প্রদান করা, জরুরি ওষুধপত্র মজুদ রাখা।
প্রতিক্রিয়ামূলক অভিযোজন (Reactive Adaptation) : জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো পরিলক্ষিত হওয়ার পর যে অভিযোজন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয় তাকে প্রতিক্রিয়ামূলক অভিযোজন বলা হয়। যেমন- লোনা এলাকায় লোনা সহনশীল ঘাষের প্রচলন করা। আকস্মিক বন্যা এলাকায় হাঁস চাষের প্রচলন করা। হাঁস পালন, ভেড়া পালন, ছাগল পালন। এসব পরিকল্পিতভাবে করা।
ডা. মো. রফিকুল ইসলাম*
*ফোকাল পয়েন্ট (দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন) ও ইউএলও, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ফার্মগেট, ঢাকা
পরিবেশ বাঁচান
অ্যাডভোকেট আলেয়া রাহাত*
লিখতে বসেছি কবিতা আমি হবে কিনা জানিনা
হোক বা না হোক আমি তা নিয়ে ভাবিনা।
শুধু ভাবি পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো একান্ত প্রয়োজন
এই কথাটি সকলকে করিয়ে দিতে চাই স্মরণ।
পরিবেশ বাঁচাতে পারিনা আমি তবুও করছি চেষ্টা
লিখতে পারিনা কবিতা আমি তবুও দেখব শেষটা।
রূপ দিতে পারিনা আমি কবিতার ছন্দে
তাই নিয়ে আছি আমি মহা দ্বিধা দ্বন্দ্বে।
ঠেকাতে হলে পরিবেশ বিপর্যয়,
বেশি করে গাছ লাগাতে হয়।
গাছের মধ্যে সেরা গাছ পামঅয়েল
পরিবেশের জন্য এই গাছ জুয়েল।
অক্সিজেন দিবে অন্য গাছের চেয়ে দশগুণ
আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড করবে শোষণ।
মাটির ক্ষয়, ঝড় বন্যা আর জলোচ্ছ্বাস
সবচেয়ে বেশি ঠেকাতে পারে পামগাছ।
যে কোন জায়গায় ফলাতে পারেন এই গাছ
এ থেকে উপকার পাবেন বারোমাস।
গাছ হল পরিবেশের বন্ধু গাছ অমূল্য
গাছ আমাদের জীবন মরণ প্রকৃতির পুকুর তুল্য।
গাছ হল আল্লাহর দান গাছ ছাড়া সব বেমানান।
খাদ্য বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা থাকার বাসস্থান
গাছবিনা কার সাধ্য করে এর সংস্থান।
অর্থ বিত্ত সবই পাবে এই কথাটি মিথ্যা না
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে গাছের তুলনা হয়না।
জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে করলে ব্যবহার বায়োগ্যাস
পরিবেশ বাঁচবে, শ্রম বাঁচবে পাবে শহরের পরিবেশ।
তার ওপর আরও পাবে জমির সার মাছের খাবার
কৃষি প্রধান দেশেতে ভাই পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ দরকার।
গোবর দিয়ে ঘুটে বানিয়ে পরিবেশ দূষণ করে
পাবে দূষিত জ্বালানি আর পাবে কিছু ছাই।
এর বেশি পাওয়ার কিন্তু কোন উপায় নাই।
ফসল উৎপাদনে জৈবসারের কোন তুলনা নাই
খরকুটো, আর্বজনা, গোবর্জ্য মানববর্জ্য ও বিষ্ঠাতে তা পাই
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক করলে ব্যবহার
উর্বরতা নষ্ট হবে উৎপাদন শীলতার
জৈবসার আর জৈব কীটনাশক জমির হল প্রাণ
কৃষকের জন্য ভাইরে এটা হলো বছরব্যাপী ত্রাণ।
উৎপাদন ব্যয় কম হবে অর্থ হবে সাশ্রয়
জৈবসারে রক্ষা করবে সকল জমির ক্ষয়।
চেষ্টা যদি করে কৃষক ব্যর্থ হবেনা।
এর চেয়ে সহজ উপায় আর তো পাবেনা।
পণ কর আজ সবাই মিলে কৃষক শ্রমিক জেলে
রাখবনা আর কোন জমি অনাবাদি ফেলে।
যে ভাবেই হোক খাদ্যের অভাব করব মোরা দূর
সোনালি ফসলের আগমনে আনব নতুন ভোর।
অভাব অনটন রইবে নাকো থাকবে না কোন ক্লেশ
বিশ্বের মাঝে পরিচিতি পাবে সোনার বাংলাদেশ।
সবুজের সমারোহে মধুর পরিবেশ
সকল দেশের সেরা সে যে আমার বাংলাদেশ।
বাঁচলে পরিবেশ, বাঁচবে আমাদের দেশ
কবিতাখানি আমার এখানেই শেষ।
খাদ্য ও পুষ্টি
কৃষিবিদ ড. মো. শাহ কামাল খান**
বাঁচার জন্য যা খাওয়া হয়
তাই হলো খাদ্য,
আর পুষ্টি হলো তাই
যা কাজে লাগে দেহের জন্য।
অপুষ্টি ও অতিপুষ্টি
দু’টোই দেশে ডজন ডজন
পুষ্টিতে সচেতন হওয়া
সব মানুষের প্রয়োজন।
শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার
জোগায় দেহের শক্তি,
পরিমিত পরিমাণে খেলে তা
দুর্বলতা হতে পাবে মুক্তি।
আমিষের প্রধান কাজ
শরীর গঠন করা,
মাছ, মাংস, ডিম, ডাল
আছে আমিষে ভরা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো
ভিটামিন-খনিজের দায়িত্ব,
শাকসবজি ফলমূল
খেতে হবে নিয়মিত।
সুষম খাবারের কোন
বিকল্প যে নাই,
সবজি-খিচুড়ি দুধ-ভাত
মাঝে মাঝে খাওয়া চাই।
*জজকোর্ট, খুলনা, মোবাইল : ০১৭১৬১৬৪৭১৮; **সিনিয়র মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অফিসার, সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১২১৮৪২৭৪
মো. দেলোয়ার হোসেন
পলাশবাড়ি, বীরগঞ্জ, দিনাজপুর
প্রশ্ন : ধানের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আর পাতাতে বাদামি/কালো ছোট ছোট দাগ পড়ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি ধানের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এর জন্য
-জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে
-পর্যায়ক্রমে জমি শুকনো ও সেচের ব্যবস্থা করতে হবে
-আক্রান্ত জমিতে ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে তা ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে
-সুষম সার ব্যবহার করতে হবে
-পরবর্তীতে বীজ শোধন করতে হবে
মো. আলমগীর
চণ্ডীপুর, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : পানের বরজে পানের গোড়া পচে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি পানের গোড়া পচা রোগ। এর জন্য
-বরজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
-আক্রান্ত লতা সংগ্রহ করে পুড়ে নষ্ট করতে হবে
-সরিষার খৈলের সাথে ডায়াথেন এম-৪৫ বা কুপ্রাভিট মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
-রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে
আকরামুল হাসান
গ্রাম- বালিচান্দা, থানা- ফুলপুর
জেলা- ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : ঢেঁড়স গাছের পাতা ছোট হয়ে যাচ্ছে, শিকড়ে প্রচুর গিঁট দেখা যায়। ফলন কম হচ্ছে। কী করলে উপকার পাবো।
উত্তর : এটা ঢেঁড়স গাছের কৃমিজনিত রোগ। এটি মাটিবাহিত রোগ। কৃষি যন্ত্রপাতি, আক্রান্ত চারা, মাটি ও সেচের পানি দ্বারা রোগ দ্রুত ছড়ায়। আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ না করা। চারা উৎপাদনে বীজতলায় ৬ সেন্টিমিটার পুরু স্তরে কাঠের গুঁড়া বিছিয়ে দিয়ে পোড়ালে কৃমি ও অন্যান্য রোগজীবাণু দমন হয়। দানাদার শস্য আবাদ করে জমির শিকড় গিঁট কৃমি কমানো যায়।
ফুরাডান (কার্বফুরান) বা মিরাল হেক্টরপ্রতি ২৫ কেজি হারে ব্যবহার করে কৃমি রোগ সহজে দমন করা যায়।
মো. মমিনুল
গ্রাম- বিষ্ণুপুর, থানা- নেয়ামতপুর
জেলা- নওগাঁ
প্রশ্ন : ধান গাছের কা- পচে যাচ্ছে, কী করণীয়?
উত্তর : এ রোগ ধান গাছে সাধারণত কুশি গজানোর শেষ অবস্থায় মাঠে দেখা যায়। রোগজীবাণু মাটিতেই বাস করে। প্রথমে কুশির বহিঃখোলে ছোট কালো কালো দাগ দেখা যায়। পরে এ দাগ ভেতরের খোলে ও কা-ে প্রবেশ করে। কা- পচিয়ে দেয়, গাছ ঢলে পড়ে, ফলে ধান চিটা ও অপুষ্ট হয়।
রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে পরে আবার সেচ দিতে হবে। জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করা। সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক স্কোর, নাটিভো অথবা কনটাফ প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো. গোলাম রব্বানি
গ্রাম- মকিমপুর, থানা- মিঠাপুকুর
জেলা- রংপুর
প্রশ্ন : বাঁধাকপির পাতা পোকায় খেয়ে কপি নষ্ট করছে, কী করব?
উত্তর : পোকার ডিম ও লেদা হাত দ্বারা বাছাই করতে হবে। ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পোকার আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি সাইপারমেথ্রিন বা ১ মিলি ক্যারাটে স্প্রে করতে হবে।
মো. নূর ইসলাম
গ্রাম- মাঝিপাড়া, থানা- পঞ্চগড়
জেলা- পঞ্চগড়
প্রশ্ন : শসা গাছের পাতাগুলো নেতিয়ে পড়ছে এবং ধীরে ধীরে গাছ মরে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বপনের আগে প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম প্রভেক্স-২০০ দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক গাছের গোড়ায় ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যায়।
সজীব
গ্রাম- তারাটি, উপজেলা- মুক্তাগাছা
জেলা- ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : মুরগির বার্ড ফ্লু আক্রমণ রোধের উপায় কী?
উত্তর : জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জীবাণুনাশক সলিউশন খামারে ঢোকার পথে দিতে হবে। খামারের চারপাশে বেড়া দিতে হবে। খামার অতিথি পাখি মুক্ত রাখতে হবে। আক্রান্ত মুরগি মাটি চাপা দিতে হবে। আবাসস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাইরের পশু-পাখির সাথে যাতে না মিশে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আক্রান্ত মুরগি মেরে ফেলতে হবে এবং মারার সময় অবশ্যই বিশেষ ধরনের পোশাক ব্যবহার করতে হবে।
ফার্মকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। আক্রান্ত মুরগি ধ্বংস করতে হবে। ফার্মের গেটে ঋড়ড়ঃ ইধঃয রাখতে হবে। গামবুট ব্যবহার করতে হবে। খামারে বহিরাগতের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ করতে হবে।
রফিক
গ্রাম- চণ্ডীপুর, উপজেলা- শ্যামপুর
জেলা- সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : মুরগির গামবোরো রোগের চিকিৎসা কী? (লক্ষণ : খাবার খাবে না, অবসাদগ্রস্ত বা ঝিমাবে, রানের মাংসে রক্ত জমাট বাঁধবে?)
উত্তর : গামবোরো ভ্যাকসিন প্রথম ৩-৫ দিনে বুস্টার ডোজ দিতে হবে। আক্রান্ত বাচ্চাকে লেবুর বা গুড়ের স্যালাইন ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে। Tab. Renamycin গুঁড়া করে খাওয়াতে হবে। অথবা Cosomix Plus Power ১ গ্রাম/ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
রিপন মিয়া
গ্রাম- মউতলা, উপজেলা- কালীগঞ্জ
জেলা- সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : ঘেরের প্রস্তুত প্রণালি কী হবে?
উত্তর : ঘের শুকিয়ে তলদেশের পচা কাদা অপসারণ এবং তলদেশ সমান করতে হবে। পাড় উঁচু করে বাঁধতে হবে। ঘেরের পাড়সহ তলায় চুন ভালোভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে। ঘেরের তলদেশ চাষ দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। ছোট মেসসাইজের নাইলন জাল দিয়ে ঘেরের চারপাশে বেড়া (৩ ফুট উঁচু) দিতে হবে। পানি প্রবেশ পথ ও জরুরি পানি নির্গমন পথ করতে হবে এবং তাতে স্ক্রিন বা বানা (বাঁশের পাটা ও নাইলনের জাল দিয়ে তৈরি) দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পরে প্রয়োজনমতো পানি প্রবেশ করিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে- ইউরিয়া ১৫০-২০০ গ্রাম/শতক, টিএসপি ৭৫-১০০ গ্রাম/শতক হারে। এরপর ব্লিচিং পাউডার সমসতম ঘেরে ছিটিয়ে দিয়ে পানি জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
হাসান পেয়াদা
গ্রাম- মির্জাগঞ্জ, উপজেলা- মির্জাগঞ্জ
জেলা- পটুয়াখালী
প্রশ্ন : পানির পিএইচ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
উত্তর : পুকুর বা খামার তৈরির সময় চুন ১ কেজি/শতক হারে ৩-৫ ফুট পানির গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। মজুদ পরবর্তীতে ২৫০-৫০০ গ্রাম/শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ পরীক্ষা করে যদি ৬ এর নিচে থাকে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুনের পরিবর্তে জিওটক্স/জিওলাইট ২৫০ গ্রাম/শতাংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এ ছাড়াও বায়োকেয়ার প্রতি ৭ দিন অন্তর ৮০-১২০ মিলি শতক হারে দিতে হবে প্রতিষেধক হিসেবে। আর নিরাময়ের জন্য পরপর ২ দিন ১২০-১৬০ মিলি শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ aiocp@ais.gov.bd
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। নবান্নের উৎসবের সাথে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। কেননা এ মৌসুমটাই কৃষির জন্য তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত একটি মৌসুম। জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
-রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে; ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলতে হবে;
-আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখতে হবে, এতে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে;
-উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করা যায়।
বোরো ধান
-রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বোরো ধানের বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে;
-চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈবসার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে;
-ঠা-াপ্রবণ এলাকায় শুকনো বীজতলা তৈরি করতে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে;
-যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রিধান২৮, ব্রিধান৪৫ এবং ব্রি ধান৫৫, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নেই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রিধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০, ব্রিহাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২ ও ব্রিহাইব্রিড ধান৩, ঠাণ্ডা প্রবণ এলাকায় ব্রিধান৩৬, হাওর এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭, ব্রিধান৫৫, ব্রি ধান৬১ চাষ করা যায়।
গম
-অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে; দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়;
-বেশি ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- শতাব্দী, সুফী, বিজয়, প্রদীপ, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব, বারি গম-২৫, বারি গম-২৬ এসব বপন করতে হবে;
-বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে;
-সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে;
-গমের ভালো ফলন পেতে হলে প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০-৭০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০-৪০০ গ্রাম এমওপি, ৪০০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে;
-ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
-গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ , ৪৫-৬০ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে তৃতীয় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা
-ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে;
-ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১ এসব;
-এক হেক্টর জমিতে বীজ বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভুট্টা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে খই ভুট্টা বা হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজের মাত্রা এর অর্ধেক হবে;
-ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি রাখতে হবে;
-সাধারণভাবে প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ১-১.৫ কেজি, টিএসপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০-৬০০ গ্রাম, জিপসাম ৬০০-৭০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
-তেলের জন্য সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন;
-সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে শতাংশ প্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
-উপরি সার প্রয়োগ করে হালকা একটি সেচ দিতে হবে; মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর সেচ দিতে হবে।
আলু
-উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসে আলু আবাদ শুরু করা যায়; অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে;
-মাটির কেইল বেঁধে মাটি তুলে দিতে হবে এবং সারের উপরিপ্রয়োগ, সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ডাল ফসল
-মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাষ, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে।
-সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিষ্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সব ক‘টি পরিচর্যা সময়মতো যথাযথভাবে করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
-এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিল, তিষি, যব এসব বপন করা যায়।
শাকসবজি
-ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে;
-চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
-সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে;
-টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে;
গাছপালা
-রোপণ করা গাছের যতœ নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে।
-মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
-হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। শীতকালে পোলট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল, টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
-এ সময় পশুখাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। তাই আমন ধানের খড়সহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন।
-এ সময় গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপ্রাণীতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
-মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবড়/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে; জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে;
-প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন;
-পুকুরে রৌদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে;
-পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসলের সাথে কার্পজাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, অগ্রহায়ণ মাসের করণীয় উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ ioag@ais.gov.bd
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা, লবণাক্ততা, অধিক তাপ, অধিক ঠাণ্ডা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইক্ষু একটি অর্থকরী খাদ্য ও শিল্পজাত ফসল, যার চাষ দিনকে দিন নিচু চরাঞ্চল, পাহাড় এবং প্রান্তিক প্রতিকূল পরিবেশপ্রবণ খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) ইক্ষু চাষভিত্তিক নানাবিদ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
বিএসআরআই মূলত দেশের পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষ উপযোগী উচ্চফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ইক্ষু জাত উদ্ভাবন, তার চাষাবাদ প্রযুক্তি, রোগবালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি, সেচ ও পানি নিষ্কাশন, ইক্ষু ফসলকে আরও লাভজনক করার জন্য ইক্ষুভিত্তিক ফসল বিন্যাস, ইক্ষুর সাথে একাধিক সাথীফসল চাষ, মুড়ি ইক্ষু চাষ, ইক্ষু চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন, উদ্ভাবিত প্রযুক্ত সম্প্রসারণ প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অদ্যাবধি বিএসআরআই ৪৫টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় চাষাবাদ উপযোগী। এছাড়া অন্যান্য প্রযুক্তির সাথে আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে ৩০টিরও বেশি প্রযুক্তি প্যাকেজ সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইক্ষু চাষের প্রতিকূল পরিবেশ হলো নিম্ন তাপমাত্রা বা অধিক ঠাণ্ডা, খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ততা। ইক্ষুর জীবনচক্রে নিম্ন তাপমাত্রা অংকুরোদগম ও প্রাথমিক কুশি পর্যায়ে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে; খরা অংকুরোদগম ও প্রাথমিক কুশি পর্যায়ে নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে; জলাবদ্ধতা নাবি কুশি পর্যায়, আখের বৃদ্ধি ও কখনও কখনও আখের পরিপক্ব পর্যায় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে; বন্যা আখের বৃদ্ধি পর্যায় ও পরিপক্ব পর্যায় জুন থেকে আগস্ট মাসে এবং লবণাক্ততা অংকুরোদগম থেকে আখ কর্তন পর্যায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসে ইক্ষু চাষে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
১. ইক্ষু জাত উদ্ভাবন কার্যক্রম : বিএসআরআই পরিবর্তিত জলবায়ুগত অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে চাষের জন্য ৪৫টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। ওই ইক্ষু জাতগুলো দেশের চিনিকল এলাকার প্রায় ৯৯% এবং চিনিকল বহির্ভূত গুড় এলাকায় প্রায় ৫৭% এলাকাজুড়ে চাষাবাদ হচ্ছে। বিএসআরআই উদ্ভাবিত ইক্ষু জাতগুলোর গড় ইক্ষুর ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনের বেশি এবং আখে চিনির পরিমাণ ও ১২% এর ঊর্ধ্বে। বিএসআরআই আখ ৪১ জাতটি চিনি ছাড়াও গুড়, রস তৈরি এবং চিবিয়ে খাওয়ার জন্য বিশেষ উপযোগী। গড় ফলনও হেক্টরপ্রতি ১৫০ টনের ঊর্ধ্বে। নিম্ন তাপমাত্রায় ইক্ষুর অংকুরোদগম ভালো হওয়ার জন্য ঠাণ্ডা সহিষ্ণু ইক্ষু জাতও উদ্ভাবন করা হয়েছে। টিস্যুকালচারের মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের জন্য বিএসআরআই আখ ৪৩ উদ্ভাবন করা হয়েছে।
খরাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয় : খরা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ, ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ইক্ষু রোপণ সম্পন্ন করা, ২৫-৩০ সে. গভীর নালায় ইক্ষু রোপণ, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ইক্ষু রোপণের সময় পটাশ সারের সুপারিশকৃত মাত্রার অতিরিক্ত হিসেবে হেক্টর প্রতি ৮২ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করা, ইক্ষু রোপণের পর পরই ইক্ষুর গোড়ায় ও নালায় ১০-১৫ সেমি. পুরু করে ট্রাস দিয়ে ঢেকে দেয়া, সেচ সুবিধা থাকলে খরার সময় সেচ দেয়া এবং সেচ সুবিধা না থাকলে খরা চলাকালীন ইক্ষুর পাতার দুই-তৃতীয়াংশ অংশ কর্তন করে দেয়া।
বন্যাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয় : বন্যা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ করা, আগাম ইক্ষু রোপণ করা, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিকও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ১৫ মে এর মধ্যে উপরি সার প্রয়োগ সম্পন্ন করা, ইক্ষু রোপণের পর তিন মাস ইক্ষুর আগাছা দমন ও মালচিং নিশ্চিত করা, জুন/জুলাই/আগস্ট মাসে ইক্ষুর মরা ও পুরনো পাতা এবং প্রতি ঝাড়ে ৫-৬টি সুস্থ কুশি রেখে অতিরিক্ত কুশি কর্তন করা, ইক্ষুর জমি বন্যায় প্লাবিত হওয়ার আগেই ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দেয়া, জমিতে স্রোতের ফলে ইক্ষুর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে জমির আইল (সীমানা) বরাবর ধৈঞ্চা বপন করা, ইক্ষুর জমি হতে পানি নেমে গেলে যথাসম্ভব দ্রুত ইক্ষু কর্তন ও মাড়াই করা,
জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় ইক্ষু চাষে করণীয়
জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ইক্ষু জাত রোপণ করা, আগাম ইক্ষু রোপণ করা, ইক্ষু রোপণের সময় সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক ও জৈবসার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ১৫ মের মধ্যে উপরি সার প্রয়োগ করা, ইক্ষু রোপণের পর তিন মাস ইক্ষুর আগাছা দমন ও মালচিং নিশ্চিত করা, ১৫ জুনের মধ্যে ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দেয়া, জুন/জুলাই/আগস্ট মাসে ইক্ষুর মরা ও পুরনো পাতা এবং প্রতি ঝাড়ে ৫-৬টি সুস্থ কুশি রেখে অতিরিক্ত কুশি কর্তন করা, ইক্ষুর জমি জলাবদ্ধতা হওয়ার আগেই ইক্ষুর গোড়ায় মাটি দিয়ে বেঁধে দেয়া, ইক্ষুর জমি জলাবদ্ধতা অবস্থায় জমিতে উৎপাদিত জলজ উদ্ভিদ (ঘাস) এবং শ্যাওলা দমন করা, ইক্ষুর জমি হতে পানি কমে গেলে যথাসম্ভব দ্রুত ইক্ষু কর্তন ও মাড়াই করা।
২. রোপা ইক্ষু চাষ (এসটিপি) প্রযুক্তি
পরিবর্তিত জলবায়ুতে ইক্ষু চাষের জন্য রোপা ইক্ষু চাষ প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে, যা ইক্ষু চাষকে অধিক লাভজনক করতে পারে। নিম্ন তাপমাত্রা এবং মাটিতে অপর্যাপ্ত রস থাকার কারণে আখের অঙ্কুরোদগম কম হওয়া সত্ত্বেও জমিতে পর্যাপ্তসংখ্যক মাড়াইযোগ্য আখ উৎপাদনের জন্য রোপা ইক্ষু চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে রোপা ধানের মতো এক বা দুই চোখবিশিষ্ট বীজখ- থেকে পলিব্যাগে, পরিবেশবান্ধব ছোট্ট চটের ব্যাগে, বীজতলায় কিংবা সরাসরি গাছে চারা উৎপাদন করে সেই চারা জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপণ করা হয়। রোপা ইক্ষু চাষের সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলো হলো প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় মাত্র ৪০% বীজ ইক্ষুর প্রয়োজন হয়, জমিতে মাড়াইযোগ্য ইক্ষুর সংখ্যা ও ওজন বৃদ্ধি হয়। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এতে বীজ বর্ধন অনুপাত বৃদ্ধি পায় (১:৩০)। ইক্ষুর ফলন ও অর্থনৈতিক সুবিধা ৫০-৮০% ভাগ বৃদ্ধি পায়। গ্রাম এলাকায় অধিক কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গ্রামের মহিলারাও রোপা ইক্ষু চাষের জন্য চারা উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৩. সাথীফসল প্রযুক্তি
ইক্ষু একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। ফলে স্বল্পমেয়াদি ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়। ইক্ষু চাষের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব বেশি হওয়ায় দুই সারির মাঝে স্বল্পমেয়াদি ফসলের চাষ করা যায়। কৃষকের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাথীফসল প্রযুক্তি এবং জোড়া সারিতে রোপণকৃত ইক্ষুর সাথে পর্যায়ক্রমিক একাধিক সাথীফসল চাষ প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে। সাথীফসলের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্যাকেজগুলো হলো এক সারি ইক্ষুর সাথে আলু/পেঁয়াজ/রসুন; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে আলু-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে রসুন-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে বাঁধাকপি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে ফুলকপি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে ব্রোকলি-মুগডাল/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ/সরিষা/সবুজ সার; জোড়া সারি ইক্ষুর সাথে পেঁয়াজ/মসুর/সবুজ সার। স্বল্পমেয়াদি ডাল ফসলের চাষের ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায় এবং আমিষের উৎস হিসেবে প্রতিদিনের খাদ্যে ব্যবহার করতে পারে।
৪. মৃত্তিকা ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা
ইক্ষুর ফলন বৃদ্ধিতে মাটির খদ্যোপাদান এবং সারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে ইক্ষুর ফলন, চিনি ও গুড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিএসআরাই ১২টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল যেখানে ইক্ষুর চাষ হয়ে থাকে সেই সকল অঞ্চলের জন্য ইক্ষুর জন্য মুড়ি ফসলসহ সাথীফসল চাষের জন্য সারের সঠিক মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিরূপণ করে।
৫. পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
ইক্ষু ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পোকামাকড় অন্যতম। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ইক্ষুর পোকামাকড় বৃদ্ধি পায়। মার্চ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দেখা যায়। জুন মাসে বৃষ্টি বাদল বাড়ার সাথে সাথে ইক্ষুর ডগার মাজরা পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। ইক্ষুর কাণ্ডের মাজরা পোকার আক্রমণ ও গোড়ার মাজরা পোকার আক্রমণ পরিবর্তিত জলবায়ুগত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায় এবং তাপমাত্রা কমে গেলে আক্রমণের প্রাদুর্ভাব কমে যায়। শুধু পোকামাকড়ের কারণেই প্রতি বছর গড়ে ২০% উৎপাদন এবং ১৫% চিনি আহরণ হ্রাস পায়। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আখের ৭০টি পোকামাকড় শনাক্ত করা হয়েছে যাদের মধ্যে ৭/৮টি অতি মারাত্মক। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে কোনো কোনো বছর বিশেষ কোনো কোনো পোকার ব্যাপক আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় এবং ফলনের ওপর সাংঘাতিকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গবেষণা কার্যক্রমের বিভিন্ন দিকের মধ্যে ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড় শনাক্তকরণ, ক্ষতিরধরন, আক্রমণের লক্ষণ, ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে পোকামাকড়গুলোকে মুখ্য, গৌণ প্রভৃতি ভাগে ভাগ, তাদের জীবন বৃত্তান্ত ও প্রজন্ম সংখ্যা, মৌসুমি প্রাচুর্যতা প্রভৃতি নিরূপণ করা হয়। জৈবিক উপায়ে ডগার মাজরা পোকা, কাণ্ডের মাজরা পোকা এবং পাইরিলা দমন; কালচারাল ও যান্ত্রিক উপায়ে সব পোকার দমন ব্যবস্থা; রাসায়নিক প্রয়োগে ডগার মাজরা পোকা, সাদা কীড়া, উঁইপোকা, শিকড়ের মাজরা পোকা, কাণ্ডের মাজরা পোকা ও আগাম মাজরা পোকা দমন; ইক্ষুর জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সুপারিশ করা হয়েছে।
৬. রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা
পরিবর্তিত জলবায়ুগত কারণে রোগের অনুকূল আবহাওয়ায় ইক্ষুর ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ইক্ষুর রোগবিস্তার ও প্রসার লাভের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪০টি রোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ও বিভিন্ন জাতের ইক্ষুতে লক্ষ করা গেছে। এদের মধ্যে ২২টি ছত্রাক, ৪টি ব্যাকটেরিয়া, ২টি মাইকোপ্লাজমা, ১টি ভাইরাস, ২টি কৃমি, ২টি পরজীবী আগাছা দ্বারা সংগঠিত হয় বাকি ৭টি রোগ অন্যান্য কারণে সংগঠিত হয়ে থাকে। শনাক্তকৃত ৪০টি রোগের মধ্যে ১০টি মুখ্য এবং বাকি রোগগুলো গৌণ। ইক্ষু রোগের নাম, রোগের কারণ, রোগের লক্ষণ নিরূপণ করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়েছে। ইক্ষুর বীজ শোধন পদ্ধতি, রোগমুক্ত পরিচ্ছন্ন বীজ আখ উৎপাদন ও ব্যবহার, সমন্বিত রোগ দমন পদ্ধতি এবং আখের রোগ পঞ্জিকা উদ্ভাবন করা হয়েছে। লাল পচা রোগের প্রকোপ কমানো ও মোজাইক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে রোগ প্রতিরোধী জাতের রোগমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; সাদা পাতা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্দ্র-গরম বাতাসে শোধিত বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; মুড়ি খর্বা ও স্মাট রোগ দমনের জন্য গরম পানিতে শোধিত বীজ ইক্ষু ব্যবহার সুপারিশ করা হয়েছে; বীজ পচা রোগ দমনের জন্য ব্যাভিস্টিন এবং বিজলি ঘাস দমনের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় ইউরিয়া প্রয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে।
৭. স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ গুড় উৎপাদন
গুড় প্রস্তুতে ইক্ষু রস পরিশোধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য হাইড্রোজের বিকল্প হিসেবে বন ঢেঁড়স ও উলট কম্বল গাছের নির্যাস ব্যবহারের মাত্রা এবং ব্যবহার পদ্ধতি সুপারিশ করা হয়েছে। মাটির পাত্র রঙ করে গুড় ভরে মাটির পাত্রের মুখ মোম বা পলিথিন বা মাটি দ্বারা বন্ধ করে দীর্ঘদিন গুড় সংরক্ষণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাটালি গুড় এবং গুড়া দানাদার গুড় পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
৮. তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে পানি ও পুষ্টির জন্য ইক্ষুর রস ব্যবহার করার লক্ষ্যে বাড়ির আঙিনায় বা বাড়িসংলগ্ন মাঠে চিবিয়ে খাওয়া আখের কয়েকটি ঝাড় লাগিয়ে উৎপাদিত আখ সারা বছর চিবিয়ে খাওয়া বা রস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
৯. উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার
সাধারণত ইক্ষু থেকে প্রাপ্ত ছোবরা চিনিকলের ব্রয়লারে ব্যবহার হয়ে থাকে। ছোবরার সামান্য অংশ ব্যবহার করা হয় কাগজ তৈরিতে, আচ্ছাদন, মাশরুম চাষ, গুড় উৎপাদনের জন্য জ্বালানি এবং গৃহস্থালি জ্বালানি হিসেবে। দুর্যোগের সময় ইক্ষুর সবুজ পাতা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ইক্ষু কর্তনের পর এর সবুজ পাতা গোখাদ্য, শুকনা পাতা জ্বালানি, আচ্ছাদন এবং পচিয়ে জৈব সার তৈরি করা হয়।
১০. টেকসই ইক্ষু গবেষণা ও সম্প্রসারণ
জাতীয় অর্থনীতির বার্ষিক জিডিপিতে ইক্ষুর অবদান ০.৭৪%। প্রতি বছর ইক্ষু হতে জিডিপিতে অবদান টাকার অংকে গড়ে ১২০০-১৫০০ কোটি টাকা। দেশে গড়ে বছরে প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টন ইক্ষু উৎপাদিত হয়, যা থেকে বার্ষিক জিডিপি আয় প্রায় ১৫২১.৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে গুড় হতে ৮৫২.০০ (০.৪১%) কোটি, চিনি হতে ৩৬৯.০০ (০.১৮%) কোটি, ইক্ষুবীজ হতে ৯২.৬০ (০.০৫%) কোটি, পশু খাদ্য ও জ্বালানি হতে ৮২.৯০ (০.০৪%) কোটি, বাই-প্রডাক্ট হতে ৬৮.৯৪ (০.০২%) কোটি এবং চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষু ও রস হতে ৫৬.২৫ (০.০৩%) কোটি টাকা পাওয়া যায়।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য শাকসবজি, দানাদার খাদ্য ও ফলমূলের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে ইক্ষু চাষ দিনকে দিন নিচু ভূমি চরাঞ্চলে, পাহাড়ি এলাকা ও প্রান্তিক প্রতিকূল পরিবেশপ্রবণ এলাকা যথা- খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে। মোট উৎপাদিত ইক্ষুর ২৩-২৭% চিনি উৎপাদনে এবং ৫৩-৫৭% গুড় তৈরিতে ব্যবহার হয়। পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের জন্য খরা, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধী ইক্ষু জাত উদ্ভাবন এবং চাষের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভানে বিএসআরআই কাজ করে যাচ্ছে। ইক্ষু দুর্যোগের সময় তাৎক্ষণিকভাবে জীবন রক্ষায় বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
ড. মু. খলিলুর রহমান* ড. মো. আমজাদ হোসেন**
* মহাপরিচালক, **পরিচালক (গবেষণা) বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), ঈশ্বরদী, পাবনা