০১. করোনাভাইরাস সর্ম্পকে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
০২. লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
০৩. পিপিই সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাক্সসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
০৪. কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।
০৫. যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।
০৬. নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।
০৭. নদীবেষ্টিত জেলাসমূহে নৌ-এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
০৮. অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে।
০৯. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। সারাদেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
১০. আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সকল সরকারি কর্মকর্তাগণ যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন-এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
১১. ত্রাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।
১২. দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে।
১৩. সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
১৪. অর্থনৈতিক কর্মকাÐ যেন স্থবির না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে।
১৫. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে।
১৬. সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যাতে বাজার চালু থাকে।
১৭. সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
১৮. জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপন করতে হবে।
১৯. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজের সকল স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সকলকে নিয়ে কাজ করবে।
২০. সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা অফিসারের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
২১. জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করবেন।
২২. সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন : কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা/ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্তা/বিধবা নারী এবং হিজরা সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
২৩. প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২৪. দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সকল সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি।
২৫. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
২৬. আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় করবেন না। খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
২৭. কৃষকগণ নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এক্ষত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে।
২৮. সকল শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি-ঘর পরিস্কার রাখবেন।
২৯. শিল্প মালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন।
৩০. গণমাধ্যম কর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভ‚মিকা পালন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৩১. গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দিবেন না এবং গুজবে বিচলিত হবেন না।
নাহিদ বিন রফিক
আলু বাংলাদেশের প্রধান সবজি। খাদ্যশস্যের তালিকায় দ্বিতীয়। বিশে^র সেরা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান সপ্তমে। আমরা যেমন ভাত খাই, তেমনি পৃথিবীর ৪০টি দেশের লোকেরা আলু খায়। অথচ কেউ কেউ মনে করেন, আলুর পুষ্টিমান খুব কম এবং এতে ভুঁড়ি বাড়ে। আসলেই এ ধারণাটি ভুল। কারণ, পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, আলুতে ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি রয়েছে। কিন্তু চালে তা মোটেও নেই। এছাড়া শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি তো আছেই। অপরদিকে চর্বির পরিমাণ চালের তুলনায় অনেক কম এবং আটার মাত্র এক পঞ্চমাংশ। তাই এর ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসও বাড়াতে হবে সমান তালে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। খাবার হিসেবে আমাদের চাহিদার পরিমাণ ৬০-৭০ লাখ মেট্রিক টন। আর বীজ হিসেবে প্রয়োজন প্রায় সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন। বাকি আলু রফতানি হচ্ছে বিদেশে। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় এবারের ফলনও বেশ ভালো। তাই চলতি বছরে উৎপাদন আশানুরূপ হবে। এখন ভরা মৌসুম। দামও একটু কম। কেজিপ্রতি দর ১৮ টাকা। যদিও মাসখানিক আগে দাম ছিল ১৪-১৫ টাকা। যেহেতু অধিকাংশ কৃষক আলু সংগ্রহের পরপরই বাজারে বিক্রি করে দেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাজারমূল্য কম থাকে। ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও আছে। এজন্য দরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময় আলু রাখার জন্য একমাত্র উপায় হিমাগার। এজন্য ব্যয় কম হলেও বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা। এছাড়া প্রায় ৩৫০ হিমাগারে দেশের মোট আলু রাখার জায়গাও হবে না। তাই সাধ্য না থাকায় কেউ কেউ খাটের নিচে কিংবা ঘরের কোনো স্থানের মেঝেতে আলু স্তূপ করে রাখেন। সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে এসব আলুর শতকরা ২০-৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। এজন্য খরচও হবে কম। বস্তাপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা। এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ‘অহিমায়িত ঘর’ ব্যবহারের মাধ্যমেও আলু গুদামজাত করা যায়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্যোগে এর উদ্ভাবন।
ছায়াযুক্ত স্থানে মাচার ওপর নির্মিত এ ঘরের ছাউনি হবে টিনের এবং চারদিকে থাকবে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক শতাংশ জমিতে বিস্তৃত ঘরের ধারণক্ষমতা ১৪-১৬ টন। অবশ্য ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আলুর পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে। একা সম্ভব না হলে কয়েকজন মিলেও তৈরি করা যেতে পারে। এভাবে সংরক্ষণ করলে ফড়িয়াদের দৌরত্ম্য বিদায় হবে। কৃষক হবেন লাভবান। মুখে ফুটবে হাসি। ‘পানির দামে আলু, চাষির মাথায় হাত’ এ ধরনের সংবাদ কোনো পত্রিকায় আর শিরোনাম হবে না। তাই সেসব সহজ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া দরকার।
আলু সংরক্ষণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক সময়ে সংগ্রহ। পরিপক্ব হলেই তুলতে হবে। এজন্য ৭-৮ দিন আগে গোড়া থেকে গাছ কেটে ফেলা দরকার। বৃষ্টি কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আলু তুলতে মানা। প্রখর রোদেও ঠিক নয়। এতে ব্যাকহার্ট রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সকালবেলা উত্তম। লাঙল কিংবা কোদালে আলু কেটে না যায়, সেদিক অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তোলা শেষে বস্তাভরে দ্রæত বাড়ি নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো কারণে জমিতে রাখতেই যদি হয়, তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে বিছিয়ে শুকনো খড়-কুটা কিংবা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। বস্তায় ঢুকানোর সময় আলু যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেজন্য প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা উত্তম। বাড়িতে এনে স্বাভাবিক বাতাস চলাচল করে, এমন শুকনো এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা দরকার। রাখার সময় বেশি উঁচু থেকে ফেলা যাবে না।
আলুর ছাল শক্তকরণের জন্য ঘরের খোলামেলা ঠাÐা জায়গা নির্বাচন করতে হয়। মেঝেতে চট বিছিয়ে ১ ফুট পরিমাণ উঁচু করে আলুর স্তূপাকারে রাখতে হয়। এর ওপরে পাতলা কাগজ দিয়ে ৫-৭ দিন ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই ছাল শক্ত হয়ে যাবে। নাড়াচাড়ায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। পাশাপাশি গায়ে ক্ষত থাকলে তা সেরে যাবে। পোকার আক্রমণ হতেও পাবে রক্ষা। সংরক্ষণের পূর্বে খুব ছোট, আঘাতপ্রাপ্ত, কাটা, ফাটা, ক্ষত, সবুজ বর্ণ এবং রোগ পোকায় আক্রান্ত আলুগুলো বাদ দিয়ে ছোট, মাঝারি এবং বড় আকারের আলু আলাদাভাবে নির্বাচন করতে হয়। আগেই ছায়াতে শুকিয়ে দিতে হবে। একটুও ভেজা থাকা চলবে না।
আলুর শ^াস-প্রশ^াস এবং বায়ু চলাচল উপযোগী করে ঘর তৈরি করতে হবে। খড়-কুটা, ছন, গোলপাতা এসবের ছাউনি এবং বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার এ ঘরটি মাটি থেকে একটু উঁচুতে মাঁচা তৈরি করে দিতে হয়। এর ওপর স্তূপ করে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতি স্তূপের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১ মিটার এবং প্রশস্ত হবে ২ মিটার। তাক বানিয়েও আলু রাখা যায়। বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি, ডোল এসবেও রাখা যাবে। নিজেদের থাকার ঘরে মাচায় বা তাক বানিয়ে, এমনকি চৌকির নিচে শুকনো বালুর ওপর আলু রাখা যাবে।
পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালির শুকনো পাতা গুঁড়া করে স্তূপে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কোনো কীটনাশক নয়। প্রতি ১৫ দিন পরপর আলুর অবস্থা দেখে নিতে হবে। দুর্গন্ধ বের হলে বুঝতে হবে আলুর পচন ধরেছে। পচা আলু সরিয়ে ফেলতে হবে। এর আশপাশের ভেজা আলু হালকা রোদে শুকিয়ে পুনরায় গুদামজাত করতে হবে। ইঁদুর কিংবা অন্য কোনো ক্ষতিকর প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলে, এদের দমন ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
এছাড়া রোগ কিংবা পোকায় আক্রান্ত আলু দেখামাত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। মাঝে মাঝে আলু ওপরে-নিচে উল্টেপাল্টে দিতে হয়।
মেধা, অর্থ ও শ্রমের বিনিময়ে কৃষক আলু উৎপাদন করেন। আর তা যদি সংরক্ষণের অভাবে লোকসান গুনতে হয়, তখন তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। তবে আগ্রহ এবং কৌশল জানা থাকলে এনে দিতে পারে এর সঠিক সমাধান। অত্যন্ত সহজ এ পদ্ধতিতে ৪ মাস পর্যন্ত আলু রাখা সম্ভব। য়
টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর: ০১৭১৫৪৫২০২৬ ; ই. মেইল:tpnahid@gmail.com
প্রফেসর ড. মু. আবুল কাসেম১ প্রফেসর ড. মো. ফারুক হাসান২ কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম৩
বিশ্বব্যাপী ভুট্টার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিধ্বংসী পোকা হলো ফল আর্মিওয়ার্ম বা সাধারণ কাটুই পোকা যার বৈজ্ঞানিক নাম ঝঢ়ড়ফরঢ়ঃবৎধ ভৎঁমরঢ়বৎফধ। অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিকল্প পোষকের উপস্থিতি এবং সেই সাথে দমন ব্যবস্থাপনা কঠিন হলেই কেবল একটি পোকা মারাত্মক ক্ষতিকর বা মুখ্য ক্ষতিকর পোকা হয়ে উঠে। এ তিন বৈশিষ্ট্যের প্রতিটিই রয়েছে এ পোকার মধ্যে। এটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের পোকা হলেও ২০১৬ সালে আফ্রিকা এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত ভারত, শ্রীলঙ্কায় এ পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। উদ্বেগের বিষয় হলো ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে স্থাপনকৃত ফেরোমোন ফাঁদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে এ পোকার উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদনকারী প্রায় সব জেলাতেই এ পোকার উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
পোকা চেনার উপায়
এ পোকার বাচ্চা বা কীড়ার দেহের উপরিভাগে দুইপাশে লম্বালম্বিভাবে গাঢ় রঙের দাগ রয়েছে। দেহের তলপেটের ৮ম অংশের উপরিভাগে ৪টি স্পষ্ট কালো দাগ আছে। মাথায় উল্টা ণ অক্ষরের মধ্যে জালের মতো দাগ রয়েছে।
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণের মাত্রা, জীবনকাল ও ক্ষতির লক্ষণ
এ পোকা ভুট্টা, সরগম, বাদাম, তামাক, বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজিসহ প্রায় ৮০ প্রকারের ফসলে আক্রমণ করে থাকে। তবে ভুট্টায় আক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। পোকাটি বাচ্চা বা কীড়া অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে। কীড়ার প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্য চাহিদা কম থাকে, তবে কীড়া বড় হতে থাকলে বিশেষ করে শেষের দিকে চাহিদা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পায়। সে কারণে শেষ ধাপসমূহে (৪-৬ ধাপ) অর্থাৎ কীড়া পূর্ণাঙ্গ বা বড় আকারের হলে রাক্ষুসে হয়ে উঠে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এমনকি এক রাতের মধ্যে সমস্ত ফসল নষ্ট করে দিতে পারে।
এ পোকার জীবনকাল ডিম-কীড়া-পুত্তলি-পূর্ণাঙ্গ পোকা এ চার ধাপে সম্পন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে এবং শীতকালে ৭০-৭৫ দিনে জীবনকাল সম্পন্ন করে। স্ত্রী পোকা গাছের গোড়ার দিকের কাÐের সাথে পাতার সংযোগস্থলের নিচের দিকে ১০০-২০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বেড় হওয়া বাচ্চাগুলো পাতা খেতে শুরু করে এবং পাতায় ছোট ছোট সারি ছিদ্র (জড়ি ড়ভ যড়ষবং ষরশব ংুসঢ়ঃড়স) তৈরি করে। কচি গাছের পাতার কানের মতো মোড়ানো অংশ এবং বড় গাছের ভুট্টার মোচার চারপাশে মোড়ানো পাতা খেতে পছন্দ করে। ভুট্টার মোচার চারপাশের পাতা খাওয়ার পর এরা মোচার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং মোচায় তৈরি হওয়া নরম দানাগুলো খেতে থাকে। এর মধ্যে ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়াগুলো পরিণত ও বড় হয়ে পাতা খেয়ে ঝাঝরা করে ফেলে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে ভুট্টা গাছের মাথার দিকে পৌঁছায়। কচি গাছ হলে বৃদ্ধি বন্ধ হয় এবং নতুন কোনো পাতা গজায় না। মোটামুটি ১৪ দিন পর পূর্ণাঙ্গ কীড়া পিউপা বা পুত্তলি দশায় পৌঁছার জন্য মাটিতে পড়ে। এ সময় এরা ১-৩ ইঞ্চি গভীরে অবস্থান করে। মাটি খুব বেশি শক্ত হলে ঝরে পড়া পাতা দিয়ে নিজেদের ঢেকে রাখে। এর প্রায় ৮-৯ দিন পর পূর্ণাঙ্গ মথ মাটি থেকে বের হয়ে আসে এবং পুনরায় জীবনচক্রটি শুরু করে। উষ্ণ, আর্দ্র আবহাওয়ায় একটি ভুট্টা ফসল মৌসুমে পোকাটি ৪-৫টি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। এ জন্য খুব অল্প সময়ে এটি বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।
পোকা বিস্তারের মাধ্যম
পোকাটি পৃথিবীব্যাপী সংগনিরোধ বালাই হিসেবে পরিচিত। ডিম, কীড়া, পুত্তলি অবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত উপাদান যেমন- চারা, কলম, কন্দ, চারা সংলগ্ন মাটি ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে। এমনকি ঝড়ো বাতাসের সাথে কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা
যেহেতু পোকাটি ইতোমধ্যে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলসহ সারাদেশে ভুট্টা আবাদকৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে ব্যাপক ফসলহানির সম্ভাবনা রয়েছে। পোকাটি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় পোকাটির অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে। চারা গজানোর পর থেকে মোচা আসা পর্যন্ত নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে মোচায় আক্রমণ হলে এ পোকা দমন করা প্রায় অসম্ভব এবং ফলন শূন্যের কোঠায় চলে আসতে পারে। পোকার উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ফসল লাগানোর সাথে সাথে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য ভুট্টা ও অন্যান্য পোষক ফসলের জন্য বিঘা প্রতি অর্থাৎ ৩৩ শতকে ৫ থেকে ৬ টি ফাঁদ পাততে হবে এবং সব সময়ই খেয়াল রাখতে হবে পোকার উপস্থিতি। পোকাটি রাতের বেলা আক্রমণ করে থাকে, দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে। তাই ভুট্টা গাছে সরাসরি খাওয়ার লক্ষণ বা এদের মল দেখেও আক্রান্ত গাছ শনাক্ত করা যায়। পূর্ণাঙ্গ পোকা, পোকার কীড়া কিংবা ক্ষতির লক্ষণ চেনার জন্য প্রয়োজনে আপনার বøকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য নিতে পারেন।
ক্ষতিকর-রাক্ষুসে এ পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রথমত ভুট্টা লাগানোর সময় কোরাজেন (১ মিলি/কেজি বীজ) জাতীয় কীটনাশক দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। গাছের দুই-তিন পাতা অবস্থা হতেই আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য ফোটা দলাবদ্ধ কীড়া সংগ্রহ করে পিষে মেরে ফেলতে হবে অথবা এক ফুট গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। এছাড়া হাত বাছাই (ঐধহফ ঢ়রপশরহম) ভুট্টার মোচা আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। আক্রান্ত গাছ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় (৯০-১০০ ফুট এলাকা জুড়ে) অতিদ্রæত জৈব বালাইনাশক স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহাইড্রোসিস ভাইরাস (এসএনপিভি) এক লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার জৈব বালাইনাশক এসএনপিভি স্প্রে করতে হবে। সম্ভব হলে উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর (ইৎধপড়হ যবনবঃড়ৎ) আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দিতে হবে। এরা ফল আর্মিওয়ার্মের কীড়ার গায়ে ডিম পাড়ে। ফলে ঐ কীড়াগুলো ভুট্টার ক্ষতি করতে পারে না। যদিও এ পোকা দমনে রাসায়নিক কীটনাশক তেমন কার্যকর নয়, তবে একান্ত প্রয়োজনে প্রোক্লেইম (১ গ্রাম/লি.) বা স্পিনোসেড ট্রেসার (০.৪ মিলি/লি.) বা ভিরতাকো (০.৬ গ্রাম/লি.) বা নাইট্রো (১মিলি/লি.) জাতীয় কীটনাশক আক্রান্ত জমি ও পাশ্ববর্তী এলাকায় পড়ন্ত বিকেলে ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। কারণ বিক্ষিপ্ত ভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আর্থিক ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি এমনকি কীটনাশকের প্রতি পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে। আক্রান্ত ফসলে সেচ দেয়ার সময় যতটুক সম্ভব ঢালাও বা প্লাবন সেচ দিতে হবে।
পরবর্তী ফসলে ভুট্টা বা অন্যান্য পোষক ফসল চাষ না করে ধান চাষ করলে এ পোকার আক্রমণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আফ্রিকাতে স্থানীয় প্রযুক্তি হিসেবে আক্রান্ত ভুট্টা গাছের গোড়ার মাটি বা ছাই ও মরিচ বাটা বা গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে কাদা বানিয়ে বদনা বা মগ দিয়ে খোলে বা পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ৩-৪ দিনের মধ্যেই কীড়াগুলো মারা যায়। তবে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। য়
১ভাইস-চ্যান্সেলর ও পরিচালক, কৃষক সেবা কেন্দ্র, হাজী মোহামম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), দিনাজপুর, ২চেয়ারম্যান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর, ৩পিএইচডি ফেলো (এনএটিপি), কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল:ayemdae@yahoo.com
মো. হাফিজুল হকখান১ আশফাক আহমেদ সবুজ২
বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজি সমূহের মধ্যে টমেটো অন্যতম একটি প্রধান সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ বাবিটা ক্যারোটিন (৩৫৬ মাইক্রো গ্রাম/১০০ গ্রাম) এবং ভিটামিন-সি (২৭ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম) রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই টমেটো উৎপন্ন হয়। টমেটো শীতকালীন সবজি হওয়ায় ভরা মৌসুমে সরবরাহ বেড়ে যায় এবং বাজার মুল্য হ্রাস পায় । টমেটোর এই ভরা মৌসুমে এমন চিত্র প্রায় দেখা যায় যে, মৌসুমের শেষ অংশে অনেক টমেটো ক্ষেতই নষ্ট হয়ে যায়। এটি দ্রæত পচনশীল পণ্য হওয়ায় ও সংগ্রহোত্তর দুর্বল অবকাঠামোর (অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা ও সংরক্ষণ অসুবিধা) জন্য সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে এর একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এই সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ প্রাায় ৩০%। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় টমেটো সংরক্ষণ করা যায় না।
তাই, টমেটো পাল্পঘন করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ কাল বৃদ্ধি করে এর ব্যবহার এবং সরবরাহ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে শুধু সংরক্ষণ কালই বৃদ্ধি নয় বরং পণ্যের মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগ, টমেটো সংরক্ষণ কালে গুণগতমান অপরিবর্তীত রেখে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় টমেটো পাল্প সংরক্ষণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। স্বল্প ব্যয়ে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহারের মাধ্যমে অপচয় রোধ করার পাশাপাশি টমেটোর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে, ক্ষতির পরিমান কমবে এবং সর্বপরি গ্রামীণ পর্যায়ে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
টমেটো পাল্প সংরক্ষণ পদ্ধতি : নির্বাচিত পরিপক্ব টমেটো সংগ্রহ করার পর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কেটে টুকরো করতে হয়। টুকরোগুলো একটি পাত্রে নিয়ে ১৫-২০ মিনিট সিদ্ধ করে কাঠের হাতাদিয়ে পিষেপাল্প বের করতে হয়। ত্বক ও বীচি আলাদা করতে কাঠের হাতাদিয়ে ভালভাবে নাড়তে হবে। একটি সূক্ষ ছিদ্রযুক্ত চালনী দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে খোসা ও বীজপাল্প থেকে আলাদা করা হয়। আলাদা করা পাল্প একটি পাত্রে নিয়ে জ¦াল দিয়ে ঘন করতে হয় (১০% টিএসএস পর্যন্ত)। অতঃপর প্রতি কেজি টমেটো পাল্পে ১ গ্রাম সোডিয়াম বেনজোয়েট (১০০০ পিপিএম) এবং ২ গ্রাম সাইট্রিক এসিড (০.২%) যোগ করা হয়। ঘন পাল্প বায়ুরোধী ও জীবাণুমুক্ত পাত্রে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। উক্ত পাত্রে টমেটো পাল্প ৩-৪ মাস পর্যন্ত জীবাণুমুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণকালে পাল্পের গুণগত মানের কোন পরিবর্তন হয় না। এই সংরক্ষিত পাল্প পরবর্তীতে সকল প্রকার রান্না এবং পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার করা যায়। য়
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা: ০১৭১৫০৬৩২৬২, ইমেইল : hafiz_hkhan@yahoo.com. ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৭১৭৮০৫৪১৪, পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
মজার মজার ফল নিয়ে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ আসে মধুমাস হয়ে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফলের পাকা ও মিষ্টি ফলের ম ম গন্ধে আমাদের রসনাকে বাড়িয়ে দেয়। মৌসুমি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি জ্যৈষ্ঠের গরমে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। সেই সাথে পুষ্টি সমস্যা দূর হতে পারে কৃষিজীবী ভাইবোনদের। আর এই মাসে প্রিয় পাঠক, চলুন এক পলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ভুবনের কাজগুলো-
বোরো ধান
জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
শুকনো বীজ ছায়ায় ঠাÐা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
আউশ ধান
এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতিদ্রæত বীজ বপন করতে হবে।
চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে।
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়।
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে।
জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়।
ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।
ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়াপোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়াপোকা গাছের কচিপাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছাপোকা ও ঘোড়াপোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমনÑ শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা
আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তুলাবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আপনার যদি তুলাচাষ উপযোগী উঁচু জমি থাকে এবং আপনি তুলাচাষে আগ্রহী হোন তাহলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিকটবর্তী অফিস/ইউনিট অফিস যোগাযোগ করূন।
শাকসবজি
মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাবপোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তা ছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন।
মাঠের মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে।
গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন।
পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানিকচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন।
যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭-১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে।
উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
এ সময়ে প্রাণিচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস-মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে।
এ ছাড়া হাঁসÑমুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে।
মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে।
বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে।
গবাদিপশুর গলাফোলা, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছ প্রজননে আগ্রহী চাষিভাইদের স্ত্রী-পুরুষ মাছ (ব্রæড ফিশ), পিটুইটারি গ্রন্থি, হাপা এবং ইনজেকশনের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখতে হবে।
আঁতুড় পুকুর বন্যায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে পোনার আকার ১ ইঞ্চি হলে সাবধানে ধরে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
নিয়মিত তদারকী, রাক্ষুসে মাছ তোলা, আগাছা বা জংলা পরিষ্কার, খাবার দেয়া, সার দেয়া, সম্পূরক খাবার দেয়া, জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এসব প্রাষঙ্গিক কাজগুলো নিয়মিত করতে হবে।
এ ছাড়া যে কোনো সমস্যায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরো বেশি লাভবান হবেন। য়
উপজেলা কৃষি অফিসার (এল. আর.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সংযুক্ত: কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল ; editor@ais.gov.bd ২৩
* কৃষিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব এড়াতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কৃষিযান্ত্রিকীকরণ, বীজ, সেচ ইত্যাদিসহ কৃষিখাতে জরুরি সহায়তা বাবদ প্রদেয় ২৫০ কোটি টাকার মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে ৭০% ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের মাঝে ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার বিতরণ;
* সেচ এবং বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে আউশের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ;
* পারিবারিক কৃষির আওতায় সবজি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সার, বীজ এবং প্রযুক্তি প্রণোদনার মাধ্যমে বসতবাড়ির আঙিনাসহ সকল পতিত জমিতে শাকসবজি এবং অন্যান্য ফসল চাষের উদ্যোগ;
* হাওরের বোরো ধান কাটার শ্রমিক সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হাওর অঞ্চলে ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার সরবরাহ প্রদান (পূর্বের বরাদ্দসহ বর্তমানে হাওরাঞ্চলে ৩৫৯টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৪২টি রিপার সচল রয়েছে এবং প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক নিয়োজিত আছে);
* দ্রæত হাওরের বোরো ধান কাটার জন্য উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাওর এলাকায় আগমন ও চলাচল নির্বিঘœ করা। এ কাজে ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং জেলা/উপজেলা কৃষি অফিসের ব্যবস্থাপনায় হাওরে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক প্রভৃতি উপকরণ প্রদান, নির্বিঘœ গমনাগমন, ধান কাটা স্থলে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে;
* হাওরে এবং যেসব অঞ্চলে ধান কর্তনের সময় হয়েছে সেই সকল অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিগণের সহায়তায় ‘নিজের ধান নিজেরা কাটি’ ¯েøাগান দিয়ে ধান কাটার উদ্যোগ গ্রহণ। এই উদ্যোগের ফলে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ কৃষকের সাথে ধান কাটায় অংশ নিচ্ছে;
* আগামী ৩০/০৪/২০২০ তারিখের মধ্যে নিচু হাওরাঞ্চলের ধান কর্তন সম্পন্ন এবং আগামী ০৭/০৫/২০২০ তারিখের মধ্যে সকল হাওরাঞ্চলের ধান কর্তনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে;
* যদিও আউশ একটি বৃষ্টি নির্ভর ফসল তথাপি আউশ মৌসুমে কোনো কোনো এলাকায় বীজতলা তৈরি এবং চারা রোপণের প্রাথমিক অবস্থায় সেচ প্রয়োজন হয়। এই প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে বিএডিসি কর্তৃক সেচ মাশুল ৫০% কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পরবর্তী বোরো মৌসুমেও অব্যাহত থাকবে;
* সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়েও জরুরি পণ্য বিবেচনায় সার, বালাইনাশক, বীজ, সেচযন্ত্রসহ সকল কৃষিযন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার প্রভৃতি), খুচরা যন্ত্রাংশ, সেচযন্ত্রসহ কৃষিযন্ত্রে ব্যবহৃত জ্বালানি/ডিজেল, কৃষিপণ্য আমদানি, বন্দরে খালাসকরণ, দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্র নির্বিঘœ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় অব্যাহত রাখা হয়েছে;
* করোনা ছুটিকালীন সময়ে সকল কৃষিপণ্যবাহী গাড়ি চলাচল এবং এসব কাজে নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের চলাচল নির্বিঘœকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
* দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রদত্ত সহায়তার সাথে নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রদত্ত সহায়তার সাথে ত্রাণসামগ্রীতে আলু, সবজি, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিতরণযোগ্য ত্রাণসামগ্রীতে আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে;
* কৃষকের উৎপাদিত সবজি ও ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্যের ভ্রাম্যমাণ বাজার পরিচালনা শুরু করেছে;
* বর্তমান বাজেটে কৃষকদের স্বার্থে সারসহ সেচকাজে বিদ্যুৎ বিলের রিবেট বাবদ কৃষিখাতে ৯০০০ কোটি টাকার ভর্তুকি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে;
* ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকায় নির্ধারণ;
* বর্তমান বাজেটে বরাদ্দকৃত কৃষিতে পুনর্বাসন ও প্রণোদনা বাবদ ১২০ কোটি টাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ ও সমবায়ভিত্তিক (মন্ত্রণালয়ে) চাষাবাদের জন্য ৫০ কোটি টাকা এবং ফসলে নতুন জাত ও প্রযুক্তি স¤প্রসারণের জন্য প্রদর্শনী স্থাপন ও গ্রহণকরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে;
* বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে খাদ্য বিভাগ কর্তৃক ধান/চাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষকের তালিকা তৈরিকরণ এবং কৃষকের সুবিধার্থে ইউনিয়ন পর্যায়ে ময়েশ্চার মিটার (ধানের আর্দ্রতা পরিমাপক যন্ত্র) বরাদ্দ প্রদান;
* আগামী খরিপ-২ এ রবি মৌসুমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির আগাম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে;
* করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময় কৃষি কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে থেকে কৃষকের সাথে মাঠ পর্যায়ে অবস্থান নিশ্চিতকরণ;
* কৃষকের সাথে থাকুন, কৃষকের পাশে থাকুন।
কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান
সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব করোনা পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সংঘটিত সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ও মানবিক সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছে করোনা সংক্রমণ ও কারোনা সংক্রমণজনিত মৃত্যু পরিস্থিতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। কেননা বিশ্বযুদ্ধের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল সীমিত কিন্তু করোনায় ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে ২১২ এর বেশি দেশ। চলতি মে মাসের ০২ তারিখ পর্যন্ত দুই লাখের উপরে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছে ৩৪ লক্ষাধিক মানুষ। আমেরিকা-ইউরোপের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে অতি উন্নত দেশগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমসিম খাচ্ছে, অসহায় বোধ করছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এতটাই তীব্র যে, গোটা মানব সভ্যতা হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সাতশো কোটি মানুষ করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার আশায় স্বপ্রণোদিত গৃহবন্দীত্বের জীবন বেছে নিয়েছে। এমন বিপর্যয় উত্তোরাধুনিক সভ্যতার প্রতিটি মানুষের কাছে ছিল অকল্পনীয়।
বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য জয়ের লড়াইয়ে নিয়োজিত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১৪৬ জন মানুষ বসবাস করে। এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ কৃষি এবং শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত। মাত্র ৮৬ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি থেকে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান হচ্ছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকা ৪টি খুঁটির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এগুলো হলো :
১. কৃষি
২. রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প
৩. বিদেশে কর্মরত শ্রমশক্তি এবং
৪. দেশের অভ্যন্তরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ
জিডিপি নিয়ন্ত্রণের এসব ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে খাদ্যের যোগানদার খাত হিসেবে কৃষি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের কৃষি ব্যবস্থার এক ধরনের চিরাচরিত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এ ব্যবস্থা এখন এক আশাজাগানিয়া সমৃদ্ধির স্তরে উঠে এসেছে। দেশ আজ প্রধান দানাজাতীয় খাদ্যপণ্য চালে উদ্বৃত্ত, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ, গম, ভুট্টা ও আলুর মতো প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে সাফল্যের পাশাপাশি সবজি, ফলমূল ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। সেইসাথে ডাল ও তেলবীজ উৎপাদনে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করছে। পাশাপাশি-মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে অভ‚তপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির দ্বারা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আক্রান্ত হওয়া মানে বাঁচা-মরার আর এক সংকটের মুখোমুখি হওয়া। এ কারণে কৃষির উপর করোনা পরিস্থিতির প্রভাব সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ বা উত্তরণের জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই। কেননা, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ইতোমধ্যেই করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতির হালহাকিকত সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। গত ২৭ এপ্রিল ২০২০ এক প্রেস ব্রিফিং এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন যে করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্ব মন্দায় দুর্ভিক্ষ হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি আমাদের প্রধান ভরসা।
করোনা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের কৃষি
চলতি বছরের শুরুতেই কোভিড-১৯ পরিচয়ে করোনা ভাইরাস চীন দেশে মানুষের জন্য মহামারী আকারে দেখা দেয়। তার প্রকোপ বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় মার্চ মাসের সূচনায়। এক মাস যেতে না যেতে অর্থাৎ মার্চ মাসের মধ্যেই করোনা বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ মহামারী আকার ধারণ করে। ২ মে পর্যন্ত আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭৯০ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৫ জন এবং এ ক্রমবৃদ্ধি সূচকীয় হারে বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ। বিগত ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সকল নাগরিককে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করাসহ কিছু বিশেষ স্বাস্থ্য সুরক্ষা আচরণ রপ্ত করার জন্য রাষ্ট্রীয় নিদের্শনা দেয়া হয়; বন্ধ করে দেয়া হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান, স্কুল-কলেজ ও গণপরিবহন। শহর থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ গ্রামে চলে যায়। মানুষের মধ্যে কাজ করতে থাকে ভয় ও অসহায়ত্ব। সংগতকারণেই এর প্রভাব কৃষি ব্যবস্থার উপর পড়ছে। কেননা কৃষক সমাজই কৃষির চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন ব্যবস্থায় অক্টোবর মাস থেকে পরের বছর মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় রবি মৌসুম। এ মৌসুম মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য প্রধান মৌসুম। এ মৌসুমে প্রাকৃতিক বৈরিতা তেমন থাকে না সে কারণে ফসল উৎপাদন নিরাপদ ও নির্বিঘœ হয়। এ মৌসুমে প্রধান খাদ্যশস্য বোরো ধানের পাশাপাশি গম, ভুট্টা, আলু, ডাল ও তেলবীজ, পিয়াঁজ, রসুন, মরিচের মতো প্রধান প্রধান মশলা উৎপান ও সংগ্রহের কাজ চলে; প্রতিটি কৃষক পরিবার কাটায় ব্যস্ত সময়। এমন একটি সময়ে যদি কৃষকদের ঘরে থাকতে হয়, উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রয় না করতে পারে, মাঠের ফসলের যদি প্রয়োজনীয় পরিচর্যা না হয় এর প্রভাব কৃষির উপর পড়বে বইকি। এ ছাড়া সমাগত খরিফ-১ মৌসুমে আউশ ধান, পাট, মুগডাল ইত্যাদি ফসল চাষের প্রস্তুতি ও পরিচর্যা, মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাস জুড়ে বোরো ধান কর্তন ও সংগ্রহের কাজে প্রতিনিয়ত কৃষকদেরকে মাঠে যেতে হবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশব্যাপী চলবে বোরো ধান কর্তন। এ সময় উত্তরবঙ্গের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট এবং জামালপুর, টাঙগাইল ও ময়মনসিংহ থেকে কৃষি শ্রমিক হাওর অঞ্চলে যাতায়াত করবে। প্রয়োজন হবে ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার প্রদত্ত কর্তন যন্ত্র ব্যবহারের। করোনা পরিস্থিতির কারণে এ কার্যক্রম বিঘিœত হলেও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হাওরে কৃষি শ্রমিক প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসাথে ৪০০ এর অধিক কর্তন যন্ত্র ৭০% ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষিতে যে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়। এ সব রাসায়নিক দ্রব্যের কোন কোনটি কাঁচামাল হিসেবে আবার কোনটি তৈরি পণ্য হিসেবে বিদেশ থেকে আসে। আমরা যে সবজি, ভুট্টা এবং পাট উৎপাদন করি এসব ফসলের বীজের প্রধান উৎস বিদেশ। শীতকালীন সবজি বীজ, আলু এবং কিছু কিছু হাইব্রিড ধানের বীজও বিদেশ থেকে আসে। পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতির বেশিরভাগ আসে বিদেশ থেকে। করোনা জনিত কারণে এসব পণ্য বিদেশ থেকে সময়মতো আসা বিঘিœত হলে তার নেতিবাচক প্রভাব কৃষির উপর পড়তে বাধ্য।
উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ কৃষি ক্ষেত্রে আরেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। দেশের ভেতরে এবং বাইরের পচনশীল কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ বিঘিœত হলে তার প্রভাবও কৃষির উপর পড়বে নানাভাবে নানামাত্রায়।
এই বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই আমাদের কৃষি উৎপাদনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। বিষয়টি কত বড় চ্যালেঞ্জ তা আমরা অনুমান করতে পারি। এমনিতেই কৃষি জলবায়ুর প্রভাব নির্ভর একটি অনিশ্চয়তার পেশা, তার উপর যদি এই প্রাণঘাতী মহামারীর মুখোমুখি হয়ে কৃষি উৎপাদন বেগবান করতে হয় সে তো হবে এক অন্য রকম মহাযুদ্ধ। এই মহামারী থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে কৃষির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার মহাযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে এবং জয়ী হতেই হবে।
আর জয়ী হতে হলে এই যুদ্ধের প্রধান সৈনিক কৃষক ভাইদের পাশে সর্বোচ্চ এবং সর্ব প্রকার সহায়তা নিয়ে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে সবার আগে। করোনা থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে কৃষক ভাইয়েরা করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যেন শামিল থাকে সেজন্য সরকার স্বাস্থ্য বিভাগ ও তথ্য বিভাগের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষক নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রসারণ কর্মীগণ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে দ্বিগুণ সতর্কতা, দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকারের সাথে যাতে মাঠ পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তি ও পরামর্শ সেবা অব্যাহত রাখেন সেজন্য সংস্থা পর্যায়ে এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের জন্য মোবাইল ভাতা বাড়িয়ে এবং করোনাকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করে এই সেবার পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নিতে হবে। প্রধান কাজ হবে উৎপাদনে কৃষকের মনোবল সুদৃঢ় করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এই কাজগুলো করার জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহীত উদ্যোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
১. বিদ্যমান মাঠ ফসলের (ঝঃধহফরহম ঈৎড়ঢ়ং) প্রয়োজনীয় পরিচর্যা অব্যাহত রাখা; কৃষক ভাইয়েরা স্ব-উদ্যোগেই এ কাজটি করে থাকেন। আমাদের সম্প্রসারণ কর্মীরা এ কাজে পরামর্শ সেবা দেয়ার কাজে নিয়োজিত আছেন।
২. প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, বালাইনাশক, সেচ ব্যবস্থাপনাসহ কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক সময়ে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
৩. রাজস্ব খাতের প্রণোদনা এবং বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের কার্যক্রম যাতে মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে নজরদারি জোরদার করা।
৪. স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কৃষি পণ্যের পরিবহন, গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ কাজসমূহ নির্বিঘœ হয় সে ব্যবস্থা করা।
৫. মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বশীল ও সময়োচিত দিক নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক জোগানের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর এবং হাওর অঞ্চলের জেলাগুলোর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জনপ্রতিনিধি, সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে কার্যকর যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকদের হাওরে ধান কাটার অংশগ্রহণে সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০০ কোটি টাকা প্রণোদনার অর্থদিয়ে ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার হাওরে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, মাননীয় সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কৃষি সচিব ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নেত্রকোনার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন এবং খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়ন হাওরের বোরো ধান কাটা পরিদর্শনে উপস্থিত হয়ে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করেন।
৬. খরিপ-১ মৌসুমের প্রধান প্রধান ফসল যেমন আউশ ধান, পাট, মুগডাল ইত্যাদি চাষের লক্ষ্যমাত্রা যাতে অর্জিত হয় সে বিষয়ে কৃষি গবেষণা, বিএডিসি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ কর্মধারা জোরদার করা। এ ক্ষেত্রে বীজ ব্যবসায়ী বিশেষ করে যারা হাইব্রিড ধান বীজ এবং পাট বীজ বিপণন করে থাকেন তাদের সাথে সমন্বয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
৭. আমন তথা খরিফ-২ মৌসুমে ইতোমধ্যে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
৮. খরিফ-১ ও খরিফ-২ মৌসুমে ফসল চাষ নির্বিঘœ করার জন্য প্রয়োজনীয় আমদানীযোগ্য উপকরণের যোগান নিশ্চিত করার জন্য উৎস দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং এসব পণ্যের আগমন, পরিবহন ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমদানিকারক ও বিপণনকারী কোম্পানিসমূহের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
৯. করোনা দুর্যোগকালে উদ্ভাবনমূলক সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের জন্য উদ্ভাবনী কর্মকর্তাদের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা। এসব উদ্ভাবনী সম্প্রসারণ সেবা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। উদ্ভ‚ত করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে চাষযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল উৎপাদন এর যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়কালে অধিক দুর্দশাগ্রস্তদের খাদ্যশস্য প্রেরণের যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তা সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়নে কৃষক সমাজের সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বশক্তি নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরিস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত অবনতি ও কৃষি ক্ষেত্রে করণীয়
এতসব প্রস্তুতি ও প্রত্যাশা অতি অবশ্যই ভ‚লণ্ঠিত হবে যদি পরিস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত অবনতি ঘটতে থাকে। করোনা সংক্রমণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এবং চিকিৎসা সুবিধার তুলনামূলক অপ্রতুলতা আমদের জন্য অধিকতর ঝুঁকির কারণ হতে পারে। পরিস্থিতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হলে অন্য সব ব্যবস্থার মত কৃষি খাতের উপরেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়াও কৃষি উপকরণের উপর আমাদের বিদেশ নির্ভরতা আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিঘিœত করতে পারে। অধিকন্তু তৈরি পোশাক রপ্তানি ও জনশক্তি থেকে আয় কমে গেলে তা আমাদের সার্বিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রীয় সামর্থ্যরে উপর প্রভাব ফেলবে। এমন চরম খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমরা কোন পর্যায়ে কৃষি উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখবো তথা খাদ্যোৎপাদন চাহিদার সমানুপাতে রাখব সে বিষয়টি এখন থেকেই ভাবতে হবে। এই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে করণীয় হলোÑ
১. করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলে সম্ভাব্য নিরাপদ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষি উৎপাদন চালু রাখতে হবে সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া।
২. এ বিষয়ে বিশ্ব পরিসরের কোন কার্যকর কৌশল বা অনুসরণযোগ্য অভিজ্ঞতা থাকলে তা গ্রহণ ও প্রয়োগের চর্চা করা। সেই সাথে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের উপযোগী উদ্ভাবনমূলক কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা।
৩. দেশজুড়ে মাঠে থাকা বোরো ধান যাতে সম্পূর্ণরূপে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় তার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, এক্ষেত্রে হাওর অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি, মাঠ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মধ্যে যে সমন্বয়মূলক কর্মধারা সূচিত হয়েছে তা হাওর অঞ্চলের বাহিরে অন্য জেলাগুলোতেও অনুসরণ করা।
৪. ভুট্টা, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে কৃষকদের সহযোগিতা করতে হবে।
৫. গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বসতবাড়িতে এবং শহরাঞ্চলের বাড়িতে পুষ্টি বাগান রচনার কাজ দ্রæততার সাথে করতে হবে। হোম কোয়ারিন্টাইনে থাকা অবস্থায় এ কাজে সকলকে উৎসাহিত করতে হবে। নার্সারি থেকে যাতে বীজ বা চারা সংগ্রহ করে এ কাজ করা যায় তার সুব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে নারী এবং যুবশক্তি ব্যবহারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. দরকারি কৃষি যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয় মজুদ গড়ে তুলতে হবে এবং ভর্তুকি মূল্যে অধিক সংখ্যক কৃষক যাতে কৃষি যন্ত্রপাতি পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. কৃষি উপকরণ দেশের বাইরে থেকে আনা, খাদ্যপণ্য আমদানি রপ্তানি এবং কৃষি পণ্যের ও উপকরণের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থা সুচারুরূপে চালু রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তঃসমন্বয় জোরদার করতে হবে।
৮. চলতি বোরো মৌসুম থেকে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান চাল সংগ্রহের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি গোডাউন এবং সরকারি শস্যগুদামগুলো ব্যবহার করতে হবে। করোনা মোকাবেলায় এটা হবে অতি গুরুত্বপর্ণ কার্যক্রম।
৯. কৃষক, কৃষি উদ্যেক্তা এবং ক্ষুদ্র মাঝারি ও বড় কৃষি ব্যবসায়ীদের কম সূদে (৪% হারে) ঋণ প্রদান করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫০০০ কোটি টাকার যে প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তা নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. প্রকৃত কৃষকদের কাজ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে অধিক পরিমাণ ধান ক্রয় করে ধানের বাজারমূল্য যাতে কৃষকের জন্য অলাভজনকভাবে কমে না যায় সে বিষয়ে তীব্র দৃষ্টি রেখে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয়ের কার্যব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. হাওরে ও অন্যান্য জেলায় বোরো ধান সংগ্রহের সময় বজ্রপাতে যেসব কৃষি শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে তাদের পরিবারের জন্য বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে কৃষি শ্রমিকদের রক্ষা করতে হবে।
১২. ক্ষতিগ্রস্ত ফুল, ফল ও সবজি চাষিদের তালিকা তৈরি করে তাদের প্রণোদনার সহায়তার আওতায় আনতে হবে।
১৩. কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করে তা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যমান জনবলের দক্ষতা, মনোবল ও আগ্রহীর সাথে কাজ করার ইচ্ছা বাড়ানোর কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
১৪. কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন পতিত জমিতে ফসল উৎপাদনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
১৫. গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সৃষ্ট কৃষক সংগঠন/সংঘসমূহকে মাঠ পর্যায়ে ও বসতবাড়িতে ফসল উৎপাদন এবং যৌথভাবে তা বাজারজাতকরণে কাজে লাগাতে হবে। য়
এপিএ এক্সপার্ট পুল সদস্য, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল-০১৭১১৮০৩৬৯৫, ই-মেইল : hamidur2152@gmail.com
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো. শরিফুল ইসলাম, গ্রাম : তাম্বুলখানা, উপজেলা : ফরিদপুর সদর, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন : ধান গাছের মাইজ পাতা মরে যাচ্ছে। কি করণীয়?
উত্তর: এটা মাজরা পোকার জন্য হচ্ছে। এই পোকা গাছের কাÐ কেটে দিচ্ছে। এই পোকা দমনের জন্য জমিতে ডাল পুতে দিতে হবে যাতে পাখি বসতে পারে এবং মাজরার লার্ভাগুলোকে খেতে পারে। আর রাসায়নিক ব্যবস্থা হিসেবে কার্বোসালফান গ্রæপের মার্শাল ২০ থেকে ২২ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া কারটাপ ৪৫০ গ্রাম প্রতি একরে প্রয়োগ করতে পারেন। এসব ব্যবস্থা নিলে আশাকরি উপকার পাবেন।
মো. আশরাফুজ্জামান, গ্রাম : লাউযুতি, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: আম গাছের পাতা, ফলে কালো দাগ পড়ছে। কি করণীয়?
উত্তর: আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে সুষম সার প্রয়োগ করা। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি প্রপিকোনাজল গ্রæপের যেমন টিল্ট বা কার্বেনডাজিম গ্রæপের নোইন ১ গ্রাম বা ২ গ্রাম ডায়থেন মিশিয়ে ১২ থেকে ১৫ দিন পর পর সঠিক নিয়মে স্প্রে করা। এসব পন্থা মেনে চললে আপনার আম গাছের সমস্যা দূর হবে।
মো. করিম হোসন, গ্রাম : পীড়ানচর, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : লিচু গাছের পাতা মোটা ভেলভেটের মতো হয়ে যাচ্ছে। কি করবো?
উত্তর : এ সমস্যা মাকড়ের কারণে হয়ে থাকে। এজন্য লিচু গাছের আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। তাছাড়া মাকড়নাশক যেমন ওমাইট বা ভার্টিমেক বা থিওভিট বা কুমুলাস প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই আপনি উপকার পাবেন।
মোছা : মৌপিয়া সুলতানা, গ্রাম : মৌতলা, উপজেলা : কালিগঞ্জ, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : পান গাছের কাÐ শুকিয়ে যাচ্ছে করণীয় কি?
উত্তর : আপনার পান গাছের কাÐের সমস্যার সমাধানের জন্য কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন সানভিট বা বিøটক্স প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে মিশিয়ে কাÐ ও চারপাশের মাটিতে ৭ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করা। এছাড়া বোর্দোমিক্সার অর্থাৎ ১০০ গ্রাম তুঁত ও ১০০ গ্রাম চুন ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। এসব কার্যক্রম গ্রহণ করলে আপনি উপকৃত হবেন।
মোছা : সোনিয়া শারমিন, গ্রাম : লখাইডাঙ্গা, উপজেলা : মণিরামপুর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : ভুট্টার মোচায় কীড়ার আক্রমণ করে পাতা ও মোচা খেয়ে ফেলছে। সমস্যার সমাধান জানাবেন।
উত্তর: ভুট্টা গাছে কীড়ার আক্রমণ রোধে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন ক্যারাটে ২.৫ ইসি ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে সঠিকভাবে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। প্রতি ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। এ নিয়ম মেনে চললে আপনি উপকৃত হবেন।
মো: কবির হোসেন, গ্রাম : ব্রাহ্মণগাঁ, উপজেলা : গৌরনদী, জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : পটল গাছের কাÐ ও পাতায় এক ধরনের পোকার আক্রমণে পটল গাছের কাÐ বিবর্ণ ও শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কি করণীয়? জানাবেন।
উত্তর : পটল গাছের আঁশ পোকা বা মিলি বাগ পোকার আক্রমণ হলে এমনটি হয়ে থাকে। এজন্য আক্রান্ত কাÐ ও গাছ তুলে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আর পোকা দমনের জন্য অনুমোদিত বালাইনাশক যেমন মার্শাল ২ মিলি বা মিপসিন ১.৫ গ্রাম কিংবা ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের যেমন টিডো ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই আপনি উপকার পাবেন।
মো. আসলাম উদ্দিন, গ্রাম : সরদার পাড়া, উপজেলা : বাঘা, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : পুকুরে মাছ মজুদ পরবর্তী সার প্রয়োগ করবো কতটুকু ?
উত্তর : পুকুরে মাছ মজুদ পরবর্তী সার প্রয়োগ করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়। সার প্রয়োগের মাত্রা-প্রতি শতাংশে ও প্রতি সপ্তাহে: কম্পোস্ট ০.৫ থেকে ১ কেজি; ইউরিয়া ৫০ থেকে ৭৫ গ্রাম, টিএসপি ৫০ থেকে ৭৫ গ্রাম। সার প্রয়োগ পদ্ধতি : পানিতে গুলিয়ে পুকুরের সর্বত্র মগ বা বাটি দিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
রতন কুমার, গ্রাম : সাথিয়া, উপজেলা : নাজিরপুর, জেলা : পিরোজপুর
প্রশ্ন : পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত সমস্যা দেখা যাচ্ছে কি করবো?
উত্তর : কলস বা পাতিল দিয়ে পুকুরের পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি করতে হবে। প্রতি শতাংশে ৫ থেকে ৭ গ্রাম অক্সিফ্লো বা অক্সিলাইফ বা এসিঅক্স ব্যবহার করা যেতে পাওে অথবা সম্ভব হলে বাইওে থেকে পরিষ্কার ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানি পুকুরে ঢুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং খাদ্য ও সার প্রয়োগ কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হবে।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
আরমান, গ্রাম : রাধাকান্তপুর, উপজেলা : লালপুর, জেলা : নাটোর
প্রশ্ন : আমার গাভীর হলুদ বর্ণের ¯্রাব দেখা যাচ্ছে। পেট অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জরায়ুর মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় কি করণীয় ?
উত্তর: ট্রাইসালফা এবং স্ট্রেপটোমাইসিন অথবা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অথবা কট্টিম ভেট খাওয়াতে হবে। সাথে ডেক্সট্রোজ স্যালাইন দিতে হবে। আশাকরি উপকার পাবেন।
মো. আলামিন, গ্রাম : বড়গাবুয়া, উপজেলা : গলাচিপা, জেলা : পটুয়াখালী
প্রশ্ন : আমার গাভীর কাঁধ ও মধ্যভাগের মাংসপেশীর কাঁপুনি হচ্ছে। আক্রান্ত গাভীর শ^াস-প্রশ^াস, দুধ ও বাসস্থানের সর্বত্র এসিটোনের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কি করবো?
উত্তর : গøুকোজ বা ডেক্সট্রোজ ৫০% নর্মাল স্যালাইনেসলুশন বানিয়ে ৫০০ মিলি শিরায় ইনজেকশন করলে দ্রæত সুফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি প্রোপাইলিন গøাইকোল বা গিøসারিন ১২৫-২৫০ মিলি সমপরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে প্রথম দিনে ২ বার ২দিন ও পরে দিনে ১ বার ২দিন খাওয়াতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল নং ০১৭১১১১৬০৩২, ই-মেইল : aufiquedae25@gmail.com
ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার১, ড. মুহম্মদ শরীফুল ইসলাম২
গাঁজায়িত ভাত (ঋবৎসবহঃবফ ৎরপব) বা পানিতে ভেজানো ভাতকে পান্তা ভাত বলে। গ্রামের মানুষ বিশেষ করে শ্রমজীবীদের কাছে এ ভাত সকালের প্রধান খাদ্য হিসেবে বহুল প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম এবং উড়িষ্যায় এ ভাত খুব জনপ্রিয় খাদ্য। পয়লা বৈশাখে অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের উৎসবে পান্তা ভাত খাওয়া এখন বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠেছে। এদিন বিশেষ করে শহরের মানুষ সকালে পান্তা-ইলিশ খেয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে পান্তাভাতে ফ্রেশভাতের চেয়ে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে।
পুষ্টিগুণ : পান্তাভাত কে আগে গরিব মানুষের খাবার এবং এর পুষ্টিমূল্য নেই বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানীদের গবেষণার তথ্য মতে এ ভাতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ২০১১ সালে ‘দি টেলিগ্রাফ্ ইন্ডিয়া’ তে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জীব প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক পান্তাভাত নিয়ে এক গবেষণায় এ ভাতের অনেক উপকারিতা সম্পর্কে জানা যায়। এ বিভাগের একজন গবেষক অধ্যাপক মধুমিতা বড়ুয়া বলেন যে, রান্না করা ভাতে এমন একটা উপাদান থাকে যা খনিজ উপাদান যেমন- আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের পর্যাপ্ত প্রাপ্তিতে বাধা দেয়। পক্ষান্তরে পান্তাভাতে বা গাঁজন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে হাইড্রোলাইসিস (পানির সংগে রাসায়নিক বিক্রিয়া) এর মাধ্যমে উৎপাদিত ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এর পুষ্টি-শোষণ বিরোধী (ধহঃর-হঁঃৎরঃরড়হধষ) ফ্যাক্টর (যেমন-ফাইটিক এসিড) ভেঙ্গে যায়। ফলে পান্তাভাতের অনুপুষ্টি/খনিজ উপাদানগুলো (সরহবৎধষ পড়হঃবহঃং) মুক্ত হয় এবং এর গুণাগুণ বেড়ে যায়; অর্থাৎ গাঁজন প্রক্রিয়ায় খাবারের আবদ্ধকৃত অনুপুষ্টিসমূহের মুক্তি (নরড়-ধাধরষধনষব) সহজ করে।
অধ্যাপক মধুমিতা বাড়ুয়া এর গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম রান্না করা সাধারণ (ফ্রেশ) ভাতের চেয়ে সমপরিমাণ পান্তাভাতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ (বিএআরসি) এর পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক ড. মো. মনিরুল ইসলাম জানান যে, বিএআরসি কর্তৃক ২০১৫ সালে পান্তা ভাতের অনুপুষ্টিকণা পরিমাপ করা হয় যার পরিমাণ দেখানো হয়েছে সারণি-১ তে।
১৯৯৮ সালের অন্য একটি গবেষণায় জানা যায় যে, গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাইটিক এসিড হাইড্রোলাইসিসের ফলে কিছু পুষ্টি উপাদান যেমন- আয়রন, জিংক ইত্যাদির জৈব-প্রাপ্যতা (নরড়-ধাধরষধনরষরঃু) বেড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ড. খালেদা ইসলাম বলেন যে, ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ার পর কিছু পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় পুষ্টি-প্রতিরোধী উপাদান ভেঙে দেয়ার ফলে খাদ্য সহজে হজম হয় এবং খাবারের স্বাদও বেড়ে যায়। ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়া যদি সঠিকভাবে করা না হয় তাহলে এটা ক্ষতিকর হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ পানি
ব্যবহার করা উচিত। তাছাড়া পাত্র সঠিকভাবে ঢাকতে হবে যাতে ধুলা-কণা প্রবেশ করতে না পারে। আমেরিকান একদল বিজ্ঞানীর মতে গাঁজনকৃত ভাত খাদ্যনালীর প্রদাহ উপশম করে এবং শরীরের তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। এ ভাত কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে এবং শরীর ঝরঝরে রাখে, বøাডপ্রেসার কমায় ও মানসিক প্রশান্তি আনে। কথায় আছে ‘পান্তা ভাতের ফল, তিন পুরুষের বল’।
প্রস্তুত প্রণালী
প্রথমে ভাত রান্নার জন্য স্বাভাবিক নিয়মে চালসিদ্ধ (নড়রষবফ) করার পর ভাতের ফ্যান (তরল অংশ) ছেঁকে আলাদা করে ভাত বাতাসে ৩-৪ ঘণ্টা ঠাÐা করা হয়। তারপর ভাত ঠাÐা বিশুদ্ধ পানি দিয়ে এমনভাবে ভিজাতে হবে যাতে ভাতের ওপর প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ পানি থাকে। পাত্রটি একটি হালকা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এভাবে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজানোর পর পান্তাভাত প্রস্তুত হয়। পান্তাভাত প্রস্তুতি ও ঢাকার সময় খাদ্য দূষণ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
পরিবেশনা
পান্তাভাত আগে গ্রামে সাধারণত সকালে লবণ, মরিচ (কাঁচা বা পোড়ানো), পিয়াজ এবং লেবু দিয়ে খাওয়া হতো। তবে খাওয়ার আগে পান্তা ভাত থেকে পানি/ফ্যান আলাদা করা হয়। এ ভাত চিংড়ি মাছ (ভাজা), সবজি, খেজুর/তালের গুড় এবং দই সহকারেও পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও পান্তাভাতের সাথে সরিষার তেল ও পিঁয়াজ
দিয়ে আলু ভর্তা, আচার, শুঁটকিমাছ (ভাজা), মাছের ঝোল
বিশেষত : সরষে ইলিশ (সরিষা দিয়ে ইলিশ রান্না), বেগুন বা অন্যান্য ভর্তা দিয়েও পরিবেশন করা হয়।
আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলে আগে ও কৃষক খুব সকালে লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যাওয়ার ২-৩ ঘণ্টা পর সকালের নাশতা
হিসেবে মাঠে পান্তাভাত খেত। এ ভাত তাদের তাৎক্ষণিক শক্তি জোগাত এবং দ্বিগুণ উৎসাহে তারা কাজে নিয়োজিত হতো। কিন্তু কেউ কোনো দিন পরীক্ষা করে দেখে নাই যে পান্তাভাতে কি গুণাগুণ বিদ্যমান। এতদিন এ রহস্য অজানাই ছিল বিজ্ঞানের কল্যাণে তা আজ প্রমাণিত। আর এ পান্তাভাত যদি সঠিকভাবে খাওয়া যায় তাহলে সাধারণ মানুষের আয়রনের অভাব বা রক্তশূণ্যতা থাকবে না এবং ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাব অনেকাংশে দূরীভ‚ত হবে; আর মানুষ শারিরীকভাবে সুস্থ থাকবে। য়
১উপপরিচালক (এলআর-পিআরএল), ডিএই, খামারবাড়ি, মোবা : ০১৮১৫৫৯৭৩০৪, ই-মেইল : dhossair1960@yahoo.com, ২উপপরিচালক (এলআর-পিআরএল), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা।
কমর-উন-নাহার১
নদীমাতৃক বাংলাদেশে এক সময় প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তখন জনসংখ্যাও কম ছিল বিধায়, প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত মাছে আমাদের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ হতো। সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক প্রয়োগ, জলাশয় ভরাট, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, নগরায়ন, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নি:সরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মাছের প্রাকৃতিক আবাস্থল ধ্বংস হয়ে প্রাকৃতিক উৎস হতে মাছের প্রাচুর্যতা দিন দিন হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্তায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আমরা পুকুরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছি। আমাদের খাদ্যে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ।
মাছ চাষ একটি লাভজনক বিনিয়োগ। কোনো জলাশয়ে বা পুকুরে প্রাকৃতিক উপায় বা স্বাভাবিকভাবে যে মাছ উৎপাদিত হয় সে জলাশয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগ করে তার চেয়ে অধিক উৎপাদনের কৌশল বা পদ্ধতিকে মাছ চাষ বলা হয়। মাছ চাষের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব।
সাধারণভাবে পুকুরের মাছ চাষ পদ্ধতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষ।
২. আধা নিবিড় মাছ চাষ ।
৩. নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ।
মাছ চাষের পূর্বশর্ত পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতি
পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতির ধাপগুলো সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করতে পারলে মাছ চাষ প্রক্রিয়াটি অনেকটাই ফলপ্রসূ হয়।
পুকুর নির্বাচন : এখানে কার্প মিশ্রচাষের পুকুর নির্বাচনের ওপরে আলোকপাত করা হলো, কার্প মিশ্র চাষ বলতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালীবাউস, সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, রাজপুঁটি প্রভৃতি মাছকে কার্পজাতীয় মাছ বলা হয়। এসব মাছ পুকুরের বিভিন্ন স্তর থেকে বিভিন্ন খাবার খায়। এজন্য বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত এবং অধিক উৎপাদনের জন্য একটি পুকুরের সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে পুকুর নির্বাচনের সময় নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
া পুকুরটি লোকালয় বা বাড়ির কাছাকাছি হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়।
া সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ মাটির পুকুর মাছ চাষের জন্য উত্তম।
া যে কোনো আয়তনের পুকুরে মাছ চাষ করা যায়। তবে ৩০ শতাংশ থেকে ১ একর আকারের পুকুর বেশি উপযোগী। পুকুরের পাড় এমন উঁচু হতে হবে যাতে বন্যায় প্লাবিত না হয়।
া পানির গভীরতা ১.৫ থেকে ২ মিটার হলে ভালো।
পুকুর প্রস্তুতকরণ (সাধারণত মার্চ ও এপ্রিল মাসে পুকুর প্রস্তুত) :
া আশানুরূপ ফল পাওয়ার জন্য পুকুরের পাড় মেরামত ও তলা সমান করতে হবে।
া পুকুর পাড়ের ঝোপ ঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। ছায়া সৃষ্টিকারী কোনো গাছ থাকলে কেটে ফেলতে হবে।
া পুরাতন পুকুরে কাদার পরিমাণ বেশি থাকে। তাই অধিক কাদা তুলে ফেলতে হবে।
া পুকুরে কোনো জলজ আগাছা, রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ রাখা যাবে না।
া পুকুর শুকিয়ে মাছ সম্পূর্ণভাবে তুলে ফেলা উত্তম। ৪০ গ্রাম/শতাংশ/ফুট পানি হিসেবে রোটেনন প্রয়োগ করে এই রাক্ষুসে অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায়। পরিমাণ মতো পানি নিয়ে তাতে রোটেনন পাউডার মিশিয়ে কাঁই তৈরি করতে হবে। তারপর ১/৩ অংশ আলাদা করে তা দিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে। বাকি অংশ বেশি পানিতে গুলিয়ে পাতলা করতে হবে। এরপর কড়া রোদের সময় পাতলা অংশ সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং বলগুলো সমভাবে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
রোটেনন প্রয়োগের সময় নাকেমুখে কাপড় ও হাতে পলিথিন বেঁধে নিতে হবে; বাতাসে অনুক‚লে ছিটাতে হবে। এসব সাবধানতা অনুসরণ করতে হবে।
চুন প্রয়োগ : মাছ চাষের ক্ষেত্রে ব্যবহারিত বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে চুন অন্যতম।
চুন প্রয়োগের উপকারিতা : পানি পারিষ্কার করে; রোগবালাই দূর করে; পানির ঘোলাত্ব দূর করে; মাটি থেকে পানিতে পুষ্টি মুক্ত করে; পুকুরের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; মাছের আঁইশ ও কাঁটা গঠনে সহায়তা করে; পানির অ¤øøত্ব দূর করে; বিষাক্ত গ্যাস দূর করে, বাফার হিসেবে কাজ করে।
চুন প্রয়োগের মাত্রা ও পদ্ধাতি : প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে টিনের বালতি বা ড্রাম, সিমেন্টের চাড়ির মধ্যে চুন দিয়ে মুখ চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর চটের বস্তার উপর আস্তে আস্তে পানি ঢালতে হবে। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পরে আরো পানি মিশিয়ে পাতলা করে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ কাজটি রোদের সময় করতে হবে।
সাবধানতা : প্লাস্টিকের পাত্রে চুন ভেজানো যাবে না; মাটির চাড়ি বা টিনের বালতি বা ড্রামে চুন ভেজাতে হবে; চুন প্রয়োগের সময় নাক মুখ গামছা দিয়ে বেধে নিতে হবে; বাতাসের অনুক‚লে চুন ছিটাতে হবে, শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ : চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পরে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। যা কার্প মাছের পুকুরের প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক খাদ্য। এগুলো বিভিন্ন ধরনের ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন। পুকুরের উর্বরতার ওপর সার প্রয়োগ নির্ভর করে। তবে পুকুর প্রস্তুতির সময় নিদিষ্ট মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উত্তম।
পুকুরের প্রয়োগের কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা আগে টিএসপি ও সরিষার খৈল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পুকুরে প্রয়োগের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দিয়ে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের আগে পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। কাজগুলো অবশ্যই রোদের সময় করতে হবে।
প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা : সার প্রয়োগের ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়ে যাবে। পানির রং হালকা সবুজ, বাদামি সবুজ ও লালচে সবুজ হলে বুঝতে হবে খাদ্য তৈরি হয়েছে। পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা যায় ৩টি পদ্ধতিতে। যেমন : সেকি ডিস্ক পদ্ধতি, গামছা গøাস পদ্ধতি, হাত দ্বারা।
সেকি ডিস্ক পদ্ধতি : সেকি ডিস্ক একটি টিনের সাদা কালো চাকতি। যার ব্যস ২০ সেমি.। লাল, সবুজ , সাদা এই তিন রঙের সুতা দ্বারা ঝুলানো থাকে।
ি সেকি ডিস্কটি লাল সুতা পর্যন্ত ডুবতেই যদি প্লেটটি অদৃশ্য হয়ে যায় তবে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি আছে। এ অবস্থায় মাছের পোনা ছাড়া যাবে না ।
ি সবুজ সুতা পর্যন্ত ডুবতেই যদি প্লেটটি অদৃশ্য হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পরিমাণমতো আছে। মাছের পোনা ছাড়া যাবে।
ি সাদা সুতা পর্যন্ত ডুবতেই যদি প্লেটটি অদৃশ্য হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে খাদ্য নেই। এই অবস্থায় সার প্রয়োগ করতে হবে।
কাজগুলো অবশ্যই সকাল ১০-১১ টার সময় সূর্যালোকিত দিনে করতে হবে। মেঘলা দিনে নয়।
গামছা গøাস পদ্ধতি : পুকুরের পানি স্বচ্ছ কাঁচের গøাসে নিতে হবে; সূর্যের আলোতে গ¬াসটি ধরতে হবে; গøাসের মধ্যে ১০-১২টা প্রাণিকণা দেখা গেলে বুঝতে হবে পুকুরে পরিমিত খাদ্য আছে; অবশ্যই পরীক্ষাটি সকাল ১০-১১টায় সূর্যালোকিত দিনে করতে হবে; পানি ঘোলা হলে পরীক্ষার ফলাফল ভালো আসবে না ।
হাত পদ্ধতি : সকাল ১০-১১টায় সূর্যালোকিত দিনে হাতের কনুই পযন্ত পুকুরের পানিতে ডুবাতে হবে যদি হাতের তালু দেখা যায় তাহলে বুঝতে খাদ্য তৈরি হয়নি। হাতের তালু দেখা না যায় তাহলে বুঝতে খাদ্য তৈরি হয়েছে।
পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা : পোনা ছাড়ার একদিন আগে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করে নিতে হবে। একটি বালতি বা পুকুরে হাপা স্থাপন করে কিছু পোনা ছেড়ে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি পোনা মারা যায় বুঝতে হবে পানির বিষাক্ততা রয়ে গেছে, এই অবস্থায় পোনা ছাড়া যাবে না। কিছুদিন অপেক্ষা করে আবার পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করে পোনা ছাড়তে হবে ।
পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতি উল্লেখযোগ্য ধাপ ও পদ্ধতিসমূহ মেনে পুকুর প্রস্তুত করলে মৎস্যচাষের জন্য আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব। পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি কাজটি সাধারণত মার্চ ও এপ্রিল মাসে করা হয় কারণ এই সময় পোনার প্রাপ্তি সহজ হয়। য়
১মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ। ই-মেইল : qunahar8@gmail.com, ফোন: ০১৮১৮৪৪০০৭২
মু. দেলোয়ার হোসেন সরকার
নতুন, জনপ্রিয় এবং উচ্চ ফলনশীল (উফশী) পাটের জাত রবি-১ বা বিজেআরআই তোষা পাট-৮ । নতুন উদ্ভাবিত এই জাত সাধারণ তোষা পাটের জাতের চেয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি ফলন দেয়। এর উচ্চতা সাধারণ পাটের চেয়ে ২০ সেন্টিমিটার বেশি। আঁশের পরিমাণও ২০ শতাংশ বেশি। সাধারণ তোষা পাট ১২০ দিন পর কাটতে হয়, নতুন এই জাত কাটা যায় ১১০ দিন বয়সে। সাধারণ তোষা পাটের আগা চিকন গোড়া মোটা হয়, পক্ষান্তরে নতুন এই জাতের পাটের আগা গোড়া সমান। এর আঁশের উজ্জ্বলতাও বেশি।
আসুন জেনে নেওয়া যাক, রবি-১ বা বিজেআরআই তোষা পাট-৮ এর উৎপাদন প্রযুক্তি।
সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য
রবি-১ জাতের পাটের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হলো এর কাÐ মসৃণ, লালচে এবং দ্রæত বর্ধনশীল। আলোক প্রাপ্তি সাপেক্ষে কাÐের বর্ণ তামাটে থেকে গাঢ় লাল বর্ণের হয়। তবে যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না সেখানে কাÐের বর্ণ সবুজ হয়। এতে স্থায়ী লাল বর্ণের উপপত্র বিদ্যমান। পাতা উজ্জ্বল ও চকচকে।
বপন সময় ও জমির বৈশিষ্ট্য
ক) মধ্য ফাল্গুন (মার্চ) হতে মধ্য বৈশাখ (এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বপনযোগ্য তবে মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ বীজ বপনের সর্বাধিক উপযোগী সময়।
খ) অপেক্ষাকৃত উঁচু, জলাবদ্ধতাহীন দোঁ-আশ এবং
বেলে দো-আঁশ মাটি ‘রবি-১’ চাষের জন্য উপযোগী।
গ) এ জাতটি বোরো ধান কাটার পর বপন করে জমিকে সহজেই ৩ ফসলী শস্যক্রমের আওতায় আনা যায়।
বীজ বপন হার
সারিতে বপন করার জন্য হেক্টর প্রতি ৫-৬ কেজি এবং ছিটিয়ে বপন করার জন্য হেক্টর প্রতি ৬-৭ কেজি বীজ প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সুনিষ্কাশিত উঁচু, দোঁ-আশ এবং বেলে-দোঁ-আশ মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রা সারণি-১ প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে গোবর বা অন্যান্য জৈবসার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আনুপাতিক হারে কমিয়ে আনতে হবে।
জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সারণি-১ তে নির্দেশিত মাত্রার অর্ধেক ইউরিয়া এবং সম্পূর্ণ মাত্রার টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে জমিতে নিড়ানী দিয়ে, চারা পাতলা করে নির্দেশিত মাত্রার অবশিষ্ট অর্ধেক ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার দেওয়ার সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা জরুরি। খরা দীর্ঘায়িত হলে কাক্সিক্ষত ফলন প্রাপ্তির জন্য সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন রবি-১ জাতের পাটে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ
তেমন পরিলক্ষিত হয় না। তা স্বত্তে¡ও পাটের সাধারণ রোগ হিসাবে আগামরা বা কাÐপচা রোগ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে রোগাক্রান্ত গাছসমূহ উপড়ে ফেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণ রোধ করার জন্য ডায়থেন এম-৪৫ বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ নামক ছত্রাকনাশক ০৩ দিন পর পর ০৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়া রবি-১ পাটের জমিতে ৫% এর উপর মাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে সানমেকটিন ১.৮ ইসি বা অ্যামবুশ ১.৮ ইসি গাছের উপরের দিকে কচি পাতার নীচের পৃষ্ঠে ০৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে।
গুণগত মানসম্পন্ন আঁশ উৎপাদন
ক) অধিক ফলন ও গুণগত মানসম্পন্ন আঁশ পাওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ে বপনকৃত পাট গাছ ১১০ দিনে কাটা উত্তম। তবে প্রয়োজনে এ জাত ১০০ দিনেও কর্তন করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ফলন সামান্য কম হলেও এতে আঁশ সোনালী রঙ ধারণ করে এবং নরম থাকে যা বিভিন্ন রকমের উন্নত মানের পাটপণ্য তৈরিতে অধিক উপযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে।
সারণি-১ সার প্রয়োগের মাত্রা
খ) পাট গাছ কাটার পর ১০-১২টি গাছ একত্রে আঁটি বেঁধে জমিতে ৩-৪ দিন খাড়া রাখার পর, পাতা ঝরিয়ে পানিতে জাগ দেয়া শ্রেয়। জাগ খুব পুরু না করে খড় বা কচুরীপানা দিয়ে ঢেকে দেয়া ভাল। জাঁক সম্পন্ন হওয়ার পর আঁশ ছাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। ধোয়া আঁশ আড়ে শুকানো উচিত। মাটিতে শুকালে আঁশের মান খারাপ হয়ে যায়।
গ) এ ছাড়া পানি স্বল্প এলাকায় আঁশ ছাড়ানোর জন্য রিবন রেটিং পদ্ধতিও অবলম্বন করা যেতে পারে।
ফলন
উপযুক্ত আবহাওয়া এবং সঠিক পরিচর্যায় কৃষকের মাঠে ‘রবি-১’ জাতের শুকনো আঁশের ফলন নিম্নরূপঃ
তবে কাক্সিক্ষত এ ফলন পেতে হলে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা ৩.৫ থেকে ৪.০ লক্ষ থাকা উচিত।
বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
আঁশের জন্য চাষকৃত মাতৃ গাছ থেকে গুণগত মানে ও পরিমাণে ভালো বীজ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই কাক্সিক্ষত গুণে, মানে ও পরিমাণে বীজ উৎপাদনের জন্য ৩টি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
ক) কাটিং বা ডগা রোপণ পদ্ধতি
আঁশ ফসলের জন্য বপনকৃত গাছের বয়স ১০০-১১০ দিন হলে সুস্থ ও সতেজ গাছের উপরের অংশ থকে প্রায় ৩০-৪৫ সেন্টিমিটার বা এক থেকে দেড় ফুট পরিমাণ কেটে নিয়ে প্রতিটিকে ২-৩ টুকরা করতে হবে যেন প্রতি টুকরায় ২ টি পর্ব বা গিট থাকে। কাটিংগুলোকে পর্যাপ্ত রস সমৃদ্ধ মাটিতে ৪৫ ডিগ্রি কাত করে পুঁতে দিতে হবে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে এসকল কাটিংস থেকে প্রচুর ডালপালা বের হয়, যা থেকে ভালো মানের বীজ উৎপাদিত হয়। এ পদ্ধতিতে প্রতি শতক জমিতে ২-৩ কেজি বীজ সহজেই উৎপাদন করা যায়।
খ) নাবী বীজউৎপাদন পদ্ধতি
জুলাই মাসের মাঝামাঝি (শ্রাবণ মাস) হতে আগস্ট মাসের শেষ বা প্রয়োজনে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি (ভাদ্র মাস) পর্যন্ত জলাবদ্ধতাহীন উঁচু জমিতে প্রতি হেক্টরে ৫ কেজি বীজ বপন করে ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ-পৌষ) মাসে বীজ সংগ্রহ করা যায়। এ পদ্ধতিতে গাছের উচ্চতা সাধারণত ৩-৫ ফুট হয়ে থাকে এবং প্রচুর শাখা প্রশাখা বিস্তার করে পরিপুষ্ট ফুল ও ফল ধারণ করে। প্রতিটি ফল সর্বাধিক পরিমাণ বীজ ধারণ করে। এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে মানসম্পন্ন প্রতি শতকে অনায়াসে ৩-৪ কেজি বীজ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে একজন কৃষকের ৩-৫ কেজি বীজ হলেই চলে। সেক্ষেত্রে কোন কৃষক তার রবি ফসলের বর্ডার ফসল হিসাবে ২-৩ সারি বীজ বপন করেই নিজের বীজে সহজেই প্রয়োজন মেটাতে পারে।
গ) চারা রোপণ পদ্ধতি
উঁচু জমিতে চারা তৈরি করে ৩০-৪০ দিন বয়সের চারা ভেজা মাটিতে রোপণ করে সন্তোষজনক পরিমাণ বীজ উৎপাদন যায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি শতক জমিতে ২-৩ কেজি বীজ উৎপন্ন হয়।
বীজ উৎপাদনে সারের মাত্রা
বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য সারের মাত্রা সারণি-২ তে প্রদর্শিত হয়েছে। তবে গোবর বা অন্যান্য জৈবসার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আনুপাতিক হারে কমিয়ে আনতে হবে।
বীজ ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ
ফল ৭০-৮০ শতাংশ বাদামি বর্ণ ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে মেঝেতে ত্রিপল/ পাটের বস্তা বিছিয়ে ফল শুকাতে হবে। উৎপাদিত বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে রাখলে ২ বছর পর্যন্ত বপনযোগ্য থাকে। য়
বিজ্ঞানী ও পাট গবেষক, পাটের কৃষি পরীক্ষা কেন্দ্র, জাগীর, মানিকগঞ্জ, মোবাইল-০১৬৭০৯২৫৯৮৭, ই-মেইলঃ delwarbarj@gmail.com
বৈশাখ
আবু হেনা ইকবাল আহমেদ১
ক.
পুনরায় ঘুরে আসে নতুন বৈশাখ
সময়ের ধারা তারে দেয় ভিন্ন বাঁক
পুরাতন ব্যবসায় ইতি টেনে পাতা
শুরু হয় নবরূপে লিখা হালখাতা।
যাত্রা পুতুলনাচ কি লাঠি সাপ খেলা
নানাবিধ আয়োজনে বসে যায় মেলা
বৈশাখে হাঁটু পানির ওই নদী নাই
বাহারি পালের নাও গানে শুধু পাই।
কালের ¯্রােতের তবু হয় না বিরাম
বয়ে চলে কুলু কুলু সে যে অবিরাম
দিন যায় রাত আসে আসে রাঙা ভোর
নতুন দিনের জন্য খুলে দেই দোর
বসন্ত গিয়েছে চলে কোকিল না থাক
নতুন পাতায় রেঙে সেজেছে বৈশাখ \
খ.
বটের নতুন শাখে ঝিমায় দুপুর
জড়াজীর্ণ সবকিছু শুষ্ক চ‚র্ণচুর
ঈশান কোণে জমা খ্যাপাকালো মেঘে
ক্ষণিকে আঁধার করে বয় বায়ুবেগে।
শুরু হয় গুড় গুড় ভীষণ গর্জন
ধ্বংসের দামামা বেজে ছোটা তার পণ
অবশেষে ধেয়ে আসে বৃষ্টি এক ঝাঁক
বর্ষণে শীতল হয় উত্তপ্ত বৈশাখ।
পায় প্রাণ মরা নদী মৃতপ্রায় তৃণ
সাঁতরায় পানি পেয়ে ব্যাঙ সর্প মীন
রুক্ষ ভ‚মি চষে বোনা আউশ ও পাট
কচি মাথা তুলে তারা ভরে দেয় মাঠ।
নতুন বছর শুরু খুলে হালখাতা
জীবন সাজায় ধরা মেলে ডালপাতা \
১কৃষিবিদ পরিচালক(অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, কৃষি মন্ত্রণালয়। সেল:০১৬১৪৪৪৬১১১<ahiqbal.ahmed@
yahoo.com> ঠিকানা : ‘কলমিলতা # ৪, এলেনবাড়ি গভ. অফিসারর্স কোয়ার্টার্স, তেজগাঁ, ঢাকা-১২১৫।
ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী
সারা বাংলাদেশ ৩০টি ইকোলজিক্যাল জোনে বিভক্ত। এর মধ্যে দেশের উত্তর পশ্চিম এলাকা ২৫, ২৬ ও ২৭ এই ৩টি ইকোলজিক্যাল জোন নিয়ে অবস্থিত। এর মধ্যে ২৬ নম্বর ইকোলজিক্যাল জোনটি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল, ২৫ নম্বর হচ্ছে মধ্যম বরেন্দ্র অঞ্চল এবং ২৭ নম্বরটি হচ্ছে সমতল বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গঠিত। বরেন্দ্র অঞ্চল বলতে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলার ১২৫টি উপজেলাকে বুঝায়।
বর্তমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ১৯৯২ সালে গঠনের সময় শুধু ২৬ নম্বর ইকোলজিক্যাল জোন নিয়ে কাজ করত। কিন্তু ক্রমান্ব^য়ে রংপুর ডিভিশন পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ভ‚-প্রকৃতিকে মোটামুটি ৩ ভাগে ভাগ করা যায় -
০১. লাল মাটি দ্বারা গঠিত প্রাচীন ভ‚মি;
০২. পলিমাটি দ্বারা গঠিত মোটামুটি প্রাচীন ও উঁচু ভ‚মি এবং
০৩. বিভিন্ন নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত নিম্ন ভ‚মি।
বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন নদী বিশেষ করে যমুনা, পদ্মা, আত্রাই, মহানন্দা, তিস্তা, করতোয়া প্রভৃতি নদীবাহিত পলি ও বালি স্ত‚পকৃত হয়ে নিম্ন প্লাবন ভ‚মি সৃষ্টি করেছে। এই পলি দ্বারা গঠিত নিম্ন ভ‚মি বর্ষাকালে বন্যায় তলিয়ে যায়। বাংলাদেশের পূূর্বাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য মÐিত এ ধরনের ভ‚মি বরেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। উঁচু বরেন্দ্র এলাকা দূর থেকে দেখতে অনেকটা গ্যালারির মতো। অসমতল ভ‚-প্রকৃতির কারণে বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশের তুলনায় উঁচু থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে যায়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে মাটির আর্দ্রতা মারাত্মকভাবে কমে যায়।
বাংলাদেশে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে উঁচু বরেন্দ্র ভ‚মি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার আবহাওয়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় রুক্ষ এবং চরম ভাবাপন্ন। বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১২৫০ থেকে ২০০০ মিমি. (আইডব্লিউএম-২০০৬)। শীত মৌসুমে কোনো কোনো বছর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে, আবার গ্রীষ্মকালে কোনো কোনো সময় ৪১-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। তবে কোনো কোনো বছরে মাত্র ৮০০-৯০০ মিলি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ বৃষ্টিপাতের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আবার মৌসুম ভিত্তিক, যেখানে জুন-অক্টোবর বা আষাঢ়-কার্তিক মাসে হয়ে থাকে। মৌসুমভিত্তিক হওয়া সত্তে¡ও বৃষ্টিপাতের ধারা সুষম বণ্ঠিত না হওয়ায় সঠিক সময়ে আমন ধান লাগানো যায় না ফলে অধিকাংশ সময়ে আমন ধানের চাষ দেরি হওয়ায় পরবর্তী ফসল চাষের সুযোগ বিঘিœত হয়। এ সমস্যার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে আমন ধান কাটার পরে বরি মৌসুমে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। অসম বৃষ্টিপাতের কারণে আমন ধানের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায় খরা আক্রান্ত হয় যা ফলনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রচলিত থকথকে কাদাময় বীজতলা তৈরির জন্য কমপক্ষে ৫০০-৬০০ মিলি (২০-২৪ ইঞ্চি) পানির প্রয়োজন হয়। কাদাময় বীজতলায় আমন ধানের চারা উৎপাদনের উল্লেখিত পরিমাণ বৃষ্টিপাতের জন্য কৃৃষকরা অপেক্ষা করেন। কিন্তু ২৫ বছরের রাজশাহী অঞ্চলের জুন-জুলাই মাসের বৃষ্টিপাতের দ্বারা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, কাদাময় বীজতলায় চারা উৎপাদনের জন্য কাক্সিক্ষত পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলশ্রæতিতে একদিকে যেমন আমন আবাদ দেরি হওয়ায় ফলন কমে যায় অন্যদিকে আমন ধান কাটার পর দ্বিতীয় ফসল হিসেবে রবি শস্যের চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে রবি শস্যের বীজ বপন সম্ভব হলেও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে দানা গঠন (বিশেষ করে ছোলার) ব্যাহত হয়।
পরিবর্তিত জলবায়ু ও কৃষিতে এর প্রভাবের ফলে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব অতি গভীর। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার কারণে আমাদের কৃষি ইতোমধ্যেই বেশ চাপের সম্মুখীন। এর সাথে পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব এটিকে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কৃৃষির সাথে আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্ক আরও গভীর। জলবায়ু যেহেতু দীর্ঘ সময়ের তাই এর ভিত্তিতেই কোনো এলাকার কৃষি-সংস্কৃতি গড়ে উঠে। প্রতিটি ফসলের জন্য নির্দিষ্ট সুবিধাজনক আবহাওয়াগত পরিস্থিতির প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহমান কালের চিরচেনা ঋতুর আবর্তন অনেকটা অনিয়মিত হয়ে গেছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষি সংস্কৃতির ওপর।
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৩১.০ লাখ হেক্টর জমি চাষযোগ্য। এ এলাকায় দানাদার ফসলসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। রবি মৌসুমে দানাদার ফসল যেমন গম, ভুট্টা, ডাল ও তেলবীজ শস্য, আলু এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে এবং খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। এছাড়া এ অঞ্চলে প্রায় ৩.০ লাখ হেক্টর জমি বরেন্দ্র অঞ্চলের আওতাভুক্ত এবং বৃষ্টিপাত খুবই কম হওয়ার ফলে আমন ধান কাটার পর নভেম্বর মাসে উঁচু জমিতে প্রয়োজনীয় ‘জো’ (বাতাল) না থাকাতে শতকরা ৫৫ ভাগ জমি অর্থাৎ প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে। দেশের জনসংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ জমির পরিমাণ প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। এ বাড়তি জনসংখ্যার মুখে খাদ্য দিতে একমাত্র পতিত জমি ব্যবহার ছাড়া গত্যন্তর নাই। এ অঞ্চলের ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় নিচে নেমে যাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু কিছু খাবার পানির নলক‚প অকেজো হয়ে পড়েছে ও গভীর নলক‚প এর ডিসচার্জ কমে গেছে। গত এক দশকে এ অঞ্চলে স্থিতিশীল পানির স্তর ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় ১০-২০ ফুট নিচে নেমেছে (তানোর, গোদাগাড়ী, নাচোল, ভোলাহাট উপজেলা এর কিছু কিছু অংশ বিশেষে নেমেছে ১৫-২৫ ফুট)। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও প্রায় সারা বছর সব পর্যায়ের সেচযন্ত্র চালু থাকা এবং ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব এর অন্যতম কারণ। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এ অঞ্চলে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তরের প্রয়োজনীয় পরিমাণ রিচার্জ হয় না।
বিএমডিএ, বিএডিসি ও অন্যান্য বিভাগ বা সংস্থা এবং জনসাধারণ ব্যক্তিগত (চৎরাধঃব) পর্যায়ে ২৪,১২১টি গভীর নলক‚প (উঞড), ৭,১৯,৪২৬ টি অগভীর নলক‚প (ঝঞড) এবং লো-লিপ্ট পাম্প রয়েছে ১০,৪৮৩টি (খখচ) (সূত্র : মাইনর ইরিগেশন সার্ভে রিপোর্ট-২০১৬-১৭, বিএডিসি)। এর মধ্যে শুধু বিএমডিএ’র গভীর নলক‚প (উঞড) ১৫,৫১৭টি ও ৪১৭টি অগভীর নলক‚প (খখচ) পরিচালনা করছে। উল্লেখিত সব গভীর ও অগভীর নলক‚প দিয়ে বছরে (সেচ মৌসুম ৫ মাস) প্রায় ১২,৪৩০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি উত্তোলিত হয়। খরা মৌসুমে বিশেষ করে বোরো ধানে সেচ দিতে অধিক হারে ভ‚গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে খাবার পানির অভাবসহ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকির সাথে যুক্ত হয়ে সামাজিক পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
১৮৪৯ সালে বরেন্দ্র ভ‚মির ৫৫% এলাকা বনভ‚মি ছিল। কিন্তু ব্যাপকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনভ‚মি উজাড় হয়ে মরুপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়। ১৯৭৪ সাল নাগাদ বরেন্দ্র ভ‚মির ৭০% এলাকা কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হয় এবং কৃষি কাজে গভীর নলক‚প দ্বারা সেচের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাদ্যের অভাব পূরণ হয়েছে, অন্যদিকে এক সময় মরুভ‚মির মতো দেখতে এক-ফসলি বরেন্দ্র অঞ্চল গভীর নলক‚পের সেচের আওতায় আসায় ফসলের নিবিড়তা দাঁড়িয়েছে ২০০%-এর অধিক। বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন (স্বল্প বৃষ্টিপাত, উচ্চ তাপমাত্রা, দীর্ঘ খরা) মোকাবেলা করে ফসল উৎপাদনের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে ভ‚গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে পরিবেশগত বিপর্যয় অনিবার্য।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৬টি জেলায় প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে কয়েকটির অপমৃত্যু ঘটেছে আর কিছু নদী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক বিল বা প্রাকৃতিক জলাধার ছিল। বর্তমানে কিছু বিলের অস্তিত্ব রয়েছে। অন্যগুলো চাষাবাদের অধীনে চলে গেছে, বরেন্দ্রের বিলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভাতিয়ার বিল, টাংরা বিল, মরিচা দাঁড়া বিল, রাজশাহীর বিল কুমারি বিলসহ আরো অনেক বিল চাষাবাদের জমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জমিগুলোতে জৈব পদার্থ উপাদান কমে গেছে। যেখানে মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র ১ শতাংশ। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক, বালাইনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে পানি দূষণ হচ্ছে, জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে যার ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে যত্রতত্রভাবে ভ‚গর্ভস্থ পানি বেশি বেশি উত্তোলন করা এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ না করার ফলে পানির বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে।
কৃষি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য এবং সেচকাজে পানির অপচয় হ্রাস ও ভ‚গর্ভস্থ পানির সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ও পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে ‘ঞযব এৎড়ঁহফ ডধঃবৎ গধহধমবসবহঃ ঙৎফরহধহপব ১৯৮৫’ (ঙৎফরহধহপব ঘড়. ঢঢঠওও ড়ভ ১৯৮৫) অধ্যাদেশটি রহিত করে বাংলা ভাষায় ‘কৃষিকাজে ভ‚গর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১৭’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কৃষিকাজে ভ‚গর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১৭ যা ২১ জানুয়ারি ২০১৮ জাতীয় সংসদে পাস হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভ‚গর্ভস্থ যেই পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় সেই পরিমাণ পানি রিচার্জ হয় না। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে কোনো কোনো এলাকায় খরার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক কৃষিকাজ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এছাড়া জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় পানীয় জলেরও সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরেন্দ্র এলাকায় কম পানি গ্রহণ করে এমন সব ফসলের জাত প্রবর্তন এবং সেচসাশ্রয়ী প্রযুক্তিগুলোকে কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সবার প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকের শিক্ষিত সন্তানদের কৃষিতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলকে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন হলো, বিজ্ঞানীরা যেভাবে খরাসহিষ্ণু ব্রি ধান ৭১, বারি গম ৩৩ ইত্যাদিসহ নতুন নতুন জাত এবং ডালজাতীয় শস্য ক্রপিং প্যাটানের মধ্যে এনে একদিকে ফসলের নিবিড়তা এবং অন্যদিকে ফসলের বৈচিত্র্য আনছেন এসব বিষয়ে যদি কৃষকদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আমাদের করণীয়
১. বরেন্দ্র অঞ্চলে সারফেস ওয়াটার ও গ্রাউন্ড ওয়াটারের বর্তমান অবস্থা, মজুদ ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে বর্তমানে একটি কম্প্রিহেনসিভ টেকনিক্যাল স্টাডি প্রয়োজন। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওডগ ও ঈএওঝ এ কাজটি করতে পারে।
২. বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অসংখ্য খাস মজা পুকুর, খাল ও বিল পুনঃ খননের মাধ্যমে জলাধার সৃষ্টি করা প্রয়োজন এবং কমিউনিটি বেইসড ইরিগেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিবিআইএমএস) মাধ্যমে কৃষিতে সারফেস ওয়াটারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতিশীঘ্রই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
৩. বর্ষাকালে পানি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য নদী বা খালের ঝঃৎধঃবমরপ চড়রহঃ এ ডবরৎ/ঊষবাধঃবফ বিরৎ/জঁননবৎ উধস নির্মাণ করে ওয়াটার রিজার্ভার সৃষ্টি এবং লো-লিফট্ পাম্প (খখচ) স্থাপনের মাধ্যমে পাশ্ববর্তী এলাকায় সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলের যে সব এলাকায় ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর তুলনামূলকভাবে বেশি নিম্নগামী হয়েছে সে সব এলাকায় খাস খাল/পুকুর/বিলের তলদেশে জব-পযধৎমব স্থাপন করে অয়ঁরভবৎ কে জরপয করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অয়ঁরভবৎ কে জরপয করার জন্য সর্বোপরি গঙ্গা ব্যারেজ স্থাপনের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
৪. উঁম বিষষ (ঝড়ষধৎ ঊহবৎমরুবফ) এর মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত করতে হবে। এতে পরিমিত সেচের মাধ্যমে রবি ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্ত উম্মোচিত হবে। এছাড়া অডউ পদ্ধতি ও সেচের পাইপ লাইন মেরামত ও সম্প্রসারণ করে সেচের পানি সাশ্রয় করা যেতে পারে। এ ছাড়াও রাত ১১টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত সেচ পাম্প চালানো ও সেচের ক্ষেত্রে প্রি-পেইড মিটারিং পদ্ধতি চালু করলে সেচের পানি সাশ্রয় হবে।
৫. প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গধংংরাব চষধহঃধঃরড়হ চৎড়লবপঃ বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে ঈড়সসঁহরঃু অভভড়ৎবংঃধঃরড়হ পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখতে পারে।
৬. বরেন্দ্র অঞ্চলে ঐবধঃ ঞড়ষবৎধহপব জরপব ঠধৎরবঃু প্রবর্তন করাসহ ঈৎড়ঢ় উরাবৎংরভরপধঃরড়হ করতে হবে। অল্প সেচ প্রয়োজন এরূপ ফসল চাষে কৃষকদেরকে ব্যাপক গড়ঃরাধঃরড়হ করতে হবে।
৭. ব্যক্তি উদ্যোক্তা/বিভিন্ন শিল্প কারখানা পর্যায়ে এৎড়ঁহফ ডধঃবৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ গড়হরঃড়ৎরহম ও আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই স্বপ্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের দ্বারা বাস্তবায়ন ও পূরণ হবে বলে আমরা আশাবাদী।য়
সাবেক এমপি ও চেয়ারম্যান, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃৃপক্ষ (বিএমডিএ), রাজশাহী, মোবাইল-০৭২১৭৬০৫০৯, ই-মেইল : chairman@bmda.gov.bd