নারিকেল অর্থকরী ফল ও তেলজাতীয় ফসল। খাদ্য বা পানীয় হিসেবে আমরা নারিকেলের যে শাঁস ব্যবহার করি তা পুরো নারিকেলের ৩৫ শতাংশ মাত্র। বাকি ৬৫ শতাংশ হলো খোসা ও মালা। নারিকেলের মালা দিয়ে বোতাম, অ্যাক্টিভেটেট কাঠ কয়লা, বাটি, খেলনা, কুটির শিল্প, চামচ ও খোসা থেকে আঁশ এবং আঁশজাত দ্রব্য যেমন- দড়ি, মাদুর এসব তৈরি হয়। দড়ি তৈরি করার সময় খোসা থেকে যে তুষ বের হয় তা পচিয়ে উৎকৃষ্ট জৈবসার তৈরি করা যায়। যশোর ও বাগেরহাট অঞ্চলে নারিকেল খোসার আঁশ ব্লিচিংয়ের মাধ্যমে সাদা করে বিদেশে রফতানি করা হয়। তাছাড়া গ্লিসারিন, সাবান ও কেশ তেল তৈরিতে নারিকেল ব্যবহৃত হয়। ইদানিং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ভোজ্যতেল হিসেবেও নারিকেল তেল উৎকৃষ্ট। নারিকেলের চোবড়ার ঝুরা দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের বীজ চারা উৎপাদন মিডিয়া হিসেবে নার্সারির বেডে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্রায় ৩৫ কোটি নারিকেল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দেশে প্রায় ১০ কোটি নারিকেল উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ মাত্র ৩ ভাগের ১ ভাগ চাহিদা মিটানো যায়। শ্রীলঙ্কায় যেখানে বছরে মাথাপিছু নারিকেলের ব্যবহার ১৪০টি সেখানে বাংলাদেশে ব্যবহার হয় ১টি নারিকেল।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন নারিকেল উৎপাদন হয়। মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নারিকেল ডাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ৪৫ শতাংশ ঝুনা নারিকেল হিসেবে খাওয়া হয়, ৯ শতাংশ দিয়ে তেল তৈরি হয় এবং অবশিষ্ট ৬ শতাংশ হতে চারা করা হয়। সারা বিশ্বে নারিকেল উৎপাদন হয় তেল তৈরির জন্য আর বাংলাদেশে নারিকেল চাষ হয় ফল ও পানীয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য। পানীয় বা শাঁস যেভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন তাতে নারকেলের মাত্র ৩৫ শতাংশ ব্যবহার হয়ে থাকে; বাকি ৬৫ শতাংশ মালা, ছোবড়া ও পানি সমন্বয়ে গঠিত যা অব্যবহৃতই থেকে যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর খোসা, মালা ও পানি থেকে অতিরিক্ত ৫-১০ গুণ বেশি উপার্জন করা সম্ভব। নারিকেল থেকে তুলনামূলকভাবে কম উপার্জন হলেও তা সারা বছরব্যাপী হয়। নারিকেলের শাঁস ও ডাবের পানিতে বিভিন্ন প্রকার খনিজ পদার্থ ও প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-ই ও ফ্যাটি এসিড আছে যা শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে ও রোগ জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। তাই জাতীয় জীবনে পুষ্টি চাহিদা পূরণে নারিকেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও নারিকেল ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নারিকেল বেশি উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার। কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত উপকূলীয় দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে বিশাল নারিকেল বাগান। যে কারণে দ্বীপটির স্থানীয় জনপ্রিয় নাম হলো নারিকেল জিঞ্জিরা। উপকূলীয় অঞ্চলে এ রকম আরও বাগান প্রতিষ্ঠা করে দেশে নারিকেল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ মিটার উচ্চতায় নারিকেল জন্মানো যায় অনায়াসে। এছাড়াও রামুতে বীজ তৈরির উদ্দেশ্যে পাহড়ের কোল ঘেঁসে গড়ে তোলা হয়েছে ২৫০ হেক্টর এলাকায় বিশাল বাগান। নারিকেল পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার প্রতি খুবই সংবেদনশীল। তাই এলাকভিত্তিক জাত নির্বাচন করে রোপণের জন্য যথাযথ মানের বীজ সংগ্রহ করা ভালো। যে এলাকাতে নারিকেল গাছের সংখ্যা বেশি সে এলাকায় নারিকেল গাছে ফলও ধরে বেশি। নারিকেলের ফলন, শাঁসের গুণাবলি ও বীজ নারিকেলের মান পরাগায়ন দ্বারা প্রভাবিত হয়।
একই ধরনের যত্ন নেয়া সত্ত্বেও কোনো গাছে খুব দেরিতে ফল আসে আবার কোনো গাছে তাড়াতাড়ি ফল আসে। আবার কোনো কোনো গাছে বছরে ৩০ থেকে ৪০টি আবার কোনো গাছে ১০০টির বেশি নারিকেল জন্মে। ইদানিং খাটো জাতের নারিকেল আবাদ শুরু হয়েছে। এসব জাতে ৩ বছরের মধ্যেই নারিকেল ধরে এবং প্রতি বছর ২০০ থেকে ২৫০টি নারিকেল ধরে। এজন্য মানসম্মত বীজমাতা নির্বাচন করা দরকার। বীজমাতা নির্বাচনে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যেখানে একসাথে অনেক গাছ থাকে সেখান থেকে বীজমাতা নির্বাচন করতে হয়। বছরে ১০০টির বেশি নারিকেল উৎপন্ন করার ক্ষমতা এবং ৩০ কেজির বেশি শাঁস দিতে সক্ষম এমন বীজমাতা হওয়া দরকার। বীজমাতা ২০ থেকে ৬০ বছর বয়সের হওয়া ভালো এবং গাছ সুঠাম, সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া নির্বাচিত গাছের পাতার সংখ্যা অধিক ও সুশৃঙ্খল বিন্যাসের হওয়া জরুরি। পাতার বোঁটা খাটো আকারের এবং প্রশস্ত ধরনের হলে ভালো হয়। তাছাড়া বীজমাতার নারিকেল মাঝারি থেকে বড় আকারের এবং নারিকেলের আকৃতি গোল ধরনের হলে বুঝতে হবে বীজমাতা সরস। নারিকেল চাষের জন্য ভারি মাটির চেয়ে হালকা মাটিতে গাছের শিকড় ভালো জন্মায়। নারিকেল গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পানি জমলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। নারিকেল সাধারণত দুই প্রকার। লম্বা ও খাটো। বাংলাদেশে প্রায় সব নারিকেল গাছই লম্বা ধরনের। তবে ইদানিং খাটো জাতের নারিকেল আবাদ শুরু হয়েছে।
নারিকেলে আছে হাজারো সমস্যা। এর মধ্যে নারিকেলে মাকড় আক্রমণ ইদানিংকালে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব মাকড়ের আক্রমণে কচি অবস্থায় নারিকেলের খোলের ওপর ফাঁটা ফাঁটা শুকনো দাগ পড়ে এবং কুঁচকে বিকৃত হয়ে পরিপক্ব হওয়ার আগেই তা ঝরে পড়ে। ফলনে দারুণ ব্যাঘাত ঘটে। আক্রমণের শুরুতে আক্রান্তÍ নারিকেল দেখে সহজে মাকড় চেনা যায় না। অতীতে আমাদের দেশে নারিকেলে এ রকম সমস্যা দেখা যায়নি। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা না থাকায় আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে মাকড় অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। কৃষকের ধারণা মোবাইল টাওয়ারের কারণে নারিকেলে এমনটি হচ্ছে। যে কারণে এ সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। মূল সমস্যা ক্ষতিয়ে না দেখে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ সমস্যাকে গুজব বলে অবহেলা করায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। এসব মাকড়ের ঝাঁক কচি নারিকেলের বোঁটার কাছে বৃতির নিচে বসে নারিকেলের গা থেকে রস চুষে খায়। রস চুষে নেয়ার সময় নারিকেলের যে ক্ষত হয় পরবর্তিতে তা ফাটা বাদামি দাগে পরিণত হয়। পরে সেকেন্ডারি ইনফেকশনের মাধ্যমে আরও বেশি সমস্যায় আক্রান্ত হয়। বাতাস, কীটপতঙ্গ ও পাখির মাধ্যমে মাকড় এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়। বর্তমানে এটি বেশ উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া কচি অবস্থায় ফল ঝরে যায়, খোসা শক্ত ও ছোট হয়ে যায়। খোসা থেকে আঁশ ছড়ানো যায় না, উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ কমে যায়; তখন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০-৮০ শতাংশ। গাছে ২-৪টা দাগবিহীন নারিকেল হলেও আকারে ছোট হয় এবং বাজার মূল্য কম হয়। দাগযুক্ত ফাটা ও বিকৃত নারিকেল বিক্রির অনুপোযোগী হয়ে যায়।
একটি গাছ থেকে বছরে ১০০ থেকে ১৫০টি নারিকেল পাওয়া গেলেও মাকড় আক্রান্ত গাছ থেকে কিছুই পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে মাকড় দমনের ওপর ধারাবাহিকভাবে গত কয়েক বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করার পর মাকড় দমন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। নারিকেল আক্রমণকারী মাকড় নারকেলের খোসা থেকে রস চুষে খায়। গাছে নারিকেল না থাকলে মাকড় বাঁচতে পারে না। বোঁটার কাছে বৃতির নিচে লুকানো অবস্থায় থাকে বলে মাকড়নাশক দিলে এরা সহজে মরে না, আবার প্রাকৃতিক শত্রুও এদের খুঁজে পায় না। কচি নারিকেলে সংজ্ঞবদ্ধ অবস্থায় থাকে বলে শীতের আগে আক্রান্ত ফল গাছ থেকে নামিয়ে ধ্বংস করে গাছের মাথায় কাঁদি সংলগ্ন এলাকায় মাকড়নাশক স্প্রে করে ঝাঁকসহ মাকড় ধ্বংস করা যায়। শীত মৌসুমে গাছে নারিকেল ধরে কম এবং তাই দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া মাকড় খাদ্যের অভাবে মারা যায় ও আক্রমণ করার মতো উপযুক্ত বয়সের নারিকেল পায় না বলে শীতকাল মাকড় দমনের উপযুক্ত সময়। সকালে কিংবা বিকালে মৃদু রোদে মাকড় বৃতির ভেতর থেকে বের হয়ে খোলের ওপর আসে তখন মাকড়নাশক দিয়ে এদের দমন বেশ কার্যকর। এ সময় বার বার গাছে উঠে স্প্রে করার দরকার হয় না। গাছে নতুন ফল এলে সে ফলের বয়স ২ মাস হলে দ্বিতীয়বার মাকড়নাশক স্প্রে করতে হয়। এক গাছ থেকে অন্য গাছে সহজেই ছড়ায় বলে এলাকাভিত্তিক মাকড় দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এককভাবে এলাকার এক-দুইজন মাকড় দমন করলে যথাযথভাবে কার্যকর হবে না। মাকড় আক্রান্ত নারিকেল গাছে ৫ ধাপে দমন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়। তবেই ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রথম ধাপ : শীত শুরু হওয়ার আগে আশ্বিন-কার্তিক (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) মাসে আক্রান্ত নারিকেল গাছের বিকৃত ২ থেকে ৬ মাস বয়সের সব নারিকেল কেটে গাছতলাতেই আগুনে পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে যাতে সেসব অবর্জনা অন্য গাছে মাকড় ছড়াতে না পারে।
দ্বিতীয় ধাপ : আশ্বিন-কার্তিক (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর) মাসে গাছের মাথা পরিষ্কার করার পর কাঁদি সংলগ্ন জায়গাতে ১.৫-২.০ মিলিলিটার হারে মাকড়নাশক ওমাইট/সুমাইট/ রনভিট/ডেনিটল/ ভার্টিমেট অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। এ সাথে আশপাশে কম বয়সি গাছের কচিপাতায় একইভাবে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
তৃতীয় ধাপ : ফাল্গুন-চৈত্র (মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ) মাসে প্রথমবার মাকড়নাশক প্রয়োগের পর গাছে নতুন ফুল আসলে তাতে ফল ধরবে, ফলের বয়স ২ মাসে মুষ্টির আকার হলে একই মাত্রায় দ্বিতীয়বার মাকড়নাশক প্রয়োগ করতে হবে।
চতুর্থ ধাপ : তৃতীয়বার চৈত্র-বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে) মাসের পর স্প্রে করার আগে কাটার মতো ডাব ও নারিকেল সংগ্রহের পর আগের মতো একই মাত্রায় মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
পঞ্চম ধাপ : চতুর্থ ধাপের মতো জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় (মধ্য মে থেকে মধ্য জুন) মাসে পাশের ছোট গাছসহ নির্দিষ্ট গাছগুলোতে শেষবারের মতো মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৫টি ধাপে মাকড় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ছত্রাকজনিত রোগের কারণেও কচি অবস্থায় নারিকেল ঝরে যায়। তাই প্রথম ও দ্বিতীয় বার স্প্রে করার সময় প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ব্যাভিস্টিন/নইন/এমকোজেম/জেনুইন নামক ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। কৃষক পর্যায়ে এসব কার্যকর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে দেশে আবার আগের মতো নারিকেলের উৎপাদন হবে। এ ব্যাপারে আরও অতিরিক্ত তথ্য জানতে হলে বারির বিজ্ঞানী ড. নাজিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা যাবে।
নারিকেল থেকে উপার্জন অন্যান্য ফসলের তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও সারা বছরই নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃষক আর্থিকভাবে উপকৃত ও লাভবান হন। নারিকেলের খোসা, চোবড়া, ফুল, ফল, কা-, পাতা সবই দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হয়। নারিকেলের বিভিন্ন অংশ প্রক্রিয়াজাত করার কৌশল আবিষ্কার করে তা দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করা যায়। নারিকেল থেকে বেশি উপার্জন ও কর্মসংস্থান তৈরি হলে কৃষকের মধ্যে নারিকেল চাষে আগ্রহ বাড়েবে ও দেশে অতিরিক্ত নারিকেল গাছ রোপণ হবে। তাছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ও পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে নারিকেলের আবাদ কার্যকর একটি বিষয়। প্রযুক্তি ব্যবহারে লাভ-ক্ষতির হিসাবে বলা যায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করার আগে গাছে বিক্রি করার মতো উপযুক্ত নারিকেল না থাকায় লাভ-ক্ষতির হিসাবে শুধু লাভের অংশই প্রকাশ পায়। প্রযুক্তি ব্যবহার করায় গাছে নতুন করে অতীতের মতো ফল ধরতে শুরু করে। একই সাথে ফলন বাড়ানোর জন্য যেসব পরিচর্যা দরকার তাও সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে আয় শূন্য টাকা। প্রযুক্তি ব্যবহারে পর আয়-
ক. মাকড় দমন করার পর ফলন (বছরে গাছপ্রতি) =৭৭টি # খ. স্থানীয় বাজার মূল্যে আয় (প্রতি নারিকেল ২০ টাকা দরে)= ১৫৪০ টাকা # গ. খরচ ১৩৪ টাকা # ঘ. গাছপ্রতি আয়= (১৫৪০-১৩৪)= টাকা বা ১৪০৬ টাকা। বিসিআর= ৮.৬৭ টাকা। অর্থাৎ ১ টাকা খরচ করে প্রায় ৯ টাকা আয় হয়।
এ প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য মাকড় সম্পর্কে প্রচলিত দীর্ঘদিনের কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা দূর করতে হবে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীদের মাকড় ও এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রযুক্তি প্রদর্শনীর আয়োজন করে কৃষকের মাঝে আগ্রহ বাড়াতে হবে। যেসব উপকরণে নিয়ে প্রযুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে তা সহজে কৃষকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কমিউনিটি রেডিও, বেতার, পত্রিকায়, টেলিভিশন চ্যানেলে সচিত্র প্রতিবেদন ও সময়োপযোগী সংবাদ বুলেটিন প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে দেশের সর্বস্তরে উপযুক্ত জায়গায় নারিকেলের চারা লাগাতে উৎসাহিত করতে হবে ও নারিকেল গবেষণা এবং সম্প্রসারণ কাজ জোরদার করে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাকড় দমনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ফুল ফোঁটার ১১ থেকে ১২ মাস পর ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। পরিপূর্ণ পাকলে নারিকেলের রঙ সবুজ থেকে বাদামি রঙ ধারণ করে এবং নারিকেলের গায়ে চুলের মতো চিকন দাগ পড়ে। এরপর সাবধানে নারিকেল পাড়তে হবে। পাড়া নারিকেল বাছাই করে সংরক্ষণ ব্যবহার ও বাজারে বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া গাছের বয়স অনুযায়ী সার দেয়া, খরায় সেচ, বর্ষায় নিকাশ, নারিকেলের মাথা ও গোড়া পরিষ্কার, বছরব্যাপী পোকা দমন অনুসরণ করতে হবে। সাধারণ পরিচর্যায় অনেক ফলন দেয়। নারিকেল থেকে বহুমুখী উপকার পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে নারিকেল তেল; পাতা থেকে ঘরের চাল, জ্বালানি; শলা থেকে ঝাড়–; গাছ থেকে ঘরের আসবাবপত্র, খাওয়ার বিভিন্ন ব্যাঞ্জন; ছোবড়া থেকে অনেক কিছু। সারা বছর ফলন দেয় বলে নারিকেলের শাঁস তৈরি ও অন্যান্য অংশ গঠনের জন্য নারিকেল গাছ বছরব্যাপী বাতাসের কার্বন গ্রহণ করে বৈশি^ক উষ্ণতা কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বাজায় রাখে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে হলে খামার ব্যবস্থাপনায় নারিকেল অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। একটু পরিকল্পিতভাবে নারিকেলের চাষ করলে আমাদের কৃষিভিত্তিক সমৃৃদ্ধিকে আমরা অনেকটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ subornoml@gmail.com
উপকূলীয় এলাকায় চরাঞ্চলে যেখানে জোয়ার ভাটার পরিস্থিতি বিরাজ করে, সেখানে সর্জান পদ্ধতি অবলম্বনে ফল-সবজি ও মাছ চাষ করা খুব সহজ এবং লাভজনক। এ পন্থায় চাষাবাদে খরচ কম, উৎপাদন ও আয় বেশি। বৃহত্তর বরিশাল জেলার অগ্রগামী চাষিরা এ পদ্ধতি অবলম্বনে বিভিন্ন প্রকার ফল পেয়ারা, কুল, লেবু, কমলা, মাল্টা, আমড়া, লিচু, কলা, পেঁপে, নানা রকম সবজি কচু, গিমাকলমি, শিম, বরবটি ও চিবিয়ে খাওয়া আখ আবাদ করে থাকে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলেও সর্জান পদ্ধতি অনুকরণে বিভিন্ন ফল কলা, পেয়ারা, আমড়া, সফেদা, কুল, ডালিম, নারিকেল, সুপারি, আম চাষসহ নানা প্রকার সবজি ও অন্যান্য ফসল টমেটো, গিমাকলমি, শিম, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টিআলু, তরমুজ, চীনাবাদাম, ফেলন, খেসারি, তিল, মেথি চাষ করার প্রচলন খুব বেশি। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, পাবনা জেলার নিচু জমিতে ও চর-হাওরে এ পদ্ধতি অবলম্বনে সফলভাবে ফল-সবজি চাষ করার সুযোগ আছে।
সর্জান পদ্ধতি : অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে যেখানে জলাবদ্ধতার কারণে পাট, ধৈঞ্চা, ডিপ ওয়াটার আমন ফসল ছাড়া স্বাভাবিকভাবে কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব হয় না সেখানে বিভিন্ন মাপের উঁচু বেড-বাঁধ তৈরি করে নিয়ে তাতে ফল চাষ উপযোগী করা হয়। দুইটি বেডের মধ্যভাগের মাটি খুঁড়ে বেডের দুই ধারে উঠিয়ে দিয়ে বেডগুলোকে সরেজমিন থেকে উঁচু করে নিয়ে বেড-বাঁধ ও নালা পদ্ধতির মাধ্যমে ফল-সবজি আবাদ করার এ পদ্ধতি সর্জান নামে পরিচিত। জমির অবস্থান এবং সেখানে কি ফসল চাষ করা হবে, স্থানভেদে ও এলাকার চাষির পছন্দ বিবেচনায় বেডের চওড়া ও নালার গভীরতা ঠিক করে নেয়া হয়। ভূমির অবস্থা অনুসারে এ বেড লম্বায় ২০ ফুট থেকে ২০০-৩০০ ফুট পর্যন্ত করা যায়।
এলাকার অবস্থা ও জমির আকার আকৃতি বুঝে এ পদ্ধতির জন্য বেডের বা বাঁধের উচ্চতা ও চওড়া ঠিক করা হয়। দুইটি বেডের মধ্যবর্তী নালার চওড়া ও গভীরতা সেভাবে চূড়ান্ত করা হয়। নোয়াখালী জেলার চরে যেসব অংশে কেবল মৌসুমি সবজি আবাদ করা হয় সেখানে ২-৩ ফুট চওড়া বেড এবং চওড়ায় ও গভীরতায় ২-৩ ফুট দেয়া হয়। বিশেষ করে যেসব উপকূলীয় এলাকায় যেখানে জোয়ার-ভাটার প্রভাব রয়েছে সেখানে এ মডেলের বিভিন্ন সংস্কার অবলম্বনে ফল-সবজি চাষ অতি জনপ্রিয়। নালা জোয়ারের পানিতে ভরে গেলে, এমনকি কয়েক ঘণ্টা তলিয়ে গেলেও আবাদকৃত নির্বাচিত ফল-সবজির তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। বিশেষ করে নারিকেল গাছ এ ধরনের পরিস্থিতিতে খুব সহজেই বেড়ে উঠে, প্রচুর ফল দানে সক্ষম হয়। নালায় পানি থাকায় বেডে রোপিত গাছগুলোতে পানি সেচের প্রয়োজন হয় না। গাছগুলো নালার পানি পরোক্ষভাবে শুষে এবং ভালোভাবে বেড়ে উঠে এবং প্রচুর ফল দানে সক্ষম হয়।
খাটো জাতের নারিকেল চাষের জন্য মডেল : এ পদ্ধতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত নিম্ন জমিতে একটা ১০ ফুট মাপের চওড়া বেডের উভয় পার্শ্বে ১০ ফুট চওড়া এবং ২.৫ ফুট গভীর নালা তৈরি করা হয়। একেকটা তৈরিকৃত নালার উভয় পাশে সমপরিমাণ মাটি উঠিয়ে দেয়ার ফলে সমতল থেকে তা প্রায় ২ ফুট উঁচু বেড তৈরি করা হয়। এ ব্যবস্থায় উঁচু বেড বা বাঁধ উঁচু হওয়ায় তা জলাবদ্ধমুক্ত হওয়ার ফলে সেখানে নারিকেলসহ অন্যান্য মধ্যমেয়াদি ফল ও মৌসুমি সবজি চাষের জন্য অতি উপযোগী করা হয়। নালায় পানি সহনশীল জাতের কচু ও মাছ চাষ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এছাড়া উঁচু বা বাঁধের কিনারে লতা জাতীয় সবজি লাগিয়ে এ সবজিকে ড্রেনের উপরিভাগের নালায় অস্থায়ী মাচা তৈরি করে তাতে লতা জাতীয় সবজিগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়। সর্জান পদ্ধতিতে খাটো জাতের নারিকেল ও তার বিভিন্ন উপযোগী অংশে মধ্যমেয়াদি ফল, মৌসুমি সবজি ও মাছ চাষের নমুনা চিত্রে দেয়া হলো। এটা বরিশাল জেলার রহমতপুর, হর্টিকালচার সেন্টারে অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে যেখানে বর্ষাকালে তিন মাসব্যাপী প্রায় ১-১.৫ ফুট পানি জমে থাকে তথায় ৩০০টি খাটো ভিয়েতনামি জাত দিয়ে বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এ পদ্ধতি অবলম্বনে সৃষ্ট মডেল বাগান এ অঞ্চলের আগ্রহী চাষি ও সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের জন্য দেখে শেখার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে।
ডাবল পদ্ধতিতে খাটো জাতের নারিকেল চাষ : এ পদ্ধতির ক্ষেত্রে বেডের মাপ চওড়ায় ১০ ফুটের পরিবর্তে ২০ ফুট চওড়া করতে হবে। দুইটি ২০ ফুট চওড়া বেডের মধ্যভাগে যে নালা তৈরি করা দরকার হবে তার মাপ চওড়ায় হবে ১০ ফুটের পরিবর্তে ১৬ ফুট। মাটির অবস্থা বুঝে বেড সরেজমিন থেকে ২-৪ ফুট করার প্রয়োজনে প্রায় ৩-৪ ফুট গভীর করে নালা তৈরি করা প্রয়োজন হতে পারে। নালা তৈরি করার সময় প্রায় ১ ফুট ঢালু রাখতে হবে তাতে বেডের মাটি ভেঙে পড়বে না। তাই নালার ওপরের ভাগ ১৬ ফুট হলে নি¤œাংশ নালার চওড়ায় ১৪ ফুট হবে। যেহেতু এখানে তৈরি বেড-বাঁধ চওড়ায় ২০ ফুট হবে তাই এ মডেলে এক সারির পরিবর্তে দুই সারি নারিকেল চারা ২০ ফুট দূরত্বে কিনারা থেকে ৪ ফুট ভেতরে চারা রোপণ করা হবে। এ ডাবল রো (Row) বা সারিতে নারিকেল চারা রোপণের ক্ষেত্রে পাশাপাশি চারা রোপণ না করে জিগ-জ্যাগ বা ত্রিকোণী-ত্রিভূজি পদ্ধতি অবলম্বনে তা রোপণ করতে হবে। তাতে গাছ বেশি পরিসরে আলো বাতাস পাবে, গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পাবে, ফলন বেশি দিবে।
এরই মধ্যে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার জাহাইজ্জার চরে সংশোধিত এ সর্জান পদ্ধতি অবলম্বনে প্রায় ২ হাজার খাটো ভিয়েতনামি জাতের একটা বড় আকারে নারিকেল বাগান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নারিকেল বাগান সৃষ্টিতে ডাবল সারি পদ্ধতি অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সংশোধিত মডেল অনুকরণ করে তা অন্যান্য চরগুলোতেও বেশি করে খাটো জাতের আমদানিকৃত নতুন নারিকেল বাগান সৃষ্টি করে তার সুফল আহরণ করা জরুরি।
বাংলাদেশে যেসব নারিকেল চাষ করার প্রচলন আছে তা লম্বা জাতের এবং শত শত বছরের পুরনো জাতের। এ লম্বা জাতের নারিকেল গাছ ঝড়ো বাতাসে টিকতে পারে না, অনেক সময় ভেঙে পড়ে। পৃথিবীর নারিকেল উৎপাদনকারী অগ্রগামী দেশগুলো বর্তমানে খাটো ও হাইব্রিড মাঝারি, খাটো জাতের নারিকেল চাষ অত্যধিক জনপ্রিয়। কয়েকটা দেশের মধ্যে ভারত এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে। এ দেশে ডিজে সর্ম্পূণা নামে একটা মধ্যম খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল জাত সম্প্রসারণে ব্যাপক হারে উৎপাদন করে চলেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেশ কিছু সংখ্যক উপকূলীয় দেশে তা রপ্তানি করে এ জাতের চারা বিপণন করে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় গত বছর ভিয়েতনাম, ভারত থেকে এ ধরনের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের নারিকেল চারা আমদানি করে তার সুফল আগ্রহী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার মহৎ কাজটা করে যাচ্ছে। দেশি জাতগুলো থেকে এ জাতগুলোর ফল দান ক্ষমতা ৩-৪ গুণ বেশি। অধিকন্তু, এসব জাতের নারিকেল চারা রোপণের ৩ বছরের মধ্যেই ফল দানে সক্ষম। এরই মধ্যে এসব আমদানিকৃত লক্ষাধিক নারিকেল চারা বিতরণ ও তা দিয়ে বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। চলতি বছরে আরও কয়েক লাখ এসব উন্নত ভিয়েতনামের খাটো ও ভারতের হাইব্রিড জাতের নারিকেল চারা আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ খাটো জাতের নারিকেল আগ্রহী চাষিদের মাঝে ডিএই এর বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টার থেকে অথবা কাছের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিতরণ করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। দেশের সব আগ্রহী ফলচাষি বিশেষ করে উপকূলীয় জেলায় বাগান সৃষ্টিতে এ খাটো জাতকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ মহৎ উদ্যোগকে সফল করতে সবার সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
এম এনামুল হক*
*মহাপরিচালক (অব.), ডিএই, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
ব্রোকলি (Brassica oleracea var. ltalica) বা সবুজ ফুলকপি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কপি গোত্রের সবজি। কিছু দিন আগেও ব্রোকলি বাংলাদেশের লোকের কাছে অপরিচিত ও অপ্রচলিত সবজি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটা লাভজনক হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং সবার কাছে সমাদৃত বটে আমাদের দেশে। কারণ কপি গোত্রের অন্যান্য সবজির চেয়ে ব্রোকলি অপেক্ষাকৃত বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ক্যান্সার প্রতিরোধক।
খাদ্যমান প্রতি ১০০ গ্রামে
প্রোটিন- ৩.৩ গ্রাম
শ্বেতসার- ৩৫০০ আ.ইউ.
ভিটামিন এ- ২০০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন ‘সি’ প্রচুর পরিমাণে এবং ক্যালসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান রয়েছে।
ব্রোকলির উৎপত্তি ইতালিতে। ব্রোকলিকে ইতালিয়ান ব্যোকলি বলা হয়। ইতালি ভাষায় Brocco শব্দ থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ব্রোকলিতে ক্যান্সার প্রতিরোধক আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোনিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী সান্টা বারবার জানিয়েছেন, ব্রোকলিতে আইসোথিয়োসায়ানেটস নামে বিশেষ ধরনের যৌগ রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ব্রোকলি স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ যে ভূমিকা রাখে তা মোটামুটি আমাদের সবার জানা। ভিটামিন-এ এর অভাবে আমাদের দেশের শিশুরা রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগে ভোগে। ব্রোকলি এই ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করে শিশুদের রাতকানা ও অন্ধত্ব রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও অস্থি বিকৃতি প্রভৃতির উপসর্গ দূর করে। ব্রোকলি অত্যন্ত সুস্বাদু উপাদেয় ও পুষ্টিকর সবজি বটে। এর অগ্রীয় ও কক্ষীয় কুঁড়ি পরিণত বয়সে সবুজ বর্ণের পুষ্প মঞ্জুরিতে রূপান্তরিত হয়। পুষ্প মঞ্জুরি ভাজি, স্যুপ ও তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। কপির চেয়ে লঘু বিধায় ব্রোকলি কেবল সিদ্ধ করে বা টাটকা অবস্থায় খাওয়া যায়। ব্রোকলির কা-ও খাওয়া যায়। এর কা- ফুলকপির চেয়ে নরম, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। কোনো কোনো দেশে কা- দিয়ে কাসুন্দি তৈরি হয়। একটি ফুলকপি একবারই সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু ব্রোকলি পর্যায়ক্রমে কয়েকবার সংগ্রহ করা যায় বলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। এর দামও ফুলকপির চেয়ে বেশি। বসতবাড়িতেও ফুলকপির চেয়ে আনুপাতিক কম যতেœ ব্রোকলি উৎপাদিত হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে ব্রোকলি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সবজি রপ্তানিযোগ্য।
জলবায়ু : ব্রোকলির নাতিশীতোষ্ণ সবজি। ব্রোকলির সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য ঠা-া ও আদ্র জলবায়ু উত্তম। এটি উচ্চ তাপমাত্রা ও খরাসহিষ্ণু। ১৫ ডিগ্রি- ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাসিক গড় তাপমাত্রা ব্রোকলি চাষের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। বাংলাদেশের শীতকালীন আবহাওয়া ব্রোকলি চাষের জন্য খুব উপযোগী। পর্যাপ্ত সূর্যালোকেরও প্রয়োজন।
মাটি : ব্রোকলির সফল চাষের জন্য মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে জৈবসার থাকা প্রয়োজন। মাটি উর্বর ও মাটির অম্ল-ক্ষারত্ব (PH) ৬.০-৭.০ হলে ভালো। বেলে দোআঁশ, দোআঁশ ও এঁটেল মাটিতে ব্রোকলি চাষ ভালো হয়। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি ব্রোকলি চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জাত : ব্রোকলি ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ফসল বলে বাংলাদেশে শুধু রবি মৌসুমে এর চাষ হয়। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, রায়খালীর বিজ্ঞানীগণ নিরলস প্রচেষ্টায় বারি ব্রোকলি ১ জাত মুক্তায়িত করেন। উল্লেখযোগ্য বিদেশি জাত হচ্ছে ডিসিক্কো, এল-সেন্ট্রো, প্রিমিয়াম ক্রপ, গ্রিন কমেট, গ্রিন ডিউক, ক্রসেডার, টপার ৪৩, ডান্ডি, ইতালিয়ান গ্রিন, স্প্রডিটিং টেক্সাম ১০৭, ওয়ালআম ২৯ এসব।
বীজ বপনের সময় : ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট-মধ্য অক্টোবর) মাস পর্যন্ত। কার্তিক (মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বোনা যায়। তবে সেপ্টেম্বরের শেষে সপ্তাহ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজের পরিমাণ : এক হেক্টরে চাষের জন্য ১৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ নির্বাচন : বীজ নির্বাচনের উৎস ও জাতের সঠিকতা যাচাই করে নিতে হবে।
বীজতলা তৈরি, বীজ বপনের চারা উৎপাদন : ব্রোকলি চাষের জন্য চারা উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসহ উন্মুক্ত জায়গা বীজতলা তৈরির উপযুক্ত স্থান। তাছাড়া বীজতলায় সেচ দেয়ার জন্য ধারে কাছে পানির উৎস থাকা চাই। চাষ বা কোদাল দিয়ে মাটি গভীর করে আলগা করে নিতে হয় এবং বীজতলার মাটি অত্যন্ত মিহি করে তৈরি করতে হয়। এঁটেল মাটি হলে কিছু ভিটি বালি মিশিয়ে নিলে ভালো হয়। বীজ বপনের জন্য ৩ মিটারী ১মিটার বীজতলা হওয়া দরকার। প্রথম বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হবে, বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় ৫-০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে ২.৫ সেন্টিমিটার দূরে চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পরপরই সেচ ও ছায়া দিতে হয়। চারা প্রতিষ্ঠিত হতে ৫-৬ দিন সময় লাগবে। এ সময় একদিন পরপর সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৫-৭ দিন পরপর সেচ দেয়া দরকার। এতে চারা শক্তিশালী হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে চারা লিকলিকে, লম্বা ও দুর্বল হয় এবং পরবর্তী এমন গাছ থেকে ফলন আশানুরূপ হয় না। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরের ৭-৮ দিন আগে প্রতিটি বীজতলায় ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হয়। চারা বৃদ্ধির হার কম হলে প্রতিটি বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া মাটিতে রসযুক্ত অবস্থায় প্রয়োগ করতে হয়।
দূরত্ব : চারা থেকে চারা-৫০ সেন্টিমিটার।
সারি থেকে সারি-৬০২ সেন্টিমিটার।
জমি তৈরি : সারা দিন পর্যন্ত সূর্যালোক পায় এমন জমির মাটি প্রথমে ভালোভাবে চাষ দিয়ে প্রস্তুত করে নেয়া উচিত। জমিতে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান তৈরি করে নিতে হবে। দুই সারিতে চারা রোপণের জন্য জমির চওড়া ও ১৫-২০ সেন্টিমিটার উঁচু মিড়ি বা বেড তৈরি করতে হবে। দুটি পাশাপাশি মিড়ির মাঝখানে যাতায়াত ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা রাখতে হবে। নালার মাটি তুলে মিড়ি বা বেড উঁচু করতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : জমিতে সারের কমতি হলে গাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না এবং পরবর্তীতে ফলন কমে যাবে। তাই ব্রোকলির জমিতে সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
মাটির অম্লাক্ষারক (PH) ৫.৫ এর নিচে হলে হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি চুন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
শূন্যস্থান পূরণ : বীজতলায় বীজ দেয়ার সময় কিছু বেশি বীজ ফেলতে হবে। প্রধান ক্ষেতে বা জমিতে চারা লাগানোর পর কিছু চারা মারাও যেতে পারে। মূল ক্ষেতের চারা মারা গেলে যেন একই বয়সের এসব চারা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়।
পরবর্তী পরিচর্যা
১. রোপণের পর প্রথম এক সপ্তাহ একদিন পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে;
২. পরবর্তীতে ৮-১০ দিন পরপরই সেচ দিতে হবে;
৩. সেচ দেয়ার পর জমিতে ‘জো’ আসলে ব্রোকলি স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। গাছ আগাছামুক্ত হবে সেইসাথে পর্যাপ্ত আলোবাতাস পাবে। গাছ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে;
৪. সারের উপরিপ্রয়োগের যথা সময়ে করতে সারের উপরিপ্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে;
৫. পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য নালা সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে, সেচের অতিরিক্ত পানি বা বৃষ্টির পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ : ব্রোকলি রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে পুষ্পমঞ্জুরি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। ধারালো ছুরি বা ব্লেড দ্বারা তিন ইঞ্চি কা-সহ পুষ্প মঞ্জুরি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে একই জমি থেকে ১ মাসব্যাপী কয়েকবার ব্রোকলি সংগ্রহ করা যায়। পুষ্প মঞ্জুরি মোটামুটি জমাট বাঁধা অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত।
ফলন : সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ১২-১৩ টন পাওয়া যায়।
*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ), আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা
নাছমিন আরা*
মানুষের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
ভেজাল খাদ্য পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি
১৯৯৪ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকাশ, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে। টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপি- ও অস্থিমজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণদের কিছুটা দেরিতে।
খাদ্যপণ্য ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ।
কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো- পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘ্নিত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ইউরিয়া ও হাইড্রোজ হচ্ছে এক ধরনের ক্ষার। এগুলো পেটে গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেপটিন এসিড তৈরি করে যা ক্ষুদামন্দা, খাবারে অরুচি, বৃহদান্ত ও ক্ষুদ্রান্তে প্রদাহসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের ডা. আহমদ সাইফুল জব্বার বলেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গণ্ডগোল, ডায়েরিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এনেসথেশিয়া ডা. মো. মিল্লাত-ই-ইব্রাহীম বলেন, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলো অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি।
মাছ ও সবজিতে ফরমালিন
শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতেই ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। হাট বাজার ঘুরে কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না কোথাও। এর মধ্যেই ক্ষতিকর পিরহানা মাছ, রাক্ষুসে মাগুর, জীবনহানিকর পটকা মাছের দেদার বাজারজাত চলছে। বাধা দেয়ার যেন কেউ নেই। মাঝে মাঝে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঝটিকা অভিযানে বিষাক্ত মাছ জব্দ ও বিনষ্ট করা হয়। কিন্তু মাছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল প্রয়োগ মোটেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। সবুজ সবজিতেও ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে অবাধে। পাইকারি আড়তগুলোতে মাছের স্তূপ দিয়ে তার ওপর প্রকাশ্যেই ফরমালিন ছিটানো হতো অথবা স্প্রে করা হতো কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। প্রশাসনের নজরদারির ভয়ে এখন আর আড়তে কেমিক্যাল মেশানোর ঝুঁকি নেয় না কেউ। মাছ আহরণ স্থল থেকেই প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছগুলোতে তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ করা হয়। আর ছোট আকারের মাছগুলো শুধু ফরমালিন মিশ্রিত পানির ড্রামে চুবিয়ে তুললেই চলে। ব্যবসায়ীরা বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাট বাজারের বেশিরভাগ দোকানেই অবাধে ফরমালিন ব্যবহার করতে দেখা যায়। আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে। এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়। সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ। সাধারণ পানি দিয়ে বানানো বরফ পাটাগুলো ধবধবে সাদা থাকে, ফরমালিন বরফ পাটার রঙ থাকে হালকা বাদামি।
বেকারির অস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য
রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে শত শত বেকারি কারখানা। কালি-ঝুলি মাখা প্রতিটি কারখানার ভেতরে-বাইরে কাদাপানি, তরল ময়লা-আবর্জনাযুক্ত নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। আশপাশেই নর্দমা ময়লার স্তূপ। মশা-মাছির ভনভন আর একাধিক কাঁচা-পাকা টয়লেটের অবস্থান। কারখানাগুলো স্থাপিত হয়েছে টিনশেড বিল্ডিংয়ে। বহু পুরনো চালার টিনগুলো স্থানে স্থানে ছিদ্র থাকায় বৃষ্টির পানি অনায়াসেই কারখানা ঘরে ঢুকে। এতে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত হয়ে থাকে মেঝে, কাদাপানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় খাদ্য-সামগ্রীতে, কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা নেই, দম বন্ধ হওয়া গরম থাকে রাত-দিন গরমে ঘামে চুপসানো অবস্থায় খালি গায়ে বেকারি শ্রমিকরা আটা-ময়দা দলিত মথিত করে। সেখানেই তৈরি হয় ব্রেড, বিস্কুট, কেকসহ নানা লোভনীয় খাদ্যপণ্য। অভিযোগ আছে উৎপাদন ব্যয় কমাতে এসব বেকারির খাদ্যপণ্যে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিমসহ নি¤œমানের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। কেক ও ব্রেড তৈরির জন্য সেখানে পিপারমেন্ট, সোডা ও ব্রেকিং পাউডার রাখা হয়েছে পাশাপাশি। বেকারির কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙসহ নানা কেমিক্যালও ব্যবহার করতে দেখা যায়। আশপাশের কারখানাগুলোতে দেদার ব্যবহার হচ্ছে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল ও পচা ডিম। বেকারিতে পচা ডিম ব্যবহার যেন সাধারণ বিষয়।
বিষাক্ত এনার্জি ড্রিংক ও জুস
এনার্জি ড্রিংকস বলতে কোনো পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বা বাজারজাতের জন্য বিএসটিআই কোনো রকম অনুমোদন দেয় না। তা সত্ত্বেও অনুমোদন পাওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্র বিএসটিআই কার্যালয়ে জমা দিয়েই কারখানায় দেদার উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের কেমিক্যাল বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, যে কোনো ড্রিংকস উৎপাদন ও বোতলজাতের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্ধারিত ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল উপকরণগুলো ফুটিয়ে নিয়ে তা রিফাইন করার মাধ্যমে সংমিশ্রণ ঘটানো এবং বোতলজাত করা থেকে মুখ লাগানো পর্যন্ত সবকিছুই অটো মেশিনে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু কথিত জুস কারখানাগুলোতে সবকিছুই চালানো হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে।
মসলায় রঙ, ইট ও কাঠের গুঁড়া
অধিক মুনাফার আশায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মসলায় কাপড়ে ব্যবহৃত বিষাক্ত রঙ, দুগন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া (নি¤œমানের মরিচ) ধানের তুষ, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন। বাংলাদেশ স্টান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও কনজিওমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব) অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। ভেজাল মসলা কিনে ক্রেতারা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, এতে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। কারণ ভেজাল মসলায় মেশানো ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভেজাল মসলা উৎপাদনকারী গুঁড়া মরিচের সঙ্গে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মেশাচ্ছেন ইটের গুঁড়া। হলুদে দেয়া হচ্ছে মটর ডাল, ধনিয়ায় সমিলের কাঠের গুঁড়া ও পোস্তদানায় ব্যবহৃত হচ্ছে সুজি। মসলার রঙ আকর্ষণীয় করতে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল রঙ মেশানো হচ্ছে। এর কারণে গুঁড়া মরিচের ঝাল বাড়ে এবং হলুদের রং আরও গাঢ় হয়। মসলার ওজন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ধানের ভুসি। অসাধু চক্র প্রথমে গোপন কারখানায় ভেজাল মসলা উৎপাদন করে। পরে তা প্যাকেটজাত করে খোলাবাজারে সরবরাহ করে। তারা কিছু প্যাকেট ছাড়া, কিছু সাধারণ প্যাকেটে এবং কিছু নামিদামি কোম্পানির লেভেল লাগিয়ে মসলাগুলো বিক্রি করেন।
ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল
বাজারের কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা থেকে শুরু করে আপেল, আঙুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। সাধারণ ফল-মূলের উজ্জ্বল রঙ ক্রেতাদের নজর কাড়ে, সেগুলো বিক্রিও হয় বেশি দামে। তাই অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তর করার জন্য অধিক ক্ষার জাতীয় টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রি করা মুহূর্ত পর্যন্ত এক একটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই ফলমূলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। অন্যদিকে ফলমূল দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করতে ফরমালিনসহ আরও কিছু বিষাক্ত পদার্থের ও ব্যবহার চলে অহরহ। ইথাইলিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের কারণে ২-৪ দিনের মধ্যেই ফল হলুদ রঙ ধারণ করে। বাস্তবে এসব ফল বাইরে পাকা মনে হলেও এর ভেতরের অংশে অপরিপক্ব থেকেই যায়। পরবর্তীতে সে ফলগুলো খাওয়ার কারণে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল, শুরু হয় নানা অসুখ-বিসুখ। অপরিপক্ব ফলমূলের স্বাদ-গন্ধ, ভিটামিনও অনেক কমে যায়। ফল পাকাতে যে বিপজ্জনক রাসায়নিক পর্দাথটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় তার নাম কার্বাইড।
বাগান থেকে আম পাড়ার পর কমপক্ষে তিনবার বিভিন্ন রাসয়নিক দ্রব্য স্প্রে করা হয়। রাতে গুদাম বন্ধ করার আগে ফরমালিন স্প্রে করা হচ্ছে। ফলে ভোরে আমে ফরমালিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। তা ছাড়া অতিরিক্ত তাপে ক্যালসিয়াম র্কাবাইড মেশানে আম রাখলে তা ক্যালসিয়াম সায়নাইডে পরিণত হতে পারে। যা অত্যন্ত মারাত্মক বিষ। কার্বোহাইড্রেটযুক্ত ফল চেনা অতটা কঠিন কিছু নয়, প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলে সমান (ইউনিফরম) রঙ হবে না, বোঁটার অংশে লালছে আভা রঙ হবে এবং ফল মিষ্টি হবে। কৃত্রিমভাবে পাকানো ফলে সব অংশে সমান রঙ হবে এবং ফলের ভেতরে চামড়ার অংশে একটু তিতা হবে। তাছাড়া ফলের এক অংশে টক অন্য অংশে মিষ্টি হয়।
মুড়িতে ইউরিয়া
এখানেও ঢুকে পড়েছে ভেজালের বিষবাষ্প। লবণের বদলে মেশানো হচ্ছে সেই ইউরিয়া। কারখানায় ভাজা মুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আড়তদারদের প্ররোচনায় গ্রামের সহজ সরল বউ-ঝিরাও মুড়িতে মেশাচ্ছেন এই বিষ। প্রতিযোগিতার বাজারে মুড়িকে লম্বা, সাদা, ফাঁপানো ও আকর্ষণীয় করতে মুড়ি বেপারি এবং আড়তদাররা শ্রমিকদের সার সরবরাহ করছেন। তাদের প্ররোচনায় না বুঝে ঘরে ঘরে মুড়ি শ্রমিকরা লবণের বদলে চালে ইউরিয়া মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করছেন। মুড়ি ভাজার চালের সঙ্গে বস্তায় বস্তায় ইউরিয়া। ইউরিয়া মিশ্রিত মুড়ির কুফলও জানেন না মুড়ি শ্রমিকরা। এক কেজি ইউরিয়ায় প্রায় ১৬০ কেজি মুড়ি ভাজা হয়। লবণের দাম বেশি হওয়ায় আর বেপারি আড়তদাররাও খুশি হওয়ায় চালে এ ইউরিয়া মিশিয়েই এখন মুড়ি ভাজা হচ্ছে। এসব সারের ক্রেতা শুধু মুড়ি বেপারি, আড়তদার ও শ্রমিকরা। বারোপোতায় এখন শুধু বিআর১১ ও ব্রি ধান২৮ ধানে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। দুই-চার বছর আগেও এখানে ঘরে ঘরে আউশ ধানের মুড়ি ভাজা হতো। ব্যবসায়ী আজিজুল জানান, বেপারি-আড়তদাররা যাচ্ছে তাই ধান কিনে দিচ্ছেন শ্রমিকদের। দরিদ্র শ্রমিকরা চালে ইউরিয়া মিশিয়ে সেই ধান থেকেই মুড়ি তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মুড়িতে ইউরিয়ার সঙ্গে হাইড্রোজও মেশানো হচ্ছে। তা চিনার উপায় হলো এ ধরনের মুড়ির শরীরে অসংখ্য ছিদ্র থাকে, দেখতে খুব সাদা রঙের হয়। স্বাদ পানসে হয়ে যায়।
দূষিত পানি বোতলে
ফলমূল, দুধ, মাছে ফলমালিন-কার্বাইডের বিষ, অন্যান্য খাদ্যপণ্যও ভেজালমুক্ত রাখা যায়নি। এমকি জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই বিশুদ্ধ মিনারেল পানি বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক জার (বড় আকারের বোতল) ভরা পানি বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে পৌঁছানোর মাধ্যমেও জমে উঠেছে দূষিত পানির রমরমা ব্যবসা। জীবন রক্ষাকারী পানি নিয়ে মরণঘাতী খেলা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের পরীক্ষাগারে বোতলজাত পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অতি নি¤œমানের পানি হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। মাত্র ১৯টি কোম্পানি অনুমোদন নিলেও দেশজুড়ে বোতলজাত পানির জার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। এর মধ্যে একটিরও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি গামছায় ছেকে বোতলে ভরে বাণিজ্য করা হচ্ছে।
দুধ নয় পুরোটাই নকল
শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন না এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, এবার নকল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা। এ দুধ সংগ্রহে কোনো গাভীর প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদি পশুর খামারও। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন ‘বিষ’। পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। জানা গেছে, পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে সহজেই নকল দুধ তৈরি করা যায়। তবে প্রয়োজন পড়ে আরও কয়েক পদের রাসায়নিক পাউডারের। যা পানিতে মিশিয়ে একেবারে সাদা দুধের আকার ধারণ করে। খালি চোখে তা ধরা অসম্ভব। এর শিকার হচ্ছেন পূর্ণ বয়স্ক থেকে শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি নকল দুধ পানে পেটের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর প্রভাব পরতে পারে কিডনি বা লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও। নকল দুধ তৈরির কারখানাগুলোতে ছানার ফেলনা পানি, খাবার পানি, থাইসোডা, পার অক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দেয়া হয়। ধলেশ্বরী ঘাট থেকে নকল দুধের চালান পাঠানো হয় দুটি নামিদামি ডেইরি প্রজেক্টে। পরে ওই প্রজেক্টের প্লাস্টিক মোড়কে প্যাকেটজাত দুধ হিসেবে বাজারে বাজারে পৌঁছে যায়। আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের ডা. এস কে রায় জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত এসব নকল দুধ পানের কারণে মানবদেহে ডায়রিয়া, জটিল পেটের পীড়া, কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হচেছ প্রতিনিয়ত। শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরো মারাত্মক। বাজারে চলমান একমাত্র হোমমেড রসগোল্লা নামের পণ্যটি আগাগোড়াই ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাবার আদালতে মামলা রজু করা হয়েছে।
রুখে দাঁড়ান খাবারে রাসায়নিক সন্ত্রাস
খাবারে ভেজাল আজ কোনো গোপনীয় ব্যাপার নয়। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও বৈধতা পেয়েছে। মহাসমারোহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য মরণব্যাধির নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ মেশানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা অনেকে জানিই না ফরমালিন, কার্বাইড কী? কী এর অপকারিতা? কী ধরনের রোগ হতে পারে রাসয়নিক পদার্থগুলোর প্রভাবে? সবচেয়ে আলোচিত ‘ফরমালিন’। এটা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা ফল, মাছ ও মাংসে মিশিয়ে পচন রোধ করা হয়। মূলত জীবাণুনাশক ও প্রাণীর মরদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয় এটি। ব্যাকটেরিয়া নাশক হওয়ায় কসমেটিক তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়। বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছেই বরফের সঙ্গে বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায়, ফরমালিন ব্যবহারে মানুষের দেহে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা যেমন- পাকস্থলীর ক্যান্সার, দৈহিক বিকলাঙ্গতা এমনকি প্রাণহানিও ঘটাতে পারে। মাত্রা বেশি থাকলে শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে। বৃক্ক, যকৃৎ, ফুলকা, পাকস্থলী ও লিভার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু কীভাবে চিনব মাছে ফরমালিন আছে?
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাছের দেহ শক্ত হয়ে যায়, যেন আমরা কেনার সময় ভাবি মাছ তাজা আছে। আঁশ উজ্জ্বল না হয়ে ধূসর রঙের হয়ে যায়, ফুলকাও ধূসর রঙের হয়। এসব দেখে মাছ কিনলে ফরমালিনযুক্ত মাছ পাওয়া যেতে পারে। ফরমালিন ব্যবহার মাছে সাধারণত মাছি বসে না। গ্রীষ্মকালীন প্রায় সব ফলে এখন ফরমালিন ও কার্বাইড অথবা অন্য কোনো রাসায়নিক স্প্রে করা হচেছ। এ সন্ত্রাস থেকে রেহাই পেতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উন্নত প্যাকেজিং প্লান্ট হাতে নেয়া যায়। যাতে কিছু দিন ফল সংরক্ষণ করা যায়। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে গ্রীষ্মের ফলগুলো জীবাণুমুক্ত করে প্যকেট করা যেতে পারে। সর্বোপরি দরকার ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার বিজ্ঞানসম্মত উপায় আবিষ্কার করা । খাবারে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে, তা বিদেশ থেকে আমদানি করা। প্রয়োজনীয় কাজে আমদানি করতে দ্বিমত নেই। চাইছি যত্রতত্র ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ। সাংবাদিক নঈম নিজাম বলেন, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ খাদ্যকে বিশুদ্ধ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা খাদ্যকে বিষে পরিণত করার জন্য রীতিমতো উঠে পড়ে লেগেছি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে যেখানে ১৯৮০ এর দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ সেখানে বর্তমানে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০-৯০ লাখ, বর্তমানে প্রায় ২০-২২ শতাংশ লোক হৃদরোগে আক্রান্ত এবং ১০-১২ লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত (বাংলাদেশ প্রতিদিন এপ্রিল-২০১৫)। সুতরাং পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাই কঠোর আইনের প্রয়োগ। এসব রাসয়নিক দ্রব্য আমদানি, সংরক্ষণ, মজুদকরণ, বিতরণ, ব্যবহার ও উম্মুক্ত বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে এবং জনগণকে ভেজাল খাদ্য ক্রয় ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার*
*উপপরিচালক (কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি) জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি, গাজীপুর; dhossain1960@yahoo.com
স্ট্রবেরি Fragaria ananasa) Rosaceae পরিবারভুক্ত একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আকর্ষণীয় বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ও উচ্চ পুষ্টিমানের জন্য স্ট্রবেরি অত্যন্ত সমাদৃত। স্ট্রবেরি একটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হলেও এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অন্যান্য ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। ফল হিসেবে সরাসরি খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বৃদ্ধিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। স্ট্রবেরি মৃদ শীতপ্রধান দেশের ফল হলেও উষ্ণম-লীয় অঞ্চলে চাষোপযোগী স্ট্রবেরির জাত উদ্ভাবন করায় দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হচ্ছে। শীত মৌসুমে আমাদের দেশে তেমন কোনো ফল উৎপন্ন না হলেও সাফল্যজনকভাবে স্ট্রবেরি চাষ সম্ভব অপরদিকে বাজারে এটি বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয় বিধায় এর চাষ খুবই লাভজনক। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২৫টি জেলায় সাফল্যের সাথে স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। বিএআরআই দীর্ঘদিন ধরে স্ট্রবেরি চাষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে আসছে এবং অদ্যাবধি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী স্ট্রবেরির তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে।
পুষ্টিমান ও ব্যবহার : স্ট্রবেরি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ফল। এর প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান হলো-
পানি ৯১.৬৭ মিলিলিটার, খাদ্যশক্তি ৩০ কিলোক্যালরি, আমিষ ০.৬১, চর্বি ০.৩৭, শর্করা ৭.০১, অশোধিত আঁশ ২.২৯ গ্রাম করে, ক্যালসিয়াম ১৩.৮৯, লৌহ ০.৩৮, ম্যাগনেসিয়াম ৯.৭২, ফসফরাস ১৮.৭৫, পটাসিয়াম ১৬৭.০০, ভিটামিন সি ৫৭.০০, নিয়াসিন ০.২৩ মিলিগ্রাম করে, ভিটামিন এ ২৭.০০ আন্তর্জাতিক একক। স্ট্রবেরি দ্বারা জ্যাম, জেলি, স্কোয়াস, জুস, আইসক্রিম, ক্যান্ডি প্রভৃতি তৈরি করাযায়। মিশ্র ফলের ককটেলে স্ট্রবেরি ব্যবহার করা যায়। স্ট্রবেরি পিউরি রেফ্রিজারেটরে দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
মাটি ও আবহাওয়া : স্ট্রবেরি মূলত মৃদু শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল। কিন্তু কিছু কিছু জাত তুলনামূলক তাপ সহিষ্ণু এদের গ্রীষ্মায়িত জাত বলা যায়। এসব জাতের জন্য দিন ও রাতে যথাক্রমে ২০-২৬ ডিগ্রি ও ১২-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। ফুল ও ফল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া আবশ্যক। স্ট্রবেরির জাতগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়ায় রবি মৌসুম চাষের উপযোগী। বৃষ্টির পানি জমে না এ ধরনের উর্বর দো-আঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটি স্ট্রবেরি চাষের জন্য উত্তম।
জাত : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট স্ট্রবেরির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা বিবেচনায় বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বারি স্ট্রবেরি-১, বারি স্ট্রবেরি-২ ও বারি স্ট্রবেরি-৩ নামে ৩টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি করে স্ট্রবেরির উন্নত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। নিম্নে বারি উদ্ভাবিত স্ট্রবেরির জাতগুলোর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো।
বারি স্ট্রবেরি-১ : বাংলাদেশে সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চফলনশীল জাত। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়। গাছপ্রতি গড়ে ৩২টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন। হৃৎপিণ্ডাকৃতির ফল ক্ষুদ্র থেকে মধ্যম আকারের যার গড় ওজন ১৪ গ্রাম। পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল বর্ণের। ফলের ত্বক নরম ও ঈষৎ খসখসে। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। স্ট্রবেরির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি। জাতটি পর্যাপ্ত সরু লতা (runner) ও চারা উৎপাদন করে বিধায় এর বংশবিস্তার সহজ।
বারি স্ট্রবেরি-২ : বাংলাদেশে সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে সংগ্রহপূর্বক বাংলাদেশের আবহাওয়া অভিযোজন পরীক্ষাপূর্বক বাছাই পদ্ধতিতে মুক্তায়ন করা হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথমে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়। গাছপ্রতি গড়ে ৩৭টি ফল ধরে। গাছপ্রতি গড় ফলন ৭৪০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৪-১৮ টন। হৃৎপিণ্ডাকৃতির ফল বেশ বড় আকারের, প্রান্ত ভাগ চ্যাপ্টা। পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল বর্ণের। ফলের ত্বক মধ্যম নরম ও ঈষৎ খসখসে। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। স্ট্রবেরির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি । জাতটি ফল প্রদান মৌসুমে সিমিত সংখ্যক runner উৎপাদন করে বিধায় runner অপসারণজনিত শ্রমিক কম লাগে।
বারি স্ট্রবেরি-৩ : বাংলাদেশে সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে সংগ্রহপূর্বক বাংলাদেশের আবহাওয়া অভিযোজন পরীক্ষাপূর্বক বাছাই পদ্ধতিতে মুক্তায়ন করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর শেষ ভাগ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়। গাছপ্রতি গড়ে ৩৯টি ফল ধরে। গাছপ্রতি গড় ফলন ৭৭০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০ টন। হৃৎপিণ্ডাকৃতির ফল বেশ বড় আকারের লম্বাটে, প্রান্ত ভাগ চোখা। পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল বর্ণের। ফলের ত্বক তুলনামূলক শক্ত ও ঈষৎ খসখসে। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। স্ট্রবেরির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ফলের স¦াদ টকমিষ্টি। জাতটি ফল প্রদান মৌসুমে সীমিত সংখ্যক runner উৎপাদন করে বলে runner অপসারণজনিত শ্রমিক কম লাগে।
চারা উৎপাদন : স্ট্রবেরির ভূসংলগ্ন সংকুচিত পর্ব সন্ধি হতে সরু লতার মতো অবস্থানিক কাণ্ড বের হয় যা মাটির ওপর দিয়ে ভূমির সমান্তরালে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং কিছু দূর সম্প্রসারিত হয়ে পর্ব সন্ধিতে নিচের দিকে শিকড় ও ওপরের দিকে বিটপ উৎপন্ন করে। একে রানার বলে। স্ট্রবেরি রানারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে। ওই গাছ থেকে উৎপন্ন রানারে যখন শিকড় বের হবে তখন তা কেটে ৫০ ভাগ জৈব সার ও ৫০ ভাগ পলিমাটি যুক্ত সিড বেড বা পলিথিন ব্যাগে লাগাতে হবে এবং হালকা ছায়াযুক্ত নার্সারিতে সংরক্ষণ করতে হবে। রানার রোপণের পূর্বে সিড বেড বা পলি ব্যাগের মাটি শোধন করে নিতে হবে। সিড বেডের ওপরে ১৫ সেন্টিমিটার পুরু ধানের তুষ বা স-ডাস্ট (করাত কলের গুঁড়া) বিছিয়ে তাতে আগুন দিয়ে পুড়ালে সিড বেডর মাটিতে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়। পলি ব্যাগে ব্যবহারের পূর্বে মাটি ও জৈব সারের মিশ্রণ ১৫ সেন্টিমিটার পুরু করে বিছিয়ে তার ওপরে ১৫ সেন্টিমিটার পুরু ধানের তুষ বা স-ডাস্ট (করাত কলের গুঁড়া) বিছিয়ে তাতে আগুন দিয়ে শোধন করা সম্ভব। অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে চারাকে রক্ষার জন্য বৃষ্টির মৌসুমে চারার উপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে। রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। তাই জাতের ফলন ক্ষমতা অক্ষুণœ রাখার জন্য প্রতি বছর পরপর টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা উত্তম।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ : স্ট্রবেরি উৎপাদনের জন্য উত্তমরূপে কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে এবং বিশেষ করে বহুবর্ষজীবী আগাছাসহ অন্যান্য আগাছা অপসারণ করে জমি তৈরি করতে হবে। জমিতে চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৩০ গ্রাম-শতাংশ হারে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিলে মাটিবাহিত রোগ জীবাণু নষ্ট হয়। স্ট্রবেরি বেডে অথমা সমতল পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। তবে ফাটিগেশন পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য বেড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এজন্য ১ মিটার প্রশস্ত এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুটি বেডের মাঝে ৩০-৫০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। প্রতি বেডে ৩০-৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে দুই সারিতে ২০-৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে। আগাম রোপণের জন্য পাতলা এবং নাবি রোপণের জন্য ঘন করে চারা লাগাতে হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আশ্বিন মাস (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) স্ট্রবেরির চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা চলে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চফলন পেতে হলে স্ট্রবেরির জমিতে নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি উর্বরতার জমির জন্য হেক্টরপ্রতি ৩০ টন পচা গোবর, ২৫০ কেজি ইউরিয়া, ১৭৫ কেজি টিএসপি, ২০০ কেজি এমওপি, ১১৫ কেজি জিপসাম, ১২ কেজি বরিক এসিড ও ৮ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বরিক এসিড ও জিংক সালফেট সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ফার্টিগেশন পদ্ধতির জন্য ২০০ কেজি ইউরিয়া ও ১৫০ কেজি এমওপি সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১৫-২০ দিন পরপর ৫-৮ কিস্তিতে সেচের পানির সাথে মিশিয়ে ড্রিপ সেচের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।
পানি সেচ ও নিকাশ : জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে প্রয়োজনমতো পানি সেচ দিতে হবে। স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে সেচের পানি নলের মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় সরাসরি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা হয়। ফলে পানির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং সেচজনিত জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা থাকে না।
মাল্চ প্রয়োগ ও পরিচর্যা : স্ট্রবেরি উৎপাদনে মাল্চ অপরিহার্য কারণ সরাসরি মাটির সংস্পর্শে এলে স্ট্রবেরির ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রবেরি চাষের সূচনালগ্নে এতে মাল্চ হিসেবে খর ব্যবহার করা হতো বিধায় এর নাম হয়েছে স্ট্রবেরি। চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরির বেড খড় বা কাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। খড়ে যাতে উঁইপোকার আক্রমণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ মিলিলিটার ডার্সবান ২০ ইসি ও ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ডিএফ মিশিয়ে ওই দ্রবণে খড় সুধন করে নিলে তাতে উঁইপোকার আক্রমণ হয় না এবং দীর্ঘদিন তা অবিকৃত থাকে। স্ট্রবেরিরর জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়া থেকে নিয়মিতভাবে রানার বের হয়। ওই রানারগুলো ১০-১৫ দিন পর পর কেটে ফেলতে হবে। রানার কেটে না ফেললে গাছের ফুল ও ফল উৎপাদন হ্রাস পায়।
ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি উৎপাদন : ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে পানির সাথে রাসায়নিক সার মিশিয়ে ফসলে প্রয়োগ করা হয়। যেসব সার পানিতে দ্রবণীয় তা ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়। ফলে ফসলের প্রয়োজনীয় সার ও পানি একত্রে গাছের গোড়ায় সরবরাহ করা যায়। ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে সার ও সেচের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ফলন ২৫-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে চাষ করলে স্ট্রবেরির ফলন ২০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ৪৫-৫৫০ শতাংশ সার এবং ৪৫-৫০ শতাংশ সার কম লাগে। সার এবং পানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও ফার্টিগেশন পদ্ধতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসলের গোড়ায় প্রয়োগের ফলে প্রয়োগকৃত সারের প্রায় সবটুকু উদ্ভিদ গ্রহণ করে। ফলে অব্যবহৃত সার চুঁইয়ে ভূ-উপরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিত করে না। এ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে মাটি ও পানি বাহিত রোগের বিস্তার কম হয়। উচ্চ মূল্যের ফসল উৎপাদনে ফার্টিগেশন-ড্রিপ সেচ খুবই উপযোগী পদ্ধতি। সারাবিশ্বে উৎপাদিত স্ট্রবেরির প্রায় ৮৫ ভাগ প্লাস্টিক-কালচার পদ্ধতিতে আবাদ করা হয়। প্লাস্টিক কালচার পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি গাছের প্রয়োজনীয় সার ও পানি সরবরাহ করা হয় ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে। ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে ফসল চাষ করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় এবং অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। ফার্টিগেশন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সেচ প্রযুক্তি যার চাহিদা ক্রমান¦য়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ পদ্ধতির খরচ বেশি হলেও দীর্ঘদিন ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ সম্বনয় করা সম্ভব। প্রতি ৩ শতক জমির ফসলের জন্য এ পদ্ধতিতে সেচ ও সার বাবদ বছরে ৩৮০-৪২০ টাকা খরচ হয়।
ফার্টিগেশন পদ্ধতির সুবিধাগুলো
ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে হেক্টরে ১৫-২০ টন স্ট্রবেরি উৎপাদন করা সম্ভব।
এ পদ্ধতিতে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে শতকরা ৫০-৫৫ ভাগ ইউরিয়া এবং ২৫ ভাগ পটাশ কম লাগে।
প্রচলিত ফারো এবং প্লাবন সেচ পদ্ধতিরে চেয়ে শতকরা ৪৫-৪৮ ভাগ সেচের পানি কম লাগে।
ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে সেচজনিত জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা না থাকায় এবং এক গাছ থেকে পানি চুয়িয়ে অন্য গাছে না যাওয়ায় প্লাবন বা ফারো সেচ পদ্ধতি অপেক্ষা এ পদ্ধতিতে রোগ বালাই এর প্রাদুর্ভাব কম হয়।
ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষের আয়-ব্যয়ের অনুপাত ৮ঃ১ এবং প্রতি হেক্টর জমিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে স্ট্রবেরি চাষ করে নিট মুনাফা ১৮-২৫ লাখ টাকা পাওয়া সম্ভব।
বর্তমানে এ উন্নত পদ্ধতির যাবতীয় উপকরণ স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়।
লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ এলাকা এবং পাহাড়ি অঞ্চলে ফার্টিগেশন পদ্ধতি খুবই উপযোগী ।
প্রতি ৫ শতক জমির ফসলের জন্য এ পদ্ধতিতে সেচের খরচ হয় মৌসুমে ১২০০-১৫০০ টাকা।
রোগবালাই ও অন্যান্য শত্রু এবং প্রতিকার
পাতায় দাগ পড়া রোগ : কোনো কোনো সময় পাতায় বাদামি রংয়ের দাগ পরিলক্ষিত হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে ফলন এবং ফলের গুণগত মান হ্রাস পায়। সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার ¯েপ্র করে সুফল পাওয়া যায়।
ফল পচা রোগ : এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। ফল পরিপক্ব হওয়ার পূর্বে নোইন ৫০ ডব্লিওপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ক্রাউন রট : এ রোগে আক্রান্ত গাছের কচি পাতা বিবর্ণ হয়ে ঢলে পড়ে য দ্রুত সমগ্র গাছে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং মারা যায়। Phytophthora নামক ছত্রাকের আক্রমণে ক্রাউন রট রোগ হয়। আক্রান্ত ক্রাউন মাঝ বরাবর লম্বালম্বি ব্যবচ্ছেদ করলে কাণ্ডের মাঝ বরাবর বাদামি বা হালকা গোলাপি বর্ণ ধারণ করে। সাধারণত জলাবদ্ধতা সম্পন্ন জমিতে ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। জমি শুষ্ক রাখতে হবে। পলিথিন মাল্চ ব্যবহার করলে তা তুলে ফেলতে হবে। ডাইথেম এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড ৭৫ ডাব্লিও পি অথবা সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার গাছের গোড়া ও মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। তবে রিডোমিল গোল্ড ৭৫ ডব্লিওপি ও সিকিউর একত্রে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৫ কেজি ট্রাইকোডামা ভিরিডি ২৫ কেজি জৈবসারের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করে ক্রাউন রট, ভারটিসিলাম উইল্টসহ অন্যান্য মাটিবাহিত ছত্রাক দমন করা যায়।
ভারটিসিলাম উইল্ট : এ রোগে আক্রান্ত গাছ হঠাৎ করে দুর্বল ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং মারা যায়। আক্রান্ত ক্রাউন মাঝ বরাবর লম্বালম্বি ব্যবচ্ছেদ করলে কাণ্ডের মাঝ বরাবর বিবর্ণ-ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। সাধারণত জলাবদ্ধতা সম্পন্ন জমিতে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। জমি শুষ্ক রাখতে হবে। পলিথিন মাল্চ ব্যবহার করলে তা তুলে ফেলতে হবে। জমিতে চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৩০ গ্রাম-শতাংশ হারে স্ট্যাবল ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিলে রোগ জীবাণু নষ্ট হয়। কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন বর্দ্দোমিক্সার (১ঃ১ঃ১০) ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছের গোড়া ও মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৫ কেজি ট্রাইকোডামা ভিরিডি ২৫ কেজি জৈবসারের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পাখি : পাখি বিশেষ করে বুলবুলি, দোয়েল, শ্যামা প্রভৃতি পাখি স্ট্রবেরির সবচেয়ে বড় শত্রু। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ব হওয়ার পূর্বেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়। পাখি পাকা ও আধাপাকা ফল নষ্ট কওে এবং খাওযার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
প্রতিকার : আলোক প্রতিসরণশীল প্লাস্টিক বা সিল্ভার স্ট্রিপ ব্যবহারের মাধ্যমে বা বাগানে শব্দ তৈরি করে পাখি তাড়ানো যায়। ফল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দ্বারা ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল খেতে না পারে।
ভাইরাস : ভাইরাস রোগের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা এবং গুণগতমান হ্রাস পেতে থাকে। সাদা মাছি পোকা এ ভাইরাস রোগ ছড়ায়। এডমায়ার ২০০ এসএল নামক কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ০.২৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ¯েপ্র করে সাদামাছি পোকা দমন করলে ভাইরাস রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
মাইট : মাইটের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ও গুণগতমান মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। এদের আক্রমণে পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে ও পুরু হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে কুচকে যায়। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ভারটিমেক ০১৮ ইসি নামক মাকড়নাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে। ফল পেকে লাল বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করতে হয়। স্ট্রবেরির সংরক্ষণ কাল খুবই কম বিধায় ফল সংগ্রহের পর পরই তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে। স্ট্রবেরির সংরক্ষণ গুণ ও পরিবহন সহিষ্ণুতা কম হওয়ায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এর চাষ করা উত্তম।
মাতৃ গাছ রক্ষণাবেক্ষণ
স্ট্রবেরি গাছ প্রখর সৌর-তাপ এবং ভারি বর্ষণ সহ্য করতে পারে না। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ফল আহরণের পর মাতৃগাছ তুলে টবে রোপণ করে ছায়ায় রাখতে হবে। ফল আহরণ শেষ হওয়ার পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃ গাছকে খরতাপ ও ভারি বর্ষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। মাতৃ গাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ফলন : হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ হাজার চারা রোপণ করা যায়। প্রতি গাছে গড়ে ২৫০-৩০০ গ্রাম হিসাবে হেক্টর প্রতি ১০-১২ টন স্ট্রবেরি পাওয়া যায়। ফাটিগেশন পদ্ধতিতে প্রায় ১৫-২০ টন স্ট্রবেরি উৎপাদন সম্ভব।
ড. মো. মসিউর রহমান*
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১, মোবাইল : ০১৭১৬৮৩৮৫৮৬, ই মেইল : moshiur.bari@yahoo.com
বাংলাদেশে উৎপাদিত ফল ও সবজি রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক। তবে সম্ভাবনার তুলনায় সফলতা যে খুব যে বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রপ্তানি কার্যক্রম খুব কাছে থেকে পর্যালোচনা করলে সহজেই দৃশ্যমান হবে, রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তাদের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই বললেই চলে। রপ্তানির বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হর্ট্রেক্স ফাউন্ডেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ফল ও সবজি রপ্তানিকারক সমিতি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো যৌথভাবে সম্পন্ন করে থাকে। এদেশের বিভিন্ন ধরনের সবজি এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত সব ফল ও সবজি রপ্তানিযোগ্য নয়। রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা প্রচলিত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন করে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফল ও সবজি আমদানিতে যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে তা যথাযথভাবে না মানতে পারলে ওই সব দেশ এদেশ থেকে ফল ও সবজি আমদানি করবে না। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সবজি সেসব দেশে রপ্তানি হয়েছে। তবে ফলের রপ্তানি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারিনি। এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, আমরা ক্রেতাদের শর্তগুলো ঠিকমতো ও যথাযথভাবে মানতে পারি না। এর সাথে রয়েছে আমাদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো। অনেকেই রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজি উৎপাদনের জন্য ফল ও সবজি চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত অথচ তার জানা নেই রপ্তানির জন্য প্রধান অস্তরায়গুলো কী কী? কী ব্যবস্থা নিলে এগুলোকে দূর করা সম্ভব। শুধু পড়লে বা দেখলে একজন সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে এদেশের ফল ও সবজিগুলো ভবিষৎতেও রপ্তানি করা সম্ভব নয়। এ ধারণা থেকে সংশ্লিষ্ট চাষিরা নিরুৎসাহিত হন প্রতিনিয়ত। বরং বাস্তবভিত্তিক ধ্যান-ধারণা থেকে বাস্তবায়নযোগ্য ম্যানুয়েল তৈরি করতে হবে যা চাষিদের জন্য সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
আমরা রপ্তানি বিষয়টিকে ততটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করে আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকি। প্রত্যেকটি ফল ও সবজির একটি বৈশিষ্ট্য থাকবে, যা স্যানেটারি এবং ফাইটোস্যানেটারি মানদ- অনুসরণ করে উৎপাদন করতে হবে, সংগনিরোধ বালাইমুক্ত হতে হবে যেমন ফলের মাছি পোকা, থ্রিপস, সাদামাছি ইত্যাদি, উৎপাদন ও সংগ্রহ পর্যায়ে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ করতে হবে এবং ট্রেস্যাবিলিটির জন্য উৎপাদনের সব পর্যায়ের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। এসব বিষয়গুলো সঠিকভাবে ও যথাযথ নিয়মে করতে হলে কন্ট্রাক্ট ফামিং বা চুক্তিভিত্তিক ফসল চাষের বিকল্প নেই। এছাড়াও দেশের নামিদামি সুপারশপগুলোতে নিরাপদ ফল ও সবজি সরবরাহের জন্যও এটি বেশ কার্যকরী। আম রপ্তানি আম গবেষকদের কাছে অনেকটাই কঠিন কাজ ছিল তবে লক্ষ্য অর্জনে প্রচেষ্ঠাও অব্যাহত ছিল। কিন্তু অতীতে কখনও কাক্সিক্ষত শর্তগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে হর্টেক্স ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের জুন মাসে কিছু বারি আম-২ আম ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাঠানো হয়েছিল। আমগুলো পাওয়ার পর আমগুলো তারা সাদরে গ্রহণ করেছিল এবং জুলাই মাসে এক ফ্যাক্স বার্তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে জানানো হয়েছিল যে, পাঠানো আমগুলো তাদের পছন্দ হয়েছে এবং বাংলাদেশের এ আমটি তারা নিতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে বারি আম-২ এর মৌসুম শেষ। আর মৌসুম থাকলেও বা কি! এক টন আমের চাহিদা মেটাতে ১০ টনের মতো আম প্রয়োজন হতো। এরপর চলতে থাকে আরও গবেষণা। একবার কিছু কৃষি বিজ্ঞানীকে দক্ষ প্রশিক্ষক গড়ে তোলা হলো এবং ২০১৫ সালে তাদের মাধ্যমে আমচাষিদের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। সবার আশা ছিল এবার হয়ত বেশকিছু আম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা। আম সুন্দর হওয়া তো দূরের কথা, অত্যধিক বৃষ্টির কারণে আমের রঙ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এবং আমের মাছি পোকা দমন করা অনেকটাই কঠিন হয়েছিল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। দক্ষ বিদেশি প্রশিক্ষকের মাধ্যমে আমচাষিদের প্রশিক্ষিত করেও আম রপ্তানি সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ধারণাও ছিল না অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে আমগুলো কিভাবে সুন্দর থাকবে, আমের মাছি পোকা কিভাবে শতভাগ দমন করা যাবে এবং আমগুলো কিভাবে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যাবে। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, পরিকল্পনা যদি সঠিক না হয় তাহলে লক্ষ্য অর্জন অনেকটাই কঠিন। অথচ ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা জেলা থেকে মে মাসে নন ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত হিমসাগর আম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ল্যাংড়া ও ফজলি আম বিদেশে রপ্তানি হয়। এর পরের মৌসুমে অর্থাৎ ২০১৬ সালে সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০০ টনের মতো আম ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে পৃথিবীর প্রধান প্রধান আম রপ্তানিকারক দেশে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে আম উৎপাদন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় এ আমগুলো শতভাগ রপ্তানি উপযোগী। গবেষণার মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি একটি পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের সহজ উপায়। কন্ট্রান্ট ফামিং ধারণাটি যদিও রপ্তানিযোগ্য ফল ও সবজি উৎপাদনে একটি কার্যকরী ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ তথাপিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কর্মতৎপরতা ততটা সন্তোষজনক নয়। বিগত মৌসুমগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, আমের ক্ষেত্রে কন্ট্রান্ট ফামিং নিয়ে কৃষকের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আসেন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে। যে সময়ে বাগান ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রায় সম্পন্ন হয়ে যায়। এরপর এক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ শুধুই ভুল খুঁজে পান আমচাষিদের কিন্তু শোধরানোর কোন পথ তাদের জানা নেই। আসলে এ দোষ কি আমচাষিদের? কন্ট্রান্ট ফামিংয়ের ধারণা থেকে বুঝা যায়, ফল বা সবজি উৎপাদনের শুরু থেকে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত চাষিদের প্রথমেই ধারণা দেয়া হবে। এরপর চাষিরা সে নিয়মনীতিগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার চেষ্ঠা করবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উৎপাদনের বিভিন্ন সময় মনিটরিং করবেন এবং পরামর্শ দেয়ার থাকলে তা সে সময়ে চাষিকে অবহিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর উল্টোটা। আমরা বেশিরভাগ সময়েই মনিটরিং নিয়ে ব্যস্ত থাকি যেটি মোটেই কাম্য নয়। প্রথমবারের মতো কন্ট্রান্ট ফামিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত আম বিদেশের বাজারে রপ্তানি করা হয়। মেহেরপুর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রায় শতভাগ ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত আম রপ্তানি হয়। প্রথমে রপ্তানিকারকদের চাহিদা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়, পরে চুক্তিভিত্তিক চাষির কাছ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে আমগুলো নিয়ে আসা হয়। পরে সেখান থেকে সর্টিং, গ্রেডিং শেষে মনোরম প্যাকেটে প্যাকিং করা হয়। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এদেশে আম উৎপাদনকারী অঞ্চলে আমের কোনো আধুনিক প্যাকিং হাউস নেই। যেসব জায়গায় বেশি পরিমাণে গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদিত হয় সেসব স্থানে প্যাকিং হাউস নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি বলে। আশাকরি, রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কার্যকরী পদক্ষেপ সময়মতো নেবেন যার ফলাফল আমরা আগামী মৌসুমে দেখতে পাব। সুতরাং কন্ট্রান্ট ফার্মিংয়ের চাষিরা আম উৎপাদনের উত্তম ফসল ব্যবস্থাপনার (প্রুনিং, ট্রেনিং, সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব বালাই ব্যবস্থাপনা) সাথে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করতে পারবেন।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, রপ্তানি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়, কারও কোনো অসাধু তৎপরতাই যেন এটি বন্ধ না হয় সেই বিষয়ে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে। তবেই আমাদের দেশের আম রপ্তানির ধারা অব্যাহত থাকবে। নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করতে পারবেন এ ঠিকানায় sorofu@yahoo.com
ড. মো. শরফ উদ্দিন*
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত এদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে মৎস্য সেক্টরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। এ ২৬০ প্রজাতির মধ্যে ৫৬ প্রজাতির মাছ আজ একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন- সরপুঁটি, রানী, মহাশোল, মেনী, নান্দিনা, রিটা, বাঘাইর, বাচা, কালবাউশ, গনিয়া, চিতল, মধুপাবদা, শিং, নাপতেকই, লাল চান্দা, নামা চান্দা, তেলিটাকি, বাটা এসব। মাছ যে হারিয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। আমরা তো দেখছি, অনেক মাছ আমাদের খাল বিল নদী নালায় আর নেই। মাছের বংশ বৃদ্ধি, বিস্তার ও উৎপাদনের জন্য কয়েকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-
এক সময় এ দিকগুলো ছিল প্রকৃতির দান। কিন্তু বর্তমানে কোনো নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলে বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। প্রশ্ন আসতে পারে উল্লিখিত বিষয়গুলো কি শুধু প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না অন্য প্রজাতির জন্য? বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, লালন ক্ষেত্র, বিচরণ ক্ষেত্র এসবের দিকে তাকালে বোঝা যায় উল্লিখিত নির্দেশগুলো মানা হয় না। এ কারণের পেছনে রয়েছে মানুষ। প্রকৃতির কারণে পরিবেশ যতটা বদলাচ্ছে মানুষের কারণে বদলাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। মৎস্য প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ফলে যে সব সমস্যা দেখা দিতে পারে তা হলো-
এবার আরও দেখা যাক মৎস্য সম্পদ কিভাবে উজাড় হচ্ছে- জলাশয় ভরাট হয়ে যায়, কারেন্ট জালের ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ধরা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, পানি সেচ দিয়ে সব মাছ তুলে ফেলা, পাটি বাঁধ দিয়ে বিলের সব মাছ ধরা, কলকারখানার বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা, জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি।
উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু কারণ যার সংশোধন বর্তমানে হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু কিছু কারণ আছে যা এখনও রোধ করতে পারি যদি আমরা একটু সচেতন হই। যেমন-
কারেন্ট জালের ব্যবহার : শুধু কারেন্ট জাল নয় নির্ধারিত ফাঁসের জাল যদি ছাড়া যায় তাহলে মাছের বিলুপ্তি রোধ করা অনেকটা সম্ভব এবং সে সাথে মাছের উৎপাদনও অনেকটা বেড়ে যাবে। বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে তার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ যদি রক্ষা করা যায় তাহলে বছরে ১.৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৬০০ কোটি টাকা। শুধু ইলিশ নয় বর্ষা মৌসুমে এ সব জালের অবাধ ব্যবহারে ডিমওয়ালা মাছসহ ধরা পড়ছে অনেক জলজ জীব ও কীটপতঙ্গ ফলে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা : বছরে বর্ষা মৌসুমে মাছ আমরা অনেকটা হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে থাকি। এ মৌসুমে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। এ সময় যদি আমরা মাছ না ধরি তাহলে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে।
পাটি বাঁধ এবং সেচ দিয়ে জলাশয় শুকিয়ে ফেলা পাটি বাঁধ এবং সেচ দিয়ে জলাশয় শুকিয়ে সব মাছ ধরে ফেলায় পরের বছরের মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে। এমনকি অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে কোনো ‘মা’ মাছ না থাকায়।
রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কলকারখানার বর্জ্য ‘নিরাপদ পানি চাই’ স্লোগান বর্তমানে সবার দাবি। মাছের অস্তিত্ব, সংখ্যা, বিকাশ ও সংরক্ষণে নিরাপদ পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি ছাড়া মাছ কল্পনা করা যায় না বলে পানি সর্বোতভাবে মাছের উপযোগী হতে হবে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কলকারখানার বর্জ্যরে কারণে পানির উপকারিতা এবং গুণাবলি আজ বিনষ্ট। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বর্জ্যরে প্রভাবে অপেক্ষাকৃত নাজুক প্রকৃতির মাছের প্রজনন, বিচরণ এবং মাছের খাদ্য প্লাংটন উৎপাদনসহ বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, শোল, টাকি, গজার, বেলে, টেংরা এসব মাছ সাধারণত কম পানিতে ধানের জমিতে ডিম দেয় এবং বাচ্চা লালন করে। কাতলা, রুই, মৃগেল, কালাবাউশসহ অন্যান্য মাছের ছোট পোনা নিচু জমির ধানক্ষেতকে লালনভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কলকারখানার বর্জ্যরে কারণে মাছের পাশাপাশি জলজ অন্যান্য প্রাণীর প্রজনন, বিচরণ এবং লালন ক্ষেত্র দূষিত হচ্ছে।
অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ : প্রকৃতি মাছের পরিবেশ স্থির করে দিয়েছে। মানুষ তা পাল্টে দিচ্ছে, নষ্ট করছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের ফলে মাছের অবাধ বিচরণ যে সীমিত হচ্ছে তা নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি তার বাঁচার মতো খাবার না পেয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। গেল ক’বছর নাগাদ বাংলাদেশে মোট ৬১৩৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খাদ্য উৎপাদন কিছুটা বাড়লে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণÑ চাঁদপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেচ প্রকল্পের ফলে প্রথম দুই বছরে মাছের উৎপাদন কমেছে ৩৫ শতাংশ।
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ : বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ ব্যবস্থাপনায় ছোট প্রজাতির মাছকে অবাঞ্ছিত এবং বোয়াল, টাকি, গজার এসব মাছকে রাক্ষুসে মাছ হিসেবে উল্লেখ করে কীটনাশক প্রয়োগ করে মেরে ফেলার ফলে নদ-নদী, খাল-বিলের পাশাপাশি বদ্ধ জলাশয় ও পুকুর থেকে এসব ব— মাছ দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশি মাছ চাষের প্রবণতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমরা অবশ্য আমাদের প্রয়োজনে বিদেশি মাছ চাষ করব, তাই বলে দেশি প্রজাতির মাছকে ধ্বংস করে নয়। আমাদের দেশি প্রজাতির ছোট মাছ যে পুকুর বা বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা যায় এবং তা লাভজনক সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। একটি বিদেশি জাতের মাছ নিয়ে আমাদের দেশে যত গবেষণা হয়েছে এবং আমাদের দেশি জাতের মাছ নিয়ে তা করা হয়নি মোটেই। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু দেশি মাছের সফল কৃত্রিম প্রজনন এবং চাষ করে আশানুরূপ ফল পাওয়ার পরে সম্প্রসারণ বা চাষিদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য মাঠ পর্যায়ে সরাসরি চাষিদের সাথে কাজ করেন, তাদের মাধ্যমে এসব বড় প্রযুক্তি হস্তান্তর করে দেশি প্রজাতির মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। পাশাপাশি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিচরণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেখানে অভয়াশ্রম তৈরি করা এবং নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র বিচরণ ক্ষেত্রে মাছের নিরবচ্ছিন্ন নির্বিঘœ চলাচলে বিঘ্ন না ঘটানো, বর্ষা মৌসুমে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ না ধরা, ক্ষতিকর শিকার সরঞ্জাম ব্যবহার না করা। পৃথিবীর অনেক দেশে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রজাতি বিশেষে এরূপ পদক্ষেপ নেয়া অতি জরুরি।
আফতাব চৌধুরী*
*সাংবাদিক ও কলামিস্ট, উপশহর, সিলেট
টার্কি (Turkey) মেলিয়াগ্রিডিডিই পরিবারের এক ধরনের বড় আকৃতির পাখি বিশেষ। এগুলো দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও তুলনামূলকভাবে অনেক বড়। বিশ্বের সর্বত্র টার্কি গৃহপালিত পাখিরূপে লালন-পালন করা হয়। এরা পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। পালনের জন্য উন্নত অবকাঠামো দরকার হয় না । এরা প্রতিদিন মোট খাদ্যের ৫০-৬০ ভাগ নরম ঘাস খায়। তাই খাবার খরচ কম। রোগবালাই (বার্ড ফ্লু, গুটি বসন্ত, ঠাণ্ডাজনিত রোগ ছাড়া এখন পর্যন্ত এদের অন্য কোনো রোগ পরিলক্ষিত হয়নি) কম বলে চিকিৎসা খরচ কম। মাংস উৎপাদনের দিক থেকে খুবই ভালো (৬ মাস বয়সে ৫-৬ কেজি)। পাখির মাংস হিসেবে এটা মজাদার এবং কম চর্বিযুক্ত। তাই গরু বা খাসির মাংসের বিকল্প হতে পারে। আমাদের দেশে অনেকের ব্রয়লার মুরগির মাংসের ওপর অনীহা আছে। তাদের জন্য এটা হতে পারে প্রিয় খাবার। প্রোটিনের নতুন আরেকটি উৎস হিসেবে টার্কি হতে পারে বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত।
টার্কি পাখি পরিচিতি : আমাদের দেশের অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে পশুপাখি পালন অন্যান্য দেশের তুলনায় সহজ। আবার কিছু প্রাণী আছে যারা দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। আর টার্কি পাখি সে রকম একটি সহনশীল জাত, যে কোনো পরিবেশ দ্রুত এরা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এরা বেশ নিরীহ ধরনের পাখি, মুক্ত অথবা খাঁচা উভয় পদ্বতিতে পালন করা যায়। ৬-৭ মাস বয়স থেকে ডিম দেয়া শুরু করে এবং বছরে ২-৩ বার ১০-১২টি করে ডিম দেয়। একটি মেয়ে টার্কির ৫-৬ কেজি এবং পুরুষ টার্কি ৮-১০ কেজি ওজন হয়। এদের মাংস উৎকৃষ্ট স্বাদের। ঘাস, পোকামাকড়, সাধারণ খাবার খেতে এরা অভ্যস্ত, তবে উন্নত খাবার দিলে ডিম ও মাংসের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। ৪-৫ মাস বয়সের টার্কি ক্রয় করা ভালো, এতে ঝুঁকি কম থাকে এবং লিঙ্গ নির্ধারণ সহজ হয়, এরকম বয়সের এক জোড়া টার্কিও দাম হবে প্রায় ৪৫০০-৫০০০ টাকা। প্রথমে বাণিজ্যিকভাবে শুরু না করে ৮-১০ জোড়া দিয়ে শুরু করা ভালো, কারণ তাতে সুবিধা অসুবিধাগুলো নির্ণয় করা সহজ হয়।
রোগবালাই : টার্কি পাখির তেমন বড় কোনো রোগবালাই নেই। চিকেন পক্সের টিকা নিয়মিত দিলে এ রোগ এড়ানো সম্ভব। অতি বৃষ্টি বা বেশি শীতের সময় মাঝে মাঝে ঠা-াজনিত রোগ দেখা যায়, রেনামাইসিন জাতীয় ওষুধ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে নিয়োমিত টিকা দিলে এসব রোগ থেকে সহজেই টার্কিকে রক্ষা করা যায়।
টিকাপ্রদান সূচি : এক দিন বয়স- এনডি-বি১ স্ট্রেইন # ৪র্থ ও ৫ম সপ্তাহ- ফাউল পক্স # ৬ষ্ঠ সপ্তাহ - এনডি-(আর২বি); ৮-১০ সপ্তাহ - কলেরা ভ্যাকসিন
টার্কি পালনের সুবিধা
পালন পদ্ধতি : দুইভাবে টার্কি পালন করা যায়- ০১. মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতি ও ০২. নিবিড় পালন পদ্ধতি
মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতি
মুক্ত চারণ পদ্ধতিতে এক একর ঘেরা জমিতে ২০০-২৫০টি পূর্ণ বয়স্ক টার্কি পালন করা যায়। রাতে পাখিপ্রতি ৩-৪ বর্গফুট হারে জায়গা লাগে। চরে খাওয়ার সময় তাদের শিকারি জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে। ছায়া ও শীতল পরিবেশ জোগানর জন্য খামারে গাছ রোপণ করতে হবে। চারণভূমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করতে হবে এতে পরজীবীর সংক্রমণ কম হয়। সুবিধা : খাবারের খরচ ৫০ শতাংশ কম হয়; স্বল্প বিনিয়োগ : খরচের তুলনায় লাভের হার বেশি।
মুক্ত চারণ ব্যবস্থায় খাবার : টার্কি খুব ভালোভাবে আবর্জনা খুঁটে খায় বলে এরা কেঁচো, ছোট পোকামাকড়, শামুক, রান্নাঘরের বর্জ্য ও উঁইপোকা খেতে পারে, যাতে প্রচুর প্রোটিন আছে ও যা খাবারের খরচকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এছাড়া শিম জাতীয় পশুখাদ্য যেমন লুসার্ন, ডেসম্যান্থাস, স্টাইলো এসব খাওয়ানো যায়। চরে বেড়ানো পাখিদের পায়ের দুর্বলতা ও খোঁড়া হওয়া আটকাতে খাবারে ঝিনুকের খোলা মিশিয়ে সপ্তাহে ২৫০ গ্রাম হিসাবে ক্যালসিয়াম দিতে হবে। খাবারের খরচ কম করার জন্য শাকসবজির বর্জ্য অংশ দিয়ে খাবারের ১০ শতাংশ পরিমাণ পূরণ করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য রক্ষা : মুক্তচারণ ব্যবস্থায় পালিত টার্কির অভ্যন্তরীণ (গোল কৃমি) ও বাহ্য (ফাউল মাইট) পরজীবী সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে। তাই পাখিদের ভালো বিকাশের জন্য মাসে একবার ডিওয়ার্মিং ও ডিপিং করা আবশ্যক।
নিবিড় পালন পদ্ধতি : বাসস্থান টার্কিদের রোদ, বৃষ্টি, হাওয়া, শিকারি জীবজন্তু থেকে বাঁচায় ও আরাম জোগায়। অপেক্ষাকৃত গরম অঞ্চলগুলোতে খামার করলে ঘরগুলো লম্বালম্বি পূর্ব থেকে পশ্চিমে রাখতে হবে। খোলা ঘরের প্রস্থ ৯ মিটারের বেশি হওয়া চলবে না। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঘরের উচ্চতা ২.৬ থেকে ৩.৩ মিটারের মধ্যে থাকতে হবে। বৃষ্টির ছাঁট আটকাতে ঘরের চালা এক মিটার বাড়িয়ে রাখতে হবে। ঘরের মেঝে সস্তা, টেকসই, নিরাপদ ও আর্দ্রতারোধক বস্তু যেমন কংক্রিটের হওয়া বাঞ্ছনীয়। কম বয়সি এবং প্রাপ্ত বয়স্ক পাখির ঘরের মধ্যে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং পাশাপাশি দুটি ঘরের মধ্যে অন্তত ২০ মিটার দূরত্ব থাকতে হবে। ডিপ লিটার পদ্ধতিতে টার্কি পালনের সাধারণ পরিচালনা ব্যবস্থা মুরগি পালনেরই মতো, তবে বড় আকারের পাখিটির জন্য যথাযথ বসবাস, ওয়াটারার ও ফিডারের জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সুবিধা : উন্নত উৎপাদন দক্ষতা; উন্নততর পরিচালন ও ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ।
নিবিড় পালন ব্যবস্থায় খাদ্য : নিবিড় পালন ব্যবস্থায় টার্কি মুরগিকে ম্যাশ ও পেলেট (ট্যাবলেট) দুইভাবেই খাবার দিতে হবে। মুরগির তুলনায় টার্কির শক্তি, প্রোটিন ও খনিজের প্রয়োজন বেশি। সেজন্য টার্কির খাবারে এগুলোর আধিক্য থাকতে হবে। খাবার মাটিতে না দিয়ে ফিডারে দিতে হবে। যেহেতু পুরুষ ও মাদির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শক্তির (এনার্জি) পরিমাণ আলাদা, তাই ভালো ফল পাওয়ার জন্য তাদের পৃথকভাবে পালন করতে হবে। টার্কিদের সব সময় অবিরাম পরিষ্কার পানির প্রয়োজন। গ্রীষ্মকালে ওয়াটারারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে এবং আপেক্ষতৃক ঠাণ্ডা সময়ে খাবার দিতে হবে। পায়ের দুর্বলতা এড়াতে দিনে ৩০-৪০ গ্রাম হারে ঝিনুকের খোসার গুঁড়া দিতে হবে এবং খাবারে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হলে তা আস্তে আস্তে করতে হবে।
সবুজ খাদ্য : নিবিড় পদ্ধতিতে ড্রাই ম্যাশ হিসাবে মোট খাদ্যের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সবুজ খাবার দেয়া যায়। সব বয়সের টার্কির জন্য টাটকা লুসার্ন প্রথম শ্রেণীর সবুজ খাদ্য। এছাড়া খাবারের খরচ কম করার জন্য ডেসম্যান্থাস ও স্টাইলো কুচি করে টার্কিদের খাওয়ান যেতে পারে।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি মুরগি পালন দিনে দিনে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। টার্কি বাণিজ্যিক মাংস উৎপাদনের জন্য খুবই উপযুক্ত কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা দেখতে খুব সুন্দর হয় এবং আপনার বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে করতে সাহায্য করে। টার্কি মুরগি দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং ব্রয়লার মুরগির মতো খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অন্যান্য পরিস্থিতিতে টার্কি মুরগি পালনের জন্য খুবই উপযুক্ত। এগুলোর পালন মুরগির মতো খুব সহজ। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি পালন-ব্যবসা করে ভালো মুনাফা অর্জনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। একটুখানি সচেতনতা, সরকারি গবেষণা এবং ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক অংশগ্রহণে এ টার্কিই হয়ে উঠতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যম এমনকি ব্যপক উৎপাদনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উপায়।
ঢাকার উত্তর বাড্ডা সাতারকুল রোডে পূর্ব পদরদিয়া গ্রামের নতুন মসজিদের (মাস্তান বাড়ি) পাশে জনাব শাহীন হাওলাদার ও মিরাজ হোসেনে গড়ে তুলেছেন একটি বাণিজ্যিক টার্কি মুরগির খামার। টার্কি সম্পর্কে আগ্রহী ব্যক্তিগণ প্রতি শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে এ খামারটি পরিদর্শন করতে পারেন এবং টার্কি খামার স্থাপনসহ যাবতীয় পরামর্শ ও তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিতে পারেন অথবা ০১৯৭২২২১২৩৪ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
গাজী মাজহারুল ইসলাম অপু*
*গ্রাম : পূর্বধুপতি, ডাকঘর : ধুপতি, সদর, বরগুনা
চালের গুণমান অটুট রেখে অধিক হারে ধান উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ধানের জাতসহ টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনালগ্ন থেকে সৌরভে-গৌরবে অতিবাহিত এ সময়ে এ প্রতিষ্ঠান ৮২টি উচ্চফলনশীল ধানের জাতসহ এমন কিছু সফলতা অর্জন করেছে যা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আশান্বিত করে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিশেষ প্রণোদনা ও যথাযথ তদারকির ফলে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর গতিশীলতা নিশ্চিত হয়েছে।
বিগত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সাত বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রির অর্জন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ প্রতিষ্ঠানের ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। এগুলো বরিশাল, ভাঙ্গা, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুর, সাতক্ষীরা ও সোনাগাজীতে অবস্থিত। অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার ধান গবেষণার জন্য বরিশাল, লবণাক্ত এলাকার জন্য সাতক্ষীরা, খরাপ্রবণ এলাকার জন্য রাজশাহী, ঠাণ্ডাপ্রবণ ও জলাবদ্ধ এলাকার জন্য রংপুর, গভীর পানির ধান গবেষণার জন্য হবিগঞ্জ ও ভাঙ্গা, উপকূলীয় এলাকার জন্য সোনাগাজী এবং অনূকূল পরিবেশের জন্য কুমিল্লা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের ১৯টি গবেষণা বিভাগ, ১১টি প্রশাসনিক শাখা ও বিভাগ এবং দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বেশ কিছু টেস্ট সাইট রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রি। বর্তমানে ২৩১ বিজ্ঞানীসহ এর জনবল ৬১৪ জন। একটি পরিচালনা পর্ষদের এর নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম সুসম্পন্ন করেন। এর ভিশন হচ্ছে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ধানের জাতের উন্নয়ন ও ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন। এর মিশনের মধ্যে আছে কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে কম খরচে অধিক ও মানসম্পন্ন ধান উৎপাদনে অবদান রাখা; জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মান সংরক্ষণের মাধ্যমে রোগ, পোকামাকড়, সার, মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; বৈরী পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো ধানের জাত উদ্ভাবন; প্রাগ্রসর গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি; দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্যে উদ্ভাবন ও উন্নয়ন ।
আটটি প্রোগ্রাম এরিয়ার মাধ্যমে ব্রির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে জাত উন্নয়ন, ফসল-মাটি-পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, ধানভিত্তিক খামার বিন্যাস, আর্থসামাজিক ও নীতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং আঞ্চলিক কার্যালয়।
এ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ (বিএডিসি) সাত শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর ১০০ টনের বেশি ব্রিডার বীজ সরবরাহ করে যা পরে আরও বর্ধিত আকারে বীজ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সারাদেশে অনুকূল পরিবেশে বোরো মৌসুমে সর্বাধিক ফলন ও কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্রি ধান২৮ এবং ব্রি ধান২৯। আমন মৌসুমে অনুরূপ সফলতার নজির সৃষ্টি করেছে বিআর১১। সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে এ জাতগুলোর পরিপূরক হিসেবে সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৫৮ এবং ব্রি ধান৪৯। পাশাপাশি লবণাক্ত পরিবেশ উপযোগী ধানের জাত ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১ এবং ব্রি ধান৪৭ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ধান উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ জাতগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ব্রি উদ্ভাবিত দুটি ধানের জাত বিআর১৬ এবং বিআর২৫ লো জিআই বা নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স গুণ সম্পন্ন। লো জিআই খাবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিরাপদ। ব্রি ধান৬২ জিঙ্ক সমৃদ্ধ আগাম জাত। মানব দেহের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করবে এ জাত। এ ছাড়াও কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তির যথাযথ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে।
দেশে দুর্ভিক্ষজনিত মানবিক বিপর্যয় এড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ব্রি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে দেশের ৭ কোটি ১২ লাখ জনসংখ্যার জন্য চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আবাদি জমির পরিমাণ প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমছে। এ সত্ত্বেও দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। চাল উৎপাদনে এ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে প্রধানত ব্রির উচ্চফলনশীল ধানের জাত, আধুনিক চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে। ব্রির কয়েকটি প্রযুক্তি কৃষকদের চাষাবাদ খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে অবদান রাখছে। এগুলো হচ্ছে-
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এ রকম ধারাবাহিক সফলতার তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার তথা জনগণের তথ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্রির পক্ষ থেকে যেসব কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেগুলোর মধ্যে আছে ধান উৎপাদন প্রযুক্তি তথ্য সংবলিত বইপত্র, লিফলেট, ফোল্ডার, পোস্টার, বার্ষিক প্রতিবেদন, জার্নাল ইত্যাদি প্রকাশ ও বিতরণ; গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা, সংবাদ সম্মেলন, প্রেস ব্রিফিং, গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, ফিল্ড ডে, ফার্মারস স্কুল, প্রশিক্ষণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জরিপ, কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম ও সম্প্রসারণকর্মীদের সরাসরি অবহিতকরণ এবং সংবাদ প্রচার, নিয়মিত বেতার সম্প্রচারে অংশ নেয়া ইত্যাদি।
*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার পূর্ব ছাড়াইতকান্দি গ্রামের মৃত মাস্টার আহসান আহম্মদ খাঁনের পুত্র কৃষক মো. আজম খাঁন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একযুগ আগে পাড়ি দেন প্রবাসে। এক যুগের বেশি সময় পরিবার থেকে দূরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবাস জীবনে ভাগ্য পরিবর্তন আশানুরূপ না হওয়ায় ২০০৮ সালে সংকল্প করে দেশে পরিবারের কাছে থেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের পেশা হিসেবে কৃষিকে বেছে নেন। এজন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন কৃষি দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তারা উন্নত কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করলেও তাদের মূলধন হিসেবে কোনো ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। পরবর্তীতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ থাকায় তিনি সেখান থেকে মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্রবাস জীবনের সঞ্চিত ৫০ হাজার টাকার সাথে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ হিসেবে প্রাপ্ত ৪০ হাজার টাকাসহ মোট ৯০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। তারপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাছ চাষের পাশাপাশি তিনি মাছের পোনা উৎপাদনও শুরু করেন এবং সেগুলো বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে জেলা মৎস্য দপ্তর থেকে সম্মাননা স্মারকসহ পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমানে তাঁর নিজ গ্রামে ১১টি পুকুর যার আয়তন ৪ একর এ মাছ চাষ ও মাছের পোনা উৎপাদন করেন। এসব পুকুরে চাষকৃত মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, শিং, মাগুর ও কৈ মাছ। এছাড়াও মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় তার আরও দুইটি পুকুর রয়েছে। এ দুইটি পুকুরের আয়তন ১০ একর। এ পুকুরগুলোতে রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের পাশাপাশি চাষ করেন বাটা, কোরাল, টেংরা ও চিংড়ি মাছ। মাছ ছাড়াও তার বর্তমানে রয়েছে নার্সারি ও ডেইরি খামার। তার নার্সারিতে কলা, পেয়ারা, কাঁঠাল, লাউ এসবের চারা কলম উৎপাদন করে নিজে ব্যবহার করেন এবং এলাকার লোকদের মাঝে বিতরণ করেন। তার ডেইরি খামারে বর্তমানে ছোট বড় ১৩টি গরু আছে। এর মধ্যে ৫টি গাভী দুধ দিচ্ছে। এ ৫টি গাভী থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়। দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা হিসাবে মাসে মোট ৪৫ হাজার টাকা আয় হয়। তাঁর এসব খামারে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ১০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের পারিশ্রমিক হিসাবে আজম খাঁনের মাসিক ব্যয় প্রায় ৪০ হাজার হাজার টাকা। এ বছর তার এসব প্রকল্পের মাছ চাষ, পোনা উৎপাদন, ডেইরি খামার ও নার্সারি থেকে সব খরচ বাদ দিয়েও ১০ লাখ টাকার ওপরে লাভ হবে বলে আশা করছেন।
আজম খাঁন একজন সচেতন কৃষক। কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন কেবল একার পক্ষে সম্ভব নয় বলে তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ‘সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার’ ওপর কৃষক মাঠ স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর স্থানীয় উপসহকারী কৃষি অফিসারের পরামর্শে গড়ে তোলেন ছাড়াইতকান্দি আইপিএম ক্লাব। পরবর্তীতে এ ক্লাবের সক্রিয় কর্মকা-ের জন্য ২০১১ সালে কৃষি তথ্য সার্ভিসের উদ্যোগে ক্লাবটিতে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এআইসিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এআইসিসি কেন্দ্রের প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রয়োগ করে নিয়মিত কৃষি প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনসহ উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন এলাকার কৃষকদের মাঝে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে আজম খাঁন সংগ্রহ করেন টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত কলার চারা, বারমাসী আম, উচ্চফলনশীল ধান বীজ, ফল গাছের পরিচর্যার নানা কৌশলসহ উন্নত সর্বশেষ প্রযুক্তি। তার উৎপাদিত বিষমুক্ত ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে আশপাশের কৃষকও বর্তমানে বিষমুক্ত ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। একই গ্রামের এনামুল করিম রাসেল নামে এক যুবক তার দেখাদেখি এবং পরামর্শে নার্সারি স্থাপন, মাছ চাষ ও কলা চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। আজম খাঁন বিভিন্ন সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে কৃষি, মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আজম খাঁন একজন কৃষিপ্রযুক্তি নির্ভর সফল কৃষক। আগামীতে তিনি গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প, খামারের বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন ও জৈবসার উৎপাদন এবং ফলদ নার্সারি স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন। কৃষি খামার স্থাপনে সাফল্যের জন্য প্রযুক্তির পাশপাশি বাজারজাতকরণ ও ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ বড় নেয়ামক বলে তিনি মনে করেন। কৃষি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো প্রশিক্ষণের সাথে মূলধন সরবরাহ ও বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দপ্তরগুলোর কার্যপরিধি বৃদ্ধি করা হলে কৃষককে প্রযুক্তির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সম্মৃদ্ধ করা হবে বলে তিনি মনে করেন।
মো. জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া*
*এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, চট্টগ্রাম। মোবাইল : ০১৮১৭-৭৮৬৫৭৩
মানুষ বৃক্ষ রোপণে সচেতন হওয়ায় নার্সারি শিল্প এখন লাভজনক। বিশেষ করে কলমের চারা উৎপাদন ও রোপণের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। ফল ও বৃক্ষ উৎপাদন কম পুঁজিতে লাভজনক ব্যবসা। এ বইয়ে বাণিজ্যিকভাবে নার্সারিতে চারা উৎপাদন, কলমের চারা তৈরি, ৪৪টি ফল ও বৃক্ষের চাষ পদ্ধতি, পরিচর্যা, রোগবালাই, পোকামাকড় দমন, বৃক্ষরোপণের স্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও বৃক্ষ কড়চা, ভেষজ উদ্ভিদ, ফলে সুস্থতা ও কৃষি বনায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি নার্সারিতে চারা উৎপাদনকারী, ফলচাষি, বৃক্ষ উৎপাদনকারী, বৃক্ষপ্রেমিক, সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগবে বলে আশা করি। নার্সারি ফল ও বৃক্ষ চাষ, পৃষ্ঠা : ৯৬, মূল্য : ১৮০ টাকা।
পোলট্রি, মাছ, গরু, ছাগল ও মহিষের খামার করা সবচেয়ে লাভজনক। এজন্য এগুলোর উৎপাদন খুব অগ্রসরমান। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি না জানার জন্য কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বইয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার স্থাপন, লেয়ার ফার্ম, ব্রয়লার ফার্ম; কোয়েল, কবুতর, হাঁস ও রাজহাঁস পালন; মাছ ও চিংড়ি চাষ, মাছ সংরক্ষণ, গবাদিপশু পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, দুগ্ধ খামার করা ও পোলট্রি, মাছ ও গরুর রোগবালাই ও উৎপাদনে সমস্যার সমাধান আলোচনা করা হয়েছে। এ বইয়ের পদ্ধতিতে ফার্ম করলে লাভবান হবেন। বইটি খামারকারী, পশু পালন, ভেটেরিনারি ও ফিশারিজের শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্রছাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার উপকারে আসবে বলে আশা করি।
হাঁস মুরগি মাছ ও গবাদিপশুর খামার, পৃষ্ঠা : ১৭৬, মূল্য : ২৭০ টাকা।
পৃথিবীতে সবচেয়ে অগ্রসরমান ও বেশি গবেষণা হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে। কৃষিতে গবেষণা যত বাড়ছে কৃষি সমৃদ্ধি তত বেশি হচ্ছে। কৃষিতে এখন কৃত্রিম উপগ্রহ, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রজননে সফটওয়্যার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, অর্গানিক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কৃষির সর্বশেষ কিছু প্রযুক্তি নিয়ে লেখা বইটি অনেক অজানাকে জানার সুযোগ করে দেবে এবং জানার বিষয়কে আরও গভীরে নিয়ে যাবে। আশা করি কৃষিবিদ, কৃষি শিক্ষক, কৃষি শিক্ষার্থী, কৃষিবিজ্ঞানীসহ কৃষি সংশ্লিষ্টদের অনেক কাজে লাগবে। বইয়ের পৃষ্ঠা : ১৪৪, মূল্য : ২৪০ টাকা।
কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ কৃষি পণ্যের দাম কম। অধিকাংশ ফসল চাষ করে কৃষকদের লোকসান হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সমস্যার কারণে কৃষি এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত। বেকারত্ব দূর এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে কৃষিকে লাভজনক করার লক্ষ্যে বইটিতে বিভিন্ন রকম ফল, ফুল, মাশরুম, রেশম, মৌ, বায়োগ্যাস, দানাদার শস্য, তেলশস্য, আঁশ ফসলের বৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতি ও উন্নত জাত লেখা হয়েছে। এছাড়াও সার, মাটি ও সেচের সাশ্রয় উৎপাদন প্রযুক্তি এবং বিষাক্ত খাদ্য, ফল-শাকসবজির পুষ্টি জেনেটিক খাদ্য ও ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে সহজ ভাষায় বইটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটি কৃষিবিদ, কৃষি শিক্ষার্থী, কৃষি শিক্ষক, কৃষক, খামারের মালিকসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট সবার কাজে লাগবে। বইটির মোট পৃষ্ঠা : ২৩৭, মূল্য : ৩২০ টাকা।
সব বই আকর্ষণীয় কমিশনে বিক্রয় করা হয়। ডাকযোগেও বই পাওয়া যায়। প্রাপ্তি স্থান : কৃষি তথ্য সার্ভিস বিক্রয় কেন্দ্র, খামারবাড়ি, কৃষি খামারবাড়ি সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। লেখক : কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ, মোবাইল : ০১৭১১ ৯৫৪১৪৩ (ফোন করে বই সংগ্রহ করা যায়)।
মো. আমিনুল ইসলাম দুলাল*
*স্ক্রিপ্ট রাইটার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারাবড়ি, ঢাকা-১২১৫
সামনে আগাই
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
১.
নরম কাদার বুকে পরম আদরে
রুয়ে আসি ছোট চারা সোনালি ধানের।
তারপর তোলপাড় উল্লাস বানের
গিলে খায় গোড়া সুদ্ধ আগাম প্রহরে।
খায়নি আমার শুধু জমির ফসল
বাবার দিনের ঘর দাদার কবর
বেবাক নিয়েছে বানে আর দিয়ে জ্বর
শরীরের শক্তিটুকু নিয়েছে দখল।
বাজি ধরে টিকে আছি ছাড়িনি সাহস।
কত আর নিবে নিক প্রাণ যদি থাকে
তার সাথে আশাটারে নিয়ে এক ফাঁকে
পুনরায় বাঁধি বুক দুঃখ করি বশ।
জীবনের শুরু থেকে করছি লড়াই
আপদ পেছনে ফেলে সামনে আগাই॥
২.
একদা ছিলাম বনে পশুর মতন
ঝড় ঝঞ্ঝা শ্বাপদেরা তাড়া করে পিছে
উপরে সূর্যের আলো সাপ খেলে নিচে
তার মাঝে কাটিয়েছি দুরন্ত জীবন।
বাঘে টানে পালা গরু যমে টানে প্রাণ
গাছ ভেঙে ফাটে মাথা ভিমরুল নাচে
শত শত বিপদেরা ঘুরে আশে পাশে
পাহার গড়িয়ে নামে সর্বানাশা বান।
আবার মানুষজন ভিন মুল্লুকের
মারমুখী হয়ে লুট করেছে সম্পদ
নিয়ে গেছে নর নারী যা ছিল নগদ
সমস্ত নতুন করে গড়ে তুলি ফের।
এভাবে অসভ্য থেকে সভ্য দুনিয়াতে
যুথবদ্ধ যুদ্ধে টিকে আছি পেটেভাতে॥
ধানক্ষেত
খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম**
চারদিকে সবুজের রঙ ছড়িয়ে
মাঠখানিকে বলো দিল ভরিয়ে
কচি কচি পাতারা বাতাসে দোলে
যেন তারা নিজেরা কতকথা বলে
দুষ্ট ছেলে যেমন হঠাৎ করে
লাফ দিয়ে দিয় শূন্যে উড়ে
তেমনি দমকা বাতাস ধানের পাতায়
হঠাৎ করে এসে দোলা দিয়ে যায়
দুলে উঠা পাতাতে রোদ লেগে
ঘুমে থাকা সুন্দর উঠে জেগে
ঢেউ খেলে যায় মাঠের বুকে
আমি চেয়ে থাকি মনের সুখে॥
নবান্ন
মোহাম্মদ নূর আলম গন্ধী***
মাঠের পরে মাঠ ভরেছে
সোনারাঙা ধান,
কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে মুখে আজি
নবান্নের-ই গান!
সোনা ধানে ভরবে গোলা
মনে জাগলো খুশির বান,
কৃষাণ-কৃষাণী ভেজায় খুশি
পেয়ে নতুন ধানের ঘ্রাণ!
নতুন চালের পিঠা পায়েস মুড়ি খই
ঘরে-ঘরে হবে এবার রান্না,
নবান্নের-ই আগমনে বইছে বাংলায়
অফুরন্ত সুখের বন্যা!
*অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, মোবাইল: ০১৫৫৮৩০১৯০৮<ahiqbal.ahmed@yahoo.com> **উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর, mesbahul65@gmail.com ***উপসহকারী কৃষি অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিস, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭১৮৭৫৩৪৮১/০১৯৪৮০২৫৮২৬
মো. জহিরুল ইসলাম
গ্রাম- তৈলটুপি, উপজেলা- হরিনাকুণ্ডু
জেলা- ঝিনাইদহ
প্রশ্ন : পেয়ারা গাছের পাতা ও ডালে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। ফলে পাতা ঝরে যায় ও ডাল মরে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাওয়া যাবে?
উত্তর : পেয়ারা গাছে ছাতরা পোকা (Mealy bug) আক্রমণ হলে এ ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। এরা পাতা ও ডালের রস চুষে নেয় ফলে গাছ দুর্বল হয়। প্রতিকার হিসেবে প্রথমে আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি থেকে ১৫-২০ সেন্টিমিটার উপরে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা মুড়ে দিতে হবে যাতে মিলিবাগ গাছে উঠতে না পারে।
জৈব বালাইনাশক বাইকাও ২ মিলি/লিটার পানি ব্যবহার করা অথবা নিমবিসিডিন (০.৪%) ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি. রগর, টাফগর বা ২ গ্রাম মিগসিন বা সপসিন মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
মো. নূর আলম
গ্রাম-সাহাডুগী, থানা-বীরগঞ্জ
জেলা- দিনাজপুর
প্রশ্ন : লিচু গাছের পাতা ভেতরের দিকে কুঁকড়িয়ে যাচ্ছে এবং পাতার নিচের দিকে লাল মখমলের মতো হয়ে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : এটি লিচুর মাইটের আক্রমণের লক্ষণ। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। মধ্য ভাদ্র থেকে কার্তিক মাস এবং মাঘের শেষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত প্রতি লিটার পানিতে ওমাইট ২ মিলিলিটার বা থিওভিট ২ গ্রাম বা ভার্টিমাক ১.২৫ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে পাতায় ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার করে স্প্রে করতে হবে।
মো. ইয়াজ উদ্দিন
গ্রাম-টীলাগাঁও, থানা-কুলাউড়া
জেলা-মৌলভীবাজার
প্রশ্ন : ড্রাগন ফল গাছের কাণ্ডে কালো কালো দাগ হচ্ছে এবং কাণ্ডে পচে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : এটি ড্রাগনের কা- পচা রোগের লক্ষণ। কাণ্ডের পচা অংশ সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা ১ গ্রাম নইন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
সনৎ মণ্ডল
গ্রাম- হাগিমপুর, থানা- লালপুর
জেলা- নাটোর
প্রশ্ন : ধানের পাতা সাদা হয়ে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : সাধারণত ধানে পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণে এ লক্ষণ দেখা যায়। এ পোকা পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে এবং পাতা মুড়িয়ে বসে থাকে। এর জন্য-
-ক্ষেতে ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
-সন্ধ্যার পর আলোক ফাঁদের ব্যবস্থা করতে হবে।
-শতকরা ২৫ ভাগ পাতা আক্রান্ত হলে কীটনাশক সেভিন ৮৫ ডচ ব্যবহার করতে হবে।
সবুজ
গ্রাম- পদ্মপাড়া, থানা- গাবতলী
জেলা- বগুড়া
প্রশ্ন : শিম গাছের পাতায় সরু কালো দাগ পড়ছে। কাণ্ডে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে পচে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি শিমের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এর জন্য
-আক্রান্ত অংশ ছাঁটাই করে তা পুড়ে ফেলতে হবে।
-ছত্রাকনাশক টপসিন (২ গ্রাম/লিটার), টিল্ট-২৫০ ইসি (০.৫ মিলি/লিটার) অথবা ডাইথেন-এম-৪৫ (২ গ্রাম/লিটার) মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
-পরবর্তীতে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
-বীজ বপনের আগে ব্যাভিস্টিন বা প্রোভেক্স দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে।
সাখাওয়াত হোসাইন
গ্রাম- বাকেরগঞ্জ, উপজেলা- বাকেরগঞ্জ
জেলা- বরিশাল
প্রশ্ন : রুইজাতীয় মাছ এবং মলা পুঁটির মিশ্র চাষের পুকুর প্রস্তুতি, পোনা মজুদ, খাদ্য ও সার প্রয়োগ পদ্ধতি কী?
উত্তর : পুকুর প্রস্তুতি : বন্যামুক্ত জলাশয়ে পাড় মেরামত ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। রাক্ষুসে ও ক্ষতিকর প্রাণী সরিয়ে ফেলতে হবে। ১ কেজি চুন-শতাংশ হিসাবে দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৭-৮ দিন পরে শতাংশে প্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে। পোনা মজুদ : শতাংশপ্রতি ১০-১৫ সেমি. আকারের ৩০-৩২টি রুইজাতীয় পোনা, ৫-৬ সেমি. আকারের ৬০টি মলা ও ৬০টি পুঁটি মাছ ছাড়তে হবে। পোনা মজুদের পর থেকে পোনার দেহের ওজনের ৫-১০ শতাংশ হারে সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে। গ্রাস কার্পের জন্য কলাপাতা, বাঁধাকপির পাতা, নেপিয়ার দিতে হবে। প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য পোনা ছাড়ার ১০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৪-৬ কেজি গোবর ও ১০০ গ্রাম ইউরিয়া দিতে হবে।
সুজন খান
গ্রাম- বালিপাড়া, উপজেলা- ত্রিশাল
জেলা- ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : পোনা পরিবহন করার জন্য ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া দরকার?
উত্তর : বড় পাতিলে, ড্রামে এবং পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহন করা যায়। পরিবহন দূরত্ব, প্রজাতি, শারীরিক অবস্থা ও তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। তবে পরিবহনের পূর্বে পোনাকে অভুক্ত রাখতে হবে। পাতিলের পানিতে খাবার লবণ ১ মুষ্টি মিশিয়ে পোনা পরিবহন করলে ভালো হয়। পোনা আনার পর ২-৩ ঘণ্টা হাপায় রেখে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।
রামকৃষ্ণ
গ্রাম- দক্ষিণ বেড়েঙ্গা, উপজেলা- জলডাঙ্গা
জেলা- নীলফামারী
প্রশ্ন : গরুর রক্ত আমাশয়ে (কক্সিভিওসিস) কী করণীয়?
উত্তর : কট্রিম ভেট বোলাম প্রতি ৮০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২টি বোলাম সেবন করতে হবে। প্রতিদিন নির্ধারিত মাত্রা ২ ভাগ করে সকালে ও বিকালে ১২ ঘণ্টা পর পর সেবন করতে হয়। রোগের লক্ষণ দূর হওয়ার পর আরও দুই দিন বোলাম খাওয়াতে হবে।
স্টমাপ্লেক্স ভেট ১০০-৩০০ কেজি ওজনের জন্য ১-২ স্যাচেট (২০-৪০ গ্রাম);
১৫-২৫ কেজি ওজনের জন্য ১/৪-১/২ স্যাচেট (১০-২০ গ্রাম);
২৫ কেজি বা এর চেয়ে বেশি দৈহিক ওজনের জন্য ১/২-১ স্যাচেট (১০-২০ গ্রাম)।
উপরের মাত্রা অনুযায়ী স্টমাপ্লেক্স ভেট পাউডার ১ থেকে ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিনে ২ বার করে পর পর ২-৩ দিন খাওয়াতে হবে।
রাসেল
গ্রাম-ঝটিকা, উপজেলা-আলফাডাঙ্গা
জেলা- ফরিদপুর
প্রশ্ন : কবুতরের খাদ্য সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : কবুতর প্রধানত গম, ভুট্টা, ধান, চাল, কাউন, জোয়ার, কালাই, খেসারি, সরিষা ইত্যাদি শস্যদানা খেয়ে থাকে। ঘরের সামনে পাত্রে খাদ্য রেখে দিলে খেয়ে নেয়। স্বাস্থ্য রক্ষা, দৈহিক বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের জন্য এদের সুষম খাদ্য দেয়া প্রয়োজন। মুরগির জন্য তৈরি সুষম খাদ্য কবুতরকেও দেয়া যেতে পারে। কবুতরের খাদ্যে শতকরা ১৫ থেকে ১৬ ভাগ আমিষ থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি কবুতর দৈনিক ৩৫ থেকে ৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য খেয়ে থাকে। কবুতরের বাচ্চার দ্রুত বৃদ্ধি এবং বয়স্ক কবুতরের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝিনুক চূর্ণ, চুনাপাথর, কাঠ কয়লা চূর্ণ, হাড়ের গুঁড়া ও লবণ দিয়ে গ্রিট মিকচার খনিজ মিশ্রণ তৈরি করে খেতে দিতে হয়। এছাড়া প্রতিদিন কিছু কাঁচা শাকসবজি কবুতরকে খেতে দেয়া প্রয়োজন।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবার জন্য রইল শীতের শুভেচ্ছা। হেমন্ত শেষে ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে শীত এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝে। শীত কৃষিতে একটি নিশ্চিত মৌসুম। আর তাই বাংলার মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়াকে ছুড়ে ফেলে কৃষকভাইরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। মাঠের কাজে সহায়তার জন্য সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোনো কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
বোরো ধান
গম
ভুট্টা
আলু
তুলা
ডাল ও তেল ফসল
শাকসবজি
গাছপালা
প্রাণিসম্পদ
মৎস্যসম্পদ
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন কতখানি বাড়ে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ loag@ais.gov.bd