সম্পাদকীয়
১৬ ডিসেম্বর বীর বাঙালি জাতির মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান, দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ আর তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাথা গণবীরত্বের পর পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন অভ্যুদয় ঘটে। বিজয় দিবসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কৃষি প্রধান নিয়ামক। জাতির পিতা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায়ে কৃষি ও পরিবেশের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় এনে সরকারের যুগোপযোগী নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ দানাদার খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফসলের পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষ খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে বিশ্বে নন্দিত হয়েছে রোল মডেল হিসেবে।
বর্তমানে মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আগামী ২০২৩ সালকে বিশ^ব্যাপী ক্রাইসিস ইয়ার হিসেবে অনুধাবন করেছেন। বিশ^ব্যাপী অনাগত এই সংকট বাংলাদেশের যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’Ñ এ বাস্তবায়নে অনুশাসন প্রদান করেছেন।
সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশে সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিতকল্পে কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষিকে টেকসই, লাভজনক ও বাণিজ্যিকীকরণে উত্তম কৃষি চর্চা মেনে উৎপাদন, রপ্তানি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষির উন্নয়নের ধারা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্কে ‘বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কৃষিতে করণীয়’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারের কৃষিকথায়।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, কবিতা ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ সংখ্যা। আশা রাখছি শুধু বিজয়ের মাসে আবদ্ধ না হয়ে দৈনন্দিন জীবনাচরণে প্রতিফলিত হবে স্বাধীনতার সারমর্ম। নিশ্চিত হবে নিরাপদ পরিবেশ। সমৃদ্ধ হবে কৃষক, কৃষি ও দেশ।
৮২তম বর্ষ ড় ৯ম সংখ্যা ড় পৌষ-১৪২৯ (ডিসেম্বর ২০২২-জানুয়ারি ২০২৩)
সূচিপত্র
নিবন্ধ
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কৃষিতে করণীয় ০৩
মোঃ বেনজীর আলম, ড. এ কে এম শামীম আলম
পেঁয়াজের অজৈবিক ডিজঅর্ডার দূরীকরণে উত্তম কৃষি চর্চার প্রয়োগ ০৫
ড. মো. আলাউদ্দিন খান, ড. রুম্মান আরা, ড. হরিদাস চন্দ্র মোহন্ত, মো. মুশফিকুর রহমান
ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যে রপ্তানি বাড়াতে করণীয় ০৯
মোঃ সাইফুল কামাল আজাদ
ব্রি উদ্ভাবিত সাশ্রয়ী বীজ বপনযন্ত্র ১১
ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম, কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
মাছচাষিদের পাশে থেকে নিরলসভাবে সেবা প্রদান করছে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল ১৩
মো: মাসুদ রানা
খাদ্য বিষক্রিয়ায় হাইড্রোজ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিকল্প ১৫
প্রফেসর ড. মারুফ আহমেদ, মোছা: ইমা পারভীন, মোঃ শাহজাহান কবির
গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ১৬
ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
নিরাপদ শাকসবজি সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ ১৮
কৃষিবিদ তাপস কুমার ঘোষ, মোছা: সাবিহা সুলতানা
প্রবীণদের (এবৎরধঃৎরপ) স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা ২০
মোরসালীন জেবীন তুরিন
আগামীর কৃষি ভাবনা
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা ২২
মুহাম্মদ শফিকুল হক আকন্দ
উচ্চমূল্যের ফসল
উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ ও সয়াবিন চাষাবাদ পদ্ধতি ২৪
ড. মো. আব্দুল মালেক
সফল কৃষকের গল্প
পাটচাষিদের সফলতা ২৬
কৃষিবিদ ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
কবিতা
উন্নত জীবন নিশ্চিত হয় ২৮
মোছলেহ উদ্দিন সিদ্দিকী
নিয়মিত বিভাগ
পৌষ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা ২৯
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
প্রশ্নোত্তর ৩০
কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
মাঘ মাসের কৃষি (১৫ জানুয়ারি-১৩ ফেব্রুয়ারি) ৩১
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের
কৃষিতে করণীয়
মোঃ বেনজীর আলম১ ড. এ কে এম শামীম আলম২
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্যঘাটতি হতে পারে। জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড বলেছে, আগামী বছর অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বমন্দা শুরু হলে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। করোনা মহামারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নেতিবাচক ধারার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ দুই দেশ থেকে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে কারণ বিশ্বের খাদ্য চাহিদার ৩০-৩৫ শতাংশ এই দুই দেশ থেকে আমদানি করা হতো। এ পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অদূর ভবিষ্যৎ বিশ্ব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেশবাসীকে সর্বাবস্থায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য মজুদ সবসময় সন্তোষজনক অবস্থায় রাখা এবং সর্বক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের জন্য পাঁচ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন এবং সার, বীজ, যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকিবাবদ টাকা বরাদ্দ রেখেছেন।
বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে দেশের ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য জোগান নিশ্চিতকরণ। অধিকতর কৃষির উৎপাদন, যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। আজকের এই যে কৃষির উন্নতি এটা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বল্পকালীন সময়ের হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত এবং বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পিতার অনুসৃত পথ অনুসরণ করে কৃষিকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসকল পরিকল্পনা নিয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মাঠ পর্যায়ে সকল কাজের বাস্তবায়ন করার কারণেই এসেছে কৃষি ক্ষেত্রের অসাধারণ সকল সফলতা।
কৃষিকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষকের হাতে আধুনিক উপকরণ দেওয়া শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যা তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালু রেখেছেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে ৫০-৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। কৃষকদের বাঁচানোর জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দরকার তা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের রয়েছে। এ সরকারের সুপরিকল্পিত কৃষিনীতি, কৃষিতে ব্যাপক ভর্তুকি, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মানসম্পন্ন উপকরণ সরবরাহের ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমাদের সাফল্যকে বিশ্ব আজ অনুকরণ করছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিক্তিক দেশ হিসেবে এখানে অনেক ধরনের ফসল এবং ফলমূল উৎপাদিত হয়। কিন্তু উত্তম কৃষিপদ্ধতি এবং আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অভাবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। অপর্যাপ্ত সংরক্ষণব্যবস্থা, অপ্রতুল কৃষিবাজার ব্যবস্থাপনা অদক্ষ কৃষিবাজার, প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও ব্যবস্থাপনার অভাব ইত্যাদি কারণে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ বৈদেশিক চাহিদা মিটাতে বা দেশের কৃষি জিডিপিতে অবদান রাখতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে ফসল ও শাকসবজি নষ্ট হয় শুধুমাত্র সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে। এদেশের মৌসুমি শাকসবজি ও ফলমূলের প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগই পচে যায় বা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে যায় বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে এ চল্লিশ শতাংশ পণ্যের অর্ধেক অংশকেও রক্ষা করা গেলেও কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বছরব্যাপী খাওয়া এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রফতানিরও অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে কৃষি উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে ঠিকই, কিন্তু কৃষির উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে প্রক্রিয়াজাত ও মূল্য সংযোজন করে কৃষির শিল্পায়ন না করতে পারায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির রূপান্তর ঘটছে না কাক্সিক্ষত মাত্রায়। সঠিক নিয়ম মেনে উৎপাদিত ও সংগৃহীত ফসল প্রক্রিয়াজাত ও মূল্য সংযোজন করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের বাজার বিস্তৃত করার জন্য কৃষিকে শিল্পায়নের সঙ্গে আরও সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
সরকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজ দানাজাতীয় খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদন প্রায় সমান সমান অবস্থায় আছে। জাতির পিতা কর্তৃক গৃহীত কৃষি উন্নয়নের আলোকে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় দেশে কৃষি গবেষণার যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে এবং কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বেগবান করে গবেষণার ফলাফল কৃষকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। নগদ সহায়তা, কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানসহ যখন যা প্রয়োজন সে অনুযায়ী কৃষককে সহায়তা দেয়াসহ কৃষিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষিতে বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে কৃষি উৎপাদন করা হচ্ছে। শুধু উৎপাদনই নয়, উৎপাদিত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার ফলে আমাদের দেশের উৎপাদিত কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ফলাফলস্বরূপ বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে, উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় অব্যাহত সাফল্য এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি করোনার ছোবল ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও বিভিন্নমুখী সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এমনিতেই ছোট দেশ, অল্প পরিমাণ কয়লা ছাড়া নেই তেমন কোন কোন খনিজ পদার্থ। শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে নির্দিষ্ট কয়েকটি কৃষি পণ্য ছাড়া অধিকাংশই আমদানি করতে হয়। করোনা ও যুদ্ধের কারণে বহির্বিশ্বে প্রায় সকল পণ্যের আমদানি মূল্য বেড়েছে। দেশে আমদানির জন্য জোগান দেয়া ডলারের অধিকাংশের উৎস হলো রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হুন্ডির আগ্রাসন এবং দেশীয় পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য না থাকায় ডলারের আমদানিও কমে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্তত কৃষি পণ্য যেন আমদানি না করতে হয় সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বস্তরে সাশ্রয়ী হওয়া এবং দেশে আবাদযোগ্য এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সে আহ্বান জানিয়েছেন জনগণের প্রতি। এ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার কাজ হিসেবে নিয়ে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাভুক্ত সংস্থাগুলো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে দেশের সকল কৃষকদের মধ্যে এ নিয়ে কাজ করছে। দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমি আছে প্রায় ৪ লক্ষ ৩১ হাজার হেক্টর (সূত্র: কৃষি ডাইরি ২০২২)। পতিত চার লক্ষ হেক্টর জমিতে ফল, সবজি, মসলাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করা সম্ভব। এ পরিমাণ জমিতে কিছু না কিছু চাষাবাদ করতে পারলে কৃষি জিডিপি এর পরিমাণ দশমিক পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর সুযোগ থাকবে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নেহায়েতই কম না। এখনও দেশের বসতবাড়ি, পুকুরপাড়, খালের পাড়, বাড়ির আঙ্গিনায় ও অব্যবহৃত জমিতে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেনি পরিপূর্ণভাবে। এসকল জমির অধিকাংশই এখনও পতিত পড়ে থাকে বছরের পর বছর। এসকল পতিত জমিতে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষের আওতায় আনা গেলে পারিবারিক শাকসবজি ও ফলমূলের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে দেশের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে এবং পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। অনাবাদি পতিত ও অব্যবহৃত জমি চাষের আওতায় এনে শাকসবজি, ফলমূল জাতীয় ফসল আবাদ সম্প্রসারণ, চাষ উপযোগী উচ্চমূল্যের বহুমুখী ফসল আবাদ সম্প্রসারণ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত জাত/ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, মানসম্মত নিরাপদ ফসল উৎপাদন এর মাধ্যমে পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে জনগণের আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ কৃষি উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হবে। দেশে বর্তমানে এক ফসলি জমি আছে ১৯.২৮ লক্ষ হেক্টর, দুই ফসলি ৪৪.৪৬ লক্ষ হেক্টর, তিন ফসলি ২২.০৭ লক্ষ হেক্টর এবং চার ফসলি জমি আছে ৬১.৮২ হাজার হেক্টর (সূত্র: ডিএই, ২০২০-২১)। স্থানীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এক ফসলি জমির কিছু অংশ দুই ফসলী এবং দুই ফসলি জমির কিছু অংশ তিন ফসলিতে রূপান্তর করে চাষাবাদ করতে পারলেই উৎপাদন বাড়বে যা খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে। দানাজাতীয় খাদ্য চাহিদামাফিক উৎপাদন করে বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমদানি নির্ভর ফসল উৎপাদন বাড়াতে হবে।
বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নতি ছাড়া এদেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। ক্ষুধা নিবারণের প্রধান উপাদানের জোগানদাতাদের তিনি তাই সর্বদাই সর্বোচ্চ স্থান দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও একই মানসিকতার। তাই আমাদের সকলের উচিত তাদের এই মানসিকতার মূল্য উপলব্ধি করে, যার যার অবস্থান থেকে নিজেদেরকে সার্বিক কৃষি উৎপাদন কাজে যথাযথভাবে আত্মনিয়োগ করে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের উৎপাদন অবস্থানকে আরও সুসংহত অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।
লেখক : ১মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭০৭০৭৩৬, ই-মেইল :drshameem66@gmail.com
পেঁয়াজের অজৈবিক ডিজঅর্ডার দূরীকরণে
উত্তম কৃষি চর্চার প্রয়োগ
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ ড. রুম্মান আরা২ ড. হরিদাস চন্দ্র মোহন্ত৩ মো. মুশফিকুর রহমান৪
পেঁয়াজ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মসলাজাতীয় অর্থকরী ফসল। উৎপাদন এবং চাহিদার কারণে মসলাজাতীয় ফসলের মধ্যে এটি প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। দেশে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ মে. টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে ২৫-২৬ লাখ মে. টন উৎপাদন হয়ে থাকে। বার্ষিক ঘাটতি প্রায় ১০ লাখ মে. টন, যা আমদানি করতে প্রায় ৪.০-৪.৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন ধরনের ডিজঅর্ডারের কারণে একদিকে যেমন- পেঁয়াজের মোট উৎপাদন কমে যায়, অন্যদিকে মানসম্পন্ন কন্দ ও বীজ প্রাপ্তিতে বাধাগ্রস্থ হয়। গাছ বা গাছের অংশ বিশেষে যে কোনো অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ বা অভিব্যক্তির ফলে স্বাভাবিক প্রত্যাশা অনুযায়ী বেঁচে না থাকতে পারাকেই গাছের ডিজঅর্ডার বলা হয়।
পরিবেশের যে কেনো জৈবিক বা অজৈবিক কারণে গাছের ডিজঅর্ডার হতে পারে। নির্জীব বস্তু বা পরিবেশের অবস্থা ও শারীরবৃত্তীয় উপাদানের (এনজাইম, সাইটোকাইনিন ইত্যাদি) ঘাটতি/আধিক্য, আবহাওয়া ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অজৈবিক ডিজঅর্ডার প্রকাশ পায়। অনেক সময় কোনো পুষ্টি উপাদানের (যেমন- ফসফরাস) ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও গাছে কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায় না, কিন্তু ফসলের ফলন কমে যায়। এসমস্ত ক্ষেত্রে নমুনা (উদ্ভিদ অংশ/মাটি) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণ ছাড়া প্রকৃত ব্যাধির ধরণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পরে। অজৈবিক ডিজঅর্ডারসমূহ পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক কৃষি অর্জনের লক্ষ্যে উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন অজৈবিক (অ্যাবায়োটিক) ডিজঅর্ডার দূরীকরণ করে পেঁয়াজের ফলন ও গুণগত মান উভয়ই বৃদ্ধি করা সম্ভব। অ্যাবায়োটিক ডিজঅর্ডারসমূহের লক্ষণ ও দূরীকরণের উপায়সমূহ নি¤েœ সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করা হলো।
পুষ্টিগত বা নিউট্রিশনাল ডিজঅর্ডার
নাইট্রোজেন (ঘ) : নাইট্রোজেন সালোকসংশ্লেষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নাইট্রোজেনের ঘাটতির কারণে পেঁয়াজের বীজতলার চারা হলুদ হয়ে যায়। নাইট্রোজেনের অভাবে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়, প্রথমে বয়স্ক (নিচের) পাতা ফ্যাকাশে সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পরে সম্পূর্ণ গাছে এ লক্ষণ প্রকাশ পায়, ফুল আসতে বিলম্বিত হয়। কন্দ আগাম পরিপক্বতা লাভ করে ছোট হয়ে যায়। নাইট্রোজেনের আধিক্যে গাছের দ্রুত বৃদ্ধি হয়, পেঁয়াজের গলা মোটা হয়ে যায়, কন্দ পরিপক্বতায় সময় বেশি লাগে। কন্দ নরম হয়ে যায়। গলা মোটা বা কন্দ নরমের ফলে সংরক্ষণাগারে সহজেই ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পচে যায়।
দূরীকরণের উপায় : পেঁয়াজ-এ অগভীর, অসমৃদ্ধ এবং তন্ত্রমূল থাকার কারণে গাছ কর্তৃক সহজলভ্যভাবে পরিমিত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান প্রয়োগ যত্নসহকারে চাষ করা প্রয়োজন। পেঁয়াজের বীজতলার চারা হলুদ হয়ে গেলে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে। পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমির ধরন, সেচ ব্যবস্থা, ফসলের ঘনত্ব, সার প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদির অবস্থা বুঝে পরিমাণ মতো নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে। স্বাভাবিক জমিতে হেক্টর প্রতি সাধারণত ২৩০-২৬০ কেজি ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। অতি বৃষ্টিপাতের পরে বা মাটির উপরিস্তর অন্যত্র কেটে নিলে পরিমাণ মতো নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে। নাইট্রোজেন সার একবারে প্রয়োগ না করে ফসলের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়ে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে, তবে চারা লাগানোর আগে মোট সারের ২৫-৩০% প্রয়োগ করা উচিত।
ফসফরাস (চ) : ফসফরাস পুষ্টি উপাদানের অভাবে মূল উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত হয় ফলে গাছ মাটির সাথে সহজেই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। পরিশেষে গাছের বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায়। ফুল উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। ফসফরাসের সাথে সাথে নাইট্রোজেন ও পটাশের ঘাটতি হলে পাতা ফ্যাকাশে সবুজ হয়ে উপর থেকে নিচের দিকে মরে যায়। অতি এসিডিক (ঢ়ঐ <৫.০) এবং অ্যালকালিন/ক্যালকেরিয়াস (ঢ়ঐ>৭.৫) মাটিতে ফসফরাস এর ঘাটতি হয়ে থাকে। অ্যালুমিনিয়ামের (অষ) টক্সিন আয়ন পেঁয়াজের মূল ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে মূল পানি ও পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না। অন্যদিকে ফসফরিক এসিড মাটির আয়রন (ঋব) অক্সাইড এবং অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের সাথে ফিক্সড হয়ে গাছের জন্য ফসফরাস এর প্রাপ্যতা বন্ধ হয়ে যায়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকলেও ফসফরাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
দূরীকরণের উপায় : স্বাভাবিক মাটিতে ফসফরাসের ঘাটতি হলে প্রয়োজন মতো ফসফরাস সার ব্যবহার করতে হবে। ফসফরাস এর অভাবে স্বাভাবিক জমিতে হেক্টর প্রতি সাধারণত ২৩০-২৬০ কেজি টিএসপি (ঞঝচ) সারের প্রয়োজন হয়।
পটাশিয়াম (ক) : পটাশ কোষে বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় সহায়তার মাধ্যমে পেঁয়াজ গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর অভাবে পেঁয়াজ গাছের পাতা ঢলে পড়ে, পাতার কিনারা হলুদ হয়ে যায়। পটাশিয়ামের অতিরিক্ত ঘাটতি হলে গাছের পুরাতন পাতার আগা হলুদ হয়ে মারা যায় এবং পাতার গোড়া শুকিয়ে যায়। পরিশেষে গাছ মারা যেতে পারে। পটাশের অভাবে অনাকাক্সিক্ষত ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পটাশিয়ামের আধিক্যে গাছ কর্তৃক নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণে বাধাগ্রস্ত হয়।
দূরীকরণের উপায় : প্রয়োজন মত পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। স্বাভাবিক জমিতে হেক্টর প্রতি সাধারণত ৭৫-৯০ কেজি এমওপি সারের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে পটাশিয়াম সার একবারে প্রয়োগ না করে ফসলের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়ে সারের উপরী প্রয়োগ করতে হবে, তবে চারা লাগানোর আগে মোট সারের ৩০-৫০% প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভারী ক্লে সমৃদ্ধ মাটিতে পটাশিয়াম বন্ধন সৃষ্টি করে, ফলে পেঁয়াজ গাছ পটাশিয়াম গ্রহণ করতে পারে না। কাঠের ছাই সরাসরি সার হিসাবে ব্যবহার করে পটাশিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। কোনো কারণে অতিরিক্ত চুন প্রয়োগ করলে পটাশিয়াম এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
সালফার/গন্ধক (ঝ) : সালফার এনজাইম ও আমিষের উপাদান এবং এটি ক্লোরোফিল উৎপাদনে সহায়তা করে। সালফার পেঁয়াজের ঝাঁঝ বৃদ্ধির প্রধান উপাদান। তাছাড়া সালফার পেঁয়াজের ফলন এবং খোসার রং ও শক্তি বৃদ্ধি করে। সালফার ফসলের রোগবালাই প্রতিরোধের সহায়ক। পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সালফার এর ঘাটতি হলে পেঁয়াজের নতুন (উপরের) পাতা সমভাবে হলুদ হয়ে যায় এবং গাছের পাতার সংখ্যা কমে যায়। সালফার এর অভাবে ধীরে ধীরে গাছের বৃদ্ধি হয় এবং ঘাটতি বেশি হলে পেঁয়াজের ফলন ও মান উভয়ই কমে যায়। পেঁয়াজের জমির মাঝে মাঝে ঘাটতিজনিত লক্ষণ প্রকাশ পায়। সালফার এর ঘাটতি হলে গাছ ভালোভাবে ঘ, চ এবং ক গ্রহণ করতে পারে না।
দূরীকরণের উপায় : বর্তমানে উচ্চফলনশীল ফসল চাষাবাদের কারণে জমিতে সালফার এর ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রয়োজন মতো সালফার সারসহ জৈব পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি সাধারণত ১১০-১৬৫ কেজি জিপসাম সারের প্রয়োজন হয়। জমি দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকলে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব পদার্থ এবং সালফার সার প্রয়োগ করে পেঁয়াজ চাষ করতে হবে।
ক্যালসিয়াম (ঈধ) : মূল ও গাছের বৃদ্ধিসহ গাছের জীবনীশক্তি বৃদ্ধিতে ক্যালসিয়াম সহায়তা করে থাকে। পেঁয়াজের কন্দকে বিভিন্ন প্রকার রোগ ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষা করে। বীজের গুণগত মান বৃদ্ধি করে ও পেঁয়াজের কন্দের সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালসিয়ামের অভাবে পেঁয়াজের নতুন পাতা হলুদ হওয়ার আগেই উপরের থেকে নিচের দিকে মরে যায়, পরিশেষে পাতার ডগা ভেঙে যায়। অধিক অ্যালুমিনিয়াম যুক্ত এসিডিক এবং অধিক সোডিয়াম যুক্ত লবণাক্ত মাটিতে ক্যালসিয়াম এর ঘাটতি হয়ে থাকে। বেলে মাটিতে সহজেই চুয়ানোর ফলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়ে থাকে।
দূরীকরণের উপায় : অতিরিক্ত সোডিয়াম যুক্ত জমিতে পেঁয়াজ চাষের জন্য সোডিয়ামের প্রতি সহনশীল/প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করে চাষ করতে হবে। সোডিয়াম যুক্ত জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা অনুযায়ী জিপসাম (ক্যালসিয়াম সালফেট) প্রয়োগ করেও পেঁয়াজ চাষ করা যেতে পারে।
ম্যাগনেসিয়াম : এটি ক্লোরোফিল গঠনে সহায়তা করে থাকে এবং সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের পচনের হার কমিয়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর অভাবে গাছের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়, পুরনো পাতার সম্পূর্ণ অংশ সমভাবে হলুদ হয়ে যায়, যা নাইট্রোজেন ঘাটতিজনিত লক্ষণের মতো মনে হতে পারে।
দূরীকরণের উপায় : জমিতে ম্যাগনেসিয়াম এর পরিমাণ খুব কম থাকলে চারা রোপণের আগে হেক্টর প্রতি সাধারণত ৩৫-৫০ কেজি ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড সারের প্রয়োজন হতে পারে। বেলে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব পদার্থ এবং হেক্টরপ্রতি ১০০-১৫০ কেজি ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড প্রয়োগ করতে হবে।
বোরন (ই) : বোরন পেঁয়াজের বীজের ফলন এবং গুণগত মান উভয়ই বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বোরন সারের ঘাটতিতে নতুন পাতা গাঢ় সবুজ বা বিভিন্ন বর্ণে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং পুরনো (নিচের) পাতার উপরের অংশ ফ্যাকাশে বা বিবর্ণ রং ধারণ করে, পরে ভঙ্গুর হয়ে ফাটলের সৃষ্টি হয়। গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয় এবং পেঁয়াজের মূল, পাতাসহ গাছ মোচড়িয়ে বিকৃত হয়ে যায়। বোরন এর অভাবে ফুলের দ- গোল আকারে ফেটে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে। এই উপাদানের অতিরিক্ত ঘাটতিতে বীজের গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়ে অধিকাংশ বীজ চিটা হয়ে যেতে পারে।
দূরীকরণের উপায় : স্বাভাবিক মাটিতে এই উপাদানের ঘাটতি হলে হেক্টর প্রতি সাধারণত ৭.৫-৯.৫ কেজি সোলিউবোর সার চারা লাগানোর আগে ব্যবহার করতে হবে। জমিতে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন এবং ক্যালসিয়াম থাকলে বোরন প্রয়োগ করে সমন্বয় করতে হবে। ফসলকে বোরনের টক্সিসিটি থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই পরিমাণ মতো বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে।
জিঙ্ক/দস্তা (তহ) : জিঙ্ক এর অভাবে নতুন পাতা হলুদ ও গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। গাছ মোচড়িয়ে বিকৃত হয়ে যায় এবং পাতা ঢলে পড়ে। কন্দ/বীজের ফলন ও গুণগত মান কমে যায়। অতিরিক্ত জিঙ্ক সার প্রয়োগ করলে পেঁয়াজের ফসলে টক্সিসিটি দেখা দেয় এবং পাতা হলুদ হয়ে যায়।
দূরীকরণের উপায় : মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনে হেক্টর প্রতি ১৫-১৭ কেজি জিঙ্ক সালফেট সার চারা লাগানোর আগে প্রয়োগ করতে হবে।
কপার/তামা (ঈঁ) : কপার এনজাইমের একটি উপাদান। পর্যাপ্ত কপার পেঁয়াজের ছাল/খোসার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং কন্দের রং উজ্জ্বল করে। কপারের অভাবে পাতার ডগা বাদামি বর্ণ ধারণ করে শুকিয়ে যায় ও ভেঙ্গে পড়ে এবং পেঁয়াজের খোসা পাতলা হয়ে যায়।
দূরীকরণের উপায় : প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ গ্রাম কপার সালফেট মিশিয়ে চারা রোপণের ৩০ এবং ৪৫ দিন পর স্প্রে করলে কপারের ঘাটতি মেটানো সম্ভব।
লোহা/আয়রণ (ঋব) : এটি সালোকসংশ্লেষনে এবং ক্লোরোফিল গঠনে সহায়তা করে থাকে। পেঁয়াজের ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। গাছে অত্যধিক লোহার অভাবে পেঁয়াজ পাতা সম্পূর্ণভাবে ফ্যাকাশে বা বিবর্ণ (ক্লোরোসিস) এবং সাদাটে বা শ্বেতবর্ণ হয়ে যায়। অধিক এসিডিক এবং অ্যালকালিন/ক্যালকেরিয়াস মাটিতে লোহার ঘাটতি হয়ে থাকে। অধিক ঈঁ, গহ এবং তহ সমৃদ্ধ মাটিতেও লোহার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
দূরীকরণের উপায় : লোহার প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য অতি অ্যালকালিনসমৃদ্ধ মাটিতে জৈব পদার্থ বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে অতিরিক্ত এসিড মাটিতে ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।
ম্যাঙ্গানিজ (গহ) : ম্যাঙ্গানিজ ঘাটতির প্রতি পেঁয়াজ খুবই সংবেদনশীল। গাছের বৃদ্ধি ধীর গতিতে হয়ে থাকে। নতুন পাতার শিরার মধ্যবর্তী অংশ হলুদ (ক্লোরোসিস) হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে ডগা পোড়া রোগে পরিণত হয়। মোটা গলা বিশিষ্ট পেঁয়াজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কন্দ পরিপক্বতায় সময় বেশি লাগে।
দূরীকরণের উপায় : ম্যাঙ্গানিজ সালফেট পেঁয়াজের জমিতে (হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ কেজি) অথবা পাতায় প্রয়োগ করে ইহার ঘাটতি মেটানো যায়। তবে পাতায় স্প্রে করাই উত্তম। প্রতি লিটার পানিতে ৮ গ্রাম ম্যাঙ্গানিজ সালফেট মিশিয়ে চারা রোপণের ৩০ এবং ৪৫ দিন পর পাতায় স্প্রে করলে ঘাটতি মেটানো সম্ভব।
মলিবডেনাম (গড়) : গাছ কর্তৃক নাইট্রোজেন গ্রহণে এই সার সহায়তা করে থাকে। এর ঘাটতি হলে পেঁয়াজ গাছ তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য আমিষ/ক্লোরোফিল তৈরি করতে পারে না, ফলে গাছের বৃদ্ধি হয় না। গাছ ঢলে পড়ে। শিরার মধ্যবর্তী পাতা ফ্যাকাশে সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ (নাইট্রোজেন ঘাটতিজনিত লক্ষণের মতো) ধারণ করে। এর অভাবে বীজতলা থেকে বীজ গজিয়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরিশেষে পেঁয়াজের চারা মারা যায়। অধিক এসিডিক এবং বেলে মাটিতে মলিবডেনাম এর ঘাটতি হয়ে থাকে।
দূরীকরণের উপায় : অতিরিক্ত এসিড মাটিতে ডলোচুন/ডলোমাইট প্রয়োগ করে মাটির ঢ়ঐ বাড়াতে হবে। বেলে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জেব পদার্থ প্রয়োগ করতে হবে। পাতায় মলিবডেনাম স্প্রে করে ঘাটতি মেটানো হয়।
শারীরবৃওীয় বা ফিজিওলজিক্যাল ডিজঅর্ডার
পেঁয়াজের বীজ অপুষ্ট/চিটা হওয়া, ঝরে পড়া এবং বীজের অঙ্কুরোদগমে ব্যর্থতা দূরীকরণের উপায় : পেঁয়াজের বীজের অঙ্কুরোদগমের আদর্শ হার ৭০%। বীজ উৎপাদন, মাঠ থেকে কদম কর্তন এবং সংগ্রহ পূর্ব এবং সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যথোপযুক্ত হলে অঙ্কুরোদগমের হার ১০০% পর্যন্ত হতে পারে। সঠিক উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও একটি কদমে পেঁয়াজের প্রায় ১৫-২৫% বীজফল ফেটে কালো দানা দেখা গেলে সম্পূর্ণ কদমটি কর্তনের জন্য বিবেচনা করা হয়। পেঁয়াজের জমিতে একসাথে পরিপক্ব ফলের কদম কর্তন করা সম্ভব হয় না। এই জন্য পেঁয়াজের জমির সমস্ত কদম কর্তন করতে ৩-৪ কিস্তি লাগতে পারে। বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে কমপক্ষে ৬-৮% আর্দ্রতা বজায় রেখে ঠা-া করে অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েল বা দ্বিস্তর বিশিষ্ট পলিথিন প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়।
রোপণকৃত চারা ঢলে পড়া দূরীকরণের উপায় : চারার আগা বা ডগা থেকে কিছু অংশ ছেঁটে ফেলে দিয়ে রোপণ করলে রোপিত চারা গাছ থেকে পানির অপচয় কম হবে এবং সহজেই মাঠে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুস্থ সবল পেঁয়াজ গাছ উৎপাদন হবে।
অনাকাঙ্খিত ফুল উৎপাদন (বোলটিং) : কন্দ উৎপাদনের সময় সঠিকভাবে কন্দের বিকাশ অথবা পরিপক্বতার আগেই অনাকাক্সিক্ষতভাবে বোলটিং (ফুলের দ-) হলে তা সঠিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য মোটেই ভালো নয়। এর প্রভাবে কন্দের আকার এবং পেঁয়াজের ফলন ও গুণগত মান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
দূরীকরণের উপায় : তুলনামূলকভাবে কম বোলটিং বা বোলটিং মুক্ত ও ভালো মানের পেঁয়াজের জাত ব্যবহার করতে হবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পরে বীজ বপন করলে বোলটিং কম হবে। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন এবং সুস্থ সবল হলে বোলটিং কম হবে। পরিমাণ মতো নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে সহজে বোলটিং হয় না। এটেল-দোআঁশ মাটিতে তুলনামূলকভাবে বোলটিং কম হয়। মুড়িকাটা (ছোট কন্দ থেকে পেঁয়াজ চাষ) পেঁয়াজে সবচেয়ে বেশি বোলটিং হয় এবং সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে বোলটিং সবচেয়ে কম হয়। বোলটিং হলে দেখামাত্র তা ভেঙে ফলতে হবে।
কন্দ থেকে গাছ গজানো (স্প্রাউটিং) : স্প্রাউটিং (ঝঢ়ৎড়ঁঃরহম) হলো সংরক্ষণকৃত কন্দ হতে পেঁয়াজের নতুন গাছ জন্মানোর এক প্রকার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। স্প্রাউটিং প্রতিরোধী বা কম স্প্র্রাউটিং সমৃদ্ধ জাতের ব্যবহার করতে হবে। পেঁয়াজ সংগ্রহের কমপক্ষে ২০ দিন পূর্বে পানি ও নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। উপযুক্তভাবে পরিপক্ব হলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কন্দ সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহের পর কন্দ হালকা ছায়ায় পাতাসহ ৫-৭ দিন কিউরিং এবং কন্দের উপর থেকে ২.০-২.৫ সেমি গলা কেটে সংরক্ষণাগারে সংরক্ষণ করতে হবে। পেঁয়াজকে উচ্চতাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা থেকে রক্ষার জন্য সংরক্ষণাগারের চারিদিক থেকে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। সংরক্ষণাগারের টিনের চালের নিচে ইনসুলেটর ব্যবহার করা যেতে পারে। সংরক্ষণাগারে স্তূপীকৃত পেঁয়াজের উচ্চতা ৩০-৪৫ সেমির (১২-১৮ ইঞ্চি) বেশি না হওয়াই ভালো।
বিভাজিত কন্দ : কন্দ ২ বা ২ এর অধিক ভাগে বিভাজন হওয়ার প্রক্রিয়াকে কন্দের বহুবিভাজন বলে । মূলত ২টি ভাবে কন্দ বিভাজিত হয়ে থাকে। ক. জাত ভেদে। খ. কন্দের তলদেশীয় প্লেট ফেটে পার্শ্বীয় গাছ উৎপাদন হয়। ভালো মানের বীজ ব্যবহার করে চারা তৈরি করে রোপণ করতে হবে। জমির প্রত্যেক স্থানে পরিমাণমত সেচ ও সার প্রয়োগ করা যাতে গাছের অসম বৃদ্ধি না হয়। একই বয়স বা আকারের চারা তুলনামূলকভাবে একটু গভীরে উপযুক্ত দূরত্বে রোপণ করতে হবে।
অন্যান্য ডিজঅর্ডার
কৌলিতাত্তিক মিউটেশন : কোনো কোনো সময় মাঠে পেঁয়াজের পাতার এবং কন্দের রঙের কৌলিতাত্তিক মিউটেশন হতে পারে। মিউটেশনের মাধ্যমে পাতার দৈর্ঘ্য বরাবর ক্লোরোফিলের ঘাটতি হয়ে সাদা থেকে হলদেসহ বিভিন্ন রঙ ধারণ করে থাকে, যা দেখতে মোজাইকের মতো মনে হয়। অনেক সময় মিউটেশনের মাধ্যমে লাল রঙের পেঁয়াজ সাদা হয়ে যায়। এ ধরনের ডিজঅর্ডার তীব্র হলে গাছের বৃদ্ধি ও বিকাশ হ্রাস পেতে পারে। কৌলিতাত্ত্বিক মিউটেশন যুক্ত গাছের কন্দ থেকে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা যাবে না।
আগাছানাশক প্রয়োগজনিত ক্ষত : অসময়ে অতিরিক্ত মাত্রায় আগাছানাশক স্প্রে করার কারণে পেঁয়াজের পাতায় ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে বা পাতা হলুদ হয়ে যেতে পারে, যাকে ফাইটোটক্সিসিটি বলা হয়। ফাইটোটক্সিসিটির মাত্রা তীব্র হলে পাতার ডগা হলুদ হয়ে টিপ বার্ণে পরিণত হতে পারে, এমনকি পাতা কোঁকড়িয়ে যেতে পারে। পরিশেষে গাছের বৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে ফলন কমে যেতে পারে। প্রতিটি হার্বিসাইডের মোড়কের নির্দেশনা মোতাবেক উপযুক্ত পরিবেশে ফসলের সঠিক বৃদ্ধি পর্যায় এবং সঠিক মাত্রায় হার্বিসাইড স্প্রে করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : পেঁয়াজ সাধারণত ৫-৭ মাত্রার চঐ জমিতে ভালো হয়ে থাকে। মাটির চঐ ৫.৫ এর নিচে হলে পরিমাণ মতো হেক্টরে ৪০০-৪৫০ কেজি ডলোচুন/ডলোমাইট (ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট) ও সালফার প্রয়োগ করে চঐ বাড়াতে হবে।
বেলে মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান সহজেই অপচয় হয়। তাই বেলে মাটিতে ব্যাপক হারে হেক্টরে ৩০০০-৫০০০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
অতি এসিডিক, অ্যালকালিন/ক্যালকেরিয়াস এবং বেলে মাটিতে বোরন/ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হয়ে থাকে। অপরদিকে অতিরিক্ত বোরন/ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি পুষ্টি উপাদানের আধিক্যে গাছের টক্সিসিটির সৃষ্টি হয়।
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর; ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর; ৩মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, বগুড়া; ৪বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৩৬১, ই-মেইল : khanalauddinsrsc@gmail.com
ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়
মোঃ সাইফুল কামাল আজাদ
বাংলাদেশ থেকে তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। কৃষির এই খাত থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৮-০৯ সালে জাতীয় রপ্তানি আয়ে কৃষিপণ্যের অবদান ছিল ০.৭৮ শতাংশ, ২০২০-২১ সালে এটা দাঁড়ায় ২.৮৭ শতাংশে। অর্থাৎ কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাজার ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে এবং গত এক যুগে এখাত থেকে আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে (সূত্র: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, ২০২১)।
কৃষিপণ্যের রপ্তানি ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত শর্তাবলি এবং বিপণনমান সঠিকভাবে নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তাজা ফল ও শাকসবজিসহ কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো হতে পারে বাংলাদেশের তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে তাজাফল ও শাকসবজি ইউরোপে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালি কমিউনিটির বাজারেই শোভা পায়। তবে চেইনশপে তাজাফল ও শাকসবজি দেখা যায় না। এটির অন্যতম কারণ চেইনশপ কর্তৃক নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত বিশেষ শর্তারোপ ও আইনি বাধ্যবাধকতা এবং বিদেশী ক্রেতাদের উদ্দেশে পণ্য রপ্তানিতে রপ্তানিকারকদের অনাগ্রহতা। তবে ইউরোপের বাজারে কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে হলে সুগঠিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ-কাঠামো বা বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। মানুষের ও উদ্ভিদের স্বাস্থ্য এবং ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসব আইনি কাঠামো প্রণীত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত মানদ- এবং বিপণনের মান সম্পর্কে বাংলাদেশের কৃষক থেকে শুরু করে রপ্তানিকারকদের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকাই ইউরোপের বাজারে কৃষিপণ্য রপ্তানির একটি অন্যতম বাধা। ফলে তাদের জন্য ইউরোপের বাজারে কৃষিপণ্য রপ্তানির সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ হতে ইউরোপের দেশসমূহের নিকট শাকসবজি রপ্তানি করতে হলে এ খাতের সাথে জড়িত সকল উৎপাদনকারী, মধ্যস্বত্বভোগী, বিপণনকারী এবং রপ্তানিকারককে অবশ্যই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) দ্বারা স্বীকৃত খাদ্যপণ্য (ফল ও শাকসবজি) নীতির মানদ- পূরণ করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রবিধান (ইসি) নং ১৭৮/২০০২ এর অনুচ্ছেদ ১১ নির্দেশনা অনুসারে, ইউরোপের দেশসমূহে খাদ্যপণ্য (ফল ও শাকসবজি) রপ্তানি করার জন্য রপ্তানিকারককে অবশ্যই ইইউ নিজস্ব খাদ্য আইন বা শর্ত মেনে চলতে হবে, অথবা যদি নিজ দেশের সাথে অন্য কোন দেশের সুনির্দিষ্ট কোন দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে থাকে, তবে সে চুক্তি বা বিধি অনুযায়ী খাদ্যপণ্য (ফল ও শাকসবজি) রপ্তানি করতে হবে।
ইউরোপের বাজারে তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত দেশের নিরাপদ খাদ্য আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রাথমিক উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য-শৃঙ্খলের প্রতিটি ধাপে খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করা, রপ্তানির আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত উদ্ভিদগত মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানি করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে বিপত্তি বিশ্লেষণ ও সংকটপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধাপ (প্রসেসিংয়ের জন্য) নীতির বাস্তবায়ন করা, রপ্তানিকারকের রপ্তানির জন্য নিবন্ধন গ্রহণ বা অনুমোদন নেয়া এবং তাজা ফল ও শাকসবজির উৎস সঠিকভাবে শনাক্তকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবিধান (ইসি) নং ১৭৮/২০০২ এর অনুচ্ছেদ ১৭ নির্দেশনা অনুসারে, বাংলাদেশ হতে ইউরোপের দেশসমূহে তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারককে অবশ্যই খাদ্যপণ্য (ফল ও শাকসবজি) উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, মোড়কীকরণ এবং বিতরণসহ খাদ্য সরবারহ শৃঙ্খলের সকল ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) নিজস্ব নিরাপদ খাদ্য আইন এবং নীতিসমূহ পূরণ করে কি না, তা যাচাই করতে হবে।
ইউরোপের বাজারে তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের নিম্নলিখিত নিরাপদ খাদ্য নীতিসমূহ মেনে চলতে হবে: ফল ও শাকসবজি প্রাথমিক উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার পাত পর্যন্ত সম্পূর্ণ খাদ্য চেইনে বা সরবরাহ শৃঙ্খলে (“ফার্ম টু ফোর্ক” পদ্ধতি) খাদ্য নিরাপদতা নিশ্চিত করা; ফল ও শাকসবজি উৎপাদন থেকে শুরু করে (প্রাথমিক উৎপাদন বাদে) রপ্তানীকরণ পর্যন্ত ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং সংকটপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধাপ (ঐঅঈঈচ) নীতির সাধারণ বাস্তবায়ন করা; ফল ও শাকসবজি উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানিকরণ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্ভিদগত মৌলিক সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা; খাদ্য প্রতিষ্ঠান বা রপ্তানিকারকের রপ্তানির জন্য নিবন্ধন গ্রহণ করা বা অনুমোদন নেওয়া; খাদ্যোপণ্যের (ফল ও শাকসবজি) সঠিক উৎস শনাক্তকরণ (ঞৎধপবধনরষরঃু) পদ্ধতি অনুসরণ করা;
কৃষকরাই মূলত তাজা ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
একজন কৃষক, প্রক্রিয়াজাতকারী, বিতরণকারী বা রপ্তানিকারকে ফল ও শাকসবজির প্রাথমিক উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ খাদ্য শৃঙ্খলে খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্য বিপত্তির বা ঝুঁকির (রাসায়নিক, অণুজৈবিক এবং ভৌতগত বিপত্তি) যেকোনো উৎস যেমন: বায়ু, মাটি, পানি, সার, খাদ্য, রাসায়নিক, শ্রমিকের স্বাস্থ্যবিধি, স্টোরেজ, হ্যান্ডলিং, বর্জ্য নিষ্পত্তি ইত্যাদি থেকে পণ্যেকে দূষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানিকারকদেরকে সর্বদা উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ)-এর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা যাচাই করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। জনস্বাস্থ্য সুরাক্ষায় খাদ্য পণ্যে দূষক বা বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য মাত্রার ভেতর রাখা অপরিহার্য। রপ্তানিকারকের খাদ্য গ্রহণের সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি বিবেচনা করত এবং উত্তম কৃষি চর্চা অনুশীলনের মাধ্যমে দূষক যা বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত ঝুঁকি এড়াতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন খাদ্য পণ্যে এবং কীটনাশকের জন্য সর্বাধিক অবশিষ্টাংশের মাত্রা (গজখং) নির্ধারণ করেছে। ইউরোপী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত পণ্যের কীটনাশকের সর্বাধিক অবশিষ্টাংশের মাত্রাগুলো হালনাগাদ করে থাকে। একজন রপ্তানিকারকে ইউরোপের দেশসমূহে পণ্য রপ্তানি করার পূর্বে অবশ্যই ইউরোপীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে কীটনাশকের সর্বাধিক অবশিষ্টাংশের হালনাগাদ অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশসমূহে শাকসবজির প্তানির উদ্দেশ্যে যে কোনো খাদ্য পণ্যের জন্য ইইউ প্রবিধান নং ১১৬৯/২০১১ অনুযায়ী উক্ত খাদ্য পণ্যের প্রয়োজনীয় তথ্য থাকতে হবে। এই প্রবিধানমালা অনুযায়ী পণ্যের লেবেল ভোক্তাদের জন্য সঠিক তথ্য প্রদানের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রপ্তানিকারককে খাদ্য পণ্যের সাপ্লাই চেইনের সকল পর্যায়ে ভোক্তাদের কাছে যথাযথ খাদ্য তথ্য সরবরাহ করা একান্ত প্রযোজ্য। ইইউতে রপ্তানি করার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে অবশ্যই ইইউ-এর গন্তব্যের দেশের একটি ভাষায় লেবেল করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য তথ্য উল্লিখিত থাকতে হবে। খাদ্য তথ্য যেন ভুল না হয় এবং ভোক্তাকে বিভ্রান্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লট মার্কিং প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদক, প্রস্তুতকারক বা খাদ্যসামগ্রী প্যাকেজকারী বা ইইউ-এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিক্রেতার দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে।
প্রাথমিক উৎপাদনকারীদেরকে ফল ও শাকসবজি উৎপাদনের সময় নি¤েœাক্ত স্বাস্থ্যবিধি বিধানসমূহ প্রতিপালন করতে হবে -পণ্যকে পারস্পরিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা; রাসায়নিক, অনুজৈবিক এবং ভৌতগত বিপত্তি বা ঝুঁকির যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করা; পণ্য সংরক্ষণের স্থান, সরঞ্জাম, পাত্র, ক্রেট, যানবাহন ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা; উদ্ভিদজাত পণ্যের উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা; পারস্পারিক দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনে পানীয় জল বা পরিষ্কার জল ব্যবহার করা; পারস্পারিক দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রাণী এবং কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ করা; বর্জ্য এবং বিপজ্জনক পদার্থ (কীটনাশকসহ) এর সঠিক সংরক্ষণ এবং পরিচালনা করা যাতে পারস্পরিক দূষণ প্রতিরোধ করা যায়; কীটনাশক ও বায়োসাইডের সঠিক ব্যবহার; খাদ্য বিপত্তিসমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপগুলো একটি উপযুক্ত সময়ের জন্য তথ্য বা ডাটা রেকর্ড রাখা এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা (ফল বা শাকসবজির ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৬ মাস পর্যন্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে); রপ্তানিকারকদেরকে ফল বা শাকসবজির ক্ষেত্রে কীটনাশক বা বায়োসাইডের কোনো ব্যবহার, কোনো কীট বা রোগের উপস্থিতি, মানব স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের ফলাফলের রেকর্ড রাখতে হবে।
বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য তাজা ফল ও শাকসবজি রপ্তানির সাথে জড়িত যেকোন প্রতিষ্ঠান ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যাক্টিভিটি প্রকেজেক্টের সাথে যোগাযোগ করে ইজি এক্সেপোর্ট সিরিজ প্রকাশনাটি গ্রহণ করতে পারবেন। তাছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ওয়েবসাইটে প্রকাশনাটি পাওয়া যাবে। অবশেষে রপ্তানির সাথে জড়িত সকলের সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
লেখক: ফুড সেফটি এক্সপোর্ট পাবলিকেশন স্পেশালিস্ট, ইউএসএআইডি ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যাক্টিভিটি, মোবাইল: ০১৬১৩০৪১৮৭০, ই-মেইল : ihasan@trade-bee.com.bd
ব্রি উদ্ভাবিত সাশ্রয়ী বীজ বপনযন্ত্র
ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম১ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন২
কৃষিতে শ্রমিকের স্বল্পতায় শ্রমঘন কাজগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ধান চাষাবাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে চারা রোপণ অন্যতম। প্রচলিত পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণে অধিক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যন্ত্রের সাহায্যে ধানের চারা রোপণের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। রোপণযন্ত্রে ব্যবহারের জন্য ম্যাট টাইপ পদ্ধতিতে চারা তৈরি করতে হয়। ম্যাট টাইপ চারা তৈরিতে সমভাবে বীজ ছিটানো অত্যাবশ্যকীয়। সমভাবে বীজ না ছিটালে মিসিং হিলের পরিমাণ বেড়ে যায়। হাতে বীজ ছিটানো শ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ কাজ এবং সমভাবে বীজ ছিটানো যায় না। এই কাজকে সহজ ও দ্রুত করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের “যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের” আওতায় ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা ট্রেতে কম সময়, স্বল্প শ্রম এবং সমভাবে বীজ ছিটানোর জন্য বীজ বপনযন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে কমিউনিটি বেইজ চারা তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে।
কারিগরি বৈশিষ্ট্য
স্থানীয় ওয়ার্কশপে স্থানীয় সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে খুব সহজে যন্ত্রটি তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী/পুরুষ চালাতে পারে। প্রতি ট্রেতে অংকুরিত বীজ ছিটাতে ১ (এক) সেকেন্ড সময় লাগে। যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি ট্রেতে ৯৫ থেকে ১৬০ গ্রাম অংকুরিত বীজ বপন করা যায়। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ১৪৪০০টি ট্রে’তে বীজ বপন করতে পারে। যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে উপরের স্তর (৬ মিমি.) কভার করা যায়। বিভিন্ন জাতের ধানের জন্য বীজ বপনের হার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যন্ত্রের ওজন (৯ কেজি) কম হওয়ায় সহজেই হাতে বহন করা যায়। হপারের বীজ ধারণক্ষমতা ৯ কেজি হওয়ায় প্রতিবার ৬০ থেকে ৭৫টি ট্রে তৈরি করা যায়। যন্ত্রটির আনুমানিক বাজারমূল্য ১২,০০০/- টাকা মাত্র।
যন্ত্রটি চালনার পূর্বে করণীয়
সমতল জায়গায় সারিবদ্ধভাবে ২ সেমি. পরিমাণ মাটি ভর্তি ট্রে স্থাপন করে দুই পাশে রেইল বসাতে হবে। বীজের আকারের উপর নির্ভর করে বীজ বপনের হার ঠিক করতে হবে। সমন্বয়কারী ডায়াল ঘুরিয়ে ব্রাশ এর ওপেনিং সমন্বয় করে বীজ বপনের হার ঠিক করতে হবে। সমন্বয়কারী ডায়াল ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরালে বীজ বপনের হার বৃদ্ধি পাবে এবং ঘড়ির কাটার দিকে ঘুরালে বীজ বপনের হার হ্রাস পাবে। ধানের জাত ও অংকুরোদগমের উপর ভিত্তি করে কাক্সিক্ষত বীজের হার পাওয়ার জন্য ২/৩ বার ট্রায়াল দিতে হবে।
যন্ত্রটি চালানোর পদ্ধতি
বীজ ধান দিয়ে ব্রি বীজ বপন যন্ত্রটির হপার ভর্তি করে রেইলের উপর স্থাপন করতে হবে। শাটার লিভারটি সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে ক্লাচ এনগেজ করে বীজ ধান অথবা মাটি পড়ার জন্য শাটারটি খুলতে হবে। চালনাকারী হাতলটি যন্ত্রের পেছনে নির্ধারিত হুকে সংযুক্ত করতে হবে। চালনাকারী হাতলে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ধীর গতিতে (প্রতি ট্রের জন্য এক সেকেন্ড) হেঁটে খালি/ ফাঁকা ট্রে থেকে বীজ বিতরণ/ছিটানো শুরু করতে হবে। বীজ ছিটানোর সময় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই গতিতে যন্ত্রটি চালনা করতে হবে। পরবর্তীতে শাটার বন্ধ করার জন্য শাটার লিভারটি পেছনের দিকে টান দিয়ে ক্লাচকে ডিজএনগেজ করতে হবে যেন বীজ ধান না পড়ে। পুনরায় মাটি ভর্তি নতুন ট্রে স্থাপন করে একই পদ্ধতিতে বীজ ছিটানোর কাজ শেষ করতে হবে।
বীজের উপরের স্তরে মাটি প্রয়োগ
বীজের উপর মাটির পাতলা স্তর (ঞযরহ ষধুবৎ) দেয়ার জন্য পূর্বের মতো একই পদ্ধতিতে সমন্বয়কারী ডায়াল ঘুরিয়ে মাটির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
ব্রি বীজ বপনযন্ত্রের উপকারিতা
যন্ত্রটি ব্যবহারে সময়, খরচ ও শ্রম সাশ্রয় হয়। নিয়ন্ত্রিত ও সমানভাবে বীজ ছিটানো যায়। সকল চারা সমানভাবে (টহরভড়ৎসষু) বৃদ্ধি পায় । চারাগুলো সমভাবে বিস্তৃত থাকায় মিসিং হিলের পরিমাণ কম হয়। ব্রি বীজ বপন যন্ত্রটি ধানের চারা রোপণযন্ত্র জনপ্রিয়করণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
ব্রি বীজ বপনযন্ত্র চালানোর সতর্কতা
সমতল স্থানে ট্রে এবং রেইল স্থাপন করতে হবে। যন্ত্রটি সবসময় কোথাও না থেমে একই গতিতে চালনা করতে হবে। রেইলের উপর থেকে পানি, কাদা অথবা ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে। বীজের উপর মাটির পাতলা স্তর প্রয়োগের জন্য সবসময় শুকনো মাটি ব্যবহার করতে হবে। ক্লাচ্ এনগেজ্ড থাকা অবস্থায় যন্ত্রটি পেছনে টানা/ সরানো যাবে না। একদিনের বেশি অংকুরিত বীজ অথবা বীজের ভ্রƒণ বা শিকড় বেশি বড় হলে যন্ত্রটি ব্যবহার করা যাবে না।
রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ
বীজ বপন যন্ত্রের জীবনকাল দীর্ঘায়িত করতে হলে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করতে হবে। যন্ত্রটি ব্যবহারের পর হপার থেকে মাটি ও বীজ ধান ভালোভাবে অপসারণ করতে হবে। এটি
ভালোভাবে
পরিষ্কার করে শুকানোর পর ঘূর্ণায়মান অংশে অয়েল বা গ্রিজ দিয়ে রাখতে হবে। সমন্বয়কারী ডায়াল ঘুরিয়ে ৩/৪ (তিন/চার) নাম্বার পজিশনে রাখতে হবে যেন রোলার ও ব্রাশ এর মধ্যবর্তী ২মিমি ফাঁকা থাকে। ব্রাশের বিচ্যুতি এড়ানোর জন্য ব্রাশ ও রোলারের সংযোগ বন্ধ করতে হবে। শাটার লিভারটি নিচের দিকে রেখে শাটার খোলা রাখতে হবে। যন্ত্রটি আর্দ্রতামুক্ত শুষ্ক ও ঠা-া স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। এটির উপর ভারী বস্তু বা জিনিস রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ব্রি বীজ বপনযন্ত্র ট্রেতে বীজ বপন কারিগরি ও অর্থনৈতিকভাবে একটি টেকসই প্রযুক্তি। ধানের চারা রোপণযন্ত্র কৃষক ও স্থানীয় উদ্যোক্তা পর্যায়ে জনপ্রিয়করণ করার জন্য বীজ বপনযন্ত্র খুবই উপযোগী। মাঠ পর্যায়ে ধানের চারা রোপণযন্ত্র এবং বীজ বপনযন্ত্র একই প্যাকেজ আকারে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
লেখক : ১প্রকল্প পরিচালক, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্প, ২ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ই-মেইল : smmomin80@gmail.com
মাছচাষিদের পাশে থেকে নিরলসভাবে সেবা প্রদান
করছে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল
মো: মাসুদ রানা
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ এবং কৃষির একটা বড় অংশ দখল করে আছে মৎস্য চাষ। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি, মাছ ছাড়া বাঙালির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশের পুকুর, নদী, খাল, বিল, হাওর, বাঁওড়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাপকভাবে মাছ চাষ হয় এমনকি বর্তমানে ঘরের ছাদে বা ঘেরা জায়গায় বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি এবং আরএএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ মাছ চাষে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ, মৎস্য সেক্টরের বিভিন্ন কর্মকা-ের সাথে যুক্ত থেকে এদেশের কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। মাছ চাষ অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা হলেও অভিজ্ঞতার অভাব, রোগবালাই, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ও প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে মাছচাষিদের অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যা মৎস্য সেক্টর তথা দেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাছচাষিদের পাশে থেকে মাছ চাষের আধুনিক কলাকৌশল সংক্রান্ত সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া, মাছের রোগবালাই নিরসনে সহযোগিতা করা, মাছের মড়ক দেখা দিলে মাছের মড়কের উৎকৃষ্ট কারণ খুঁজে বের করা এবং তার সমাধান দেওয়াসহ মৎস্য চাষ ও মৎস্য চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকার তথ্য দিয়ে দেশের মাছচাষিদের সহযোগিতা করে কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে এবং ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ইধহমষধফবংয ঋরংয ঐড়ংঢ়রঃধষ/বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল নামক সংস্থাটি ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এটি একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণমূলক সংগঠন। প্রান্তিক ও সর্বস্তরের মাছচাষিদের মাছ চাষ সম্পর্কিত কলাকৌশলের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা প্রদান করে দরিদ্রতা বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, মাছের রোগ নিরাময়ে পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে সর্বস্তরের মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান, মাছের রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাষিদের পুকুরে/জলাশয়ে গিয়ে আধুনিক চিকিৎসা প্রদান, প্রত্যেক উপজেলার প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে মাছ চাষীদের নিয়মিতভাবে পুকুরের/ জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করে পরামর্শ প্রদান, চাষিদের মাছ চাষে আগ্রহ টিকিয়ে রাখতে নিয়মিতভাবে চাষিদের সাথে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের টিম দ্বারা মতবিনিময় করা, মৎস্য সেক্টরে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে গ্রামীণ বেকার যুবকদের মাছ চাষ ও মাছের রোগ দমন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে চাষিদের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার তৈরি ও ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান, বায়োফ্লক, হাইডেনসিটি, আরএএসসহ যাবতীয় আধুনিক মাছ চাষ বিষয়ে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, সঠিকভাবে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিবহন বিষয়ে হ্যাচারি ও নার্সারি মালিকদের সহযোগিতা প্রদান, বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে মাছের মড়ক দেখা দিলে মাছ চাষিদের পাশে থেকে সাহস প্রদান এবং মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মড়কের কারণ খুঁজে সমাধান করা, উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ রক্ষার্থে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, সামাজিক যোগাযোগ ও হটলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে চাষিদের ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদান, দেশের সকল জেলায় ইউনিয়নভিক্তিক আঞ্চলিক মৎস্য পরামর্শ ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মাঝে নিয়মিতভাবে সেবার মান নিশ্চিতকরণ, মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে একযোগে কাজ করে দেশের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় মাছের রোগ ও আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ক নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান, মাছের রোগ নির্ণয় ও নিরাময় সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে গবেষণা পরিচালনাকরণ, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের মধ্যে কুইজ/রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের ব্যাপক প্রচারণা করা, প্রথম সারির মৎস্য ঔষধ উৎপাদনকারী সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় ক্ষুদ্র দুঃস্থ মাছ চাষিদের মাঝে মাছের পোনা বিতরণ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মাছ চাষিদের মেধাবী সন্তানদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় উচ্চশিক্ষায় বৃত্তির ব্যবস্থা করা, মৎস্য হ্যাচারি মালিক, মাছ চাষি, মাছ বিক্রেতাদের মধ্যে বন্ধন স্থাপন করে চাষিদের বাজার দর জানা এবং ন্যায্যমূল্য পেতে সহযোগিতা করা, নিরাপদ মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে মাছ চাষিদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং এর সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোকপাতকরণ, ভোক্তাদের নিকট গুণগত মানের মাছ পৌঁছানোর লক্ষ্যে চাষিদের মাছ আহরণোত্তর ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকার প্রদত্ত যেকোন কর্মকা- বাস্তবায়নে সগৌরবে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের উল্লেখযোগ্য কাজ। এ ছাড়াও ইধহমষধফবংয ঋরংয ঐড়ংঢ়রঃধষ নামক অ্যাপ্লিকেশন সফট্ওয়ার তৈরীকরণের মাধ্যমে চাষিদের মৎস্য সেবা সহজীকরণ করা, মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত যেকোন কর্মকা- বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পিকেএসএফসহ মৎস্য সেক্টরের অন্যান্য দপ্তরের সাথে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে দেশের মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে অংশ গ্রহণ করা। এক কথায়, বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের কাজ হচ্ছে মাছচাষিদের পাশে থেকে উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগবালাই নিরসন ও নিরাপদ মাছ উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা।
বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল একটি স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণমূলক সংগঠন। দেশের পাঁচটি বিভাগে এ কার্যক্রম চলমান। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে সার্ভিস বুথ ও প্রতিনিধি। পর্যায়ক্রমে পুরো বাংলাদেশে এই সেবা ছড়িয়ে দেয়া হবে। যে সকল প্রতিনিধি প্রান্তিক লেভেলে সেবা প্রদান করবেন তারা বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্ট হিসেবে পদায়ন হবেন। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টগণকে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতালের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দ্বারা মৎস্য চাষ, মৎস্য রোগ ব্যবস্থাপনা, খাবার ব্যবস্থাপনা, পানি পরীক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে বিস্তর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টগণ চাষির সমস্যা ভালভাবে জেনে বুঝে পুকুর/জলাশয় পরিদর্শন ও পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে পরামর্শ দিবেন এবং কি পরামর্শ দিয়েছেন তা তাৎক্ষণিক সংগঠনের চিকিৎসা সচিবকে অবগত করবেন। তাদের আয়ত্বের মধ্যে না থাকলে সমস্যার বিস্তারিত ছবি ও পানি পরীক্ষার রিপোর্টসহ সংগঠনের চিকিৎসা সচিবের নিকট দাখিল করবেন, পরবর্তীতে চিকিৎসা সচিব তার টিমের সাথে পরামর্শ করে আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টকে পরামর্শ পাঠাবেন যা তিনি চাষিকে দ্রুততার সাথে লিখিত আকারে প্রদান করবেন। আঞ্চলিক মৎস্য সেবা কর্মী কাম ফিল্ড কনসালটেন্টগণ সংগঠনের চিকিৎসা সচিবদের সাথে নিজ নিজ এলাকার মাছ ও মাছের রোগসংক্রান্ত সমস্যাবলী সমাধানের জন্য সচেষ্ট থাকবেন।
মৎস্য হাসপাতাল থেকে সেবা পাওয়া একাধিক মাছ চাষিরা বলেন, ‘আমরা যেকোনো সমস্যায় মৎস্য হাসপাতালের প্রতিনিধিদের পাশে পাই। তারা পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের সাহায্য করে। মাছের রোগ চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেয়। ফলে আমাদের ভোগান্তি অনেক অংশে কমছে।’ বর্তমানে রাজশাহী বিভাগ (নাটোর, নওগা, বগুড়া, জয়পুরহাট), ঢাকা বিভাগ (গাজীপুর, মানিকগঞ্জ), ময়মনসিংহ বিভাগ (ময়মনসিংহ সদর, নেত্রকোনা, জামালপুর), রংপুর বিভাগ (রংপুর সদর, দিনাজপুর) এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মোট ৬৮টি সার্ভিস বুথ চালু রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসলে বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল তাদের কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়াতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল :০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল : ranadof.bd@gmail.com
খাদ্য বিষক্রিয়ায় হাইড্রোজ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিকল্প
প্রফেসর ড. মারুফ আহমেদ১ মোছা: ইমা পারভীন২ মোঃ শাহজাহান কবির৩
বেঁচে থাকার জন্য সবার আগে প্রয়োজন খাদ্যের। মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। খালি চোখে না দেখা অণুজীব থেকে শুরু করে বৃহদাকার নীল তিমি পর্যন্ত প্রত্যেকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাবার। কিন্তু বর্তমানে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যই যেন হয়ে উঠেছে মানুষের জীবননাশের কারণ। শুধুমাত্র অল্পকিছু মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অননুমোদিত কেমিক্যাল, খাদ্য হচ্ছে ভেজালযুক্ত, বাড়ছে বিষক্রিয়া, বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি, কমছে আয়ু।
ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়।
খাঁটি জিনিস এ কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
ভেজাল নামটা খাঁটি কেবল, আর সকলই মিথ্যে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা যেন বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতির স্পষ্ট চিত্রই তুলে ধরে। বর্তমান নাগরিক জীবনের অন্যতম উদ্বেগের নাম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি ভেজাল খাবার। মজাদার খাবার এখন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা রাজধানীসহ, জেলাশহর, উপজেলাশহর, হাটবাজারগুলোতে বিভিন্ন মিষ্টি ও বেকারি খাবারে ব্যবহার করছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ হাইড্রোজ, যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। হাইড্রোজ গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের রঙ সাদা করতে ব্যবহার করার কথা থাকলেও বর্তমানে কতিপয় অর্থলোভী ব্যবসায়ী ব্যবহার করছে খাদ্য সাদা বা পরিষ্কার রাখতে। ফলে খাদ্য হচ্ছে বিষাক্ত।
হাইড্রোজের ব্যবহার : হাইড্রোজ সাধারণত ব্লিচিং এজেন্ট ও রিডিউসিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। সাধারণত গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের এবং কাগজ শিল্পে কাগজের ম-ের রঙকে উজ্জ্বল করতে হাইড্রোজ ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশে যে খাবারগুলোতে অননুমোদিতভাবে হাইড্রোজ ব্যবহার হচ্ছে তা হলো : মুড়ি সাদা করতে; চালের রঙ উজ্জ্বল করতে; গুড়ের রঙ উজ্জ্বল করতে; জিলাপি মুচমুচে করতে; মোরব্বা সাদা ও শক্ত করতে; মিষ্টির রঙ সাদা করার জন্য; কেক নরম ও আকর্ষণীয় করতে; আটা-ময়দার মধ্যেকার জ্যান্থফিলের রঞ্জক কে কমিয়ে সাদা রঙ এ পরিবর্তন করতে; রসগোল্লা তেলে ভাজার পর হাউড্রোজ মিশ্রিত চিনির সিরায় ছেড়ে দিলে তা ধবধবে সাদা হয়; ময়দার তৈরি বিস্কুট সাদা করার জন্য তালমিছরি নামে সাদা ধবধবে এক ধরনের চিনির তৈরি মিষ্টিদ্রব্য সাদা করতে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজ।
ক্ষতিকর প্রভাব : খাদ্যে হাইড্রোজ ব্যবহার করলে তা জারিত হয়ে বিষাক্ত সালফার-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে যা মানুষের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে হাইড্রোজ শরীরে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে যা বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষিদ্ধ হাইড্রোজ প্রয়োগের ফলে ক্যান্সার, হাঁপানি এবং চর্মরোগ হয়। দ্রবণটিকে ৪-৫ ঘণ্টার জন্য স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে। যদি সেই খাবারের মধ্যে হাইড্রোজ উপস্থিত থাকে তাহলে পাত্রের তলায় ধূসর বর্ণের অধক্ষেপ পড়বে। সংগঠিত বিক্রিয়াটি নিম্নরূপ :
২ঈঁঝঙ৪+ঘধ২ঝ২ঙ৪=২ঈঁঙ (অধক্ষেপ) + ঘধ২ঝ২ঙ৬+২ঝঙ২
এ ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে খাদ্যে উপস্থিত হাইড্রোজের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।
হাইড্রোজের বিকল্প ব্যবহার ও জনসচেতনতা : যদিও হাইড্রোজের সরাসরি বিকল্প নেই বললেই চলে তবে পটাশিয়াম মেটা বাইসালফাইট, সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইট অনেকটা হাইড্রোজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। যদিও এই ব্যাপারে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।
আমাদের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করতে হবে। একে বাস্তবায়িত করতে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য এবং এসবের জোগানদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক জেলায় এবং বড় বড় বাজারগুলোতে পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। ইঝঞও ও ইধহমষধফবংয ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু অঁঃযড়ৎরঃু সহ বিভিন্ন সংস্থাকে এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং বাজার তদারকির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ভোক্তাপর্যায়ে সবাইকে খাবার ক্রয়ের আগে সেই খাবার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। ক্রেতাপর্যায়ে খাবারের চাকচিক্য না দেখে খাবারের গুণাবলী ও পুষ্টিগুণ দেখে খাবার ক্রয়ের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের খাদ্যদ্রব্যে হাইড্রোজ মিশানোর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জানিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার প্রয়াস চালাতে হবে। একই সাথে সরকারিভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সঠিক বাজার তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : ১ডিপার্টমেন্ট অব ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর; ২,৩ বিএসসিইন ফুড অ্যান্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর; মোবাইল : ০১৭৫০৭৭৭৮৯৯, ই-মেইল : maruffpp@gmail.com.
গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ পৃথিবীর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য এ দেশের প্রায় ২৪.৩ মিলিয়ন গরু, ১.৫ মিলিয়ন মহিষ, ২৬.৩ মিলিয়ন ছাগল ও ৩.৬ মিলিয়ন ভেড়া প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, কৃষি কাজ, হাল চাষ, চামড়া রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, গ্রামীণ পরিবহনে গাড়ি টানা, জ্বালানি ও মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির জন্য গোবর, ধর্মীয় সন্তুষ্টিতে পশু কোরবানি, কর্ম-সংস্থানসহ দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থ উপার্জন এবং পরিবেশ রক্ষাসহ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। গবাদিপশু আর অবহেলিত সম্পদ নয় বরং এটি কৃষকের নিকট একটি অতি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গবাদিপশুর গুরুত্ব অনুধাবন করেই এদেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৭৫ ভাগের বেশি লোক কোনো না কোনো পশু-পাখি পালন করে থাকেন। তবে গবাদিপশু প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধান সমস্যা হচ্ছে রোগ। গবাদিপ্রাণির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বলতে গবাদিপ্রাণির রোগ প্রতিরোধ ও অসুস্থ পশুকে চিকিৎসা প্রদান করাকে বোঝায়।
গবাদিপশুকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে হলে বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন তার মধ্যে রয়েছে -
স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান : গবাদিপশুকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, অতিরিক্ত ঠা-া ও গরম এবং পোকামাকড়, বন্য জীবজন্তু হতে রক্ষার জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান জরুরি। বাসস্থান নির্ভর করে আপনি কতটি গবাদিপশু লালন পালন করছেন তার উপর। যদি সংখ্যা ১০-১৫টির মধ্যে থাকে, তবে স্ট্রাকচারড শেড বানানোর দরকার নেই। সাধারণত আমরা গোয়ালঘরে যেভাবে গরু পালন করি সেই রকম একটা গোয়ালঘরের মতো ঘর বানাতে পারলেই পালন শুরু করা যায়। তবে এখানে বিচার্য বিষয় হচ্ছে যে গবাদিপশুর আরামের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার সংস্থান যেমন- প্রতিটি গরুর জন্য ৩ ফিট প্রস্থ এবং ৭ ফিট দৈর্ঘ্যের জায়গা দরকার হয়। ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের জন্য ঘরটি উত্তর-দক্ষিণমুখী হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর সাথে যা দরকার হয় তা হচ্ছে খাবারের পাত্র/চারি। ঘরটি খর, টিন, ছন অথবা হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি করা যায়। কোন অবস্থাতেই ঘর যেন স্যাঁতস্যেঁতে অবস্থায় না থাকে। বাসস্থান প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার করলে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা : সুষম খাদ্য শরীরে শক্তি ও কাজ করার ক্ষমতা দেয়; শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে; শরীরকে রোগমুক্ত রাখাতে সাহায্য করে। গবাদিপশুর খাদ্য প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত ১. ছোবড়া বা আঁশজাতীয় খাদ্য। ২. দানাদার খাদ্য ৩. পানি।
ছোবড়া বা আঁশওয়ালা খাদ্য গবাদিপশুর প্রধান খাবার এবং পুষ্টির প্রধান উৎস। গবাদিপশুকে তার ওজনের কমপক্ষে ৪% বিভিন্ন জাতের ঘাস দিতে হবে। পুষ্টিমান কম হলেও পেট ভরাতে ও জাবর কেটে হজমে সহায়তার জন্য গবাদিপশুকে পর্যাপ্ত খড় খাওয়ানো প্রয়োজন।
যেসব খাদ্যে আয়তনের তুলনায় খাদ্যমান অপেক্ষাকৃত বেশি এবং সহজপাচ্য তাকে দানাদার খাদ্য বলা হয়। দানাদার গোখাদ্যগুলো হলো চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, কলাই, ছোলা, খেসারি, সয়াবিন ও শুকনো মাছের গুঁড়া এসব। সুষম দানাদারের মধ্যে কমপক্ষে ৫৫-৬০% শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট (চালের কুড়া, ভুট্টা, গমের ভুসি), ২৫-৩০% প্রোটিন বা আমিষ (ডালবীজ যেমন : এংকর, মসুরি, মুগ, খেসারি, মাষকলাই বা ডালবীজের খোসা), ১০-১২% ফ্যাট (তেলজাতীয় বীজের খৈল, যেমন: সরিষা, তিল, নারিকেল, সয়াবিন, কালোজিরার খৈল), ভিটামিন ও মিনারেল ২-৩% (যেমন : লবণ ও ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স) থাকবে।
গবাদিপশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হবে। বাচ্চাকে তিন মাস তার ওজনের কমপক্ষে ১০% মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
পরজীবী দমন ব্যবস্থাপনা : গবাদিপশু সাধারণত তিন ধরনের কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয় যেমন- গোল কৃমি, ফিতা কৃমি ও পাতা কৃমি (কলিজা কৃমি)। গবাদিপশুকে বছরে কমপক্ষে তিনবার কৃমির ঔষধ খাওয়ানো উচিত। তাছাড়া বহিঃপরজীবীর (যেমন- উকুন, আঠালি ও মাইট) আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
টিকা প্রদান : উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন করার পাশাপাশি যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে প্রতিপালিত পশুকে নিয়মিত ভ্যাকসিন বা টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসা।
গবাদিপশুর বিভিন্ন রোগের মধ্যে কয়েকটি রোগ সংক্রামক বা ছোঁয়াচে। এ সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগগুলোতে গবাদিপশু আক্রান্ত হলে অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসার কোনো সুযোগ বা সময় পাওয়া যায় না। চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়ার আগেই পশু মারা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনেক অর্থ ব্যয় করে দ্রুত চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়ে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখা হলেও তা থেকে প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যায় না। কাজেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হচ্ছে এই রোগগুলো যেন গবাদিপশুকে আক্রমণ করতে না পারে, তার জন্য এসব সংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধকল্পে ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া। বাংলাদেশের গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ৮টি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায় এবং এই রোগগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টিকাও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উৎপাদন করে। এ দেশেপ্রাপ্ত গবাদিপশুর জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিন টিকার নাম ও ব্যবহার বিধি টেবিলে দ্রষ্টব্য।
স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ, পরিমাণমতো সুষম খাবার সরবরাহকরণ এবং নিয়মিত পরজীবী দমন ও টিকা প্রদান সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান গবাদিপশুর পূর্বশর্ত। এসব ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেই প্রাণিজ আমিষের কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।
লেখক : অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সিলেট, মোবাইল : ০১৭১১৪৮৪৯৪৫, ই-মেইল :s.islam7525gmail.com
নিরাপদ শাকসবজি সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ
কৃষিবিদ তাপস কুমার ঘোষ১ মোছা: সাবিহা সুলতানা২
শাকসবজি মানবদেহের প্রয়োজনীয় জৈবরাসায়নিক পুষ্টি উপাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনসহ মানবদেহের জন্য অপরিহার্য খনিজ পদার্থ। উন্নয়নশীল দেশের জন্য শাকসবজি শক্তির মৌলিক উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন অত্যন্ত উপকারী, তেমনি খাদ্য ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। শাকসবজি সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগত মানও ভালো থাকে। এতে করে কৃষকদের শাকসবজির সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় না। তাছাড়া জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে চাষকৃত শাকসবজিতে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে থাকে। কৃষকরা মানসম্মত শাকসবজির ফলন বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের উপর ভালো লাভ পেতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে কৃষকগণ ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন এবং সর্বশেষ স্প্রে ও ফসল তোলার মধ্যে সময়ের উপযুক্ত ব্যবধান মেনে চলেন না। যার ফলে বাজারের শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ মানবদেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকীস্বরূপ। নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহের বিভিন্ন অংশে কীটনাশকের দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় বিভিন্ন জীবনঘাতী ব্যাধি যেমন : ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনির বিভিন্ন রোগ ইত্যাদি। ভোক্তা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে ফসল সংগ্রহ করে বাজারজাত করা প্রয়োজন। ভোক্তা নিরাপদ সবজি গ্রহণের নিমিত্ত বাজার থেকে কেনা শাকসবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ জরুরি।
শাকসবজির ধরনভেদে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহের নিয়ম
টমেটো, বেগুন, শসা, কুমড়া এসব সবজিকে বোঁটা থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে গাছ থেকে আলাদা করে নিতে হবে। চারা গাছ পাতলা করার সময় ছোট গাছ হিসেবে লালশাক, পালংশাক এসবের শাককে সংগ্রহ করে নিতে হবে। পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক সংগ্রহের সময় সম্পূর্ণ গাছটি শিকড়সহ উপড়ে ফেলে সংগ্রহ করতে হয়। শাক হিসাবে ব্যবহারের জন্য পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগা প্রুনিং বা গাছের অংশ কেটে সংগ্রহ করে নিতে হবে। আবার বিভিন্ন সবজি সংগ্রহের উপযোগী সময় ও উপযুক্ত অবস্থাভেদে সংগ্রহ করতে হবে।
বেগুন : ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় তবে পরিপূর্ণ আকার এবং রঙ প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে।
চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিন পরই ফসল সংগ্রহের সময় হয়। ফুল ফোটার ৭-১০ দিন পরই বেগুন সংগ্রহ করা যায়।
লাউ ফলের ত্বকের লোমশ ভাগ পরিপক্বতার সাথে সাথে কমতে থাকে, ফলের লোমশ ঘনত্ব দেখেও এর সংগ্রহ উপযোগিতা নির্ণয় করা যায় এবং সংগ্রহ করতে হয়; শিম ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। শুঁটি পরিপূর্ণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে এর বীজের অংশ কিছুটা স্ফীত হওয়ার পর পরই সংগ্রহ করতে হবে। অতিরিক্ত পরিপক্ব শুঁটিতে আঁশ জন্মালে কোমলতা ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়; বরবটি শুটি পরিপূর্ণ লম্বা ও মোটা হলে এবং বীজের অংশ সামান্য স্ফীত হতে শুরু করলে বরবটি তোলা যাবে; মুলা বীজ বপণের ২০-২৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায় শাকের জন্য ঘন করে বপন করলে ফসল ২০ দিন পর এবং মুলার জন্য ৪০ দিন পর থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে; ধুন্দল গাছে ফল ধরার ৮ থেকে ১০ দিন পরেই সংগ্রহ উপযোগী হয়। ফল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে। বেশি পরিপক্ব হলে ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান দুটোই কমে যায়; ঢেঁড়স কোমল ও কচি অবস্থায় ঢেঁড়সের ফল তুলতে হবে। ফল বের হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর ঢেঁড়স খাওয়ার উপযোগী হয়; টমেটো জাত ও লাগানোর সময়ের উপর নির্ভর করে ২-৪ মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময় হয়। ফলের নিচের ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। এরূপ ফল সংগ্রহ করলে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
সবজি সংগ্রহে সতর্কতা : হাত দিয়ে মোচড়ায়ে সবজি ফসল সংগ্রহ করা যাবে না, এতে মাতৃগাছের ক্ষতি হয়। মোচড়ানোর ফলে গাছে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়ে রোগজীবাণুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষতি এড়ানোর জন্য ধারালো ছুরি বা ক্লিপার দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহ করে ফসল তোলার পাত্রে রাখতে হবে। আর যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংগ্রহ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করে শাকসবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাপকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
যেমন : ক) মাঠে থাকা অবস্থায় সংগ্রহের সময় সবজির গায়ে ধুলাবালু লাগতে পারে। এজন্য সংগ্রহের পর পরই পরিষ্কার পানিতে সবজি ধুয়ে নিতে হবে এতে সবজি ফসল টাটকা ও সুন্দর দেখায় এবং নেতিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে। খ) এরপর আকর্ষণ ও মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে সটিং এবং গ্রেডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজিভেদে আকার-আকৃতি বর্ণ, ব্যত্তি, পরিপক্বতা অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে গ্রেডিং করে নিতে হবে। গ) রসালো সবজি সংগ্রহ করার পরও স্বসন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এজন্য ঠা-া ঘরে বায়ুশূণ্য করে অল্প সময়ের জন্য হলেও মাঠের তাপ সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি থেকে বালাইনাশক অবশিষ্টাংশ অপসারণ তথা সংক্রমণমুক্তকরণ কয়েক পদ্ধতিতে রান্নাঘরে সহজলভ্য কিছু উপাদান দ্বারা সহজেই করা যেতে পারে। উপাদানগুলো হলো খাবার লবণ, গুঁড়া সাবান, হলুদ গুঁড়া ও ভিনেগার দ্বারা সহজেই করা যেতে পারে। বেগুন, শিম, টমেটো এবং কাঁচামরিচ এবং খোসা ছাড়ানোর মাধ্যমে শসা হতে অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের যথা- ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা যায় যা নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
খাবার লবণ দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণ পানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণ পানিতে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে ও পরিমিত তাপে রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৬% পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয়।
হলুদ গুঁড়া দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে হলুদ গুঁড়া যোগ করে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত হলুদ দ্রবণে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৭১% পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয় ।
খাবার লবণ+খোসা ছাড়ানো
বাজার থেকে কিনে আনা শসা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণপানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণপানিতে শসা ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। চাকু দিয়ে শসার খোসা ছাড়াতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে খোসা ছাড়ানো শসা ধুয়ে ফেলতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৫% পর্যন্ত ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।
ভিনেগার দ্বারা
বাজার থেকে কিনে আনা কাঁকরোল ও টমেটো পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি হারে এসিটিক এসিড বা ভিনেগার যোগ করে ভিনেগার-পানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত ভিনেগার-পানিতে কাঁকরোল ও টমেটো ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে কাঁকরোল ও টমেটো ধুয়ে নিতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮০% পর্যন্ত ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।
শাকসবজির সুষ্ঠু সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণমুক্তকরণ ব্যবস্থা যদি নিয়মিতভাবে করা হয় তবে উৎপাদনকারীর অপচয় রোধ হবে এবং কৃষক অধিক মুনাফা লাভ করতে পারবেন। আর দেশের শাকসবজির উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা অর্জনের পথ হবে সুগম। উপরোক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন সবজি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সংক্রমণমুক্তকরণের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি সহজলভ্য করা সম্ভব।
লেখক : ১প্রকল্প পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ২প্রোগ্রাম কমিউনিকেটর, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা; মোবাইল : ০১৭১৯৭৫৩৪৩১, ই-মেইল :sabiha.saao@yahoo.com
প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও ব্যবস্থাপনা
মোরসালীন জেবীন তুরিন
দিন দিন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সাথে সাথে আমরা অনেকটা আত্মকেন্দ্রিকও হয়ে পড়ছি, নগরজীবন-যাপন এর কারণে আমাদের সমাজব্যবস্থা আর ততটা সুসংগঠিত হচ্ছে না এবং সম্পদ অপ্রতুলতার কারণে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রবীণ সমাজ এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রবীণ বা বয়স্কদের নিয়ে সচরাচর এখন কোন আলোচনা হয় না। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আজকের এই প্রবীণরাই আমাদের পথপ্রদর্শক, তারাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস। যেহেতু এক সময় আমাদের সবাইকে এই পরিণতিতে যেতে হবে তাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে মনোযোগী ও সচেতন হতে হবে এবং বয়স হওয়ার আগেই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কিছু ব্যাপার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেমন- খাদ্যাভাস, জীবনযাত্রা সঠিকভাবে মেনে চলে বয়স্কদের সমস্যা কমানো যায়। যুবক বয়সে আমাদের কোন কোন খাদ্যাভাস আমাদের ক্ষতি করে বোঝা না গেলেও পরবর্তীতে তা ক্ষতি করতে পারে। আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে চাকুরি শেষ হয়ে গেলে শক্তি শেষ মনে করা হয় । কিন্তু সঠিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে চাকরির পরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা যায়। তাই আমাদের প্রবীণ বা বয়স্কদের বৃদ্ধাবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে।
চিকিৎসা শাস্ত্রেGeriatric, Gerontology হল মেডিসিন এর এমন একটি শাখা যেখানে বয়স্কদের বৃদ্ধাবস্থা এবং তাদের রোগসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রবীণদের লক্ষণসমূহ : সকল বয়স্কদের ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তাই Geriatric Syndrome।UN, ২০০১ এর রিপোর্টে দেখানো হয়েছে বিশ্বজুড়ে ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে যেমন ইতালি, জাপান, জার্মানিতে ২০০২ সালে যেখানে ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের শতকরা ২৪ ভাগ সেখানেই ২০২৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে শতকরা ৩৪ ভাগ। টঘ, ২০০১ এর আরেকটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে , ষাট (৬০) বছরের অধিক বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবস্থানুপাতিক হারে আমাদের শিশু ও যুবসমাজ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ২০০০ সালের ৬.৮ মিলিয়ন থেকে ২১০০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৬৫ মিলিয়ন যেখানে জনসংখ্যা হবে দ্বিগুণ এবং কর্মঠ লোকের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন থেকে নেমে দাঁড়াবে ২ মিলিয়ন। আমাদের দেশে বর্তমানে কর্মঠ তরুণ সমাজ বয়স্ক মানুষ থেকে বেশি যা পরবর্তীতে কমে যাবে। তাই আমাদের যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। জাপান তার যুবসমাজকে কাজে লাগিয়েছিল তাই তারা উন্নত করতে পেরেছিল। আর দশ বছর পরে আমাদের কর্মঠ মানুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে তাই এই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
বার্ধক্য : বয়স বৃদ্ধি যা অবশ্যম্ভাবী এটা কোন অসুস্থতা নয়, ageing একটি biological phenomena; ষাট বছর এর উপরের মানুষদের বয়স্ক ধরা হয়। বয়স্কদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা হয়ে থাকে যেমন: শারীরিক সমস্যা; মানসিক সমস্যা; সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সমস্যা।Independent Commission on Health in India এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বয়স্কদের সাধারণত দৃষ্টি শক্তির সমস্যা, হাড় এর ক্ষয়জনিত সমস্যা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, কানে কমশোনা, হজম জনিত সমস্যা, মূত্রাশয় সমস্যা ইত্যাদি নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। ৮৮% বয়স্ক লোকেরা দৃষ্টিশক্তির নানা সমস্যায় ভোগেন যেমনঃ চোখে ছানিপড়া, গ্লুকোমা, রেটিনার ক্ষয় ইত্যাদি। ৪০% বয়স্ক লোকের হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যা থাকে যেমনঃ অস্থি শুকিয়ে যাওয়া, অস্থিসন্ধি প্রদাহ ইত্যাদি। বয়স্কলোকের মধ্য ১৮.৭% লোক হাত কাপাকাপি, ভুলে যাওয়া রোগ ও উন্মাদনার মতো কিছু সমস্যায় ভোগে। বয়স্কদের হৃদজনিত রোগও দেখা যায়। বয়স্করা অ্যাজমা ব্রংকাইটিস এর মতো বিভিন্ন শ্বাস জনিত সমস্যায় ভোগে। প্রায় ৯% বয়স্কদের হজম শক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পেপটিক আলসার এবং অনেকসময় কম চলাফেরার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যায় ভোগে। এছাড়াও বয়স্কদের দাঁত পড়ে যায়, মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ঘ্রাণশক্তি কমে যায়, ঘন ঘন টয়লেট যেতে হয় তাই পানি ও কম খায়। মোট কথা তারা ঠিক মতো খেতে পারে না, ফলশ্রুতিতে একসময় তারা চরম অপুষ্টির শিকার হয়।
বয়স্কলোকদের ৮.৫% লোক ভুলে যাওয়া রোগ, হতাশা, উদ্বিগ্নতা, ডিলিরিয়াম, উন্মাদনার মতো সমস্যায় পতিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সত্তাও নষ্ট হয়, তাদের আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কেউই ভালো কাজ দেয় না বা তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হয় না। তারা আগে যেখানে পরিবারের কর্তা ছিল আজ সেই পরিবারে সে নিগৃহীত, তারা অনেক কাজ নিজে করতে পারে না অন্যের উপর নির্ভরশীল হয় তাই তারা চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
বয়স্কদের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা
স্যার জেমস স্টালিং এর মতে বার্ধক্যকে যবধষ করা যাবে না, এটাকে ঢ়ৎড়ঃবপঃ, ঢ়ৎড়সড়ঃব এবং বীঃবহফ করতে হবে। অনেকের শরীর ষাট বছর পার হয়ে গেলেও সিস্টেমিক ডিজিস না হতে পারে কিন্তু বয়স হলে বার্ধক্যজনিত সমস্যা হতে পারে। হার্ট, কিডনি, চোখ এইগুলো ষাটের পরে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। প্রাথমিকভাবে বয়স্কদের পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম করা, ধূমপান না করা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অনেক সময় দেখা যায় পরিবারে বয়স্কদের পছন্দ অনুযায়ী রান্না করা হয় না। তাদের পুষ্টির কথা ভাবা হয় না। বয়স্কদের খাবারে পানি থাকতে হবে ৮-১০ গ্লাস, ডায়াবেটিস না থাকলে কন্দজাতীয় খাবার তারা খেতে পারে। হজমজনিত সমস্যা এড়ানোর জন্য তারা ডালজাতীয় খাবার কম খেতে পারে এবং শাক কম খেয়ে সবজিজাতীয় খাবার ও ফল খেতে পারে। হাড় ক্ষয়জনিত সমস্যার জন্য তাদের খাবারে দুধ রাখতে হবে। চিনি, তেলজাতীয় খাবার কম দিতে হবে। বয়স্কদের দৈনিক খাদ্য চাহিদা অনুযায়ী খাবার প্রদান করা প্রয়োজন (বয়স্কদের দৈনিক খাদ্য চাহিদা সারণি দ্রষ্টব্য)। পুষ্টি চাহিদা পেতে, বয়স্কদের খাদ্য পরিকল্পনাতে শর্করা জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে, আমিষ ও ফ্যাট পরিমিত গ্রহণ করতে হবে, তাদের নিয়মিত দুধ বা দুধজাতীয় খাবার ২৫০ মিলি., সপ্তাহে ১-২ টি ডিম, শাকসবজি ১০০ গ্রাম এবং বিভিন্ন ফল ১০০ গ্রাম গ্রহণ করতে হবে।
তাছাড়া পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি বয়স্কদের যাতে ভালো ঘুম হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘুমের জন্য আলো বাতাস যাতে প্রবেশ করে এমন রুমে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস ইত্যাদি রোগের ওসসঁহরুধঃরড়হ করতে হবে। তাদের চলাফেরা পথে তারা যেন কোনভাবে আঘাত না পায় সেজন্য পথের বাধা সরিয়ে ফেলতে হবে, যাতে ভালো করে দেখতে পায় তাই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, সমান আরামদায়ক জুতা দিতে হবে, সিঁড়ি দিয়ে ভালোভাবে উঠতে পারে তাই রেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্ব সহজে জ¦ালানোর জন্য নিচে সুইচ এর ব্যবস্থা ও সহজে যেন নিরাপদ পানি পান করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে এবং তৃতীয়ধাপে যখন তারা নিজের কাজ নিজে করতে পারে না তাদের জন্য ডাক্তার, সমাজকর্মী, মনোবিজ্ঞানী এদের তত্ত্বাবধানে গঠিত পুনর্বাসন এর ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও আমাদের দেশে তার চর্চা নেই। বয়স্করা সঙ্গ প্রিয়। অস্ট্রেলিয়ায় এক গবেষণায় ২০০ বৃদ্ধ লোকের উপর এই গবেষণা চালানো হয়, যাদের প্রত্যেকেরই ডায়াবেটিস, প্রেসার আছে। এখন ১০০ জনকে পরিবারের সাথে রাখা হয়েছে এবং ১০০ জনকে ওল্ডহোমে রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে যে যারা পরিবারের সাথে নাতিপুতিদের সাথে ছিল তাদের ডায়েবেটিস ও প্রেসার নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাই প্রবীণদের পরিবারের সাথে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য আগারগাঁওতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত আছে। বিন¤্র চিত্তে আমরা বয়স্কদের সম্মান দেখালে আমাদের সন্তানও আমাদের দেখে আমাদের থেকে উত্তম শিক্ষা নিবে। সবাই যেন বৃদ্ধ অবস্থায় সুন্দর সময় কাটাতে পারে, অবহেলিত না হয়। য়
লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারটান, আঞ্চলিক কার্যালয়, সিরাজগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭২৩৬৭২১৯২ ই-মেইল :turinbsmrau@gmail.com
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ
ও সম্ভাবনা
মুহাম্মদ শফিকুল হক আকন্দ
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে কৃষি। এদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৭ ভাগ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১) এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রায় ৪১ ভাগ জনশক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১)। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, মাটির উর্বরতা, সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, উৎপাদন সহায়তা, সেচ সম্প্রসারণ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি এগিয়ে চলছে এক দুর্বার গতিতে আর এজন্যেই এটি আজ বিশ্বের কাছে এক বিশয়। সমস্ত পৃথিবীতে বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে সপ্তম আর আম উৎপাদনে অষ্টম। উল্লেখ্য, দানাদার ফসল, ফল ও সবজি উৎপাদনের বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করতে পারলেও ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় মাত্র ১২ শতাংশ। তাই এখনই সময় ভোজ্যতেল উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার।
ভোজ্যতেলের প্রয়োজনীয়তা
মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম ফ্যাট বা চর্বি। এই ফ্যাট দেহের তাপশক্তি উৎপাদন, মস্তিষ্কের বিকাশ, বিভিন্ন হরমোনের উৎপাদন, চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় ভিটামিন শোষণ (এ,ডি,ই,কে) এবং ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। মূলত ফ্যাট দেহের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা ফ্যাট মানেই খারাপ, অস্বাস্থ্যকর। এ ধারণাটা ঠিক নয়। মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অপর দিকে, খারাপ ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাটজাতীয় খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো দেহের কোষের বিকাশ, কোলেস্টেরলের মাত্রা স্থিতিশীল রাখা এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। অ্যাভোকাডো, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ তেল (ক্যানোলা/সরিষা, জলপাই, চীনাবাদাম, তিলের তেল) মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের ভালো উৎস। অন্যদিকে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রধানত উদ্ভিজ্জ তেল (সূর্যমুখী, তিল, সয়াবিন, কর্নওয়েল) ও সামুদ্রিক মাছে পাওয়া যায়। এই ফ্যাট খাওয়ার ফলে এলডিএল (খউখ) কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। খারাপ ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাটজাতীয় খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই ফ্যাট খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএলের পরিমাণ বাড়ায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (ঐউখ) কমিয়ে দেয়। চর্বিযুক্ত মাংস, ক্রিম, বাটার, চিজ, পাম অয়েল, নারকেল তেল, ফ্রাই করা খাদ্যে এই ফ্যাট বেশি পাওয়া যায়।
ফ্যাট শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তাই ফ্যাটজাতীয় খাবারকে একেবারে বাদ না দিয়ে, ভালো ফ্যাট গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং খারাপ ফ্যাট বর্জনের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের ইতিহাস
বাংলাদেশে তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো সরিষা। এ ছাড়া দেশে সূর্যমুখী, তিল, চীনাবাদাম, তিসি, কুসুমফুল, সয়াবিন ইত্যাদি চাষাবাদ হয়ে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে দেশে উৎপাদিত সরিষার তেল দিয়েই ভোজ্যতেলের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ হতো এবং সরিষার তেল ছিল বাঙালির ঐতিহ্যের একটা অংশ। পরবর্তীতে আশির দশকে জাতিসংঘের রিলিফ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দেশে সয়াবিন তেলের ব্যবহার শুরু হয়। তাছাড়া দেশে উফশী বোরো ধানের আবাদ বাড়তে থাকায় সরিষার আবাদ কমতে থাকে। এ ছাড়াও, সরিষার তেলে বিদ্যমান ইরুসিক এসিড নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করা হয়। ফলে সরিষার তেল থেকে সরে গিয়ে মানুষ সয়াবিন তেলের দিকে বেশি ঝুঁকে পরে। প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেলে যে সমস্ত গুণাগুণ থাকা দরকার যেমন-সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগের নিচে থাকা, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের উপরে থাকা এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ এর অনুপাত ১:২ থাকা এগুলো সবই সরিষার তেলে বিদ্যমান রয়েছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি ও আবাদ পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসেবে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পামতেল এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়। এতে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের দেশে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী হতে প্রাপ্ত ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ মে. টন অর্থাৎ আমাদের দেশীয় চাহিদা দাঁড়ায় মোট ২৪ লাখ মে. টন। অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই এখনো আমদানি নির্ভর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৬.১০৬ হে: জমিতে ৮.২৪৩ লাখ মে.টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। অপরদিকে চীনাবাদাম ০.৯৫ লাখ হে: জমিতে ১.৭১ লাখ মে.টন, তিল ০.৬৫১ লাখ হে: জমিতে ০.৭৭১ লাখ মে.টন, সয়াবিন ০.৭৯১ লাখ হে: জমিতে ১.৪২২ লাখ মে.টন, সূর্যমুখী ০.০৯২ লাখ হে: জমিতে ০.১৬ লাখ মে.টন এবং অন্যান্য তেলজাতীয় ফসল ০.০১২ এবং ০.০১৪ লাখ মে.টন। যা থেকে দেখা যায় যে, সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তেলজাতীয় ফসল। বাংলাদেশে সয়াবিন ও বাদাম চাষ হলেও এ দুটো ফসল থেকে তেল নিষ্কাশন এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানোর জন্য সরিষার আবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত আশার কথা যে, বর্তমানে ভোজ্যতেল ব্যবহার নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ার ফলে সরিষার তেল জনপ্রিয় হচ্ছে এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনে পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো সঠিক পরিকল্পনামাফিক তেলজাতীয় ফসলের আবাদে সমম্বিত ব্যবস্থাপনার অভাব। বাংলাদেশের আবাদি জমির মাত্র শতকরা ৩ ভাগ জমিতে তেল ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে রোপা আমন চাষ না করার ফলে সময়মতো সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়াও মানসম্মত তেল ফসলের বীজের অপর্যাপ্ততা, বাদাম ও সয়াবিনের বীজ কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণের সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেলজাতীয় ফসলসমূহ আবহাওয়া, আর্দ্রতা, জলাবদ্ধতা এবং রোগবালাইয়ের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে দুর্বল অবকাঠামো ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদনের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। উক্ত সম্ভাবনাসমূহ বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সমম্বিত উদ্যোগ। এক্ষেত্রে রোপা আমন, সরিষা ও বোরো ধানের উচ্চফলনশীল এবং স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার, লবণাক্ততা সহনশীল সূর্যমুখী ও সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যমান বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করেও তেলজাতীয় ফসলের আবদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশে রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসের আওতায় প্রায় ২০ লাখ হে: জমি রয়েছে (সূত্র : ডিএই)। উক্ত শস্যবিন্যাসে স্বল্পজীবনকালের (১১০-১১৫ দিন) আমন মৌসুমে ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫ বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২২ দ্বারা চাষ করে সরিষার মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি জাত (৮০-৮৫ দিন) বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭ অথবা বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ চাষ করে পরবর্তীতে বোরো ধান চাষ করে সরিষার আবাদি এলাকা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ ছাড়া রোপা আমন-পতিত-আউশ এবং রোপা আমন-পতিত-পাট জমিতে বারি সরিষা-১৮ জাত অন্তর্ভুক্ত করে আবাদি এলাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরিষার ফলন অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় (যেমন- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম) সূর্যমুখী ও সয়াবিন, চর এলাকায় (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ) বাদাম, তিল, সূর্যমুখী ও সরিষা, হাওর এলাকায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সরিষা এবং পার্বত্য এলাকায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়ি) সরিষা, তিল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে উফশী বীজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া বর্তমান সরিষার জমিগুলোর প্রায় ৩০% জমিতে টরি-৭, মাঘী, ডুপিসহ অন্যান্য দেশী জাতের আবাদ হচ্ছে এগুলো কে বারি সরিষা ১৪, ১৭ ও ১৮, বিনাসরিষা- ৪, ৯ ও ১১ জাত দ্বারা স্থানীয় জাত প্রতিস্থাপন করার পাশাপাশি সুষম সার (বিশেষ করে বোরন, সালফার) ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি তেলজাতীয় ফসলের জমিতে মৌচাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্ভব।
বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছায় কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে, মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষিতে এক দুর্বার গতি সঞ্চারিত হয়েছে। যার ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় তিন বছরমেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফলে আগামী তিন বছরে দেশের ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমপক্ষে ৪০% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আসুন আমরা সকল স্তরের জনগণ সরকারের এহেন কার্যক্রমে সহায়তা করার মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে দেশের টাকা দেশেই রাখি, সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
লেখক : মনিটরিং অফিসার (অতিরিক্ত উপপরিচালক), তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১১১৮৫২৩২, ই-মেইল : shafiqdae@yahoo.com
উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ ও সয়াবিন চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. মো. আব্দুল মালেক
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও দৈনিক খাদ্য চাহিদার বিবেচনায় বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতার শিকার এবং এ অপুষ্টি বিভিন্ন মাত্রার আমিষ, ক্যালরি, ভিটামিন এবং খণিজ পদার্থের অভাবজনিত কারণে হয়ে থাকে। বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষ ও ক্যালরির ঘাটতি পূরণ এবং অপুষ্টি দূরীকরণে সয়াবিন গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ সারাবিশ্বে সয়াবিন তেল ফসল হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হলেও পুষ্টির সর্বোৎকৃষ্ট উৎস সয়াবিনে অত্যাবশ্যকীয় নয়টি এমাইনো এসিড সমৃদ্ধ উচ্চমানের ৪০-৪৪% আমিষ, ২৪-২৬% কার্বোহাইড্রেট ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ ১৮-২২% তেল বিদ্যমান। এছাড়াও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যথা ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ফসফরাস এবং ভিটামিন-এ, বি, সি, ডি ও ই এর উৎস। সয়াবিনে মানবদেহের মস্তিষ্ক বৃৃদ্ধিতে সহায়ক লেসিথিন এবং হৃদরোগ প্রতিরোধসহ রক্তনালীতে প্লাক তৈরিতে বাধাদানকারী ও ক্যান্সার প্রতিরোধী আইসোফ্লভেনস্ বিদ্যমান। সয়াবিনে বিদ্যমান দ্রবণীয় এবং অদ্রবনীয় ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন দূরীকরণেও ভূমিকা রাখে।
তাই উল্লিখিত পুষ্টিমানের বিবেচনায় এবং দেশের অপুষ্টি দূরীকরণে প্রয়োজন দেশে সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল সয়াবিনের জাত চাষ করা।
বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ জাতটি চলতি ২০২২ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি) কর্তৃক দেশের সয়াবিন চাষাধীন এলাকায় চাষাবাদের জন্য নিবন্ধিত হয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য: গাছ উচ্চতায় মাঝারি (৫০-৫৮ সেমি.), প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৪-৫টি, পাতা অন্যান্য জাতের তুলনায় গাঢ় সবুজ, প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৪৫-৬০টি, ১০০০ বীজের ওজন ১২-১৪ গ্রাম এবং বীজের রঙ উজ্জ্বল ক্রিম রঙের ও অন্যান্য জাতের বীজের তুলনায় উজ্জ্বল, বরি মৌসুমে জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন এবং খরিফ-২ মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন, প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ২.৬৫ টন এবং সর্বোচ্চ ফলন ৩.২০ টন। এছাড়াও জাতটি ভাইরাসজনিত হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ সহনশীল এবং পোকার আক্রমণ কম।
জমি নির্বাচন ও তৈরি
এ দেশের মাটি এবং আবহাওয়ায় সয়াবিন রবি ও খরিফ-২ মৌসুমে চাষ করা যায়। বেলে দো-আঁশ হতে দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। খরিফ-২ অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য হতে হবে। রবি মৌসুমে মাঝারি থেকে নিচু জমিতেও চাষ করা যায়। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী।
মাটির প্রকারভেদে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে এবং আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে সেচ প্রয়োগ, পানি নিষ্কাশন ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
বপনের সময় ও বীজের হার
রবি মৌসুমে পৌষের প্রথম থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির শেষ) পর্যন্ত এবং খরিফ-২ মৌসুমে মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য ভাদ্র (জুলাইয়ের প্রথম থেকে আগষ্টের শেষ) পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৫৫ কেজি (একর প্রতি ২২ কেজি) এবং ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৬০ কেজি (একর প্রতি ২৪ কেজি) বীজ প্রয়োজন।
বপন পদ্ধতি
সয়াবিন বীজ সারিতে বপন করা উত্তম, তবে ছিটিয়েও বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সেমি. বা ১২ ইঞ্চি দিতে হবে এবং খরিফ-২ মৌসুমে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩৫ সেমি. বা ১৪ ইঞ্চি দিতে হবে। সারিতে ১.০ - ২.০ ইঞ্চি গভীরে বীজ বপন করতে হবে। রবি মৌসুমে ছিটিয়ে বপন করলে চাষের পর বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে মাটি কাদাযুক্ত হলে বীজ ছিটিয়ে দিলেই হবে।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ
বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। সাধারণভাবে অনুমোদিত সারের মাত্রা সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : অনুমোদিত সারের মাত্রা (কেজি/হেক্টর)
জমিতে পচা গোবর অথবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে। রাসায়নিক সার শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে পরে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
জীবাণুসার প্রয়োগ ও ব্যবহার পদ্ধতি
সয়াবিন গাছ রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে গাছের শিকড়ে জমা করতে পারে। বপনের পূর্বে বীজে জীবাণুসার মিশিয়ে বপন করলে গাছের শিকড়ে নডিউল বা গুঁটি সহজে সৃষ্টি হয়। শিকড়ে সৃষ্ট গুঁটি থেকে গাছ নাইট্রোজেন পায়। উল্লেখ্য, জীবাণুসার প্রয়োগ করা হলে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
একটি পাত্রে এক কেজি পরিমাণ বীজ নিয়ে পরিষ্কার পানিতে হাত ভিজিয়ে ভিজা হাতে সয়াবিন বীজ নাড়াচাড়া করতে হবে, যাতে সকল বীজের উপরিভাগ ভিজে যায়। এক কেজি সয়াবিন বীজে ২০-৩০ গ্রাম চিটাগুড় বা ভাতের ঠা-া মাড় ভালোভাবে মেশানোর পর ৫০ গ্রাম জীবাণুসার মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে চিটাগুড় মিশ্রিত আঠালো বীজের গায়ে জীবাণুসার সমভাবে লেগে যায়। জীবাণুসার মেশানোর পর বীজ তাড়াতাড়ি বপন করতে হবে, কারণ জীবাণুসার পাউডার মেশানোর পর বীজ অনেকক্ষণ ফেলে রাখলে জীবাণুসারের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
আন্তঃপরিচর্যা
চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হওয়ার মধ্যেই নিড়ানি অথবা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। রবি মৌসুমে গাছে ফুলধরা এবং ফল বা শুঁটি ধরার সময় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ গজানোর ৫০-৫৫ দিন পর দিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে সাধারণত এ ফসলের জন্য কোন সেচের প্রয়োজন হয় না, বরং জমিতে পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
উচ্চফলনশীল বিনা সয়াবিন৭ ও সয়াবিন চাষাবাদে বিছাপোকা, কা-ের মাছি পোকা, কা- পচা রোগ, হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ প্রভৃতি বালাই আক্রমণ হতে পারে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দমন করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ
পরিপক্ব অবস্থায় সয়াবিন গাছ শুঁটিসহ হলুদ হয়ে আসলে এবং পাতা ঝরে গেলে মাটির উপর হতে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। শুঁটিসহ গাছ রোদে ৩-৪ দিন ভালভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। পরবর্তীতে ভালো করে শুকিয়ে ঠা-া করে বীজ গুদামজাত করতে হবে। উল্লেখ্য, সংরক্ষণের ২-৩ মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
মাড়াই করার পর বীজ বিশেষ যত্নসহকারে শুকাতে হবে। যদি রোদের উত্তাপ খুব প্রখর হয় তবে বীজ একটানা তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি রোদে শুকানো ঠিক নয়। কারণ কড়া রোদে অনেকক্ষণ ধরে বীজ শুকালে অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সয়াবিন বীজ সরাসরি সিমেন্টের তৈরি পাকা খোলায় না শুকিয়ে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে। বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে। শুকানো বীজ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে ‘কট’ শব্দ করে বীজ ভেঙে গেলে বুঝতে হবে যে বীজ ভালভাবে শুকিয়েছে।
শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং রোগাক্রান্ত পচা বীজ বেছে ফেলে দিতে হবে।
বীজ সংরক্ষণের পূর্বে এর অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
বীজ রাখার জন্য বায়োরোধী মোটা পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক বা টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসী, বিস্কুটের টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মোটা পলিথিনের ব্যাগে বীজ রেখে মুখ শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তা আবার একটি প্লাস্টিক বা চটের বস্তায় ভরে রাখলে ভালো হয়। তবে যে পাত্রই হোক প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। উল্লেখ্য, বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠা-া হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল: ০১৭১২-১০৬৬২০, ই-মেইল: malekbina@gmail.com
পাটচাষিদের সফলতা
কৃষিবিদ ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিগত ১৩ বছরের শাসনামলে প্রায় ১৪টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব উচ্চফলনশীল পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের জাত চাষাবাদ করে কৃষক বেশ লাভবান হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসল চাষাবাদকারী কৃষক/ উদ্যোক্তার সফলতা উপস্থাপন করা হলো।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বেনাপোল থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার আগে অবস্থিত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা। এ উপজেলার কৃষক মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। যদিও তিনি পাট চাষাবাদের সাথে পূর্বেই পরিচিত ছিলেন তবুও তিনি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজস্ব বাজেটের কর্মসূচির আওতায় পাট গবেষণা উপকেন্দ্র মণিরামপুর, যশোর-এর মাধ্যমে পাট চাষাবাদের উপর জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য পাট ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে মোঃ আবদুর রাজ্জাক বলেন “এ প্রশিক্ষণের আগে উচ্চফলনশীল পাট জাত, বীজ নির্বাচন, রোগ-কীটপতঙ্গ দমন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না এবং আমি সাধারণত ভারতীয় জাতের (জেআরও-৫২৪) পাটের বীজ ক্রয় করে সনাতন পদ্ধতি অনুসরণ করে ছিটিয়ে বীজ বপন করতাম। সে জন্য আমি আশানুযায়ী ফলন পেতাম না; তদুপরি আমি বিভিন্ন সমস্যা এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।
পাট গবেষণা উপকেন্দ্র মনিরামপুর, যশোর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তিনি গত বছর বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) এর বীজ এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে সারি করে বপন করেন।
এ প্রসঙ্গে মোঃ আবদুর রাজ্জাক বলেন “আমি এবং আমার পরিবার গত ৫০ বছর যাবত পাট চাষ করছি এবং আমি বা আমার বাবা বা দাদা কখনও পাট আঁশের এমন ফলন বা এমন উন্নত মানের আঁশ দেখতে পাইনি”।
এ জমি থেকে জনাব আবদুর রাজ্জাক ১৪ মণ পাটের আঁশ এবং প্রায় ৩৫ মণ পাট খড়ি পান। উৎপাদিত পাট বিক্রি করে উৎপাদন খরচ বাদে তাঁর ২৩০০০/- (তেইশ হাজার) টাকা লাভ হয়। একই পরিমাণ জমিতে ২০১৮-২০১৯ ইং অর্থবছরে ভারতীয় জাতের (মহারাষ্ট্র) পাটবীজ (জেআরও-৫২৪) বপন করে উৎপাদন খরচ বাদে তার ১৩৫০০/- (তের হাজার পাঁচ শত) টাকা লাভ হয়। বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের তোষা পাট, বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) চাষাবাদে এ অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য তিনি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনুরূপভাবে পাটের আবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জে কেনাফের আবাদ দিন দিন বেড়েই চলছে। এ দেশের পাটচাষিগণ দেশের বাইরের আমদানিকৃত বীজ দ্বারা পাট আবাদ করে প্রায়ই প্রতারিত হন। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-৯৫ জাতের কেনাফ বীজের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় পাটচাষিগণ দেশের বাহিরের বীজ বপন করে কম ফলন পান। কিন্তু এইচসি-৯৫ জাতের কেনাফ চাষ করে অনেক লাভবান হয়েছেন কৃষক মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক তিনি একজন পুরনো পাটচাষি। তিনি প্রায় ১২ বছর যাবত পাট চাষ করছেন। এক সময় তিনি প্রচুর পাটের আবাদ করতেন। মাঝে কয়েক বছর পাটের দাম কম পাওয়ায় আশাহত হন। বিগত ২-৩ বছর যাবৎ আবহাওয়া অনুকূল থাকায়, পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় এবং ঠিক সময় সার, গুণগত মানের বীজ বিশেষ করে পাট গবেষণার উচ্চফলনশীল এইচসি-৯৫ জাতের বীজ ব্যবহার করে সঠিক সময়ে আবাদ করে তিনি অনেক লাভবান হয়েছেন।
পাটচাষি মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘আমি এবার ১ (এক) একর জমিতে পাট গবেষণার কেনাফ বীজ এইচসি-৯৫ আবাদ করে ৩০ মণ আঁশ পেয়েছি, যা গড়ে ২,২০০/-(দুই হাজার দুই শত) টাকা মণ দরে বিক্রি করে মোট ৬৬,০০০/- (ছয়ষট্টি হাজার) টাকা এবং পাশাপাশি মোট ২৬,০০০/- (ছাব্বিশ হাজার) টাকার পাটকাঠিও বিক্রি করেছি’। কৃষক মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকের মতে, পাট চাষে বিশেষ করে কেনাফের জমিতে তেমন নিড়ি আর কীটনাশক প্রয়োগের খরচ নেই। জমি চাষ, সার, পাট কাটা, আঁশ সংগ্রহ করতেই যতটুকু খরচ। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ২২,০০০/- (বাইশ হাজার) টাকা খরচ হয়েছে যা পাটকাঠি বিক্রির টাকা দিয়েই পূরণ হয়েছে। এতে পাট বিক্রির পুরো টাকাই তার নিট আয়। এ বছর তিনি প্রায় ৭০,০০০/- (সত্তর হাজার) টাকা আয় করেন শুধু পাটজাতীয় আঁশ ফসল কেনাফ চাষ করে।
পাট গাছ জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। পাট ফসল চাষের পর ওই জমিতে অন্য ফসল আবাদ করলে সার দিতে হয় কম এবং জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তার মতে, জমির শস্যবিন্যাসে অবশ্যই পাট/পাট জাতীয় আঁশ ফসলকে রাখা উচিত। সফল পাটচাষি মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকের সাফল্য দেখে অনেকেই পাট চাষে বিশেষ করে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত এইচসি-৯৫ আবাদে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মোঃ আবু বক্কর পাট বিক্রি করে ছেলে মেয়ের পড়াশোনা এবং সাংসারিক ব্যয় মিটান। এলাকায় কেনাফ চাষ প্রসঙ্গে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জনাব মোঃ কামালউদ্দিন জানান, দেহুন্দা ইউনিয়নে কয়েক শতাধিক একর জমিতে কেনাফের জাত এইচসি-৯৫ এর আবাদ হয়। কৃষকরা খুবই ভালো ফলন পান এবং রোগবালাইও কম হয়। সফল পাটচাষি মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক তাঁর সফলতার জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সারাদেশে বিজেআরআই উদ্ভাবিত জাতসমূহের সম্প্রসারণ ও বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক লাভবান হবেন এবং পাটের সোনালি আঁশের সুদিন আবার ফিরে আসবে বলে বিশ্বাস করেন মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকের মতো সফল পাট চাষিরা।
চা-এর বিকল্প রোজেলি ড্রিংক্স উৎপাদনে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর-এ অর্থনীতি বিভাগের তরুণ উদ্যোক্তা ০৩ জন শিক্ষার্থী। রিফাত শাহরিয়ার, আল মোতহাসিম বিল্লাহ এবং মাহমুদুর রহমান স্নাতক শেষ শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়নকালীন সময়ে চাকরি না করে নতুন কোন জিনিস নিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন। একাজে প্রথমেই সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, রংপুর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আবুল ফজল মোল্লা। তিনি মেস্তার চাষাবাদে পরামর্শ দেন এবং কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করেন। মেস্তার ক্যালিক্স উৎপাদন প্রকল্পের সফলতা প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় প্রথমে ৪ (চার) বিঘা জমির উপর, এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। এখান থেকে মেস্তার ৩.৫০ টন কাঁচা ক্যালিক্স সংগ্রহ করেন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের পর যা থেকে ৩২০ কেজি শুকনা ক্যালিক্স পাওয়া যায় যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা।
তারা আরো বলেন, আমাদের দেশে এ পানীয় নতুন হওয়ায় মানুষের কাছে এর পরিচিতি কম, যার ফলে তারা প্রথমে একটু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তবে আশাবাদী, সরকারি সহযোগিতা পেলে এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা থাকলে খুব শীঘ্রই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন। মেস্তার এই ক্যালিক্স দিয়ে চা সদৃশ পানীয় ছাড়াও আচার, জ্যাম, চাটনি, জুস, বার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব। রোজেলি ড্রিংক্স যেমন- মূল্যবান তেমনি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এ পানীয় পানে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, শরীরে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এ পানীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ রোজেলি ড্রিংক্স পিরিয়ডের ব্যথা প্রশমন করে। রোজেলি ড্রিংক্স নিয়ে অল্প কিছুদিন কাজ করেই তারা বেশ সফলতা পেয়েছেন। ইয়ং বাংলা আয়োজিত স্টুডেন্ট টু স্টার্ট অফ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে ২২৫০টি টিমের মধ্যে তারা রানারআপ হয়েছেন।
আমাদের দেশে চা এর বিকল্প এ ড্রিংক্স নতুন হলেও বিভিন্ন দেশে পূর্ব থেকেই এর প্রচলন আছে। তাই আমরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রোজেলি ড্রিংক্স তৈরির উপকরণ বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য উদ্যোক্তাগণ বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কেন্দ্র, রংপুর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পাট একটি কৃষি পণ্য এবং এটি একই সাথে একটি শিল্প পণ্য, যা পরিবেশবান্ধব। তাই আমাদের দেশে পাট চাষিদের নিট আয় এবং পাট আঁশের নিট উৎপাদন উভয়ই বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১), উচ্চফলনশীল জাতের কেনাফ এইচসি-৯৫ এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ মেস্তার জাত বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১)-এর চাষাবাদ সম্প্রসারণ করার অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে বলে বিজেআরআই-এর বিজ্ঞানীগণ বিশ^াস করেন।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫,
ই-মেইল : norshedbjri@gmail.com
কবিতা
উন্নত জীবন নিশ্চিত হয়
মোছলেহ উদ্দিন সিদ্দিকী
কোন এক কালে...
কুয়াশার কাকভোরে লাঙল জোয়াল কাঁধে
ছিল কৃষকের পথ চলা;
পশুর পেশির বলে, লাঙলের ফলা ঠেলে
হতো চাষ- বারো মাস।
সনাতন চাষে, রাজার কি যায় আসে
কৃষকের হতো সর্বনাশ।
শ্রম দিয়েছে যতো, ফলন হতোনা ততো
শোষণের দ- অবারিত;
দারিদ্র্য অপুষ্টি ছিল নিয়তির পরিহাস।
একদিন তাই...
শেকল ভাঙ্গার গর্জনে উঁচু তর্জনীর ইশারায়,
আমাদের স্বাধীনতা এলো
এক রক্তগঙ্গা পাড়ি দিয়ে বাংলার আঙিনায়।
তারপর কেটে যায় কাল...
কালের কলস ভাঙে আকালের রাত আসে।
পিশাচ মৃদঙ্গ বাজায়
অন্ধকারে নিমজ্জিত কৃষক
জাতির পিতা হারাবার দুঃসহ বেদনায়।
দারিদ্র্য অপুষ্টি অসচ্ছলতা নিত্যসাথী হয়
তার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে জরাজীর্ণতার অন্ধকার।
ভোর হয়...
আবারো ভোর হয়
আলো ফোটে পূর্ব দিগন্তে
দুঃস্বপ্নের কালো ছায়া আলোর স্পর্শে নিপতিত
স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ে
তাঁরই সুযোগ্য কন্যার হাত;
কী মায়ার বলয়ে আগলে রাখে আমাদেরে
প্রশান্তির ¯িœগ্ধতায়।
পরিবর্তনের ডালি সাজায় কৃষক
হাল চাষে কলের লাঙল।
রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারে চারা রোপণ।
সেচে-সারে সুষম ব্যবস্থাপনা
বালাইনাশকের নাই দাপট
পরিবেশবান্ধব কৃষি- নির্মল প্রকৃতি
উন্নত প্রযুক্তি হাতের মুঠোয়।
খোরাকি কৃষি বদলে যায়
বাণিজ্যিক কৃষির দুর্দান্ত প্রতাপে।
হার্ভেস্টারে ঘরে উঠে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন
সমলয়ের স্বপ্নীল একতায়।
আমাদের ডিজিটাল বাংলায়।
গোলায় শস্যের সমারোহ
উঠুনের কোণে সবজি আবাদ
পুকুরে বিলে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ
হাঁসের পাল চড়ে হাওরের বুকে
পোল্ট্রিশিল্পে, দুগ্ধ খামারে এগিয়েছে দেশ
গবাদিপশুর পাল ধুলোয় উড়িয়ে আসে পড়ন্ত বিকেলে।
রপ্তানি আয় বাড়ে
ফল-সবজি মাছের পসরায়
বিশ^ বাজারে আমরাও আছি
বলিষ্ঠ পদচারণায়।
কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়
ভাল উৎপাদনে, উত্তম পুষ্টিতে,
সুরক্ষিত পরিবেশে
উন্নত জীবন,
আজ নিশ্চিত হয়।
লেখক : ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৫৫৬৩৩২৯৬৯ ই-মেইল:smoslahuddin@yahoo.com
পৌষ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
বোরো ধান
বোরো মৌসুমে ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৬, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বঙ্গবন্ধু ধান ১০০, ব্রি ধান১০১, ব্রি ধান১০২, বিনা ধান ১০, বিনা ধান ১৪, বিনা ধান ২৪ ও অনুমোদিত হাইব্রিড ধান আবাদ করুন।
রাাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চাষের জন্য ট্রেতে চারা তৈরি করুন।
অতিরিক্ত ঠা-ার সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখুন এবং বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিন।
প্রতিদিন সকালে চারার উপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিন।
চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিন।
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করুন, লাভবান হোন।
চারা রোপণে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করুন। সময় ও খরচ উভয়ই বাঁচান।
চারার বয়স ২৫-৩০ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ করুন।
গম
চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে প্রথম সেচ দিন।
একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে এবং
বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে উইডার দিয়ে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করুন।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিন।
গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিন।
গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিন।
আলু
চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর মাটি তোলার সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন।
নাবি ধসা রোগ থেকে আলু রক্ষার্থে নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে ডায়থেন এম ৪৫ অথবা হেম্যানকোজেব অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ¯েপ্র করুন।
গাছে রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ৭ দিন পরপর সিকিউর অথবা অ্যাক্রোভেট এম জেড ২ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ রাখুন ।
তুলা
তুলা পরিপক্ব হলে রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা সংগ্রহ করুন।
ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন।
ডাল ও তেল ফসল
সরিষা, তিসি এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিন।
ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করুন।
শাকসবজি
লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক একবার শেষ হয়ে গেলে আবার বীজ বুনে দিন।
শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক নিয়মিত সেচ দিন।
বিবিধ
অধিক লাভবান হতে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন ।
স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।
লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : manzur_1980@yahoo.com
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: আল ইমরান, উপজেলা- সাঘাটা, জেলা- গাইবান্ধা
প্রশ্ন : শিমের পচন রোগ হলে করণীয় কী?
উত্তর : রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট-২৫০ ইসি অথবা ডাইথেন এম-৪৫, ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
আনোয়ার, উপজেলা- কটিয়াদী, জেলা- কিশোরগঞ্জ
প্রশ্ন : পেঁপে গাছের পাতার উপর হলুদ ও গায় সবুজ রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। করণীয় কী?
উত্তর : পেঁপের মোজাইক ভাইরাস, ভাইরাসের বাহক জাবপোকা বালাইনাশক দ্বারা দমন করা। যেমন- সানপ্রোজিন-০৫ গ্রাম, ডাইমেথয়েট (০২%)।
ওসমান গনি, উপজেলা- শিবগঞ্জ, জেলা- বগুড়া
প্রশ্ন : আলু বীজ কিভাবে শোধন করতে হয়?
উত্তর : আলু বীজকে মারফিউরিক ক্লোরাইড ২ লিটার পানিতে ১ গ্রাম নিয়ে ১২ ঘণ্টা ডুরিয়ে নিলে ভাল হয়। এছাড়া ভিটাভেক্স ২০০ ১ লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম মিশিয়ে আলু ধুয়ে নেয়া যায়। এরপর ছায়ায় শুকিয়ে বীজ বপন করতে হবে।
মিজানুর রহমান, উপজেলা- রাজাপুর, জেলা- ঝালকাঠী
প্রশ্ন : ধান বীজ সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থাপনা কী?
উত্তর : ৮০% ধান পাকার পরেই একদিনে কেটে মাড়াই করে ৩/৪ দিন রোদে শুকাতে হবে। ছায়ায় ঠা-া করতে হবে ১২% আর্দ্রতায় আসলে। বায়ুরোধক পলিথিন এ বেঁধে ফেলতে হবে। শুকনো নিমপাতা দিয়ে ছালার বস্তায় সংরক্ষণ করতে হবে। শুকনো ছাই/শুকনো তুঁত কৌটার মধ্যে পাতলা কাপড়ে বেঁধে ধান বীজ রাখার পাত্রের মধ্যে পাত্রের মুখে দিয়ে সিল করতে হবে।
সুফিয়া রহমান, উপজেলা- বোদা, জেলা- পঞ্চগড়
প্রশ্ন : লবণাক্ততা কীভাবে কমাতে পারি?
উত্তর : ধান চাষ করলে সবসময় পানি ধরে রাখতে হবে। মিষ্টি পানি সংরক্ষণ/আটকে রাখতে হবে। জিপসাম সার ১০-১২ কেজি/ বিঘা প্রয়োগ করলে লবণাক্ততা দূর হয়। এছাড়া সবুজ সার চাষ করে মিশিয়ে দিলে অথবা সর্জান পদ্ধতিতে ফসল চাষ করে।
রায়হান কবির, উপজেলা- বাগেরহাট, জেলা- বাগেরহাট
প্রশ্ন : ধানক্ষেতে বাদামি গাছফড়িং প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তর : ২-৩ হাত পরপর বিলিকেটে জমিতে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে। লাইন ও লগো পদ্ধতিতে ধান লাগাতে হবে। ক্ষেতে উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণ (বোলতা, মাকড়সা/লেডি বার্ড বিটেল) করতে হবে। পাইমেট্রোজিন গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
মারজান, উপজেলা- রাণীসংকৈল, জেলা- ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : টমেটোর পাতা কুঁকড়ে গেছে। সমস্যা কী?
উত্তর : সাদা মাছি দ্বারা ভাইরাস ছড়ায়। আক্রান্ত গাছ ছোট হয়ে থাকে। গাছে ছাই ছিটিয়ে দেয়া। এমিডাক্লোরাপিড গ্রুপের কীটনাশক (০.২৫ মিলি/লি.) পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার ব্যবহার করা যেতে পারে।
কৃষক : মো: মুস্তাকিন, যশোর সদর, যশোর
প্রশ্ন : নারিকেলের ফল ঝরে যায়, করণীয় কি?
উত্তর : বোরণ ও পটাশ সার দিতে হবে, অতিরিক্ত রস পুষ্টির অভাবে হয় ঝরে যেতে পারে। গাছের গোড়ায় সুষম মাত্রায় সার দিতে হবে। মাকড়নাশক ব্যবহার করতে হবে। ১০ লিটার পানিতে ২৫/৩০ গ্রাম ওমাইট মিশিয়ে ফুট পাম্পের সাহায্যে ফল ও গাছের পাতা ১০-১৫ দিন অন্তর তিনবার ভিজিয়ে দিতে হবে।
কৃষক : মো: শামিম, উপজেলা- গোদাগাড়ি, জেলা- রাজশাহী
প্রশ্ন : করলার পাতায় ছোট ছোট হলুদ এবং পাতার নিচে গোলাপী ছত্রাক দেখা যায়, করণীয় কী?
উত্তর : গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করা, গাছের রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১-২ গ্রাম মিকিউর বা মেনকোজেব ২ গ্রাম ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
কৃষক : মো: শফিকুল ইসলাম, উপজেলা- কুমিল্লা সদর, জেলা- কুমিল্লা
প্রশ্ন : ধানের পাতার সবুজ অংশ মুড়িয়ে খেয়ে ফেলে, করণীয় কী?
উত্তর : জমির পাশে আলোর ফাঁদ এবং জমিতে পার্চিং করতে হবে। শতকরা ২৫ ভাগ পাতা আক্রান্ত হলে, হেক্টরপ্রতি ম্যালাথিয়ন ১.১২ লি:, সুমিথিয়ন ১.০ লি:, ডাইমেথোয়েট ১.১২ লি:, কারবারিল ১.৭০ কেজি ব্যবহার করতে হবে।
কৃষক : মো: রিপন, উপজেলা- সাতক্ষীরা সদর, জেলা- সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : সরিষা চাষের জন্য ভালো জাতগুলোর নাম কী?
উত্তর : সরিষার জীবনকাল ৮৫-৯০ দিন। জমি থেকে আমন ধান কাটার পর আগাম সরিষা করা যায়। ভালো জাতগুলো বারি সরিষা ১৪, বারি সরিষা ১৭, বারি সরিষা ১৮ এবং বিনা সরিষা ৪, বিনা সরিষা ৯ এই জাতগুলো চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
কৃষক : মো: আবু সাঈদ, উপজেলা- পলাশবাড়ি, জেলা- গাইবান্ধা
প্রশ্ন : কলার পাতায় বড় দাগ সৃষ্টি করে ফলে পাতা পুড়ে যায়, করণীয় কী?
উত্তর : আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি প্রোপিকোনাজাল (টিল্ট-২৫০ ইসি) মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৪১০৪৮৫৩; ই-মেইল: iopp@ais.gov.bd
মাঘ মাসের কৃষি
(১৫ জানুয়ারি-১৩ ফেব্রুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
মাঘ মাস। হাড় কাঁপানো শীতের আভাস। কথায় আছে মাঘের শীত নাকি বাঘকেও হার মানায়। জলবায়ু পরিবর্তনে তীব্র শীতের মাঝেও খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যস্ত থাকে কৃষিজীবী ভাইবোনেরা। কেননা এ মাস বোরো মৌসুমের পাশাপাশি কৃষির ব্যস্ততম সময় তাই আসুন আমরা জেনে নেই মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো।
বোরো ধান
ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বোরো ধানে নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছা দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা, আলোর ফাঁদ এসবের মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এভাবে রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে তা পাতলা করে দিতে হবে। গম গাছ থেকে যদি শিষ বেড় হয় বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হয় তবে জরুরিভাবে গমক্ষেতে একটি সেচ দিতে হবে। এতে গমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দিতে হবে। গম ক্ষেতে ইঁদুর দমনের কাজটি সকলে মিলে একসাথে করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে এসময় ভুট্টা ফসলে আর্মিওয়ার্ম, ফল আর্মিওয়ার্ম ইত্যাদি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ থেকে লার্ভাগুলো হাত দ্বারা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে স্পেনোসেড (ট্রেসার ৪৫এসসি@ ০.৪ মিলি./ লিটার) বা এবামেকটিন বেনজোয়েট ( প্রোক্লেম ৫ এসজি বা সাহাম ৫ এসজি @ ১ গ্রাম/ লিটার) বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
আলু
আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে ¯েপ্রয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম এক্সট্রামিল অথবা ডাইথেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা মেলুডি ডুও প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে নিয়মিত ¯েপ্র করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে। আলু গাছের বয়স ৮০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। খুব সহজে ও কম খরচে আলু উত্তোলন করতে পটেটো ডিগার যন্ত্র ব্যবহার করুন। ক্ষতির হার ১% এর নিচে এবং শ্রমিক ৫০% সাশ্রয় হয়। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
তুলা সংগ্রহের কাজ এ মাস থেকেই শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়। ভালো তুলার সাথে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনো না মেশে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে বস্তায় ভরে মাচা বা দানেস এর উপর সংরক্ষণ করতে হবে। ইঁদুর নষ্ট করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি এ সময় পাকে। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমির উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে। এ সময় চর অঞ্চলে পেঁয়াজের সাথে বিলে ফসল হিসেবে বাদাম চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
বেশি ফলন পেতে শীতকালীন শাকসবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে জৈবসার, জৈব বালাইনাশক, ফেরোমন ফাঁদ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাই দমন করতে হবে। শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে।
গাছপালা
শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত এ সময় আমগাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ১ মিলি কন্জা প্লাস অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এসময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
শীতকালে পোল্ট্রিতে অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব সমস্যা দেখা যায়। মোরগ-মুরগীর অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড সরবরাহ করতে হবে। শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোল্ট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পোল্ট্রি লিটারে অ্যামোনিয়া গ্যাস রোধে ১ বর্গফুট জায়গায় ১ কেজি হারে অ্যামোনিল পাউডার মিশাতে হবে। গোখামারে শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। নাহলে গাভীগুলো তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে।
মৎস্যসম্পদ
পুকুরে পানি কমে দূষিত হয়ে যায় বলে শীতকালে মাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কার্প ও শিংজাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ দেখা দেয়। মাছের ক্ষতরোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পরপর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। মাছ চাষ বিষয়ে যে কোন পরামর্শের জন্য কাছের উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, অত্যন্ত সংক্ষেপে মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো। আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের গ্রহণযোগ্যতার সমন্বয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই। কৃষির যে কোনো সমস্যায় উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, editor@ais.gov.bd