সম্পাদকীয়
ভাদ্র মাস। এ সময় প্রকৃতিতে কখনো অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম। সে সাথে পাকা তালের মোহনীয় গন্ধ জানান দেয় এটা ভাদ্র মাস। বাংলাদেশে তালের প্রাচুর্য ও জনপ্রিয়তার কারণে রচিত হয়েছে প্রবাদসহ বিভিন্ন রচনাবলী। ‘ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না’ বলে বাঙালি সমাজে প্রবাদ রয়েছে। প্রিয় পাঠক ভাদ্র মাসে তাল গ্রহণের আমন্ত্রণ রইল।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন। এই রূপকল্পসহ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারি বেসরকারি ও অংশীজনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফসলের পাশাপাশি দেশীয় ফল, কফি, কাজুবাদাম, ড্রাগনফলসহ বিদেশী ও অপ্রচলিত ফলের উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছর। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয়; চাল উৎপাদনে তৃতীয়; জামসহ বেরী জাতীয় ফল ও সুগন্ধি মসলা উৎপাদনে চতুর্থ; মসুর ডাল ও গ্রীষ্মম-লীয় ফল (কাঁঠাল, লিচু) উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারিকেল ছোবড়া উৎপাদনে সপ্তম; চা ও কুমড়া উৎপাদনে অষ্টম; আম, পেয়ারা ফুলকপি, ব্রকলি, মটরশুঁটি উৎপাদনে নবম অবস্থানে উঠে এসেছে।
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য দেশের মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ। টেকসই ও লাভজনক কৃষি ব্যবস্থায় টেকসই পরিবেশ প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্ত বিরূপ প্রভাব আমাদের দেশে দৃশ্যমান। জলবায়ু পরিবর্তনসহ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেক উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অটল। ৫ জুন ২০২৩ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি সবাইকে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান। সেক্ষেত্রে অন্যান্য বৃক্ষের মতো প্রকৃতির আশীর্বাদ তালগাছকে লাগানো যেতে পারে। দেশে তালগাছ কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিতেও আসছে বজ্রপাতের বিড়ম্বনা। বাড়ছে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা। এ সম্পর্কে কৃষিকথায় এবারের সংখ্যায় ‘নিরাপদে তালগাছ ও তালের গুড় উৎপাদন প্রযুক্তি’ এবং ‘পরিবেশ সুরক্ষায় তালগাছ’ নিবন্ধ দুটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি, পুষ্টিবার্তা, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প এবং মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা। আশা করি, কৃষিকথা জনসাধারণের দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করবে।
৮৩তম বর্ষ ড় ৫ম সংখ্যা ড় ভাদ্র-১৪৩০ (আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২৩)
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
নিরাপদে তালগাছ ও তালের গুড় উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি ০৩
ড. মো. ওমর আলী, ড. মোছা. কোহিনুর বেগম
কৃষি পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ ০৫
ডঃ মনসুর আলম খান
পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ০৭
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
চরাঞ্চলে মিশ্র ফসল হিসেবে মসলার চাষাবাদ ০৯
ড. মো. আলাউদ্দিন খান, ড. মো. শহিদুল আলম, মো. মুশফিকুর রহমান
কৃষিপণ্য থেকে নিরাপদ ফ্রাইড চিপ্স তৈরির ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং প্রযুক্তি ১২
ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, মো: হাফিজুল হক খান
ব্লাক সোলজার ফ্লাই সম্ভাবনাময় শিল্প ১৪
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন
জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা ১৬
ড. রিপন সিকদার
পাহাড়ের জুমে সমভূমি তুলা (কার্পাস) আবাদ ও ফলন বৃদ্ধির কৌশল ১৯
সুবীর কুমার বিশ্বাস
আগামীর কৃষি ভাবনা
পরিবেশ সুরক্ষায় তালগাছ ২১
মৃত্যুঞ্জয় রায়
বাউ সালাদ কচু সালাদ পরিবারে নতুন সদস্য ২২
ড. এম এ রহিম, ড.সুফিয়া বেগম
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য সেক্টরের অবদান ২৩
মোঃ মাসুদ রানা (পলাশ)
গুড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি প্রাকটিস ও স্মার্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে প্রাণিজাত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ২৫
কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমান
সফল কৃষকের গল্প
দেশেই উৎপাদন হচ্ছে বিদেশী ফল স্ট্রবেরি ও ড্রাগন ২৭
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম
নিয়মিত বিভাগ
প্রশ্নোত্তর ২৯
কৃষিবিদ আয়েশা সুলতানা
আশি^ন মাসের কৃষি (১৬ সেপ্টেম্বর- ১৬ অক্টোবর) ৩০
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
নিরাপদে তালগাছ ও তালের গুড় উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি
ড. মো. ওমর আলী১ ড. মোছা. কোহিনুর বেগম২
তাল ইড়ৎধংংঁং গণের একটি প্রজাতি। এর প্রজাতিগত নাম ইড়ৎধংংঁং ভষধনবষষরভবৎ বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশি তালগাছ দেখা যায়। তবে বৃহত্তর ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি এই গাছ দেখা যায়। তাল এর পরিকল্পিত রোপণ ও ব্যবহার করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। তাল মরু এলাকার গাছ বিধায় বাংলাদেশের সকল এলাকায় অযত্ন অবহেলায় জন্মে থাকে। এ গাছ পানি ছাড়াই দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়ালেও সহজে মারা যায় না। তাই তাল বৃহত্তর রাজশাহী জেলার বরেন্দ্র এলাকা হতে ঝড়-ঝঞ্চা-লবণাক্তপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সকল অঞ্চলে উৎপাদন ও ব্যবহার হয়।
অপার সম্ভাবনাময়ী তালগাছের গুরুত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
কচি তালশাঁস সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। পাকাতালের রস পিঠা, পায়েস, জ্যাম জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর এ সমস্ত খাদ্যদ্রব্য বেশ উপাদেয় ও মজাদার বিধায় সকলেই কমবেশি পছন্দ করে। তালগাছের কা- ছাদ, দেওয়াল, বেড়া এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ডোঙ্গা, নৌকা এবং বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প তৈরিতেও এর ট্রাঙ্ক ব্যবহৃত হয়। তালের পাতা থেকে শক্তিশালী এবং বহুমুখী আঁশ পাওয়া যায়; যা দিয়ে ম্যাট, দড়ি, টুপি এবং আরো অনেক ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প তৈরি হয়। তালগাছের বিভিন্ন অংশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তালের রসে শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি, বদহজম সারানোর গুণও উপস্থিত আছে। এর পাতা, শিকড় এবং বাকলেও অনেক ওষধি গুণাগুণ উপস্থিত আছে রয়েছে।
তালগাছ শুষ্ক ও অর্ধশুষ্ক এলাকায়ও ভালো জন্মায় এবং বৈরী আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। এটা মাটির ক্ষয়রোধ, পানি ধরে রাখতে এবং বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত ভারসাম্য (ঊপড়ষড়মরপধষ নধষধহপব) বজায় রাখে। এই গাছ উঁচু এবং এর পাতার অগ্রভাগ সুচালো হওয়ায় এটি বজ্রনিরোধক হিসেবে কাজ করে। এজন্য হাওর, বাঁওড় এলাকায় তালগাছের গুরুত্ব খুব বেশি।
উচ্চ মাত্রার চিনি বিশেষ করে সুক্রোজ বিদ্যমান থাকায় তালের রস থেকে ইথানল তৈরির সম্ভাবনা প্রচুর। এটি নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব জৈব জ্বালানি। এটা জীবাষ্ম জ্বালানির উত্তম পরিপূরক হতে পারে; যা গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিংস্বরন কমাতে পারে।
ইথানল তৈরির জন্য কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এটা একটা দেশের উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তালের রস থেকে প্রস্তুতকৃত ইথানল রন্ধনকাজে, আলো জ্বালাতে এবং পরিবহনে ব্যবহৃত হতে পারে। এটা ওষুধ প্রস্তুতিতে, রাসায়নিকে দ্রব্য হিসেবে এবং অ্যালকোহোলিক পানীয় হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
নিরাপদ তালগাছ উৎপাদন প্রযুক্তি
সরাসরি তালের বীজ মাটিতে লাগালে তা থেকে চারা তৈরির সম্ভাবনা কম থাকে। চারা তৈরি করে কাক্সিক্ষত জায়গায় লাগালে শতভাগ সম্ভাবনা থাকে। তালের চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল।
উত্তম মাতৃগাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পরিপক্ব তাল হতে বীজ সংগ্রহ করে পাকা তালের উপরের শক্ত খোসা ছাড়িয়ে কিছু সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং পরে হাত দ্বারা কচলিয়ে আঁশ হতে রস বের করতে হবে। পরিপক্ব তাল বীজের অংকুরোদগমের হার সাধারণত ৭০-১০০ ভাগ।
পাকা মেঝে বা ইট বিছানো মেঝেতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। তবে মাটির উপরও সরাসরি বীজতলা করা যেতে পারে। মাটির উপর বীজতলা করতে হলে মাটির উপর মোটা পলিথিন শিট বিছিয়ে দিয়ে তার উপর ৩০-৫০ সেমি: পুরু করে বেলে মাটি বা কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি বিছিয়ে দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজ পাশাপাশি রেখে বীজতলার উপর সারি করে সাজাতে হবে এবং বীজের উপর ২-৩ সেমি: পুরু করে কম্পোস্ট মিশ্রিত বালি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। বীজতলা সব সময় পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই বীজ অংকুরিত হতে শুরু করবে। বীজ অংকুরোদগমের সময় শিকড়ের মত দেখতে টিউবের আকৃতিতে বীজপত্র বের হয়। যাকে জর্মিটিউম বলা হয়।
১০-১৫ সপ্তাহের মধ্যে ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব এর উপরে একটি পাতলা আবরণীতে পরিণত হয়। এ সময় চারায় একটি ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব ও শিকড় থাকে। চারার গোড়া ও শিকড়ের গা হতে ছোট ছোট অনু শিকড়ও গজাতে শুরু করে। ঈড়ষবড়ঢ়ঃরষব এর বৃদ্ধি শেষ হলে অর্থাৎ বীজের সাথে জার্মটিউবের সংযোগ স্থানে পচতে বা শুকাতে শুরু করলে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
বীজতলায় উৎপাদিত চারা গোবর/কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পলিব্যাগের আকার ১৫দ্ধ২৫ সেমি. এবং পলিথিনের পুরুত্ব ০.০৬/০.০৭ মিমি. হতে পারে। প্রতিটি পলিব্যাগের নিচে ২/৩ টি ছিদ্র করতে হবে।
চারা পলিব্যাগে স্থানান্তরকালে বেলে মাটি/কম্পোস্ট সরিয়ে চারা উন্মুক্ত করতে হবে এবং বীজ হতে চারা আলাদা করতে হবে। বীজ হতে চারা আলাদা করতে হলে জার্মটিউবের উপরে অর্থাৎ বীজসংলগ্ন চিকন, পচা/শুকনা স্থানে কাটতে হবে। যদি চারার শিকড় বেশি লম্বা হয় তবে প্রয়োজনে চারার সাথে ১০-১৫ সেমি. শিকড় রেখে ধারালো চাকু দ্বারা কাটতে হবে। পলিব্যাগের ২/৩ অংশ গোবর/কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি দ্বারা ভরতে হবে। একটি চারা পলিব্যাগে এমনভাবে রাখতে হবে যেন চারার গোড়া প্রায় ৫-৬ সেমি: ব্যাগের মধ্যে থাকে। চারা পলিব্যাগে বসানোর পর ব্যাগের খালি অংশ গোবর/কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটি ভরতে হবে। পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরের পর কমপক্ষে ২-৩ সপ্তাহ ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে প্রয়োজনে সেচ দিয়ে পলিব্যাগের মাটি আর্দ্র রাখতে হবে। জুন-জুলাই মাসের মধ্যে ৩০-৫০ সেমি. লস্বা দুই পাতার চারা পলিব্যাগে পাওয়া যাবে।
মৌসুমী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সেমি. লম্বা দু’ পাতা বিশিষ্ট চারা মূল জমিতে রোপণ করা যায়। তবে মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে বা সেচ সুবিধা থাকলে চারা মে মাসেও রোপণ করা যায়।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর শারীরতত্ত্ব ও চিনি রসায়ন বিভাগ তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে বিগত তিন বছর ধরে লক্ষাধিক চারা উৎপাদন করে যাচ্ছে।
তালগাছ থেকে নিরাপদে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি আধুনিক প্রযুক্তি
তাল গাছের পুষ্পমঞ্জরি থেকে সংগৃহীত রস থেকে গুড়, তালমিশ্রি তৈরি করা হয়। সাধারণত ১০-১২ বছর বয়সের পুরুষ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে (চৈত্রের ২য় সপ্তাহ) পুরুষ তালের পুষ্পমঞ্জরি বেড় হয়। নরম পুষ্পমঞ্জরিকে প্রথম তিনদিন প্রতিদিন আধাঘণ্টা এক হাতে ধরে অপর হাতের তালুর চাপের মাধ্যমে উপর থেকে নীচে সকালে ও বিকালে প্রায় ৪০/৪৫ বার হালকাভাবে টানতে হবে। কোনভাবেই জোড়ে আঘাত করা যাবে না। পুষ্পমঞ্জরি একটু শক্ত হলে পুষ্পমঞ্জরির দুই পাশে ২টি বাশের বাতা দিয়ে উপর থেকে নীচে ২/৩ দিন সকাল ও বিকেলে ২০/২৫ বার টানতে হবে। এরপর পুষ্পমঞ্জরির শেষ প্রান্তে ধারালো দা দিয়ে সোজা করে কাটতে হবে । কাটা অংশ দিয়ে মিষ্টি রস ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকে। মার্চ থেকে মধ্য জুলাই (আষাঢ় মাস) পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যাবে। পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ তালগাছ থেকে প্রতিদিন ২৫/৩০ লিটার পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। স্ত্রী তাল গাছ হতে রস সংগ্রহ করতে মে মাসে ফলের মঞ্জরিদ- বেড় হলে ধারালো দা দিয়ে কাটতে হয়। পুষ্পমঞ্জরি হতে সংগৃহীত এই রস জ্বাল দিয়ে গুড়, তালমিশ্রি প্রস্তুত করা হয়।
তালের গুড় পুষ্টিমানের দিক দিয়ে খুবই সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর মিনারেল যেমন আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস বিদ্যমান। এতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ বিদ্যমান। এতে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান যা আমাদের দেহকে ফ্রি রেডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে দেহকে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এতে বিদ্যমান ডায়েটারি ফাইবার হজমে সহায়তা করে, কোলেস্টেরল লেভেলকে এবং রক্তের সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর শারীরতত্ত্ব ও চিনি রসায়ন বিভাগের তাদের নিজস্ব বাগান থেকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তালের রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, তালমিশ্রি তৈরি এবং সংগৃহীত রসের রাসায়নিক বিশ্লেষণের উপর কাজ করে যাচ্ছে।
সর্বোপরি বহুবিধ গুণসম্পন্ন, পরিবেশবান্ধব এই গাছটির চারা উৎপাদন এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএসআরআই, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল: ০১৭৩১৯১৯১৭৪; ই-মেইল: kohinoorbegum.bsri@gmail.com
কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে ‘উত্তম কৃষি চর্চা
ডঃ মনসুর আলম খান
বাংলাদেশে বিগত দিনে কৃষি খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ধান, ভুট্টা, আলু, সবজি, ফল, মাছ, গরু, ছাগল ইত্যাদি কৃষি পণ্য উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা একসময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, তারাই এখন বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে’। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরের লক্ষ্য কৃষিকে আধুনিকায়ন ও লাভজনক করা। আর এই লক্ষ্য অর্জনের পথে আগামী দু’দশক বাংলাদেশের কৃষি খাত দ্রুত গতির রূপান্তরধর্মী এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। পরিবর্তনের কেন্দ্রে থাকবে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’।
কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০’ এর বর্ণনা মতে ‘এটি একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে’।
কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এই ধারণার আর্বিভাব খুব বেশি দিন আগের নয়। ১৯৯৭ সালে ইউরোপের সুপারশপ এবং প্রধান সরবরাহকারীদের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ‘Europe GAP’ নামে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৭ সালে উক্ত চর্চার নামকরণ করা হয় Global GAP। উত্তম কৃষি চর্চা বাংলাদেশ প্রবেশ করে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক উদ্যান ফসল, সবজি ও ফলের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় গত ২১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে ‘বাংলাদেশে উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০’। উক্ত নীতিমালার অধীনে মে ২০২৩ এ গৃহীত হয়েছে ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চার মানদ- (Standards of Bangladesh Good Agricultural Practices)। বাংলাদেশে GAP বাস্তবায়নের জন্য মোট ২৪৬টি বাধ্যতামূলক উত্তম চর্চা সম্বলিত ১) নিরাপদ খাদ্য মডিউল; ২) পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা মডিউল; ৩) কর্মীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ মডিউল; ৪) পণ্যমান মডিউল এবং ৫) সাধারণ প্রয়োজনীয়তা মডিউল শীর্ষক মোট পাঁচটি মডিউল প্রস্তুত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে উক্ত চর্চাসমূহ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চার চারটি মূল স্তম্ভ খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত হবে। মানদ- নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কে পরিকল্প স্বত্বাধিকারী (স্কিমওনার) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিইএ) কে সার্টিফিকেশন বডি Bangladesa Agricultural Certification Bodz (BACB) হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, ISO17011 মানদ-ে পরিচালিত এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্রিডিশন ফোরাম IAF এর আওতাধীন বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড (BAB) থেকে BACB এর সার্টিফিকেট গ্রহণের কার্যক্রম চলমান আছে।
দেশে দেশে উত্তম কৃষি চর্চা অনুশীলনের সম্মতির মানদ-ের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। কোন দেশ তাঁদের নিজেদের আর্থসামাজিক, কৃষ্টি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মোতাবেক সম্মতির মানদ- নির্ধারণ করে থাকে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার যে মানদ- বাংলাদেশের জন্য সেই একই মানদ- বর্তমানে প্রযোজ্য নয়। (Bangladesh GAP) মোতাবেক বর্তমানে বাংলাদেশে ২৪৬টি উত্তম চর্চাকে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হবে। আবার বর্তমানে প্রযোজ্য এমন অনেক মানদ- ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। গুরুত্বের দিক থেকে অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণের সূচকসমূহকে তিনটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে, ১) অতি গুরুত্বপূর্ণ (গধলড়ৎ গঁংঃ) চর্চা; যা শতভাগ (১০০%) মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ চর্চা অনুসরণ না করা হলে খাদ্য ও পণ্যের মান ও বৈশিষ্ট্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিধায় এর নিচের কোন মান গ্রহণযোগ্য নয়; ২) গুরুত্বপূর্ণ (গরহড়ৎ গঁংঃ/) চর্চা; এসব চর্চা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা শতকরা নব্বই ভাগ (৯০%); এবং ৩) সাধারণ (এবহবৎধষ) চর্চা; গুরুত্বের দিক থেকে এসব চর্চা সাধারণ মানের, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ (৫০%) মেনে চললেই সম্মতি দেয়া হবে।
বাংলাদেশে কার্যকর ২৪৬টি উত্তম কৃষি চর্চার মানদ-ের মাঝে ‘পণ্য শনাক্তকরণ ও গতিবিধি (ঞৎধপবধনরষরঃু ধহফ ৎবপধষষ)’ অনেকটা রবি ঠাকুরের ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’ গানের উত্তর খোঁজার মতো। কোন কারণে কোন পণ্যে খারাপ কিছু পাওয়া গেলে তা গোড়ায় সমাধান করা এবং সরবরাহ শিকলের কোন পর্যায়ে ক্ষতিকর কিছু গোচরে এলে ভোক্তাকে তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেয়া শতভাগ বাধ্যতামূলক করণীয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বহুমুখী প্রচেষ্টায় এ বছর আম রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমের এই বাজার মূলত প্রবাসী বাঙ্গালি কেন্দ্রিক, মূলধারার সুপারশপে প্রবেশ করতে হলে ঞৎধপবধনরষরঃু থাকা আবশ্যক। সরকার ইধহমষধফবংয এঅচ আওতায় সন্ধানযোগ্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
‘রোপণ সামগ্রী (চষধহঃরহম সধঃবৎরধষং)’ উত্তম কৃষি চর্চার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ মানদ-। বীজ ও চারা হতে হবে নিখুঁত ও জীবাণুমুক্ত, বপন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি হতে হবে জীবাণুমুক্ত, নার্সারি হবে নিবন্ধিত। বীজ কোম্পানির নাম, সীলমোহরসহ বীজ বপনের প্রতিটি পর্যায়ের তারিখ ও অন্যান্য তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে যথাযথভাবে। ‘বেশি সারে বেশি ফসল’ এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে এসে কৃষককে বিজ্ঞানভিত্তিক সার প্রয়োগে অভ্যস্ত হতে হবে। জমিতে সার ও মাটি উর্বরকারি পদার্থ (ঋবৎঃরষরুবৎং ধহফ ংড়রষ ধফফরঃরাবং) প্রয়োগ করতে হবে উৎপাদিত ফসলের ধরণ ও মাটির ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে। সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা কর্তৃপক্ষের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োগকৃত পদার্থে ক্ষতিকর কোন উপাদান পাওয়া গেলে তা অপসারণের বাধ্যবাধকতা শতভাগ (অতি গুরুত্বপূর্ণ)।
বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লবের অন্যতম উপকরণ সেচ। ইধহমষধফবংয এঅচ মোতাবেক জমিতে সেচ এবং উৎপাদিত ফসল পরিষ্কার করা কাজে ব্যবহৃত পানি হতে হবে ক্ষতিকর উপাদান মুক্ত ও বিশুদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলার উপস্থিতির কারণে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৬ মে পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পান রপ্তানি বন্ধ ছিল। কারণ হিসেবে ইউরোপ থেকে জানানো হলো বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত কোন এক চালানের ফাইটোস্যানিটারি পরীক্ষায় তারা সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করেছে। উক্ত সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার মূলত মানুষের পয়ঃবর্জ্যে বাস করে। পানের মত একই অবস্থা হয়েছিল রাশিয়ায় আলু রপ্তানিতে। ফাইটোস্যানিটারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে রাশিয়াতে আলু রপ্তানি বন্ধ ছিল প্রায় ছয় বছর, যা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ বছরই নতুন করে আবার চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে ফাইটোস্যানিটারি সনদ ছাড়া কোন পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে জাহাজীকরণ করা হবে না। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি মন্ত্রণালয় ঢাকার পূর্বাচলে দুই একর জমিতে স্থাপন করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড পরীক্ষাগার।
ফসলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার (ঐধৎাবংঃরহম ধহফ যধহফষরহম ঢ়ৎড়ফঁপব) ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চার নীতিতে উৎপাদিত ফসল সরাসরি মাটিতে অথবা মেঝেতে রাখা যাবে না। ফসল কর্তন যন্ত্রপাতি, কন্টিনার, গোদাম, পরিবহন ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা হতে হবে অনুমোদিত নীতিমালা মেনে। উৎপাদিত ফসল রাখতে হবে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ থেকে নিরাপদ দূরে। ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত সকল স্তরে নিয়োজিত কৃষক-কৃষাণি এবং শ্রমিকের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি (চবৎংড়হধষ যুমরবহব) নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান ও অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের জন্য থাকতে হবে পর্যাপ্ত জীবাণুনাশক সুরক্ষাসামগ্রী।
জিএমও (এবহবঃরপধষষু গড়ফরভরবফ ঙৎমধহরংসং) বা জিএম ফুড (এগ ঋড়ড়ফ) সংক্রান্ত এফএও এর সব ক’টি নির্দেশনাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন কৃষক জিএম ফসল ফলাতে পারবেন না, এমন কি অন্য ফসলের সাথে মেশাতেও পারবে না, এটা যে জিএম ফুড সেটা ভোক্তাকে নিশ্চিতভাবে জানাতে হবে, ফসলের গায়ে থাকতে হবে বিশেষ লেভেল। ঋঅঙ এর মতে, ‘এগ পৎড়ঢ়ং ংযধষষ নব ংঃড়ৎবফ ংবঢ়ধৎধঃবষু ভৎড়স ড়ঃযবৎ পৎড়ঢ়ং...... ঞযব ঢ়ৎড়ফঁপবৎ ংযধষষ রহভড়ৎস পষরবহঃং ধনড়ঁঃ ঃযব ংঃধঃঁং ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়ফঁপঃ রিঃয ৎবংঢ়বপঃ ঃড় এগঙং.’ বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে একমাত্র জিএম ফুড হলো বিটি বেগুণ। টঝঅওউ এর সহযোগিতায় ২০১৪ সালে ২০ জন কৃষকের হাতে বিটি বেগুনের (ইঃ নৎরহলধষ) চারা বিতরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জিএম ফুডের যুগে প্রবেশ করে। আমাদের কয় জন কৃষক জানেন যে পোকারোধী বিটি বেগুনের জিনে (এবহব) কৃত্রিমভাবে যুক্ত করা আছে ঈৎং১অপ জিন। উক্ত জিন (ইঋঝই) আবার নেয়া হয়েছে ইধপরষষঁং ঃযঁৎরহমরবহংরং নামক ব্যাকটেরিয়া থেকে। বাজারে বিটি বেগুন, ফল, সবজি, দুধ প্রভৃতি খাদ্য বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তা হিসেবে জনগণ খাচ্ছে। কিন্তু এসব খাদ্যে ভেজাল থাকলে পরিশেষে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য করার মাধ্যমে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করার ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চা একান্ত জরুরি।
বাংলাদেশের কৃষি ক্রমেই খোরপোশ কৃষি (ঝঁনংরংঃবহপব অমৎরপঁষঃঁৎব) থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হচ্ছে। মাত্র ৮৫-৯০ লাখ হেক্টর আবাদি জমির উপর নির্ভর করছে ১৭ কোটি লোকের খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও কৃষিপণ্যের রপ্তানি। টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০’ অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গবেষণা ও সম্প্রসারণ সংস্থাসমূহ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গাবতলিতে স্থাপন করা হচ্ছে ঠধঢ়ড়ঁৎ ঐবধঃ ঞৎবধঃসবহঃ (ঠঐঞ) প¬ান্ট, যুক্ত করা হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সবজি ভ্যান, পিপিপির আওতায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণ করা হচ্ছে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য সরকার থেকে হাওর অঞ্চলে ৭০ ভাগ এবং দেশের অন্য সকল অঞ্চলে দেয়া হচ্ছে ৫০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি। উৎপাদন, পরিবহন, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণের যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে উত্তম কৃষি চর্চা’ অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগোচ্ছে সঠিক পথ ধরে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সকল বাধা অতিক্রম করে ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’র বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ অর্জনের অদম্য অভিযাত্রায়।
লেখক : উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, ই-মেইল : monsuralammkhan@gmail.com
পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কৃষিভিত্তিক এই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ফসল খাত। এ দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৩%। কৃষি খাতের এই ১৩% জিডিপির মধ্যে ফসল খাতের অবদান প্রায় ৭%। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিকের খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। আর এই মৌলিক দায়িত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষিতে শস্যনিবিড়তা (ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম ওহঃবহংরঃু) বৃদ্ধি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর। আর মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১৬০ লাখ ৫৬ হাজার ৮১৬ হেক্টর যা এ দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একটি অনুশাসন প্রদান করে বলেছেন -“এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে”। সুতরাং কৃষিদরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়ন করার জন্য কৃষিতে ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। ফসল চাষের নিবিড়তা (ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম ওহঃবহংরঃু) বলতে আমরা বুঝি বছরে একটি নির্দিষ্ট জমিতে কয়টি ফসল চাষ করা যায়। ফসল চাষের নিবিড়তা কোন একক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। এটি ফসল উৎপাদনের সাথে জড়িত একাধিক উপাদানের উপর নির্ভর করে। কোনো এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাটির বৈশিষ্ট্য, সেচ সুবিধা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ততা, বর্গা চাষ, অকৃষি খাতে উপার্জন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, কৃষকের আর্থিক অবস্থা, ফসলের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চিয়তা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের উপর জমির শস্যনিবিড়তার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। পাট ও পাটজাতীয় ফসল আঁশ ফসলকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
ফসল পর্যায়ক্রম/শস্যবিন্যাস (ঈৎড়ঢ় জড়ঃধঃরড়হ) বলতে একখ- জমিতে এক বছরে পর পর কোন কোন ফসল পর্যায়ক্রমে চাষাবাদ করা হয় সেই বিন্যাসকেই বুঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি অঞ্চলগুলোতে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি শস্যবিন্যাস বিদ্যমান আছে। তবে মোট ফসলি জমির প্রায় ৬১ হাজার ৮২২ হেক্টর জমিতে চার ফসলি শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭১-৭২ সালে শস্যনিবিড়তা ছিল ১৫৩.৭৪%। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ২০৫% (ডিএই ২০২০-২১)। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২১৫%। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল চাষের নিবিড়তা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সারণি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কৃষি অঞ্চলগুলোর মধ্যে শস্যনিবিড়তা সবচেয়ে বেশি (২৩৬%) বগুড়া ও যশোর অঞ্চলে এবং সবচেয়ে কম (১৩৮%) রাঙ্গামাটি অঞ্চলে। আবার, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেখানে নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা বেশি সেসব জেলায় ফসল চাষের নিবিড়তা জাতীয় গড়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমানে বাংলাদেশে শস্যনিবিড়তা ২১৫% (ডিএই ২০২২-২৩)। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলকে শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে পাটের অপ্রচলিত এলাকায় ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলে পাট ফসলভিত্তিক প্রায় ৯৪টি শস্যবিন্যাস চিহ্নিত করা হয়েছে যার অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় খরিফ-১ মৌসুমে শুধুমাত্র রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। কিন্তু এসব অঞ্চলে যদি বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত লবণাক্ত সহিষ্ণু দেশী পাটের জাত ‘বিজেআরআই দেশী পাট ১০’ বর্তমানে বিদ্যমান একফসলি জমির শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে লবণাক্ত এলাকার বিস্তর একফসলি জমিতে দুটি ফসল আবাদ করা সম্ভব হবে। এর ফলে লবণাক্ত এলাকার একফসলি জমি দোফসলি জমিতে রূপান্তরিত হবে এবং ফসল উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে ঐসব অঞ্চলের কৃষক অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবে। আবার, বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসটি বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় মাঝারি উঁচু শ্রেণির ২.৩১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়। ঐসব জমিতে বিদ্যমান দুই ফসলি শস্যবিন্যাসের স্থলে পাটকে অন্তর্ভুক্ত করে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা সম্ভব। কারণ, বোরোর পরে মাঝারি উঁচু জমিতে খুব সহজেই পাট ফসলকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এর ফলে দুই ফসলি শস্যবিন্যাস বোরো-পতিত-রোপা আমন-এর স্থলে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমন প্রবর্তিত হবে। তিন ফসলি শস্যবিন্যাস (বোরো-পাট-রোপা আমন) অনুসরণ করার মাধ্যমে বিদ্যমান শস্যবিন্যাস (বোরো-পতিত-রোপা আমন) অপেক্ষা ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে কৃষকের আয় প্রায় ৩০-৪০% বাড়বে বলে বিজেআরআই-এর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ মনে করেন।
সম্প্রতি নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে পাট ও পাটশাকের সাথে অন্যান্য ফসলের সমন্বয় সাধন করে বছরে পাটভিত্তিক চার ফসলি শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ০.০২৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সাধারণত ‘আলু-পতিত-পাট-রোপা আমন’ শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদ করা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে তিন ফসলি শস্যবিন্যাস আলু-পতিত-পাট-রোপা আমন আবাদ করা হয় সেখানে অনায়াসেই চার ফসলি নতুন শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ প্রবর্তন করা সম্ভব। এই নতুন শস্যবিন্যাসটি অনুসরণ করলে ফসল চাষের নিবিড়তা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হবে। পাট ও পাট শাক এই শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভূক্ত থাকায় মাটিতে জৈব পদার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বজায় রাখবে এবং মানুষের পুষ্টি উপাদান যোগানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। কৃষক অনুসৃত তিন ফসলি শস্যবিন্যাসের চেয়ে পাটভিত্তিক চার ফসলি নতুন শস্যবিন্যাস ‘আলু-পাটশাক-পাট-রোপা আমন’ অনুসরণের ফলে ফসল চাষের নিবিড়তা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং সেই সাথে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৫৯,৯৬০/- টাকা অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে (বিজেআরআই, ২০২০)।
মানুষের খাদ্যের মূল উৎস হিসেবে প্রাথমিক জোগানদাতা হলো কৃষি। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের জোগান শিল্প বা অন্য কোনো সেক্টর থেকে পাওয়া গেলেও ঐসব সেক্টর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় কৃষিকে আধুনিক, টেকসই এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের প্রাথমিক জোগানদাতা হিসেবে আরো শক্তিশালী করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রেখে আবাদযোগ্য সমস্ত জমি চাষের আওতায় এনে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, সেই সাথে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল ফোন নম্বর ঃ ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫, ই-মেইল ঃ morshedbjri@gmail.com
চরাঞ্চলে মিশ্র ফসল হিসেবে মসলার চাষাবাদ
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ ড. মো. শহিদুল আলম২ মো. মুশফিকুর রহমান৩
বিভিন্ন নদী বা শাখানদীর মাধ্যমে উভয় পাশে সময়ের সাথে সাথে বিপুল পরিমাণে বালু, পলি এবং কাদামাটি জমা হয়ে যে ভূখ-ের সৃষ্টি হয় তাকে চর (ঈযধৎষধহফ) বলা হয়। চর দুই ধরনের হয়ে থাকে ক) সংযুক্ত চর, যা মূল ভূখ-ের সংলগ্নে থাকে এবং খ) দ্বীপ চর, যা মূল নদীর খালসমূহের সাথে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে। বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধলেশ^রী ইত্যাদি নদীর তীরে প্রায় ৮.৩ লাখ হেক্টর চর আছে, যার প্রায় ৫.২-৭.৯ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য। এদেশের চরাঞ্চলে প্রায় ৬৫ লাখ লোক বসবাস করে। চরের জমিতে পুষ্টি উপাদান এবং জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশে লবণাক্ততা মুক্ত চরাঞ্চলগুলো হলো কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, বাজশাহী, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর চরের জমিতে ফসল চাষ করা হয়। চরাঞ্চলের কৃষকরা সাধারণত তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে স্থানীয় বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ করে। বাংলাদেশে মসলা ফসল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মূল ভূখ-ে চাষযোগ্য জমির স্বল্পতার কারণে মসলা ফসলের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ দেশে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কালিজিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মসলাজাতীয় ফসল। এ সমস্ত মসলা ফসলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে ক্রমবর্ধমান জনসখ্যার খাবার উৎপাদনে প্রতিকূল চরের ইকোসিস্টেমে বর্ণিত মসলা ফসলগুলোর ফলন এবং উৎপাদন উভয়ই বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সে লক্ষ্যে টেকসই ফসল উৎপাদন এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরাঞ্চলে বর্ণিত ফসলের উন্নত জাত ও আধুনিক চাষ পদ্ধতির প্রয়োগ এবং একক ফসলসহ মিশ্র ফসলের চাষাবাদ করা আবশ্যক।
সংযুক্ত চরাঞ্চল উঁচু হয় এবং এতে বালু ও আগাছার পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে, কিন্তু পলির পরিমাণ কম থাকে। আগাম রোপণ/বপনকৃত ফসল এবং মাঠে দীর্ঘস্থায়িত্বকাল বিশিষ্ট ফসল এ চরাঞ্চলের জন্য নির্বাচন করা হয়। এ ধরনের চরে মসলা ফসলের মধ্যে রসুন, পেঁয়াজ, মুড়িকাটা পেঁয়াজ (ছোট কন্দ রোপণ করে পেঁয়াজ উৎপাদন), মরিচ, সাধারণত একক বা মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে দ্বীপ চরাঞ্চল নিচু হয় এবং তেমন একটা আগাছা থাকে না, কিন্তু পলির পরিমাণ বেশি থাকে। বিলম্বে রোপণ/বপনকৃত ফসল এবং মাঠে স্বল্প স্থায়িত্বকাল বিশিষ্ট ফসল এ চরাঞ্চলের জন্য নির্বাচন করা হয়। এ ধরনের চরাঞ্চলে সাধারণত পেঁয়াজ একক ফসল কিংবা পেঁয়াজের ভেতর কালিজিরা, ধনিয়া মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হয়।
মিশ্র ফসল
একই জমিতে একসঙ্গে দুই বা ততোধিক প্রজাতির ফসল চাষ করার পদ্ধতিকে মিশ্র ফসল চাষ বলা হয়ে থাকে। ভূমি, শ্রম, পুষ্টি উপাদান, পানি, আলোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে মিশ্র ফসলের মাধ্যমে প্রতি একক জমি থেকে একক ফসলের তুলনায় মোট উৎপাদন, আয় এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা যায়। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় এবং ফসল চাষের সফলতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে চরাঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা ১৪৫-১৬২%। পরিকল্পিত মিশ্র ফসল চাষের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব। অন্যদিকে একই জমিতে একটি নির্দিষ্ট বিন্যাস অনুসরণ করে দুই ধরনের ফসল চাষের পদ্ধতিকে আন্তঃফসল চাষ বলা হয়। চরে সারি কিংবা ফালি পদ্ধতিতে আন্তঃফসল চাষ করা যায়।
সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের ভেতর কালিজিরা/ধনিয়ার মিশ্র ফসল চাষ
দ্বীপ চরাঞ্চলে সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের ভিতর কালিজিরা বা ধনিয়া অথবা পেঁয়াজের ভেতর কালিজিরা ও ধনিয়া উভয়ই একই সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হয়ে থাকে। পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই বার চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। শেষ চাষের সময় প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পচা গোবর সার, বিঘাপ্রতি ৩৫ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম, ২-৩ কেজি দস্তা সার এবং ১-২ কেজি বোরন সার প্রয়োগ করা হয়। জমিতে রসের ঘাটতি থাকলে পানি দিয়ে সার প্রয়োগ করতে হয়। পেঁয়াজের ৩টি জাত যথা বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং বারি পেঁয়াজ-৬ জাত চরে চাষের উপযোগী, তবে বারি পেঁয়াজ-৪ খুবই উন্নত জাত। কালিজিরা ও ধনিয়ার উন্নত জাত হলো যথাক্রমে বারি কালিজিরা-১ ও বারি ধনিয়া-২। ডিসেম্বর মাসে পেঁয়াজ (৮০০-১০০০ গ্রাম/বিঘা), ধনিয়া (১.০-১.৫ কেজি/বিঘা) এবং কালিজিরা (৮০০-১০০০ গ্রাম/বিঘা)-র বীজ একই সাথে বপন করা হয়। পেঁয়াজের ভেতর ধনিয়া ও কালিজিরা উভয়ই একই সাথে মিশ্র ফসল চাষ করলে ধনিয়া ও কালিজিরার বীজ হার অর্ধেক করে হবে। পরে বালু দিয়ে বীজ ঢেকে দেয়া হয়। পেঁয়াজ বীজ বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম প্রোভ্যাক্স ছত্রাকনাশকের মাধ্যমে শোধন করে নিতে হবে। ধনিয়া বীজ পানিতে ২৪-৪৮ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে এবং পরে শুকিয়ে বপন করতে হয়। কালিজিরা বপনের পূর্বে বীজ কমপক্ষে ২ দিন রোদে শুকিয়ে এবং ঠা-া করে পরে ১০-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজাতে হবে। পরে প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম প্রোভ্যাক্স ছত্রাকনাশকের মাধ্যমে শোধন করে নিতে হবে। শোধনকৃত বীজ রোদে শুকিয়ে ঝুরঝুরা করে বপন করতে হবে। অনেক চরাঞ্চলে কৃষক চাষ না দিয়েই বীজ বপন করে থাকে। বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর পানি সেচ দিয়ে বিঘাপ্রতি ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হয়। বপনের ৪০-৪৫ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করে পানি দেয়া হয় এবং পুনরায় ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করা হয়। বপনের ৬০-৭০ দিন পর পুনরায় আগাছা নিড়িয়ে ও সেচ দিয়ে ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া সার দেয়া হয়। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লুনা সেন্সেশন (১ মিলি/লিটার পানি)/রোভরাল (২ গ্রাম/লিটার পানি)/এমিস্টার টপ (১ মিলি/লিটার পানি) ১৫ দিন পর পর পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে। থ্রিপস দমনের জন্য সাকসেস/ইমিটাফ (১ মিলি/লিটার পানি) স্প্রে করতে হবে। অনেক কৃষক জমিতে প্রায় ২৫-৩০% ধনিয়া রেখে বাকিটা তুলে বাজারে বিক্রয় করে থাকে। আবার অনেক কৃষক ধনিয়া ও কালিজিরার বীজ হারের এক- তৃতীয়াংশ বপন করে। অনেক কৃষক বিভিন্ন জমির সীমানায়, রসুন, ধনিয়া, কালিজিরা করে থাকে। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা হয়। পেঁয়াজ সংগ্রহের ১৫-২০ দিন পূর্বে ধনিয়া ও কালিজিরার বীজ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে ধনিয়া পাতা বপনের ১.০-১.৫ মাসের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। পেঁয়াজের ফলন জাতভেদে ২.০-২.৫ টন/বিঘা। কালিজিরা ফলন বিঘাপ্রতি ১২০-১৪০ কেজি এবং ধনিয়ার ফলন বিঘাপ্রতি ১৫০-২০০ কেজি (বীজ) ও ৫০০-৭০০ কেজি (কাঁচা পাতা)।
মুড়িকাটা পেঁয়াজের ভেতর কালিজিরার মিশ্র ফসল চাষ
সংযুক্ত চরাঞ্চলে পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই বার চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। শেষ চাষের সময় প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পচা গোবর সার, বিঘাপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৩০ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম, ২-৩ কেজি দস্তা সার এবং ১-২ কেজি বোরন সার প্রয়োগ করা হয়। অক্টোবর ১৫-নভেম্বর ১৫ তারিখের মধ্যে পেঁয়াজের ৪-৬ গ্রাম ওজনের সেট (পেঁয়াজের ছোট কন্দ) রোপণ করতে হবে। পেঁয়াজের রোপণ দূরত্ব হবে ১৫ সেমি. ী ১০ সেমি.। বিঘাপ্রতি ৩০০-৪০০ কেজি সেটের প্রয়োজন হয়। সেট রোপণের ২০-২৫ দিন পর বিঘাপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হবে এবং আগাছা নিড়িয়ে সেচ দিতে হবে। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য বর্তমানে ৩টি জাত যথা বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং বারি পেঁয়াজ-৬ আছে, তবে বারি পেঁয়াজ-৪ এর ফলন বেশি। সেট রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর বিঘাপ্রতি ১ কেজি বারি কালিজিরা-১ এর শোধনকৃত বীজ বপন করতে হবে এবং নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে সেচ দিতে হবে। সেট রোপণের ৬০-৬৫ দিনের পর বিঘাপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে এবং নিড়িয়ে সেচ দিতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লুনা সেন্সেশন রোভরাল (২ গ্রাম/লিটার পানি)/এমিস্টার টপ (অ্যাজোস্কিস্ট্রোবিন+ডাই ফেনোকোনাজল) (১ মিলি/লিটার পানি) ১৫ দিন পরপর পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে। থ্রিপস দমনের জন্য সাকসেস/ইমিটাফ (১ মিলি/ লিটার পানি) স্প্রে করতে হরে। জানুয়ারি ১৫-ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখের মধ্যে পেঁয়াজের কন্দ তুলতে হবে। মুড়িকাটা পেঁয়াজে ফুলের দ- উৎপাদন হয়, তা মাঝে মাঝে সংগ্রহ করে খাওয়া যায় এবং বাজারে বিক্রয় করা যায়। মার্চ মাসে কালিজিরা সংগ্রহ করা হয়। মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন জাতভেদে বিঘাপ্রতি ২.০-৩.০ টন এবং কালিজিরার ফলন বিঘাপ্রতি ১২০-১৪০ কেজি। পরে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল ঘরে তোলা হয় কিংবা বাজারজাত করা হয়।
রসুনের সাথে কালিজিরার মিশ্র ফসল চাষ
অনেক কৃষক সংযুক্ত চরাঞ্চলে একক ফসল হিসাবে রসুন চাষ করে থাকে, তবে মিশ্র ফসল হিসেবেই চাষ করা ভালো। পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই বার চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। শেষ চাষের সময় প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পচা গোবর সার, বিঘা প্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৩৫ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম, ২ কেজি দস্তা সার এবং ১ কেজি বোরন সার প্রয়োগ করা হয়। অক্টোবর ১৫-নভেম্বর ১৫ মধ্যে রসুনের ০.৭৫-১.০ গ্রাম ওজনের বীজ কোয়া ১৫ সেমি. ী ১০ সেমি দূরত্বে রোপণ করতে হবে। বিঘাপ্রতি ৭০-৮০ কেজি বীজের প্রয়োজন হবে। কোয়া রোপণের ২০-২৫ দিন পর বিঘাপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হবে এবং আগাছা নিড়িয়ে সেচ দিতে হবে। রসুন উৎপাদনের জন্য বর্তমানে ৪টি জাত যথা বারি রসুন-১, বারি রসুন-২, বারি রসুন-৩ এবং বারি রসুন-৪ আছে, তবে বারি রসুন-১ ও বারি রসুন-৪ এর ফলন বেশি। কোয়া রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর বিঘাপ্রতি ১ কেজি বারি কালিজিরা-১ এর শোধনকৃত বীজ বপন করতে হবে এবং নিড়ানি দিয়ে মাটি কোপিয়ে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে সেচ দিতে হবে। কোয়া রোপণের ৬০-৬৫ দিনের পর বিঘাপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে এবং নিড়িয়ে সেচ দিতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লুনা সেন্সেশন (১ মিলি/লিটার পানি)/রোভরাল (২ গ্রাম/লিটার পানি)/এমিস্টার টপ (ইমিডাক্লোরপ্রিড) (১মিলি/লিটার পানি) ১৫ দিন পর পর পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে থ্রিপস আক্রমণ করে থাকে। থ্রিপস দমনের জন্য সাকসেস/ইমিটাফ (অ্যাজোস্কিস্ট্রোবিন+ ডাইফেনোফোনাজল) ইমিডাক্লোরপ্রিড (১ মিলি/লিটার পানি) স্প্রে করতে হবে। ফেব্রুয়ারি ১৫-মার্চ ১৫ মধ্যে রসুনের কন্দ তুলতে হবে। মার্চ মাসে কালিজিরা সংগ্রহ করা হয়। রসুনের ফলন জাতভেদে বিঘাপ্রতি ১.০-১.৫ টন এবং কালিজিরার ফলন বিঘাপ্রতি ১২০-১৪০ কেজি। পরে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল ঘরে তোলা হয় কিংবা বাজারজাত করা হয়।
মরিচের সাথে ধনিয়ার মিশ্র চাষ
সংযুক্ত চরাঞ্চলে মরিচ একক ফসল কিংবা মরিচ (স্থানীয় বা হাইব্রিড জাত) এর সাথে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও রসুনের আন্তঃফসল চাষ করা হয়ে থাকে। পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই বার চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। শেষ চাষের সময় প্রাপ্যতা সাপেক্ষে পচা গোবর সার, বিঘাপ্রতি ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া, ৩০-৩৫ কেজি টিএসপি, ২০-২৫ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম, ২-৩ কেজি দস্তা সার এবং ১-২ কেজি বোরন সার প্রয়োগ করা হয়। সেপ্টেম্বর ১৫-অক্টোবর ১৫ জমিতে সরাসরি বা সারি করে বীজ বপন করা হয়ে থাকে। প্রতিবিঘা জমিতে ১ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজতলায় চারা তৈরি করেও চারা রোপণ করা যেতে পারে। প্রতি কেজি বীজকে ২ গ্রাম অটোস্টিন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। সারি পদ্ধতিতে ৫০ সেমি. ী ২৫ সেমি. দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। মরিচের মধ্যে প্রতিবিঘায় ২ কেজি ধনিয়ার বীজ বপন করা হয়। বপন/রোপণের ২০-২৫ দিন পর আগাছা নিড়িয়ে পানি দিয়ে বিঘাপ্রতি ৮-১০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করা হয়। ফুল আসা শুরু হলে বিঘাপ্রতি ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল ধরা শুরু হলে বিঘাপ্রতি ৫০ গ্রাম বোরিক এসিড দিতে হবে। বিভিন্ন রোগ দমন করার জন্য সানভিট/কুপ্রাভিট (কপার অক্সিক্লোরাইড) (৭ গ্রাম/লিটার পানি)/টিল্ট (০.৫ মিলি/লিটার পানি)/ অটোস্টিন (২ গ্রাম/লিটার পানি) ৮-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য টাফগর/এডমায়ার (২ মিলি/লিটার পানি)/ভার্টিমেক/থিওভিট (২ মিলি/লিটার পানি)/সাকসেস (১.২ মিলি/লিটার পানি)/মেলাথিয়ন (১ মিলি/লিটার পানি) মাঝে মাঝে স্প্রে করতে হবে। জমি থেকে মরিচ জাতভেদে ৪-৫ বার সংগ্রহ করা যায়। প্রতিবার সংগ্রহের পর বিঘাপ্রতি ৪-৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। মরিচের জমির ভেতর ৮-১০ ফুট পর পর পানি সেচের জন্য ড্রেন এবং এরই সাথে ড্রেন বরাবর ২-৩ ফুটের জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করা যায়। অনেক কৃষক আইল তৈরি করে আইলে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও রসুন রোপণ করে থাকে। ধনিয়া পাতা বপনের ১.০-১.৫ মাসের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। জাতভেদে মরিচের ফলন বিঘাপ্রতি ২-৪ টন এবং ধনিয়ার কাঁচা পাতার ফলন বিঘাপ্রতি ৮০-১২০ কেজি। অনেক কৃষক চরাঞ্চলে বালুর উপরে পলিথিন বিছিয়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে পাকা মরিচ শুকিয়ে থাকে। অন্যদিকে কোন কোন কৃষক পলিথিন না বিছিয়েই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সরাসরি বালুর উপর মরিচ শুকায়, যা মোটেই উচিত নয়।
তাছাড়া অনেক কৃষক ফেব্রুয়ারি মাসে পাটশাকের সাথে ধনিয়া মিশ্র ফসল চাষ করে থাকে। সংযুক্ত চরাঞ্চলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আখ রোপণ করে সারির মাঝে মাঝে বারি পেঁয়াজ-৫সহ অন্যান্য পেঁয়াজ চাষ করা যায়। ভুট্টা, চীনাবাদাম, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, ডাল, তেল ইত্যাদি ফসলের মধ্যেও মিশ্র বা আন্তঃফসল হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন, কালিজিরা ও ধনিয়া চাষ করা যায়।
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর; ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব), সরেজমিন গবেষণা বিভাগ (অঞ্চল-১), বিএআরআই, বগুড়া, ৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৩৬১, ই-মেইল : khanalauddinsrse@gmail.com
কৃষিপণ্য থেকে নিরাপদ ফ্রাইড চিপ্স তৈরির ভ্যাকুয়াম
ফ্রাইং প্রযুক্তি
১ ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী ২মো: হাফিজুল হক খান
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কৃষি উৎপাদন সমগ্র বিশে^র রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। কৃষি আমাদের গর্ব করার মতো বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কৃষক ও কৃষি পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের শ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং কৃষিবান্ধব সরকারের যথাযথ উদ্যোগ উন্নয়নের মহাসড়কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কৃষির জয়গান এখন সর্বত্র। তা সত্ত্বেও কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়া, সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ কমানো ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ রয়ে গিয়েছে। দেশে বছরব্যাপী কৃষিপণ্যগুলোর কিছু সরাসরি খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার কিছু ফসল প্রক্রিয়াজাত করে খাবারের কাঁচামাল ও সংরক্ষণের মাধ্যমে বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য বছর জুড়ে তৈরি করা সম্ভব। যেমন- মচমচে চিপ্স অন্যতম একটি প্রস্তুতকৃত খাদ্য যা বিভিন্ন ফসল থেকে তৈরি করা হয় এবং এর চাহিদা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গণজমায়েত এ অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সাধারণত সরাসরি তেলে ভেজে সরবরাহ করছে আবার বাসায় তৈরিকৃত চিপসপণ্য মোড়কজাত করেও বিক্রয় করছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে সাধারণত কোন কাঁচা ফল বা সবজির টুকরো বা ফালিকে তেলে কিছুক্ষণ রেখে ফ্রাই করে পণ্যটি পুরো মচমচে করা হয়। এখানে পণ্যকে ভাজার জন্য তেলকে তাপ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় যা খাবারের সরাসরি সংস্পর্শে আসে।
ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং একটি উন্নত ও বাণিজ্যিক পদ্ধতি যেখানে কম তাপমাত্রা ও চাপে ভাজা চিপস জাতীয় পণ্যের গুণগত মান বজায় থাকে এবং এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ বিধায় বিভিন্ন ফল ও সবজির চিপস পণ্য তৈরিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
সাধারণত যে সকল ফল বা সবজি বেশি মিষ্ট হয় বা চিনির পরিমাণ অধিক থাকে সে সকল পণ্য ১৫০-১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তারও অধিক তাপমাত্রায় তেলে ভাজা হলে ভাজা পণ্য বাদামি বর্ণ ধারণ করে। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, তেলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করার ফলে ভাজা চিপস পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত কারসিনোজেনিক উপাদান এক্রাইলামাইড উৎপন্ন হয়, যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ গবেষণা পরিচালনাকালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহকৃত সহজলভ্য ভাজা আলুর চিপস রেজিস্টারকৃত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গবেষণাগারে পরীক্ষা করার পর দেখা যায় যে, আলু কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে তেলে ভাজা হলে মচমচে আলুর চিপসে ৫৬৩-১০১৮০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি এক্রালামাইড পাওয়া যায়, যা প্রতিদিন আমাদের শরীরের সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য মাত্রার ৩-৫০ গুণ বেশি (টিডিআই ২.৬ মাইক্রোগ্রাম/কেজি; একজন মানুষের গড় ওজন ৭০ কেজি হিসেবে ১৮২ মাইক্রোগ্রাম/কেজি)। উন্নত দেশে বাণিজ্যিক উপায়ে কৃষিপণ্য বিশেষ করে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল, কন্দাল ও অন্যান্য ফসল থেকে চিপ্স তৈরিতে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ইহা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। নিরাপদ ও গুণগতমান অক্ষুণœ রেখে উৎকৃষ্টমানের মচমচে চিপ্স পণ্য তৈরিতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের ¯œ্যাক্স শিল্পে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় নিরাপদ ভাজা চিপ্স (ফ্রাইড পণ্য) তৈরি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এ পণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা দেশে যেমন রয়েছে তেমনি বিদেশে রপ্তানিতে রয়েছে। এটি একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব অন্যদিকে নিরাপদ ও উচ্চমান সম্পন্ন ভাজা চিপ্স তৈরিতে একটি আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে সারা বিশে^ সমাদৃত। এ প্রযুুক্তি ব্যবহার করে নির্ধারিত তাপমাত্রা ও নিদিষ্ট সময় অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফলমুল ও সবজি যেমন : আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, আলু, মিষ্টিআলু, গাজর, পেঁপে, মানকচু, কাসাভা ইত্যাদি থেকে বহুবিধ মচমচে ভাজা চিপ্স অনায়াসে প্রক্রিয়াজাত করা যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিন ও ডি-ওয়েলিং মেশিন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রকার মচমচে চিপ্স পণ্য তৈরির মাধ্যমে নিঃসন্দেহে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। বিএআরআই উদ্ভাবিত মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে আলু স্লাইচ বা টুকরো সরাসরি শুকানো ছাড়াই ভাজা যায়, উৎকৃষ্ট বর্ণ ধারণ করে এবং সমভাবে চিপ্স মচমচে হয়। এছাড়াও গবেষণায় দেখা যায় যে, মচমচে ভাজা আলুর চিপ্সে এক্রালামাইডের পরিমাণ প্রায় ৭৪-৮১ মাইক্রোগ্রাম/কেজি যা এক জন মানুষের শরীরের ওজন অনুযায়ী সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ। উল্লেখ্য যে, বারি ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটির মূল্য আমদানিকৃত যন্ত্রের তুলনায় বহুলাংশে সাশ্রয়ী। এটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের ব্যবহার উপযোগী। যন্ত্রটি আকারে ছোট ও সহজেই যে কোন স্থানে স্থানান্তরিত করা যায় এবং অল্প জায়গায় স্থাপন করা যায়। ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটির পরিচালনা পদ্ধতি অতি সহজতর। তৈরিকৃত ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটি স্থানীয় যেকোন ওয়ার্কশপে তৈরি করা যাবে এবং স্বল্প খরচে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়।
ডি-ওয়েলিং এর মাধ্যমে তৈরিকৃত চিপ্স থেকে ১৫ ভাগের অধিক পরিমাণে তেল নিংড়ানো যায় ফলে এটি অল্প চর্বিযুক্ত হয়। বাজারে যেসব ভাজা চিপ্স পণ্য পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ক্রেকার্স পণ্য। কিন্তু ভ্যাকুয়াম প্রযুক্তি ও প্রটোকল ব্যবহার করে প্রকৃত ফেশ-কাট (ৎবধষ ভৎবংয-পঁঃ) ফ্রাইড বা ভাজা চিপস তৈরি করা যায়। গবেষণায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে, ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিনের মাধ্যমে আলু, কলা, কাঁঠাল, গাজর, আনারস, আম, মানকচু থেকে চিপ্স তৈরিতে সাধারণত ১০০-১২০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় এবং ৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত তেলে ডুবিয়ে ভাজতে হয়। ফল বা সবজির টুকরোর পরিমাণ, পুরুত্ব ও কোষের ধরনের উপর ভিত্তি করে চিপ্স ভাজার সময় নির্ধারণ করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে মচমচে চিপ্সের উপরিভাগে অধিক পরিমাণ তেল লেগে থাকে বা দেখা যায় যা খাওয়ার সময় আমাদের শরীরের ভেতরে প্রবেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সময় টিস্যু পেপার, কাগজ বা অন্যকোন দ্রব্যাদি ব্যবহার করে চিপ্সের উপরিভাগের লেগে থাকা তেল মুছে বা বের করে নেয়ার চেষ্টা করা হয়, যা কখনই স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। আবার প্রচলিত পদ্ধতিতে তৈরিকৃত চিপ্সের সংস্পর্শে থাকা অতিরিক্ত তেল সংরক্ষণ সময় কমায় এবং কিছুদিন পরে প্যাকেটে রাখা চিপ্সে তেলের দুর্গন্ধ (ৎধহপরফ) তৈরি করে। গবেষণায় লক্ষ্য করা হয়, ফল বা সবজির টুকরো ভাজার পরে মচমচে চিপ্স ১-২ মিনিট ডি-ওয়েলিং করলে চিপ্স থেকে প্রায় ১০ ভাগ তেল নিষ্কাশন বা বের হয়ে আসে যা পুনরায় চিপ্স তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ফয়েল প্যাকেটে মচমচে চিপ্স রেখে যথাযথভাবে নাইট্রোজেন ফ্রাশ করলে সংরক্ষণকৃত চিপ্স ৬ মাসের অধিক গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়। কাজেই আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। এ বিবেচনায় মুখরোচক খাদ্য পণ্য হিসেবে কৃষিজাত দ্রব্য দিয়ে তৈরিকৃত ভাজা চিপ্সকে নিরাপদ করাও সময়ের দাবি। সর্বোপরি ভাজা চিপ্সকে নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ বজায় রেখে সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য করতে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার কোন বিকল্প নেই।
লেখক : ১ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল : ferdous613@gmail.com
ব্লাক
সোলজার
ফ্লাই
সম্ভাবনাময় শিল্প
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন
প্রকৃতিতে প্রাপ্ত পোকামাকড়ের মধ্যে অতি পরিচিত একটি পতঙ্গ ব্লাক সোলজার ফ্লাই। এটি মূলত এক ধরনের মাছি পোকা, যা দেখতে সম্পূর্ণ কালো বর্ণের ও শান্ত প্রকৃতির। এরা প্রকৃতি বা মানুষের জন্য একেবারেই ক্ষতিকর নয়। বরং এটিকে আমরা নানাভাবে আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি। ব্লাক সোলজার ফ্লাই প্রকৃতিতে বিচরণকারী হলেও এর অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিশ^ব্যাপী এটিকে এখন ফার্মে চাষ করা হয়।
ব্লাক সোলজার ফ্লাই লার্ভা পুষ্টিসমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় মুরগী ও মাছের খাবারের বিকল্প হিসেবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক মাছিপোকা তাই সারা বিশ্বে এখন পালন করা হচ্ছে এবং এ পোকার খামার বর্তমানে বিশ্বে পোকামাকড় চাষের সবচেয়ে বিস্তৃত রূপ।
ব্লাক সোলজার ফ্লাই বা প্যারেড পোকা ফার্মের হাঁস মুরগীর বা মাছের প্রচলিত রেডি ফিডের পরিবর্তে অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন প্রাকৃতিক খাবার। ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির লার্ভা হয়ে উঠেছে প্রাণিসম্পদের জন্য প্রাণিজ আমিষের একটি সুলভ উৎস। বর্তমানে প্রাণিজ সেক্টরে এই মাছিপোকার খামার ও লার্ভা কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বহুপুষ্টিগুণ ও উপকার বিবেচনায় পোল্ট্রি খামারিরা একে বলছে বাদামি সোনা বা ব্রাউন গোল্ড। বাংলাদেশেও বর্তমানে এই বিশেষ প্রজাতির মাছির খামারে লার্ভা উৎপাদন করা হচ্ছে। এই মাছিপোকার থেকে উৎপাদিত লার্ভা প্রাণিসম্পদের নিরাপদ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে।
ব্লাক সোলজার ফ্লাই এর দ্রুত উৎপাদন চক্র ও প্রোটিনের উচ্চমাত্রার কারণে খাদ্য উৎপাদনের জন্য এবং লার্ভাতে প্রোটিনের মাত্রা উচ্চ থাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর খাদ্যের একটি আদর্শ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু প্রোটিনের উৎস হিসেবেই নয় জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও ব্লাক সোলজার ফ্লাই লার্ভা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর লার্ভা জৈব বর্জ্য খেয়েই বাঁচে।
প্রাপ্তবয়স্ক মাছিপোকা ভাগাড় বা বর্জ্যরে স্তূপে ডিম পাড়ে। সেই ডিম থেকে উৎপাদিত লার্ভা এই বর্জ্য খায় এবং বর্জ্যকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করে এবং উপজাত হিসেবে তা থেকে জৈবসার তৈরি হয়। অর্থাৎ টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও এই পোকার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের অনেক দেশেই জৈব বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে এটি ব্যবহৃত হয় এবং বাংলাদেশে এটির সম্ভাবনা নিয়ে কাজ চলছে।
জীবনচক্র : ব্লাক সোলজার ফ্লাই পতঙ্গের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পাঁচটি ধাপের প্রয়োজন হয়। যেমন : ১. মাছি; ২. ডিম; ৩. লার্ভা; ৪. (পিপি) পিউপা; এবং ৫. পিউপা (স্টিক)।
১. মাছি : ব্লাক সোলজার ফ্লাই পপুলেশনে পুরুষ মাছি ও স্ত্রী মাছি বিদ্যমান। স্ত্রী মাছি সাধারণত পুরুষের থেকে বড় হয়। পুরুষ মাছি স্ত্রী মাছির সাথে মিলনের পরে মারা যায় এবং স্ত্রী মাছি ডিম পাড়ার পরে মারা যায়।
র) মাছির ফ্লায়িং খাঁচা : ব্লাক সোলজার ফ্লাই চাষ করতে হলে একটি নেট ঘরের প্রয়োজন। যে স্থানে আলো, বাতাস ও সূর্যের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
রর) মাছির খাবার : এটি সাদা পানি ও মিষ্টি পানি পান করে। যেকোন ধরনের পানি পাত্রে রেখে তার উপর সুতি কাপড় ভিজিয়ে রাখতে হয়।
ররর) মাছির বসার স্থান : যে কোন ধরনের ছোট গাছ ফ্লাইং কেসে রাখতে হয় বা শুকনা কলাপাতাও ঝুলিয়ে রাখা যায় এবং এই পাতায় পানি বা চিনি মিশ্রিত পানি স্প্রে করা যেতে পারে।
রা) মাছি ডিম পাড়ার স্থান : ডিম পাড়ার পূর্বেই ডিম পাড়ার স্থান তৈরি করতে হবে। ১২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ২.৫ ইঞ্চি প্রস্থ ও ১.৫ ইঞ্চি উচ্চতার কাঠের টুকরায় আলপিন ঢুকিয়ে তিনটি আলপিন যুক্ত কাঠ রাবার দিয়ে একত্র করে তৈরি করা হয়। কাঠগুলো কোন বালতি বা বোলে পচনশীল বর্জ্য রেখে তার উপরে কাঠগুলো স্থাপন করা হয়। যেমন- ভাত, পচা শাকসবজি ও পচা ফল ইত্যাদি।
া) ডিম সংগ্রহ : মাছি পোকা কাঠের ফাঁকে ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো কাঠ থেকে ছুরির মাধ্যমে খুব আলতোভাবে তুলে যেকোন পাত্রে সংগ্রহ করতে হয়। ডিম সংগ্রহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এই কাজটি অতি সাবধানতার সাথে করতে হয়। একটি স্ত্রী মাছি ৫০০-৯০০টি ডিম পাড়ে।
২. ডিম : ডিমগুলো সংগ্রহ করার পর একটি চালনি বা নেটযুক্ত পাত্রে রাখতে হবে। সমপরিমাণ পাত্রে ফিড ও পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। তারপর নেটযুক্ত চালনিসহ ডিমগুলো বোল বা বালতিতে রাখতে হয়।
ডিম সংগ্রহের ৩-৫ দিন পর ডিম ফুটে। ডিম ফোটার আরো ২ দিন পর পাত্রে হালকা ফিড দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর লার্ভা তৈরির স্থানে যে কোন ধরনের নরম পচনশীল বস্তু দিতে হবে। এতে ফোটানো ডিমগুলো ছিটিয়ে দিতে হবে।
৩. লার্ভা : লার্ভা চাষের জন্য বেড তৈরি করতে হয়। একটি বেডের দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট আকারের তৈরি করতে হবে। কেউ চাইলে বড় গামলা বা বোলেও চাষ করতে পারবেন। বেড তৈরি হলে তাতে আগে পচনশীল বস্তু দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে পলিথিনজাতীয় কিছু বেডে না পড়ে। খাবার প্রস্তুত হলে ডিম বীজ ছাড়তে হবে। ৮-৯ দিন বয়স হলে মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ১৪-১৫ দিন বয়স হলে তা পিউপা হয়ে যায়। এগুলো আর খাওয়ানো যাবে না।
র) লার্ভার খাবার : লার্ভার খাবার হিসেবে সাধারণত যেকোন ধরনের নরম পচনশীল বস্তু ব্যবহার করা যায়। যেমন- ভাত, পচা শাকসবজি, পচা মাছ-মাংস, গোবর, মুরগীর বিষ্ঠা ইত্যাদি। লার্ভা বাদামি রঙ হয়ে গেলে আর খাবারের প্রয়োজন হয় না।
৪. প্রি-পিউপা : পিউপার বয়স ১৪-১৫ দিন হলে তা কালো রং হয়ে যায় এবং ওই অবস্থায় ৭-১০ দিন থাকে। তারপর স্টিক হয়ে যায়।
৫. পিউপা (স্টিক) : স্টিকগুলো একদম নড়াচড়া করে না; শক্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় ৭-৮ দিন থাকবে। এর মধ্যে মাছি হয়ে যাবে। মাছি হওয়ার পর খেয়াল রাখতে হবে যাতে তার ডানায় পানি না লাগে।
ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ের গুরুত্ব
পোল্ট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার : রান্না ঘরের বর্জ্যে উৎপাদিত এই পোকার লার্ভা পোল্ট্রির ফিড হিসেবে খুব ভালো ফলাফল দেয়। পোল্ট্রি ফিডে সয়াবিনের (১০-২০%) সাথে ব্লাক সোলজার ফ্লাই ফিড হিসেবে ব্যবহার করলে সব থেকে ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়। কমার্শিয়াল ফিডের থেকে এই ফিডে প্রোটিন বেশি ও উন্নত মানের। ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ে বিদ্যমান অ্যামিনো এসিড পোল্ট্রি ফিড হিসেবে এটিকে বেশি মূল্যবান করে তোলে।
মাছের খাদ্য হিসেবে : এই পোকার লার্ভা ও প্রি-পিউপা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ে প্রোটিন ও মিনারেল যথেষ্ট পরিমাণ থাকায় এটি মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি মাছের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং লিপিড এর পরিমাণ বাড়ায়। এটি খাদ্য হিসেবে ব্যবহারে কোন সমস্যা হয় না এবং মাছের গুণগত উৎপাদন বাড়ায়।
প্রাণীর খাদ্য হিসেবে : ব্লাক সোলজার ফ্লাই প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহারে খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। এটি কুমির, ব্যাঙ, শুকর, ভেড়া প্রভৃতির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরীসৃপের খাবার হিসেবে ব্যবহারে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
বায়োডিসেল প্রডাকশন : ব্লাক সোলজার ফ্লাই থেকে বায়োডিসেল আহরণ করা যায়। প্রাণীর বর্জ্য বা গোবরে চাষকৃত লার্ভা থেকে বায়োডিসেল আহরণ করা যায়। লার্ভার শরীরের লিপিড থেকে এটি তৈরি করা যায়।
কাইটিন উৎপাদন : ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ের দেহের বহিরাবরণ থেকে কাইটিন আহরণ করা যায়। এই কাইটিন বায়োটেকনোলজি, কসমেটিকস তৈরি এবং মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
জৈবসার উৎপাদন : ব্লাক সোলজার ফ্লাই লার্ভা বর্জ্য খেয়ে তা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে এবং এদের মধ্যে জৈবসারে পরিণত হয়, যা অন্যান্য মাইক্রোবিয়াল সারের মতোই কাজ করে। ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ের সার বায়ো ফার্টিলাইজার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের চেয়ে বেশি হয়। এ ছাড়াও এটি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
আর্থিক উপকারিতা : ব্লাক সোলজার ফ্লাই চাষ বা খামার করা অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। এটির খরচ কম এবং কম সময়ে উৎপাদন সম্ভব। এই কালো মাছি পোকা লো-ভ্যালু দ্রব্য যেমন- জৈব বর্জ্য থেকে হাই ভ্যালু-প্রোটিন ও মিনারেল উৎপাদন করে। দ্রুত উৎপাদিত লার্ভার খামার আর্থিক সংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। লার্ভা পোল্ট্রি ফিড ও মাছের খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। এ ছাড়াও বর্জ্য পুনপ্রক্রিয়াজাতকরণ হওয়ায় উৎপাদিত উপজাত জৈবসার হিসেবে বিক্রি ও ব্যবহার করা যায়। কম সময়ে কম পরিশ্রমে ও কম দক্ষতার দ্বারা আর্থিক সংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ খাত এটি।
পরিবেশের উপর প্রভাব : পোল্ট্রি বা লাইভস্টকের জন্য খাবার উৎপাদনে আমাদের জমির উপরে আলাদা চাপ পড়ে তাই ব্লাক সোলজার ফ্লাই ব্যবহারে জমির উপর চাপ কমবে। তাছাড়াও এদের দ্বারা পুনপ্রক্রিয়াজাতকৃত বর্জ্য পরিবেশবান্ধব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ে। পোল্ট্রি ও লাইভস্টকের নিরাপদ ফিডের উৎস হিসেবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপাদান হিসেবে টেকসই কৃষি উন্নয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আর্থসামাজিক প্রভাব : সনাতনী খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আমাদের ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ অবস্থায় উৎপাদন বাড়াতে টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অপরিহার্য। এই ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে ব্লাক সোলজার ফ্লাই একটি। টেকসই ও নিরাপদ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া এটি সারাবিশ্বে কৃষি অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে।
ব্লাক সোলজার ফ্লাই এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : পোল্ট্রি ফিড ও লাইভস্টক ফিডের আকাশচুম্বী দাম বিশ্বব্যাপী, যেখানে এ খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে, সেখানে এক বিরাট সম্ভাবনা উৎস ব্লাক সোলজার ফ্লাই। এ ছাড়াও দূষণ ও অনিরাপদ ফিডের বিকল্প হিসেবে এটির জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। ব্লাক সোলজার ফ্লাই গুণগত পোল্ট্রি, লাইভস্টক ও মাছ উৎপাদনে টেকসই পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এ ছাড়াও সারাবিশ্বে পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও এটি অন্যতম উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কোন পুঁজি ছাড়াই বা স্বল্প পুঁজিতে ব্লাক সোলজার ফ্লাই থেকে আর্থিক ও পরিবেশগত মুনাফা এটিকে ক্রমশ জনপ্রিয় করে তুলছে।
বর্তমানে বিশ্বে জনসংখ্যা ৮.৪ বিলিয়ন, যা ২০৫০ সালে ৯ বিলিয়ন হবে। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রোটিনের চাহিদা পূরণে টেকসই হাতিয়ার হিসেবে ব্লাক সোলজার ফ্লাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ব্লাক সোলজার ফ্লাই ক্রমশ, জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বসতবাড়ির আশেপাশে সহজেই এটি চাষ করা সম্ভব বলে এটি হতে পারে সম্ভাবনাময় শিল্প।
লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়। মোবাইল : ০১৭৭৪৩৫৫৭৮৭, ই-মেইল :sakhawat_sau@yahoo.com
জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা
ড. রিপন সিকদার
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় দুইটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ৮৫% বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে খরা, ভারী বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, লবণাক্ততা এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষি খাত হুমকির সম্মুখীন। প্রতি ডিগ্রি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন- গম, চাল, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন যথাক্রমে ৬.০% ৩.২%, ৭.৪% এবং ৩.১% হ্রাসের পূর্বাভাসও রয়েছে।
বৈষ্ণিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবণাক্ততাজনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লবণাক্ততা একটি প্রধান প্রাকৃতিক সমস্যা যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই ২০১২) এর তথ্য মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের ২.৮৬০ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিগত ২৫ বছরে লবণাক্ততা ১ থেকে ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে খরা এবং বৃষ্টিপাতের মাত্রা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড় মানের উপরে অবস্থান করছে। অগভীর পানির স্তর এবং সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পানির ঊর্ধ্বমুখী গতির ফলে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলে লবণাক্ততা দেখা দেয়। মূলত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন মৃত্তিকা লবণাক্ততার উপর বেশি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শুষ্ক কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য বর্ধিত তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব একে অপরের সাথে ধনাত্মকভাবে বা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লবণাক্ততা একটি পরিবেশগত সমস্যা। যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে। বিশ্বব্যাপী ৮৩১ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি কৃষি জমি লবণাক্ততা (লবণাক্ত প্রভাবিত এলাকা ৩৯৭ মি. হে ও সোডিসিটি বা ক্ষারীয় প্রভাবিত এলাকা ৪৩৪ মি. হে) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত (সূত্র : খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৭)। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচ, কম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে কৃষি জমিতে বার্ষিক ১০% হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০% এর বেশি আবাদি জমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে আবাদ সম্প্রসারণ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১-২% জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। চাষকৃত এলাকার প্রায় ৬% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলে ধান, গম ও ভুট্টার মতো প্রধান দানাশস্যের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চমাত্রার বাষ্পীভবনের কারণে মৃত্তিকা পৃষ্ঠের উপরের স্তরে লবণ জমা হয়। এই ধরনের লবণাক্ততার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি লোনা হয়ে যায়। উচ্চ পরিমাণে দ্রবণীয় লবণের সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়ন থাকে যা উপকারী পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং নাইট্রেট আয়নের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষতিকর সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়নের উপস্থিতি উচ্চমাত্রার আয়নিক লবণাক্ততা তৈরি করে, যা রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন সৃষ্টি করতে সহায়তা করে এবং ফসলের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
বীজের অংকুরোদগম থেকে শুরু করে চারা বড় হওয়া পর্যন্ত জমিতে লবণাক্ততা হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি/কৌশল অবলম্বন করা হয়ে থাকে যেমন- মৃত্তিকার ওপরের স্তর আঁচড়ানো, মৃত্তিকার উপরের স্তর অপসারণ, মানসম্পন্ন পানি দিয়ে বীজ বপনের পূর্বে জমিতে সেচ প্রদান, বীজ বপনের জন্য ফারো ও রীজ পদ্ধতি অবলম্বন, মালচিং, জমিতে গভীর চাষ দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই কৃষি এবং বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত প্রশমনের জন্য উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ ব্যতীত কতিপয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
অজৈব ও জৈব সংশোধন
লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অজৈব সার (যেমন-জিপসাম) প্রয়োগের মাধ্যমে মাটিকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সারের ক্যালসিয়াম আয়ন বিষাক্ত সোডিয়াম আয়নকে প্রতিস্থাপিত করে মৃত্তিকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। তবে মৃত্তিকার অজৈব সংশোধন ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য। উপরন্তু, এটি মৃত্তিকায় অবস্থিত উপকারী জীবাণুর জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে জৈব সংশোধনের মাধ্যমে মাটির ভৌত-রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধিত হয়। এটি লবণের লিচিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং মৃত্তিকার স্থিতিশীলতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। অজৈব সংশোধনের তুলনায় জৈব সংশোধন সস্তা এবং সহজ। জমিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগের ফলে মাটির পুষ্টি গুণ, জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং মাটির ক্যাটায়ন এক্সচেঞ্জ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জৈব পদার্থসমূহ লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে সোডিয়াম নামক বিষাক্ত আয়নের সাথে প্রতিযোগিতা করে ও উদ্ভিদের জন্য উপকারী পটাশিয়াম আয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। জৈব সংশোধনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে খামারজাত সার, পোলট্রি সার, বর্জ্য কম্পোস্ট, বায়োচার, ফ্লাই অ্যাশ, জিওলাইটস এবং মাস্টার অয়েল কেকের কম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জৈবসার এবং জিপসাম (২৫%) এর সংমিশ্রণে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ত জমিতে ৫% জিওলাইট ব্যবহার করে ক্যালসিয়াম আয়ন এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আয়রন ও ম্যাংগানিজ নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৯% ও ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, জৈব সংশোধনের কার্যকারিতা অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকা থেকে নিম্ন বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকায় বেশি কার্যকরী।
অণুজীবের ব্যবহার
রাসায়নিক ও জৈবসার ব্যবহার থেকে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের ব্যবহার অনেকগুণ ভালো বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে অধিকাংশ অণুজীবের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব। মৃত্তিকায় অবস্থিত অণুজীবগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক রাইজোব্যাকটেরিয়া (যেমন-সিউডোমোনাস, ক্লেবসিয়েলা, অ্যাজোটোব্যাকটর, অ্যান্টোরোব্যাকটর ইত্যাদি), ব্যাকটেরিয়া (যেমন-অ্যামোনিফিলাস, আথ্রব্যাক্টর, অ্যাজোস্পিরিলাম, ব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াম ইত্যাদি), মাইকোরাইজা এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া যা বিভিন্ন হরমোন এবং উপকারী পদার্থ তৈরির মাধ্যমে মৃত্তিকা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
ফাইটোহরমোনের ব্যবহার
ফাইটোহরমোন হচ্ছে এক ধরনের সিগনালিং মলিকিউল, যা উদ্ভিদ কোষে অল্প পরিমাণে থাকে। ফাইটোহরমোন স্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু (লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত) উভয় পরিবেশেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাত মোকাবিলায় অ্যাবসিসিক এসিড, সাইটোকাইনিন, জিব্রালিক এসিড, ইথিলিন, স্যালিসিলিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অক্সাইড, জ্যাসমোনেট, জ্যাসমোনিক এসিড নামক বিভিন্ন ধরনের ফাইটোহরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ- অ্যাবসিসিক এসিড লবণাক্ত পরিবেশে পত্ররন্ধের স্টোমাটা বন্ধের মাধ্যমে উদ্ভিদকে পানি ঘাটতির হাত থেকে রক্ষা করে যার ফলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ কমে যায়। আবার অ্যাবসিসিক এসিড প্রোলিন নামক অসমোরেগুলেটরি পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অসমোটিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ভিদকে লবণাক্ততাজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে সাইটোকাইনিন লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি গ্রহণ ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতিরোধ করে।
লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার
লবণাক্ত অঞ্চলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফসলের লবণ সহনশীলতার মাত্রা বিভিন্ন রকম এবং এই লবণ সহনশীলতার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ফসলকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে যেমন- লবণ সহনশীল (রায়, ক্যানোলা, সুগারবিট, তুলা, বার্লি, কেনাফ, বার্মুডাঘাস), মধ্যম মাত্রার লবণ সহনশীল (বার্লি, গম, সরগম, সয়াবিন, সূর্যমুখি, কাউপি), লবণ সংবেদনশীল (ধান) ও মধ্যম মাত্রার লবণ সংবেদনশীল (আখ, ভুট্টা, তিসি, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সিলারি, টমেটো, শসা, লেটুস, আলফা-আলফা)। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তথা লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ফসলের (যেমন- ধানের ক্ষেত্রে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, বিনা ধান২৩, ব্রি ধান৬১, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান৮, বিনা ধান১০; সরিষার ক্ষেত্রে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭) লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের চাষাবাদ খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করে।
হ্যালোফাইট এর ব্যবহার
হ্যালোফাইট বলতে এমন উদ্ভিদকে বোঝায় যা লবণাক্ত পরিবেশে নিজেতে মানিয়ে নিতে পারে এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে পারে। পান্ডানাস, পোঙ্গামিয়া, প্যানিকাম, প্লান্টাগো, পোর্টেরাসিয়া, প্রসোপিস, রাইজোফোরা, স্যালিকর্নিয়া এবং সালভাডোরা প্রজন্মের হ্যালোফাইটগুলো লবণাক্ত মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই জনপ্রিয়। এই সমস্ত হ্যালোফাইটগুলোর কতিপয় বৈশিষ্ট্য গ্লাইকোফাইটে (অধিকাংশ ফসল যা তুলনামূলকভাবে লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল) স্থানান্তরিত করতে পারলে লবণাক্ত সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং লবণাক্ত পরিবেশে গ্লাইকোফাইট উদ্ভিদসমূহকে অভিযোজিত হতে সহায়তা করবে।
গ্রাফটিং কৌশল
সাধারণত উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রাফটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে লবণসহনশীল জাতের রুটস্টক এর সাথে গ্রাফটিং করা সায়নগুলো লবণ সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদকে লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে গ্রাফটিং এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু এটি লবণাক্ত সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য একটি আশাপ্রদ কৌশল হতে পারে।
সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা
শস্যের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ, ন্যূনতম চাষ এবং শস্য বহুমুখীকরণ; এই তিনটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাটির লবণাক্ততা সঠিকভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
আধুনিক সেচ এবং নিষ্কাশন কৌশল
বিশ্বের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি টেকসই কৃষির পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সেচযোগ্য এলাকার প্রায় ৪৩% ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। অতএব, টেকসই ফসল উৎপাদনে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো প্রধানত ধান-গম শস্যপর্যায়ের উপর নির্ভর করে। এই শস্যপর্যায়ে অধিক পরিমাণে সেচের পানি (২০০-২৫০ সেমি/বছর), কৃত্রিম সার, ও শ্রমিক ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচের ফলে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ১২.২ ডেসি/মি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই লবণাক্ততা এড়াতে এবং শুকনো জমিতে পানির ঘাটতি পূরণের জন্য আধুনিক শস্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের সাথে সাথে মানসম্পন্ন সেচের পানির পরিমিত ব্যবহার অপরিহার্য।
ন্যানোপ্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান
কৃষিখাতের উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি। যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে কার্যকর। বর্তমানে কৃষি খাতে ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমিতি মাত্রায় ন্যানোমেটেরিয়ালস (যেমন- কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব), ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রনঅক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড, জিংকঅক্সাইড, সিলিকন ডাইঅক্সাইড, কিউপ্রিকঅক্সাইড, সেরিয়ামঅক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) এর ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, বায়োমাস, অসমোলাইটস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পরিবেশবান্ধব, কার্যকরী ও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজন খুবই জরুরি। উপরন্তু, লবণাক্ত এলাকায় উপরোক্ত পদ্ধতি/প্রযুক্তিসমূহের ব্যবহার এবং নিত্যনতুন গবেষণা কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭ ইমেইল : ংরশফবৎৎরঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়সজলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা
ড. রিপন সিকদার
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় দুইটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ৮৫% বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে খরা, ভারী বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, লবণাক্ততা এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষি খাত হুমকির সম্মুখীন। প্রতি ডিগ্রি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন- গম, চাল, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন যথাক্রমে ৬.০% ৩.২%, ৭.৪% এবং ৩.১% হ্রাসের পূর্বাভাসও রয়েছে।
বৈষ্ণিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবণাক্ততাজনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লবণাক্ততা একটি প্রধান প্রাকৃতিক সমস্যা যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই ২০১২) এর তথ্য মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের ২.৮৬০ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিগত ২৫ বছরে লবণাক্ততা ১ থেকে ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে খরা এবং বৃষ্টিপাতের মাত্রা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড় মানের উপরে অবস্থান করছে। অগভীর পানির স্তর এবং সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পানির ঊর্ধ্বমুখী গতির ফলে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলে লবণাক্ততা দেখা দেয়। মূলত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন মৃত্তিকা লবণাক্ততার উপর বেশি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শুষ্ক কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য বর্ধিত তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব একে অপরের সাথে ধনাত্মকভাবে বা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লবণাক্ততা একটি পরিবেশগত সমস্যা। যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে। বিশ্বব্যাপী ৮৩১ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি কৃষি জমি লবণাক্ততা (লবণাক্ত প্রভাবিত এলাকা ৩৯৭ মি. হে ও সোডিসিটি বা ক্ষারীয় প্রভাবিত এলাকা ৪৩৪ মি. হে) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত (সূত্র : খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৭)। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচ, কম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে কৃষি জমিতে বার্ষিক ১০% হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০% এর বেশি আবাদি জমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে আবাদ সম্প্রসারণ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১-২% জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। চাষকৃত এলাকার প্রায় ৬% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলে ধান, গম ও ভুট্টার মতো প্রধান দানাশস্যের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চমাত্রার বাষ্পীভবনের কারণে মৃত্তিকা পৃষ্ঠের উপরের স্তরে লবণ জমা হয়। এই ধরনের লবণাক্ততার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি লোনা হয়ে যায়। উচ্চ পরিমাণে দ্রবণীয় লবণের সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়ন থাকে যা উপকারী পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং নাইট্রেট আয়নের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষতিকর সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়নের উপস্থিতি উচ্চমাত্রার আয়নিক লবণাক্ততা তৈরি করে, যা রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন সৃষ্টি করতে সহায়তা করে এবং ফসলের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
বীজের অংকুরোদগম থেকে শুরু করে চারা বড় হওয়া পর্যন্ত জমিতে লবণাক্ততা হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি/কৌশল অবলম্বন করা হয়ে থাকে যেমন- মৃত্তিকার ওপরের স্তর আঁচড়ানো, মৃত্তিকার উপরের স্তর অপসারণ, মানসম্পন্ন পানি দিয়ে বীজ বপনের পূর্বে জমিতে সেচ প্রদান, বীজ বপনের জন্য ফারো ও রীজ পদ্ধতি অবলম্বন, মালচিং, জমিতে গভীর চাষ দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই কৃষি এবং বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত প্রশমনের জন্য উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ ব্যতীত কতিপয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
অজৈব ও জৈব সংশোধন
লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অজৈব সার (যেমন-জিপসাম) প্রয়োগের মাধ্যমে মাটিকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সারের ক্যালসিয়াম আয়ন বিষাক্ত সোডিয়াম আয়নকে প্রতিস্থাপিত করে মৃত্তিকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। তবে মৃত্তিকার অজৈব সংশোধন ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য। উপরন্তু, এটি মৃত্তিকায় অবস্থিত উপকারী জীবাণুর জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে জৈব সংশোধনের মাধ্যমে মাটির ভৌত-রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধিত হয়। এটি লবণের লিচিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং মৃত্তিকার স্থিতিশীলতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। অজৈব সংশোধনের তুলনায় জৈব সংশোধন সস্তা এবং সহজ। জমিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগের ফলে মাটির পুষ্টি গুণ, জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং মাটির ক্যাটায়ন এক্সচেঞ্জ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জৈব পদার্থসমূহ লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে সোডিয়াম নামক বিষাক্ত আয়নের সাথে প্রতিযোগিতা করে ও উদ্ভিদের জন্য উপকারী পটাশিয়াম আয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। জৈব সংশোধনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে খামারজাত সার, পোলট্রি সার, বর্জ্য কম্পোস্ট, বায়োচার, ফ্লাই অ্যাশ, জিওলাইটস এবং মাস্টার অয়েল কেকের কম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জৈবসার এবং জিপসাম (২৫%) এর সংমিশ্রণে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ত জমিতে ৫% জিওলাইট ব্যবহার করে ক্যালসিয়াম আয়ন এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আয়রন ও ম্যাংগানিজ নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৯% ও ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, জৈব সংশোধনের কার্যকারিতা অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকা থেকে নিম্ন বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকায় বেশি কার্যকরী।
অণুজীবের ব্যবহার
রাসায়নিক ও জৈবসার ব্যবহার থেকে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের ব্যবহার অনেকগুণ ভালো বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে অধিকাংশ অণুজীবের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব। মৃত্তিকায় অবস্থিত অণুজীবগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক রাইজোব্যাকটেরিয়া (যেমন-সিউডোমোনাস, ক্লেবসিয়েলা, অ্যাজোটোব্যাকটর, অ্যান্টোরোব্যাকটর ইত্যাদি), ব্যাকটেরিয়া (যেমন-অ্যামোনিফিলাস, আথ্রব্যাক্টর, অ্যাজোস্পিরিলাম, ব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াম ইত্যাদি), মাইকোরাইজা এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া যা বিভিন্ন হরমোন এবং উপকারী পদার্থ তৈরির মাধ্যমে মৃত্তিকা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
ফাইটোহরমোনের ব্যবহার
ফাইটোহরমোন হচ্ছে এক ধরনের সিগনালিং মলিকিউল, যা উদ্ভিদ কোষে অল্প পরিমাণে থাকে। ফাইটোহরমোন স্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু (লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত) উভয় পরিবেশেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাত মোকাবিলায় অ্যাবসিসিক এসিড, সাইটোকাইনিন, জিব্রালিক এসিড, ইথিলিন, স্যালিসিলিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অক্সাইড, জ্যাসমোনেট, জ্যাসমোনিক এসিড নামক বিভিন্ন ধরনের ফাইটোহরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ- অ্যাবসিসিক এসিড লবণাক্ত পরিবেশে পত্ররন্ধের স্টোমাটা বন্ধের মাধ্যমে উদ্ভিদকে পানি ঘাটতির হাত থেকে রক্ষা করে যার ফলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ কমে যায়। আবার অ্যাবসিসিক এসিড প্রোলিন নামক অসমোরেগুলেটরি পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অসমোটিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ভিদকে লবণাক্ততাজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে সাইটোকাইনিন লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি গ্রহণ ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতিরোধ করে।
লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার
লবণাক্ত অঞ্চলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফসলের লবণ সহনশীলতার মাত্রা বিভিন্ন রকম এবং এই লবণ সহনশীলতার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ফসলকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে যেমন- লবণ সহনশীল (রায়, ক্যানোলা, সুগারবিট, তুলা, বার্লি, কেনাফ, বার্মুডাঘাস), মধ্যম মাত্রার লবণ সহনশীল (বার্লি, গম, সরগম, সয়াবিন, সূর্যমুখি, কাউপি), লবণ সংবেদনশীল (ধান) ও মধ্যম মাত্রার লবণ সংবেদনশীল (আখ, ভুট্টা, তিসি, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সিলারি, টমেটো, শসা, লেটুস, আলফা-আলফা)। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তথা লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ফসলের (যেমন- ধানের ক্ষেত্রে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, বিনা ধান২৩, ব্রি ধান৬১, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান৮, বিনা ধান১০; সরিষার ক্ষেত্রে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭) লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের চাষাবাদ খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করে।
হ্যালোফাইট এর ব্যবহার
হ্যালোফাইট বলতে এমন উদ্ভিদকে বোঝায় যা লবণাক্ত পরিবেশে নিজেতে মানিয়ে নিতে পারে এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে পারে। পান্ডানাস, পোঙ্গামিয়া, প্যানিকাম, প্লান্টাগো, পোর্টেরাসিয়া, প্রসোপিস, রাইজোফোরা, স্যালিকর্নিয়া এবং সালভাডোরা প্রজন্মের হ্যালোফাইটগুলো লবণাক্ত মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই জনপ্রিয়। এই সমস্ত হ্যালোফাইটগুলোর কতিপয় বৈশিষ্ট্য গ্লাইকোফাইটে (অধিকাংশ ফসল যা তুলনামূলকভাবে লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল) স্থানান্তরিত করতে পারলে লবণাক্ত সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং লবণাক্ত পরিবেশে গ্লাইকোফাইট উদ্ভিদসমূহকে অভিযোজিত হতে সহায়তা করবে।
গ্রাফটিং কৌশল
সাধারণত উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রাফটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে লবণসহনশীল জাতের রুটস্টক এর সাথে গ্রাফটিং করা সায়নগুলো লবণ সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদকে লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে গ্রাফটিং এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু এটি লবণাক্ত সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য একটি আশাপ্রদ কৌশল হতে পারে।
সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা
শস্যের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ, ন্যূনতম চাষ এবং শস্য বহুমুখীকরণ; এই তিনটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাটির লবণাক্ততা সঠিকভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
আধুনিক সেচ এবং নিষ্কাশন কৌশল
বিশ্বের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি টেকসই কৃষির পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সেচযোগ্য এলাকার প্রায় ৪৩% ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। অতএব, টেকসই ফসল উৎপাদনে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো প্রধানত ধান-গম শস্যপর্যায়ের উপর নির্ভর করে। এই শস্যপর্যায়ে অধিক পরিমাণে সেচের পানি (২০০-২৫০ সেমি/বছর), কৃত্রিম সার, ও শ্রমিক ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচের ফলে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ১২.২ ডেসি/মি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই লবণাক্ততা এড়াতে এবং শুকনো জমিতে পানির ঘাটতি পূরণের জন্য আধুনিক শস্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের সাথে সাথে মানসম্পন্ন সেচের পানির পরিমিত ব্যবহার অপরিহার্য।
ন্যানোপ্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান
কৃষিখাতের উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি। যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে কার্যকর। বর্তমানে কৃষি খাতে ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমিতি মাত্রায় ন্যানোমেটেরিয়ালস (যেমন- কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব), ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রনঅক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড, জিংকঅক্সাইড, সিলিকন ডাইঅক্সাইড, কিউপ্রিকঅক্সাইড, সেরিয়ামঅক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) এর ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, বায়োমাস, অসমোলাইটস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পরিবেশবান্ধব, কার্যকরী ও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজন খুবই জরুরি। উপরন্তু, লবণাক্ত এলাকায় উপরোক্ত পদ্ধতি/প্রযুক্তিসমূহের ব্যবহার এবং নিত্যনতুন গবেষণা কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭ ইমেইল : ংরশফবৎৎরঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়স
পাহাড়ের জুমে সমভূমি তুলা (কার্পাস)
আবাদ ও ফলন বৃদ্ধির কৌশল
সুবীর কুমার বিশ্বাস
বাংলাদেশের তুলার উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক বুঝতে শিখেছে তুলা চাষের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলার নতুন জাত ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে সদা জাগ্রত বাংলার কৃষকের পাশে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক, যার প্রধান কাঁচামাল তুলা। তুলার দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাতে আমদানি ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খইল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। এই ভোজ্যতেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টরেল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫-২০% তেল পাওয়া যায়, যা সয়াবিন তেলের আমদানি ব্যয় কমাতে সক্ষম। খইলে রয়েছে উচ্চ প্রোটিন ২৪%, উচ্চফ্যাট ২০% এবং ক্রুড আঁশ ৪০%, যা পশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া তুলার পাতা মাটির জৈবসার বৃদ্ধিতে সহায়ক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল তুলা উৎপাদনের জন্য কার্পাস মহল হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে জমির উর্বরতা হ্রাস, পাহাড়ি জাতের তুলা বীজের কম ফলন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দিন দিন তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ের জুমে সমভূমি তুলা (কার্পাস) আবাদের ব্যবস্থা করেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাহাড়ের জুমে এই জাতের তুলা উৎপাদনের মাধ্যমে ফলন অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই এই জাতের তুলা উৎপাদনের সঠিক ব্যবস্থাপনা জানা প্রয়োজন।
বপনের সময়
পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল/আগাছা পরিষ্কার করে তুলা বীজ বপন করা হয়। এপ্রিল ও মে মাসে পাহাড়ি তুলা এবং জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত আপল্যান্ড তুলার (সমভূমি তুলা) বীজ বপনের উপযোগী সময়। পর্যাপ্ত বৃষ্টির পর মাটির জো আর ঠা-া হলে পাহাড়ের ঢালে জুমে মে মাসেও তুলা বীজ বপন করা হয়। তবে আবহাওয়া ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাহাড়ের ঢালে জুমে চারা তৈরির মাধ্যমে তুলা চাষ করা যায়।
বপনের পদ্ধতি
একক ভাবে জুমে/ধানের সাথে/ছোট চারার ফলজ বনজ বাগানে তুলা ফসল আবাদ করা যায়। তাছাড়া বৃষ্টির পানি জমে না বা বন্যার পানি উঠে না এমন উঁচু জমি তুলা চাষের উপযোগী। জুমে ৩-৪ হাত দূরে লাইন দেওয়া যায়। সাধারণত একক তুলায় সমতলে/ পাহাড়ে দুই হাত (৯০ সেমি.) সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারা এক হাত (৪৫ সেমি.) দূরত্বে বপন করা হয়। তুলার বীজ মাটি সামান্য গভীরে (সর্বোচ্চ ১/৪ ইঞ্চি গভীর) বর্ষার ফাঁকে ফাঁকে বপন করতে হবে। বপন করার পর বীজ হালকা মাটি/জৈবসার দিয়ে ঢেকে দিলে চারা গজাতে সহজ হয়। দুই থেকে তিন দিন পর চারা গজায়।
পলিব্যাগে বা আম পাতা সেলাই করে (নারকেলের শালাকা দিয়ে), ছোট প্যাকে, ফেলে দেওয়া কাগজের কাপে চারা তৈরি করে ১৫-৩০ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করা যায়। তাছাড়া, নার্সারিতে চারা তৈরি করেও (মরিচ/বেগুন চারার ন্যায়) শিকড়ে ইকোস্প্রিন ১৫০ মিগ্রা. প্রতি লিটার পানিতে মাত্রায় আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে অপরাহ্নে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়।
সার ব্যবস্থাপনা
তুলা ফসলে সবটুকু রাসায়নিক সার একবারে প্রয়োগ না করে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য কয়েক কিস্তিতে (২-৪ কিস্তিতে) প্রয়োগ করা হয়। তুলা ফসলে রাসায়নিক সারের মাত্রা কানি (৪০ শতক) প্রতি ইউরিয়া : টিএসপি : এমওপি : জিপসাম : দস্তা : বোরন ৩০:৩৫:৪০:১৫:২:২ কেজি। জমিতে আগাছা হলে তা পরিষ্কার করে গাছের গোড়া থেকে প্রায় ৪ ইঞ্চি দূরে গর্তে ফাঁস (সার) দিতে হয়। তাছাড়া বিশেষজ্ঞগণ মতামত দেন যে, কানি (৪০ শতক) প্রতি ১৫-২০ মণ জৈবসার (কম্পোস্ট বা গোবর বা পোলট্রি লিটার সার বা কেঁচো সার ইত্যাদি) প্রয়োগে রাসায়নিক সার কম লাগে এবং মাটির স্বাস্থ্য ও পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। অতঃপর গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং জঙ্গল/খড়কুটা দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি ঢেকে দিতে হবে (জৈব মালচিং)। এতে সার (ফাস) ও মাটি ধুয়ে যায় না, তুলা গাছের খুব উপকার হয়।
বালাই ব্যবস্থাপনা
জাব, জ্যাসিড, থ্রিপস প্রভৃতি পোকা দমনের জন্য কনফিডর/ইমিটাফ/ফটিক ৭০ ডব্লিউডিজি ৪ গ্রাম প্রতি ১৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে চিবিয়ে খাওয়া পোকা দমনের জন্য “হাত বাছাই” এর পর লিবসেন/ট্রেসার অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স সাধারণত ৬০-৭০ দিন হলে ৩য় কিস্তির সার (ফাস) প্রয়োগ করতে হবে এবং সাধারণত ৮০-৯০ দিন বয়স হলে গাছের শীর্ষ ডগা ভেঙ্গে দেয়া যায়।
গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে ২য় কিস্তির ফাস প্রয়োগের পর ফসলের অবস্থা বুঝে (যদি বাড় বাড়তি ভালো হয়) তবে গাছ খাটো রাখতে “রূপালী বাম্পার”(ম্যাপিকুয়েট ক্লোরাইড) প্রয়োগ করতে হবে ১-১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে। আর বাড়-বাড়তি সতেজ রাখতে ফ্লোরা পিজিআর প্রয়োগ করা ভালো। তাছাড়া, লাগাতার ঝড় বৃষ্টির মধ্যে (সাধারণত সেপ্টেম্বর- নভেম্বর মাস) আগাম চাষকৃত তুলা ফসলের কুঁড়ি-ফুল-ফল ঝরে পড়া রোধে ঝড় বৃষ্টির আগে একবার এবং ঝড়-বৃষ্টির পরে আরও একবার প্লানোফিক্স/ক্রপসকেয়ার/সুপারফিক্স পিজিআর প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলি মাত্রায় মিশিয়ে বিকেলে বা ঠা-া আবহাওয়ায় স্প্রে করতে হবে।
তুলা গাছের স্বাভাবিক ফলন বৃদ্ধির জন্য ১৬টি ফল ধারণ শাখার উপর থেকে তুলা গাছের মাথা কেটে দিতে হয়। এই ডিটপিং প্রক্রিয়া তুলার ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ তুলা ফসলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়। গাছের পরিস্থিতি, আবহাওয়া, মাটির অবস্থা অনুসারে সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ প্রয়োগ করলে খরচ কম হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। এতে কৃষক অধিক লাভবান হতে পারে।
তুলা উত্তোলন
সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে তুলা উত্তোলন শুরু হয়। ঠা-া ও শুকনা অবস্থায় তুলা তুলতে হয়। ভেজা তুলা তুললে তা ওজনে কমে যায়। বৃষ্টির পর তুলা উত্তোলন করা ঠিক না। সাধারণত বৃষ্টি হলে এরপর ২-৩ দিন রোদে তুলা শুকালে উত্তোলন শুরু করতে হয়। এতে তুলা উত্তোলনও সহজ হয় এবং সময় কম লাগে। তুলা উত্তোলনের পর পরিবহনের জন্য জিনার কর্তৃক বস্তা সরবরাহ করা হয়। উত্তোলনকৃত তুলা বস্তায় সংরক্ষণ করা হয় এবং জিনারের নিকট বিক্রয় করা হয়। সাধারণত একই মাঠ থেকে মোট তিনবার তুলা উত্তোলন করা হয়।
তুলা বাজারজাতকরণ
যেকোন ফসলের বাজারজাতকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক বাজার ব্যবস্থার অভাবে কৃষক ঐ ফসলে চাষের আগ্রহ হারায়। এক্ষেত্রে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের চেষ্টায় তুলার বাজারজাতকরণ সবচেয়ে কৃষকবান্ধব। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে সারাদেশে তুলার এক মূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং কৃষক থেকে জিনার সরাসরি তুলা ক্রয় করে থাকে। এক্ষেত্রে কোন মধ্যস্বত্বভোগীর অবস্থানের সুযোগ নেই।
সতর্কতা
রূপালী বাম্পার কেবল মাত্র মাঠ কর্মীর উপস্থিতি/ অনুমোদন ক্রমে ব্যবহার করতে হবে। কনফিডর/ ফটিক বার বার প্রয়োগ না করে গাছের বয়স ৭০-৮০ দিনের পর জ্যাসিডের আক্রমণ বেশি হলে অন্য গ্রুপের কীটনাশক পেগাসাস প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মাত্রায় একবারই মাত্র প্রয়োগ করতে হবে। (পেগাসাস বার বার ব্যবহার করলে গাছের আগা শুকিয়ে যায় ও ফুল-ফল ভালো হয় না)। জমিতে রসের অভাব দেখা মাত্র পানি তুলে দিতে হবে। ঠা-া ও শুকনা তুলা মাঠ থেকে তুলতে হবে। পোকা রোগাক্রান্ত ও দাগযুক্ত ও অর্ধ ফুটন্ত তুলা আলাদা তুলতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হয়, অতিরিক্ত ইউরিয়া তুলা গাছের জন্য ক্ষতিকর। এমওপি সার ইউরিয়া থেকে বেশি ব্যবহার করতে হয়। চারা গাছে রাসায়নিক সার তুলনামূলক কম ব্যবহার করে পরবর্তীতে সার ব্যবহার আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দিতে হয়।
সাথী ফসল
তুলার সাথে ধান, লালশাক, মুলা, বরবটি, ভুট্টা, ধনিয়া, পাট, হলুদ, মরিচ, পিয়াজ, গীমাকলমী, মুগ, মারফা ইত্যাদি সাথী ফসল হিসেবে এবং আইল ফসল হিসেবে কুমড়া, শিম, ঝিঙা, করলা ইত্যাদি আবাদ করা যায়। এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের সাথে সাথে কৃষক অধিক লাভবান হতে পারে। এ ছাড়া সাথী ফসল চাষের ফলে আগাছা নিয়ন্ত্রণের খরচ অনেক কমে যায়। সাথী ফসল চাষের ফলে জমিতে আগাছা কম হয়।
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা বহুকাল ধরে অবহেলিত ছিল। পশ্চাৎপদ এই জনগোষ্ঠী বহুকাল ধরে আধুনিকতা থেকে ছিল অনেক দূরে। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতি নানা কারণে তাদের উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। দিন বদলের স্লোগান নিয়ে সরকার এগিয়ে এসেছে পাহাড়ি এলাকার জনগণের পাশে। আর সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে তুলা উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ের মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য পাহাড়ের ঢালে সমভূমি তুলা (কার্পাস) চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই জাতের তুলা আবাদের মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকার কৃষকগণ আর্থিকভাবে সাবলম্বী হতে পারবে।
লেখক : তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, আঞ্চলিক কার্যালয়, চট্টগ্রাম। মোবাইল : ০১৭৪৭১৬৫০৬৯, ই-মেইল : cdoctg@cdb.gov.bd
পরিবেশ সুরক্ষায়
তালগাছ
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তালগাছ পরিবেশ সংকটে প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন খরায় পুড়ছে মাটি, সংকটে পড়েছে মাটির নিচে থাকা পানিস্তর, বাড়ছে শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো বজ্রপাতের দুর্যোগ। সব দুর্যোগ মোকাবেলা করে ঠায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সেই তালগাছ। পাখিরা তা জানে, অথচ মানুষ জানে না। বাবুই বাসা বাঁধে তালগাছে, বাদুড় ঝোলে তালগাছে, শকুন ও ঈগল আশ্রয় নেয় তালগাছে। সারাদিন মাঠে চড়ে বেড়ানো ময়ূরও রাতে ঘুমায় তালগাছের মাথায়। টিয়াপাখি ডিম পাড়ে তালগাছের উপরে। এজন্য কোনো কোনো দেশে তালগাছকে মনে করা হয় শক্তির প্রতীক হিসেবে। ধারণা করা হয় তালগাছ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যার কাছ থেকে আমরা পাই কাঁচা ও পাকা ফল, কাঠ, পাতা, রস, মোম ইত্যাদি।
শতবর্ষী তাল
‘এক পুরুষে রোপে তাল/ অন্য পুরুষি করে পাল। তারপর যে সে খাবে/ তিন পুরুষে ফল পাবে।’ খনার এ বচনটি মোটেই মিথ্যে নয়। একটা তালগাছ বাঁচে একশো বছরেরও বেশি আর লম্বা হয় প্রায় একশো ফুট। লাগানোর পর সে গাছে তাল ধরতে সময় লাগে প্রায় বিশ বছর। অনেকে এজন্য তালগাছ লাগিয়ে তার ফল খেয়ে যেতে পারে না। একটা তালগাছে পঁচিশ থেকে চল্লিশটা পাতা থাকে। এতো বড় পাতা খুব কম গাছের থাকে। একটা গাছে বছরে ছয় থেকে বারোটা কাঁদিতে তিনশোটা পর্যন্ত তাল ধরে। পুরুষ গাছে ফল ধরে না, পুরুষ ফুলের জটা হয়। জটা কেটে রস নামানো হয়। মেয়ে গাছে ফল ধরে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে তালগাছে ফুল ফোটে ও রস হয়। দেড় থেকে দু মাস ধরে পুরুষ পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল ফুটতে থাকে। মার্চ-এপ্রিলে তালের রস নামে। এপ্রিল-মে মাসে কচি তালের শাঁস হয় ও আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তাল পাকে। অক্টোবর-নভেম্বরে তালের আটি থেকে গ্যাঁজ হয় ও ভেতরে ফোঁপা হয়।
তালগাছকে বলা হয় কল্পবৃক্ষ অর্থাৎ এ গাছের কাছে বেঁচে থাকার জন্য যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। এ গাছ থেকে পাওয়া যায় রস, গুড়, চিনি, তালমিশ্রি, তালশাঁস, তাল ফল, তাল ফোঁপা, নারিকেলের মতো বীজের শাঁস থেকে তেল ইতাদি খাদ্য। এমনকি তালের আটি থেকে সদ্য গজানো অংকুর বা গ্যাঁজ সিদ্ধ করে খাওয়া যায় যা পুষ্টিকর। পাকা ফলের আঁশ পাওয়া যায় রেয়নের মতো সুতা যা দিয়ে তৈরি করা যায় বস্ত্র, বাসস্থান নির্মাণের জন্য তালকাঠের চেয়ে শক্ত কাঠ আর কি আছে! তালগাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যে যুগে কাগজ আবিষ্কার হয়নি, সে যুগে তালপাতা ব্যবহৃত হতো লেখার জন্য। এখনো অনেক জাদুঘরে তালপাতার পুঁথি দেখা যায়। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা- মানুষের এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদার সবই পূরণ করতে পারে তালগাছ। তালগাছের বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি কারুপণ্য যেমন হাতপাখা, টুপি, ব্যাগ, বর্ষাতি, মাথাল, ঝুড়ি উপার্জনের উৎস। তালের রস আফ্রিকায় মদ ও বিয়ার তৈরির অন্যতম উপকরণ। একটি গাছ থেকে বছরে প্রায় দেড়শো লিটার রস পাওয়া যায়।
বজ্রযোগী তাল
তালগাছ যেন এক বজ্রযোগী, মানুষ ও প্রাণীকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে চলেছে সেই অনাদিকাল থেকে। যেসব এলাকায় লম্বা লম্বা তালগাছ বেশি, সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কম। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য দুর্যোগের সাথে বজ্রপাতও এক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফাঁকা মাঠে কাজ করতে থাকা অনেক কৃষক বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন। যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, বিগত এক দশকে (২০১০-২০১৯) বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ২৫৭১ জন, এর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামের মানুষ ও ৮৪ শতাংশ পুরুষ। চলন বিল ও হাওরে তাই অনেকেই আর কৃষি কাজ করতে যেতে চাইছেন না। ২০১৬ সালে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার সে বছর ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে অন্তর্ভুক্ত করে। সরকার বজ্র নিরোধক হিসেবে তালগাছ লাগানোর ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে বিল বা খোলা স্থানের মধ্য দিয়ে যেসব রাস্তা গিয়েছে তার দুইপাশে এবং জমির আইলে তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেয়া দরকার।
খনার বচনে ‘কুয়ো হয় আমের ভয়/তাল তেঁতুলের কিবা ভয়!’ অর্থাৎ কুয়াশায় আমের মুকুল নষ্ট হয় কিন্তু তাল ও তেঁতুলের কিছুই হয় না। এটাও তালের প্রতি প্রকৃতির আশীর্Ÿাদ। সে কারণেই হয়তো আজও তাল টিকে আছে বরেন্দ্রভূমির মতো খরাপীড়িত মাটিতেও ও শৈত্যপ্রবাহের দেশে।
এ দেশেও স্বাধীনতার আগে যে পরিমাণ তালগাছ ছিল এখন তা নেই। এখন তালগাছ লাগানোর যেমন লোক নেই, তেমনি তালগাছে উঠে রস নামানো ও তাল পাড়ার লোকও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। দেশে তালগাছ কমে যাচ্ছে। সেজন্য আমরা শাস্তিও কম পাচ্ছি না। দেশে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। এজন্য সরকারিভাবে দেশে তালগাছ রোপণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, আমাদেরকে সে উদ্যোগকে বেগবান করতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (অব.), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrity@gmail.com
বাউ সালাদ কচু সালাদ পরিবারে নতুন সদস্য
ড. এম এ রহিম১ ড.সুফিয়া বেগম২
বাউ সালাদ কচু Araceae পরিবারভুক্ত একবীজপত্রী হার্বসজাতীয় উদ্ভিদ। এই প্রজাতিটি মূলত বান্দরবান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হয়। খাদ্য সংকটে খাদ্য ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে । বাউ সালাদ কচু স্থানীয়ভাবে সালাদ কচু নামে পরিচিত। এটি কাঁচা অবস্থায় সালাদ হিসাবে খাওয়া যেতে পারে এবং গলা চুলকায় না। বাউ সালাদ কচু একটি অপ্রচলিত গুরুত্বপূর্ণ কন্দজাতীয় উদ্ভিদ যা বাণিজ্যিকভাবে বৃষ্টিবহুল উচ্চ জমি, বাড়ির বাগান এবং ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরের বহুতল ভবনের খালি ছাদে বেড তৈরি করে বা টব, জিও ব্যাগ, ড্রামে চাষাবাদ করা যায়। আন্তঃফসল পদ্ধতিতে যেমন- কলাগাছ, আনারস বা অন্যান্য বহুবর্ষজীবী ফসলের সাথে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যায়। সালাদ কচু ট্রপিক্যাল অঞ্চল যেমন: থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও জাপানসহ অন্যান্য এশিয়ান দেশে প্রচুর চাষ হয়।
এ দেশে খরিফ মৌসুমের এটি মূলত শাকসবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় যখন বাজারে অন্যান্য শাকসবজি সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের মতো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলে ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত জায়গায় চাষাবাদ হতে পারে। করম, পাতা, পাতার ডাঁটা শাকসবজি এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চারা বা সাকার বীজ হিসাবে বিক্রয় করা যায়।
সালাদ কচু সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য। এটি মাইক্রো-পুষ্টি ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ। এছাড়াও আলসার, ডায়াবেটিস, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি জাতীয় রোগ নিরাময়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি কাঁচা সালাদ খাওয়ার ফলে পুষ্টিমান অক্ষুণœ থাকে। জিংক বেশি পরিমাণে থাকার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি মেধার বিকাশ হয়। ক্ষুধা মন্দা দূর হয়, আয়রন ও ক্যালসিয়ামের জন্য শারিরিক দুর্বলতা দূর হয়।
বাউ সালাদ কচু জাতটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন একটি জাত। উদ্ভিদের প্রকৃতি অর্ধখাঁড়া এই ফসলের পাতাগুলোর আকার ঢেউ খেলানো ও পেটিওল লম্বা হয়। পাতাগুলো হৃদয়ের আকারের এবং খাঁড়া প্রকৃতির, পাতা হলুদাভ ও নিলাভ সবুজ। পাতার উপরিভাগ গ্লেসি রঙের হয়।
কচুতে মারাত্মক কোন রোগ ও পোকামাকড় দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে (Catter piller) পোকা আক্রমণ করে এবং পাতায় গর্ত করে বাসা বাঁধতে চেষ্টা করে। ফলে পাতার মান নষ্ট হয়। আক্রমণ দেখা দিলে ১০ লি: পানিতে ২৫ গ্রাম রিডোমিল মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। সুমিথিয়ন অথবা রিপকর্ড অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করা যেতে পারে। কবুতর ও মুরগী কচি পাতা ভক্ষণ করে ফসল নষ্ট করে। তাই প্রয়োজনে নেট/জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
বর্তমানে সৌখিন কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন দৌলতপুর, কুষ্টিয়া, কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক মাসিক কৃষিকথায় প্রকাশিত বাউ সালাদ কচু সম্পর্কে জানতে পারে। তিনি বাউ সালাদ কচু চাষে আগ্রহী হন। লেখকের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ অনুযায়ী ৫০টি চারা সংগ্রহ করে এক শতক জমিতে বাউ সালাদ কচু চাষ করেন।
বিশেষভাবে আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেন পতিত, অব্যবহৃত এবং সোলার প্যানেল এর নিচে যেখানে অন্যান্য ফসল উৎপাদন সম্ভব না সেখানে অনায়াসে এ ফসল চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। তার কাছ থেকে অন্যান্য চাষিরা চারা নিয়ে চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছে। তারা বাউ সালাদ কঁচু সালাদ খেয়ে ও রান্না করে উল্লেখ করেছেন এটি খাওয়ার পর গলা চুলকায় না, সুস্বাদু। এছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক মাহবুবুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ মাসুদ রেজা বাসার ছাদে টবে লাগিয়ে প্রতিদিন খাবারের টেবিলে সালাদ হিসেবে গ্রহণ করছেন।
বান্দরবান জেলার চাষিদের মতে, ২টি পাতাসহ ডাঁটা ১০ টাকা করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বডি সালাদ কঁচু নিয়ে ইঞঠ এবং অঞঘ বাংলা টিভিতে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। এতে করে প্রচুর নতুন কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। এ পর্যন্ত চারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন : খুলনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, রাজবাড়ি, ময়মনসিংহ, ভোলা, ঢাকা জেলায় আগ্রহী চাষিরা/বাগানিরা বাড়ির ছাদে বারান্দায় টবে অথবা পতিত জমিতে চাষ করছেন।
বাউ সালাদ কচু চাষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে অনুশাসন বাস্তবায়ন হচ্ছে।
লেখক: ১প্রফেসর (অব) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭৭২১৮৮৮৩০, ২সহকারী অধ্যাপক (অব:) একেইউ ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজ। মোবাইল: ০১৭১৬৬০৭৫৬৬, ই-মেইল :sufia_beg@yahoo.com
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য সেক্টরের অবদান
মোঃ মাসুদ রানা (পলাশ)
বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণে মৎস্য সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, আমাদের খাদ্যের প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ। দেশের জিডিপির ৩.৫৭ শতাংশ ও কৃষিজ জিডিপির ২৬.৫০ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১.২৪ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২)। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশে^ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬.২১ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের উৎপাদনের প্রায় ছয় গুণ। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে উন্নীত হবে যার নামকরণ হবে “স্মার্ট বাংলাদেশ”। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চারটি মূলভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এগুলো হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে দেশের শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, অর্থনীতি, গবেষণা ও প্রকৌশলসহ সকল খাতকে স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর করা। কৃষির উপসেক্টর মৎস্য খাতকে স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, বেকারত্ব দূরীকরণ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, অল্প পুঁজিতে অধিক লভ্যাংশ অর্জনসহ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভবপর হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য সেক্টরের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসমূহ বর্ণনা করা হলো-
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে স্মার্ট টেকনোলজির ব্যবহার : মৎস্য চাষে পানির পিএইচ, অ্যামোনিয়া, তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেনসহ অন্যান্য নিয়ামকসমূহ স্মার্ট টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন নিয়ামকগুলোর সেন্সর পুকুরে থাকবে যেখান থেকে নিয়মিত তথ্য মোবাইল অ্যাপস এ আসবে যা দেখে খামারি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ামকগুলোর মান নির্ধারিত মাত্রার থেকে কমবেশি হলে স¥ার্ট টেকনোলজির মাধ্যমে ঘরে বসেও সমাধান করা সম্ভব যা মাছকে রোগজীবাণু থেকে নিরাপদ রাখবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। ফিস ফিডার ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা সম্ভব, এমনকি এই টেকনোলজি ব্যবহার করে ঘরে বসেও মাছের খাবার দেওয়া সম্ভব, যা খাবারের অপচয় রোধ করবে এবং মাছের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে খামারিকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে সহায়তা করবে। ইমেজ প্রসেসিং টেকনোলজির মাধ্যমে পুকুরের বিভিন্ন স্তরের মাছের ছবি সংগ্রহ করা যায়, যা সরাসরি মোবাইল অ্যাপস বা সফটওয়ারে সন্নিবেশিত হয়, যা সফটওয়ারের মাধ্যমে বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাছের বিস্তৃতি, দৈহিক বৃদ্ধি ও বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করে।
মাছ বাজারজাতকরণ টেকনোলজির ব্যবহার (স্মার্ট ফিস মার্কেটিং) : মাছের বাজারব্যবস্থায় গুচ্ছ আকারে মধ্যস্বত্বাভোগী থাকার কারণে মাছ চাষিরা তাদের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এমনকি চাষিরা চাইলেই অনান্য পন্যের মতো মাছ বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারে না। খামারিরা যে দামে মাছ বিক্রি করে ভোক্তা তার প্রায় দ্বিগুণ দামে মাছ ক্রয় করে, পুরো টাকাটা চলে যায় মধ্যস্বত্বাভোগীদের পকেটে, ফলশ্রুতিতে খামারি ও ভোক্তা দুই পক্ষই লোকসান গুনছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবায়িত ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে আমরা আজ অনলাইন মার্কেটিং সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাছ কেনাবেচার ক্ষেত্রে স্মার্ট ফিস মার্কেটিং সিস্টেম এখন সময়ের দাবি। স্মার্ট ফিস মার্কেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে খামারিরা তাদের উৎপাদিত মাছ কোন আড়তে দাম কেমন তা খামারে বসে থেকে মোবাইল অ্যাপসের সহায়তায় জানতে পারবে এবং যেখানে বাজারমূল্য বেশি সেখানে বাজারজাত করে অধিক লাভ করতে পারবে।
মৎস্য আহরণ জাহাজ ও জেলেদের সুরক্ষায় স্মার্ট টেকনোলজির ব্যবহার : বঙ্গোপসাগরে যে ট্রলারগুলো বা জাহাজগুলো মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে বের হয় তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান, মৎস্য আহরণ ক্ষেত্র খুঁজে পেতে সহায়তা প্রদান, ঝড়ে বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে কোন জেলে মারা গেলে বা নিখোঁজ হলে তার লাশ খুঁজে পেতে স্মার্ট টেকনোলজি রাখতে পারে অনন্য ভূমিকা। এক্ষেত্রে জেলেদের হাতে ঘড়ির মতো ডিভাইস থাকবে যা পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ফলশ্রুতিতে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়া জাহাজ বা জেলেকে খুব সহজেই খুঁজে বের করা যাবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেমের সহায়তায় জেলেরা খুব সহজেই মৎস্য আহরণ ক্ষেত্রসমূহ খুঁজে পাবে এবং মাছ ধরা শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে। সমুদ্রের পানি যেহেতু স্বচ্ছ তাই ইমেজ প্রসেসিং টেকনোলজি ব্যবহার করে জেলেরা ট্রলার থেকে মাছের ঝাঁকের গতিবিধি লক্ষ করতে পারবে, রাডার, সোনার ব্যবহার করেও মাছের ঝাঁকের অবস্থান, পরিধি ও দূরত্ব নিরূপণ করা যায় ফলে জেলেরা স্মার্ট টেকনোলজির সহায়তায় অল্প সময়ে অধিক মাছ আহরণ করতে পারবে যা তাদের উপার্জন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে।
মৎস্য সেবা ত্বরান্বিতকরণ ও মাছচাষিদের প্রশিক্ষণে স্মার্ট টেকনোলজির ব্যবহার : মাছ চাষিরা তাদের চাষ শুরু থেকে শেষ অবধি নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন যেগুলো তৎক্ষণাৎ সমাধানে ব্যর্থ হলে লোকসানের শিকার হতে হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের সহায়তায় মাছচাষিদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান মৎস্য অফিসার বা মৎস্য বিশেষজ্ঞগণ এখন ঘরে বসেই দিতে পারেন। মৎস্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন মাছ চাষিদের অনলাইনভিত্তিক সেবা দিয়ে আসছে, যেমন বাংলাদেশ মৎস্য হাসপাতাল নামক একটি সংগঠন ২০১৬ সাল থেকে মাছচাষিদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে চলেছে, তারা তাদের কাজের সুবিধার জন্য বিভিন্ন এলাকায় সার্ভিস বুথ চালু করেছে। দেশ ডিজিটাল হওয়ার সুবাদে খামারিরা এখন যেকোন সমস্যা তড়িত সমাধান পাচ্ছে, যা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি তথা অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দেশ স্মার্ট হলে মৎস্য অধিদপ্তরের দূরপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন আরও বেগবান হবে ফলে দেশে মৎস্য সেক্টরে তৈরি হবে অসংখ্য জনবল যা দরিদ্রতা দূরীকরণ, বেকারত্ব দূরীকরণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ইলিশ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে স্মার্ট টেকনোলজির ব্যবহার : ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, যা এখনো অবদি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি, উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার উপর। মৎস্য অধিদপ্তরের সঠিক ব্যবস্থাপনায় গত কয়েক বছরে ইলিশের উৎপাদন গাণিতিক হারে বেড়েছে। ইলিশ ব্যবস্থাপনা বলতে মূলত প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষা, জাটকা সংরক্ষণ ও জাটকা ও মা ইলিশের চলাচলের পথ সচল রাখা, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা ও অনান্য কর্মকা-। আমরা যদি প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে পরিপূর্ণ ডিম ছাড়তে দেওয়া ও জাটকা ধরা বন্ধ করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমরা নদীতে কোথায় মা ইলিশ বা জাটকা আহরণ করা হচ্ছে তা শনাক্ত করা সহজতর হবে এবং তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও মাইক্রো বা ন্যানো চিপ টেকনোলজি ব্যবহার করে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদী ও নদী থেকে সমুদ্রে আসা যাওয়ার পথ নিরূপণ করা যাবে। সুতরাং স্মার্ট টেকনোলজির মাধ্যমে মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ করা ও দেশের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভবপর হবে।
মৎস্য সেক্টরের গবেষণায় স্মার্ট টেকনোলজির ব্যবহার : মৎস্য সেক্টরের নানাবিধ গবেষণা যেমন ফিস পপুলেশন ডিনামিক্স, স্টক এসেসমেন্ট, মাইগ্রেটরি পথ চিহ্নিতকরণসহ অনান্য কাজে মাইক্রো বা ন্যানো চিপ ডিভাইস ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার গবেষণা ভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণাকে বেগবান করা সম্ভব। অঁঃড়হড়সড়ঁং টহফবৎধিঃবৎ ঠবযরপষবং ব্যবহার করে গবেষকরা সমুদ্রের গভীরে বিভিন্ন মাছের পপুলেশন, পানির বিভিন্ন প্যারামিটার ও অন্যান্য তথ্যাদি খুব সহজেই সংগ্রহ করতে পারবে, যা সমুদ্রে কোন অঞ্চলে মাছের প্রাপ্যতা কেমন, কোন এলাকায় কি মাছের আধিক্য বেশি তা স্পষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব ফলশ্রুতিতে সমুদ্রে নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড খুঁজতে যন্ত্রটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্তির পথে তাদের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক ট্যাগ ব্যবহার করে সমুদ্রের কোন অঞ্চলে এসব প্রাণি ব্রিডিং ও নার্সিং করে থাকে তা খুব সহজেই নির্ধারণ করা ও ঐ এলাকাগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
আমাদের রয়েছে ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সুবিশাল সমুদ্র সম্পদ যেখানে রয়েছে অপার সম্ভাবনা ও আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সম্পদ। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে মৎস্য ভা-ার যার খুব অল্প পরিমাণ আমরা আহরণ করতে পারি কারণ গভীর সমুদ্রের সকল স্তর থেকে মাছ আহরণ করার মতো ট্রলার আমাদের নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমুদ্রে মাছ চাষ করা হয় কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিন্তু আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়া ৫০ বছর অতিক্রম করলেও আমরা সমুদ্র মাছ চাষের চিন্তা করতে পারিনি। আমাদের এই সুবিশাল সমুদ্র তথা ব্লু ইকোনমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে সমুদ্রে মাছ চাষ বা মেরিকালচার করা জরুরি যা আমাদের দেশের মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে বিশে^ মাছ উৎপাদনে ১ম বা ২য় স্থান অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট টেকনোলজির মাধ্যমে আমরা সমুদ্রে মাছ চাষ করে দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি তথা অর্থনীতিকে মজবুত করতে পারব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হার্ভেস্ট, টেকনোলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল : ranadof.bd@gmail.com
গুড অ্যানিমেল হাজবেন্ডি প্রাকটিস ও স্মার্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে প্রাণিজাত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন
কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমান
সারাদেশে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সাধারণত বেশির ভাগ দুধ উৎপাদন করেন আর অল্প কিছু বড় কৃষক বাণিজ্যিক আকারে দুগ্ধ ব্যবসা করেন। এই দুগ্ধ খামারসমুহ সম্প্রতিকালে বিদ্যমান জীবিকায়ন থেকে আরও বাজারভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যা দেশীয় এবং বিশ্ব বাজারের ভোক্তাদের সন্তুষ্টির দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে গরু ও মহিষ প্রধানত দুগ্ধজাত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যান্য প্রজাতি যেমন মহিষ ও ছাগলের চেয়ে গবাদি পশুকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়; যদিও বর্তমানে মহিষ দুধ উৎপাদনকারী প্রাণী হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে, যা সরকারি উদ্যোগের কারণে সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশে প্রায় ২৪.৭০ মিলিয়ন গবাদি পশু, ১.৫০ মিলিয়ন মহিষ এবং ২৬.৭৭ মিলিয়ন ছাগল (DLS২০২২) রয়েছে। মোট ৮.৭২ মিলিয়ন দোহনকারী গাভীর মধ্যে ৪.৬২ মিলিয়ন (৫৩%) দেশী এবং ৪.০৪ মিলিয়ন (৪৭%) ক্রস ব্রিড গবাদিপশু রয়েছে। ক্রস ব্রিড বেশির ভাগ হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল এবং সিন্ধি জাতের। দুগ্ধ খাতে ক্ষুদ্র কৃষকদের আধিপত্য ছিল। ৭০% এরও বেশি দুগ্ধ খামারিরা ক্ষুদ্র কৃষক এবং মোট ৭০-৮০% দুধ উৎপাদন করে, দেশের মোট দুধের বাকি (৩০-২০%) আসে বাণিজ্যিক দুগ্ধ খামার থেকে (উদ্দীন এট আল, ২০২০)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন । একটি সুস্থ জাতি না থাকলে আমরা স্মার্ট নাগরিক খুঁজে পাবো না, যা স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম স্তম্ভ। স্বাস্থ্যকর জাতির জন্য খাদ্য নিরাপদতা গুরুত্বপূর্ণ। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে, বাংলাদেশে প্রাণীপালন স্মার্ট ফার্মিং-এ রূপান্তরিত হচ্ছে, এইশিল্প বিপ্লব (4IR) শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং অটোমেশন প্রযুক্তির সমন্বয়ে। স্মার্ট ফার্মিংয়ের মধ্যে রয়েছে রিয়েল-টাইম সেন্সর যা পরিধানযোগ্য স্মার্ট কলার, মেশিন লার্নিং ডেটা বিশ্লেষণ এবং ক্লাউডভিত্তিক ডেটা সেন্টারের সাহায্যে খামার থেকে ডেটা সংগ্রহ করে যা ডেটা পরিচালনা করে এবং পণ্যের গুণমান পরিচালনার জন্য কৃষককে সহায়তা করতে পারে। প্রাণী উৎসিত খাদ্য পণ্যে সাধারণত এক ধরনের সাধারণ মাইক্রোবায়োটা থাকে, যার মধ্যে উপকারী জীবাণু ও প্যাথোজেন থাকে। এ ছাড়াও, এই পণ্যগুলো পরবর্তীতে সম্ভাব্য খাদ্যবাহিত রোগজীবাণু, যেমন সালমোনেলা এসপিপি, এসচেরিচিয়া কোলি, স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস, ক্যাম্পিলোব্যাক্টর এবং অন্যগুলোর সাথে দূষণের ঝুঁকিতে থাকে। খাদ্যজনিত রোগজীবাণু ছাড়াও মাংস, দুধ ডিম এবং এর উপজাতগুলোতে এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী জিন থাকতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য সরাসরি হুমকি তৈরি করে। প্রাথমিক উৎপাদনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, রাসায়নিক এবং কীটনাশকের নির্বিচারে ব্যবহার দেশের খাদ্য ও খাদ্যপণ্যের নিরাপদতাকে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বে ২০০টিরও বেশি রোগের কারণে ৫৫০ মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং প্রতি বছর অনেক মানুষ মারা যায় অনিরাপদ খাবারের কারণে। স্ট্যান্ডার্ড অনুশীলন যেমন- গুড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিস (GAHP), খামারের যাবতীয় কার্যাবলীর সাথে জড়িত খাদ্যের নিরাপদতার চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে পারে।
স্মার্ট ফার্মিং এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গুড এনিমেল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিসের ব্যবহার দুগ্ধ ও প্রাণিসম্পদ খামারের ক্ষেত্রে কিছুটা আশাব্যঞ্জক চিত্র রয়েছে। গবাদি প্রাণির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গ্রামীণফোন ‘ডিজিগরু’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছে। কাঞ্চন, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের মাসকো ডেইরি ফার্ম এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার গবাদিপশুর খামারটিকে দেশের প্রথম ডিজিটাল প্রাণিসম্পদ খামার (মাস্কো ডেইরি ফার্ম) বানিয়েছে । ২০১৯ সালে, Digi Cow,IoT ভিত্তিক ডিজিটাল লাইভস্টক ম্যানেজমেন্ট সলিউশন, Masco Dairy Enterpriseএ চালু করেছিল। এই উরমর ঈড়ি প্রযুক্তি গরুর খাদ্য, বিভিন্ন আচরণ, উর্বরতা ও স্বাস্থ্যের অবস্থা ইত্যাদি, তথ্য বিশ্লেষণ করে দুগ্ধ খামারিদের সহজে গরুর স্বাস্থ্য, উর্বরতা এবং পঙ্গুত্ব নিরীক্ষণ তথ্য পেতে পারে। সূর্যমুখী প্রাণি সেবা গবাদি প্রাণীর প্রযুক্তি, বীমা এবং অন্যান্য পরিষেবাসহ দুগ্ধ খামারগুলোতে সহায়তা করছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার ডাচ ডেইরি ফার্মটি স্মার্ট প্রযুক্তির সমন্বয়ে সুসজ্জিত। ইওন গ্রুপ রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় দেশের প্রথম স্বয়ংক্রিয় দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা প্রধানত অন্যান্য দুগ্ধভিত্তিক পণ্য যেমন ঘি, দই এবং আইসক্রিমের পাশাপাশি পাস্তুরিত দুধ তৈরি করে, যা বারাকাহ ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করা হয়। খামারটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রাণীখাদ্য প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে দুগ্ধ দহন ও দুধের প্যাকেজিং পর্যন্ত কোনরকম হাতের ব্যবহার করা হয় না। প্রতিটি গরুর স্বাস্থ্য, খাদ্য গ্রহণ, ওষুধের প্রয়োগ এবং প্রজনন পর্যবেক্ষণের জন্য আইওটি সেন্সর স্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের স্মার্ট ফার্মিং প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ দুধের চাহিদা পূরণের কাজ চলছে।
একটি আইনিকাঠামোর মধ্যে স্মার্ট ফার্মিং কার্যক্রমগুলোকে বেগবান করার জন্য, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ, অর্থায়ন, বীমা, আন্তর্জাতিক বাজারে অভিগম্যতার সহায়তা প্রদান, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, কার্যক্রমের তদারকি ও মূল্যায়ন ইত্যাদি এখন সময়ের চাহিদা। এজন্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বতন্ত্র স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দরকার। আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড অ্যাক্ট,২০২২ প্রণয়ন করছে। এই আইনের অধীনে একটি দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হবে যা এই খাতের উন্নয়নের বিষয়ে সব ধরনের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) অনুসারে, ভারত এখন বিশ্বের এক নম্বর দুধ উৎপাদক দেশ। ডেইরি বোর্ড ভারতকে শীর্ষ দুধ উৎপাদক দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমরা চাই ভারতের মতো বাংলাদেশেও ডেইরি বোর্ড দুধ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডেইরি বোর্ডের আওতায় ডেইরি খামারের জন্য গুড প্র্যাকটিস প্রটোকল তৈরি করতে হবে,যা গুড ডেইরি প্র্যাকটিস নামে অভিহিত হতে পারে। গুড প্র্যাকটিস (জিপি) চারটি স্তম্ভ নিয়ে গঠিত যেমন ইহা অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক ভাবে স্থায়িত্বশীল এবং খাদ্যে নিরাপদতা থাকবে। এটি অবশ্যই প্রযুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সেটআপের একটি ইউনিক মিশ্রণ যা, কৃষকদের জীবিকার উপর উল্লেখযোগ্য এবং টেকসই প্রভাব ফেলে । এছাড়াও এটি সাপ্লাই চেইনের সকল অংশীজনকে সংবেদনশীল করে, একত্র করে এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করে যা, বিভিন্ন প্রচলিত এবং সুপারিশকৃত অনুশীলনের সংকলন।
গুড অ্যানিমল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিস খামার অনুশীলনের ন্যূনতম মানগুলো নিশ্চিত করে যা ভোক্তাদের চূড়ান্ত পণ্যগুলো সম্পর্কে আস্থা প্রদান করে এবং মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। এ ধরনের উত্তম চর্চাগুলো বা অনুশীলনগুলো পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে খামার শ্রমিক এবং প্রাণী উভয়ের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিত করে। ASEAN দেশগুলো GAHP-এর একটি অভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে। এটিকে ASEAN মেম্বার স্টেট/সদস্য রাষ্ট্র (AMS) জুড়ে প্রবর্তন করেছে যেমন ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাও চউজ, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন এবং সিঙ্গাপুর। সদস্য রাষ্ট্রগুলো AMS) ইতিমধ্যেই ASEAN মুরগির মাংস এবং ডিম শিল্পে খাদ্য নিরাপদতার জন্য একটি সাধারণ GAHP প্রটোকল তৈরি করেছে। বাংলাদেশে প্রাণি উৎপাদিত খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করার জন্য প্রাণী পালন অনুশীলন, প্রাণী কল্যাণ, জীব নিরাপত্তা, প্রাণী স্বাস্থ্য পরিচর্যার পাশাপাশি খামারে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য এঅঐচ-এর অভিন্ন নির্দেশিকা নেই। এঅঐচ নির্দেশিকাগুলোকে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানি বাজারে পৌঁছানোর লক্ষ্য তৈরি করতে হবে; বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রকল্পভিত্তিক এঅঐচ মডিউল/ম্যানুয়াল/গাইডলাইন তৈরি হয়েছে । এসব এঅঐচ মডিউল/ম্যানুয়াল/গাইডলাইন আন্তর্জাতিক মানদ-ের সাথে সঙ্গতি রেখে সংশোধিত করতে হবে যা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত এবং বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সাথে মিল রেখে তৈরি করতে হবে । উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ট্রেড ফেসিলিটেশন প্রকল্পের আওতায় গুড লাইফস্টক হাজবেন্ড্রী প্র্যাকটিস ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (ইউনিডো) এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় রুমিনেন্ট খামার, মুরগির খামার; অ্যানিমল মার্কেট, অ্যানিমল ট্রান্সপোর্ট, কসাইখানার পোস্টমর্টাম ও এন্টিমর্টাম ইনস্পেকশনের জন্য GAHP প্রটোকল তৈরি করেছে এবং বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া হয়েছে। এ সকল প্রটোকল সমূহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর একটি স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে গুড অ্যানিমল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিস পলিসি ও বাস্তবায়ন কৌশল তৈরি করতে পারে, যা স্মার্ট লাইফ স্টক ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) প্রাণিজাত খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করতে এবং জনস্বাস্থ্য সম্ভাব্য ঝুঁকি কমানোর নিমিত্তে গুড অ্যানিমল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিস মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং এ অনুযায়ী ডেডিকেটেড ইন্সপেকশন সিস্টেম চালু করা উচিত। পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে তালমিলিয়ে বলতে চাই ‘আমারা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাআল্লাহ এ দিন থাকবে না। গুড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি প্র্যাকটিস ইতোমধ্যে ডেভেলপ হয়েছে, প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে বাস্তবায়ন করলেই আমরা স্মার্ট লাইভস্টক ফার্মিংয়ের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে পারব।
লেখক : জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা। মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৯৬৯৭, ই-মেইল : smrajiurrahman@yahoo.com
দেশেই উৎপাদন হচ্ছে বিদেশী ফল স্ট্রবেরি ও ড্রাগন
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম
স্ট্রবেরি চাষ করে প্রথম বছরেই তাক লাগিয়ে দেয় চুয়াডাঙ্গার রুহুল আমীন রিটন। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার পেয়ারাতলা গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় রিটনের। তাই পরিবারের অর্থনৈতিক কষ্ট দূর করতে অতি অল্প বয়সে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ২০০২ সালে এসএসসি পাস করার পরেই তিনি ধান কিনে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। এভাবে কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। স্বল্প পরিসরে ব্যবসা চলতে থাকে। কিন্তু রিটন সব সময়ই স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করার, দেশের জন্য কিছু করার। তিনি নিজেকে একজন বড় উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেন। এ ভাবনা প্রতিনিয়ত তাকে নতুন কিছু করার তাগিদ দেয়। ২০১৬ সালে ব্যবসার সামান্য পুঁজি ব্যবহার করে তিনি চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথমে তিনি জীবননগর উপজেলার খয়েরহুদা মাঠে বত্রিশ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলম্ব লেবু ও বারোমাসি (ঙউঈ ৩) জাতের সজিনার চাষ শুরু করেন। কিন্তু মৌসুমের মাঝামঝি যখন ফল ধরতে থাকে, তখন তিনি লক্ষ্য করেন এ ফসলগুলো বাজারজাতকরণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য। ফসল বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, মূলধন তুলে আনাই কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষতি হয় প্রায় সাতাশ লক্ষ টাকা। কিন্তু হাল ছাড়লেন না পেয়রাতলা গ্রামের শিক্ষিত স্বনির্ভর যুবক রুহুল আমিন।
যখন তিনি বুঝলেন কলম্বো লেবু ও সজিনা চাষে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তিনি একই জমিতে আন্তঃফসল হিসেবে থাই পেয়ারা ৩ লাগালেন। ২০১৮ সালে থাই পেয়রা গাছ থেকে ফলন পেতে শুরু করেন। প্রথম বছর থাই পেয়ারা বিক্রি করে লাভ করেন প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা। বর্তমানে ৪ হেক্টর জমিতে পেয়ারা বাগান রয়েছে। এই পেয়ারা বাগান থেকে প্রতি বছর বিঘা প্রতি প্রায় ২৭০ মণ পেয়ারার ফলন পান। পরবর্তী বছরগুলোতে লাভের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি ৭০ লক্ষ টাকা লাভ করেন শুধু পেয়ারা বাগান থেকেই।
এখানেই শেষ নয়, শুরু হয় নতুন পথের যাত্রা। ২০১৮ সালে মাত্র ৪ বিঘা জমিতে বারি ড্রাগন ১ জাতটির চাষাবাদ শুরু করেন। ২০১৯ সালে এখান থেকে লাভ করেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। বর্তমানে ৬৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন। এখানে ১ লক্ষ ৭০ হাজার গাছ রয়েছে। ড্রাগন ফল একটি লাভজনক ফসল। এ ফসল চাষে প্রথম বছর একটু খরচ বেশি হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে তেমন খরচ হয় না। রিটনের ড্রাগন বাগানে হেক্টর প্রতি ফলন হয় ২৯.৫০ টন। ড্রাগন ফল চাষে তিনি মোট বিনিয়োগ করেন ৫৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। প্রতি বছর গড়ে উৎপাদন খরচ হয় ১১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং লাভ হয় প্রায় সাড়ে চল্লিশ লক্ষ টাকা। ড্রাগনের পাশাপাশি তিনি স্ট্রবেরি, পেয়ারা, আনার, আঙ্গুরসহ বেশকিছু ফলের চাষ শুরু করেছেন।
তিনি এক খ- জমিতে কমপক্ষে দুই ধরনের ফল গাছ লাগিয়েছেন। ফলে প্রায় সারাবছরই জমি থেকে আয় হচ্ছে। ড্রাগন বাগানে ফল ধরে সাধারণত মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। বাকি সময় কৃষক রিটন নভেম্বর মাসে ড্রাগন বাগানের শেডের পাশেই নতুন শেড তৈরি করেন। আর সেই শেডের পাশেই স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করে ড্রাগন ফলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে চল্লিশ বিঘা জমিতে লাগান আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল জাতের স্ট্রবেরি। এখানে ৯৫ হাজার গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ছত্রাক লেগে প্রায় ৩০ হাজার চারা মারা গেছে। স্ট্রবেরী চাষে তিনি সম্পূর্ণ জৈবসার ব্যবহার করেছেন। কচুরিপানা থেকে উৎপাদিত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে মাদা তৈরি করেন। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোং এ চিনি উৎপাদনের পর উপজাত দ্রব্য থেকে তৈরি জৈবসার প্রতি মাদার চারিদিকে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেন। তিনি সেচের পানিতে ১:১০০ অনুপাতে সরিষার খৈল প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সরিষার খৈল ও পানি ১:১০ অনুপাতেও প্রয়োগ করে থাকেন। ভাতের মাড়, আখের গুঁড়, গরুর মূত্র ও খেসারি ডালের বেসন এ উপাদানগুলো পানিতে মিশিয়ে একপ্রকার জৈবসার তৈরি করে তিনি নিজেই পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেন। চারা রোপণের ৭০-৮০ দিনের মধ্যে ফল বিক্রির উপযুক্ত হয়। সে ফল দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় শহরে চাহিদার তুলনায় দামও বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম বারেই বড় অংকের লাভের আশা করছেন কৃষক রুহুল আমিন। স্ট্রবেরি ১,০০০-১,২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাগানে বর্তমানে ৬৫ হাজার স্ট্রবেরি গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে ৭০০-৯০০ গ্রাম পর্যন্ত ফল পাওয় যায়। স্ট্রবেরি বিক্রি করে তিনি প্রথম বছরেই স্থানীয় কৃষকসহ অনেকেরই নজর কাড়েন। শুধু তাই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই দেখতে আসেন রুহুল আমিন রিটনের খামার। যেহেতু প্রথমবারের মতো এ জাতের স্ট্রবেরি আবাদ করা হয়েছে সেহেতু কিছুটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু স্ট্রবেরি উৎপাদনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় এবারেই। স্থানীয় বাজারে তেমন একটা পরিচিতি না থাকলেও ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে এর চাহিদা অনেক। তাই বাজার দর বেশ ভালো।
রিটনের স্ট্রবেরি বাগানে প্রায় প্রতিদিনই ৫০-৬০ জন দিনমজুর কাজ করে। এদেরকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। এখানে কাজ করে অনেকেরই জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। রিটনের বাগানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলে ৫০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। এক বেলা কাজ করলে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। স্ট্রবেরি চাষে তিনি বিনিয়োগ করেন ২৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত তিনি ৩৩ লক্ষ ৯ হাজার টাকার স্ট্রবেরী বিক্রি করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে স্ট্রবেরি উত্তোলন ও বিক্রি শুরু করেন।
রিটন তার এ খামারের নাম দিয়েছেন গ্রীন প্লানেট এগ্রো। এ যেন সত্যিই চোখ জুড়ানো এক খ- সবুজ।
রিটনের উৎপাদিত ফসলের পরবর্তী ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পক্ষ থেকে উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় একটি পলিসেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সেডে তিনি উৎপাদিত ফসল বাছাই, পরিষ্কারকরণসহ বাজারজাত এর জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।
রবি মৌসুমে ৪০ বিঘা জমিতে ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯, ব্রিধান ৪৯ ও ব্রিধান ৫১ বোরো ধানের চাষ করেন। এছাড়া তিনি ১০ কাঠা জমিতে বারি সূর্যমুখী-৩, সূর্যমুখী ৮ বিঘা জমিতে ভুট্টা-৭৫৫ ও ২ বিঘা জমিতে চাঁপাকলা ও নেপালি কলা চাষ করেছেন। আরো রয়েছে সাগর কলা, বল সুন্দরী কুল, থাই আমলকী। পরীক্ষামূলকভাবে ওয়ান্ডারফুল, মোলর, ডলসি, হিকাজ, পারসিয়াংকা, সফটসিড-১, সফটসিড-২, সফটসিড-৪, ভাগোয়া, সুপার ভাগোয়া, গণেশসহ প্রায় ষোলটি জাতের আনার গাছ, রেডগ্লোভ, ব্লাক ম্যাজিক, ওয়ান্ডারফুল, সোনাকা, সুপার সোনাকা, ইসাবিলা, নিরো, কার্ডিনাল, ক্রিমসন, বিডিগো, থমসন, নানা শাহেদ পার্পল, মামা জাম্বো, শরৎসিডলেস, ফ্লেমসহ আরো দশ প্রজাতির আঙ্গুর গাছ লাগিয়েছেন।
রুহুল আমিন রিটনের এ বাগান দেখতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই। অনেকে আসেন বাগানের নৈস্বর্গীক পরিবেশে কিছুটা সময় পার করতে। অনেকে আবার পরামর্শ নেন কিভাবে গড়ে তোলা যায় এ রকম একটি বাগান। বেকার ও কর্মসংস্থানহীন যুবক সমাজের জন্য রিটন একটি দৃষ্টান্ত।
লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা। মোবাইল : ০১৭১৬৭৬৮৮২১, ই-মেইল : aiskhulna1@gmail.com
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ আয়েশা সুলতানা
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: ফজলুল হক, উপজেলা : কিশোরগঞ্জ, জেলা : নীলফামারী।
প্রশ্ন : ধানের ছড়ার গায়ে কালো দাগ হয় এবং ছড়া খোলের মধ্যে আটকে থাকে। করণীয় কী?
উত্তর : ধানের খোলপঁচা রোগের কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে।Sarocladivm oryzac নামক জীবাণু দ্বারা এ রোগের বিস্তার ঘটে। কার্বোডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- দ্বারা বীজ শোধন করে নিলে সুফল পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৩ গ্রাম হারে ১ লিটার পানিতে গুলে এক রাত ভিজিয়ে রাখতে হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে পরিমিত পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। জমির পানি শুকিয়ে আবার পানি দিতে হবে। প্রয়োজনে আক্রমনকালে ছত্রাকনাশক যেমন প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি হারে বিকাল বেলা স্প্রে করতে হবে। পরবর্তীতে আবাদের জন্য এবং অন্য ফসলে রোগ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফসল কাটার পর ক্ষেতের নাড়া পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
মো: সাইফুল ইসলাম, উপজেলা : নলছিটি, জেলা : ঝালকাঠি।
প্রশ্ন : চালকুমড়া গাছের কা-ে এবং পাতায় সাদা পাউডারের মতো দাগ দেখা যায়। প্রতিকার কী?
উত্তর : Oidium spp ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের প্রতিকারে সঠিকমাত্রায় সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম সালফার ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে অথবা ম্যানকোজেব + মেটালেক্সিল ২ গ্রাম/হেক্সাকোনাজল ১ মিলি/কার্বেন্ডাজিম ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকাল বেলা স্প্রে করা যেতে পারে। পরবর্তী ফসলের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছের পরিত্যক্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
মো: মিঠুন মল্লিক, উপজেলা : চৌগাছা, জেলা : যশোর।
প্রশ্ন : বেগুনের কচি ডগা ঢলে পড়ে মারা যায়। কী করতে পারি?
উত্তর : বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এ পোকা দমনে প্রতিরোধ সহনশীল লম্বাজাত বেগুন চাষ করা যেতে পারে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার আক্রান্ত ডগা ও ফল ছিঁড়ে ধ্বংস করতে হবে এবং জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথ ধরে এদের বংশ কমানো যেতে পারে। আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানিতে কার্বোসালফান ৩ মিলি/কারটাপ ২.৫ গ্রাম/থারইপার মেথ্রিন ১ মিলি হারে স্প্রে করতে হবে।
মো: দুলাল, উপজেলা : নওয়াবগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর।
প্রশ্ন : কচি নারিকেল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। করণীয় কী?
উত্তর : Phytopthors palmivora নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের প্রতিকারে আক্রান্ত গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানিতে সানডিট ৪ গ্রাম বা ডাইথেন এম-৪৫ ২.৫ গ্রাম বা বর্দোমিকচার (১%) মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত নারিকেল সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলতে হবে।
মোহাম্মদ আলী, উপজেলা : মান্দা, জেলা : নওগাঁ।
প্রশ্ন : পটলে পানি ভেজা নরম পচা রোগ দেখা যায়, পরবর্তীতে পটল গাছসহ পটল নষ্ট হয়ে যায়। এর সমাধান কী?
উত্তর : Rhizoctonia sp নামক এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে। একে পটলের গোড়া ও ফল পচা রোগ বলা হয়। ফলে বা গাছে এ রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ বা পটল সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে এবং প্রতি বছর পটল চাষ না করে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাসহ সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। পটলের শাখা ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন/নোইন প্রতি লিটার পানিতে ভিজিয়ে শোধন করে লাগাতে হবে। রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি প্রপিকোনাজল/২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন/১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম/২ গ্রাম ম্যানকোজেব+ মেটালেক্সিল মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
মো: আনোয়ার হোসেন, উপজেলা : মির্জাপুর, জেলা : টাঙ্গাইল।
প্রশ্ন : পেঁপের মোজাইক রোগ সম্পর্কে জানতে চাই?
উত্তর :Apis gossypi হচ্ছে এ রোগের বাহক। পেঁপে গাছের যে কোন বয়সে এ রোগ হতে পারে। পাতার উপর হালকা হলুদ ও গাড় সবুজ রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। গাছের ফল কম হয় এবং বিকৃত ও ছোট হয়। এ রোগের প্রতিকারে আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে বা নষ্ট করতে হবে। ভাইরাসের বাহক জাব পোকা ও সাদা মাছি ডাইমেথয়েড ০.২% /ইমিডাক্লোরোপ্রিড ০.২% হারে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, কাঁঠালিয়া, ঝালকাঠি। সংযুক্ত : কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৬৫৩২৫৫; ই- মেইল : ayesha_sultana07@yahoo.com
আশ্বিন মাসের কৃষি
(১৬ সেপ্টেম্বর - ১৬ অক্টোবর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
আশি^ন মাস। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শুভ্র কাশফুল, সাদা মেঘ, সুনীল আকাশ। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কচি ধান বাতাসের সাথে সাথে দুলছে। বৃক্ষরাজির সবুজপাতা ও মাটি সিক্ত করে স্বচ্ছ শিশির যা অবসাদগ্রস্ত মনটা আপ্লুত হয়ে উঠে। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে প্রকৃতি বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রকৃতির এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।
আমন ধান
আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিতাপাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে অথবা কৃষি কাজে পানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে পানির অপচয় অনেক কম হয়। শিষ কাটা লেদাপোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খোলপোড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। সঠিক রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাবি আমন রোপণ
কোন কারণে আমন সময়মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।
তুলা
এ সময় তুলাক্ষেতে গাছের বয়স ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গোড়ার সবচেয়ে নিচের ১-২টি অঙ্গজ শাখা কেটে দেয়া ভালো। লাগাতার বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ হেলে পড়লে পানি নিষ্কাশনসহ হেলে যাওয়া গাছ সোজা করে গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে। ইউরিয়া, এমওপি ও বোরনসহ অন্যান্য অনুখাদ্য নিয়মিতভাবে পাতায় প্রয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ সময় রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা গেলে সঠিক বালাই শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাট
নাবি পাট ফসল উৎপাদনে এ সময় গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সমান রেখে অতিরিক্ত গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ১৫-২০ দিনে এবং তৃতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ৪০-৪৫ দিনে প্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। এ সময় সবজি ও ফল বাগানে সাথী ফসল হিসেবে বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন।
আখ
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করা উচিত। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বিনা চাষে লাভজনকভাবে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি সরিষা জাত (বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০ ইত্যাদি) চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জায়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায় যেমন- মুলা, লালশাক, পালংশাক, চীনাশাক, সরিষাশাক অনায়াসে করা যায়। সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করা যায়।
কলা
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত কৃষক-কৃষানির কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্ত প্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলাবাগানে সাথী ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়।
সরকারিভাবে মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে জি-৯ কলার টিসু কালচার চারার উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। এ জাতের কলার ফলন অন্য জাতের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি, সুস্বাদু ও রোগ প্রতিরোধী। মাত্র ৮-৯ মাসের মধ্যে কলা পাওয়া যায়।
গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট হলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে। বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখনই। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
এসময় তাল পাকে। তালের চারা তৈরি করার জন্য উত্তম মাতৃগাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পরিপক্ব তালের উপরের শক্ত খোসা ছাড়িয়ে কিছু সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে হাত দিয়ে কচলিয়ে আঁশ হতে রস বের করতে হবে। প্রতিটি তালে সাধারণত তিনটি করে বীজ থাকে এবং রস সংগ্রহ করার সময় বীজগুলো পৃথক হয়ে যাবে। বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজতলায় বপন করতে হবে। বীজ শুকিয়ে গেলে অঙ্কুরোদগম হবে না। পরিপক্ব তালের বীজের অঙ্কুরোদগমের হার সাধারণত ৭০-১০০ ভাগ।
আশ্বিন মাসে নিয়মিত কৃষি কাজের পাশাপাশি সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। খাদ্য নিরাপত্তায় ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অভিযান খুবই জরুরি। এককভাবে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোন লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের জনগণকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের বৈজ্ঞানিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আসুন সবাই একসাথে ইঁদুর দমন করি। সবাই ভালো থাকি।
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : editor@ais.gov.bd