Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ফসল উৎপাদনে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় কচুরিপানার ব্যবহার

শিরোনাম দেখে সম্মানিত পাঠকবৃন্দের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। এ আবার কেমন কথা, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষতিতে পানিতে ভাসমান মশা মাছির আবাসস্থল এ কচুরিপানা কি অবদান রাখতে পারে? হ্যাঁ, জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় কচুরিপানা বিশেষ বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশগুলো তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে। উন্নত বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে, “Natural Resource Utilization Group” এবং ÒNatural Resource Research Institute” নামে অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কৃষি প্রধান বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ এর গুরুত্ব অনেক ক্ষেত্রে অজানা ও অবহেলিত। কচুরিপানা এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যা ব্যবহারের মাধ্যমে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।


জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাংলাদেশের একটি নির্মম বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে ভারি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। গলছে হিমালয়ের বরফ। বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। এ সব কারণে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত আসছে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উপর। যদিও বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান হচ্ছে ১৪.২২ শতাংশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এবং বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন হয়ে দেশে ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। দেখা দিচ্ছে তীব্র খরা। যা দেশে কৃষি উৎপাদনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এবার আমন মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ২/৩ বার ধানের চারা রোপণ করেও কূলকিনারা পাচ্ছে না কৃষক। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’র (আইপিসিসি) হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ৩২ শতাংশ এবং গম উৎপাদন আট শতাংশ হ্রাস পাবে।


জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেশি পরিমাণে বাড়ছে। এতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩৬ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্তার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে যেখানে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৫০ হাজার ৩৫০ হেক্টর, ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৮০ হেক্টর। আশংকা করা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। এতে বৃষ্টি পাতের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। এই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত কৃষি উৎপাদনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।  এটা এতই স্পষ্ট যে, উত্তাপ বৃদ্ধির মূল কারণ শিল্প বিপ্লব এবং এজন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে পানিতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এটাই জলবায়ু পরিবর্তন। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।


বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ এবং প্লাবন ভূমি। তাই উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২১০০ সালে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে। এতে বাংলাদেশের ভূ-ভাগের সাড়ে ১৭ শতাংশ এলাকা লোনা পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় চার কোটি মানুষ পরিবেশগত দুর্যোগে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। দেশে ভিতর এদের পুনর্বাসনের মতো জায়গা থাকবে না। কারণ উঁচু এলাকাগুলোতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্থান দেয়ার মতো জায়গা নেই। তত্ত্ব ও সূত্র যাই বলুক না কেনো জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা। ক্ষতির এই আশঙ্কা থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজোট সরকারের দায়িত্ব নিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে নিজস্ব অর্থায়নে গঠন করেন ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’। এ সাহসিকতা ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়ে দেশ ও জাতিকে ধন্য করেছেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সম্মানিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষির অভিযোজিতা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা নানা আয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি একজন কৃষি গবেষক হিসাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজিতায় কিভাবে কচুরিপানাকে কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি-


তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব কমাতে কচুরিপানার ব্যবহার  জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান উপসর্গ হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বিংশ শতকের প্রথম দিকে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ছিল ২৮০ পিপিএম এবং বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮০ পিপিএম। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে বিগত শতকে পৃথিবীর গড় উত্তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০ সেন্টিগ্রেড। যদি অব্যাহতভাবে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ বাড়তেই থাকে তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী  ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ১.৫০-৩০ সেন্টিগ্রেড। এতে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। বিপন্ন হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বায়ু, পানি, মাটি, বৃক্ষ ও প্রাণী- এই পাঁচটি হলো প্রাকৃতিক পরিবেশের মৌলিক উপাদান। এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। তাপ প্রবাহের কারণে মাটির আদ্রতা দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে মাটি পানি শূন্য হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে মাটিতে বিদ্যমান পানির স্তর নিচে নেমে যায়। মাটিতে প্রয়োজনীয় রসের অভাবে গাছ মাটি থেকে খাদ্য উপাদানসমূহকে গ্রহণ করতে পারে না। ডালপালার বিস্তার না ঘটাতে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটে। শিকড়ের প্রবৃদ্ধি থেমে যায়। ফলে মাঠ ফসল, ফল বাগান, সারিতে লাগানো গাছপালা সমূহের উৎপাদন কমে যায়। এই তাপ প্রবাহ থেকে গাছপালা ও মাঠের ফসল রক্ষা করতে হলে কচুরিপানাকে মালচ্্ বা জাবড়া হিসাবে ব্যবহার করুন। কচুরিপানা প্রকৃতির দান, সর্বত্রই বিস্তৃত। কিনতে হয় না, শুধু সংগ্রহ করে গাছের গোড়ায় দিবেন। কচুরিপানার কা-ের ভিতর ফোমের মতো অসংখ্য ঝালিকা কোষ বিদ্যমান। এরা দিনের বেলায় শুকিয়ে মচমচ হয়ে থাকে। রাতে কুয়াশা থেকে শিশির গুড়ি গ্রহণ করে পানিসিক্ত হয়। বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় না বল্লেই চলে। কাজেই এ সময়টাতে কচুরিপানাকে বাড়ির সমস্ত গাছপালা এমনকি বাগানসমূহে মালচ্্ বা জাবড়া হিসাবে ব্যবহার করে জলবায়ুর পরিবর্তনগত প্রভাব তাপদাহ থেকে রক্ষা করুন, ফসল উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখুন।


অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে মাটির ক্ষয়রোধে কচুরিপানার ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো অনাবৃষ্টি। ঋতুকাল বর্ষা এখন আর নিয়ম মেনে চলে না। তবুও মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে থাকে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের গবেষণায় দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির উপরিস্তর থেকে মাটি ক্ষয় হয়ে প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদী, নালা, খাল, বিল, সাগরে পতিত হয়ে পানির স্তরকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আর অন্যদিকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টির তীব্রতা মাটি কণাকে বিচ্ছুরিত করে মাটির গঠনকে আলগা করে ফেলে। এভাবে মাটি ক্ষয় প্রক্রিয়াটি তরান্বিত হয়। এ অবস্থায় বৃষ্টি শুরুর পূর্বেই কচুরিপানা দ্বারা গাছের গোড়ার চতুর্দিকে উঁচু করে মালচ্্ বা জাবড়া প্রয়োগ করা হলে বৃষ্টির তীব্রতা সরাসরি মাটিকে আঘাত করতে পারে না। ফলে মাটি ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে এই কচুরিপানা সময়ের ব্যবধানে পচে মাটিতে জৈব পদার্থ যুক্ত করে মাটিকে সমৃদ্ধ করে।


তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ হ্রাস রোধে কচুরিপানার ব্যবহার ঃ বিশিষ্ট মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ব্রাকম্যান ব্রেডির মতে, মাটির তাপমাত্রা ৩৪০-৩৮০ সেন্টিগ্রেড হলে মৃত্তিকাস্থ অণুজীব মারা যায়, জৈব পদার্থ দ্রুত বিযোজিত হয়ে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, গাছের খাদ্যোপাদানগুলো মাটিতে রসের অভাবে মাটির সাথে ফিক্সড হয়ে যায়। এতে মাটি অনুর্বর হয়ে ফসল উৎপাদনে বিঘœতা সৃষ্টি করে। অথচ এই জৈব পদার্থকে বলা হয় মাটির প্রাণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো মাটিতে ভার্মি কম্পোস্ট  (কেঁচো সার) জৈব সার প্রয়োগ করা। ভার্মি কম্পোস্ট  (কেঁচো সার) জৈব সার তৈরির প্রাথমিক উপাদান হলো প্রকৃতি প্রদত্ত চির অবহেলিত কচুরিপানা। কচুরিপানা কেঁচো উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়ক। কচুরিপানার বৃদ্ধি এতটাই তাৎক্ষণিক যে, কোনো জলাশয়ের উপরে কার্পেটের মতো স্তর তৈরি করাটা মাত্র একদিনের ব্যাপার। হেক্টর প্রতি  প্রতিদিন এদের বৃদ্ধি প্রায় ১৭ টনের উপরে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই এদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কচুরিপানায় খুব দ্রুত ও প্রচুর পরিমাণে ফুল ফোটে। তাই কচুরিপানা এখন কৃষির এক মহাসম্পদ। সম্প্রতি ভার্মিকম্পোস্ট (কেচোঁসার) তৈরির মাধ্যম হিসেবে কচুরিপানা একটি উত্তম উপকরণ হিসেবে নানা দেশে প্রমাণিত হয়েছে। কচুরিপানা এদেশে আগাছা এবং সর্বত্রই জলাভূমিতে দেখা যায়। কচুরিপানা থেকে তৈরি করা জৈব সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাফল্য পাওয়া গেছে । ১৮০ টন কাঁচা কচুরিপানা থেকে প্রায় ৬০ টন জৈব সার উৎপাদিত হতে পারে। আমাদের দেশে দিন দিন গোবরের প্রাপ্যতা কমে আসছে, কারণ এখন আর কৃষকের গোয়ালে গরু নেই, আছে পাওয়ার টিলার। কচুরিপানা প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে বেশ ভালোভাবেই নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম পুষ্টি উপাদান পরিশোষণ করতে পারে। ফলে কচুরিপানা পচিয়ে জৈবসার তৈরি করে  জমিতে ব্যবহার করলে এ সব উপাদান মাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ভারতের তামিলনাড়–র গবেষক সেলভারাজ এক পরীক্ষায় প্রমাণ পেয়েছেন, ভার্মিকম্পোস্টের জন্য যেখানে অন্যান্য কৃষিবর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে ৭০ দিন সময় লাগে সেক্ষেত্রে কচুরিপানা থেকে জৈব সার তৈরি করতে সময় লাগে মাত্র ৫৫ দিন। উক্ত বিজ্ঞানীর মতে, বিভিন্ন উদ্যান ফসল চাষের জন্য যেখানে হেক্টরপ্রতি ১০-১৫ টন জৈব সার লাগে সেখানে কচুরিপানা থেকে তৈরি করা জৈব সার লাগে মাত্র ২.৫-৩.০ টন, এ পরিমাণ জৈব সার ব্যবহার করেই ফলন ২৫-৩০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। জলবায়ুগত দিক বিবেচনায় অন্যান্য প্রথাগত জৈব সার থেকে যেখানে শতকরা ৭০ ভাগ মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, সেখানে ভার্মি কম্পোস্ট  (কেঁচো সার) জৈব সার থেকে উৎপন্ন হয় মাত্র শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ। কাজেই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভার্মি কম্পোস্ট  (কেঁচো সার) জৈব সার অধিক পরিবেশবান্ধব।


জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে সবজি চারা সস্তা কৌশলে তৈরিতে কচুরিপানার ব্যবহার  অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে যেখানে সবজির বীজতলা করা কঠিন হয়ে পড়ে সেখানে কচুরিপানা পচা বা শিকড়ের অংশ ব্যবহার করে ঘরের চালার নিচে পলিব্যাগে বা ছোট ছোট পুটলি আকারে লাউ, কুমড়া, করলা, চিচিংগা,পুঁইশাক ও শশিন্দা জাতীয় সবজির চারা অনায়াসে তৈরি করা যায়।


জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় ভাসমান কৃষিতে কচুরিপানার ব্যবহার ঃ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি আর পানি অথই পানি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে লাখ লাখ হেক্টর জমি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে সারা দেশে। পানিবন্দি এলাকার মানুষের বাঁচতে শেখার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে এক আশাজাগানিয়ার বাস্তব গল্প হলো ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি। ভাসমান বেড বা ধাপ তৈরিতে ভাসমান কচুরিপানা সংগ্রহ করে প্রায় ১৫০ ফুট বেড তৈরি করা হয়। কাজেই প্রতিকূল পরিবেশে কৃষকদের ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল উদ্ভাবনী উদ্যোগে কচুরিপানাকে ব্যবহার করে ভাসমান কৃষি  জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় হতে পারে এক আলোকবর্তিকা। আশার কথা, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ভাসমান কৃষি’ কর্মকা-ের উপর গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে।


অবিরাম বর্ষণে গো খাদ্যের জোগানদাতা ঃ অবিরাম বর্ষণে মাঠ ঘাট যখন পানিতে ডুবে যায়, তখন পানির ওপর ভেসে থাকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সবুজ বর্ণের সমারোহে কচি কচি ডগায় সুশোভিত কচুরিপানা। কৃষক ভাইয়েরা গো খাদ্যের তীব্র সংকটে দিক বিদিক ছোটাছুটি করে। সে সময় কচুরিপানা গো খাদ্যের বিপদকালীন উৎসে পরিণত হয়।

 

দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় এ কচুরিপানাকে শুকিয়ে মালচ হিসাবে ব্যবহার করে লবণাক্ততা কমিয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কচুরিপানার এত কৃষিতাত্ত্বিক গুরুত্ব থাকার পরও বাংলার কৃষক ভাইয়েরা কচুরিপানার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তাই পরিশেষে বলব, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষক ভাইয়েরা সংগঠিত হয়ে দলবদ্ধভাবে কচুরিপানা সংগ্রহ করে জৈব সার তৈরি, মাল্্চ হিসাবে ব্যবহার, ফল গাছের গোড়ায় মাল্্চ হিসেবে ব্যবহার করে মাটির ক্ষয়রোধ করে মাটিতে জৈব সার সংযুক্ত করে এবং শুকনো কচুরিপানা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করার পর যে ছাই তৈরি হবে তা লবণাক্ত অঞ্চলের মাটিতে প্রয়োগ করলে লবণাক্ততার প্রধান উপাদান সোডিয়ামকে ছাইতে থাকা পটাশিয়াস রিপ্লেস করে অর্থাৎ এ সকল পদ্ধতি অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।

 

ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএআরআই, নোয়াখালী,  মোবা : ০১৮২৭-৮৬৫৮৬০, Psoofrdbari@gmail.com

 

 

বিস্তারিত
বিভিন্ন উপাদানের “ইমেজ মুক্তা” উৎপাদন ও চাষ কৌশল

মুক্তা একটি দামি রত্ন। এটি শৌখিনতা এবং আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তার ব্যবহার প্রধানত অলংকার হিসেবে হলেও এর আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে, যেমন- মুক্তা চূর্ণ বিভিন্ন ওষুধের দামি কাঁচামাল হিসেবে এবং প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরিসহ আরও নানা কাজে মুক্তার ব্যবহার রয়েছে। গোলাকার মুক্তার মতো ইমেজ মুক্তাও অলংকার এবং শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ইমেজ মুক্তা তৈরিতে স্বল্প সময়ের প্রয়োজন হয় (৭-৮ মাস) এবং তৈরির কৌশলটি সহজ বলে যে কেউ সহজেই তা আয়ত্ব করতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ইমেজ মুক্তা চাষের খুবই অনুকূল। উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট “মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উপাদানে তৈরি ইমেজ মুক্তার উপর গবেষণা পরিচালনা করে ব্যপক সফলতা অর্জন করে।


ইমেজ মুক্তা কি?
মুক্তা হচ্ছে জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভিতর জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের রত্ন। এই রত্নটি যখন ছবি বা ইমেজ আকারে তৈরি হয় তখন তাকে ইমেজ মুক্তা বলে। বিভিন্ন ধরনের ছাঁচ বা ইমেজকে ঝিনুকের ম্যান্টল টিস্যুর নিচে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপিত ইমেজটির চারদিকে ঝিনুকের শরীর থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (নেকার) নিঃসৃত হয়ে জমা হয় এবং ধীরে ধীরে ইমেজ মুক্তা তৈরি হয়।       
ইমেজ মুক্তার গুরুত্ব : ইমেজ মুক্তা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
ডেকরেশন পিস হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
ভ্যালু এডেড প্রোডাক্ট (মূল্য সংযোজিত পণ্য) হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
স্বল্প সময়ে, স্বল্প পুঁজিতে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির জলাশয়ে এ ধরনের মুক্তা চাষ সম্ভব;
মাছের সাথে একত্রে ইমেজ মুক্তা চাষ করে মাছ চাষি বাড়তি আয় করতে পারে;
বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ইমেজ মুক্তা চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

বিভিন্ন ধরনের ইমেজ মুক্তা : বিভিন্ন ধরনের উপাদান ইমেজ মুক্তার ইমেজ বা ছাঁচ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়, যেমন- মোম, ঝিনুকের খোলস, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুক্তা গবেষণাগারে মোম এবং ঝিনুকের খোলসের তৈরি ইমেজ/ ছাঁচ দিয়ে আকর্ষণীয় ইমেজ মুক্তা উৎপাদন করা হয়েছে। ইমেজ বা ছাঁচ তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে ছাঁচের তলা যেন উত্তল হয় এবং ছাঁচের ডিজাইন যেন স্পষ্ট হয়।


মোমের ইমেজ : মোম দিয়ে ইমেজ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে একটি মৃত ঝিনুকের পরিষ্কার খোলসের ভেতরের দিক তেল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। এরপর গলিত মোম ঐ খোলসে ঢেলে মোম জমাট বাঁধার পূর্বে খোলসটি ডানে বামে নেড়ে মোমের একটি পাতলা স্তর তৈরি করা হয়। এরপর একটি সূচের সাহায্যে মোমের স্তরের উপর মৃদুচাপ প্রয়োগ করে পছন্দমাফিক ডিজাইনের ইমেজ তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত ইমেজটি এক মিনিট পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে মোমের খসখসেভাব দূর করা হয়।    

    
খোলসের ইমেজ : খোলসের ইমেজ বা ঝযবষষ ইমেজ তৈরির জন্য প্রথমে কিছু মৃত ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করা হয়। এগুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর শেলকাটিং মেশিনের সাহায্যে এই খোলসগুলোর বাইরের স্তরটি অর্থাৎ পেরিওস্ট্রাকাম স্তরটি ঘষে পরিষ্কার এবং মসৃণ করা হয়। অতঃপর কাটিং মেশিনের সাহায্যে খোলসটির অবতল অংশ আয়তাকার করে ব্লকাকারে কেটে নেওয়া হয়। এরপর ব্লকটির উপর পেন্সিল দিয়ে নির্দিষ্ট মাপের বিভিন্ন ধরনের ইমেজের চিত্র অঙ্কন করা হয়। অতঃপর মিনি গ্রাইন্ডার মেশিনের সাহায্যে অঙ্কিত ইমেজটি ছাঁচ আকারে কেটে নেওয়া হয়। পরিশেষে একই মেশিনের সাহায্যে ইমেজের ধারগুলো ঘষে মসৃণ করা হয়। এভাবে একটি খোলস ইমেজ বা ঝযবষষ ইমেজ তৈরি করা হয়। যা পরে জীবাণুমুক্ত করে জীবিত ঝিনুকে কাঙ্খিত মুক্তা পাওয়ার জন্য প্রবেশ করানো হয়।    


ইমেজ মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক
সকল ঝিনুক মুক্তা উৎপাদন করতে পারে না। বিশেষ কিছু ঝিনুক আছে যেগুলো মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাদুপানিতে চার প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে যেগুলো মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম;
যেমন-

Lamellidens marginalis, L. corrianus,
L. phenchooganjensis, L. jenkinsianus
তন্মধ্যে Lamellidens marginalis এবং খ. L. corrianus ঝিনুকগুলো ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে অধিক উপযোগী।
ইমেজ মুক্তা উৎপাদন কৌশল : ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের কৌশলকে অপারেশন বলা হয়। নিম্নে ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপগুলো বর্ণনা করা হলো :
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঃ ড্রপার বোতল, অপারেশন তাক, ঝিনুক খোলার যন্ত্র, স্ট্যুপল, স্প্যাচুলা, ট্রে, ছিদ্রযুক্ত ট্রে    
প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঃ ইমেজ (মোমের ও শেল), ৭০% এ্যালকোহল, পটাস, বিশুদ্ধ পানি    
ঝিনুক নির্বাচন ঃ সব আকৃতির ঝিনুক ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়। সাধারণত বড় আকৃতির সুস্থ সবল হলুদাভ ঝিনুক ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী। গোলমুক্তা তৈরির জন্য সাধারণত অল্প বয়স্ক ঝিনুক নির্বাচন করা হয় কারণ এই ঝিনুকগুলোর নেকার নিঃসরণের হার বেশি থাকে। কিন্তু ইমেজ মুক্তা তৈরির জন্য বড় ঝিনুকের প্রয়োজন হয় বলে কিছুটা বয়স্ক ঝিনুক নির্বাচন করতে হয়, কারণ অল্প বয়সের ছোট ঝিনুকে ইমেজ বা ছাঁচের মতো একটা বড় বহিরাগত বস্তু প্রবেশ করালে ঝিনুক তা দেহ থেকে বের করে দেবে।


পুকুরে ঝিনুক ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
অপারেশনকৃত ঝিনুক পুকুরে ফোল্ডার আকৃতির নেট ব্যাগে মজুদ করা হয়। নেট ফোল্ডার হচ্ছে এক বা একাধিক সারির পকেট বিশিষ্ট ফোল্ডার যা বাঁশ বা লোহার কাঠামো ও জাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এই নেট ফোল্ডারগুলো পুকুরে দড়ির সাহায্যে নির্দিষ্ট গভীরতায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ফোল্ডারের প্রতি পকেটে একটি করে ঝিনুকের অঙ্কীয় দিক ঊর্ধ্বমুখী করে স্থাপন করা হয়। নেট ফোল্ডারে ঝিনুকটির নড়াচড়া করার তেমন সুযোগ না থাকায় ঝিনুকের দেহের ভেতরের ইমেজটি বের হয়ে আসে না।    


পুকুরে ঝিনুক স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ : বাঁশ, দড়ি, ফ্লট (ঋষড়ধঃ)/ভাসা    
 

অপারেশন পূর্ববর্তী পরিচর্যা

প্রকৃতি থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে ঝিনুকগুলো হলুদাভ, সুস্থ-সবল, ক্ষতমুক্ত এবং ৩-৩.৫ বছর বয়সের হতে হবে। বাছাইয়ের পর ঝিনুকগুলো কমপক্ষে একমাস পুকুরের তলদেশে রেখে প্রতিপালন করতে হবে। ঝিনুকগুলো অপারেশন উপযোগী করে তোলার জন্য নিম্নলিখিত মাত্রায় সার, গোবর এবং চুন প্রয়োগ করতে হবে।    
সারণি১ ঃ সার ও চুন প্রয়োগের মাত্রা

 

এক মাস পর লালন পুকুর থেকে গবেষণাগারে এনে ঝিনুকগুলো অপারেশন উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। সুস্থ-সবল ম্যান্টলযুক্ত ঝিনুকগুলো অপারেশনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত ঝিনুকগুলো সিস্টার্নের পানিতে ৭ দিন না খাইয়ে রাখতে হবে এবং প্রতিদিন সকালে সিস্টার্নের পানি পরিবর্তন করে নতুন পানি দিতে হবে। এতে করে ঝিনুকের ভেতরের ময়লা এবং পাকস্থলীয় খাবার পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে যাবে। অষ্টম দিন সকালে অপারেশনের কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে ঝিনুকগুলো সিস্টার্ন থেকে উঠিয়ে গবেষণাগারে এনে ছিদ্রযুক্ত ট্রেতে অঙ্কীয় দিকে নিম্নমুখী করে রাখতে হবে যেন ভেতরে কোনো পানি না থাকে।


অপারেশন পদ্ধতি : অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি একটি ট্রেতে ৭০% অ্যালকোহলের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। অপারেশনকারীর হাত পটাশ মিশ্রিত পানি দিয়ে ও মোমের ইমেজগুলো বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ট্রে থেকে পর্যায়ক্রমে একটি করে ঝিনুক নিয়ে অপারেশন তাকের উপর স্থাপন করে ঝিনুক খোলার যন্ত্র দিয়ে খোলস দুটি ৮ মি.মি. পরিমাণ খুলে স্ট্যুপল দিয়ে আটকে দিতে হবে। ভেতরে ময়লা থাকলে ড্রপার বোতলের সাহায্যে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। পরবর্তীতে সতর্কতার সাথে স্প্যাচুলার সাহায্যে ঝিনুকের একপাশের খোলস থেকে ম্যান্টল পর্দা সামান্য পরিমাণ সরিয়ে ইমেজটি খোলস ও ম্যান্টলের মাঝ বরাবর প্রবেশ করিয়ে খোলসের অবতল অংশে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এরপর স্প্যাচুলার সাহায্যে হালকা চাপ দিয়ে ম্যান্টলের ভেতরের বাতাস বের করে ইমেজটি সঠিক ভাবে সন্নিবেশ করতে হবে। অতঃপর সাবধানে স্ট্যুপল খুলে ঝিনুকটি ট্রেতে অঙ্কীয় দিক ঊর্ধ্বমুখী করে রাখতে হবে। অপারেশন শেষে ঝিনুকের খোলসের উপর নির্দিষ্ট সংখ্যা লিখে চিহ্নিত করে দিতে হবে।     

   
অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা : অপারেশনের পর ঝিনুকগুলো সিস্টার্নে প্রথম ৭ দিন খাবার না দিয়ে নেট ফোল্ডারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রতি ফোল্ডারে ৪টি করে ঝিনুক দিতে হবে। পরবর্তী ১৪ দিন বিকাল বেলা পুকুর থেকে প্লাংকটন সংগ্রহ করে সিস্টার্নে দিতে হবে। প্রতিদিন সকালবেলা সিস্টার্নের পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে। সিস্টার্নে ২১ দিন পরিচর্যা করার পর অপারেশনকৃত ইমেজগুলো নেট ফোল্ডারসহ পুকুরের পানিতে রশিতে করে ঝুলিয়ে দিতে হবে। ১৫ দিন পর পর ঝিনুকগুলো চেক করতে হবে। ঝিনুকের গায়ে এবং নেট ফোল্ডারে ময়লা থাকলে পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং পুকুরে পর্যাপ্ত প্লাংকটন আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতি মাসে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে।


ইমেজ মুক্তার চাষ ব্যবস্থাপনা : অপারেশনকৃত ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়ার জন্য ঝিনুকগুলোকে জলাশয়ে চাষ করতে হবে। মুক্তা উৎপাদন ও গুণগত মানের জন্য চাষ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নে মুক্তার চাষ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলোঃ


পুকুর প্রস্তুতি :  মুক্তা চাষের পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকা বাঞ্ছনীয়। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে মুক্তার রং ভালো হয় এবং ঝিনুকের জন্য পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। পুকুরের আকার ৫০-৮০ শতাংশ বা এর চেয়ে বড় হলে ভালো, তবে এর চেয়ে ছোট পুকুরেও ইমেজ মুক্তা চাষ করা যাবে। পুকুরের গভীরতা ১.৫-২.০ মিটার হলে ভালো। নির্বাচিত পুকুরের পানি সরিয়ে তলদেশ ভালোভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এরপর শতকে এক কেজি হারে চুন ভালোভাবে পুকুরের মাটিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে ঝিনুকের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫ গ্রাম টিএসপি, এবং ৫ কেজি গোবর পানিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।


প্রাকৃতিক খাদ্য ঃ ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ মূলত পরোক্ষ। ফুলকার মাধ্যমে এরা পানিতে বিদ্যমান এলজি, ক্ষুদ্রাকার ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটন, জৈব পদার্থ ইত্যাদি ছেঁকে খায়। তাই পুকুরে যথেষ্ঠ পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতির জন্য নিয়মমাফিক সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তা চাষের জন্য পানির উপযুক্ত রং হলো হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০-৩২ সে.মি.। জলাশয়ে ঝিনুকের প্রাকৃতিক খাদ্য প্রস্তুতির জন্য নিম্নক্তো ছক(সারণি-২) অনুযায়ী পাক্ষিক চুন ও সার প্রয়োগ করা উচিত।


ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিকভাবেও সার প্রয়োগ করা যায়। সূর্যালোকিত দিনে সকালে পানিতে গুলানো সার পুকুরের চারদিকে সমানভাবে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টির সময় বা মেঘলা দিনে এবং শীতকালে পানির তাপমাত্রা খুব কমে গেলে সার প্রয়োগ করা উচিত নয়।
 

পুকুরে মাছ মজুদকরণ ঃ একজন মাছচাষি খুব সহজেই মাছের পুকুরে ইমেজ মুক্তা চাষ করে বাড়তি আয় করতে পারে। এক্ষেত্রে, তৃণভোজী মাছ যেমন, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, এশিয়ান কার্প ইত্যাদি ইমেজ মুক্তা চাষের পুকুরে চাষ করা যেতে পারে। যে সকল মাছ ঝিনুকের সাথে খাদ্যে প্রতিযোগিতা করবে যেমন-সিলভার কার্প, সেসব মাছ মুক্তা চাষের পুকুরে মজুদ না করাই ভালো। যদি একান্ত করতেই হয় তবে তা অল্প পরিমাণে। এছাড়া মধ্যস্তরে কিংবা নিচের স্তরে যে সব মাছ বিচরণ করে খাবার খায় যেমন- রুই, মৃগেল, কালিবাউস ইত্যাদি মাছও ইমেজ মুক্তার পুকুরে চাষ করা যেতে পারে। কিন্তু মাংসাশী মাছ যেমন- ব্ল্যাক কার্প, ইত্যাদি মুক্তা চাষের পুকুরে চাষ করা যাবে না।


পানি প্রবাহ ঃ পুকুরের পানিতে সামান্য প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ঝিনুকের বৃদ্ধিসাধনে এবং মুক্তা উৎপাদনে সহায়ক হয়। তাই সম্ভব হলে প্যাডল হুইল বা হোস পাইপ ব্যবহার করে সামান্য প্রবাহের ব্যবস্থা করা যায়। মাসে একবার পুকুরের  কিছু পরিমাণ পানি পরিবর্তন করলে ভালো হয়।


অপারেশনকৃত ঝিনুক মজুদকরণ ঃ ইমেজ প্রতিস্থাপনের ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলো অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যার জন্য দ্রুত সিস্টার্নে স্থানান্তর করতে হবে। এতে ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার, বৃদ্ধি, মুক্তাস্তর তৈরি দ্রুত হয়। অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা শেষে ঝিনুক পুকুরে মজুদ করতে হবে। সিস্টার্ন ও পুকুরে ঝিনুক সমূহের জন্য ঝিনুকের আকৃতির চেয়ে ছোট ফাসের নাইলন নেট দিয়ে প্রতিটি ৪০দ্ধ৩৫ বর্গ সে.মি. সাইজের নেট ফোল্ডার তৈরি করতে হবে। প্রতি ফোল্ডারে ৪ টি ঝিনুক রেখে ফোল্ডারগুলো রশির সাহায্যে পুকুরের পানিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এভাবে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ টি ঝিনুক মজুদ করা যেতে পারে। প্রতি রশিতে দুটি ব্যাগের দূরত্ব ৪০-৪৫ সে.মি. এবং দুটি রশির দূরত্ব ১২০-১৫০ সে.মি. হলে ভালো হয়।


ঝিনুক মজুদ পরবর্তী পুকুর ব্যবস্থাপনা ঃ ইমেজ মুক্তা চাষের জন্য পানির সঠিক গুণাগুণ বাজার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ, বৃদ্ধি এবং নেকার নিঃসরণের ক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানির অনুকূল তাপমাত্রায় ঝিনুক দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নেকার দ্রুত নিঃসৃত হয়ে মুক্তা গঠিত হয়। মুক্তা চাষের জন্য পানির উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৫ক্ক-৩০ক্ক সে.। তাই অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলোকে এই তাপমাত্রার ভেতর রাখার জন্য বিভিন্ন ঋতুতে পানির তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নেট ফোল্ডার ঝুলানোর গভীরতা কমাতে বা বাড়াতে হবে। শীতকালে ফোল্ডারগুলোকে ২০ সে.মি. গভীরতায় ঝুলাতে হবে। গ্রীষ্মকালে উপরিস্তরের পানির তাপমাত্রা বেশি থাকে বলে ৪০-৪৫ সে.মি. গভীরতায় ঝুলাতে হবে। পানির তাপমাত্রা খুব বেশি (৩২ক্ক সে. এর বেশি) বেড়ে গেলে পুকুরে ঝর্ণার মাধ্যমে অথবা নতুন পানি সরবরাহ করে পানির তাপমাত্রা সহনীয় করতে হবে। এছাড়া এই সংকটময় সময়ে ফোল্ডারগুলোকে তলদেশ থেকে মাত্র ১০ সে.মি. উপরে ঝুলিয়ে ঠাণ্ডা পরিবেশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঝিনুক জলাশয়ের উদ্ভিদকণা, ক্ষুদ্রপ্রাণিকণা ইত্যাদি ফুলকার সাহায্যে ছেঁকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ইমেজ মুক্তা চাষের পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য থাকা প্রয়োজন। পুকুরে পরিমাণমতো প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পানির রঙ হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০-৩২ সে.মি. হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের স্বল্পতা দেখা দিলে স্বচ্ছতা বেশি হয়। সেক্ষেত্রে দ্রুত পানিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। পূর্বে ব্যবহৃত সারের পরিমাণের অর্ধেক হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে স্বচ্ছতা ২৫ সে.মি. এর কম হলে বুঝতে হবে পুকুরটিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যাধিক। সেক্ষেত্রে নতুন স্বচ্ছ পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রয়োজনে পুকুরের কিছু পরিমাণ পানি স্বচ্ছ পানি দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া পুকুরে প্রতি মাসে শতক প্রতি এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ঝিনুক বর্ধনের জন্য ৭-৮ হচ্ছে উপযুক্ত pH, অম্লীয় (pH<6.5) এবং ক্ষারীয় (pH>8.5) উভয় ধরনের পানিই ঝিনুকের বর্ধন এবং মুক্তা তৈরির জন্য অনুকূল নয়।    

 
পুকুরে অপারেশনকৃত ঝিনুক পর্যবেক্ষণ ঃ ইমেজ প্রতিস্থাপনের প্রথম মাসে অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলো সাধারণত দুর্বল থাকে। তাই প্রতিস্থাপনের পর প্রথম মাসে নিয়মিত ঝিনুকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মৃত ঝিনুক কিংবা ইমেজ বের করে দেওয়া ঝিুনক সরিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়া নিয়ম করে প্রতি মাসে একবার ঝিনুকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ সময় ঝিনুকগুলোকে পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং খোলসের মুখে আটকে থাকা শ্যাওলা দূর করে দিতে হবে।


ইমেজ মুক্তা আহরণ ঃ হেমন্তের শেষে বা শীতের শুরুতে ইমেজ মুক্তা আহরণের উপযুক্ত সময়। আহরণের এক মাস পূর্বে ঝিনুকগুলোকে পানির উপরিতলের কাছাকাছি (১০ সে.মি. গভীরতায়) ঝুলিয়ে দিতে হবে। এতে করে ঝিনুকের দ্যুতি এবং রঙ উজ্জ্বল হয়। ব্যবহার উপযোগী ইমেজ মুক্তা তৈরি হতে ৭-৮ মাস সময় লাগে। আহরণের সময় ঝিনুকটির সংযোজনী পেশি ছুরি দিয়ে কেটে ঝিনুকটির দুটি খোলস খুলে ফেলতে হবে। এরপর ম্যান্টল পর্দাটি সরিয়ে ফেললে ইমেজ মুক্তাটি দেখা যাবে। খোলসসহ মুক্তাটি প্রথমে সামান্য লবণ পানি দিয়ে ধুয়ে এরপর স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুতে হবে। সবশেষে বাতাসে ইমেজ মুক্তা শুকিয়ে নিতে হবে।


ইমেজ মুক্তা আমাদের দেশে একটি নতুন সংযোজন। চমৎকার অলংকার তৈরি ছাড়াও শৌখিন দ্রব্য তৈরি, গৃহসজ্জায় এবং আরও নানাবিধভাবে ইমেজ মুক্তা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইমেজ ম্ক্তুার উৎপাদান কৌশল সহজ এবং উৎপাদনে সময় কম লাগে। এছাড়া উৎপাদন ব্যয়ও কম। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী। এটি একটি পরিবেশবান্ধব এবং নারীবান্ধব প্রযুক্তি। নারীরা সহজেই এই প্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এসব দিক বিবেচনা করে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে ইমেজ মুক্তার এক বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।

 

ড. মোহসেনা বেগম তনু১ অরুণ চন্দ্র বর্মন২ মোহাম্মদ ফেরদৌস সিদ্দিকী৩ সোনিয়া স্কু৪ মো: নাজমুল হোসেন৫


১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৭১১১১৫৩৩৩, ইমেইল :tanu@yahoo.com, ২,৩ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা৪,৫বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বামগই, ময়মনসিংহ-২২০১

বিস্তারিত
বাংলাদেশে চাষ উপযোগী সম্ভাবনাময়ী বিদেশি ফল অ্যাভোকাডো

বাংলাদেশে যেসব বিদেশি ফল অধুনা চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তার মধ্যে অ্যাভোকাডো অন্যতম। অন্যান্য ফলের তুলনায় এ ফলের মিষ্টতা কম হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অতি উপযোগী। এ ফলের আকার অনেকটা পেয়ারা বা নাশপাতির মতো। একেকটা ফলের ওজন প্রায় ৩০০-৭০০ গ্রাম হয়। ফলের ভেতরে বেশ বড় ডিম্বাকার বীজ থাকে। আহার্য্য অংশ মাখনের মত মসৃণ, হালকা মিষ্টি স্বাদের। একই কারণে অনেকের কাছে এটি মাখন ফল নামে পরিচিত। পেঁপের মতো কাঁচা-পাকা ফল, সবজি, ভর্তা, সালাদ, শরবতসহ ভিন্নতরভাবে খাওয়ার সুবিধা আছে। টোস্টে মাখনের পরিবর্তে অ্যাভোকাডো ক্রিম দিয়ে খাওয়া, সালাদে, স্যান্ডুইচে মেয়নেজের পরিবর্তে অ্যাভোকাডোর ক্রিম দিয়ে আহার করা স্বাস্থ্যসম্মত।


উৎস ও বিস্তার : এ ফলের আদি স্থান মেক্সিকো ও গুয়াতেমালা। পরে এটি আমেরিকা ও ক্যারাবিয়ান দেশগুলোতে বিস্তার ঘটে। যেসব দেশে বেশি অ্যাভোকাডো উৎপন্ন হয় তার মধ্যে মেক্সিকো, চিলি, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, কলম্বো, পেরু, কেনিয়া, ব্রাজিল, রুয়ান্ডা, চীন অন্যতম। অধুনা শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, থ্যাইল্যান্ড, ইসরাইল, নেদারল্যান্ডস ও ভারতে এ ফলের চাষের প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ৬০-৭০ জন উৎসাহী চাষি এ ফল সফলভাবে চাষ করছে। তবে তাদের এসব গাছ বীজ থেকে তৈরি এবং অ্যাভোকাডো গাছের সংখ্যা খুব কম, দু-চারটের বেশি নয়। ডিএই আওতাধীন ৫ থেকে ৭টা হর্টিকালচার সেন্টারে রোপিত অ্যাভোকাডো গাছে ফল দেয়া আরম্ভ করেছে। বর্তমানে প্রচুর ফল অনুরাগী অ্যাভোকাডো ফল চাষে অতি আগ্রহী হচ্ছে।


পুষ্টি ও ঔষধিগুণ : অ্যাভোকাডো পুষ্টিতে ভরপুর এবং ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ ফল। ইহা দেহকে সোডিয়াম, সুগার ও কোলস্টেরল মুক্ত রাখে। এ ফল অতি ক্যালোরি সমৃদ্ধ, এতে দেহের জন্য উপকারী ফ্যাট যথেষ্ট রয়েছে, হার্টকে সুস্থ রাখে, ক্যান্সার ও কোলস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। চর্বিতে গলে যায় (Fat soluble) এমন পুষ্টি উপাদন (A, D, K, E) প্রচুর রয়েছে, যা দেহকে সুস্থ রাখতে বুস্টার হিসেবে কাজ করে। শিশুদের সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য অ্যাভোকাডো ফল আহারের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ফল মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে সুপরিচিত। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ভিটামিনস ও মিনারেলস এ ফলে প্রচুর রয়েছে। বিশেষ করে ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি এতে বেশি। প্রচুর ভিটামিন সি, বি-৬, রিভোফ্লাভিন ছাড়াও দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ফাইবার সমৃদ্ধ। বয়স্কদের মাসল ও হাড় ক্ষয় রোধে এবং মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের ক্যান্সার রোধক হিসেবে এ ফল কাজ করে। অ্যাভোকাডো আহারে গর্ভবর্তী মায়ের গর্ভপাত রোধ করে, এবং স্বাভাবিক ডেলিভারিতে সহায়ক হয়। মানসিক চাপ, হতাশা দূরীকরণ, ক্ষুধা বৃদ্ধি, সুনিদ্রা নিশ্চিত করা এবং দেহের ক্ষতিকর দ্রব্যাদি প্রস্রাব ও মল আকারে বের হয়ে দেহকে সুস্থ রাখতে এ ফল অতি গুরুত্ব বহন করে।


জলবায়ু ও মাটি : ট্রপিক্যাল, সাব-ট্রপিক্যাল আওতাধীন দেশগুলোতে এ ফল ভালো হয়। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি, আর্দ্র ও গরম আবহাওয়া এ ফল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে ফুল ফল ধরাকালে বেশি গরম, শুকনা বাতাস ও ফ্রোস্ট সহনশীলতা এ ফলের কম। শীত শেষে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ১৮০-২৫০ সেন্টিমিটার তাপমাত্রা ফুল ফোটা ও ফল ধরার জন্য বেশি উপযোগী এবং ফল বড় হওয়ার জন্য ২৫০-৩৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে ভালো হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০-১২০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এলাকায় অ্যাভোকাডো ভালো ফলন দেয়। দেশের পার্বত্য জেলাগুলোসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর উঁচু অংশে এ ফল সম্প্রসারণ সম্ভাবনা খুব বেশি।


প্রায় সব ধরনের মাটিতেই অ্যাভোকাডো ফলানো যায়। বিশেষ করে পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত লাল মাটি (বরেন্দ্র এলাকা ও মধুপুর গড়) ও এঁটেল মাটিতেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ ফলের লবণাক্ত সহিষ্ণুগুণ তুলনায় কম। চাষের জন্য সয়েল পিএইচ মাত্রা ৫-৭ বেশি উপযোগী। গাছের জলাবদ্ধ সহনশীল ক্ষমতা নেই। এজন্য পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত, পানির স্তর অপেক্ষাকৃত নিচে (র্৩-র্৪) থাকে, সারা দিন রোদ পায় এবং অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি এ ফল চাষে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। অ্যাভোকাডো চাষের জন্য মাটি অবশ্যই উর্বর ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হতে হবে।


জাত : পৃথিবীতে শতাধিক জাতের অ্যাভোকাডো ফল চাষ করা হয়ে থাকে। জাতগুলোকে তিনটি রেসে বা গোত্রে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো : ক. মেক্সিকান, খ. গুয়াতেমালা এবং গ. ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান প্রজাতি। মেক্সিকান গোত্রীয় ফলের আকার ছোট (২৫০ গ্রাম), ফলের ত্বক পাতলা ও মৃসণ, এ প্রজাতির ফলে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি (৩০%) ও হিম সহনশীল। গুয়াতেমালা গোত্রীয় ফলের আকার বেশ বড় (৬০০ গ্রাম), ফলের বোটা বেশি লম্বা, ফলের ত্বক পুরু এবং অমসৃণ। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গোত্রীয় ফলের আকার মাঝারি, (৩০০-৪০০ গ্রাম) ফলের উপরিভাগ মসৃণ ও উজ্জ্বল। বাংলাদেশে আবাদের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রেসের অ্যাভোকাডো চাষের জন্য বেশি উপযোগী। অ্যাভোকাডো উৎপাদনকারী দেশগুলোতে যে সব জাতের আবাদ প্রচলন বেশি সেগুলোর মধ্যে হ্যাস, ফুয়ার্টে, বেকন, রিড, পুলোক, জুটানো, জান, লিন্ডা, নাবাল অন্যতম। পরপরাগায়ন পদ্ধতিতে ফল ধরায় আমের মতো বীজের চারায় নতুন নতুন জাতের সৃষ্টি হয়। তবে মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে না, স্বাভাবিকভাবে ফলন ও ফলের মান কমে যায়।


বংশবিস্তার : বীজ থেকে চারা তৈরি করে যৌন (Asexual) পদ্ধিতে এবং কলম তৈরি করে অঙ্গজ (অংবীঁধষ) পদ্ধতি অবলম্বনে অ্যাভোকাডো গাছের বংশবিস্তার করা হয়। বাংলাদেশে চাষি পর্যায়ে যেসব গাছ রয়েছে সেগুলো সবই বীজ থেকে তৈরি চারার গাছ। ভারতেও বেশির ভাগ অ্যাভোকাডো বীজ থেকে উৎপাদিত।


বীজ থেকে চারা উৎপাদন : পুষ্ট ফলের বীজ সংগ্রহ করে তা থেকে চারা তৈরির জন্য বীজতলায় বীজ বসাতে হয়। বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজ বপন করা প্রয়োজন। কেননা সংগৃহীত বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ২-৩ সপ্তাহের বেশি থাকে না। তবে ৫০ সে. তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ করা হলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কয়েক মাস বাড়ানো যায়। বীজতলা বা টবে বীজ বসানোর আগে সমপরিমাণ মাটি, মোটা বালু এবং কোকোডাস্ট মিশ্রিত মিডিয়া তৈরি করে নেয়া উত্তম। বীজ বসানোর আগে বীজের উপরি ভাগের আবরণ সরিয়ে দিলে বীজ বেশি গজায়। এ ফলের বীজ বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বীজের চওড়া ভাগ নিচে থাকে। বসানো বীজের উপরি ভাগ সামান্য পরিমাণ পুরু (২/১ ) মোটা লাল বালু ও কোকোডাস্ট মিশিয়ে ঢেকে দিতে হয়। বসানো বীজের মাটি ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নেয়া প্রয়োজন। বীজতলার মাটিতে যেন রসের অভাব না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং নিয়মিত ঝর্ণা দিয়ে হালকা সেচ দিয়ে চারা গজাতে সহায়তা করতে হবে। কাপে বা প্লাস্টিক বোতলের উপরি ভাগ কেটে তাতে পানি দিয়ে বীজ বসানো হলেও বীজ থেকে চারা গজায়। এক্ষেত্রে বীজের ৩০% পানির ওপরে এবং ৭০% পানিতে ডুবানো অবস্থায় বীজ স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যবস্থায় গজানো চারা র্৫র্ -র্৭র্  ইঞ্চি লম্বা হলে তা টবে বা পলি ব্যাগে রোপণ করে বাড়তে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।


কলম তৈরি পদ্ধতিতে : দু-তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট চারা গাছ কলম করার জন্য উপযোগী হয়। ক্লেপ্ট, ভিনিয়ার বা সাইড গ্রাফটিং পদ্ধতি অবলম্বনে মূলত কলম তৈরি করা হয় এবং সফলতার হার বাড়ে। সারা বছর ধরে কলম করা যায়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত কলম করার জন্য বেশি উপযোগী। বাডিং পদ্ধতিতেও অ্যাভোকাডো গাছের বংশবিস্তার করা যায়। সমগোত্রে বা রেসে কলম করলে সফলতার হার বাড়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রেসের সাথে ম্যাক্সিক্যান রেসের কলম করা যায় না, তবে গুয়াতেমালা ও হাইব্রিড জাতের সায়ন দিয়ে সব প্রজাতির কলম করা যায়।


চারা/কলম রোপণ : বাগান তৈরির জন্য সাধারণত ২০-২৫ ফুট দূরত্বে চারা/কলম রোপণ করা হয়। বাড়ির আঙিনা বা দু-এক সারি গাছ রোপণের জন্য ১৫ থেকে ১৬ ফুট দূরত্ব দিলেই চলে। চা বাগানে আধা ছায়া দেয়ার জন্য অ্যাভোকাডো অতি উপযোগী। তবে এক্ষেত্রে ৩র্০ -৪র্০ ফুট দূরত্ব দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। ফুয়ার্টের  মতো আকারে বেশি বড় ও ঝোপালে জাতের বেলায় অপেক্ষাকৃত বেশি দূরত্বে (৩র্০-৩র্৫ ) রোপণ প্রয়োজন হয়। অ্যাভোকাডো বাগানে মধ্যমেয়াদি মিশ্রফল (সাইট্রাস, পেয়ারা, কুল) বাগান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি দূরত্ব (৩র্০-৩র্৫ ফুট) দিতে হয়। গাছ রোপণের আগে ‘লে-আউট’ প্ল্যান তৈরি করে প্রথমে রোপণের নির্ধারিত স্থানগুলো নির্ণয় করে নিয়ে তথায় গর্ত তৈরি করার প্রয়োজন হয়। প্রতিটি গর্তের মাপ তিন ফুট লম্বা, চওড়া ও গভীর (র্৩দ্ধর্৩দ্ধর্৩) হতে হবে। গর্ত তৈরি শেষে তা ৩-৪ দিন রোদ খাওয়ানো বা গর্তে খড়কুটো ফেলে আগুন দিয়ে পোড়ালে মাটিতে বসবাসরত রোগ-পোকা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। যেসব মিশ্রণ দিয়ে তৈরিকৃত গর্ত ভরাট করতে হবে তা হলো-


(ক) মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড)১৫%, (খ) ৩ নং গ্রেডের ইটের মার্বেল সাইজের ছোট খোয়া ১৫% (গ) নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া (কোকোডাস্ট) ১৫%, (ঘ) উর্বর মাটি ( ভিটেমাটি) ২৫%, (ঙ) পচা গোবর/ আর্বজনা পচা ৩০%
এর সাথে আর মেশাতে হবে হাড়ের গুঁড়া-১ কেজি, ভার্মি কম্পোস্ট ৫ কেজি, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি-৩০০ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট, ম্যাগসালফেট, ফেরাস সালফেট ও বোরন জাতীয় অনুখাদ্য ১০০ গ্রাম করে। এর সবগুলো একত্রে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ১৫ দিন রেখে দেয়ার পর তথায় গাছ রোপণের জন্য উপযোগী হয়। চারা রোপণের আগে তৈরিকৃত মাদায় দু-এক দিন পরপর পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায় সার মিশ্রিত মাটি গাছ রোপণের জন্য বেশি উপযোগী হবে।


সেচ সুবিধা ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে বছরের যে কোন সময় অ্যাভোকাডোর চারা/কলম লাগানো যায়। তবে বর্ষা আরম্ভ হওয়ার আগে এপ্রিল-মে মাসে গাছ রোপণ করা হলে বর্ষা ও শীত আরম্ভের আগে শিকড় দ্রুত ছড়ানোর সুযোগ পায়, প্রতিকূল অবস্থায় গাছ বেড়ে উঠার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ভূমি থেকে ১র্০র্ -১র্২র্  উঁচু করে তৈরি মাদার মধ্যভাগে চারা/কলম রোপণ করলে ভালো হয়। পরাগায়নের সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বেশি ফলন পাওয়ার জন্য সমান সংখ্যক ১:১ অথবা ২:১ অনুপাতে ‘এ’ এবং ‘বি’ গোত্রীয় গাছের চারা রোপণ করতে হয়। গাছ রোপণ করে অবশ্যই গাছকে কাঠি দিয়ে বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে ঝড়-বাতাসে গাছ হেলে পড়া রোধ করে সমানভাবে চারদিকে বাড়তে সহায়তা দিতে হবে।


সার প্রয়োগ : গাছের বাড়ন্ত অবস্থায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশ সার ১:১:১ অনুপাতে এবং ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে ২:১: ২ অনুপাতে প্রধান এ তিন প্রকার রাসায়নিক সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়। গাছের বয়স ভেদে প্রতি বছর প্রতিটা গাছে যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন হয় তা নিম্নরুপ


প্রতি বছরের জন্য সুপারিশকৃত সারগুলো দু-ভাগে করে নিয়ে একেক ভাগ বছরে কমপক্ষে দুবার প্রয়োগ করতে হয়। এ সারের ৫০% বর্ষার আগে মে-জুন মাসে এবং অপর ৫০% বর্ষা শেষে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গাছে প্রয়োগ করে তা পানি দিয়ে ভালোভাবে ভেজাতে হয়। এছাড়া অনুখাদ্যের অভাব পূরণে প্রতি বছর গাছের বয়স ভেদে ১০০-২০০ গ্রাম করে ম্যাগসালফেট, জিঙ্ক সালফেট, ফেরাস অক্সাইড ও বোরন সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়। মাটির পিএইচ মাত্রা কম হলে ফেরাস সালফেট না দিলেও চলে।


পরাগায়ন অনুকূল ব্যবস্থায় বৃদ্ধিকরণ : ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে গাছে আমের মতো মুকুল ধরে, তাতে ২০০-৩০০টা ছোট ছোট ফুলের সমারোহ থাকে। প্রতিটি ক্ষুদ্র ফুল উভয় লিঙ্গিক (Bisexual) হলেও একই গাছের ফুল দিয়ে পরাগায়ন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। তাই পরাগায়ন সুবিধা ও ফলন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাগানে একাধিক গাছ রোপণ করা উচিত। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফুটার পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন জাতের অ্যাভোকাডোকে দুইভাবে ভাগ করা হয়। (ক) প্রথমটা ‘এ’ টাইপ (হ্যাশ, সিযোন্ড, গুয়াতেমালা, লুলা) (খ) অপর প্রজাতি ‘বি’ টাইপ (বেকন, ফুয়ার্টে, জুটানো, নাবাল) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘এ’ টাইপের স্ত্রী অঙ্গ সকাল ৮-১১টা এবং পুরুষ অঙ্গ (পরাগরেণু) পরের দিন বিকেল ৩-৬টায় পরাগায়ন উপযোগী হয়। অপর পক্ষে ‘বি’ টাইপের স্ত্রী অঙ্গ বিকেল ৩-৬টা এবং পুরুষ অঙ্গ পরের দিন সকাল ৮-১১টায় পরাগায়ন উপযোগী হয়। একই কারণে বাগানে এ এবং বি টাইপের গাছ থাকলে পরাগায়নে অসঙ্গতি দুর করে ফল ধরতে সহায়ক হয়।


ট্রেনিং-প্রুনিং : ছোট অবস্থায় ট্রেনিং-প্রুনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ৪-৫ ফুট পর্যন্ত কাণ্ড গঠন করা এবং চার ধারে সমান সংখ্যক ডালপালা ছাড়াতে সহায়ক হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। কোনো জাতের গাছ বেশি উপরের দিকে বাড়ে আবার কোনো প্রজাতি বেশি ঝোপালো এবং ডালপালা ছড়িয়ে নিচে মাটিকে স্পর্শ করে। সময়মতো উপরে বৃদ্ধি রোধ করা এবং অতিরিক্ত ডাল গজালে তা ছেটে কমিয়ে দিয়ে গাছে অবাধে আলো-বাতাস চলাচল সুবিধা নিশ্চিত করা ও ফল ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে বেশি মাত্রায় ছাঁটাই করলে ফলন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


সেচ নিষ্কাশন : অ্যাভোকাডো গাছে খুব বেশি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বেশি প্রয়োজন। তবে শুকনা মৌসুমে ৩-৪ সপ্তাহের ব্যবধানে সেচ দেয়া হলে ফল বেশি ধরে এবং ফলের আকার বড় হয়। শুকনা মৌসুমে অবশ্যই খড়কুটা, শুকনা কচুরিপানা, লতাপাতা গাছের চারধারে র্র্৪র্ -র্৫র্  ইঞ্চি পুরু করে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া উত্তম। এ ব্যবস্থায় মাটিতে রস সংরক্ষিত, আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং পরে এগুলো পচে জৈবসারের উৎস হিসেবে গাছের প্রয়োজন মেটায়।


রোগ ও পোকামাকড় : এ ফল গাছে প্রধানত শিকড় পচা, পাতায় দাগপড়া এবং গোড়া পচা রোগের উপদ্রব মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাগানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বর্ষকালে যেন কোনো মতেই পানি না জমে সে ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে গাছকে নিরাপদ রাখা যায়। এ ছাড়া কপার মিশ্রণে তৈরি ছত্রাকনাশকসহ অন্যান্য উপযোগী ছত্রাকনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে গাছকে সুস্থ রাখা প্রয়োজন। অ্যাভোকাডো গাছে মাইট, মিলিবাগ, স্কেল পোকা ও ফলের মাছি পোকার উপদ্রব মাঝে মাঝে দেখা যায়। এসব পোকার আক্রমণ দেখা গেলে উপযোগী বালাইনাশক স্প্রে করে গাছকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া উচিত ।


ফল সংগ্রহ : প্রধানত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পুষ্ট বা পাকা ফল পাওয়া যায়। কচি ফলের রঙ অনেকটা সবুজ থাকে, তবে পুষ্ট হলে বা সংগ্রহ উপযোগী হলে ফলের রঙ পরিবর্তন হয়ে হালকা সবুজ বা কিছুটা ধূসর বা বাদামি রঙ ধারণ করে। এ দেশে ফল পুষ্ট হতে ৫-৬ মাস সময় লাগে, অথচ অন্য দেশগুলোতে অ্যাভোকাডো ফল পাকতে ৮-১০ মাস সময় লাগে। অন্য ফলের ন্যায় গাছে ফল পেকে ঝরে পড়ে না। পুষ্ট ফল পেড়ে ঘরে ৫-৭ দিন রাখলে ফল নরম হয়ে আহার উপযোগী হয়। এ ফল দীর্ঘদিন গাছে রাখার সুবিধা আছে। পুষ্ট ফল এক দেড় মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। গাছের বয়স ও জাত ভেদে প্রতি গাছ থেকে ২০০ থেকে ৫০০টা ফল পাওয়া যায়। এক থোকায় বা বোঁটায় ১-৪টার বেশি ফল ধরে না। কোনো কোনো গাছে অসময়ে ফুল-ফল আসতে দেখা যাায়। সংগৃহীত ফল ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হলে ১-২ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।


বাংলাদেশে অ্যাভোকাডো সম্প্রসারণে অতি উপযোগী হওয়ায় পুষ্টি সমৃদ্ধ এ ফলের উপযোগী জাত চিহ্নিত করে তা বিস্তারে সংশ্লিষ্ট সবার অবদান রাখা একান্ত প্রয়োজন।

 

এম. এনামুল হক

মহাপরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং সদস্য, বিশেষজ্ঞ পুল (APA), কৃষি মন্ত্রণালয়, মোবা : ০১৯১৭০৫৫২০৫

বিস্তারিত
পরিবেশবান্ধব ব্রি সৌরশক্তি চালিত আলোক ফাঁদ

কীটনাশক ছাড়া কীটপতঙ্গ দমনের জন্য প্রচলিত আলোক ফাঁদ বৈদ্যুতিক শক্তি/জ্বালানির সাহায্যে চালানো হয়। আলোক ফাঁদ ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ফাঁদটি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এটি তদারকি করা যেমন  শ্রমসাধ্য তেমনি সময়ের  অপচয় হয়। কৃষকের ফসল, বাগান বা সবজির ক্ষেতে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে বৈদ্যুতিক শক্তি চালিত আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিকল্প শক্তি দরকার যা নিরবচ্ছিন্নভাবে আলোক ফাঁদে আলো জ্বলতে শক্তি সরবরাহ করবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং দেশের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর কীটতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি (এফএমপিএইচটি) বিভাগ ফসলের মাঠে ব্যবহার উপযোগী সৌরশক্তি চালিত একটি আলোক ফাঁদ উদ্ভাবন করেছে। আলোক ফাঁদটি ফসলের মাঠে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকামাকড় দমনের জন্য একটি কার্যকরী প্রযুক্তি। কীটপতঙ্গ সনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষণ ও দমনের জন্য এটি একটি সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করে দানাদার, ডাল, শিম, বেগুন, বরবটি, করলা ইদ্যাদি সবজি এবং অন্যান্য শস্যের কীটপতঙ্গ দমন করা যায়। সৌরশক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায় বিধায় এটি একটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং ফসলের মাঠে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তিটি পোকামাকড় দমনে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রযুক্তিটি একটি সোলার প্যানেল (১৬.৮ ভোল্ট/২০ ওয়াট), একটি ব্যাটারি (ডিসি ১২.৮ ভোল্ট, ৭.৫ এম্পায়ার এবং পি০৪ টাই পলিথিয়াম আয়রন ফসফেট), একটি কণ্ট্রোলার (ডিসি ১২ ভোল্ট), একটি বৈদ্যুতিক বাতি (ডিসি ১২ ভোল্ট, ৮ ওয়াট), একটি প্লাস্ট্রিকের গামলা এবং একটি স্ট্যান্ডের সমন্বয়ে তৈরি আলোক ফাঁদ তৈরি করতে প্রায় ২০৩ সেমি দৈর্ঘ্য এবং ৫ সেমি ব্যাসের একটি লোহার স্ট্যান্ডের (এমএস পাইপ) প্রয়োজন হয়, যার উপরে ৩৬ সেমি প্রস্থ এবং ৪৮.৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি এঙ্গেলবার দ্বারা গঠিত চতুর্ভুজ আকৃতির একটি ফ্রেমে সোলার প্যানেল বসানো থাকে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার কারণে ফ্রেমটিকে স্ট্যান্ডের উপরে ২৩.৫০ উত্তর-দক্ষিণ কোণে স্থাপন করা হয়। সোলার প্যানেলটিকে স্ট্যান্ডের সাথে শক্ত করে আটকে রাখতে ৪৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি এমএস ফ্ল্যাটবার দ্বারা অতিরিক্ত সাপোর্ট প্রদান করা হয়। এই সাপোর্ট স্ট্যান্ডের মাথায় এবং সোলার প্যানেলের নিচে একটি ডিসি বাল্ব থাকে। বাল্বটিকে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য এমএস সিট দিয়ে ২৯ সেন্টিমিটার ব্যাসের চাকতি আকৃতির ঢাকনা তৈরি করা হয় এবং এটিকে ঢাকনার মাঝ বরাবর হোল্ডারের সাথে আটকে রাখা হয়। প্যানেলের ব্যাটারি স্ট্যান্ডের সাথে এমনভাবে লাগানো থাকে যেন বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পায়। আলোক ফাঁদে আকৃষ্ট পোকামাকড় মারা যাওয়ার জন্য বাল্বের নিচে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ৪৯.৫ সেমি ব্যাসের একটি গোল চাকতির (এমএস ফ্ল্যাটবার) সাহায্যে প্লাস্টিকের গামলা বসানো হয়। পানি ভর্তি প্ল­াস্টিকের গামলা অতিরিক্ত পানির ভারে পড়ে না যায় সেজন্য ৪৪ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি স্ট্যান্ডের সাহায্যে গোল চাকতিকে সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। লাইট জ্বলার পর পোকামাকড় আলোর আকর্ষণে লাইটের চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে বাল্বের নিচে থাকা শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট মেশানো পানির গামলায় পড়ে মারা যায়। পোকামাকড় ফসলের উপর ডিম পাড়ার কোনো প্রকার সুযোগ পাওয়ার আগেই মারা যাওয়ায় ফসল আর পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় না। মরা পোকামাকড় যেন পানি ভর্তি গামলায় পচে গন্ধ ছড়াতে না পারে সে জন্য দুইদিন পর পর গামলার পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে কোনো রকম জ্বালানির প্রয়োজন হয় না বলে এটি পরিবেশবান্ধব।


সোলার প্যানেলের সেলগুলো সৌরশক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপের কার্যক্রম শুরু হয়। প্যানেলের সেলগুলোর গৃহীত সৌরশক্তিকে একটি রেগুলেটরের সাহায্যে ডিসি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। রেগুলেটরটি একই সাথে ব্যাটারিকে অতিরিক্ত চার্জের মাধ্যমে নিশ্চিত ক্ষতি থেকেও  রক্ষা করে। ডিসি বাল্ব সরাসরি ব্যাটারি থেকে শক্তি গ্রহণের মাধ্যমে চালিত হয়। যন্ত্রটির সুবিধা হলো, এটি মাঠে একবার স্থাপন করলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে (দিনে) নিভে এবং সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে (রাতে) জ্বলে।


যে কোনো ধরনের আলোতেই পোকা আকৃষ্ট হয় কিন্তু আলোর তীব্রতা ও রঙের উপর পোকার আকৃষ্টতা কম বেশি হয়। ব্রির এফএমপি এইচটি বিভাগের বিজ্ঞানীগণ দীর্ঘদিনের গবেষণায় বাল্বের তিনটি আলোর রঙের সর্বাধিক কার্যকারিতা পেয়েছেন, যেগুলো সাধারণ আলোর তুলনায় পোকামাকড় দমনে বেশি কার্যকরী। বাল্বের আলোর রঙ তিনটি হলো- নীলাভ, হলদেটে বা পীতাভ এবং ফিকে সবুজ বা সবুজাভ। ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপে নীলাভ রঙের বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নীলাভ রঙের বাল্বের আলোর দিকে পোকামাকড় আকর্ষিত হওয়ার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি; কারণ নীলাভ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি।


ব্রি সৌরশক্তি চালিত আলোক ফাঁদের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই। সহজে এবং কম খরচে এটি তৈরি করা যায়। এজন্য জ্বালানি খরচ লাগে না এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়। দানাদার, ডাল, সবজি এবং অন্যান্য শস্যের পোকা দমনের জন্য আলোক ফাঁদের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ । ধানের মাজরা ও কাইচথোড়কালীন যাবতীয় ফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সবজির ফল ছিদ্রকারী পোকা, শোষক পোকা, চিবানো পোকা এগুলোর আক্রমণ দেখা মাত্র জমিতে আলোক ফাঁদ বসাতে হবে। আলোক ফাঁদ জমিতে বসানোর প্রথমদিকে পোকামাকড় মারা যাওয়ার পরিমাণ বেশি দেখা যাবে এবং সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে। প্রতি একর জমির জন্য পৃথক পৃথকভাবে একটি আলোক ফাঁদ বসাতে হবে। পুকুরে মাছ চাষের সাথে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যাবে। আলোক ফাঁদের সাহয্যে মারা যাওয়া পোকামাকড়গুলো মাছ সম্পূরক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে।


আলোক ফাঁদ স্থাপন ও সংরক্ষণে করণীয়
সোলার লাইট ট্র্যাপের নিচের অংশটিকে ভালোভাবে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। সম্ভব হলে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে স্থায়ীভাবে উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর স্থাপন করতে হবে।
পোকার জন্য স্থাপিত বাল্বতিটিকে নিচ থেকে ২/৩ অংশ উপর বরাবর দুই থেকে তিনটি ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে পুরো গামলাটি পানিতে ভরে যায় এবং লাইট ট্র্যাপ বাঁকা হয়ে পড়ে। এতে বাল্ব ও ব্যাটারি নষ্ট হতে পারে।


ফসলের মৌসুম শেষে লাইট ট্র্যাপটি ঘরে না রেখে মাঝে মাঝে চার্জ দিলে ব্যাটারি সচল থাকবে অন্যথায় চার্জ শূন্য হয়ে ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাতে উড়ন্ত পোকামাকড় দমনে ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপ একটি কার্যকর প্রযুক্তি। ব্রি সোলার লাইট ট্র্যাপ সৌরশক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করে বিধায় ফসলের মাঠে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যাবে। ফলে ফসলের মাঠে যেমন কীটনাশকের ব্যবহার কমবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে এবং পরিবেশ থাকবে নির্মল। বিষমুক্ত খাবার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রযুক্তিটি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

 

ড. মো. দুররুল হুদা১ড. মো. গোলাম কিবরিয়া ভূঞা২
বিধান চন্দ্র নাথ৩ ড. মো. পান্না আলী৪

১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ২,৩,৪ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিআরআরআই, গাজীপুর; যোগাযোগ : Kibria­­- 1971@yahoo.com (Mobile & b-kash: 01717902516)

বিস্তারিত
গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুরা রোগ বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- বাতা, ক্ষুরা, ক্ষুরপাকা, এঁসো, খুরুয়া, তাপরোগ, খুরাচল ইত্যাদি। দুই ক্ষুর ওয়ালা সকল প্রাণী এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া এ রোগের শিকার। ক্ষুরা রোগ হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। বছরের যেকোনো সময় এ রোগ হতে পারে। বর্ষার শেষ থেকে সারা শীতকাল (সেপ্টেম্বর  থেকে জানুয়ারি) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগে বাছুরের মৃত্যুর হার ব্যাপক এবং বয়স্ক পশুর উপর এর প্রভাব মারাত্মক। তবে এ রোগ দমন করা সম্ভব। একটু সচেতন থাকলে এবং সময়মতো প্রতিষেধক টিকা দিলে গবাদিপশুকে সহজেই এ রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।


ক্ষুরা রোগ কি ?
ক্ষুরা রোগ অতি তীব্র প্রকৃতির সংক্রামক ভাইরাস জনিত রোগ| এ রোগে আক্রান্ত পশুর মুখ ও পায়ে ঘা হবার ফলে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না এবং খুঁড়িয়ে হাটে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এ রোগ দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের গরুতে ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।


রোগের কারণ : ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ নামক এক প্রকার ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টি করে। সে কারণে ইংরেজিতে ক্ষুরা রোগকে এফ,এম,ডি বলে। এ ভাইরাসের মোট ৭টি টাইপ  রয়েছে। এগুলোর নাম এ, ও, সি, স্যাট-১, স্যাট-২, স্যাট-৩ ও এশিয়া-১। বাংলাদেশে এবং এশিয়া-১ টাইপের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।


রোগ বিস্তার : ক্ষুরা রোগ অত্যন্ত সংক্রামক হওয়ায় কোনো এলাকায় এ রোগ দেখা দিলে একশত ভাগ পশুই তাতে আক্রান্ত হয়। এ রোগের জীবাণু  রোগাক্রান্ত প্রাণীর ফোসকা ফেটে অন্য প্রাণীর দেহে  বিস্তার লাভ করে। রোগাক্রান্ত পশুর লালা, শেষ্মা, প্রস্রাব, মল ও দুধের মাধ্যমে দেহ হতে বের হয়ে আসে। এসব পশুর খাদ্য, পানি, আবাসস্থলের দেয়াল, বাতাস ইত্যাদি কলুষিত করে। বাতাসের সাহায্যে এ ভাইরাস ৬০/৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে সময় আক্রান্ত পশুকে দূর-দূরান্তের হাটবাজারে বিক্রির জন্য নেয়া হয়। তখন ভাইরাস ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে  ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। আক্রান্ত পশুর পরিচর্যাকারীর চলাচল এবং তার জামাকাপড়, জুতা ইত্যাদির  সাহায্যে ও ভাইরাস বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ভাইরাস বহনকারী ষাঁড় কৃত্রিম প্রজননের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক কারণ এ সব ষাঁড় থেকে সংগৃহীত সিমেন কৃত্রিম প্রজননে  ব্যবহার করলে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে।


রোগের লক্ষণ : প্রথমে জ্বর হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা  (১০৫-১০৭ ফারেনহাইট) এর মধ্যে  সীমাবদ্ধ থাকে।
জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভেতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝে ফোসকা হয়, পরে ফোসকা ফেটে লাল ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
আক্রান্ত পশুর মুখ থেকে লালা পড়তে থাকে, ঠোঁটের নাড়াচড়ার ফলে সাদা ফেনা বের হতে থাকে এবং চপ চপ শব্দ হয়। ঘাষ বা অন্য কিছু খেতে পারে না বলে পশু দুর্বল হয়ে পড়ে।
ক্ষুরের ফোসকা ফেটে ঘা হয়, পা ফুলে ব্যথা হয়। ঘা বেশি হওয়ায় চলা ফেরা করতে কষ্ট হয়।
ক্ষত স্থানে মাছি ডিম পাড়ে ফলে পোকা হয়। মাছি ও জীবাণুতে ঘা  বিষিয়ে উঠে। ফলে পশু পা ছুড়তে থাকে যেন পায়ে  কিছু লেগে আছে।
রোগের পরিমাণ বেশি হলে ক্ষুরা বা জিহ্বা খসে পড়তে পারে। গাভীর ওলানে ফোসকা হতে পারে, ফলে ওলান ফুলে উঠে এবং দুধ কমে যায়। বাছুরের এ রোগ হলে বাছুর প্রায়ই মারা যায়।
পশুর শ্বাসকষ্ট, রক্ত শূন্যতা এবং পরিবেশগত  উচ্চ তাপমাত্রায় অসহিষ্ণুতা দেখা যায়।

 

ক্ষতিকর প্রভাব : ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক হওয়ায় প্রতি বছর অসংখ্য পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে বিশেষ করে বাছুর  বেশির ভাগই মারা যায়।
রোগাক্রান্ত পশু সুস্থ হলেও কৃষি কাজে ব্যবহার করা যায় না ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। দুধ ও মাংসের উৎপাদন হ্রাস পায়।
গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হয় এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। ওলানের প্রদাহ হলে গাভীর দুধ দেয়ার ক্ষমতা চিরতরে লোপ পায়।

 

প্রতিকার : পৃথিবীর অনেক দেশ ক্ষুরা রোগ মুক্ত। এসব দেশের মধ্যে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। এসব দেশে হঠাৎ কোনো স্থানে ক্ষুরা রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত পশুকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক বলে অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা  করে পরিষ্কার শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই  কাদা বা পানিতে রাখা যাবে না।

 

এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। তাই আক্রান্ত পশুকে অন্যত্র নেয়া এবং বাইরের কোনো পশুকে এ এলাকায় আনা উচিৎ নয়।
আক্রান্ত এলাকার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল সুস্থ পশুকে অবিলম্বে টিকা  দিতে হবে।
আক্রান্ত পশুকে নরম ও তরল খাবার  যেমন- ভাতের ফ্যান বা জাউভাত খেতে দিতে হবে।

 

যিনি আক্রান্ত পশুর সেবাযত্ন করবেন তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়, হাত-পা এবং ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস অবশ্যই জীবাণু নাশক ওষুধ দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এ জন্য ১ লিঃ পানিতে ৪ চা চামচ আইওসান মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করাতে হবে।
মৃত পশুকে মাটির নিচে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

 

পশুর ঘর সব সময় পরিষ্কার  রাখতে হবে। দৈনিক ২% আইওসান দ্রবণ দিয়ে বা অন্য কোনো সুবিধাজনক জীবাণুনাশক দ্রব্য মিশ্রিত  পানি দ্বারা ধুয়ে দিতে হবে।
সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এ ব্যবস্থা ছাড়াই সীমান্তবর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য গরু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় এদেশে  এ রোগ প্রতিরোধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

 

ক্ষুরা রোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই বেশি কার্যকর, তাই ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের জন্য কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জোরদারকরণসহ গবাদিপশুকে প্রতি ৬ মাস অন্তর এ রোগের টিকা দিয়ে নিতে হবে। তাহলে এ রোগের  প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদের দেশের গবাদিপশুকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। 

 

মোঃ জাহিদুর রহমান                                                                                              

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, রামপাল, বাগেরহাট, টেলিফোন নং- ০৪৬৫৭-৫৬০২৪, মোবা : ০১৯১৩৮১৩৬৫৬                                                 

বিস্তারিত