Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

পাতকুয়া : বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত (মাঘ ১৪২৩)

বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা এবং ভারতের মালদা জেলা বরেন্দ্র  ভূমির অন্তর্গত। বরেন্দ্র অঞ্চল মূলত ২৩-৪৮-৩০ উত্তর অক্ষাংশ ও ২৬-৩৮ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮-০২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ও ৮৯-৫৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। কর্কটক্রান্তি রেখা এ স্থানের সামান্য দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে গেছে। বরেন্দ্র শব্দের সরল ও ব্যাকরণসম্মত অর্থ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের বরে (বর+ইন্দ্র) অর্থাৎ অনুগ্রহ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে বরেন্দ্র এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ এগুলোকে ‘ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র’ বলা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম। পরীক্ষা করে দেখে দেখা গেছে, এ মাটিতে শতকরা মাত্র ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্র্থ রয়েছে। এ মাটিতে নাইট্টোজেন কম, ফসফরাস কম-মধ্যম, পটাশ, গন্ধক ও দস্তা কম-মধ্যম মানের রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বেলে বা বেলে দো-আঁশ জাতীয় মাটিতে নেই। এখানে লাল মাটি রয়েছে। পলি অঞ্চলে লাল মাটি দেখা যায় না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাড়ি (খাল) এবং পুকুর ছিল কিন্তু বর্তমানে এগুলো বেশিরভাগ মাছ চাষে লিজ দেয়া হয়েছে। এর কারণে সেখান থেকে পানি নিয়ে সেচ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া  নদীর পানি শুকিয়ে সেচ কাজে বিঘ্ন হচ্ছে। এ এলাকায় চাষাবাদ করা কঠিন। এজন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে অনেক এলাকা চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু বেশি পানি তোলার কারণে এ এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাই বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার এ এলাকা নিয়ে বিশেষ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এর মধ্যে পাতকুয়া একটি। পাতকুয়া (
Dugwell) হলো ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিম্ন পর্যন্ত গোলাকার আকৃতিতে মাটি খনন করে চারপাশ থেকে চুয়ানো পানি (Leaching water) ধরে রাখার আধার। পাতকুয়া হাজার বছরের পুরনো একটি প্রযুক্তি যা ব্যবহার করে  মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য বালতির সাথে রশি বেঁধে পানি উত্তোলন করে তা খাবার ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করত।
কিন্তু আধুনিক পাতকুয়াটি মূলত একটি নতুন উদ্ভাবন। এ ধারনাটি বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপির। ধারণাটি বাস্তাবায়নের জন্য তিনি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলে তার নির্দেশক্রমে পাতকুয়া খনন করা হয়েছে এবং এ পাতকুয়া থেকে জনসাধারণ খাবার পানি ব্যবহারের পাশাপাশি সেচকাজে ব্যবহার করার সুফল ভোগ করছে।  এটি খনন আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের পরিবর্তে যান্ত্রিক পাওয়ার রিগ, দৈহিক শক্তির পরিবর্তে সোলার শক্তি ব্যবহার করে পানি উত্তোলন, ফ্যানেল আকৃতির কাঠামোতে বৃষ্টির পানি ধরে তা পাতকুয়ায় নির্গমন করে  ভূগর্ভস্থ পানির  স্তরের মজুদ  বৃদ্ধিসহ পাতকুয়াকে খাবার পানির পাশাপাশি সেচ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া শুরু হয়েছে। নলকূপগুলো  থেকে আজ আর সেভাবে পনি পাওয়া যাচ্ছে না।
এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে প্রধান প্রধান হচ্ছে আম, লিচু, কলা, কুল, পেয়ারা। তবে কয়েক বছর ধরে স্ট্রবেরির চাষ এ অঞ্চলে বাড়ছে। সবজি চাষে এরই মধ্যে এ অঞ্চল অনেক অগগ্রতি লাভ করেছে। এর মধ্যে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী উপজেলায় লতিরাজ কচু, মাচায় তরমুজ চাষ, ফুল চাষ শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় পলিব্যাগ দিয়ে পেয়ারা উৎপাদন, পেঁয়াজ  বীজ উৎপাদন, মাল্টা, ড্রাগন ফল, মুগ ডাল ব্যাপকভাবে আবাদ শুরু হয়েছে। আর এ কারণে এ অঞ্চলে পানির ঘাটতি হলে তা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণে পাতকুয়ার মতো প্রযুক্তি এখন সময়ের দাবি।
পাতকুয়া খনন ও ব্যবহারের যন্ত্রাংশ
হাইড্রোলিক পাওয়ার রিগ (বিভিন্ন কাটারসহ); আরসিসি রিং ৪০ ইঞ্চি থেকে ৫০ ইঞ্চি (চাহিদাকৃতি বয়স অনুয়ায়ী); রিং স্থাপনের জন্য উইঞ্চ (winch); ওয়ার রোপ; ৯০০ ওয়াট  থেকে  ১৫০০ ওয়াট  ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার প্যানেল; সোলার পাম্প (পানি উত্তোলনের চাহিদা অনুয়ায়ী ক্ষমতাসম্পন্ন); ২০০০ লিটার থেকে ৩০০০ লিটার ধারণক্ষমতার  ওয়াটার ট্যাঙ্ক; শস্য উৎপাদনের জন্য ভূ-গর্ভস্থ নালা (১ ইঞ্চি থেকে ১.৫ ইঞ্চি  ব্যাসের পাইপ ) প্রায় ৩৫০ মিটার (ইউপিভিসি পাইপ); সেচ কাজের জন্য পানি সরবরাহ  টাপ স্ট্যান্ড (৮-১০টি); খাবার-গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারকল্পে পানির ট্যাপ (প্রয়োজনমতো); ড্রিপ (Drip) স্প্রিংকলার 
(Sprinkler) পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যে ফ্রেক্সিবল পাউপ  ইমিউর অন্যান্য যন্ত্রাংশ।
পাতকুয়া খনন করার জন্য প্রথমে রিগ মেশিনের সাথে সংযুক্ত ড্রিলিং রডের নিম্ন প্রান্তে ৫০ ইঞ্চি থেকে ৫২ ইঞ্চি ডায়ার কাটার লাগানো হয়। যান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে হাউড্রোলিক পদ্ধতিতে কাটারকে ঘুরিয়ে মাটি কাটা হয়। খননকৃত মাটিকে পানির সাথে মিশ্রিত করে রির্ভাস সার্কুলেশন পদ্ধতিতে কাদা পাম্পের  সাহায্যে তোলা হয়। এভাবে কাক্ষিত গভীরতায় না যাওয়া পর্যন্ত পাতকুয়া খনন কাজ অব্যাহত থাকে। খনন কাজ সম্পন্ন হলে ওয়ার রোপের সাহায্যে  আরসিসি রিং পর্যায়ক্রমে নিচ থেকে ওপরের  দিকে স্থাপন করা হয়। এভাবে পাতকুয়া তৈরি করা হয়।
পাতকুয়া খননের পর পাতকুয়ায় জমা পানি উত্তোলনের জন্য সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদিত সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাম্পের সাহায্যে পানি হেডার ট্যাঙ্কে উত্তোলন করা হয়। হেডার ট্যাঙ্কে উত্তোলিত পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে সেচ, খাবার পানি গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি পাতকুয়ার ৩৫০ মিটার পাইপলাইন থাকে। এ পাইপলাইনে মাঝে মাঝে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আউটলেট নির্মাণ করা থাকে। সেখান থেকে পাশের জমিতে সরাসরি এবং দূরের জমিতে ফিতা পাইপের মাধ্যমে ফসলে সেচ দেয়া হয়। এছাড়া খাবার পানির জন্য কুয়ার পাশে একাধিক ট্যাপ স্থাপন করা আছে। সেখান থেকে স্থানীয় জনসাধারণ খরায় ও গৃহস্থালি কাজে পানি ব্যবহার করে থাকে।
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার চশসহবত মৌজায় একটি পাতকুয়া খননপূর্বক সৌরশক্তির সাহায্যে পানি উত্তোলনের জন্যে সোলার পাম্প স্থাপন  করা হয়েছে, যার বিবরণ হলো-
কুয়ার গভীরতা : ৭০ ফুট; কুয়ার ব্যাস ৪৪ ইঞ্চি; রিংয়ের গভীরতা ৭০ ফুট + ৩ ফুট (প্লাট ফর্মের উপরে); সোলার প্যানেল  ৯০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন (প্যানেল ৬টি); প্যাম্পের ডিসচার্জ : ১ লিটার  / সে.; প্রতিদিন প্রাপ্ত পানির পরিমাণ : ১৫০০০ থেকে ১৮০০০ লিটার; পাতকুয়া খননের ব্যয় : ৪.৫০ লাখ টাকা; পাম্পসহ সোলার প্যানেল স্থাপন ব্যয় : ৪.১৫ লাখ টাকা; পাইপলাইন নির্মাণ ব্যয়: ১.২৫ লাখ টাকা। (সূত্র : বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেট)
পাককুয়া ব্যবহারের সুফল অনেক। এটি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর  চাপ কমায় কারণ এ অঞ্চলে যত বেশি গভীর নলকূপের ব্যবহার কমানো যায় ততই মঙ্গল। এছাড়া খরার সময় খরাপ্রবণ এলাকায় স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন ধরে রাখা যায়। বিশেষ করে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা এসবের আবাদের জন্য। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার রোধ করে জলবায়ু পারিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব রোধ করা সম্ভব। আর বেশি বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি করানো এবং সংরক্ষণ করা যায়। পাতকুয়া ব্যবহারে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার করা সম্ভব। আর এর সাথে স্থানীয় জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করানো সম্ভব। যেহেতু পাতকুয়ার পানি উত্তোলন কাজে  বিদ্যুৎ শক্তির পরিবর্তে  সৌরশক্তি ব্যবহার হয় সেহেতু এটি পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে সহায়ক। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি হুমকির মুখে পড়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে। সেজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণাসহ কৃষিতে নানামুখী উদ্যোগ। পাতকুয়ার মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যদি আরও ব্যবহৃত হয় তবে এ এলাকার কৃষিতে নতুন আলোর সন্ধান দিবে এটি অবশ্যম্ভাবী।

কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক অফিস, রাজশাহী

বিস্তারিত
আমাদের সমৃদ্ধ সম্পদের প্রতিশ্রুত হাতছানি

মানুষের বিশুদ্ধ ও নিখুঁত শ্রম কখনও বৃথা যায়। এর ফল একদিন না একদিন আসেই। স্বাধীনতার পর ৪৫ বছর ধরে বিনিয়োগকৃত আমাদের সম্মিলিত শ্রম আর বিনিয়োগের ফল অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আয়েশিভাবে পেতে শুরু করেছি। কৃষিতে আমদানিকারক বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে রফতানিকারক দেশে পরিণত হচ্ছে। দুর্যোগে দুর্বিপাকে আমরা হাঁটু গেড়ে স্তব্ধ হয়ে স্থবির হয়ে পড়তাম। খেই হারিয়ে ফেলতাম। এখন আমরা সেসব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সক্ষমতা অর্জন করেছি এগিয়ে যাচ্ছি সম্মুখ পানে। কৃষি প্রধান দেশে কৃষির উন্নতি সমৃদ্ধি মানে আমাদের সার্বিক সমৃদ্ধি। আমাদের অর্থনীতির চাকা নিত্য সচল আছে কৃষির সিংহভাগ অবদানের জন্য। এভাবে চললে একদিন ঠিকই আমরা মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে বলতে পারব আসলেই বাংলাদেশ গর্বিত কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিতে এখন শুধুই জয়জয়কারের ধ্বনী। কৃষিতে আমাদের পরিকল্পনা, গবেষণা, সম্প্রসারণ, বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা আর সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণের কারণে আমাদের অল্প সময়ে এ অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। আশা করা যায়, কৃষির এ সাফল্য অব্যাহত থাকবে আগামী দিনের জন্য। মনে রাখতে হবে স্থায়িত্বশীল কৃষির যুতসই বৈশিষ্ট্য ছাড়া আমাদের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না কখনও।
আমাদের কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, কৃষি সম্প্রসারণবিদ, কৃষি উন্নয়ন কর্মী, কৃষির সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন আবিষ্কার উদ্ভাবন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন গর্বিত পালক সংযুক্ত করছেন কৃষি উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে। আর সেগুলো কাজে লাগিয়ে  দেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছি দূরের গর্বিত বাতিঘরে।
ধানভিত্তিক সাফল্য
ধান তথা ভাত আমদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) খাদ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় অগ্রগতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। এর উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে- হাইব্রিডের ৪টি জাতসহ ৮২টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন। এদের ফলন সনাতন জাতের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। ব্রি’র এসব উদ্ভাবনের মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল ৯টি, আকস্মিক বন্যা মোকাবিলার ২টি, খরাসহনশীল ৩টি, স্বল্প জীবনকালের ৬টি, জিঙ্কসমৃদ্ধ ৪টি, সর্বাধিক ফলনের ৫টি এবং সুগন্ধি ও রফতানি উপযোগী ৪টি জাতসহ ৮২টি জাত এ যাবৎকাল উদ্ভাবিত হয়েছে। আধুনিক ধান চাষের জন্য মাটি, পানি ও সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ৫০টির বেশি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যার সাথে রয়েছে ৩৯টি লাভজনক ধানভিত্তিক শস্যক্রম উদ্ভাবন। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান আবাদে এ যাবত ব্রি ৩২টি কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। বালাই আক্রমণ থেকে ধানকে রক্ষার জন্য ধানের ১০টি প্রধানসহ ৩২টি রোগ ও ২০টি প্রধানসহ ২৬৬টি ক্ষতিকর পোকা শনাক্তকরণ এবং বালাই ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবিত হয়েছে। ধানভিত্তিক জ্ঞানসমৃদ্ধ করে দক্ষ মানুষ দিয়ে ধান উৎপাদনকে আরও বেগবান করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১ লাখের বেশি কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রচারেই প্রসার এ ভাবনাকে মাথায় রেখে ধানবিষয়ক ২৯১টি বইপত্র প্রকাশ বিতরণ করেছে। দেশ-বিদেশের ৮ হাজারের বেশি ধানের জার্মপ্লাজম ব্রি জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করে আমাদের ভবিষ্যত ধান প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতি বছর ব্রি থেকে প্রায় ১০০ টন ব্রিডার বীজ উৎপাদন করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা হয় যা পরে আরও বাড়িয়ে বীজ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারাদেশের কৃষকের কাছে চলে যায়।
তথ্য বলে, দেশে আবাদকৃত উফশী ধানের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত চাষ করা হয় এবং এ থেকে পাওয়া যায় দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯১ ভাগ। আর সেকারণেই ১৯৭০-৭১ সালে এদেশে চালের উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন। ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণে প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগ থেকে ৪৬ টাকা মুনাফা অর্জন। গর্বের সাথে বলতে হয়, বর্তমানে বিশ্বের ১৪টি দেশে ব্রি উদ্ভাবিত ১৯টি জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে।
আর জাতওয়ারি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা যদি বলি তাহলে দাঁড়ায় ব্রি এ যাবত ৪টি হাইব্রিড, ৭৮টি ইনব্রিড মোট ৮২টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে আউশ+আমন+বোরো ১টি জাত আউশ+বোরো ২ মৌসুমের জন্য ১১টি জাত, বোরো মৌসুমের জন্য ২৩টি জাত, আউশের জন্য ১০টি জাত, আমনের জন্য ৩৫টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বোরো মৌসুমের সুগন্ধি জাত ব্রি ধান৫০। বোরো মৌসুমে লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান ৬১, ব্রি ধান ৬৭। বোরো আগাম জাত বিআর৭, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫। বোরোতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মেগা জাত ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯। জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান-ব্রি ধান ৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৪। জিঙ্ক সমৃদ্ধ বোরো ধান- ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭৪। জিঙ্ক সমৃদ্ধ আমন ধান- ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭২। বোরো ঠাণ্ডা সহিষ্ণু জাত- ব্রি ধান৩৬। হাওর এলাকা উপযোগী জাত-বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯। আমনে সরু ও সুগন্ধি জাত-বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০। আমন মৌসুমে লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত- ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৭। আমনে স্বল্প জীবনকাল ও খরা সহনশীল জাত ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৪৭ ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১। আমনে জলমগ্নতা সহনশীল জাত- ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২। নাবি আমন জাত বিআর২২, বিআর২৩, ব্রিধান৪৬। আমণে অলবণাক্ত জোয়ার ভাটার জাত ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭। আমনে সর্বাধিক জনপ্রিয় জাত মেগা ভ্যারাইটি- বিআর১১, ব্রি ধান৪৯। বোনা আউশের জাত বিআর২১, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৬৫। রোপা আউশের জাত বিআর২৬, ব্রি ধান ২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৫। শিলাপ্রবণ এলাকা উপযোগী জাত- বিআর ৮, বিআর৯। ব্রি হাইব্রিড জাত-ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ বোরো মৌসুমের জাত। ব্রিধান ৭২ জাতের বৈশিষ্ট্য হলো নিচু থেকে মাঝারি উঁচু জমিতে আমন ধান কাটার পর গম, সরিষা, ডাল আবাদ করা হয় সে জমিতে ব্রিধান৭২ চাষ করা হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও  ধান উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ জাতগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ব্রি উদ্ভাবিত দুইটি ধানের জাত  বিআর১৬ এবং বিআর২৫ লো জিআই বা নি¤œ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স গুণ সম্পন্ন। লো জিআই খাবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিরাপদ। এক সময় ধানের জাত আবিষ্কার করা হতো শুধু খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য। আর এখন আমরা বিলাসিতা করে ভাবছি অন্যান্য আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্যর ধানের জাত উদ্ভাবন আর আবিষ্কারের দিকে।
অন্যান্য ফসলে সাফল্য
সফলতার সাথে উচ্চফলনশীল জাতসহ অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আসছে আমাদের বিজ্ঞানীরা। দেশের জলবায়ু ও কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বিএআরআই এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৪৭৯টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৪৪২টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ৯২১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। দানাজাতীয় ফসল ৬৮, তেলজাতীয় ফসল ৪৩, ডালজাতীয় ফসল ৩৬, কন্দাল ফসল ১০০, সবজি ফসল ১০৯, ফল ৭৪, ফুল ১৬, মশলা ২৬, আঁশজাতীয় ০৬, নেশাজাতীয় ০১ মোট ৫৭৯৮টি ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। উৎপাদন প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে ফসল, মাটি, রোগবালাই এবং পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ১৯৪, কৃষি যন্ত্রপাতি ৩৩, সেচ এবং পানি ব্যবস্থাপনা ৩৫, শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ২৮, ফার্মিং সিস্টেম রিসার্চ ১৩৪, জীব প্রযুক্তি ১৮। মোট ৪৪২টি। সর্বমোট প্রযুক্তি (উদ্ভাবিত জাত+উৎপাদন প্রযুক্তি) : বিএআরআই এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৪৭৯টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৪৪২টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ৯২১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফলের ১০ হাজারের অধিক কৌলিসম্পদ (জার্মপ্লাজম) জিন ব্যাংকের মাধ্যমে সংরক্ষণ করছে।
পরমাণুভিত্তিক সাফল্য
বিনা কর্তৃক ৯টি ফসলের ৪২টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিনাছোলা- ৫ ও ৬, বিনামসুর-৪; ২০১০ : বিনাধান-৮ (লবণসহনশীল), বিনামুগ-৮, বিনাটমেটো-৬; ২০১১ বিনাসরিষা- ৭ ও ৮, বিনাতিল-২, বিনাসয়াবিন-১ ও ২, বিনামসুর-৫ ও ৬, বিনাটমেটো-৭, বিনা চীনাবাদাম-৫ ও ৬; বিনাধান ৯ ও বিনাধান-১০ (লবণসহনশীল); বিনাছোলা- ৭ ও ৮; বিনাটমেটো-৮, ৯ ও ১০; বিনাসয়াবিন-৩ ও ৪; বিনাতিল-৩; বিনামসুর-৭; বিনাধান- ১১ ও ১২ (বন্যা সহনশীল), ১৩ ও ১৪; বিনাসরিষা- ৯ ও ১০; ২০১৪ : বিনাধান-১৫ ও ১৬; বিনা চীনাবাদাম- ৭, ৮ ও ৯; বিনামসুর- ৮ ও ৯; বিনাধান-১৭, বিনাধান-১৮।
সোনালি আঁশের সাফল্য
বিজেআরআই-পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের ৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে তোষা পাটের ২টি, দেশি পাটের ৩টি, কেনাফের ১টি এবং মেস্তার ১টি। উদ্ভাবিত জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পাট পচনের আপদকালীন প্রযুক্তি হিসেবে পাওয়ার রিবনার, স্বয়ংক্রিয় জুট রিবনার, শীতকালীন সবজির সাথে পাট বীজ উৎপাদন, কৃষি বনায়ন পরিবেশে নাবি পাট বীজ উৎপাদন, নিমপাতার রস দিয়ে পাটের হলুদ মাকড় দমন এবং বাটা রসুনের সাহায্যে পাটবীজ শোধন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বল্প মূল্যের হালকা পাটের শপিং ব্যাগ, প্রাকৃতিক উৎস থেকে রঙ আহরণ করে পাটপণ্য রঞ্জন পদ্ধতি, পাটজাত শোষক তুলা, অগ্নিরোধী পাট বস্ত্র, জুটপ্লাস্টিক কম্পেজিটসহ ৬টি নতুন পাটপণ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা হয়েছে এবং সিনথেটিক উলের বিকল্প পাটউল ও পাট উলজাত সোয়েটার, পাটতুলা ও পাট তুলাজাত, সেনিটারি ন্যাপকিন, বেবি ন্যাপকিন, বিভিন্ন ইনসুলেটিং ম্যাটেরিয়াল, পাট এবং তুলার সংমিশ্রণে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত টেক্সটাইল পণ্য যেমন পর্দার কাপড়, বেড কভার, সোফা কভার, জিন্স এসব পণ্যের মান উন্নয়ন করা হয়েছে।
মিষ্টিভিত্তিক সাফল্য
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ যাবত আখের ৪৫টি উপযোগী জাত, ১০৫ এর বেশি সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি, সুগারবিটের ১৭টি জাত আনয়ন, তাল খেজুর, গোলপাতা, স্টেভিয়ার জাত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার যোগ্যফল আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।
অন্যান্য সাফল্য
একই সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন সংস্থা-দপ্তর অধিদপ্তর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউ, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি তাদের মেধাবী জনবলের মাধ্যমে জ্ঞান মেধা দক্ষতা আন্তরিকতা দিয়ে আবিষ্কার উদ্ভাবন সম্প্রসারণ করে স্ব মহিমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। কৃষিবান্ধব তথ্য প্রযুক্তিগুলো কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়ন করে দেশের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। এ যাবতকাল কৃষিতে আমাদের সাফল্যগাথায় সংযুক্ত আছে। বর্তমানে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন করেছি। বার্ষিক খাদ্য শস্য চাল, গম, ভুট্টা মিলে উৎপাদন ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন যা ১৯৭১ সালে ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। ধান উৎপাদনের সাফ্যল্যজনক ধারাবাহিকতার কারণে বর্তমানে ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ। আর আমরা এখন বিদেশে চাল রপ্তানিও করছি। শুধু কি তাই? সাহায্য আর খয়রাতি হিসেবে বিদেশে চাল সহায়তা দিচ্ছি। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয়। ২০১৫-১৬ বছরে মোট সবজি উৎপাদন ১ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন। সবজির মধ্যে আলু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৫-১৬ বছরে আলু উৎপদান ১ কোটি ৩ লাখ ৪ হাজার  মেট্রিক টন ও মিষ্টিআলু উৎপাদন ৭ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন। কম সময়ে ফলবান খাটো জাতের নারিকেলের প্রবর্তন করা হয়েছে বিশেষকরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এ জাতের আবাদ বাড়ছে।  দেশীয় ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার এবং পাটসহ ৫ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। ফসলের  প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন ১৫৬টি। বোরো ধানের উচ্চফলনশীল  বীজ সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বোরো ধানের উফশী বীজ ২০১৫-১৬ বছরে জাতীয় চাহিদার ৮৫.৯৮% নিশ্চিত করেছে, ২০০৮-০৯ বছরে এ সরবরাহ ছিল মাত্র ৩৮%। সেচ সুবিধা  সম্প্রসারিত হয়ে ৯ লাখ ৮১ হাজার ১৯৮ হেক্টরে উন্নিত হয়েছে। সার, জ্বালানি ও সেচ কাজে বিদ্যুতের  ভর্তুকি প্রদান ৫৬ হাজার ৭৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। খামার যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান ১৬৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান ২  কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন। খুচরা সার বিক্রেতা  নিয়োগ ৩৬ হাজার ৩৪৯ জন। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক একাউন্ট  খোলা ১  কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি। ৪ দফা  ননইউরিয়া সারের মূল্য কমিয়ে টিএসপি ২২ টাকা, এমওপি ১৫ টাকা, ডিএপি ২৫ টাকা মূল্য নির্ধারণ। নিয়োগ-কর্মসংস্থান ৭ হাজার ৭১৬ জন। মাটি ও জলবায়ু ভিত্তিতে ফসলের ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন ১৭টি। ডিজিটাল কৃষি তথা ই-কৃষির প্রবর্তন পুরো দেশের অফিসে ই-কৃষি, কমিউনিটি রেডিও, ই-বুক, কৃষি কল সেন্টারের মতো তথ্য প্রদানকারী উদ্ভাবনী সংযুক্ত হয়েছে আমাদের কৃষি ভুবনে। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৩সহ বিভিন্ন কৃষি উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন। এসব গৃহীত কার্যক্রম কৃষি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
গর্বিত সাফল্য
কৃষিতে আবিষ্কার উদ্ভাবনের গর্বিত সিরিজ যা আমাদের কৃষিকে বেগবান করেছে ব্যঞ্জরিত আঙ্গিকে সেসবের দিকে যদি এক পলক দৃষ্টি দেয়া যায় তাহলে দেখা যায় কত কিছু আবিষ্কার উদ্ভাবন হয়ে গেছে এরই মধ্যে আমাদের কৃষি ভুবনে? এগুলো এখন আরও সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর সময় যৌক্তিকভাবে নিখুঁতভাবে হিসেব করে। আমাদের লাগসই প্রযুক্তিতে বীজ সংরক্ষণ, এলসিসি, ড্রামসিডার, এডব্লিউডি, কম্বাইন্ড হার্বেস্টার, ট্রান্সপ্লান্টার, সিডড্রিল, উইডার, থ্রেসার, পাওয়ার থ্রেসারসহ অন্যান্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কৃত্রিম পরাগায়ন, সমন্বিত কৃষি, ফসল আবাদে লগো পদ্ধতি, ফার্টিগেশন, হাইড্রোপনিক, মিশ্র ও সাথী ফসল চাষ, ড্রাগওয়েল বা পাতকুয়া, মাটি পরীক্ষা, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার, মিশ্রসার, ভার্মি কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট, জীবাণুসার, ছাদে বাগান, শুকনা বীজতলা, গাছের অঙ্গজ বংশ বিস্তার, ভাসমান ফসল চাষ, সর্জান পদ্ধতিতে চাষাবাদ, বিষমুক্ত পরিবেশবান্ধব কৃষি, আলোরফাঁদ, পার্সিং, সেক্স ফেরোমেন, বিষটোপ ব্যবহার, টিসুকালচার, মালচিং, জৈবপ্রযুক্তি, জৈবকৃষি, বসতবাড়ির প্রযুক্তি, অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা, বীজ শোধন, রিবন রেটিং, রাবার ড্যাম, সোলার সেচ, ফ্রুট ব্যাগিং, ফিতা পাইপ, ব্লকভিত্তিক সেচ, জমিতে মৌমাছি পালন, আইলে সবজি চাষ, কমিউনিটি বীজতলা, মাশরুম চাষ, উন্নত চুলা, বায়োগ্যাস, খাচায় মাছ চাষ, আইপিএম-আইসিএম, খাটো জাতের নারিকেল আবাদ, রাস্তার ধারে, পতিত অনাবাদি জায়গায় বৃক্ষরোপণ ফসল ফলানো, পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজিত তথ্য প্রযুক্তির বাস্তবায়ন, ব্যবহারকারীবান্ধব কৃষি তথ্যপ্রযুক্তির যৌক্তিক ব্যবহার, কৃষি তথ্য ও যোগযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক), কমিউনিটি রেডিও, কমিউনিটি টেলিভিশন, কৃষি কল সেন্টার, সুষ্ঠু প্রচার প্রচারণা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এসব একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।
আমরা অনেক কিছু করেছি পেয়েছি এ তুষ্টিতে বিভোর হয়ে থাকলে চলবে না। বরং সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নব নব আবিষ্কার আর উদ্ভাবনকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সময় ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে। দেশ যতদিন থাকবে কৃষিও ততদিন থাকবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষিও ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হবে আমাদের। কৃষি ছাড়া আমাদের আর কোনো বিশেষ গতি নেই। সুতরাং যুগের সাথে, সময়ের সাথে আর চাহিদার সাথে সমন্বয় করে কৃষির পরিকল্পনা, গবেষণা, বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা, তদারকি, মূল্যায়ন, সম্প্রসারণ সবকিছুই অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। বাংলার কৃষি যেভাবে এগোচ্ছে এ গতিধারাকে নিত্য বেগবান করতে হলে আমাদের সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনা মাফিক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমার আমাদের স্বপ্নের বাতিঘরে পৌঁছতে পারব অনায়াসে। আমার আমাদের আয়েশি বন্দরে আমাদের সফলতার নৌকা ভিড়াতে পারব গর্বের সাথে।

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫;
Subornoml @gmail.com

বিস্তারিত
সেচ সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব লাভজনক ফসল বিন্যাস

আমাদের দেশে বোরো ধান উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণ সেচের পানির প্রয়োজন হয়। সেচের পানি প্রধাণত মাটির নিচ থেকে গভীর বা অগভীর নলকূপের সাহয্যে তোলা হয়। নদী-নালা খাল-বিল থেকেও পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে সেচ দেয়া হয়। উভয়ক্ষেত্রেই পানি তোলার জন্য প্রয়োজন হয় শক্তির। শক্তি পাই বিদ্যুৎ বা ডিজেল পুড়িয়ে। প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে মাটির প্রকারভেদে ৩ থেকে ৫ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এই বিপুল পরিমাণ পানির সবটাই কি ধান গাছের জন্য অপরিহার্য? মোটেই নয়। অর্ধেকেরও বেশি পানি স্রেফ অপচয় হয়। এই অপচয়ের আর্থিক মূল্যটা কত? টাকার অংকে তা কয়েক হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সারাদেশে বোরো ধানের পিছনে অপচয়কৃত পানি তুলতে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ ও ডিজেল অপচয় হচ্ছে। এই অপচয় বন্ধ করা গেলে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে। ফলে কৃষক সরাসরি লাভবান হবে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সাশ্রয়ের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নতি হবে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বিগত প্রায় ৫ দশক ধরে ক্রমবর্ধিত হারে মাটির নিচ থেকে পানি তোলার কারণে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। বাড়ছে আর্সেনিক দূষণ ও পানি তোলার খরচ। এ অবস্থা চলতে থাকলে জনস্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। যা আমাদের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে বোরো ধানের চাষ মারাত্নক হুমকির সম্মুুীণ  হয়েছে। যে কারণে সরকার উত্তরবঙ্গে বোরো ধান চাষকে নিরুৎসাহিত করছে এবং দক্ষিণাঞ্চলে বোরো ধানের আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জোয়ারভাটা ও লবণাক্ততার মতো নানাবিধ সমস্যা সংকুল দক্ষিণাঞ্চল বোরো ধান উৎপাদনে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ রয়েছে।
এ অবস্থায়, মুল্যবান পানির এ ভয়াবহ অপচয় রোধ করতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষককে নিয়ে গত ২০০৭ সাল থেকে গবেষণা শুরু করা হয়। দীর্ঘ এক দশকের গবেষণায় বোরো ধান উৎপাদনের একটি পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পানি সাশ্রয়ী নতুন উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিটি ‘শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ প্রযুক্তি’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের পূর্বে রবি মৌসুমে একটা লম্বা সময় হাতে থাকে বলে একে কেন্দ্র করে নতুন একটি শস্য বিন্যাস গড়ে উঠেছে। স্বল্প মেয়াদী রোপা আমন-সরিষা-শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান-তিন ফসলভিত্তিক নব উদ্ভাবিত এ শস্য বিন্যাস এবং বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান উৎপাদন প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যে দিনাজপুর, রংপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকের মাঠে পরপর ৩ বছর পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতি বছরই সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেছে। কাজেই এই প্রযুক্তি ও শস্য বিন্যাসের ব্যাপক সম্প্রসারণ করা গেলে খরাপ্রবণ উত্তরবঙ্গেও পরিবেশসম্মত উপায়ে লাভজনকভাবে ধান চাষ অব্যাহত রাখা যাবে।
তাহলে প্রযুক্তিটি কি?
শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান উৎপাদন এমন একটি প্রযুক্তি যাতে জমি কাদা করতে হয় না কিংবা বীজ তলায় চারা তৈরির দরকার হয় না। জো অবস্থার মাটি বা শুকনা মাটিকে চাষ দিয়ে সরাসরি লাইনে বীজ বোনা হয়। কাইছথোড় পর্যন্ত মাটিতে কেবল রস থাকলেই চলে-দাঁড়ানো পানির দরকার হয় না। তবে কাইচথোড়ের পর থেকে ফুল আসা পর্যন্ত জমিতে ছিপছিপে ৩-৫ সেমি পানি রাখতে হয়। আর তাতে করে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি পানি সাশ্রয় হয়। এটি একটি নতুন প্রযুক্তি বিধায় ধাপে ধাপে এর ধারাবাহিক বর্ননা হলো-
জাত নির্বাচন: ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৫৮, বিনা ধান১৪ খুব ভালো ফলন দেয়। আর হাইব্রিড জাতের মধ্যে হীরা ধান ২ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান ৩ সন্তোষজনক ফলন দিতে সক্ষম। তবে ব্রি ধান২৯ জাতটি কোনভাবেই চাষ করা যাবে না।
বপন কাল: জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ (মাঘ মাসের মাঝামাঝি) থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি (ফাল্গুনের ১ম সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তার পূর্বে বীজ বপন করলে অতিরিক্ত শীতে চারা মারা যাওয়ার আশংকা থাকে।
জমি তৈরি : মাটির ধরন অনুযায়ী ৩/৪ টি আড়াআড়ি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। অতঃপর প্রয়োজন মতো মই দিয়ে জমি সমান করতে হবে।
বীজ তৈরি: বপনের পূর্বে বীজকে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পানি থেকে তুলে অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নিয়ে ৩০-৪০ ঘণ্টা জাগ দিতে হবে। বীজের মুখ সামান্য ফেটে অংকুর উকি দিলেই বীজ বপনের উপযুক্ত হবে বলে ধরে নিতে হবে। তবে খুব বেশি সময় ধরে জাগ দেয়া যাবে না। তাতে অংকুর লম্বা হয়ে যাওয়ার এবং বোনার পর তা শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বীজ বপন কৌশল: ছোট আঁকড়া বা আংটা দিয়ে ১০ ইঞ্চি দূরে দূরে ১-২ ইঞ্চি গভীর করে জমির উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লাইন টানতে হবে। প্রতি লাইনে ৬ ইঞ্চি পরপর ৫-৬টি করে বীজ ফেলে দুই পাশের মাটি দিয়ে বীজকে ঢেকে দিতে হবে। তবে ঠচগ বা বীজ বপন যন্ত্র দিয়ে আরও কম খরচে ও সহজে বীজ বুনা যায়।
সার ব্যবস্থাপনা: সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতির সাথে এর কোন পার্থক্য নেই। তবে পর্যাপ্ত জৈবসার দিতে পারলে ভালো হয়। জৈবসার মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ও অন্যান্য সারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। শেষ চাষের সময় মাটির প্রকারভেদে প্রয়োজন মতো টিএসপি, ডিএপি, জিপসাম এবং দস্তা সার ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে এমওপি বা পটাশ সারের অর্ধেক শেষ চাষের সময় এবং বাকি অর্ধেক কাইচথোড় আসার ঠিক আগে ছিটাতে হবে। এতে ধানের রোগবালাই ও পোকার উপদ্রব কম হবে। আর ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে বীজ বোনার ২৫, ৪০ ও ৫৫ দিন পর ছিটিয়ে দিতে হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা: মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বীজ বোনার পরপরই একটি হালকা সেচ দিতে হবে। ধান গাছের পেটে থোড় আসার আগ পর্যন্ত মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলেই চলে। এ সময়ের মধ্যে মাটিতে রসের ঘাটতি হলে প্রয়োজন মতো হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে থোড় আসার পর ধান গাছের পানির চাহিদা বেড়ে যায় তাই সে সময় জমিতে ছিপছিপে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ সময়টাতে (এপ্রিল মাসে) বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায় বলে খুব বেশি সেচ দিতে হয় না।
আগাছা ব্যবস্থাপনা: এ পদ্ধতির একটি প্রধান সমস্যা হলো আগাছা। জমি শুকনা থাকে বলে আগাছার ব্যাপক আক্রমণ হয়। তবে যথাসময়ে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করলে কার্যকরভাবে আগাছা দমন করা যায়। হাত দিয়ে বা নিড়ানি দিয়ে ৩/৪ বারে আগাছা সম্পূর্ণ নিমূর্ল করা যায় কিন্তু তাতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে বীজ বোনার ১-৩ দিনের মধ্যে প্রতি ৫ শতাংশ জমির জন্য অনুমোদিত আগাছানাশক স্প্রে করতে হবে। ২১ দিনের মাথায় একবার নিড়ানি দিয়ে আবারও পূর্বের নিয়মে আগাছানাশক স্প্রে করতে হবে। এতে আগাছা দমনের খরচ অনেক কমে যায় এবং আগাছার জন্য ফলনের কোনো ঘাটতি হয় না।
পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে লাগানো ধান গাছ বেশি শক্তিশালী ও কষ্টসহিষ্ণু হয় বলে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। একই মাঠের সকল জমিতে এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে পোকামাকড় বা পাখি কোন সমস্যাই নয়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ২/১টি জমিতে এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে শেষের দিকে যখন আশপাশের সকল জমির ধান কাটা হয়ে যায় তখন পোকমাকড় ও পাখির উপদ্রব বেড়ে যায়। কারণ এ ধানের মোট জীবনকাল কম হলেও সরাসরি বোনা হয় বলে প্রচলিত ধানের সপ্তাহ দুয়েক পরে পাকে। কাজেই মাঠের অধিকাংশ/সকল কৃষক মিলে একযোগে এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করতে হবে। তাহলে রোগ, পোকা বা পাখির কোন সমস্যাই থাকবে না।
ফসল কাটা: জাতভেদে বীজ বোনার ১০৫ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ মে মাসের মধ্যে ফসল কাটা যাবে। বীজতলা করতে হয় না বলে এ পদ্ধতিতে ধানের মোট জীবনকাল ২০-২৫ দিন কমে যায়। জাতভেদে হেক্টর প্রতি ৫.৫ - ৬.৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। শুকনা পদ্ধতিতে উৎপাদিত বোরো ধানের মোট জীবনকাল কম এবং বীজ বোনার আগে রবি মৌসুমে যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় বলে এ প্রযুক্তির বোরো ধানকে কেন্দ্র করে রোপা আমন-সারিষা-শুকনা পদ্ধতিতে বোরো-এই শস্য বিন্যাসটি গড়ে উঠেছে। নতুন উদ্ভাবিত এই শস্য বিন্যাসের রোপা আমন ও সরিষার চাষ পদ্ধতি হলো-
রোপা আমন: স্বল্প মেয়াদী রোপা আমনের জাত নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিনা ধান ৭, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭,  ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪ এর যেকোন একটি চাষ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদী জাত বলে চারার বয়স কোনক্রমেই ২০-২৫ দিনের বেশি নয়। জুলাই মাসে (আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহে) চারা লাগালে অক্টোবর মাসের শেষ দিকে (কার্তিকের মাঝামাঝি) ধান কাটা যাবে।
সরিষা: স্বল্প মেয়াদী সরিষার জাত নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে বারি সরিষা ১৪ ও বারি সরিষা ১৫ সবচেয়ে উপযুক্ত জাত। ৮৫-৯০ দিনের মধ্যে এ দুটো জাতের সরিষা কাটা যায়। নভেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহে (কার্তিকের শেষ সপ্তাহে) সরিষার বীজ বপন করে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহে (মাঘের শেষ সপ্তাহে) ফসল ঘরে তোলা যায়। বিঘা প্রতি ৫-৬ মন সরিষা পাওয়া যায়।
রোপা আমন-সরিষা-শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ফসল বিন্যাসটি প্রচলিত ফসল বিন্যাসের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ফসল বিন্যাস। সাধারণত কৃষক আমন মৌসুমে দীর্ঘ জীবন বিশিষ্ট ধান চাষ করেন যা নভেম্বর মাসের শেষের দিকে কাটার উপযুক্ত হয়। অন্যদিকে জানুয়ারি মাসে রোপা পদ্ধতির বোরো ধান চাষ হয় বলে কোন ক্রমেই সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। বিগত দুই-তিন দশকের চাষাবাদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বোরো ধানের কারণে এদেশে তেল ও ডালজাতীয় শস্যসহ অধিকাংশ রবি শস্যের আবাদ ব্যাপক হারে কমে গেছে। এমতাবস্থায়, ডাল ও ভোজ্য তেলের জন্য আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছি। নতুন উদ্ভাবিত ফসল বিন্যাসটি অনুসরণ করলে একদিকে যেমন সরিষাসহ অন্য অনেক রবি শস্যের উৎপাদন এলাকা বাড়বে অন্য দিকে আমন ও বোরো ধান উৎপাদনের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না। উল্লেখ্য যে, রোপা আমন-সরিষা-রোপা বোরো ফসল বিন্যাসটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে কিন্তু এ বিন্যাসটি সেচ সাশ্রয়ী নয় এবং রোপা আমন-সরিষা-শুকনা পদ্ধতিতে বোরো শস্য বিন্যাসের চেয়ে বেশি ফলন দিতে অক্ষম। সুতরাং স্বল্প সেচে লাভজনক উপায়ে দেশের সর্বত্র বোরো ধান চাষকে অব্যাহত রাখতে এবং ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য রবি শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে নতুন উদ্ভাবিত শুকনা পদ্ধতির বোরো চাষ এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ফসল বিন্যাসটির ব্যাপক সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আশা করি।

কৃষিবিদ ড. মো. মশিউর রহমান*
কৃষিবিদ মোজাহার হোসেন আহম্মদ**

*প্রফেসর **পিএইচডি ফেলো, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল: ০১৭১১০৭২৫৬১

বিস্তারিত
বোরো ধানে চিটা হওয়ার কারণ ও প্রতিকার

প্রকৃতির সাথে কৃষির রয়েছে সুনিবিড় সম্পর্ক। ফসল উৎপাদনে আবহাওয়ার প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা যতই সমৃদ্ধ হোক না কেন প্রকৃতির কাছে এখনও আমরা দারুণ অসহায়। অবশ্য প্রকৃতির সাথে সেতুবন্ধনেই আমাদের কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে। ধান ফসলও আবহাওয়ার প্রভাবে দারুণ প্রভাবিত। বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো এ হলো মৌসুমভিত্তিক ধান আবাদের বিন্যাস। শুধু আবহাওয়াজনিত কারণে এ বিন্যাসগুলোর রয়েছে স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বোরো মৌসুম ঠাণ্ডা হিম শীতলের সমন্বয়ে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হয়। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। বোরো মৌসুমের প্রতিটা দিনেই রয়েছে দারুণ বৈচিত্র্যতা। গবেষণায় দেখা গেছে, ধান গাছ তার জীবনচক্রের মধ্যে কাইচথোড় থেকে ফুল ফোটা  পর্যন্ত সময়ে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম সহ্য করতে পারে না। ওই সময় বাতাসের তাপমাত্রা যদি ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অথবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে যায় তাহলে ধানে ব্যাপকভাবে চিটা দেখা দেয়। তাছাড়া এ সময়ে খরা, ঝড়, পোকামাকড় বা রোগবালায়ের আক্রমণ হলেও চিটা হয়ে থাকে।
ধানের জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে নিম্ন তাপমাত্রা
গবেষণা মোতাবেক ধান গাছের জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রিটিক্যাল (নিম্ন) তাপমাত্রার একটি স্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে। ধানের জীবন চক্রের অঙ্কুরোদগম অবস্থায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চারা অবস্থায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুশি অবস্থায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, থোড় অবস্থায় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফুল ফোটা অবস্থায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে তাপমাত্রা চলে গেলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
ধানে চিটা হওয়ার মূল কারণ
স্বাভাবিকভাবে ধানে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ চিটা হয়। চিটার পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হলে ধরে নিতে হবে থোড় থেকে ফুল ফোটা এবং ধান পাকার আগ পর্যন্ত ফসল কোনো না কোনো প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে, যেমন অসহনীয় ঠাণ্ডা বা গরম, খরা বা অতিবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ছা, পোকা ও রোগবালাই।
ঠাণ্ডা :  রাতের তাপমাত্রা ১২-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনের তাপমাত্রা ২৮-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কাইচথোড় থেকে থোড় অবস্থা অবধি) ধান চিটা হওয়ার জন্য মোটামুটি সংকট তাপমাত্রা। তবে এই অবস্থা পাঁচ-ছয় দিন শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকলেই কেবল অতিরিক্ত চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাতের তাপমাত্রা সংকট মাত্রায় নেমে এলেও যদি দিনের তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি থাকে তবে চিটা হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
গরম : ধানের জন্য অসহনীয় তাপমাত্রা হলো ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।
ঝড়ো বাতাস : ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ থেকে পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়। এতে ফুলের অঙ্গগুলো গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। আবার ঝড়ো বাতাস পরাগায়ন, গর্ভধারণ ও ধানের মধ্যে চালের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এতে ধানের সবুজ খোসা  খয়েরি বা কালো রঙ ধারণ করে। ফলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে।
খরা : খরার কারণে শীষের শাখা বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বিকৃত ও বন্ধ্যা ধানের জন্ম দেয়ায় চিটা হয়ে যায়।
ঠাণ্ডাজনিত কারণের লক্ষণ
চারা অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ থাকলে চারা মারা যায়। কুশি অবস্থায় বাড় বাড়তি কমে যায়, গাছ হলুদ হয়ে যায়, থোড় অবস্থায় শীষ পুরোপুরি বের হতে পারে না, শীষের অগ্রভাগের ধান মরে যায় বা সম্পূর্ণ চিটা হয়ে যায়।
প্রতিরোধের উপায়
ফসল চক্রে নেমে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করা কঠিন। কিন্তু বোরো ধান অগ্রহায়ণের শুরুতে বীজ বপন করলে ধানের থোড় এবং ফুল ফোটা অসহনীয় নিম্ন বা উচ্চ তাপমাত্রায় পড়ে না, ফলে ঠাণ্ডা ও গরম এমনকি ঝড়ো বাতাসজনিত ক্ষতি থেকেও রেহাই পাওয়া সম্ভব। চিটা ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ হলো-

  • ব্রি ধান২৮ এর ক্ষেত্রে ১৫-৩০ নভেম্বরের মধ্যে এবং ব্রি ধান২৯ এর ক্ষেত্রে ৫-২৫ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন সম্পন্ন করতে হবে।  অর্থাৎ দীর্ঘ জীবনকাল সম্পন্ন (১৫০ দিনের উপর) ধানের জাতগুলো নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং স্বল্প জীবনকালের (১৫০ দিনের নিচে) জাতগুলো ১৫ নভেম্বর থেকে বীজতলায় বপন করতে হবে।
  • বোরো মৌসুমে কেবল ব্রি ধান২৮ চাষ না করে বিআর ১, ব্রি ধান৩৫ ও ব্রি ধান৩৬ এর আবাদ করতে হবে।
  • বীজতলায় চারা থাকা অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ চললে চারার উচ্চতা ভেদে ৫-১০ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে। তাছাড়া স্বচ্ছ এবং পাতলা পলিথিনের ছাউনি দিয়ে শৈত্যপ্রবাহকালে দিনে ও রাতে ঢেকে রাখতে হবে।
  • চারা রোপণের জন্য ৩৫ থেকে ৪৫ বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। কুশি অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ চললে জমিতে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে। তাছাড়া থোড় ও ফুল ফোটা স্তরে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থাকলেও ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখলে চিটার পরিমাণ কমানো যায়।
  • অতি আক্রমণকাতর জাতের আবাদ পরিহার করা বা অবস্থার প্রেক্ষাপটে কৃষক আবাদ অব্যাহত রাখলে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি পরিমিত ইউরিয়া সার ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
  • আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

 ব্রি ধান২৮ এর গড় জীবনকাল ১৪০ দিন। মনে করি, একজন কৃষক ২৫ নভেম্বর বীজতলায় বীজ বপন করল। ৪০ দিন বয়সের চারা মাঠে রোপণ করেন (অর্থাৎ ০৪ জানুয়ারি)। মূল জমিতে চারা লাগানোর পর থেকে সর্বোচ্চ কুশি স্তর পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন (অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি)। এরপর ধান গাছের প্রজনন পর্যায়ের কাইচথোড় স্তর শুরু হয়। ধান গাছে কাইচথোড় থেকে ফুল ফোটা স্তর পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৩০ দিন (অর্থাৎ ১৫ মার্চ)। পরে ধান পাকা পর্যায়ের দুধ স্তর শুরু হয়ে পরিপক্বতায় পৌঁছাতে প্রায় ৩০ দিন সময় লাগে (অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল)। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, জানুয়ারি মাস সবচেষে শীতল মাস। তাছাড়া এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে। হাওর অঞ্চলে আগাম বোরো ধান আবাদ করলে অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বীজতলা এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মূল জমিতে রোপণ করলে নিশ্চিত অতিরিক্ত ঠাণ্ডাকালীন (১৫ জানুয়ারি) প্রজনন পর্যায়ের কাইচথোড় স্তর আক্রান্ত হয় ফলে চিটা হয়। ঠাণ্ডাজনিত কারণে চিটা হলে আমরা এটাকে কোল্ড ইনজুরি বলে থাকি। আবার অনেক কৃষক ভাইয়েরা যদি একটু দেরিতে বোরো আবাদ করেন অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তাহলে প্রজনন পর্যায়ের কাইচথোড় স্তরটি অতি গরমকালীন (১৫ মার্চ) গরমে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে ধানে চিটা হতে পারে।
এক কথায় বলতে গেলে, ব্রি ধান২৮, ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সমযে ৪৫ দিনের চারা রোপণ করলে সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ব্রি ধান২৯, ২০ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৫ দিনের চারা রোপণ করলে চিটার পরিমাণ কম হয় এবং ফলন বেশি হয়। তাই ব্রি ধান২৯ এর বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ০৫ থেকে ২৫ নভেম্বর এবং ব্রি ধান২৮ এর বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ১৫ থেকে ২৫ নভেম্বর। তাই উফশী নাবি জাতগুলো ৫ নভেম্বর এবং আগাম জাতগুলো ১৫ নভেম্বর থেকে বীজ বপন শুরু করলে ফসলের থোড়-গর্ভাবস্থা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করতে পারে, ফলে ঠাণ্ডা বা গরমের কারণে ধান চিটামুক্ত হবে এবং ফলন বেশি হবে। মূলকথা হলো ধানের কাইচথোড় থেকে ফুল স্তর পর্যন্ত সময়টুকু অতিরিক্ত ঠাণ্ডা (জানুয়ারি থেকে মধ্য ফেব্রয়ারি) এবং অসহনীয় গরম (মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল) এ সময়ে ফ্রেমে যেন না পড়ে সেদিকে একটু বিশেষ  খেয়াল রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের স্বাভাবিক কৃষি কাজ ও অগ্রগতিকে ল-ভ- করে দেয়। ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শৈত্যপ্রবাহ, অসহনীয় উত্তাপ, ঝড়, বন্যা, পোকামাকড়, রোগবালাই এর প্রাদুর্ভাব সমূলে নির্মূল করা সম্ভব নয় তবে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। তাই কৃষকদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। জয়  হোক কৃষকের।

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট

বিস্তারিত
বিনা ধান১৮ : বোরো ধানের নতুন জাত

বিনা ধান১৮ বোরো মৌসুমের চাষাবাদের উপযোগী নতুন একটি জাত যা পরমাণু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। জাতটির বৈশিষ্ট্য ব্যাপারে প্রধান গবেষক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ সিএসও বলেন এটি উচ্চফলনশীল বোরো ধানের জাত। উচ্চফলনশীল বোরো ধানের জাত ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে ১২-১৫ আগে পাকে অথচ ব্রি ধান২৯ এর সমান ফলন দেয়। গাছ শক্ত বলে হেলে পড়ে না। পাতা গাঢ় সবুজ, লম্বা ও চওড়া। ডিগ পাতা খাঁড়া। জীবনকাল বোরো মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন। যথোপযুক্ত পরিচর্যায় বোরো মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ৭.৫-৮.০ টন ফলন দেয়। রান্নার পর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘক্ষণ রাখলে নষ্ট হয় না। জাতটি  পাতা পোড়া, খোল পচা ও কা- পচা এসব রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া এ জাতটির প্রায় সব ধরনের পোকার আক্রমণ বিশেষ করে বাদামি গাছ ফড়িং, গলমাছি ও পামরি পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। বিনা ধান১৮ বোরো মৌসুমের জন্য অনুমোদিত হলেও জাতটি আউশ মৌসুমে চাষ করা যায়।
আঞ্চলিক উপযোগিতা : লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের প্রায় সব মধ্যম উঁচু ও মধ্যম নিচু জমিতে বিশেষ করে বৃহত্তম রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে জাতটির অধিক ফলন পাওয়া যায়।
চাষাবাদ পদ্ধতি : জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী বোরো জাতের মতোই। জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি দেয়া হলো-
বীজ হার, বীজ বাছাই ও শোধন : প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০ কেজি বা একরপ্রতি ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। ভারি, পুষ্ট ও  রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করে এবং বপনের আগে বীজ শোধন করা ভালো।
বীজতলা তৈরি : বোরো মৌসুমে অঞ্চল ভেদে ২০ কার্তিক থেকে ৫ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত  ০৫ শতাংশ (২০০ বর্গমিটার) পরিমাণ বীজতলায় ১০ কেজি বীজ ফেলা যায়।
চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি : বোরো মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ কালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে ৫০ দিনের চারা রোপণ করলেও তেমন ক্ষতি হয় না। বেশি বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই বোরো মৌসুমের জন্য ৬ সপ্তাহের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা  কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। প্রতি গুছিতে একটি করে সতেজ চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। প্রয়োজনে ২-৩ টি সুস্থ-সবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপণ করা যেতে পারে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সেন্টিমিটার থাকা ভালো। চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে কোনো চারা মারা গেলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে।  

সারের নাম

 

বীজতলার জন্য

রোপা ক্ষেতের জন্য

প্রতি হেক্টরে

প্রতি একরে

প্রতি শতাংশে

প্রতি হেক্টরে

প্রতি একরে

প্রতি বিঘায়

ইউরিয়া (কেজি)

১০০-১২০

৪০-৫০

০.৪-০.৫

২২০-২৫০

৯০-১০০

৩০-৩৫

টিএসপি (কেজি)

৮০-১০০

৩২-৪০

০.৩-০.৪

১১০-১২০

৪৫-৫০

১৪-১৭

এমওপি (কেজি)

৩০-৫০

১২-২০

০.১-০.২

১৪০-১৭০

৫৫-৬৫

১৮-২৩

জিপসাম

-

-

-

৬৫-৮০

২৫-৩০

৮-১০

দস্তা

-

-

-

৮-১০

৪.০০-৪.৫০

১.৫

রোপণ জন্য জমি তৈরির শেষ চাষের আগে সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং দস্তা জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে চাষের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক ৩০-৩৫ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে অথবা এক তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর, এক তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ১৮-২০ দিন পর এবং শেষ তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োগ করতে হবে। অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি বোরাক্স ২-৩ কেজি (একর প্রতি ১ কেজি) এবং দস্তা সার ৪-৫ কেজি (একর প্রতি ২ কেজি) হারে দেয়া যেতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ২-১ দিন আগে জমির অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে আগাছা দমন করতে হবে। জমির উর্বরতা ও ফসলের অবস্থায় ওপর নির্ভর করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে।
পরিচর্যা : এ জাতের ধানের পরিচর্যা অন্যান্য উফশী জাতের মতোই। চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে দ্রুত নিড়ানি যন্ত্র বা হাতের সাহায্যে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করতে হবে। চারা রোপণের পর থেকে জমিতে ৫-৭ সেন্টিমিটার (২-৩ ইঞ্চি) পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ধান গাছে যখন কাইচথোড় আসা শুরু করে তখন পানির পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো উচিত। ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভালো।
রোগ ও পোকা মাকড় দমন : রোগ বালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ দেখা দিলে কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পোকা মাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে প্রচলিত তরল বা দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া খোলা ঝলসানো, ব্যাক্টেরিয়াল লিফব্ল­াইট বা পাতা ঝলসানো ও অন্যান্য রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত  রোগনাশক প্রয়োগ করতে হবে। খোল ঝলসানো, কা-পচা রোগ দেখা দিলে বেনলেট, হোমাই, বেভিস্টিন বা টপসিন মিথাইল মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োাগ করা যেতে পারে।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ : শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়। শীষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। মাড়াই করার পর ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে গোলাজাত করতে হবে।

ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল*
*প্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১৬৭৪৯৪২৯

বিস্তারিত
কৃষি উন্নয়নে ই-কৃষি : কিছু সরকারি উদ্যোগ

কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সামগ্রিক মানোন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রসার সম্পর্কে আজ আর কারোরই সংশয় নেই। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এসব কিছুই তথ্যপ্রযুক্তির সারথি হিসেবে আমাদের দৈনন্দিনের কাজকে করেছে গতিশীল। ডিজিটাল শব্দটি যেন আজ জীবনেরই একটি অংশ হয়ে গেছে। অথচ বছর কয়েক আগে বর্তমান সরকার যখন ‘ভিশন ২০২১’ রূপকল্পের মধ্য দিয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে তখন অনেকের কাছে এটি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। গত সাত বছরে বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারি পদক্ষেপ, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সে সাথে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগের ফলেই দেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ছোট্ট একটি যন্ত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমরা আক্ষরিক অর্থেই সারা বিশ্ব জগতকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন প্রায় ১১ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ, ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখ জন এবং তন্মধ্যে মোবাইলেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন প্রায় ৫ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ (বিটিআরসি; আগস্ট ২০১৬)। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, সে সাথে বাড়ছে আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারও। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার প্রায় ২০% যা ২০১৮ সালের শুরুতে ৪০% হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব তথ্য উপাত্ত যথার্থই প্রমাণ করে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা মোটেই পিছিয়ে নেই বরং বিশ্ব মানচিত্র আমরা একটি উদাহরণ সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছি। সেবা গ্রহীতার কষ্ট, খরচ ও সময় লাঘব করে বিভিন্ন নাগরিক সেবা যেমন-অনলাইনে পরীক্ষার ফল প্রদান, ফরম পূরণ, বিদেশে চাকরি বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্যা তুলে ধরে সমাধান গ্রহণ এসব আজ নিত্য ঘটনা। এসব সাফল্যের পথ ধরেই আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৬, আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড ২০১৫সহ সম্মানজনক অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির এ অপার সম্ভাবনা আমাদের কৃষিকেও করেছে সমৃদ্ধ। কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তি তথা ই-কৃষি আমাদের কৃষি উন্নয়নের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। সাধারণ অর্থে ই-কৃষি বলতে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকেই বোঝায়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণনসহ প্রতিটি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে সঠিক কলাকৌশল জেনে টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করাকে বোঝায়। সনাতন পদ্ধতিতে তথ্য গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের কৃষক-কৃষাণীরা তথ্যপ্রযুক্তি তথা ই-কৃষিকেও সাদরে গ্রহণ করেছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ গ্রামীণ কৃষক মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ৬৬ শতাংশ কৃষক পরিবার একের অধিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি পরিবারের আয় বেড়েছে গড়ে ১০ হাজার ৫০০ টাকা (অরগাকোয়েস্ট জরিপ ২০১৩, ক্যাটালিস্ট)। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের এ রেখাচিত্র আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সংস্থাগুলো ই-কৃষির প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রায় প্রতিটি সংস্থাই প্রদেয় নাগরিক সেবাগুলোকে ই-সার্ভিসে পরিণত করে সময়মাফিক গুণগত সেবা প্রদানের প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। এসব উদ্যোগের ফলে কৃষকসহ আপামর কৃষিজীবীরা যেমন একদিকে উপকৃত হচ্ছেন অন্যদিকে কৃষি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছেও কর্মপন্থা প্রণয়নে প্রয়োজনীয় তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার উল্লেখযোগ্য কিছু ই-কৃষি সেবা সম্পর্কে তথ্য দেয়া হলো-
 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)
কৃষি সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সর্ববৃহৎ সংস্থা। সরাসরি সেবা দানের পাশাপাশি অনলাইন ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির বেশ কিছু সেবা রয়েছে। জমিতে বছরব্যাপী পরিকল্পনামাফিক চাষবাস করার জন্য ডিজিটাল ক্রপ ক্যালেন্ডার
(http://cropcalendar.marssil.com) সেবাটি চালু রয়েছে। কৃষক ফসল প্যাটার্ন পছন্দ করার পর একটি কার্ড প্রিন্ট করতে পারবে যেখানে তারিখসহ চাষাবাদ পদ্ধতি, সার, সেচ, বালাই দমন ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা লেখা থাকবে। ছবিভিত্তিক কৃষকের চাষাবাদ পদ্ধতি কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা (http:/qais.ml/) এর মাধ্যমে কৃষক ছবি দেখে ১২০টি ফসলের উন্নত চাষ প্রণালি, সার ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং বালাই ব্যবস্থাপনা এসব সম্পর্কে জানতে পারবে। ছবি দেখে বালাই শনাক্তকরণ এবং তার ব্যবস্থাপনার বর্ণনা অনলাইনে কৃষকের .gov.bd/krishokerjanala/home.html) থেকে পাওয়া যাবে। এখানে ছবি দেখে ব্যবহারকারী বিভিন্ন ফসলের যে কোনো সমস্যা নিজে নিজেই চিহ্নিত করতে পারবেন এবং চিহ্নিত ছবিতে ক্লিক করলেই সমাধান ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শ পাওয়া যাবে। রোগ চিহ্নিত করার পর তার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদিত রাসায়নিক বা জৈব বালাইনাশকের নাম জানার জন্য আছে বালাইনাশক নির্দেশিকা বা Pesticide Prescriber (http://pest2.bengalsols.com/)। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই এ ওয়েবপেজ থেকে সেবা নেয়া যাবে। গুগল প্লে স্টোর থেকেও এর মোবাইল অ্যাপসটি ডাউনলোড করা যাবে।


কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)
প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও আইসিটি মাধ্যমে কৃষি সংশ্লিষ্টদের কাছে সময়োপযোগী কৃষি তথ্য পৌঁছানোই কৃষি তথ্য সার্ভিসের মূল দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে পরিচালিত কৃষি কল সেন্টারে যে কোনো অপারেটর থেকে ১৬১২৩ নম্বরে প্রতি মিনিট ০.২৫ টাকা (ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ছাড়া) ব্যয়ে ফোন করে কৃষি/মৎস্য/প্রাণিসম্পদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সমাধান নিতে পারবেন। শুক্রবার ও সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সেবাটি দেয়া হচ্ছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে
(www.ais.gov.bd)-এ কৃষি বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্যের পাশাপাশি অনলাইনে প্রশ্ন করে স্বল্পতম সময়ে সে প্রশ্নের সমাধান জানতে পারেন। তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য বিস্তারের লক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস দেশব্যাপী ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) প্রতিষ্ঠা করেছে। এআইসিসি থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথ্য সেবা গ্রহণ করছেন। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে নির্মিত মাল্টিমিডিয়া ই-বুকের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসল ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সহজে তথ্য নেয়া যায়। কৃষি তথ্য সার্ভিসের দুইটি মোবাইল অ্যাপস রয়েছে। বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্যসমৃদ্ধ একটি মোবাইল অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোর থেকে Agriculture Info Service নামে সার্চ করে বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি জনপ্রিয় মাসিক কৃষিকথা পত্রিকাটির একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে সহজেই ব্যবহারকারীরা জনপ্রিয় এ ম্যাগাজিনটি মোবাইল ফোনেই পড়তে পারবেন। গুগল প্লে স্টোর থেকে কৎরংযরশড়ঃযধ নামে সার্চ করে এটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। এসবের পাশাপাশি বরগুনা জেলার আমতলীতে প্রতিষ্ঠা করেছে কমিউনিটি রেডিও কৃষি রেডিও এফএম ৯৮.৮ যেখান থেকে দৈনিক ০৮ ঘণ্টা প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণের চাহিদাভিত্তিক তথ্যসেবা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সবোর্চ্চ প্রতিষ্ঠান। ই-কৃষির উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো-ভূমির উপযোগিতাভিত্তিক ফসল অঞ্চল
(http:/ cropzoning. barcapps.gov.bd)-এর ফলে ভূমির উপযোগিতা অনুসারে বিভিন্ন ফসল অঞ্চলে নির্দিষ্ট শস্য উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে উপজেলাওয়ারি ১৭টি ফসলের উপযোগিতা শ্রেণী অনুযায়ী ম্যাপ প্রস্তুত এবং টেবিলের মাধ্যমে উৎপাদন উপযোগী এলাকা উপস্থাপন করা হয়েছে। এআরএমআইএস (http:/ armis. barcapps.gov.bd) বাংলাদেশে কৃষি গবেষণার সাথে সংযুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সংবলিত তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে Agricultural Research Management Information System (ARMIS) বাস্তবায়ন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬,৫০০ গবেষণা তথ্য ডাটাবেজটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। গবেষক, নীতিনির্ধারক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিজ্ঞানীদের জন্য ডাটাবেজটি কৃষি গবেষণার রেফারেন্স গাইড হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বিএআরসি আর্কাইভ (http://archive.barcapps.gov.bd) বিএআরসির বিভিন্ন বই, নিউজলেটার, জার্নাল, প্রকাশনা, পলিসি ডকুমেন্ট, নন-কনভেনশনাল ডকুমেন্ট এসবের সংগ্রহশালা তৈরির জন্য অনলাইন আর্কাইভ তৈরি করা হয়েছে।
 

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)
অটোমেটিক গ্রাউন্ডওয়াটার লেভেল অ্যান্ড স্যালাইনিটি মনিটরিং সিস্টেমের সাহায্যে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানের ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল এবং লবণাক্ততার পরিমাণ সংক্রান্ত উপাত্ত সার্ভারের মাধ্যমে কম্পিউটার মনিটরে হাইড্রোগ্রাফ বা রিপোর্ট আকারে প্রদর্শন এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও গ্রাউন্ডওয়াটার জোনিং ম্যাপ হলো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জিআইএসভিত্তিক ডিজিটাল ম্যাপ। এতে ৩০০০টি নলকূপের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে। বিএডিসির বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ বিভাগ (বীপ্রস) সংক্রান্ত সফটওয়্যারটির মাধ্যমে বিএডিসির বিভিন্ন বীজের (আউশ, আমন, বোরো, গম, ভুট্টা ও অন্যান্য বীজ) ভবিষ্যতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, সংগ্রহ, মজুদ, বিতরণ, কৃষক পর্যায়ে প্রাপ্যতা সম্পর্কে যে কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান জানতে পারবে।

 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তিসমূহের তথ্য সমৃদ্ধ ‘কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে। মূলত এটি কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। এ অ্যাপসটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা তাদের মোবাইল হ্যান্ডসেটে ব্রাউজ করে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের বিস্তারিত প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারবেন। অধিকতর তথ্যের জন্য উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রশ্ন জানাতে পারবেন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সাথে সরাসরি কলের মাধ্যমে পরামর্শ নেয়া যায়। এ অ্যাপসটি
BARI Application কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার নামে গুগল প্লে স্টোর ও উইন্ডোজ স্টোর থেকে এন্ড্রয়েডভিত্তিক মোবাইল এবং উইন্ডোজভিত্তিক মোবাইলে এ ডাউনলোড করে অফ লাইনে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও অনলাইনে যে কোনো স্মার্টফোনের  ব্রাউজারে baritechnology.org/m ঠিকানা থেকে এ অ্যাপসের ওয়েব ভার্সনটি ব্যবহার করা যায়।  
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত ও ব্রি প্রযুক্তিগুলো মাধ্যমে ‘রাইস নলেজ ব্যাংক’ নামে একটি ডায়নামিক মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যা মোবাইলভিত্তিক অনলাইন জ্ঞান ভাণ্ডার যাতে আধুনিক ধান চাষ সম্পর্কিত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল সন্নিবেশিত আছে। অ্যাপটি
‘Rice Knowledge Bank’ নামে গুগল প্লে স্টোর ও উইন্ডোজ স্টোর থেকে এন্ড্রয়েডভিত্তিক মোবাইলে ফ্রি ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া যে কোনো স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ কম্পিউটারের ব্রাউজার http://knowledgebank-brri.org ঠিকানা থেকে এ অ্যাপসের ওয়েব ভার্সনটি ব্যবহার করা যাবে।
 

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট  থেকে অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম নামক একটি সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সুষম সার সুপারিশ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের সব উপজেলার জন্য এ কার্যক্রম চালু রয়েছে। দেশের যে কোনো প্রান্তের একজন কৃষক জমি ও স্থানের কয়েকটি তথ্য দিয়ে মৃত্তিকা উর্বরতা মানের ভিত্তিতে তার চাহিত ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ পেতে পারেন। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে
(www.srdi.gov.bd) প্রবেশ করে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার মধ্যে ‘অনলাইন সার সুপারিশ’ লিংকটিতে ক্লিক করার মাধ্যমে এ সার্ভিসের সুবিধা পাওয়া যাবে। অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম প্রবর্তনের ফলে ধান ফসলের ফলন ১৫-২৫% এবং অন্যান্য ফসলের ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি পায়, সারের অপচয় কমে, ফসলের পুষ্টিমান বাড়ে এবং মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
 

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম)
ই-কৃষি সেবা বিস্তারের লক্ষ্যে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক ৬৪টি জেলা থেকে সংগৃহীত খুচরা, পাইকারি ও কৃষকপ্রাপ্ত বাজার দর দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ভিত্তিতে অনলাইনের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়, যা পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে
www.dam.gov.bd ওয়েবসাইটে সহজলভ্য করা হয়ে থাকে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর কৃষি উৎপাদন বিষয়ক বৈশ্বিক তথ্য ভাণ্ডার স্ট্যাটিসক্যাল পকেটবুক ২০১৫ অনুযায়ী বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে আমরা চতুর্থ অবস্থানে রয়েছি, দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিদেশে চালও রপ্তানি করছি। সরকারের সময়োপযোগী নীতি ও পদক্ষেপ এবং সে সাথে কৃষিবিদ, কৃষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ কর্মী সবার সম্মিলিত এসব প্রচেষ্টার ফলেই কৃষির এ যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে ই-কৃষির প্রসার এ সাফল্য অর্জনের অন্যতম সারথী হিসেবে কাজ করেছে। অত্যন্ত আশার কথা আমাদের কৃষিতে তরুণ কৃষক, উদ্যোক্তারা এখন সংযুক্ত হচ্ছেন। প্রযুক্তিবান্ধব এসব তারুণ্যের অমিত শক্তির সাথে তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার মিথস্ক্রিয়ায় বাংলার কৃষি হবে আরও সমৃদ্ধ, দিগন্তজোড়া ফসলের সোনালি মাঠে বিস্তৃত হবে কৃষকের হাসি।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ*

*তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা

 

বিস্তারিত
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (BJRI) (মাঘ ১৪২৩)

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) দেশের অন্যতম প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিগত ১৯৩৬ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির (ICJC) আওতায় ঢাকায় জুট এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে পাটের গবেষণা শুরু হয়। ১৯৫১ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির (ICJC) স্থলে পাকিস্তান সেন্ট্রাল জুট কমিটি (PCJC) গঠিত হয় এবং বর্তমান স্থানে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয় ১৯৫১ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে এ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিজেআরআই মূলত তিনটি ধারায় তার গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে ১. পাটের কৃষি পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, এর উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণা, ২. পাটের কারিগরি তথা প্রচলিত পাট পণ্যের মান উন্নয়ন এবং মূল্য সংযোজিত বহুমুখী নতুন নতুন পাট পণ্য উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণা এবং ৩. পাট ও তুলার সংমিশ্রণে বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদনের গবেষণা। বর্তমানে পাটের কৃষি গবেষণায় ৬টি, কারিগরি গবেষণায় ৪টি গবেষণা বিভাগ, জুট টেক্সটাইল গবেষণায় ১টি গবেষণা বিভাগ এবং পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগসহ মোট ১২টি বিভাগ রয়েছে। কৃষককের সময়োপযোগী চাহিদা ও প্রয়োজন মোতাবেক অঞ্চল ভিত্তিক পাটের কৃষি গবেষণার জন্য মানিকগঞ্জে পাটের কেন্দ্রীয় কৃষি পরীক্ষণ কেন্দ্র এবং রংপুর, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ ও চান্দিনায় (কুমিল্লা) চারটি পাট গবেষণা আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং তারাবো (নারায়ণগঞ্জ), মনিরামপুর (যশোর) ও কলাপাড়ায় (পটুয়াখালী) তিনটি পাট গবেষণা উপকেন্দ্র এবং নসিপুরে (দিনাজপুর) একটি প্রজনন বীজ উৎপাদন  ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। উল্লেখ্য, পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের দেশি, বিদেশি বীজ সংরক্ষণ ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য তৎকালীন ইন্টারন্যাশনাল জুট অর্গানাইজেশনে (IJO) সহযোগিতায় ১৯৮২ সালে বিজেআরআইতে একটি ‘জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জিন ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পাট ও সমগোত্রীয় আঁশ ফসলের প্রায় ৬০০০ জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত আছে। বর্তমান সরকারের বিগত মেয়াদ হতে পাটের গবেষণা এবং পাট উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণে অধিক পরিমাণে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে দেশে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন এবং পাট আঁশ ও বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। ২০০৮-২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি বিজেআরআইতে যসব গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তাহলো-
পাটের জীবন রহস্য
(Genome sequencing) উন্মোচন : জীব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বে সর্বপ্রথম দেশি ও তোষা পাটের জীবন রহস্য (Genome Sequencing) আবিষ্কার করা হয়েছে এবং পাটসহ পাঁচশতাধিক ফসলের ক্ষতিকারক ছত্রাক Macrophomina phaseolina এর জীবন রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। উন্মোচিত জেনোম তথ্য ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল, বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহনশীল এবং পণ্য উৎপাদন উপযোগী পাট জাত উদ্ভাবনের জন্য বর্তমান সরকার ‘পাট বিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ আবিষ্কারের ফলে পাটের বিভিন্ন প্রতিকূলতা (Stress) সহনশীল (লবণাক্ততা, খরা, বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগজীবাণু সহনশীল), কম লিগনিন সমৃদ্ধ উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ২৫% জমি লবণাক্ততার কারণে পতিত থাকে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের একটি ব্যাপক এলাকা খরাপ্রবণ। প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ওই সব পতিত জমিতে পাট চাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। ফলে পতিত-ব্যবহার অনুপযোগী জমি আবাদের আওতায় আসবে। এছাড়া কম লিগনিন সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন সম্ভব হলে বস্ত্র শিল্পে তুলার বিকল্প হিসাবে অথবা তুলার সাথে সংমিশ্রণে পাটের ব্যবহারে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে।   
পাট ও
Macrophomina phaseolina এর জেনোম তথ্য থেকে মেধাসত্ত্ব (IPR) অর্জনের জন্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১২টি দেশে ৭টি আবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
জেনোম গবেষণার মাধ্যমে ফসলের কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বিজেআরআই এ আন্তর্জাতিক মানের একটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে যা প্রথমত পাট এবং পরবর্তিতে অন্যান্য ফসলের উন্নয়নে ব্যবহার করা যাবে।
নতুন জাত ও কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন : পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের ৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে তোষা পাটের ২টি (বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৬), দেশি পাটের ৩টি (বিজেআরআই দেশি পাট-৭, বিজেআরআই দেশি পাট-৮ ও বিজেআরআই দেশি পাট শাক-১), কেনাফের ১টি (বিজেআরআই কেনাফ-৩) এবং মেস্তার ১টি (বিজেআরআই মেস্তা-২)। উদ্ভাবিত জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পাট পচনের আপদকালীন প্রযুক্তি হিসেবে পাওয়ার রিবনার, স্বয়ংক্রিয় জুট রিবনার, শীতকালীন সবজির সাথে পাট বীজ উৎপাদন, কৃষি বনায়ন পরিবেশে নাবি পাট বীজ উৎপাদন, নিম পাতার রস দিয়ে পাটের হলুদ মাকড় দমন এবং বাটা রসুনের সাহায্যে পাট বীজ শোধন শীর্ষক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।  
শিল্প প্রযুক্তি উদ্ভাবন : স্বল্প মূল্যের হালকা পাটের শপিং ব্যাগ, প্রাকৃতিক উৎস থেকে রঙ আহরণ করে পাটপণ্য রঞ্জন পদ্ধতি, পাটজাত শোষক তুলা, অগ্নিরোধী পাট বস্ত্র, জুট-প্লাস্টিক কম্পেজিটসহ ৬টি নতুন পাট পণ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা হয়েছে এবং সিনথেটিক উলের বিকল্প পাট উল ও পাট উলজাত সোয়েটার, পাট তুলা ও পাট তুলাজাত, সেনিটারি ন্যাপকিন, বেবি ন্যাপকিন, বিভিন্ন ইনসুলেটিং ম্যাটেরিয়াল, পাট এবং তুলার সংমিশ্রণে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত টেক্সটাইল পণ্য যেমন পর্দার কাপড়, বেড কভার, সোফা কভার, জিন্স ইত্যাদি পণ্যের মান উন্নয়ন করা হয়েছে।
প্রযুক্তি হস্তান্তর
পাট আঁশ ও বীজ উৎপাদন, রিবন রেটিং পদ্ধতি, কৃষি বনায়ন পরিবেশে নাবি পাটবীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য ২১০০০ জন পাটচাষি, ৭০০০ জন সম্প্রসারণ কর্মী এবং ১০০০ জন সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে পানি স্বল্প এলাকায় পাট পচন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উন্নতমানের পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাট বীজ উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে;
বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদন প্রযুক্তি বিষয়ে ১০০০ জন পাট পণ্য উৎপাদন কর্মী এবং ৩০০ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে;
রিবন রেটিং পদ্ধতি সম্প্রসারণের জন্য ৩০০০টি রিবনার বিনামূল্যে কৃষককের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় আরও ৩০,০০০টি রিবনার বিনামূল্যে কৃষককের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।  এছাড়া মান সম্পন্ন পাটপণ্য উৎপাদন, রঞ্জন, ডিজাইন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য ২০০০ জন পাটপণ্য উৎপাদন কর্মীকে প্রশিক্ষণ প্রদান;
রাস্তার মাটিধস, নদীর বাঁধ ও পাহাড়ের ঢাল সংরক্ষণে ৪০০০০ মিটার জুট জিও টেক্সটাইল রাসায়নিক প্রক্রিয়াকরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং ওয়াপদাকে প্রদান।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন
পাটের জীবন নকশা (এবহড়সব ঝবয়ঁবহপরহম) উন্মোচনের ফলে পাটের বিভিন্ন প্রতিকূলতাসহনশীল (লবণাক্ততা, ক্ষরা, দ্রুত পচনযোগ্য, বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগজীবাণু সহনশীল) উচ্চফলনশীল পাট জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সরকার ১১৮২০.০০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘পাটের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিকূলতাসহনশীল (লবণাক্ততা, ক্ষরা, দ্রুত পচনযোগ্য, বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগজীবাণু সহনশীল) উচ্চফলনশীল পাট জাত উদ্ভাবনের গবেষণা কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া, বিজেআরআই পাট ও পাট জাতীয় ফসলের লবণাক্ততা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, আধুনিক পাট আঁশ ও বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে হস্তান্তর এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্য হস্তান্তর ও জনপ্রিয়করণ, বিজেআরআইয়ের মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বিজেআরআইয়ের প্রধান কার্যালয় এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক উপকেন্দ্রের গবেষণাগার, প্রদর্শনী কেন্দ্র, প্রশিক্ষণ ও মাঠ গবেষণা সুবিধার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২১৩৯.০০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘পাট ও পাট জাতীয় ফসলের কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।  
পাট, কেনাফ ও মেস্তার প্রজনন বীজ এবং মান ঘোষিত বীজ (TLS) উৎপাদন ও বিতরণ : বিগত সাত বছরে পাট, কেনাফ ও মেস্তার ১৪০০০ কেজি প্রজনন বীজ উৎপাদন এবং বিএডিসিসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে এবং ৪৬০ টন মান ঘোষিত বীজ (TLS) উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এ কার্যক্রম দেশের পাট বীজের ঘাটতি মোকাবিলায় ভূমিকা পালন করেছে।  
পাটের কৃষি প্রযুক্তি এবং বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর : পাটের বহুমুখী ব্যবহার সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং পাটের কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যে এনজিও এবং শিল্পোদ্দোক্তাদের সাথে ৮টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে বাণিজ্যিকভাবে পাটপণ্য উৎপাদিত হবে এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিবেশ উন্নয়ন ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।
ইনস্টিটিউটের মানবসম্পদ উন্নয়ন : বিগত সাত বছরে ১৫ জন বিজ্ঞানী স্থানীয় এমএস,  ১৫ জন বিজ্ঞানী স্থানীয় পিএইচডি, ৪ জন বিজ্ঞানী  বৈদেশিক পিএইচডি এবং  ৩১ জন বিজ্ঞানী বিদেশে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে ১৬ জন বিজ্ঞানী স্থানীয় পিএইচডি, ৭ জন বৈদেশিক পিএইচডি এবং ১ জন বিজ্ঞানী বৈদেশিক এমএস লিডিং পিএইচডি অধ্যয়নরত আছেন। উচ্চশিক্ষার ফলে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

(সাত বছরের সাফল্য)

*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ

যে সব প্রজাতির মাছ রাক্ষুসে স্বভাবের নয়, খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করে না, জলাশয়ের বিভিন্ন স্তরে বাস করে এবং বিভিন্ন স্তরের খাবার গ্রহণ করে এসব গুণাবলির কয়েক প্রজাতির রুইজাতীয় মাছ একই পুকুরে একত্রে চাষ করাই হলো মিশ্রচাষ। আর কার্প জাতীয় মাছ বলতে দেশি ও বিদেশি রুই জাতীয় মাছকেই বুঝায়। আমাদের দেশে, দেশি কার্পের মধ্যে কাতলা, রুই, মৃগেল, কালীবাউশ এবং বিদেশি কার্পের মধ্যে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, ব্ল্যাক কার্প, কমন কার্প অন্যতম। মাছের স্বভাবজাত কারণে পুকুরের বিভিন্ন স্তরে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। সাধারণত পুকুরে ৩ স্তরে মাছ আলাদাভাবে অবস্থান করে খাবার খায়। এজন্য সেভাবে তাদের যত্নআত্তি করতে হয়। উপরের স্তরে কাতলা, সিলভার কার্প এবং বিগহেড জলাশয়ের উপরের স্তরের খাবার খায়। উপরের স্তরে এসব মাছ সবুজ উদ্ভিদকণা (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) এবং প্রাণিকণা (যুপ্ল্যাঙ্কটন) খেয়ে থাকে। মধ্য স্তরের রুই মাছ এ স্তরে থাকে এবং ক্ষুদ্র প্রাণিকণা, ক্ষুদ্রকীট, শেওলা খাবার খায় এবং নিম্নস্তরের মৃগেল, কালীবাউশ, মিরর কার্প বা কার্পিও, ব্ল্যাক কার্প অধিকাংশ সময়েই জলাশয়ের নিম্নস্তরে বিচরণ করে। তলদেশের ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ, শেওলা, শামুক, ঝিনুক, ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা এদের প্রধান খাবার। গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি সব স্তরেই অবস্থান করে। জলজ উদ্ভিদ, নরম ঘাস, শেওলা, ক্ষুদিপানা, টোপাপানা, হেলেঞ্চা, ঝাঁঝি এসব গ্রাস কার্পের প্রধান খাবার। ক্ষুদি পানা ও টোপা পানা সরপুঁটির প্রধান খাবার। তাই কোনো জলাশয়ের তলদেশে বেশি পরিমাণ আগাছা, ঘাস, হেলেঞ্চা জন্মালে গ্রাস কার্প ছেড়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জলাশয়ের বিভিন্ন স্তরের খাবার খায়; খাদ্য ও জায়গায় জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না; এরা রাক্ষুসে স্বভাবের নয়;  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো; খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে বা দ্রুতবর্ধনশীল; সহজে পোনা পাওয়া যায়; অল্প মূল্যের সম্পূরক খাদ্য খায়;  খেতে সুস্বাদু এবং বাজারে চাহিদা আছে; অর্থনৈতিক মূল্য আছে; কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা পোনা উৎপাদন করা যায়। এস বৈশিষ্ট্যে সম্পন্ন মাছ নির্বাচন করতে হবে।
চাষ পদ্ধতি :  বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশে ও উপকরণের প্রাপ্যতা, চাষির আর্থিক অবস্থা এবং জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এক এক রকম পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। যেমন- ক. সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ; খ. আধানিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ; গ. নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ। সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ হলো কম খরচে জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে যে পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে কম অথবা বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। পুকুরের রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা হয় না। পুকুরে বাহির থেকে কোনো খাবার ও সার দেয়া হয় না। এ পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনও অনেক কম হয়। আধানিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ হলো বৈজ্ঞানিক নিয়মে পুকুর প্রস্তুত করে, নিয়মিত সার এবং সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে, মধ্যম ঘনত্বে পোনা মজুদ করে মাছ চাষ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক খাবার যাতে বেশি উৎপাদন হয় তার জন্য সার ব্যবহার করা হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তার জন্য খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে প্রজাতি নির্বাচন করে পুকরে নির্দিষ্ট ঘনত্বে  পোনা মজুদ করা হয়। এসব মাছের প্রাকৃতিক খবারের চাহিদা পূরণ না হলে বাহির থেকে চাহিদা মাফিক খাবার দেয়া হয়। আমাদের  দেশে ব্যাপকভাবে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয়। আর নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ হলো অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে, অধিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধি ও বাহির থেকে উন্নতমানের পরিপূর্ণ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করে উচ্চতর ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রযুক্তির সর্বাধিক সুযোগ ব্যবহার করা হয়। তাই অন্য দুই পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি ঘনত্বে  পোনা মজুদ ছাড়া ও নিয়মিত পানি বদল ও বায়ু সঞ্চালনের আধুনিক ব্যবস্থা করা হয়।
পুকুরের স্থান নির্বাচন খনন : পুকুর নির্বাচন ঠিকমতো করা না হলে মাছ চাষে সমস্যা হয়, মাছ ঠিকমতো বাড়ে না, মাছ চুরি হতে পারে, পোনা পরিবহনে অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে। লাভজনক চাষ করতে হলে খেয়াল রাখতে হবে পুকুরের মালিকানা নিজস্ব এবং একক হওয়া; লিজ পুকুর হলে তার মেয়াদ ৫ বছরের বেশি বা দীর্ঘমেয়াদি; পুকুরটি অবশ্যই বন্যামুক্ত হওয়া; পুকুরের পানির গভীরতা ২-৩ মিটার; দো-আঁশ মাটি পুকুরের জন্য সবচেয়ে ভালো; পুকুরের তলার কাদার পরিমাণ কম হওয়া। তবে কোনো মতেই ১০-১৫ সেন্টিমিটারের এর বেশি হবে না; পুকুরের পাড়ে যেন কোনো বড় বা পাতাঝরা গাছপালা না থাকে; পুকুরটি যেন খোলামেলা ও প্রচুর আলোবাতাস লাগে। দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা সূর্যালোক যেন পুকুরে পড়ে; পুকুর ২০-৫০ শতাংশের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়; আর স্থান নির্বাচনে খেয়াল রাখতে হবে খুব সহজেই যেন পোনা পাওয়া যায়; পুকুর বসতবাড়ির কাছাকাছি হলে পুকুরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার সুবিধা হয় মাছ চুরির ভয় থাকে না; ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কাছে হাটবাজার থাকলে ভালো হয়। পুকুর খনন বা নতুন পুকুর খনন করতে হলে যেসব বিষয়াদি বিবেচনায় রাখতে হবে তা হলো-পুকুর খননের সময় পুকুরটি যেন আয়তাকার হয়। আয়তন ৩৩ শতক থেকে ৫০ শতক হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা। পুকুরের গভীরতা এমনভাবে করা দরকার যাতে শুকনা সময়ে ১.৫-২ মিটার পানি থাকে। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ কণা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে পুকুরের মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি করে। পুকুরে বাতাস চলাচল করলে পানির উপরের স্তরে ঢেউয়ের মাধ্যমে পানিতে অক্সিজেন দ্রবীভূত হয়।
পুকুর প্রস্তুতকরণ : পুরনো পুকুর হলে প্রথমে রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে হবে। পুকুর সেচের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলে রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত মাছ ধরে ফেলা উত্তম। চাষযোগ্য মাছ থাকলে তা অন্য পুকুরে সরিয়ে ফেলতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পুকুরের তলায় পানি জমে না থাকে। পুকুরের তলায় সামান্য পানিও জমে থাকলে তাতেও রাক্ষুসে মাছ লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু নানাবিধ কারণে পুকুরের পানি নিষ্কাশন সম্ভব নাও হতে পারে। পুকুর থেকে পানি নিষ্কাশন করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুনরায় পানি সরবরাহ করার মতো পানির উৎস ও ব্যবস্থা থাকে না। তাই পুকুরে ওষুধ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা ভালো। রোটেনন, চা বীজের  খৈল, তামাকের গুঁড়া এসব ওষুধ দিয়ে পুকুরের রাক্ষুসে মাছ দূর করা যায়। প্রখর সূর্যের তাপে রোটেননের কার্যকারিতা বেশি। রোটেন মাছের ওপর বিষ ক্রিয়ার মেয়াদকাল প্রায় ৭ দিন। তবে রোটেনন দিয়ে মারা মাছ খাওয়া যায়। তামাকের গুঁড়া প্রয়োগে মাছ, শামুক ও ঝিনুক মারা যায় কিন্তু চিংড়ি মরে না। এটি পরে সার হিসেবে কাজ করে। একটি পাত্রে পানির মধ্যে এক রাত ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর সূর্যালোকিত দিনে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। মাছের ওপর বিষ ক্রিয়ার মেয়াদ থাকে ৭-১০ দিন।
জাল টানা-পুকুরের পানি নিষ্কাশন এবং ওষুধ প্রয়োগ ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমে যখন পুকুরে পানি কম থাকে তখন ঘন ঘন জাল টেনে রাক্ষসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায়। তবে এতে অনেক সময় কাদার মধ্যে রাক্ষুসে মাছ লুকিয়ে থাকতে পারে।
আগাছা দমন-ভাসমান ও শিকড়যুক্ত পানির উপরে ভাসমান জলজ আগাছা পুকুরে সরবরাহকৃত সার গ্রহণ করে। ফলে ফাহটোপ্ল্যাঙ্কটন প্রয়োজনীয় সার গ্রহণ করার সুযোগ পায় না। এ কারণে আগাছাপূর্ণ পুকুরে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন তৈরির জন্য বেশি সার প্রয়োজন হয়। এ জন্য পুকুর থেকে আগাছা সম্পূর্ণ রূপে অপসারণ করা দরকার। আগাছা পুকুরের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে  দেয়। পুকুর পাড় ও তলদেশ উন্নয়ন-পুকুরের তলদেশে অত্যধিক কাদা, আবর্জনা, পচা জৈব পদার্থ থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পুকুরের তলদেশ অসমান, পাড় ভাঙ্গা কিংবা ছিদ্রযুক্ত থাকলে তা মেরামত করে নিতে হবে। পুকুরের তলদেশে বিভিন্ন রোগ জীবাণু, বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে। চুন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব দূর করা যায়। তাছাড়া চুন প্রয়োগে পুকুরের পানির পিএইচ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়। পুকুরে শতাংশপ্রতি ১ কেজি কলিচুন প্রয়োগ করতে হয়। কলিচুন প্রথমে পানির সঙ্গে মিশিয়ে তারপর ঠা-া করে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে জাল টেনে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। যদি পুকুরে পানি না থাকে তা হলে পুকুরের তলদেশে চুন পাউডার করে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। পুকুরের তলদেশের মাটির প্রকারভেদ, পুকুরের বয়স ও পানির পিএইচের ওপর চুনের মাত্রা নির্ভর করে। এঁটেল মাটি, কাদা মাটি ও লাল মাটির পুকুরে চুন একটু বেশি দরকার হয়।
সার ব্যবস্থাপনা : পুকুরের পানিতে সূর্যের আলোর সহায়তায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে এক ধরনের উদ্ভিদকণা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয়। এসব উদ্ভিদকণা প্রাথমিক উৎপাদক হিসেবে পরিচিত। এগুলো রুই জাতীয় মাছের খাদ্য। প্রাণিকণাও এ মাছের প্রিয় খাদ্য। তাই উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরির জন্য সার প্রয়োগ করতে হয়। পুকুরের প্রতি শতাংশ হারে সার ব্যবহার করতে হয়। পুকুরে মাটি ও পানির গভীরতা ভেদে সারের মাত্রা কমবেশি হতে পারে। পুরনো পুকুরের তুলনায় নতুন পুকুরে জৈব সারের পরিমাণ বেশি লাগে। চুন প্রয়োগের অন্তত ৫-৭ দিন পর রাসায়নিক সার ব্যবহার করা উচিত। চুন প্রয়োগের পরপরই টিএসপি সার ব্যবহার করা যাবে না। কারণ চুনের সাথে টিএসপি সারের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে বলে সারের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। টিএসপি সহজে পানিতে গলে না বলে ব্যবহারের ১০-১২ ঘণ্টা আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। শুকনা পুকুরে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হলে পুরো পুকুরে সার ছিটিয়ে লাঙল বা আঁচড়ার সাহায্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পর পরই পুকুরে পানি সরবরাহ দিতে হবে। তা না হলে জৈব সারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নাইট্রোজেনের কার্যকারিতা কমে যায়। পুকুরে পানি থাকলে জৈব ও অজৈব সার পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে জাল টেনে পানির সাথে সারা পুকুরে ছড়িয়ে নিতে হবে। পুকুরে সার প্রয়োগের আগে সেকি ডিস্কের রিডিং দেখতে হবে। সেকি ডিস্কের রিডিং ৩০ সেন্টিমিটারের বেশি হলে সার প্রয়োগ করতে হবে।
পানি সংগ্রহ ও পোনা মজুদ : জৈব সারের মূল উপাদান নাইট্রোজেন ও ফসফরাস। শুকনো পুকুরে ব্যবহারে এসব সারের উপাদান বাতাসে চলে যায়। তাই সার  দেয়ার পরপর পুকুরে পানি সরবরাহ করতে হবে। এতে সার গলে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান পানিতে মিশতে পারবে। তবে পানি প্রবেশের সময় যাতে রাক্ষুসে মাছ কিংবা অবাঞ্ছিত মাছ পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এজন্য পানি প্রবেশর পথে ঘন ফাঁসের জাল দিয়ে আটকে দিতে হবে। পুকুরে এমন প্রজাতির মাছের চাষ করতে হবে যেগুলো একে অপরের সাথে কিংবা পরিবেশ নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা করে না। মিশ্র চাষের উদ্দেশ্যই হলো পুকুরের সব স্তরের খাদ্যকে সমানভাবে ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সার দিলে পুকুরের বিভিন্ন স্তরে প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্ম হয়। খাদ্যগুলো হলো উদ্ভিদকণা, প্রাণিকণা এবং পুকুরের তলদেশে বসবাসকারী প্রাণিগুলো। এ প্রাকৃতিক খাদ্যমালা পুকুরে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে। মিশ্রচাষের আসল উদ্দেশ্যই হলো পুকুরের সব স্তরের খাদ্য ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন লাভ করা। তবে পুকুরে একাধিক প্রজাতির মাছ মজুদ করলেই লাভবান হওয়া যাবে না। খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে না এমন দুই বা ততোধিক প্রজাতির পোনা নির্বাচন করা প্রয়োজন। পুকুরে  পোনা মজুদের আগে নিচের কাজগুলো করতে হয়Ñ
বিষাক্ততা পরীক্ষা : পুকুরে পোনা মজুদের আগে পানিতে ওষুধের বিষক্রিয়া জেনে নেয়া উচিত। বিষক্রিয়া জানার জন্য পুকুরে একটি হাপা টাঙিয়ে তার মধ্যে ১০-১৫টি পোনা ছেড়ে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত দেখতে হবে। যদি পোনা মারা না যায়, তবেই পুকুরে পোনা মজুদ করা যাবে। বালতি বা ডেকচির মধ্যেও এ কাজটি করা যায়। পোনা মারা গেলে পানি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যবেক্ষণে পোনা মজুদের আগেই পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করতে হবে। পুকুরের পানির রঙ হবে সবুজাভ, লালচে অথবা বাদামি সবুজ। হালকা সবুজ। হালকা সবুজ, ঘন সবুজ, তামাটে লাল বা পরিষ্কার রঙ এর পানি কার্প জাতীয় মাছ চাষের জন্যে ভালো নয়। তাই পানির রঙ ঠিক আছে কিনা তা যেসব পরীক্ষা দ্বারা দেখতে হবে তা হলো-
সেকি ডিস্ক : সেকি ডিস্ক একটি লোহার থালা। এর ব্যাস ২০ সেমি রঙ সাদা-কালো। এটি ৩ রঙের প্লাস্টিকের সুতা দ্বারা ঝুলানো থাকে। গোড়া থেকে প্রথম সুতার রঙ লাল ২০ সেন্টিমিটার, দ্বিতীয় সুতার রঙ সবুজ ১০ সেন্টিমিটার  এবং হাতে ধরার সর্বশেষ সুতার রঙ সাদা ১০০-১২০ সেন্টিমিটার।
লাল সুতা : পানিতে লাল সুতা পর্যন্ত ডুবানোর পর থালার সাদা অংশ দেখা না গেলে বুঝতে হবে পুকুরে অতিরিক্ত খাদ্য আছে। তবে পানি ঘোলা থাকলেও এ অবস্থা হতে পারে। এ অবস্থায় রেণু ছাড়া, সার ও সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করা ঠিক নয়।
সাদা সুতা : সাদা সুতা পর্যন্ত নামানোর পরও থালার সাদা অংশটি দেখা গেলে বুঝতে হবে খাদ্য কম আছে। এ অবস্থায় আরও সার দিতে হবে। পুকুরে পোনা থাকলে খাদ্য প্রয়োগ বহাল রাখতে হবে। সবুজ সুতা-পানিতে সবুজ সুতা পর্যন্ত ডুবানোর পর থালার সাদা অংশটি দেখা না গেলে বুঝতে হবে খাদ্য পরিমিত আছে। এ অবস্থায় রেণু ছাড়া যাবে, সার না দিলেও চলবে। সেকি ডিস্ক সূর্য উঠার পর (বেলা ১১-১২টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে।
মজুদ ঘনত্ব ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা : পুকুরে পোনার মজুদ ঘনত্ব নির্ভর করে চাষ পদ্ধতির ওপর। খাদ্য ব্যবহার, পুকুরের পানি পরিবর্তনের সুযোগ এবং পানিতে অক্সিজেনের জোগানের জন্য এজিটেটর ব্যবহারের সুযোগ থাকলে অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করা যায়। সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ পুকুরে পোনা মজুদের পর থেকেই দৈনিক নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। সরিষার খৈল, চালেরকুঁড়া, গমেরভুসি, ফিশমিল এসব মাছের সম্পূরক খাদ্য। মাছের সম্পূরক খাদ্যে শতকরা ২০ ভাগ আমিষ থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
গ্রাস কার্পের খাদ্য : গ্রাস কার্প ঘাসখেকো মাছ। তাই গ্রাস কার্পের খাবার সরবরাহের জন্য পুকুরে চার ফুট লম্বা, চার ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট আবেষ্টনীতে ফিডিং রিং ক্ষুদিপানা-কলাপাতা-সবুজ নরম ঘাস প্রতিদিনি সরবরাহ করতে হবে। লাঠি পুঁতে ফিডিং রিংটিকে আটকে দিতে হবে যাতে ফিডিং রিংটি একই স্থানে অবস্থান করে। ফিডিং রিংটি সব সময় পরিপূর্ণ রাখতে হবে। কেননা গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি ক্ষুদ্রাকৃতির পাকস্থলী বিশিষ্ট। তাই ক্ষুধা পাওয়ার সাথে সাথে যাতে সামনে খাবার পেতে পারে সেজন্যে ফিডিং রিংটি সর্বদা ঘাসে পরিপূর্ণ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরনো বা ভাঙা রিং পরিবর্তনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি গ্রাস কার্পের বিষ্ঠা ৫টি কার্পের খাবারের জোগান দিতে পারে।
সম্পূরক খাদ্য ব্যবস্থাপনা : পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা ভেদে সম্পূরক খাদ্যের মাত্রা নির্ভর করে। তবে সাধারণত মজুদ পুকুরে প্রতিদিন মাছের ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শীতকালে মাছের জৈবিক পরিপাকক্রিয়া কমে যায়, ফলে তাদের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যায়। এজন্য শীতকালে মাছের ওজনের শতকরা ১-২ ভাগ হারে খাবার দিলেই চলে। খাদ্যের সাথে সরিষার খৈল ব্যবহার করা হলে পরিমাণমতো একটি পাত্রে সমপরিমাণ পানির সাথে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পচা সরিষার খৈলের সাথে পরিমাণমতো অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে আধা শক্ত গোলাকার বলের মতো তৈরি করতে হবে। এ খাদ্য দিনে দুইবার অর্থাৎ সকালে ও বিকালে পুকুরের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে সরবরাহ করতে হবে। সম্ভব হলে খাদ্য পাত্রের মধ্যে সরবরাহ করলে ভালো হয়। শুকনো গুঁড়া খাবার সরাসরি পুকুরের পানিতে ছড়িয়ে দিলে খাদ্যের অপচয় হয়। এতে মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ খাদ্যের পচন ক্রিয়ায় পুকুরের পরিবেশ দূষিত হবে।
সার প্রয়োগ : মজুদ পুকুরে সার প্রয়োগের আগে প্রাকৃতিক খাদ্যের অবস্থা জেনে নেয়া ভালো। কারণ সম্পূরক খাদ্য ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করলে পানি দূষণ হতে পারে। সার প্রয়োগের আগে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের অবস্থা জেনে নিতে হবে। এতে সঠিক মাত্রার সার ব্যবহার করা যাবে এবং পুকুরে পানির পরিবেশও ঠিক রাখা সম্ভব হবে। তিনভাবে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা যায়। সেকি ডিস্ক ব্যবহার করতে হবে। এটি পানিতে ডুবানোর পর যদি থালাটি ২০ সেন্টিমিটার এর পর্যন্ত দেখা যায় তবে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য কম আছে। সার দেয়া প্রয়োজন। গ্লাস ব্যবহার-পুকুর থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে সূর্যের বিপরীতে দেখতে হবে ক্ষুদ্র প্রাণিকণা আছে কিনা। একটি সাধারণ গ্লাসে ৮-১০টি প্রাণিকণা দেখা গেলে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে। প্ল্যাঙ্কটন নেট ব্যবহার-প্ল্যাঙ্কটন আটকানো যায় এমন নেটে ৪০ লিটার পানি চালনা করে জালে আটকানো প্ল্যাঙ্কটন একটি বিকারে সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ ২ সিসি হলে খাদ্য পর্যাপ্ত আছে বলে বুঝতে হবে। এভাবে পানি পরীক্ষার পর প্রাকৃতিক খাদ্য কমে গেলে পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সার প্রয়োগ করতে হয়। সার একত্রে একটি পাত্রে ৩ গুণ পানির সাথে মিশিয়ে ১২-১৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে ৯-১০টার মধ্যে সার গুলানো পানি পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
নমুনা সংগ্রহকরণ : পুকুরে মাছের বৃদ্ধি ঘটছে কিনা অথবা রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব পরীক্ষা করা এবং পুকুরে মজুদ মাছের পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য মাসে অন্তত দুইবার জাল টেনে মজুদ মাছের শতকরা ১০ ভাগ ধরে তার গড় ওজন বের করতে হবে। এ গড় ওজন দ্বারা পুকুরের মজুদ মাছের সংখ্যার সাথে গুণ করে মোট মজুদ মাছের পরিমাণ নির্ণয় করে পরবতী সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। একই সময় মাছের দেহের রোগ বালাই আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। এছাড়া ও জাল টানা হলে পুকুরের তলদেশে জমে থাকা মিথেন, অ্যামনিয়া ক্ষতিকর গ্যাস বের হয়ে যাবে। অন্যদিকে জাল টানার ফলে মাছ ছুটাছুটি করেবে। এতে মাছের  দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে।
অন্যান্য পরিচর্যা : মাছ চাষের সফলতা অধিকাংশ নির্ভর করে পুকুরে পানির পরিবেশ ঠিক রাখার ওপর। কোনো রকম পচন ক্রিয়া যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাই যেসব পদার্থ পানিতে পচন ক্রিয়া ঘটাতে পারে তা যাতে পুকুরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গাছের পাতা পড়ে অনেক সময় পানির পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে  ফেলতে হবে। নালা-নর্দমার বিষাক্ত পানি পুকুরে যাতে কোনোক্রমে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কোনো উৎস থেকে আসা পানি, জাল বা অন্য কোনো পাত্র পুকুরের পানিতে ধোয়া উচিত নয়। এসবের মাধ্যমে পুকুরে রোগবালাই সংক্রমিত হতে পারে। অনেক সময় বাজার থেকে মাছ এনে রান্না কাজের জন্য পুকুরে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়, এতে অনেক সময় পুকুরে রোগ সংক্রমণ ঘটতে পারে।
আংশিক আহরণ : মাছ বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাদের দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুততর হয় না। ফলে নির্দিষ্ট বয়সের পরে পুকুরে প্রতিপালন করার প্রয়োজন নেই। কাজেই পুকুরে বড় মাছ রাখা হলে অধিক লাভ পাওয়া যায় না। তাই বাজারজাতকরণ উপযোগী মাছ ধরে ফেলতে হয়। এছাড়া পুকুরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার বেশি মাছ মজুদ রাখা হলে ছোট মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। তাই পুকুর থেকে নিয়মিত বড় মাছ ধরে ছোট মাছকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। বড় মাছ ধরে ফেললে পুকুরে বেশি জায়গা হওয়াতে ছোট মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিঘাপ্রতি কার্প জাতীয় মাছের পুকুরে ধারণক্ষমতা ২২৪ কেজি। কাজেই বিঘাপ্রতি ২২৪ কেজির বেশি মাছ আহরণ করে বিক্রয় করতে হবে। সাধারণত অতিরিক্ত মাছ আহরণের সময় পুকুরের বড় মাছ আহরণ করে ছোট মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ করে দেয়া উত্তম। তবে একমাসে যে কয়টি মাছ আহরণ করা হবে, সমান সংখ্যক সে প্রজাতির মাছের পোনা পুকুরে মজুদ করতে হবে। এভাবে আহরণ ও মজুদের মাধ্যমে মৎস্য চাষ করলে অনেক বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। নিয়মিত আংশিক আহরণের মাধ্যমে বড় মাছ ধরার ফলে ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। মাছকে পুকুরে বেশি দিন না রেখে বছর শেষে পুরাপুরি আহরণ করে পরবর্তী বছরের জন্য পুকুর তৈরি করা ভালো। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পুকুরে যখন পানি কম থাকে তখন মাছ ধরে ফেলতে হবে।

মো. রফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া*

* রহমতপুর আবাসিক এলাকা, চাঁদপুর

বিস্তারিত
গবাদিপশুর রক্তপ্রস্রাব : কারণ ও প্রতিকার

আদ্র স্যাঁতসেঁতে জলাবদ্ধ এলাকায় গবাদিপশু রক্ত প্রস্রাব সমস্যায় আক্রান্ত হয়। স্যাঁতসেতে কর্দমাক্ত মাটি যেখানে পচা জৈব পদার্থ বেশি এবং মাটিতে অ্যালকালাইন সল্ট বিশেষ করে নাইট্রাইটের পরিমাণ বেশি থাকে এসব এলাকাতে গবাদি পশুর রক্ত প্রস্রাবের ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রস্রাবের সাথে লাল রক্ত কণিকা বা লাল রক্ত কণিকার রঙ অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতিকে হিমাচুরিয়া বলা যেতে পারে। রক্তে তিন প্রকার কণিকা থাকে। লাল রক্ত কণিকা (RBC), শ্বেতরক্ত কণিকা (WBC), ও অনুচক্রিকা বা থ্রম্বোসাইট। হিমোগ্লোবিন লাল রক্ত কণিকার রঞ্জক পদার্থ। এটি লৌহঘটিত প্রোটিন। লাল রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি অক্সিজেন বহনের সহায়ক। প্রস্রাবে রক্ত বা রক্ত উপাদানের উপস্থিতির কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কিডনি ও মূত্রনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, মূত্রতন্ত্রের নালিতে পাথর হওয়া, মূত্রথলের প্রদাহ, সংক্রামক রোগ ব্যাবেসিওসিসি, ল্যাপ্টোস্পাইরোসিস, ক্যাসিলারি হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া, পুষ্টিগত কারণের মধ্যে রয়েছে ফসফরাস ও কপারের অভাব ও মাত্রাতিরিক্ত পানি গ্রহণ, ওষুধজনিত কারণ এবং খাদ্যের রঙের কারণে।
প্রস্রাবের সাথে লাল রক্ত কণিকা বা প্রস্রাবে রক্তের উপস্থিতি খালি চোখে দেখা যেতেও পারে নাও দেখা যেতে পারে।  অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে রক্ত কণিকার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রতি কিউবিক মিলিমিটার প্রস্রাবে ৩০০-৫০০ লোহিত রক্ত কণিকা বা ইরিথ্রোসাইট থাকলে প্রস্রাবের রঙ পিংক বা গোলাপি বর্ণের হবে। হেমাচুরিয়া বা রক্তমেহ
(Haematuria) নির্ণয়ে ইউরিন ডিপস্টিক (Urine Dipstick) টেস্ট করা যায়। প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে কমপক্ষে ১০টি ইরিথ্রোসাইট (RBC) থাকলে হেমাচুরিয়া বলা যায়। RBC এর সংখ্যা  ১০টির কম হলে ক্রিয়েটিন দেখতে হবে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রে মূত্রের সেডিমেন্ট টেস্ট করলে লোহিত কণিকা ধরা পড়বে। কিডনিতে আঘাত, কিডনি প্রদাহ, বৃক্কনালি (Ureter) প্রদাহ, তীব্র মূত্রথলি প্রদাহ, মূত্রনালিতে পাথরি, ত্রুটিপূর্ণভাবে মূত্রথলিতে ক্যাথেটার প্রয়োগ, বিষক্রিয়া কপার, ফেনোল সালফা নেমাইড, মার্কারি ও আর্সেনিকজনিত বিষক্রিয়ার কারণ হলে প্রস্রাবে রক্ত আসতে পারে। হিমাচুরিয়ার ক্ষেত্রে প্রস্রাবের বর্ণ উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয়।
প্রস্রাবের সাথে রক্ত মিশ্রিত থাকলে রক্তের উৎপত্তিস্থল কিডনি প্রস্রাব শেষে ফোটায় ফোটায় রক্ত আসলে উৎপত্তিস্থল মূত্রথলি এবং প্রস্রাবের শুরুতে রক্ত এলে রক্তপাতের উৎস মূত্রনালি বুঝতে হবে। প্রস্রাবের হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতিকে হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া বলে। এ অবস্থায়  প্রস্রাবের রঙ বাদামি বা কালচে বাদামি বর্ণের  হয়। মাংস পেশির পিগমেন্ট মায়োগ্লোবিন যখন প্রস্রাবে আসে তখন তাকে বলা হয় মায়োগ্লোবিন ইউরিয়া। অত্যাধিক হারে স্কেলিটাল মাংস পেশির কোষ বিনাশের ফলে মায়োগ্লোবিন ইউরিয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ও প্রস্রাবের বর্ণ বাদামি বা কালচে বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। প্রস্রাবে রক্ত ও মাংসপেশির পিগমেন্ট পেপার স্টিপস টেস্ট এবং ট্যাবলেট টেস্টের  সাহায্যে সহজেই নির্ণয়  করা যায়। হিমাচুরিয়া ও হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া প্রভেদমূলক ব্যবস্থা নিরূপণের জন্য প্রথমে একটি সেন্ট্রিফিউজ টিউবে প্রস্রাব নিয়ে ১ ঘণ্টা র‌্যাকে রেখে  দিলে বা ১০ মিনিট সেন্ট্রিফিউজ করলে হেমোগ্লোবিন ইউরিয়ার ক্ষেত্রে কোনো তলানি পড়বে না।  হেমাচুরিয়ার  ক্ষেত্রে লাল রঙের তলানি পড়বে।
হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া ও মায়োগ্লোবিন ইউরিয়ার মধ্যে প্রভেদমূলক ব্যবস্থা নিরূপণের জন্য ১০ মিলিলিটার প্রস্রাবের সাথে ১০ গ্রাম অ্যামোনিয়াম সালফেট মিশিয়ে ঝাঁকালে যদি প্রস্রাবের বর্ণ না থাকে তবে  বোঝতে হবে হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া। রক্তে ফসফরাস এর মাত্রা কমে গেলে বা একই সাথে কপারের অভাবজনিত কারণে মহিষের হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া হতে পারে।  প্রস্রাবের বর্ণ গাঢ় বাদামি বা কালচে বাদামি বর্ণের। মহিষে রোগটি দুগ্ধাদানকালে দেখা যেতে পারে। পুষ্টিগত হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া চিকিৎসায় ৬০ গ্রাম সোডিয়াম হাইড্রোজেন অর্থোফসফেট ৫% ডেক্সেটোজ দ্রবণে দ্রবীভূত করে শিরায় ইনজেকশন করতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর পর ইনজেকশন করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রস্রাবের স্বাভাবিক বর্ণ ফিরে আসে। এছাড়া ডাইক্যালসিয়াম ফসফেট দানাদার খাদ্যের সাথে মিশিয়ে পশুকে খাওয়াতে হবে। শিরায় ১০% এসকরবিক এসিড ৫০ এমএল প্রয়োগে সুফল পাওয়া যায়।  উদ্ভিজ্জ খাদ্য খেয়ে রক্ত প্রস্রাব হলে এসকরবিক এসিড চিকিৎসায় উপকার পাওয়া যায়। ২-১০ মাস বয়সের বাছুরের অতিরিক্ত পানি পান করার কারণে রক্ত প্রস্রাব হতে পারে। অল্প বয়সের বাছুরের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সাথে প্রায়ই রক্ত দেখা যায়। বাকেটের সাহায্যে যেসব বাছুরকে দুধ খাওয়ানো হয় তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি হয়। বাকেটে দুধ বা  পানি যাই থাকুক না কেন বাছুর প্রচুর পরিমাণে তা গ্রহণ করে। বাছুরকে প্রয়োজনমতো পানি খেতে দিতে হবে। অধিক পারিমাণ পানি গ্রহণের কারণে কিডনিকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। বাকেটের মাধ্যমে দুধ বা পানি সরবরাহ করা হলে উন্মুক্ত পানির পাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।  ননইউরো নেফ্রোলজিক্যাল উপাদন  যা প্রস্রাবের বর্ণ পরিবর্তন করে এর মধ্যে রয়েছে বিটরুট, রেড ক্যাবেজ, ব্লুবেরি, খাদ্যস্থ রঙ, ড্রাগ পিগমেন্ট মেন্ট্রোনিডাজল,নাইট্রোফিউরেনটোয়েন, ফেনিনডিওন এসব। মূত্রাশয়ের প্রদাহ বা মূত্রথলির প্রদাহ, পাইলোনেফ্রাইটিস-কিডনির সংক্রামণ এ রকম সমস্যার কারণে গাভীর রক্ত প্রস্রাব হতে পারে।  তবে পুরুষ প্রাণীতে এ সমস্যা তেমন একটা দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে পশুকে প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়াতে হবে। বোভাইন সিস্টাইটিসের ক্ষেত্রে প্রস্রাব ক্ষারধর্মী হবে। মূত্র সেন্ট্রিফিউজ করলে তলানি পড়বে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রদ্বারা এ তলানি পরীক্ষা করলে লোহিত কণিকা ও এপিথেলিয়াল কোষ পাওয়া যাবে। প্রস্রাব ক্ষার ভাবাপন্ন হলে মূত্রবৎ তন্ত্রে জীবাণুনাশক যেমন হেক্সামিন, ম্যান্ডেলিক এসিড কাজ করে না। সুতরাং পশুর মূত্র লিটমাস কাগজ দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে। প্রস্রাব ক্ষারভাবাপন্ন হলে তা অম্লভাবাপন্ন করার জন্য অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ৫ গ্রাম করে দিনে তিনবার খাওয়াতে হবে।
অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড খাওয়ানোর পর প্রস্রাব অম্লভাবাপন্ন হলে গাভীকে ৫ গ্রাম হিসেবে হেক্সামিন দিনে দুইবার খাওয়াতে হবে। হেক্সামিন ইউরিনারি অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে কাজ করে। আবার ইউরিনারি সিস্টেম তথা মূত্রতন্ত্রে নিম্নাংশের জীবাণু ঊর্ধ্বাংশে উঠে কিডনিতে সংক্রমণ সৃষ্টি করে যে প্রদাহ হয় তাকে পাইলোনেফ্রাইটিস বলে। স্ত্রী প্রাণীতে পাইলোনেফ্রাইটিসজনিত রক্ত প্রস্রাব হয়ে থাকে। পুরুষ প্রাণীতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। তীব্র প্রকৃতির রোগে রক্তমেহ বা হেমাচুরিয়া, পুঁজমেহ
(Pyuria) কষ্টমূত্র (Dysuria) জ্বর, পুনঃপুন ও ব্যথাপূর্ণ প্রস্রাব হয়। পাইলোনেফ্রাইটিসের চিকিৎসায় অ্যাম্পিসিলিন, সালফোনেমাইডস, পেনিসিনিল ব্যবহার করা যায়। ৭ থেকে ১০ দিন পেনিসিলিন চিকিৎসা বেশ কার্যকর। প্রোনাপেন ৪০ প্রতিদিন ১ বার করে ৩-৫ দিন মাংসপেশিতে ইনজেকশন করতে হবে। তৃণভোজী পশুর মূত্র অ্যালকালাইন হয়। অ্যালাকালাইন মূত্র জীবাণুর বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী। অ্যালকালাইন মূত্রে ক্ষেত্রে সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা কার্যকরতে হয় না। সেজন্য মূত্রকে এসিডিফিকেশণ করে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। প্রস্রাব অম্লভাবপন্ন করার জন্য অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড বা সোডিয়াম এসিড ফসফেট ব্যবহার করা যেতে পারে। সোডিয়াম এসিড ফসফেট খাওয়ানোর প্রায় আধাঘণ্টা পরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাবেসিয়া (Babesia) গণভুক্ত আঠালিবাহিত বিভিন্ন প্রজাতি  দ্বারা সৃষ্ট পশুর রোগ ব্যাবেসিওসিস (Bbesiosis) নামে পরিচিত। এ রোগটি রেড ওয়াটার ফিভার নামে ও পরিচিত। এ রোগের কারণে ও রক্ত প্রস্রাব হতে পারে। জ্বর অ্যানেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ইউরিয়া  এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রোগের বাহক আঠালি নিয়ন্ত্রণ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডিপিং ও স্প্রের মাধ্যমে কীটনাশক পদার্থ প্রয়োগ করে আঠালি নিধন করা সম্ভব। ইমিডোকার্ব ডাই প্রোপায়োনেট ইমিজেল প্রতিকেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.২ মিলিগ্রাম হিসেবে ত্বকের  নিচে একবার ইনজেকশনই বেশ কার্যকর। গবাদি পশুতে রক্ত প্রস্রাবের ক্ষেত্রে সংক্রামক রোগ (ব্যাবেসিও সিস), পুষ্টিগত কারণ (ফসফরাস ও কপারের ঘাটতি), ড্রাগ পিগমেন্ট বোভাইন সিস্টাইটিস, পাইলোনেফ্রাইটিস বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। মূত্রথলির প্রদাহ, কিডনিতে ইনফেকশনজনিত কারণেই মূলত রক্ত প্রস্রাব হয়ে থাকে।

কৃষিবিদ মো. আকতার হোসেন*
* প্রশিক্ষক (প্রাণিসম্পদ), ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি, চট্টগ্রাম ০১৯১৩২০১১০৭

 

বিস্তারিত
কবিতা ১৪২৩ মাঘ

স্ট্রবেরি
মো. আবদুস সবুর মণ্ডল*

যদি চাষ করেন স্ট্রবেরি ভাগ্য ফেরাতে হবে না দেরি
নিজের সংসার চলবে বেশ সমৃদ্ধও হবে আমার দেশ।
গাছ লাগানোর দুই মাসে সব গাছে ফুল আসে
এরপরেও ৩০ দিন গুণে ফল তুলে নিন।
এইভাবে তুলুন ফল সাড়ে তিন মাসকাল।
পাকা ফল খান নিজে বাড়তি ফল রাখুন ফ্রিজে।
মূল্য যার আকাশ ছোঁয়া ২৫০ টাকা প্রতি পোয়া।
সুযোগমতো বাজারে দেন নগদ টাকা বুঝে নেন।
এগিয়ে আসুন সাধক চাষা এবার পুরাবো মনের আশা।
আমরা দেশের গর্ব দেশের সেবা করব
চেষ্টা করলে শেষটা উন্নত হবে দেশটা।
. . . . . . . . .
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি সবাই মিলে
দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
এসে মা জননী সোনামণি সবাই মিলে দেব পানি
এসো ভাই সবাই মিলে এটা আমার দাবি।
তাড়াতাড়ি নাওগো মেনে
স্ট্রবেরি চাষ করলে ভাগ্য ফিরবে রাখ জেনে।
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি
সবাই মিলে দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
ওরে একটি বাড়ি একটি খামার
হয়ে যাবে তোমার আমার।
টাকায় ভরবে পকেট মোদের
আল্লাহ তায়ালা ফসল দিলে
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি।
সবাই মিলে দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
কেজি ৬০০ নয়কো পাকা
অধম চাষি সবুর বলে স্ট্রবেরি চাষ করলে
টাকার অভাব যাবে চলে
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি
সবাই মিলে দেশটা গড়ে কর চাষ স্ট্রবেরি।
. . . . . . . . . .
রসাল ফল স্ট্রবেরি চাষ কর তাড়াতাড়ি ওরে চাষি ভাই
চাহিদা তার বিশ্বব্যাপী তুলনা যার নাই।
পুষ্টিগুণে ভরপুর রোগবালাই হবে দূর
ফল খেলেও রোগবালাই যাবে ভাই।
কৃষকবান্ধব আমাদের সরকার
ঘটাতে চাষের প্রসার হয়েছে বদ্ধ পরিকর
প্রতি কেজি ৬০০ টাকা একথাটি নয়কো ফাঁকা
প্রতি গাছে ৪শ’র মতো ফল পাওয়া যায়
সাড়ে চার হাজার গাছে বিঘাপ্রতি কত আসে
হিসাব করলে পাবে রায়।
জিরো থেকে হিরো হতে বেশি পুঁজি লাগে না
চাষের কাজ করতে শুরু ধরতে কিন্তু হবে গুরু।
শুনতে যত সহজ কাজে তত সহজ নয়
বীজ হয় না এ গাছে তবে আবার মজা আছে
লতি কচুর মতো করে বাড়ে এ গাছ
গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে আছে অনেক কাজ
প্রতিকূল আবহাওয়ায় গাছগুলো যায় মরে
মরে যাওয়ার আগে কিন্তু নোটিশ দেয় না
যেতে হবে নিয়ম ধরে ধৈর্যের সাথে কাজ করে
তবে ফল পাওয়া যাবে মিছে কথা না।
বাড়ি আঙিনায় ঘরের ছাদে স্ট্রবেরি লাগানো যাবে
নিজের লাগানো ফল খাবে বেড়ে যাবে আয়
তাই আর না করে দেরি চাষ করুন স্ট্রবেরি
লেগে যান সবাই মিলে দেশের সেবায়।


*গোপালপুর ২নং ওয়ার্ড, পুরাইকালী, পাইকগাছা পৌরসভা, খুলনা ০১৯৪৪৮৪১৪২১

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (মাঘ ১৪২৩)

আবদুল হক
গ্রাম : সুবিদ খালী, উপজেলা : মির্জাগঞ্জ,
জেলা : পটুয়াখালী
প্রশ্ন : বাঁধাকপির পাতায় হলুদ রঙের দাগ পড়ে, পরে দাগগুলো কালো হয়ে পাতাটি নষ্ট হয়ে যায়। কি করলে প্রতিকার পাবো।
উত্তর : কপি গোত্রের সবজিতে এটি একটি মারাত্মক রোগ। প্রথমে পাতায় এ রোগের আক্রমণ হয়। পরবর্তীতে ফুল ও বীজ পডে আক্রমণ বিস্তার লাভ করে। অল্টারনারিয়া নামক এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে ফুলকপি ও বাঁধাকপিতে এ রোগ দেখা যায়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এজন্য ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রভেক্স-২০০ (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম) দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে; প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০ কেজি সালফার ও ১ কেজি বোরন প্রয়োগে গাছের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়ে; আক্রমণ দেখা দিলে ইভারাল বা রোভরাল (ইপ্রোডিয়ন) ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আহিনুর রহমান, গ্রাম : জয়কুর
উপজেলা : পীরগঞ্জ
জেলা : ঠাকুরগাঁ
প্রশ্ন : টমেটো গাছের পাতার কিনারা প্রথমে হালকা বাদামি ও কালো হয়ে যায়। আস্তে আস্তে পুরো পাতা ঝলসিয়ে যায় ও গাছ মারা যায়। কি করলে প্রতিকার পাবো।
উত্তর : ফাইটফথোরা নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। টমেটো ছাড়া আলুতেও এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগটি বাংলাদেশে মড়ক নামেও পরিচিত। রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ পাতায় প্রকাশ পায়। অনুকূল আবহাওয়া পেলে ৪-৫ দিনের মধ্যে সব ফসল মরে যায়। রোগের লক্ষণ ক্রমান্বয়ে গাছের কাণ্ড ও ফলে ছড়িয়ে পড়ে।  আর- সুস্থ টমেটো ফসল হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে; রোগের অনুকূল পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র প্রতিরোধক হিসাবে ২ গ্রাম মেনকোজেব+মেটালাক্সিল (রিডোমিল গোল্ড, মেটারিল) জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে; রোগ দেখা মাত্র সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে; রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সিকিউর মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মহসিনা
গ্রাম : আদর্শ কাশিরামপুর, উপজেলা : পীরগঞ্জ
জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : আলুর পাতা হলুদ হয়ে যায় ও কাণ্ডের গোড়া পচে যায়। কী করণীয়?
উত্তর : এটি আলুর ছত্রাকজনিত রোগ। একে কাণ্ড পচা রোগ বলে। কাণ্ডের গোড়ায় কালো দাগ পড়ে। পরে আলুর গা থেকে পানি বের হয় এবং পচে যায়। এর জন্য- আক্রান্ত গাছ কিছু মাটিসহ সরিয়ে ফেলতে হবে; জমিতে বীজ বপনের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মেনকোজেব অথবা প্রভেক্স দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে; পরবর্তীতে জমিতে গভীর চাষ দিয়ে কয়েক দিন ফেলে রাখতে হবে; একই জমিতে বারবার আলু চাষ না করা ভালো। কয়েকবার দানাফসল চাষ করে আবার আলু চাষ করলে এ রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।
ইদ্রিস আলী
গ্রাম : কালীগঞ্জ, উপজেলা : জলডাঙ্গা
জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : ফুলকপির পাতা, ডগা ও কপি খেয়ে পোকা নষ্ট করছে। কী করণীয়?
উত্তর : ডিম থেকে বের হয়ে পোকা একত্রে গাদা করে থাকে। পাতার সবুজ অংশ খেয়ে বড় বড় ছিদ্র করে। এর জন্য ক্ষেত পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে; ডিম ও পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে; চারা লাগানোর এক সপ্তাহের মধ্যে জমিতে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে; আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (সুমিথিয়ন, সিমবুশ, রাইসন) প্রতি ১০ লিটার পানির সাথে ১০ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
ফরিদুল ইসলাম
গ্রাম : রাধানগর, উপজেলা : মেঘনা
জেলা : কুমিল্লা
প্রশ্ন : ভুট্টার পাতা ঝলসে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : ভুট্টার পাতা ঝলসানো ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের নিচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়। এ রোগের জীবাণু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেক দিন বেঁচে থাকে জীবাণুর বীজকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত সুস্থ গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হলে এবং ১৮-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়।
প্রতিকার : রোগ প্রতিরোধী জাতের (মোহর) চাষ করতে হবে; আক্রান্ত গাছ, ঝরা পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; আক্রান্ত ফসলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি প্রপিকোনাজল (টিল্ট ২৫০ ইসি) মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে;  ভুট্টা উঠানোর পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
রাশেদুল হক
গ্রাম : শালডাঙ্গা, থানা : দেবীগঞ্জ
জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন :  পেঁয়াজের পাতা পচে যাচ্ছে, কী করণীয়?
উত্তর : পেঁয়াজের পাতা পচা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের আক্রমণে পাতায় ও বীজকাণ্ডে পানি ভেজা তামাটে, বাদামি বা হালকা বেগুনি রঙের দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা ওপর থেকে মরে আসে। এক সময় পাতা/গাছ ভেঙ্গে যায়।
প্রতিকার : আক্রান্ত পাতা ও বীজকা- ছাঁটাই করে ধ্বংস করা; সুষম সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা করা; আক্রান্ত ক্ষেতে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ইপ্রডিয়ন (রোভরাল) এককভাবে অথবা ২ গ্রাম রোভরাল ও ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে ১২ দিন পরপর ২ বার স্প্রে করা।
বীথি
গ্রাম : জলিশা, উপজেলা : দুমকী
জেলা : পটুয়াখালী
প্রশ্ন : মুরগির চোখে পিজিয়ন পক্স বা গোটা দেখা দিলে করণীয় কী?
উত্তর : পিজিয়ন পক্সের টিকা দিতে হবে। ৫-৭ দিন বয়সের কবুতর ও ২-৭ দিন বয়সের বাচ্চা মুরগিকে ১-৩ মাস পর পর এ টিকা দিতে হবে। আক্রান্ত মুরগিকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ১% সল্যুশন তুলা দিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে।
মুজিবর রাহমান
গ্রাম : হাজীপাড়া, উপজেলা : গৌড়নদী
জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : ছাগলের চোখে ছানি পড়ে, কী করব?
উত্তর : ছাগলের চোখের ছানি দূর করতে সিলভার নাইট্রেট প্রয়োগ করা হয়। পরিপক্ব ছানি অপারেশন করতে হবে। অটো থেরাপি (রস থেকে ব্লাড সংগ্রহ করে মাংসে প্রয়োগ করা) প্রদান করতে হবে। আঘাতজনিত ছানি হলে এন্টিবায়োটিক, এন্টিহিস্টামিন দিতে হবে।
সোহেল রানা
গ্রাম : কাটলা, উপজেলা : বিরামপুর
জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : দেশি শিং মাছ চাষের জন্য করণীয় কি?
উত্তর : পুকুরের আয়তন ২০ শতক হলে ভালো হয় এবং গভীরতা ৫-৬ ফুট এবং ৭-৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো থাকলে ভালো হয়। পোনার মজুদ ঘণত্ব ৭৫০-৮০০ প্রতি শতকে হলে ভালো হয়। শিং এর পোনা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে হবে। খাবার দিলে দুইবেলা বাজার থেকে রেডি ফিড এনে মাছের ওজনের ৩-৫% হারে খাবার দিতে হবে। ৬ মাস হলে বড়গুলো তুলে ছোটগুলো ছাড়তে হয়। প্রতি কেজিতে ১৫টি হলে বিক্রি করা উত্তম। পুকুরে কাপড় ধোয়া, গোসল করা নিষেধ।
দেশি শিং মাছ চাষে তিনগুণ লাভ পাওয়া যায়। শিং মাছের একক চাষও লাভজনক।
শিং চাষের পুকুরে নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রয়োজন। বর্ষাকালের পানির স্তরের অন্তত ২-২.৫ ফুট উপরে শক্ত করে ঘের/বেষ্টনী দিতে হবে। টিন বা ঘন ফাঁসের নাইলন জাল অথবা বাঁশের বানা দিয়ে ঘের দিতে হবে। স্থায়ীভাবে চাইলে ইট দিয়ে ঘের দেয়া যায়, তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বেষ্টনীর কোথাও কোন ফাঁকা না থাকে।
আরিফুল ইসলাম
গ্রাম : সকদিরামপুর, উপজেলা : ফরিদগঞ্জ
জেলা: চাঁদপুর
প্রশ্ন : ফুলকা পঁচা রোগ হলে কি করব?
উত্তর : প্রতি শতাংশে আধা কেজি হারে চুন ৭ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। ঘা যুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে ২০ লিটার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে  ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।
প্রতি কেজি খাবারের সাথে টেরামাইসিন ট্যাবলেট (৩ মি.গ্রা) একটি করে এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি (মাঘ ১৪২৩)

পাতাঝড়া গাছগুলোতে নতুন পাতায় সাজাতে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে আমাদের মাঝে। প্রকৃতিতে লেগেছে নানা রঙের ছোয়া। ঘনকুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকৃতিকে নতুনভাবে সাজাতে, বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ফাল্গুন আসে। নতুন প্রাণের উদ্যমতা আর অনুপ্রেরণা প্রকৃতির সাথে আমাদের কৃষিকেও দোলা দিয়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন ফাল্গুনের শুরুতেই আসুন সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বৃহত্তর কৃষি ভুবনে করণীয় দিকগুলো।
বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে;
ধানের কাইচথোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩-৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে;
পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাইমুক্ত রাখতে হবে;
এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়;
জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যে কোনো কৃমিনাশক ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে;
ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে;
জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি-বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে;
টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।
গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়;
গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে;
মাঠে অবস্থিত গম ফসল বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কাটার আগে মাঠে যে জাত আছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাত মিশ্রণ হতে পারে;
সকালে অথবা পড়ন্ত বিকালে ফসল কাটা উচিত;
বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে;
মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার ওপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাশের সাথে ঝুলিয়ে আবার অনেকে টিনের চালে বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করে থাকেন। তবে যেভাবেই শুকানো হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে  চেয়ে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে;
ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।
পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়;
পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭,ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪। স্থানীয় বীজ ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন;
পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়;
পাটের জমিতে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো;
ভালো ফলনের জন্য একরপ্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া, ৭ কেজি টিএসপি, ৯ কেজি এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়শ, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে;
মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনা যায়;
সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈব সার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।
গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার আথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে;
এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলিলিটার সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে পুরো গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কাঁঠালের ফলপচা বা মুচিঝরা সমস্যা সমাধানে কাঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দ্রােমিশ্রণ বা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফলিকুর প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে;
বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে;
প্রাণিসম্পদ
এ সময় মুরগির রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে;
খাবারের সাথে ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই সরবরাহ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমন- সবুজ ঘাষ, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক খাওয়াতে হবে;
যে কোনো সমস্যা সমাধান করেত উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
মৎস্যসম্পদ
মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন;
পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে;
পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে;
শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসেই কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য কাছের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্ঠা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ 
manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত