Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৭

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। বাংলাদেশ উইকিপিডিয়া ২০১৬ তথ্য মতে মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৪৭ শতাংশ এ খাতে নিয়োজিত এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে এককভাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ অবদান রাখছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রায় সাত কোটি জনসংখ্যা নিয়ে একসময় বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে খাদ্য উদ্বৃত্তে দেশ হিসেবে স্বীকৃত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সফল অভিযোজনের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। প্রতি বছর ফসলের বালাই ও ইঁদুরের আক্রমণের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়।


ইঁদুর একটি চতুর ও নীরব ধ্বংসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে পারে। ইঁদুরের বিচরণ ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোয়ার ঘর পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির দিকটি অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাত শস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ-তোষক এসব কাটাকুটি করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। ২০১৩ সালের এক গবেষণা মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লে­গ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। ইঁদুর যা খায় তার ৪/৫ গুণ নষ্ট করে।

ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। ইঁদুরের ওপরের ও নিচের চোয়ালের সামনের জোড়া দাঁত চোয়ালের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এবং এ জোড়া দাঁতের কোনো রুট ক্যানেল না থাকায় সামনের কর্তন দন্তগুলো অনবরত সারাজীবন বাড়তে থাকে।  আর এ সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০টির মতো স্তন্যপায়ী প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০টির মতো ইঁদুরের প্রজাতি পাওয়া গেছে। প্রজাতি ভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যেসব প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বই-পত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর বোনা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানা জাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান গম বার্লির ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর ফলদ গাছ বিশেষ করে নারিকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে।

 

বছর

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্রছাত্রী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীর সংখ্যা

নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা

ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষাকৃত ফসলের পরিমাণ (মে. টন)

২০১২

৫৫,০৩,৪৬১

১,৩৬,২২,০৯৫

১,০২,১৬৯

২০১৩

৮৩,৮৭,৮৭২

১,৩৯,৩৯,৯৮৬

১,০৪,৫৪৯.৮৯৫

২০১৪

৬৪,৩৯,৫৮৯

১,২৮,৯২,৯৩৩

৯৬,৬৯৬.৯৯

২০১৫

৭২,১০,৭৫০

১,২৫,৮৫,১৮১

৯৪৩৮৮.৮৫৭৫

২০১৬

৬০,২৬,৬৯১

১,১৮,৪৫,৯০৪

৮৮৮৪৪.২৮

সূত্র : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

বিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমন এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্জিত হয়। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।


ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৭ এর উদ্দেশ্য
*    কৃষক, কৃষানী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ

      সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা;
*    ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীগণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো;
*   ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প কারখানা ও হাঁস মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
*    আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কম রাখা;
*    গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা;
*    রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
*    ইঁদুর বাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।

 

কর্মসূচির সময়
এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারা দেশে একযোগে পরিচালনা করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান-২০১৭ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দিনে বিগত অভিযানের জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলা পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/জেলা পরিষদ প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যান/ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ/পৌরসভার চেয়ারম্যান/মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/জেলা পরিষদ প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যান/সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অথবা তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করাতে হবে।


ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান
যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। বিগত বছরের অভিযান বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রাথমিকভাবে অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক যাচাই করার পর জাতীয় পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে যাচাইপূর্বক চূড়ান্ত করে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।


ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ ইঁদুর চালাক প্রাণী এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক স্থানে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। একা ইঁদুর মারলে দমন ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে থাকে। এজন্য পাড়া প্রতিবেশীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একই দিনে ও একই সময়ে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গণচীনে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়)। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এ বছর ১৫,০০০ কর্মসূচি পুস্তিকা ও ১০০০০ পোস্টার মুদ্রণ করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলোন ও জিংক ফসফাইড গ্রুপের ইঁদুরনাশক (যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট , রেটক্স, জিংক ফসফাইড ইত্যাদি) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের, এ সমস্যা আগে যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মলিত প্রচেষ্টা এবং অংশীদারিত্ব। একা ইঁদুর নিধন করার সাথে সাথে অন্যদের ইঁদুর নিধনের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। একা ইঁদুর নিধন করলে সাময়িকভাবে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, তবে অল্প কিছুদিন পরই আবার অন্য স্থানের ইঁদুর এসে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

কৃষিবিদ অমিতাভ দাস*
* পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা

বিস্তারিত
স্মার্ট ইঁদুর প্রাণী ও দমন ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের কৃষকের মতে ইঁদুর হচ্ছে দুই নম্বর ক্ষতিকারক গুরুত্বপূর্ণ বালাই। পোকামাকড় হচ্ছে এক নম্বর ক্ষতিকারক বালাই। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃহৎ এলাকা দখল করে আছে। বনজ ও আগাছা, ভূমি, মানুষের কৃষি জমি, গ্রাম ও শহর, রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেচের নালা, হাঁস-মুরগির খামার এবং যেখানে মানুষ বাস করে সেখানে ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির অধিক অপকারী ও উপকারী ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর প্রজাতি আছে। বাস্তবে পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রজাতির শতকরা ৪২ ভাগ ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। বেশিরভাগ ইঁদুরের প্রজাতি অধিক পরিমাণে বংশ বিস্তার করতে পারে। এজন্য এদের মারা হলে পরিবেশের ভারসাম্যের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং দমন না করা হলে মাঠের ফসল, বাসা-বাড়ির জিনিসপত্র, অফিসের যন্ত্রপাতি ও মূল্যবান কাগজপত্র, রাস্তাঘাটের ক্ষতি এবং পরিবেশের দূষণ এবং ৬০ প্রকারের অধিক মারাত্মক রোগজীবাণুর বিস্তার ও ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে।


একজন আদর্শ কৃষক বলেছেন ‘ইঁদুর স্মার্ট প্রাণী, এদের মারতে হলে বৃদ্ধি ও দমন কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ হতে হবে।’ কারণ ইঁদুরের স্মরণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, প্রতিনিয়ত নিজের পরিবেশ যাচাই করার অভ্যাস, সন্দেহ প্রবণতা প্রখর, যে কোনো খাদ্য জিহ্বা বা ঘ্রাণ নিয়ে যাচাই করার পর গ্রহণ করে। বাচ্চাদের খাবার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা না পেলে স্ত্রী ইঁদুর গর্ভধারণ করে না। বাচ্চার সংখ্যা বাড়ানোর ও কমানোর ক্ষমতা রয়েছে। ইঁদুর মারতে হলে সঠিক দমন কৌশল নির্বাচন করতে হবে। প্রতিটি ইঁদুরের প্রজাতির আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।


বন্যা বা বর্ষার পানি বেশি হলে মাঠের ইঁদুর রাস্তাঘাট, বাঁধ, উঁচু স্থানের অল্প জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। সিলেট অঞ্চলে এবার বন্যার পানিতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি ও ইঁদুরকে দায়ী করেছেন। বাস্তবে বাঁধ সহজে ভেঙে যাওয়ার জন্য ইঁদুরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইঁদুরের গর্তের কারণে সহজে বাঁধের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। বন্যার পানি ফসলের জমিতে আসার সাথে সাথে মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর বাঁধের দুইধারে গর্ত খুঁড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ সময়  এতো বেশি মাঠের ইঁদুর বাঁধে জড়ো হয় যা বাঁধ এলাকায় ইঁদুর বন্যার সৃষ্টি হয়। বাঁধ ও সড়কে বর্ষার সময় প্রতি কিলোমিটারে ৩০০-৫০০টির বেশি ইঁদুরের গর্ত পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এক কিলোমিটারে বাঁধে বা রাস্তায় ৫০০টির বেশি ইঁদুর জড় হয়। বাঁধে বা রাস্তাঘাটে ইঁদুর দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই এটি ইঁদুরের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বর্ষার শুরু হতে বাঁধে ইঁদুর নিধন করা হলে বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা যাবে। এছাড়া পরবর্তীতে আমন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। বর্ষার প্রারম্ভে প্রতিটি ইঁদুরের গর্তে একটি গ্যাস বড়ি (Phostoxin Tablet) প্রয়োগ করে সহজেই ইঁদুর দমন করা যায়। এছাড়াও চিংড়ি মাছ অথবা শামুকে জিংক ফসফাইড বিষ দিয়ে প্রতিটি সতেজ গর্তে প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধন করা যাবে। দুঃখজনক যে বাঁধ উঁচু রাস্তাঘাট, মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হয় না। ইঁদুরের গর্তে শুধু  মাটি দিয়ে মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে কোনো কাজ হয় না। বাঁধ, মহাসড়ক বিভাগে বর্ষার সময় ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে।


দেশের প্রতিটি শহরে ইঁদুরের কারণে কোটি কোটি টাকার রাস্তাঘাটের ক্ষতি, পানির অপচয়, ড্রেনে ইঁদুরের মাটি ভরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ইঁদুর দ্বারা নানা প্রকার রোগের বিস্তার ঘটে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা বা শহরে মশা নিধনের কার্যক্রম থাকলেও ইঁদুর দমনের কোনো কর্মসূচি নেই। সিঙ্গাপুরে ইঁদুরবাহিত রোগ (যেমন- প্লেগ) বিস্তার রোধে আইন রয়েছে কারও বাসাবাড়ির আঙিনায় ইঁদুরের উপস্থিতি থাকা আইনত দ-নীয় অপরাধ এবং জরিমানা দিতে হয়। আমাদের দেশে আইন নেই এবং ইঁদুর মারার ব্যবস্থাও নেই। কাজেই এখন শহরে যেমন  মানুষের সংখ্যা বেশি তেমনি গ্রামের চেয়ে শহরের ইঁদুরের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।


বাংলাদেশের কৃষক নানাভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইঁদুর নিধন করে থাকে। সবাই মরা ইঁদুর দেখতে পছন্দ করে। তাই অধিকাংশ কৃষক (৬০%) বিষটোপ দ্বারা ফসলের মাঠে ও ঘরবাড়িতে ইঁদুর নিধন করে। কৃষকের অভিমত ইঁদুরের বিষে কাজ হয় না, খায় না এবং মরে না। প্রধান কারণ সঠিক স্থানে, সময়ে ও সঠিকভাবে বিষটোপ ব্যবহার করেন না। তাদের বিষটোপ ব্যবহারে জ্ঞানের অভাব। বর্তমানে ৬-৭% বেশি কৃষক ইঁদুর নিধনে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে থাকে। গ্যাস বড়ি ব্যবহারে কৃষকের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। অপরদিকে ৩৯% কৃষক নানা রকম ফাঁদ ব্যবহার করে যা বেশি কার্যকর। জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ সংগ্রহ করে কার্যকারিতা পরীক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিএআরআই এ কাজটি ডিএইর সাথে যৌথভাবে করতে পারে। শহরে বা বাসাবাড়িতে ইঁদুর নিধনের গ্লুবোর্ড ব্যবহার করা ভালো।


দেশের অধিকাংশ কৃষক (৬১%) মনে করেন ইঁদুর নিধনের দায়িত্ব সরকার ও কৃষকের। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। কিন্তু সামাজিকভাবে ইঁদুর দমনের সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। অধিকাংশ কৃষক ইঁদুর নিধনে ক্যানভাসার বা কীটনাশক ডিলারের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে। কৃষকের মতে ইঁদুর দমনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকে যথা-ক্যানভাসার>টেলিভিশন>কৃষিকথা> উপজেলা কৃষি অফিস। টেলিভিশনে ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।


এক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ৮৬% কৃষক ইঁদুর নিধন অভিযানের পুরস্কার বা নগদ অর্থের পরিবর্তে বাজারে কার্যকর বিষটোপ পাওয়ার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। অভিযানের পুরস্কারের মাধ্যমে অল্পসংখ্যক কৃষক বা ব্যক্তি উপকৃত হন। পুরস্কারের পরিবর্তে বিষটোপ/ গ্যাসবড়ি/ফাঁদ প্রতিটি উপজেলার এক/দুইটি গ্রামের কৃষককে প্রদান করে একযোগে ইঁদুর নিধন করা হলে বেশি ইঁদুর মারা পড়বে, জনগণের কর্মোদ্দ্যোগ বৃদ্ধি পাবে ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষতা লাভ করবে।


এতে ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি গ্রাম ২ জন কৃষক নিয়ে ইউনিয়নে ইঁদুর দমন দল গঠন করা যেতে পারে।  এদের ডিএই/বিএআরআই যৌথভাবে একদিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করলে দমন প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে। ফসল ও সম্পদের ইঁদুরজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম থাকবে।

 

ড. সন্তোষ কুমার সরকার*

 *মুখ্য প্রশিক্ষখ (অব.), মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭

 

বিস্তারিত
ধানে ইঁদুর সমস্যা : ক্ষতি ও ব্যবস্থাপনা

ইঁদুর সবার কাছে পরিচিত স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ডী বালাই যা মানুষের সাথে নিবিঢ়ভাবে সহাবস্থান করে। এ প্রাণী প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের ক্ষতিসাধন করছে যেমন- মাঠের শস্য কেটেকুটে নষ্ট করে, খায় এবং গর্তে জমা করে।


গুদামজাত শস্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ করে।


মানুষ ও গবাদিপশুতে রোগবালাই ছড়ায়।


মাঠের ফসল উৎপাদন ও গুদামজাত শস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইঁদুর এক বিরাট সমস্যা। প্রজাতিভেদে এদের ওজন ৭০-৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। ইঁদুর আকারে ছোট হলেও বছরে সব ধরনের ক্ষতি মিলিয়ে প্রায় ১০-১২শ’ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য নষ্ট করে থাকে, যার বাজারমূল্য ৭শ’ কোটি টাকারও বেশি। ইঁদুর বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গর্ত করে এবং মাটি সরিয়ে বাঁধ দুর্বল করে ফেলে। ফলে বাঁধ ভেঙে পানি দ্বারা প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর, ফসলাদি ও গবাদিপশুর যে ক্ষতি সাধন করে তার আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যাবে। ইঁদুর দ্বারা প্রাথমিক ক্ষতি হয় ধান, গম, বাদাম ও নারিকেল ফসলে। বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের মধ্যে কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত মাঠের ইঁদুর ও ছোট লেজযুক্ত ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিচু ভূমির জমিতে বেশি আক্রমণ করে। ইঁদুর যে কোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বংশধর সৃষ্টি করতে পারে। বাচ্চা প্রসবের পর ২ দিনের মধ্যেই স্ত্রী ইঁদুর পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারে। এদের গর্ভধারণকাল প্রজাতিভেদে ১৮-২২ দিন হয়। সারা বছরই বাচ্চা দিতে পারে। মাঠ ফসলের শতকরা  ৫ থেকে ৭ ভাগ এবং গুদামজাত শস্যের ৩ থেকে ৫ ভাগ ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হয়। ইঁদুর শুধু আমাদের খাদ্য শস্য খেয়ে  নষ্ট করে তাই নয় বরং এদের মলমূত্র, লোম খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে টাইফয়েড জন্ডিস, প্লেগ, চর্মরোগ ও ক্রিমিরোগসহ প্রায় ৬০ ধরনের রোগ ছড়াতে পারে।


ইঁদুর কোথায় থাকে এবং ধান ক্ষেতে কি ক্ষতি করে?
মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর গর্তে থাকে। গর্তের মুখ বন্ধ রাখে এবং মাটি স্তূপ করে রাখে। একটি গর্তে একটি মাত্র ইঁদুর থাকে। সাধারণত আগাম পরিপক্ব ধানের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। ইঁদুর ধান গাছের কুশি তেরছা কোণে (৪৫ ডিগ্রি) কেটে দেয়। গাছের শীষ বের হলে শীষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি ও পাকা শীষগুলো কেটে দেয়। ইঁদুর ধান ফসলে তিন মৌসুমেই আক্রমণ করতে পারে। তবে আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ সময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। তাই ইঁদুরের প্রজনন শুরুর আগেই ইঁদুর নিধন অভিযান কার্যক্রম শুরু করা দরকার।


ইঁদুর কেন কাটাকাটি করে?
ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের অনবরত কাটাকাটির অভ্যাস বিদ্যমান। কারণ এসব প্রাণীর মুখের ওপরের ও নিচের চোয়ালের সামনের জোড়া দাঁত চোয়ালের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এবং এ জোড়া দাঁতের কোনো রুট ক্যানেল না থাকায় সামনের কর্তন দন্তগুলো অনবরত সারাজীবন বাড়তে থাকে। দাঁতের এ অনবরত বৃদ্ধিকে কমিয়ে আনার জন্য ইঁদুর বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা অনবরত কাটাকাটি করে।


আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় কোনটি?
আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। কারণ এ সময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। জমিতে পানি থাকে বলে ইঁদুর মাঠের উঁচু স্থানে, রেলসড়ক ও মহাসড়ক, বাঁধে এবং পুকুরের পাড়ে, ধানের জমির পাশে কচুরিপানার দলে অল্প জায়গায় অবস্থান করে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এ সময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি কম হয় এবং ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।


কোথায় কখন ইঁদুর দমন করতে হবে?
সড়ক ও মহাসড়কের ইঁদুরের নতুন গর্তে, ফসলের মাঠে, পুকুর পাড়ের গর্তে, রেললাইনে ইঁদুরের গর্তে, ফসলের মাঠে উঁচু স্থানে, ঘরবাড়ির ও আশপাশের ইঁদুরের নতুন গর্তে, জমিতে যখন পানি থাকে ও ধানে থোড় আসার আগে ইঁদুর দমন করতে হবে। রাস্তাঘাটের ইঁদুর মাঠের পানি সরে গেলে আমন ক্ষেতে ঢুকে পড়ে এবং বিপুল ক্ষতি করে। তাই জমির পাশে সরকারি রাস্তার ও উঁচু জায়গার ইঁদুর জমিতে প্রবেশ করার আগেই মেরে ফেলতে হবে।


মাঠ ফসলের বৃদ্ধির সাথে সাথে ইঁদুর প্রজনন প্রক্রিয়াও চালাতে থাকে। তাই ফসলের থোড় ও পাকা অবস্থায় ইঁদুর দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। কারণ এ সময় মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যায়। এ সময় ইঁদুরের ক্ষতির মাত্রা বেশি হলেই কেবল ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়, তখন দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকরী হয় না। কারণ মাঠের ফসল রেখে ইঁদুর বিষটোপ খেতে চায় না এবং দমন খরচ অনেক গুণ বেড়ে যায়।


কিভাবে ইঁদুর দমন করা যায়?
ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। তবে ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। সবাই মিলে একযোগে বেশি জায়গার ইঁদুর মারলে ফসল রক্ষা পায় ও ইঁদুরের সংখ্যা পরবর্তীতে বাড়তে পারে না। এজন্যই সরকারিভাবে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে এবং এটাকে সামাজিকভাবে আরও কার্যকরী করতে হবে। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১. অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন  ২. রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন এবং ৩. জৈবিক পদ্ধতিতে দমন।  

অরাসায়নিক পদ্ধতি মানে ভৌতিক ও যান্ত্রিক কলাকৌশল যেমন-
গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা।
ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা।
ইঁদুরের গর্তে মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুরকে বের করে মেরে ফেলা।
ক্ষেতের আইল চিকন (যেমন- ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি) রেখে ক্ষেতে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়।
বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে।
একই এলাকার ধান ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করা হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়। বাড়িঘর ও ক্ষেতের আশপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করতে হবে।
ধান ক্ষেতের চারদিকে এক মিটার উচ্চতায় পলিথিন দ্বারা ঘিরে দিয়ে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
আগে পাকে এমন স্বল্প জীবনকালের ধান (যেমন- ব্রি ধান৬২) চাষ করে একে ফাঁদ ফসল হিসেবে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে।


বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক (রিপেলেন্ট) যেমন- জমিতে ভিডিও ফ্লিম টানিয়ে, মানুষের প্রতিকৃতি জমিতে দিয়ে অথবা আলট্রা শব্দ সৃষ্টি করে জমি থেকে ইঁদুরকে সাময়িক সরিয়ে রাখা যায়। ইঁদুর তাড়ানোর নতুন পদ্ধতি হিসেবে আমন ধান ক্ষেতে পলিথিনের ঝাণ্ডা উড়িয়ে সুফল পাচ্ছেন কৃষক। বাতাসের কারণে পলিথিন পত পত শব্দ করে উড়ে আর ইঁদুর মনে করে কেউ আসছে, তাই ভয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য বায়ুপ্রবাহ মন্থর হলে কৌশলটি ভালোভাবে কাজ করবে না। বেশি সময় ধরে একই উৎপীড়ক ব্যবহার করলে এর কার্যকারিতা কমে যায়।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমনে তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। যেমন- ১. একমাত্রা বিষটোপ। ২. দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ এবং ৩. বিষ গ্যাস বড়ি।

 

একমাত্রা বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর একবার খেলেই সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড (<২%) বিষটোপ এর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত।
 

প্রয়োগ কৌশল : জিংক ফসফাইড ছাড়া শুধু গম কয়েক দিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করতে হবে।   
 

সমস্যা : যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয় তবে বিষটোপ লাজুকতা (বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর মরে পড়ে আছে, এটা দেখে জীবিত ইঁদুরের ওই বিষটোপের প্রতি খাওয়ার অনীহা)। দেখা দিতে পারে।  


দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে  মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছু দিন অর্থাৎ ২ থেকে ১৪ দিন পর মারা যায়। এক্ষেত্রে ল্যানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‌্যাট ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ রক্তের জমাটবাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে ইঁদুরের দেহে কোনো কারণে সৃষ্ট বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ ক্ষতের জন্য অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ইঁদুর দুর্বল হয়ে গর্তের মধ্যে মারা যায়। এখানে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না।


বিষ গ্যাস বড়ি : বিষ গ্যাস বড়ি মরণ গ্যাস উৎপন্ন করে। ইঁদুরের গর্তে বিষাক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিলে ইঁদুর মারা যায়। এজন্য নতুন সচল গর্তে গ্যাস বড়ি দিয়ে আশপাশের সব গর্তের/নালার মুখ মাটি দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দিতে হবে।


বিষটোপ কোথায় প্রয়োগ করতে হবে?
ইঁদুর নতুন মাটি বের করেছে এরূপ সচল গর্তের ভেতরে বিষটোপ দিতে হবে। একটি গর্তে অনেক মুখ থাকতে পারে তবে যে গর্তের মুখে নতুন মাটি পাওয়া যাবে শুধু সেই গর্তের ভেতর বিষটোপ  দিতে হবে। একটি গর্তে জিংক ফসফাইডের বিষটোপের একটি টুকরা (কেক) অথবা বড়ি প্রয়োগের পর গর্তের সব মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। ল্যানির‌্যাট ছোট পাত্রে বা মোটা কাগজের পোটলা তৈরি করে সচল গর্তের মুখে রাখতে হবে।


জৈবিক পদ্ধতিতে কিভাবে ইঁদুর দমন করা যায়?
জৈবিক পদ্ধতি হলো অন্য জীবের সাহায্যে দমন। ইঁদুরভোজী প্রাণীদের রক্ষা এবং বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। আমরা জানি পেঁচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, বিড়াল জাতীয় প্রাণীর প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও হাঙ্গেরি মাঠ ফসলের ইঁদুর দমনে পেঁচার ব্যবহার করছে। এজন্য তারা পেঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালন কার্যক্রমকে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহিত করছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, একজোড়া পেঁচা চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চার লালন-পালনে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায়  ১১ প্রজাতির পেঁচার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কোনো এলাকায় কোনো প্রজাতির পেঁচা বেশি তার সঠিক তথ্য জানা নেই। মানব সমাজে পেঁচাকে অলক্ষণের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু মানুষের কোনো ক্ষতি না করে বরং পেঁচা নীরবে-নিভৃতে ইঁদুর দমন করে মাঠের ফসলের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। তাই জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সংরক্ষণ ও বংশবিস্তারের সুযোগ করে দিতে হবে। পরিশেষে একটি পরিচিত স্লোগানের মাধ্যমে শেষ করতে চাই, তাহলো-

 

‘সবাই মিলে ইঁদুর মারি
দেশের সম্পদ রক্ষা করি’।

 

ড. মো. মোফাজ্জল হোসেন*  মো. মোসাদ্দেক হোসেন**
*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর-১৭০১

 

বিস্তারিত
দানাদার ফসলের ইঁদুরের ক্ষতি ও দমন ব্যবস্থাপনা

ধান বাংলাদেশের প্রধান ও মুখ্য দানা শস্য, ধানের পর গম, ভুট্টা, মুখ্য দানাদার ফসল। চিনা, কাউন, বার্লি গৌণ দানাদার ফসল হিসেবে পরিচিত। যেসব প্রাণীর মেরুদণ্ড আছে তাদের মেরুদণ্ডী প্রাণী বলা হয়। আর যেসব মেরুদণ্ডী প্রাণী আমাদের ফসলের ক্ষতি করে থাকে তাদের ক্ষতিকর বা অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী বলা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল অংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ মাঠ থেকে শুরু করে গোলাঘর পর্যন্ত উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বিরাট অংশ শুধুমাত্র ক্ষতিকর মেরুদণ্ডী প্রাণীর কারণে নষ্ট হয়। এদের উপস্থিতি পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য একান্ত আবশ্যক। মেরুদণ্ডী প্রাণীর অন্তর্গত পশুপাখির অধিকাংশই আমাদের উপকারে আসে। মানুষের উপকারে একবারেই আসে না এমন পশুপাখির সংখ্যা নিতান্তই কম। বাংলাদেশে দানাদার ফসলে ক্ষতিকর মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে।


ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের প্রধান শক্র। ইঁদুর মানুষের উপকারে আসে এমন ঘটনা বিরল। মানুষের আশপাশে থেকেই এরা মাঠে গুদামে বাসাবাড়িতে অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। এদের উপদ্রবে পৃথিবীর বহুদেশে চরম দুর্যোগ নেমে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৬৭) হিসাব মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। বিশ্বে প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে, সে খাবার খেয়ে অনায়াসেই ২৫-৩০টি দরিদ্র দেশের মানুষ এক বছর বাঁচতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইঁদুর প্রায় ৭২৪ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোলআলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসের শতকরা ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। ইঁদুর শুধুমাত্র গম ফসলে বছরে প্রায় ৭৭,০০০ মেট্রিক টন ক্ষতি করে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ইঁদুর প্লেগসহ প্রায় ৪০ প্রকার রোগ ছড়ায়। শস্যহানি, রোগ-জীবাণু ছড়ানো ছাড়াও ইঁদুর বই পুস্তক, কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র, রাস্তাঘাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নষ্ট করে থাকে। টেলিফোনের তার ও বৈদ্যুতিক তার কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল ও ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটায়।

 

ইঁদুরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতি
স্তন্যপায়ী শ্রেণীর মধ্যে রোডেনশিয়া বর্গের অন্তর্ভুক্ত ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হলো একটি বিশেষ ধরনের প্রাণী এবং তাদের বিশেষত্ব এই যে, স্তন্যপায়ী শ্রেণীর ৫৪১৯টি প্রজাতির মধ্যে ২২৭৭টি প্রজাতিই এ বর্গের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মাত্র ২০-২৫টি প্রজাতি আপদ বালাই বা অনিষ্টকারী হিসেবে চিহ্নিত। অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষতিকারক প্রাণী যা ফসল বপন থেকে শুরু করে ফসল কাঁটা ও সংগ্রহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে ক্ষতি করে থাকে। এরা সাধারণত গর্তে বাস করে, তবে কোনো কোনো প্রজাতির ইঁদুর ঘরে বা গাছে বাসা তৈরি করে বাস করে। ইঁদুর যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে খুব দ্রুত বংশবিস্তার করতে সক্ষম। এ জাতীয় প্রাণীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের দাঁতের গঠন ও বিন্যাস। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী Rodent শব্দটি এসেছে তাদের কর্তন দাঁত (Rodere = কাটা, dent= দাঁত) থেকে। যা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও ধারাল বাটালির মতো। এ দাঁত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাড়তে থাকে, তাই ইঁদুর দাঁত বৃদ্ধির সমতা রাখার জন্য বা দাঁত ক্ষয় করার জন্য অনবরত কাটাকুটি করে বা গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি করতে থাকে। ইঁদুরের ওপরের ও নিচের মাঢ়িতে এক জোড়া ছেদন দ- ও ৩ জোড়া পেষণ দন্ত আছে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর গবেষকরা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করেছে, যেমন-সজারু, কাঁঠবিড়ালি, নেংটি ইঁদুর (mice)।


সাধারণত ইঁদুরের জীবনকাল এক থেকে তিন বছর, একটি স্ত্রী ইঁদুরের বয়স তিন মাস পূর্ণ হলে বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। স্ত্রী ইঁদুরের সাধারণত ৮-১০ জোড়া স্তন থাকে। গর্ভধারণ কাল ১৯-২৩ দিন। বাচ্চা প্রসবের পরে মাত্র দুই দিনের মধ্যে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। এরা সারা বছরই বাচ্চা জন্ম দিতে পারে, তবে বছরে ৫-৭ বার এবং প্রতিবারে ৬-১০টি বাচ্চা জন্ম দিয়ে থাকে। মা ইঁদুর এদের যতœ বা লালন পালন করে থাকে। পুরুষ ইঁদুরের বাচ্চা লালন পালনে কোনো আগ্রহ নেই, অধিকন্তু খাদ্য সংকটের সময় এরা এদের বাচ্চাকে খেয়ে ফেলে। এদের ১৪-১৮ দিনে চোখ ফোটে। ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত দুধ পান করে এবং তিন সপ্তাহ পর থেকে শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে। পাঁচ সপ্তাহ পর থেকে এরা মা এর সঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে যায়।


মাঠের কালো ইঁদুর (Bandicota bengalensis)
মাঠের কালো ইঁদুর মাঠ ফসলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির, ওজন প্রায় ১৫০-৩৫০ গ্রাম, পশম কালো ধূসর রঙের। মাথাও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। এরা সাঁতারে পটু। এরা গর্ত তৈরি করে বসবাস করে। বাংলাদেশের বনাঞ্চল ব্যতীত সর্বত্রই এদের বিস্তৃতি। সব রকমের কৃষিজাত ফসলেই এদের পাওয়া যায়। এছাড়া শহর এলাকা, ঘরবাড়ি এবং গুদামেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরা গর্ত তৈরির ব্যাপারে সক্রিয় যার ফলে বীজতলা ও ফসলের চারা অবস্থায় খুবই ক্ষতি হয়ে থাকে। ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানই গর্ত করে, ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে, গুদামে খেয়ে, পায়খানা, প্র¯্রাব, পশম, মাটি ও শস্যের সাথে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট, পানি সেচের নালা, বাঁধ এবং ঘরবাড়ির যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। সবচেয়ে আশংকাজনক ব্যাপার হলো যে এ প্রজাতির একটি ইঁদুর এক রাত্রে ২০০-৩০০টি ধান বা গমের কুশি কাটতে পারে।


মাঠের বড় কালো ইঁদুর (Lesser bandicoot rat, Bandicota indica)
এদের দেখতে মাঠের কালো ইঁদুরের মতো। কিন্তু তাদের চেয়ে আকারে বেশ বড়, মুখাকৃতি সরু, ৩৫০-১০০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পেছনের পা বেশ বড় এবং কালো হয় বলে সহজেই চেনা যায়। মাথা ও দেহের দৈর্ঘ্য ১৫-৩০ সেন্টিমিটার। এ ইঁদুরের রঙ কালচে ধূসর বা তামাটে বর্ণের। মাথা ও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যের তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। লেজ বেশ মোটা, লেজের রিংগুলো স্পষ্ট, পেছনের পা বড়, চওড়া ও পায়ের পাতার নিচের দিকে কালো। এরা সাঁতারে পটু, গর্তে বাস করে, গর্ত ৮-১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা সাধারণত মাঠে ধান ফসলের বেশি ক্ষতি করে।


গেঁছো ইঁদুর/ঘরের ইঁদুর (House/ roof rat,) Rattus rattus
গেঁছো ইঁদুর সাধারণত মাঝারি ধরনের, লম্বাটে, লালচে বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। শরীরের নিচের দিকটা সাদাটে বা হালকা বর্ণের। এ জাতের ইঁদুর গুদাম জাত শস্য, ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদির ক্ষতি সাধন করে থাকে। এরা মাটিতে গর্ত না করে ঘরের মাচায় বা গুপ্ত স্থানে গাছে বাসা তৈরি করে বংশ বৃদ্ধি করে। এদের সাধারণত মাঠে কম দেখা যায়, তবে বাড়ির আশপাশে, উঁচু এলাকায় ও নারিকেল জাতীয় গাছে বেশি দেখা যায়।


ঘরের নেংটি ইঁদুর (House mouse, Mus musculus)   
ছোট আকারের এ ইঁদুরকে কোনো কোনো এলাকায় ঘরের বাতি ইঁদুর, কোথাও শইল্লা ইঁদুর বলে থাকে। এ ইঁদুরের শরীর ও মাথার দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজের দৈর্ঘ্য কিছুটা বড় হয়। গায়ের পশম ছাই বা হালকা তামাটে বর্ণের, পেটের পশম খানিকটা হালকা ধূসর বর্ণের। এরা ঘরে বাস করে, ঘরে সংরক্ষিত খাদ্যশস্য, ঘরের জিনিস পত্র, কাপড় চোপড়, লেপ তোষক, বই পুস্তক, অফিস আদালত, বাসাবাড়ি, ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক তার ইত্যাদি কেটে ব্যাপকভাবে ক্ষতি সাধন করে।


ইঁদুরের ক্ষতির ধরন বা লক্ষণ
ধান ক্ষেতে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন : ইঁদুর ধান গাছের কা- সব সময়ই তেছরাভাবে কাটে যার ফলে কাণ্ড নুয়ে পড়ে। কিন্তু ধান বা গমে যখন শীষ বের হয় তখন ইঁঁদুর কখনও কখনও ওই শীষকে বাঁকিয়ে নিয়ে শুধু শীষ কেটে দেয়। কোনো কোনো সময় ইঁদুর শুধুমাত্র তার দাঁতকে ধারালো এবং স্বাভাবিক রাখার জন্য অথবা বাসা তৈরি করার জন্য ধান কেটে টুকরো টুকরো করে থাকে। গভীর পানির ভাসা আমন ধানে থোর আসার আগে থেকেই ইঁদুরের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত বড় কালো ইঁদুর  ভাসা আমন ধানে ক্ষতি করে থাকে। ফসল কাটার সময় ধান ক্ষেতে অনুরূপ লক্ষণ দেখা যায়। ফলে ফলন অনেক কমে যায়। রোপা আমন ধানেও বেশি ক্ষতি করে থাকে।


গম ও বার্লি ক্ষেতে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন : গম উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ইঁদুর। বীজ গজানো থেকে শুরু করে গম কাটা পর্যন্ত মাঠে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। ক্ষেতে বহু সংখ্যক গর্ত, নালা ও প্রচুর পরিমাণে মাটি উঠিয়ে গমক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে ইঁদুর শীষ বের হওয়া অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। শীষ বের হওয়ার শুরু থেকে কুশি কেটে গাছের নরম অংশের রস খায় ও পরে গাছ কেটে ও গম খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে। ইঁদুর গাছ কেটে গমসহ শীষ গর্তে নিয়েও প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। একটি ইঁদুর এক রাতে ১০০-২০০টি পর্যন্ত গমের কুশি কাটতে সক্ষম। ফলে গমের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। গমের ও বার্লিতে শীষ বের হওয়ায় সময় থেকে গম পরিপক্ব অবস্থা পর্যন্ত ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
সংগ্রহোত্তর ক্ষতি : প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য গুদামে সংরক্ষণ করা হয় যেখানে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, ইঁদুর দ্বারা সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ২.৫-৩০ শতাংশ। ছোট কালো ইঁদুর, গেছো ইঁদুরএবং নেংটি ইঁদুর প্রধানত গুদামে, গবেষণাগারে, অফিসে, বাসাবাড়িতে ক্ষতি করে থাকে। একটি ইঁদুর প্রতি পরিবারে গুদামে বছরে ৪০-৫০ কেজি দানাশস্য ক্ষতি করে থাকে এবং এ ক্ষতির পরিমাণ ৭৫,০০০-১,০০,০০০ মেট্রিক টন।


ইঁদুরের উপস্থিতির চিহ্ন
ইঁদুরের পায়খানা (Dropping)
ইঁদুরের বিষ্ঠা ফসলের ক্ষেতে, বাড়িতে, দালান কোঠার বা গুদামে গর্তের পার্শে¦, দেয়াল বা মাচার ওপর দেখতে পাওয়া যায়। ইঁদুরের প্রজাতির ভেদে বিষ্ঠার আকার ও আকৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে।


ইঁদুরের চলাচলের রাস্তা (Runway)
অন্যান্য প্রাণীর মতো ইঁদুরেরও সচরাচর একই পথ দিয়ে চলাফেরা করে। তারা এ পথ সব সময়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। ফসলের জমিতে ফসলের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে তাদের সুড়ঙ্গ পথ ৫-৬ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে।


ইঁদুরের পায়ের চিহ্ন (Foot print)
কাদা মাটিতে, নরম বা বালি মাটিতে ইঁদুরের পায়ের ছাপ বোঝা যায়। তাছাড়া কালি মিশ্রিত ঢাইলের ওপর ও পায়ের ছাপ বুঝা যায়। পায়ের ছাপ বা চিহ্ন ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়।

 

দাগ (Smear)
ইঁদুর সব সময় একই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। বার বার একই রাস্তা ব্যবহার করার ফলে, চলাচলে রাস্তার পার্শ্বে, বিম এ এক ধরনের দাগ দেখা যায় একে Smear বা দাগ বলে। দাগ দেখেও ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়।


ইঁদুরের গর্ত (Burrow)
ইঁদুরের গর্ত সাধারণত খাদ্য গুদামের কাছে দেয়ালের বাহিরে স্থাপনার নিচে এবং বাঁধের পাড়ে ফসলের ক্ষেতে দেখা যায়। সদ্য নতুন মাটি বা উঠানো গর্ত দেখে সহজেই সতেজ গর্ত শনাক্ত করা যায় এবং ইঁদুরের উপস্থিতি সহজেই বুঝা যায়।


ক্ষত এবং কাটাকুটির চিহ্ন (Damage)
মাঠে কাটা গাছ, কাটা ফল, শাকসবজি, গুদামে বা মাচাতে কাটা বস্তা ইত্যাদি দেখে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়। গম বা ধানের কা- তারা তেরছা করে কাটে।


শব্দ (Sound) ও ঘ্রাণ
ঘরে বাড়িতে সাধারণত রাতের বেলায় মাচা বা সিলিংয়ের ওপর ইঁদুরের দৌড়ানো বা চলাফেরার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ইঁদুরের কিচির মিচির শব্দ বা ইঁদুরের প্র¯্রাব পায়খানার গন্ধ শুকেও ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায়।


সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
শত শত বছর ধরে ফসলের মাঠে ইঁদুর দমন করা হচ্ছে তবুও ইঁদুরের সমস্যা প্রকট। কারণ যত্রতত্রভাবে ইঁদুর দমনের কৌশল অবলম্বন করা। বুদ্ধিমানের কাজ ইঁদুরের প্রাদুর্ভাবের সময় ইঁদুর দমন করা। অতএব, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, ইঁদুর দমন একটি পরিবেশগত কৌশল যে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু কোনো প্রজাতিকে ধ্বংস করা নয়। ইঁদুর দমনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ইঁদুরের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য ও বাসস্থান সম্পর্কে জানা এবং এসব উপাদানগুলো সীমিত করা যা ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।


ইঁদুর দমন পদ্ধতিগুলো আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। ক. পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিক পদ্ধতি খ. বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুুর দমন।


ক. পরিবেশ সম্মতভাবে দমন : কোনো রকম বিষ ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিক পদ্ধতি। বিভিন্নভাবে এটা করা যায়। যেমন-


পরিদর্শন ও সজাগ দৃষ্টির মাধ্যমে আশ্রয়স্থল কমানো/বাসস্থান ব্যবস্থাপনা :
প্রতিবন্ধকতা
গর্ত খোঁড়া, পানি ও ধোঁয়া দিয়ে
জৈব নিয়ন্ত্রণ বা পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে
নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতার মাধ্যমে
নিবিড়ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরণ ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। কোনো কোনো ফাঁদে ইঁদুর ধরা পড়ার সময়ই যাতাকলে আটকিয়ে মারা যায়। এগুলোকে মরণফাঁদ বলে। কোনো কোনো ফাঁদে (বাঁশের ফাঁদ, বাক্সের ফাঁদ, খাঁচার ফাঁদ ইঁদুর জীবন্ত ধরা হয় এগুলোকে জীবন্ত ফাঁদ বলে। ফাঁদে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত যেখানে ইঁদুর দেখা যায় এবং যেখান দিয়ে ইঁদুর চলাফেরা করে যেমন ঘরের কিনারা, দেয়ালের পার্শ্ব, চালের ওপর বা গর্তের কাছাকাছি সেখানে ফাঁদ স্থাপন করা উচিত। মরণফাঁদ ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় আড়াআড়িভাবে দেয়ালের বিপরীতে পাতা উচিত কেননা তাতে দুই দিক হতে ইঁদুর ফাঁদে পড়ার সম্ভবনা থাকে। বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ঘরবাড়ির জন্য উপযোগী কিন্তু মাঠেও এ ধরনের ফাঁদ পাতা যায়।


বপন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে
বপন পদ্ধতির উপর ইঁদুরের আক্রমণ কমবেশি হয়ে থকে। যেমন- গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারিতে বপন (৬-৮%) ছিটিয়ে বপনের চেয়ে (৮-১০%) ইঁদুরের আক্রমণ কিছুটা কম হয় আবার বেড পদ্ধতিতে গম আবাদ করলে ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়।


ইঁদুরের লেজ সংগ্রহের মাধ্যমে
এ ব্যবস্থা এরই মধ্যে কয়েকবার বাংলাদেশে নেয়া হয়েছে এবং আশানুরূপ ফলও পাওয়া গেছে। প্রতিটি ইঁদুরের লেজের জন্য পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে লেজ সংগ্রহ অভিযান চালিয়ে ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে রাখা সম্ভব।


খ. রাসায়নিক দমন বা ইঁদুরনাশক দিয়ে দমন
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহু যুগ ধরে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন চলে আসছে। বিষ ক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ক. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (Acute poison) খ. বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ (Chronic poison)। বাংলাদেশে দুই ধরনের ইঁদুরনাশক পাওয়া যায়।


ক. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (Acute poison)
যেসব বিষ খেলে ইঁদুরের দেহে তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া দেখা দেয় এবং মৃত্যু ঘটায় তাদের তীব্র বিষ বলা হয়। যেমন- জিংক ফসফাইড। একমাত্র ‘জিংক ফসফাইড’ সরকার অনুমোদিত একমাত্রা বা তাৎক্ষণিক বা তীব্র বিষ। বিষটোপ তৈরিও খুব সহজ। তাই অতি সহজে কৃষক ভাইরা জিংক ফসফাইড দিয়ে বিষটোপ তৈরি করে এবং তা দিয়ে ইঁদুর দমন করে। এ বিষ থেকে তৈরি বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর সাথে সাথেই মারা যায়। ইঁদুর মরা অবস্থায় বিষটোপ পাত্রের আশপাশেই পড়ে থাকতে দেখা যায় বলে অনেকেই এ বিষটোপ খুব পছন্দ করে। কিন্তু এ বিষটোপের প্রধান অসুবিধা হলো বিষটোপ লাজুকতা। অর্থাৎ মরা ইঁদুর পড়ে থাকতে দেখে অন্য ইঁদুর আর বিষটোপ খেতে চায় না। একেই বিষটোপ লাজুকতা বলে। বিষটোপ ব্যবহারের আগে ২-৩ দিন বিষহীন টোপ ব্যবহার করে ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নিলে ইঁদুরের মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যায়। তবে কোনো ক্রমেই পর পর দুই তিন রাত বিষটোপ ব্যবহারের পর ওই স্থানে এক মাস আর এ বিষ ব্যবহার করাই ভালো।


খ. দীর্ঘমেয়াদি বিষ (Chronic poison)
যেসব বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না গেলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ২-১৪ দিনের মধ্যে মারা যায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিষ বলা হয়। দীর্ঘমেয়াদি বিষকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক. একমাত্রা বিষ, খ. বহুমাত্রা বিষ। একমাত্রা একবার খেলেই ইঁদুর মারা যাবে, যেমন- ক্লের‌্যাট, স্টর্ম। বহুমাত্রা বিষ খেয়ে ইঁদুর মরার জন্য একাধিকবার খেতে হবে যেমন- ল্যানির‌্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট, রেকুমিন। উল্লিখিত সবগুলো বিষই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। ইঁদুর এ ধরনের বিষ খেয়ে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে গর্তের ভেতর মারা যায়, সেজন্য মৃত ইঁদুর সচরাচর চোখে পড়ে না। এ ধরনের বিষ খেলে সহসা কোনো আক্রান্ত লক্ষণ ধরা পড়ে না বিধায় পরিবারের অন্যান্য ইঁদুররাও এ ধরনের বিষটোপ খেতে কোনো কুণ্ঠা/দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। ফলে একসাথে অনেক ইঁদুর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের বিষটোপে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। পরীক্ষামূলকভাবে মাঠে এ জাতীয় বিষ দ্বারা শতকরা ৯০ ভাগ ইঁদুর দমন করা সম্ভব। এদেশে ল্যানিরটি বা ক্লেরাট, ব্রোমাপয়েন্ট নামে বিভিন্ন কীটনশকের দোকানে পাওয়া যায়।


সতর্কতা
জিংক ফসফাইড বিষটোপ তৈরির সময় কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে দিতে হবে। বিষটোপ তৈরির পরও ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। ছোট শিশু ও বাড়ির গৃহপালিত পশুপাখি যেন এ বিষটোপের সংস্পর্শে না আসে তা লক্ষ্য রাখতে হবে। মৃত ইঁদুরগুলো একত্রিত করে গর্তে পুঁতে  ফেলতে হবে। বিষটোপ প্রস্তুত ও প্রয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং কোনো রকম অসুস্থতা অনুভব করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। গ্যাস বড়ি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।


ইঁদুর মানুষের ব্যক্তিগত ও জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তাই এদের সংখ্যা কমিয়ে মূল্যবান ফসল রক্ষা করে খাদ্যাভাব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট একক পদ্ধতি ইঁদুর  দমনের জন্য  যথেষ্ট নয়। ইঁদুর  দমনের সফলতা নির্ভর করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর। অতএব সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

 

ড. মো. শাহ আলম*

*প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত), অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর

 

বিস্তারিত
পানের ভেষজ গুণ

ভারতবর্ষের প্রাচীন ভেষজ গ্রন্থ আয়ুর্বেদে নিঃশ্বাস দুর্গন্ধমুক্ত রাখার জন্য পান সেবনের উল্লেখ আছে। নিয়মিত পান সুপারি খেলে নিঃশ্বাসে কোনো দুর্গন্ধ থাকে না, হজমও ভালো হয়। এটি এ উপমহাদেশের এক প্রাচীন ধারণা ও লোক অভ্যাস। এখনও কেউ কেউ মূত্রকৃচ্ছতায় ভালোভাবে মূত্র নিঃসরণের জন্য দুধের সাথে পানের রস ও চিনি মিশিয়ে পান করেন। এতে প্রস্রাবের ওই সমস্যাটা চলে যায় ও মূত্র নিঃসরণ ভালো হয় এবং স্নায়ু ও শরীরের দুর্বলতা থাকলে তাও দূর হয়। দেহের ক্লান্তি ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য কয়েকটা পান পাতার রস এক চামচ মধু দিয়ে খেলে তা টনিকের মতো কাজ করে। এ মিশ্রণের এক চা চামচ পরিমাণ একবার খেতে হয়। এভাবে দিনে ২ থেকে ৩ বার খাওয়া যায়। পান পাতা সেবনে দেহের চর্বি বা মেদ কমে এবং ওজন কমে বলে জানা গেছে। নিচে পান খাওয়ার উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারিতার কথা বর্ণনা করা হলো।
 

হজমে সাহায্য করে
পান খেলে লালাগ্রন্থির নিঃসরণ বেড়ে যায়। এ লালার কারণেই হজমের প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়। লালার মধ্যে থাকা বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচক খাদ্যকে কণায় ভাঙতে সাহায্য করে যার ফলে হজম ভালো হয়। শুধু পান পাতা চিবিয়ে খেলেও এ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষ করে গুরুপাক বা ভারী খাবার খাওয়ার পর অনেকেরই হজমের সমস্যা হয়। এজন্য যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনের শেষে পান পরিবেশন করা হয় যা খেলে ওসব খাবার দ্রুত হজম হয়ে যায়। কোমল পানীয় খাওয়ার চেয়ে এটা নিশ্চয়ই ভালো। বদহজম হলে পানিতে পান পাতা টুকরো করে কেটে কিছুক্ষণ সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ করা বা জ্বাল দেয়ার সময় তাতে কয়েকটা গোলমরিচ দিতে হবে। তারপর তা নামিয়ে ছাঁকতে হবে। তারপর ঠাণ্ডা করে তা খেতে হবে। শিশুদের ২ চা চামচ খাওয়াতে হবে। এতে হজম ভালো হবে, বদহজম বা অজীর্ণ হলে সেটাও চলে যাবে।

 

মুখের দুর্গন্ধ দূর করে
খাবার গ্রহণের পর তার কণা মুখের ভেতরে, দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকে। এগুলো ব্যাকটেরিয়া পচিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। পান খেলে তার রস জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে এসব ব্যাকটেরিয়াকে জন্মাতে দেয় না। ফলে মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও মুখে দুর্গন্ধ হয় না।

 

যৌন শক্তি বাড়ায়
এটি একটি পুরনো প্রথা, তবু কার্যকর। নববিবাহিত দম্পতিদের অনেকেই যৌন মিলনে যাওয়ার আগে পান খান। এতে তাদের যৌন ক্ষমতা ও মিলনের স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধি পায়।
গ্যাস্ট্রিক আলসার নিরাময় করে


পান খেলে পেটে বায়ু কম হয় ও গ্যাস হয় না। এর ফলে গ্যাস্ট্রিক ও তা থেকে আলসার সৃষ্টির সুযোগ কমে যায়। পানের রস হজমে সাহায্য করায় তা পেটে বদ গ্যাস তৈরি রোধ করে। ফলে পেট ফাঁপে না ও গ্যাস্ট্রিক হয় না।


জন্মরোধ করে
পান গাছের শিকড় বেটে রস করে খেলে ছেলেপুলে হয় না। জন্ম নিরোধক বড়ি না খেয়েও জন্মনিয়ন্ত্রণে এটা সেবন করা যায়। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।


উঁকুন মরে
মাথায় উঁকুন হলে গোসলের কিছুক্ষণ আগে পান পাতার রস মাথায় লাগিয়ে বসে থাকলে উঁকুন সবংশে মরে যায়। এ কাজে ঝাল পান হলে ভালো হয়।


ফোঁড়া ফাটায়
পান পাতার চকচকে সবুজ পিঠে ঘি মাখিয়ে একটু সেঁক দিয়ে গরম করে ফোঁড়ার ওপর লাগিয়ে দিলে দ্রুত ফোঁড়া পেকে ফেটে যায়। আবার পাতার উল্টো পিঠে ঘি মাখিয়ে একইভাবে বসিয়ে রাখলে তা পুঁজ টেনে বের করে আনে। ঘিয়ের বদলে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করেও একই ফল পাওয়া যায়।


কান পাকা সারায়
কান পেকে পুঁজ হয়ে গেলে সেসব কানে পান পাতার রস গরম করে ১-২ ফোঁটা কানের ভেতরে দিলে এ সমস্যা চলে যায়।


চর্মরোগ সারায়
দেহের কোথাও দাদ হলে বা চুলকানি পাঁচড়া হলে সেখানে ঘষে পান পাতার রস লাগিয়ে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে তা সেরে যায়।


পাইওরিয়া ভালো করে
দাঁতের মাঢ়ি দূষিত হলে সেখানে ফুলে যায় ও পুঁজ হয়, ক্ষত হয়। এক্ষেত্রে পানের রসের সাথে অল্প পানি মিশিয়ে কুলকুলি করলে সেখান থেকে আর পুঁজ পড়ে না, ধীরে ধীরে ক্ষতও শুকিয়ে যায়। মুখগহ্বরে কোনো ক্ষত হলে পানের রসে তার উপশম হয়। পানের রসে এসকরবিক এসিড আছে যা একটি চমৎকার এন্টিঅক্সিডেন্ট। এটা মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।


নখকুনির কষ্ট সারায়
নখকুনিতে নখের কোণায় ব্যথা হয়। এ অবস্থায় সেখানে কয়েক ফোঁটা পানের রস দিলে ব্যথাটা চলে যায়।


আঁচিল দূর করে
আঁচিল হলে সে আঁচিলের ওপর কয়েক দিন পানের রস লাগালে তা ধীরে ধীরে খসে পড়ে ও সেখানে আর আঁচিল তৈরি হয় না।


ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
পান রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে। পানের ডায়াবেটিস প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে।


সর্দি বের করে
বুকের ভেতর কফ/সর্দি বা শ্লেষ্মা জমা হলে তা বের করতে পানের রস কার্যকর। এ ক্ষেত্রে পানের রসের সাথে মধু মিশিয়ে চেটে চেটে কয়েক দিন খেতে হবে। এতে বুকে জমা কফ বেরিয়ে যাবে।


মাথা ব্যথা দূর করে
মাথা ব্যথা হলে কপালে পানের রস লেপে দিলে দ্রুত মাথাব্যথা কমে যায়।


ক্ষত ও ব্যথা সারায়
পানের বেদনানাশক ও ক্ষত সারানোর ক্ষমতা আছে। ক্ষতস্থানে পানের রস লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখলে দুই-চার দিনের মধ্যেই ক্ষতস্থান শুকিয়ে যায়। কোথাও ব্যথা হলে পান পাতা বেটে মলমের মতো সেখানে লেপে দিলে দ্রুত ব্যথা কমে। দেহের ভেতরে কোথাও ব্যথা হলে পানের রস করে পানিতে মিশিয়ে তা শরবতের মতো খেতে হবে। শুধু পান পাতা চিবিয়ে রস খাওয়ার পার পানি খেলেও এ উপকার পাওয়া যায়।


কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
গ্রামের এ এক পুরনো অভ্যাস। বিশেষ করে শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পানের বোঁটা ক্যাস্টর অয়েল বা সরষের তেলে ডুবিয়ে তা মলদ্বারে ঢুকিয়ে ডুস দেয়া হয়। এতে শিশুদের পেটে জমে থাকা মল বেরিয়ে আসে। বড়দের এর সাথে ইসবগুলের ভুসি পানিতে ভিজিয়ে শরবত করে রোগীকে খাওয়ানো হয়, ত্রিফলা ভিজিয়ে সেই পানিও খাওয়ানো হয়। রাতে ১টি পান পাতা কুচি কুচি করে কেটে এক গ্লাস পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে তা ছেঁকে খালি পেটে কয়েক দিন খেলে কোষ্ঠ্যকাঠিন্য চলে যায়। না ভিজিয়ে রাখতে পারলে সকালে পান ছেঁচে রস বের করে তা পানির সাথে মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে।


ঠাণ্ডা লাগা দূর করে
ঠাণ্ডা লাগা সারাতে পান চমৎকার কাজ করে। ঠাণ্ডা লাগলে সর্দি কাশিও হয়। এক্ষেত্রে একটি পানপাতা গরম পানি দিয়ে ছেঁচে রস বের করতে হবে। এ রসের সাথে এক চিমটি গোলমরিচের গুঁড়া ও এক চিমটি আদার গুঁড়া মিশাতে হবে। ভারতে একে বলে কাশ্যম। শিশুদের ক্ষেত্রে ৩ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স হলে এ কাশ্যমের ১ চা চামচ খাওয়াতে হবে, বড়দের ক্ষেত্রে খাওয়াতে হবে ২ চা চামচ। ৩ বছরের নিচে বয়স হলে সেসব শিশুদের এটা খাওয়ানো যাবে না। সেক্ষেত্রে ২ চা চামচ পানের রসের সাথে ১ চা চামচ নারিকেল তেল ও এক টুকরো কর্পুর মিশিয়ে শিশুর বুকে মালিশ করতে হবে। সর্দি-কাশি সারানোর জন্য ২ গ্রাম পান পাতা ও দারচিনি ১১০ মিলিলিটার পানিতে জ্বাল দিয়ে তা নামিয়ে একটু ঠা-া করে রোজ একবার খেতে হবে। এতে ৭ দিনের মধ্যে সর্দি কাশি সেরে যাবে।


ক্ষুধা বৃদ্ধি করে
পাকস্থলী গড়বড় হলে সবই উল্টে যায়। খিদেও লাগে না। পাকস্থলীতে অম্লমান বা পিএইচের মাত্রা স্বাভাবিক না থাকলেই এরূপ হয়। পান তা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে শুধু পান পাতা চিবিয়ে খেলেও ক্ষুধা বাড়ে।


এন্টিসেপটিকের কাজ করে
কোথাও কেটে গেলে দ্রুত সেখানে পানের রস লাগিয়ে দিলে জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে না। পান পাতা পলিফেনল বিশেষত চাভিকল নামক রাসায়নিক উপাদানে পূর্ণ। এটা জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ছাড়া সেখানে ফোলাও বন্ধ করে, ব্যথার উপশম করে। শরীরের যেসব অংশ প্রায় সময়ই ঘামে ভেজা থাকে সেখানে নানা রকম ছত্রাক জন্ম নেয় ও দাদের মতো চর্ম রোগের জন্ম দেয়। পানের রস সেখানে লাগালে তা এন্টিসেপটিকের কাজ করে ও ছত্রাক জীবাণু ধ্বংস করে।


পিঠে ব্যথার উপশম করে
নানা কারণে পিঠে ব্যথা হতে পারে। শোয়া থেকেও হয়। বয়স্কদের এ সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়। মাংসপেশির টান থেকেও এরূপ ব্যথা হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যথা জায়গায় পান পাতার গরম পুলটিস দিয়ে সেঁক দিলে উপকার হয়। এ ছাড়া পান পাতার রসের সাথে নারিকেল তেল মিশিয়ে ব্যথা জায়গায় মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়।


মূত্র স্বল্পতা ও মূত্রকৃচ্ছতার উপশম করে
যাদের কম প্রস্রাব হয় বা প্রস্রাব করতে গেলে কষ্ট হয় তারা পান পাতার রস সেবন করে উপকার পেতে পারেন। এক্ষেত্রে ১টি পান পাতা ছেঁচে রস করতে হবে। সেই রস একটু দুধের সাথে মিশিয়ে পান করলে উপকার হবে। এতে দেহে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়বে ও মূত্রকৃচ্ছতা চলে যাবে।


ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
পান পাতায় আছে চমৎকার এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ও দেহে ক্যান্সার সৃষ্টি প্রতিরোধ করে। এজন্য রোজ ১০-১২টি পান পাতা পানিতে ৫ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। এরপর তা নামিয়ে ছাঁকতে হবে। একটু ঠা-া হলে তাতে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে কুসুম গরম থাকতেই পান করতে হবে। রোজ এটা খেতে পারলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।


মেছতা দূর করে
পান অনেক ধরনের চর্মরোগ ভালো করার ক্ষমতা রাখে। মেছতা, এলার্জি, চুলকানি, দেহে দুর্গন্ধ সৃষ্টি ইত্যাদিও উপশম করতে পারে। এরূপ অবস্থায় ২টি পান পাতা ছেঁচে রস বের করতে হবে। এর সাথে একটু হলুদের গুঁড়া বা কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে মেছতা ও এলার্জির কারণে ফুলে ওঠা জায়গাগুলোতে লাগাতে হবে। এতে এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কয়েক দিনের মধ্যে চলে যাবে। পাতা সিদ্ধ করা পানিটা ফেলে না দিয়ে তা ঠাণ্ডা করে সেই পানি ফেস ওয়াশের মতো ব্যবহার করে মুখম-ল ধুতে পারলে তাতে মুখের অনেক দাগ চলে যায়, মুখে মসৃণতা আসে। দেহে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হলে গোসলের আগে পানপাতার রস তিল, নারিকেল বা সরষের তেলের সাথে মিশিয়ে গায়ে মেখে তারপর গোসল করলে সারা দিন আর গায়ে কোনো দুর্গন্ধ থাকে না, মনও থাকে চনমনে।


শিশুদের পেট ব্যথা কমায়
পেটে ব্যথা হলে ছোট্ট শিশুরা কাঁদতে থাকে। বড় শিশুরা হয়তো বলতে থােক, পেট চেপে ধরে কাতরাতে থাকে। এ অবস্থায় পান পাতার চকচকে পিঠে নারিকেল তেল মাখিয়ে তা গরম করে সেই পাতা পেটের ওপর চেপে ধরে সেঁক দিতে হবে। ৩-৪ মিনিট পর পর এভাবে কয়েকবার সেঁক দিলে পেটে ব্যথা কমে যাবে। খেয়াল রাখতে হবে সেঁকের সময় তাপটা যেন বেশি না হয়।


গলাব্যথা দূর করে
গলাব্যথা হলে খুব সহজেই তা পান পাতা ব্যবহার করে দূর করা যায়। এক্ষেত্রে ১ চা চামচ পান পাতার রস এ গ্লাস গরম পানিতে মিশিয়ে গড়গড়া বা গার্গেল করতে হবে।  


দাঁতে ব্যথা কমায়
দাঁতে ব্যথা হলে ২ কাপ পানিতে ২-৩টি পান পাতা সিদ্ধ করতে হবে। জ্বাল দিতে দিতে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে তা দিয়ে কুলকুলি করতে হবে। এতে দাঁতে ব্যথা কমে যাবে।


পোড়া সারায়
পুড়ে গেলে সেখানে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া হয়। পোড়া জায়গায় পান পাতা বেটে তার সাথে ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে প্রলেপ দিলে যন্ত্রণার উপশম হয় ও সহজে ঘা হতে পারে না।


পানের দোষ গুণ
পান যেমন বলকারক ও একাধিক রোগ নিরাময়কারী তেমনি বলহানিকর ও অস্বাস্থ্যেরও কারণ। যেমন নতুন পান পাতা শ্লেষ্মা বাড়ায়, পুরনো পাতা শ্লেষ্মা দূর করে। পান হজম করে বটে তবে বেশি খেলে অজীর্ণ হয়। পাতার রস বিশেষ ইন্দ্রিয়ের শক্তি বৃদ্ধি করে আবার  বোঁটা ও শিরার রস সেই ইন্দ্রিয়ের শক্তি কমিয়ে দেয়। তাই পানের বোঁটা খাওয়া উচিত নয়। যে কোনো চর্মরোগে পান পাতার রস লাগালে তা দাহ সৃষ্টি করে, আবার পোড়া জায়গায় লাগালে তা প্রশান্তি দেয়। পাতার রস মুখে জড়তা ও অরুচি দূর করে। আবার বেশি খেলে বা রস বাসি হলে ঠিক এগুলোই বেড়ে যায়। পান খাওয়ার পর অনেক খাবারের স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না।


সতর্কতা
যারা রুগ্ন, দুর্বল, ক্ষীণ স্বাস্থ্যের তারা পান খাবেন না। মূর্চ্ছা রোগী, যক্ষ্মা রোগী ও যাদের চোখ উঠেছে তারও পান খাবেন না। অতিরিক্ত নেশার পর পান খাওয়া চলবে না।

 

মৃত্যুঞ্জয় রায়*

*উপ প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা ও উপকূলীয় কৃষি, শাকসবজির রোগ, মশলার চাষ, পাহাড়ি ফসল, শাকসবজি চাষ, ছাদে বাগান বইয়ের লেখক

বিস্তারিত
মাটি পরীক্ষার সুফল এবং মাটিতে খাবার লবণ প্রয়োগের কুফল

বাংলাদেশে পরিবেশের বৈচিত্র্যতা আছে। পরিবেশের এ বিচিত্রতা শুধু অঞ্চলভিত্তিক নয়, এর বিস্তৃতি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়েও বিদ্যমান। ভূমির উত্তম ব্যবহার এবং কৃষির সঠিক পরিকল্পনার জন্য ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এবং ৮৮ উপ-অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই মাটির পুষ্টি উপাদান সব জায়গায় এক রকম নয়। এজন্য মাটি পরীক্ষা করে সার দেয়া উপকারী। আমাদের দেশের চাষাবাদ কৌশল, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং বিভিন্ন পারিপার্শি¦ক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশের মাটিতে পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমছে। আর এ অসুবিধা দূর করার জন্য পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সারের অপচয় রোধ তথা পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় ফসলের চাহিদাভিত্তিক সার প্রয়োগ করতে হবে সাথে সাথে গুঁড়া ইউরিয়া সারের বদলে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা প্রয়োজন। সুষম সার ব্যবহার বলতে বোঝায় মাটির উর্বরতা মান অনুসারে ও ফসলের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ। গাছের পাতার রঙ দেখে সার দেয়া (এলসিসি ব্যবহার) এবং জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করাও প্রয়োজন। সাথে ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মেশানো, ডালজাতীয় ফসলের চাষ করা, সবুজ সার ফসলের চাষ ও জমিতে মেশানো, কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
 

মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার খাওয়া প্রয়োজন তেমনি সব গাছের খাবারের প্রয়োজন হয়। গাছের জন্য যেসব খাবারের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে কিছু গাছ নিজেই তৈরি করতে পারে। বাকিগুলো মূলের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু হতে কার্বন-ডাই অক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। ক্রমাগতহারে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার দেয়া দরকার। কৃত্রিম উপায়ে গাছে যেসব খাবার দেয়া হয় তাকেই গাছের পুষ্টি উপাদান বলে। মাটিতে পুষ্টি উপাদান না দিলে গাছ পুষ্টি পাবে না ও ফসল ভালো হবেনা আর এতে গাছের বাড় বাড়তি কমে যাবে তেমনি বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ হবে। আর পুষ্টি উপাদান জমি থেকে নিঃশেষ হয়ে গেলে পুষ্টি উপাদান পূরণ করা কঠিন হবে। আর ফসলে পুষ্টি ঘাটতি থাকলে তা মানুষ, পশুপাখি সবার পুষ্টি ঘাটতি হবে।


মাটি পরীক্ষার সুফল
মাটিতে পুষ্টি উপাদানের সঠিক অবস্থা জানা থাকলে প্রয়োজন মাফিক সার সরবরাহ করা যায়। অধিক সার প্রয়োগে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকি থাকে। আর কোনো পুষ্টি উপাদান বেশি দিলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় থাকে না ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। বেশি পরিমাণ রাসায়নিক সার দিলে পরিবেশ দূষিত হয় এবং ফলনও কম হয়।


মাটির নমুনা এবং সংগ্রহে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
মাটির নমুনা হলো কোনো জমি থেকে সংগৃহীত কিছু পরিমাণ মাটি যা ওই জমির মাটির গুণাবলির প্রতিনিধিত্ব করে। সাধারণত একখ- জমির কর্ষণ স্তর বা উপরিস্তর থেকে সমদূরত্বে ৯টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। মাটির নমুনা সংগ্রহের যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় তাহলো-কোদাল/খন্তা/নিড়ানি/বেলচা/অগার। এর সাথে প্লাস্টিকের বালতি/গামলা/পলিথিন শিট লাগবে মাটি আনার জন্য। আর লাগবে মোটা পলিব্যাগ ও সুতলি এবং লেবেল বা ট্যাগ।


জমি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহের নিয়ম
জমির চার সীমানা থেকে ২-৩ মিটার বা ৪-৬ হাত ভেতরে সমান্তরালভাবে সমদূরত্ব বজায় রেখে ৯টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
রাস্তা বা বাঁধের পরিত্যক্ত ইটের ভাটা/নিকটবর্তী স্থান/সদ্য সার দেয়া জমি/গোবর বা কম্পোস্ট/আবর্জনা স্তূপকৃত জায়গা/ফসলের নাড়া পোড়ানোর জায়গা থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। উল্লে­খ্য, মাটির এরকম একটি খ-/প্লট হতেই নিতে হবে।


একাধিক খণ্ড/প্লটের মাটির নমুনা পরীক্ষা করাতে হলে প্রতি খ- জমি হতে আলাদাভাবে মাটির মিশ্র নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
মাটি সংগ্রহের আগে জমির এক স্থানে গর্ত করে কর্ষণ স্তরের গভীরতা দেখে নিতে হবে। সাধারণত রোপা ধানের জমিতে কর্ষণ স্তরের নিচে শক্ত ‘কর্ষণ তল’ থাকে। তাই নমুনা সংগ্রহকালে কর্ষণতল বাদ যাবে।


কর্ষণ স্তরের গভীরতা জানার পর জমির আয়তনমতো জমির ৯টি স্থান চিহ্নত করতে হবে।
পরিষ্কার কোদাল বা খন্তা বা যে কোনো খনন যন্ত্রের সাহায্যে কর্ষণ স্তরের গভীরতা পর্যন্ত আকৃতির গর্ত করতে হবে।
গর্তের এক পাশ থেকে ৪ আঙুল পরিমাণ পুরু মাটির চাকা তুলে চাকাটির দুই পাশ এবং কর্ষণ তলের অংশ (যদি থাকে) কেটে বাদ দিয়ে চাকাটি পলিথিন শিটের ওপর কিংবা প্লাস্টিক বালতিতে রাখতে হবে।


একইভাবে ৯টি স্থান থেকে সংগৃহীত একই পরিমাণ মাটি বালতিতে রাখতে হবে।
চাষ দেয়া জমি থেকে মাটি এমনভাবে নিতে হবে যাতে ঢেলাযুক্ত, গুঁড়া কর্ষণ স্তরের সম্পূর্ণ অংশই সমপরিমাণে সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত মাটির নমুনা ভালোভাবে মিশ্রিতকরণ
পরিষ্কার পলিথিন শিট কিংবা বালতিতে রাখা সংগৃহীত মাটির নমুনার চাকাগুলো পরিষ্কার হাতে গুঁড়া করে ভালোভাবে মেশাতে হবে।
মেশানোর সময় মাটিতে ঘাস বা শিকড় থাকলে ফেলে দিতে হবে।
মেশানো মাটি সমান চার ভাগ করে দুইকোন থেকে দুইভাগ ফেলে দিতে হবে। বাকি দুইভাগ মাটি আবার মিশিয়ে তা থেকে ৫০০-৭৫০ গ্রাম পরিমাণ গুঁড়া মাটি পলিথিন ব্যাগে রাখতে হবে।
মাটি ভেজা কিংবা আর্দ্র থাকলে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে নিতে হবে।
ভেজা মাটির ক্ষেত্রে মাটির পরিমাণ এমনভাবে নিতে হবে যাতে শুকালে মাটি মোটামুটি ৫০০ গ্রাম থাকে।
এ ৫০০ গ্রাম পরিমাণ মাটি পরীক্ষার জন্য সংশ্লি­ষ্ঠ উপসহকারী কৃষি অফিসারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে মাটি পরীক্ষার নমুনা পাঠিয়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে।
মাটি পরীক্ষা কোথায় করা যায়
সরকারি ও বেসরকারি প্রায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঢাকা প্রধান অফিসসহ সব আঞ্চলিক অফিসগুলো, ব্র্যাক, প্রশিকা, জিকেএফ এবং বিএফএ। এছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগার রয়েছে।

 

লবণ প্রয়োগের কুফল
ফসলের অধিক ফলনের আশায় অন্যান্য সার ব্যাবহারের পাশাপাশি জমিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করা মোটেও ঠিক নয়। যা ফসল উৎপাদনে কোনো উপকার করে না বরং মারাত্মক ক্ষতি করে। খাওয়ার লবণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন দ্বারা গঠিত মাটিতে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে গেলে মাটিতে বিষাক্ততা দেখা দেয়। খাওয়ার লবণ জমিতে দিলে সাময়িক কিছু ভালো ফলাফল দেখা গেলেও তা জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং জমিকে অনুর্বর করে তোলে। মাটিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করলে যেসব ক্ষতি হয় তা হলো
মাটিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান থাকলেও গাছ তা ব্যবহার করতে পারে না। এটি গাছের জন্য অত্যবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান ফসফরাস ও পটাশিয়ামকে গাছের ব্যবহার উপযোগী হতে দেয় না। অর্থাৎ আমরা টিএসপি বা ডিএপি সার বা এমওপি সার ব্যবহার করলেও লবণ প্রয়োগের জন্য কোনো উপকার পাওয়া যাবে না।


এছাড়া একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারি। সমুদ্রের পানি হচ্ছে লবণাক্ত এটি থেকেই আমরা খাওয়ার লবণ পাই। এ পানির কারণে খুলনা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা জেলার মাঠ ফসলের উৎপাদন উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলের থেকে কম। অর্থাৎ লবণাক্ততা মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয় আর আমরা যদি এ লবণ মাটিতে প্রয়োগ করি তবে আমাদের মাটিও লবণাক্ত হবে এবং ফসল উৎপাদন কমিয়ে দিবে।


এছাড়াও গাছ মাটি থেকে পানি গ্রহণ করতে পারবে না কারণ লবণের সোডিয়াম ও ক্লোরিন গাছের পানি নেয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ অভিশ্রবণ প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে ফসল কম হবে ।
খাওয়ার লবণের কারণে কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যায়। কারণ লবণ মাটিতে ক্ষারীয় অবস্থা সৃষ্টি করে। আর এ কারণে শিকড় দিয়ে গাছ পুষ্টি নিতে পারে না ফলে গাছের রোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যাওয়ার কারণে গাছের শিকড়ের বিস্তার কমে যায় এবং গাছ হলুদ হয়ে যায়।


 মাটির উপকারী অনুজীব নষ্ট হয়, যার ফলে মাটি তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।
খাওয়ার লবণের কারণে গাছের ভেতরের প্রয়োজনীয় রস শিকড় দিয়ে মাটিতে চলে যায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে মারা যায়। কারণ লবণ প্রয়োগ করলে গাছের মধ্যকার রসের ঘনত্বের চেয়ে মাটির মধ্যকার পানির ঘনত্ব বেড়ে যায় ফলে গাছের রস মাটির পানিতে চলে আসে।  


লবণ প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার, টিএসপি সার, দস্তা সার প্রয়োগ করলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাবে না।
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ও ফলন উভয়ে কমে যায়।


এছাড়া খাওয়ার লবণ প্রয়োগের কারণে মাটির গঠন ভেঙে যায়। এবং সঠিক মাত্রায় মাটিতে পানিও বাতাস থাকতে পারে না। আর পানি ও বাতাস পরিমাণমতো না থাকলে গাছের শিকড় সঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না, গাছ সহজে পানি গ্রহণ করতে পারে না।


মাটির গঠন ভেঙে গেলে মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং উৎপাদন বিকল্প প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে প্রথমে লবণ ছোলা প্রয়োগ করলে পটাশ সারের গ্রহণ বৃদ্ধি পায় পরে কমতে কমতে এমন পর্যায়ে যায় যে সার প্রয়োগ করলে ও আর গাছ গ্রহণ করতে পারে না।   

 
মাটি গাছের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে যা গাছের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৫১ সাল থেকে নাইট্রোজেন, ১৯৫৭ সাল থেকে ফসফরাস, ১৯৬০ থেকে পটাশিয়াম, ১৯৮০ সাল থেকে সালফার, ১৯৮২ সাল থেকে দস্তা (জিংক), ১৯৯৫ সাল থেকে বোরন এবং ২০০০ সাল থেকে ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের অভাব পরীলক্ষিত হচ্ছে। গাছে ১৬টি পুষ্টি উপাদানরে মধ্যে ১৩টি মাটি থেকে আসে। দীর্ঘদিন শস্য উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ আর আগের অবস্থায় নেই। এ অবস্থায় মাটির স্বাস্থ্যের জন্য মাটি পরীক্ষা করা এবং জমিতে লবণ প্রয়োগ না করা একান্ত প্রয়োজন।

 

কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী

বিস্তারিত
উত্তরাঞ্চলে খাটো জাতের নারিকেল চাষ

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নারিকেল বেশি উৎপন্ন হলেও উত্তরাঞ্চলে অনেক নারিকেল গাছ দেখা যায়। এসব গাছ থেকে যে সংখ্যক নারিকেল পাওয়া যায় তা জমির ব্যবহারের তুলনায় অনেক কম। এজন্য নারিকেলের জাত চিনে সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে নিয়মিত পরিচর্যা করলে বেশি সংখ্যক নারিকেল পাওয়া সম্ভব যা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে। কারণ নারিকেলের কচি অবস্থায় ডাব এবং  পরিপক্ব অবস্থায় ঝুনা নারিকেলের ব্যবহার প্রায় সারা বছরই হয়ে থাকে। এছাড়াও নারিকেলের প্রায় প্রতিটি অংশই কোনো না কোন কাজে ব্যবহার করা যায়। এর পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সবকিছ্ইু ছোট বড় বিভিন্ন শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, চর্বি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিতে ভরপুর নারিকেলের শাঁস বিভিন্ন পদের মুখরোচক সুস্বাদু খাবার তৈরির উপকরণ হিসেবে অনেকের কাছেই প্রিয়। এছাড়া কচি নারিকেল যা ডাব নামে পরিচিত তার পানি তৃষ্ণা নিবারণে ও রোগীর পথ্য হিসেবেও সমাদৃত। ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম থাকে।


অর্থনৈতিকভাবে নারিকেল একটি  গুরুত্বপূর্ণ ফল হওয়ায় এর বাণিজ্যিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তবে উত্তরাঞ্চলের আবাদি জমিতে বাগান আকারে চাষ না করে যদি বসতবাড়ি, নদী-খাল-বিল ও পুকুরপাড়ে, রাস্তার পাশে, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারদিকে সুবিধাজনক স্থানে এবং আম, লিচু বাগানের পশ্চিম ও উত্তর দিকে বাতাস প্রতিরোধী গাছ হিসেবে  নারিকেল চাষ করা যায় তাহলে যেমন বাড়তি আয়ের সংস্থান হতে পারে তেমনি পরিবেশেরও উন্নয়ন সম্ভব হবে। বিশেষ করে খাল-বিল-নদীর বাঁধে পরিকল্পিতভাবে নারিকেল গাছ লাগালে এগুলোকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।


নারিকেলের সব জাতকে গাছের ধরন অনুযায়ী প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। লম্বা জাতের গাছ ও খাটো জাতের গাছ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে আগে থেকেই লম্বা জাতের নারিকেল চাষ হয়ে আসছে। এগুলো দীর্ঘজীবী, কাণ্ড বেশ লম্বা হয়, প্রায় ৮-১০ বছরের আগে ফুল-ফল ধরে না, পরপরাগায়িত এবং এ গাছগুলো কষ্টসহিষ্ণু ও বেশি মাত্রায় রোগ-পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।


বর্তমানে বাংলাদেশে নারিকেলের তিনটি খাটো জাতের চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জাতের গাছগুলোতে দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ফুল আসে এবং তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ডাব ও ঝুনা নারিকেল সংগ্রহ করা যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ জাতগুলোর চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদেরসহ সব পর্যায়ের জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ যাতে প্রতারিত না হয় সেজন্য শুধুমাত্র হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে খাটো জাতের নারিকেল চারা সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল ডিজে সম্পূর্ণা ডোয়ার্ফ গাছে আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরে ও সংগ্রহ উপযোগী হয়। প্রতিটি গাছে বছরে গড়ে ২৫০টি নারিকেল ধরে। এ জাতটি হাইব্রিড হওয়ায় অর্থাৎ এ জাতের গাছ থেকে যেসব পুষ্ট নারিকেল পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে চারা তৈরি করে আবার রোপণ করা যায় না।


এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে নারিকেলের  দুটি খাটো জাত আনা হয়েছে। সিয়াম-১ এবং সিয়াম-২ নামের দুটো জাত ভিয়েতনাম থেকে সম্প্রতি আনা হয়েছে। এ জাতের গাছগুলো থেকে আড়াই থেকে তিন বছরে ফল পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছে গড়ে ১৫০টি করে নারিকেল ধরে। এ জাতগুলো মুক্ত পরাগায়িত অর্থাৎ এ জাতের গাছ থেকে যেসব পুষ্ট নারিকেল পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে চারা তৈরি করে আবার রোপণ করা যায়।


নারিকেলের জন্য সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ থেকে বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উত্তম। বেশি শীত বা বেশি গরম নারিকেলের জন্য যেমন ভালো নয়, তেমনি বেশি বৃষ্টিও ভালো নয়। রোদ থাকলে নারিকেল গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।


বাগান আকারে নারিকেলের চারা রোপণ বর্গাকার বা ষড়ভূজী পদ্ধতিতে রোপণ করা ভালো। বর্ষার আগে এক পশলা বৃষ্টি হলে মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আষাঢ় বা জুন মাস এবং বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন বা সেপ্টেম্বর মাস নারিকেল চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। একটি চারা থেকে আরেকটি চারা ৬ থেকে বা ১৮ ফুট দূরে দূরে রোপণ করতে হয়। এ হিসাবে প্রতি হেক্টরে ২৭৮টি বা প্রতি বিঘায় ৩৭টি নারিকেল চারা রোপণ করা যায়।


রোপণের আগে ১ মিটার  বা ৩ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট গভীর করে গর্ত তৈরি করে গর্তের মাটির সাথে ১৫  থেকে ২০ কেজি শুকনো পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়। এর সাথে ফুরাডান জাতীয় কীটনাশক ৫০ গ্রাম মিশিয়ে দিলে মাটিতে থাকা পোকার আক্রমণ থেকে চারা গাছকে রক্ষা করা যায়। গর্তে সার মেশানোর সপ্তাহ খানেক পর সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে গর্তের মাঝ বরাবর এমনভাবে মাটি সরিয়ে চারা রোপণ করতে হয়, যাতে নারিকেলের খোসা সংলগ্ন চারার গোড়ার অংশ মাটির ওপরে থাকে এবং গোড়ায় মাটি দিয়ে নিচের দিকে ভালোভাবে চেপে দিতে হয়। এতে চারাটি শক্তভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।  রোপণের পর প্রয়োজনমত পানি দিতে হয়।
প্রথম থেকে তৃতীয় মাস পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করতে হয় এবং বর্ষায় যাতে গোড়ায় পানি না জমে সেজন্য নিকাশের ব্যবস্থা করতে হয়। ২০ দিন পর পর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করাসহ পোকা ও রোগের আক্রমণ রোধে দুই সপ্তাহ পর পর বালাইনাশক স্প্রে  করতে হয়।


চতুর্থ, অষ্টম ও ১২তম মাসে চারা প্রতি ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি ও ১০ কেজি গোবর সার ভালোভাবে গাছের গোড়ার চারদিকের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয় এবং ১৫তম মাসে দ্বিগুণ পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হয়। ১৮তম ও ২১তম মাসে ৬৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ৮৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। সব সময়ই সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয়। ১৮তম মাসে গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম হারে বোরন সার দিতে হয়। ২৪তম মাস বা ২ বছর পর গাছে ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ২০০০ গ্রাম এবং ১১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়।


গরু-ছাগল থেকে চারা গাছকে রক্ষা করতে ঘেরা-বেড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। আশ্বিন মাসে নারিকেলের গাছ পরিষ্কার করতে হলে শুধুমাত্র শুকনো হেলে পড়া শুকনো ডালই ছাঁটাই করতে হয়। কখনোই সবুজ ডাল বা ডালের অংশ কাটা উচিত নয়। পুষ্পমঞ্জরির যে অংশগুলো শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে সহজে উঠে আসে শুধুমাত্র সেগুলোই পরিষ্কার করতে হয়। কখনোই জোর করে বা কাঁচি দিয়ে কেটে গাছ পরিষ্কার করা উচিত নয়। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। একটি বয়স্ক বা ফলন্ত নারিকেল গাছে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০টি ডাল থাকলে সে গাছ সর্বোচ্চ সংখ্যক ফল দিয়ে থাকে। হাইব্রিড জাতে দুই বছর পর এবং মুক্ত পরাগায়িত জাতে আড়াই বছর পর ফুল আসে এবং ফলের বয়স ছয় মাস হলে সেগুলো ডাব হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। আর ফলের বয়স এক বছর হলে ঝুনা নারিকেল হিসেবে গাছ থেকে পাড়তে হয়।


যদি বিশ্বস্ত উৎস থেকে সঠিক জাত সংগ্রহ ও সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে নিয়মিত বিভিন্ন পরিচর্যা সুষ্ঠুভাবে করা যায়, তাহলে রোপণ করা নারিকেলের চারার সুষ্ঠু বাড়-বাড়তি নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত ফলন এবং উত্তরাঞ্চলের অব্যবহৃত জায়গায় নারিকেল চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে মোট ফলদ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

 

কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম*
*উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর

 

বিস্তারিত
উন্নত জাতের গাভী পালন

পরিকল্পিতভাবে গাভী পালন একটা লাভজনক কার্যক্রম অল্প মাঝারি বেশি সব ধরনের পুঁজি দিয়ে সুষ্ঠুভাবে গাভী পালন করলে অনেক লাভবান হওয়া যায়।
গাভী পালনের জন্য ঘরটি মোটামুটি খোলামেলা জায়গায় হতে হবে; বাঁশ, ছন, খড়, পাটখড়ি দিয়ে ঘর নির্মাণ; ঘরের মেঝে ঢালু ও ড্রেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে চোনা ও পানি গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে পারে; খাদ্য ও পানির পাত্রগুলো প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার করা; খাওয়া শেষ হলে পাত্রগুলো ঢেকে রাখতে হবে। গরুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে; প্রতিদিন নিয়মিত গোয়াল ঘরের গোবর-চোনা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট স্থানে বা গর্তে জমা করতে হবে। যা পরবর্তীতে মূল্যবান সারে পরিণত হয়; গরুর গায়ের আঠালি, ডাসা (মাছি), জোঁক অবাঞ্ছিত পোকামাকড় বেছে ফেলতে হবে; গরুর স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে; উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়  থেকে গবাদিপশুকে গোবসন্ত, তরকা, বাদলা, গলাফুলা, ক্ষুরা রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে; গবাদিপশুর রোগ দেখা দিলে প্রাণিচিকিৎসক বা নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
 

উন্নত জাতের গাভী প্রাপ্তি স্থান
মানিকগঞ্জ, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, চিরিরবন্দর, রংপুর সদর, বগুড়া সদর, রাজশাহী সদর, ঢাকা সদর, নারায়ণগঞ্জ সদর, কুমিল্লা সদর, চট্টগ্রাম সদর, সলেট সদর, বাঘাবাড়ীঘাট মিল্কভিটা এলাকা, সাভার এলাকার মুশুরী খোলা, ভার্কুতা, কেরানীগঞ্জ উপজেলার আটি এলাকা উল্লেখযোগ্য।
পালনের জন্য দেশি উন্নত জাতের অথবা সংকর জাতের গাভী নির্বাচন করতে হবে।


দৈনিক সুষম খাদ্য-তালিকা (গ্রাম হিসেবে)
চালের গুঁড়া ২৫০; গমের ভুসি ২৫০; খৈল ২৫০; ডালের ভুসি ২৫০; চিটাগুড় ২০০; লবণ/খনিজ; মিশ্রণ ভিটামিনসহ ৫০ গ্রাম।
এছাড়াও দৈনিক অন্তত ৩ কেজি খড় অথবা ৯-১২ কেজি কাঁচা ঘাস ও প্রচুর পরিমাণে ঠাণ্ডা পরিষ্কার পানি খাওয়াতে হবে।

 

বাছুরের পরিচর্যা
চালের গুঁড়া ৩০০ গ্রাম; গমের ভুসি ৩০০ গ্রাম; খৈল ২৫০ গ্রাম; চিটাগুড় ১৫০ গ্রাম; লবণ ও ভিটামিন ৫০ গ্রাম।
এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে খড়, কাঁচাঘাস ও বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে হবে। ছয় মাস বয়সে বাছুরকে সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। বাছুরকে কৃমির ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ মতে দিতে হবে। স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে সুষম খাদ্য দিতে হবে।

 

প্রাথমিক প্রয়োজন : যে কোনো কিছু গড়তে সবার আগে প্রয়োজন প্রাথমিক প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে যে কোনো কাজের সফলতার ও ব্যর্থতা। ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলতে প্রয়োজন আর্থিক সঙ্গতি, অভিজ্ঞতা ও গরুর নিরাপদ আশ্রয়। প্রথমেই বিশাল ফার্ম তৈরিতে হাত না দিয়ে ছোট পরিসরে কাজে হাত দেয়া ভালো। ৫ থেকে ৬টি গরু নিয়ে যাত্রা করে আস্তে আস্তে ফার্মকে সম্প্রসারণ করাই উত্তম। ২টি গরুর জন্য একজন দক্ষ লোক নিয়োগ করা গেলে ভালো। তবে খেয়াল রাখতে হবে লোকটির গরুর যত্ন নেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কিনা।
 

বাছাই প্রক্রিয়া : নিজ এলাকায় বিশেষ করে মফস্বলে গরুর ফার্ম গড়ে তোলাই শ্রেয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন গরুর উন্নত জাত বাছাই। উন্নত জাতের গরু বাছাই না করলে সারা বছর ফার্মে রোগবালাই লেগে থাকবে। ভালো জাতের গরুর পাশাপাশি ফার্মে পর্যাপ্ত ঘাস, খৈল বিচালির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফার্ম গড়ে তোলার পরপরই দুধ বিক্রির জন্য প্রচারণা চালাতে হবে।
 

স্থান নির্বাচন : যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো এবং দুধ বিক্রির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এসব এলাকার আশপাশেই ডেইরি ফার্ম গড়ে তোলা প্রয়োজন। চারপাশে উঁচু দেয়াল, পরিবেশসম্মত আবাসন, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং গরুর বিশ্রাম ও হাঁটাচলার জন্য জায়গা থাকতে হবে। গরুর ওষুধের দোকান, কাঁচা ঘাসের খামার আশপাশে থাকলে ভালো।


খাবার সরবরাহ : ডেইরি ফার্মের জন্য সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে গরুর খাবারের প্রতি। পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন খাবার না পেলে সঠিক পরিমাণ দুধ পাওয়া যায় না। ধানের কুঁড়া, গমের ভুসি, ছোলা, খেসারির খোসা, লবণ, খৈল, নারিকেলের ছোবড়া, ঘাস-বিচালির পর্যাপ্ত সংগ্রহ রাখতে হবে। অনেক সময় বাসি ও পচা খাবার গরুকে সরবরাহ করা হয়। যা কখনোই ঠিক নয়। এতে করে গরুর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সবসময়ই খেয়াল রাখতে হবে গরুর খাদ্য যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পুষ্টিমান সম্পন্ন হয়। এজন্য পচা বা দীর্ঘদিন রাখা এসব পণ্য গরুকে খাওয়ানো উচিত নয়। গাভীর গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন আলাদাভাবে পরিচর্যা করতে হবে। এ সময় স্থানীয় প্রাণিচিকিৎসকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।


আয়-ব্যয় : ডেইরি ফার্ম একটি দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম। সাথে সাথে লাভের আশা করা ভুল। বরং ধীরে সুস্থে এগুলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে। গড়ে এক একটি গরু কিনতে ৩০-৫০ হাজার টাকা খরচ হবে। এছাড়া যত বেশি গরুর সংখ্যা বাড়বে খরচের খাতও তত কমবে। বর্তমানে শহরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ও কনফেকশনারির লোকজন সরাসরি ফার্মে এসে দুধ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। গড়ে এক একটি গরু থেকে মাসে ৪-৫ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করা সম্ভব। খরচ বাদে এ লাভ একটি পরিবারের জন্য কম নয়।


পরিচর্যা : উন্নত জাতের গাভী ডেইরি ফার্মের জন্য সহায়ক। এক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ান গাভীর জাত বেছে নেয়া যেতে পারে। এজন্য পশু খামারি এবং প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে নিলে ভালো হয়। প্রতিটি গরুর জন্য আলাদা মশারি, ফ্যান, ময়লা পরিষ্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আলোর জন্য লাইটিং এবং পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও নজর দেয়া জরুরি।
 

পশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা : দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় প্রাণিচিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবেও খামারিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য ছাড়াও ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। যুব উন্নয়ন, কৃষি ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকেও প্রশিক্ষিত তরুণরা বিনা জামানতে বেশ মোটা অংকের ঋণ সহায়তা পেতে পারেন। বেকার শিক্ষিত তরুণদের জন্য এটি হতে পারে একটি চমৎকার পেশা। তাই নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হই এবং এরকম ডেইরি ফার্ম করে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হই।


গাভীর দুধের উৎপাদন যেভাবে বাড়ানো যায়
গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান জাতের ওপর নির্ভর করে। গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ দুধের উপাদান যেমন- মাখন, আমিষ, খনিজ পদার্থ সবই বিভিন্ন জাতের গাভীতে কম-বেশি হতে পারে। বংশগত ক্ষমতার কারণে দেশীয় জাতের গাভীর দুধের মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে কিন্তু এরা দুধ উৎপাদন করে কম। সিন্ধি, শাহিওয়াল, হরিয়ানা জাতের গাভীর দুধে মাখন বা ননীর পরিমাণ অন্য বিদেশিয় জাতের গাভী যেমন- হলস্টেন, ফ্রিজিয়ান, জার্সি ইত্যাদি জাতের গাভী সিন্ধি, শাহিওয়াল, হরিয়ানা প্রভৃতি গাভী থেকে বেশি।

 

খাদ্য গাভীর দুধ উৎপাদন ও দুধের গুণগতমানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অধিক পরিমাণ খাদ্য খাওয়ালে বেশি দুধ পাওয়া যায়। তবে খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে। গাভীকে সুষম খাদ্য না খাওয়ালে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং দধের গুণগতমানও কমতে বাধ্য। কারণ খাদ্যে বিদ্যমান উপাদানগুলো ভিন্ন অবস্থায় দুধের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। খাদ্যে দুধের মাখনের উপস্থিতির পরিমাণ কম-বেশি করতে পারে। যে ধরনের খাদ্যের জন্য গাভীর দুধের মাখনের হার কম হতে পারে। তাহলো-


১. মাত্রাতিরিক্ত দানাদার খাদ্য খাওয়ালে; ২. পিলেট জাতীয় খাদ্য খাওয়ালে; ৩. অতিরিক্ত রসালো খাদ্য খাওয়ালে এবং ৪. মিহিভাবে গুঁড়া করা খড় খাওয়ালে।
গাভীর দুধে মাখনের পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে। দুধে খনিজ পদার্থ ও খাদ্যপ্রাণের পরিমাণ গাভীর খাদ্যের মাধ্যমে বাড়ানো যায়। গাভীকে সুষম খাদ্য না দিলে দুধে সামান্য মাত্রায় আমিষ ও শর্করা জাতীয় উপাদান পাওয়া যায় এবং দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। দুধ দোহন বিশেষ করে দোহন কাল, দোহনের সময়, দুধ দোহন প্রক্রিয়া, বিভিন্ন বাঁটের প্রভাব ইত্যাদি গাভীর দুধের পরিমাণ ও মানকে প্রভাবিত করে। গাভীর দুধ দেয়ার পরিমাণ আস্তে আস্তে ৫০ দিনে বেড়ে সর্বোচ্চ হয়। ওলানে দুধের চাপের ওপর দুধের পরিমাণ ও উপাদান নির্ভর করে। দুগ্ধদান কালের ৯০ দিন পর থেকে দুধে মাখন ও আমিষের হার আংশিক বাড়ে। একই গাভীকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দোহন করলে দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। তাই সকালের দুধের চেয়ে বিকালের দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই গাভীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২-৩ বার দোহন করা উচিত। এতে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে পারে।


প্রসবকালে গাভীর সুস্বাস্থ্য আশানুরূপ দুধ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাভী থেকে বেশি দুধ পেতে হলে গর্ভকালে সুষ্ঠু পরিচর্যা ও সুষম খাদ্য দেয়া প্রয়োজন। প্রসবের দুই মাস আগে গাভীর দুধ দোহন অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। মোট দুধ উৎপাদনের ৪০% ওলানের সামনের অংশের বাঁট এবং ৩০% পেছনের অংশের বাঁট থেকে পাওয়া যায়। গাভীর ওলানের বাঁট অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ, বাসস্থান, গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমানের হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। পারিপার্শ্বিক অবস্থা গাভীর জন্য আরামদায়ক হওয়া উচিত। দোহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে অর্থাৎ দুধ দোহন ত্রুটিপূর্ণ হলে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান কমতে পারে।


প্রতিকূল আবহাওয়া দুধ উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। শীত মৌসুম দুধাল গাভীর জন্য আরামদায়ক। এ মৌসুমে দুধ উৎপাদনের এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, গরমকাল, বর্ষাকাল, আর্দ্র আবহাওয়ায় গাভীর দুধের উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যায়। গরমের দিকে গাভীকে ঠা-া অবস্থায় রাখলে উৎপাদনের কোনো ক্ষতি হয় না। গাভীর প্রজননের সময় দুধ উৎপাদন কমে যায়।


দীর্ঘ বিরতিতে বাচ্চা প্রসব করলে গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। স্বল্প বিরতিতে বাচ্চা প্রসবের কারণে দুধ উৎপাদন কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। তাই গাভীকে বাচ্চা প্রসবের ৬০-৯০ দিনের মধ্যে পাল দিতে হবে। কোনোক্রমেই ৬০ দিনের আগে প্রজনন করানো উচিত নয়। গাভীর শরীরে ৫০% এবং দুধে প্রায় ৮৭% পানি থাকে। তাই গাভীকে ইচ্ছামতো পানি পান করার ব্যবস্থা করলে দুধ উৎপাদন বেশি হয় এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে।


গাভীর বড় ওলানের পরিচর্যা
অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভীর দৈহিক আকার যেমন বড় হয় তেমনি বড় হয় তার ওলানও। এসব গাভী যত্নসহকারে পরিচর্যা করতে হয়। উঠা-বসার সময় শেডের কনক্রিটের মেঝেতে ঘষা লেগে ওলানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আর তাতে গোবর বা চোনা লেগে রোগ-জীবাণুর আক্রমণে গাভী অসুস্থ হয়। ওলানে সমস্যা দেখা দিলে দুধ উৎপাদন কমে যায়। ম্যাসটাইটিস রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলে কখনও কখনও ওলানের এক বা একাধিক বাঁট কেটে ফেলতে হয়। তখন দুধ উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে।


ওলানে আঘাতজনিত সমস্যা এড়াতে কনক্রিটের পরিবর্তে বালির মেঝে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত বলে অভিমত দিয়েছে ডেইরি বিজ্ঞানীরা। এ বালির মেঝে তৈরি করতে হবে বিশেষ প্রক্রিয়ায়। প্রায় দেড় মিটার সমপরিমাণ গভীর করে মাটি শেডের মেঝে থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর কমপক্ষে দুইস্তরে বড় বড় টায়ার বসাতে হবে। টায়ারের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে পরিষ্কার বালু। বালু অবশ্যই কাঁকর, ইটের টুকরা, লোহার টুকরা বা অন্যান্য যে কোনো ধারালো বস্তুমুুক্ত হতে হবে। রোগের সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে এ বালু সংগ্রহ করতে হবে।


বালির মেঝে নরম হওয়ায় গাভী উঠে দাঁড়ানো কিংবা বসার সময় কোনো ধরনের আঘাত পাবে না। ওলানের আঘাতজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে। এ মেঝের সুবিধাজনক দিক হচ্ছে গাভীর চোনা সহজেই ঝুরঝুরে বালিতে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া। তবে বালি যেন ভেজা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্য দিনে কমপক্ষে দুইবার গোবর পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সব বালি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন উলটপালট করে দিতে হবে। ওপরের বালি নিচে এবং নিচের বালি ওপরে উঠে এলে রোগ-জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না, রোগ বাসা বাঁধার সুযোগ পাবে না। ছয় মাস পরপর শেডের পুরনো বালি ফেলে দিয়ে নতুন বালি দিতে হবে।
 

এভাবে করলে আমরা কম খরচে লাভজনকভাবে গাভি পালন করা যায়।

 

শেখ সিফাতুল আলম মেহেদী*

*স্বর্ণকুঞ্জ, সদর রোড, খুলনা

বিস্তারিত
মাছ চাষের আধুনিক কৌশল

মাছ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য সম্পদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাছ চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন- একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়, খাল ও ডোবায় মাছ চাষ করা যায়, আবার চৌবাচ্চায়ও মাছের চাষ করা যায়। সাধারণত মাছের জন্য পুকুরে খাবার উৎপাদনই হচ্ছে মাছ চাষ। এটি কৃষির মতোই একটি চাষাবাদ পদ্ধতি। আবার কোনো নির্দিষ্ট জলাশয়ে/জলসীমায় পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প পুঁজি, অল্প সময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের উৎপাদনকে মাছ চাষ বলে। মূলত বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে অধিক মাছ উৎপাদনই মাছ চাষ।
 

চাষ উপযোগী মাছের গুণাগুণ ও উপকারিতা
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। এছাড়া খাড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতে কয়েক শত প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছগুলো হলো- রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, বিদেশি মাগুর, থাই পাঙ্গাশ প্রভৃতি। এসব মাছের কিছু গুণাগুণ আছে-

 

এসব মাছ খুব দ্রুত বাড়ে; খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না; পুকুরে বেশি সংখ্যায় চাষ করা যায়; পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে, তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে; এসব মাছ খেতে খুব সুস্বাদু; বাজারে এসব মাছের প্রচুর চাহিদা আছে; সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।

বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুরকে প্রস্তুত করে নেয়াই ভালো। কারণ একটি পুকুর মাছ চাষের উপযুক্ত না হলে এবং পুকুর প্রস্তুত না করে চাষ শুরু করে দিলে বিনিয়োগ ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ঝুঁকি এড়াতে এবং লভ্যাংশ নিশ্চিত করতেই বৈজ্ঞানিক কৌশল অনুসরণ করে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
 

মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি
১. পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত করা; ২. পাড়ের ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করা; ৩. জলজ আগাছা পরিষ্কার করা; ৪. রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা; ১. পুকুর শুকানো; ২. বার বার জাল টানা; ৩. ওষুধ প্রয়োগ- রোটেনন। পরিমাণ ২৫-৩০ গ্রাম/শতাংশ/ফুট। এর বিষক্রিয়ার মেয়াদ ৭-১০ দিন। প্রয়োগের সময় রোদ্রজ্জ্বল দিনে। ২. ফসটক্সিন/কুইফস/সেলফস ৩ গ্রাম/শতাংশ/ ফুট। মেয়াদ এবং সময় পূর্বের মতো; ৫. চুন প্রয়োগ: কারণ/কাজ/উপকারিতা সাধারণত ১ কেজি চুন/শতাংশ প্রয়োগ করতে যদি ঢ়ঐ এর মান ৭ এর আশেপাশে থাকে। বছরে সাধারণত ২ বার চুন প্রয়োগ করতে হয়। একবার পুকুর তৈরির সময়, দ্বিতীয় বার শীতের শুরুতে কার্র্তিক অগ্রহায়ণ মাসে।

 

চুন প্রয়োগের উপকারিতা ও সাবধানতা
১. পানি পরিষ্কার করা/ঘোলাটে ভাব দূর করা; pH নিয়ন্ত্রণ করে; রোগ জীবাণু ধ্বংস করে; মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; বিষাক্ত গ্যাস দূর করে; শ্যাওলা নিয়ন্ত্রণ করে। চুন কখনও প্লাস্টিকের কিছুতে গোলানো যাবে না; পুকুরে মাছ থাকা অবস্থায় চুন গোলানোর ২ দিন পর পুকুরে দিতে হয়; গোলানোর সময় এবং দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন নাকে মুখে ঢুকে না যায়; পানি নাড়া চাড়া করে দিতে হবে; সার প্রয়োগ : সার প্রয়োগ প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক; জৈব সার/প্রাকৃতিক যা কিনা প্রাণীকণা তৈরি করে। গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, কম্পোস্ট; অজৈব বা রাসায়নিক বা কৃত্রিম সার ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি যা উদ্ভিদ কণা তৈরি করে।

 

নতুন পুকুরের ক্ষেত্রে সার প্রয়োগ মাত্রা
১. প্রতি শতাংশে গোবর ৫-৭ কেজি অথবা ২. হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ৫-৬ কেজি অথবা ৩. কম্পোস্ট ১০-১২ কেজি এবং ইউরিয়া ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি ৫০-৭৫ গ্রাম।

 

পুকুর প্রস্তুতির আনুমানিক মোট সময়
* পাড় ও তলা+ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার = ২ দিন; ক্স রাক্ষুসে মাছ পরিষ্কার = ৩ দিন (৭-১০ দিন পর্যন্ত বিষক্রিয়া থাকে)।
* চুন প্রয়োগ = ৩-৫ দিন; * সার প্রয়োগ = ৭ দিন; এরপর পোনা ছাড়া হবে। গড়ে মোট ১৭ দিন (২+৩+৫+৭)।
পুকুরে চাষযোগ্য মাছের বৈশিষ্ট্য- দ্রুতবর্ধনশীল; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি; বাজার চাহিদা বেশি।

 

পুকুর নির্বাচন
 ১. পুকুরটি খোলামেলা জায়গায় এবং বাড়ির আশপাশে হতে হবে।
২. মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো।
৩. পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০ শতাংশ থেকে ১ একর আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
৪. পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে।
৫. পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপ-ঝাড় থাকা যাবে না।
 

পুকুর প্রস্তুত
পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। সাধারণত পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেয়া হয়। পুকুর প্রস্তুতির কাজটি পর্যায়ক্রমে করতে হবে:
 ১ম ধাপ : জলজ আগাছা-কচুরিপানা, কলমিলতা, হেলেঞ্চা শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে;
 ২য় ধাপ : শোল, গজার, বোয়াল, টাকি রাক্ষুসে মাছ এবং অবাঞ্ছিত মাছ মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলতে হবে;
 ৩য় ধাপ : এরপর প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠা-া করে পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে;
৪র্থ ধাপ : মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে চুন দেয়ার এক সপ্তাহ পর জৈবসার দিতে হবে;
৫ম ধাপ : পুকুর শুকনা হলে পুকুরে সার, চুন, গোবর সব ছিটিয়ে দিয়ে লাঙল দিয়ে চাষ করে পানি ঢুকাতে হবে;
৬ষ্ঠ ধাপ : পোনা মজুদের আগে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে;
৭ম ধাপ : পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুদ করতে হবে। মৃত্যুর হার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সেন্টিমিটার হতে হবে।
 ৮ম ধাপ : এর পর নিয়মমতো পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমনÑ
 ১. পোনা হাড়িতে বা পলিথিন ব্যাগে আনা হলে, পলিথিন ব্যাগটির মুখ খোলার আগে পুকুরের পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে;
২. তারপর ব্যাগের মুখ খুলে অল্প করে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে ভরতে হবে।
৩. ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা যখন সমান হবে তখন পাত্র বা ব্যাগের মুখ আধা পানিতে ডুবিয়ে কাত করে সব পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। সকাল ও বিকালই পোনা ছাড়ার ভালো সময়।
 ৯ম ধাপ : দিনে দুইবার অর্থাৎ সকাল ১০টায় এবং বিকাল ৩টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসি ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
 

সতর্কতা : ১. রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে।
২. সঠিক সংখ্যায় পোনা মজুদ করতে হবে।
৩. পোনা ছাড়ার আগে পোনা রোগে আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুকুরে যাতে আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫. প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।

 

বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য মাছ
দেশি কার্প- রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউশ; বিদেশি কার্প- গ্রাস কার্প, সিল্ভার কার্প, কার্পিও, মিরর কার্প, বিগহেড কার্প ছাড়াও পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, সরপুঁটি/রাজপুঁটি, কৈ, চিংড়ি এসব।
বিভিন্ন স্তরের মাছ একসাথে চাষের আনুপাতিক হার
উপরের স্তর ৪০%; মধ্য স্তর ২৫%; নিম্ন স্তর ২৫%; সর্বস্তর ১০% মোট ১০০%। সাধারণত শতাংশ প্রতি ১৫০টি পোনা ছাড়া যায়। এ হিসাবে ৩০ শতাংশের একটি পুকুরে মোট ৪৫০০টি পোনা ছাড়া যাবে। এবং উপরের স্তরের মাছ থাকবে {(৪০ঢ৪৫০০)/১০০}=১৮০০টি পোনা

 

পুকুরে মাছ চাষ
১. সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে পুকুরের কোনো ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো পরিচর্যা নিতে হয় না।
 ২. আধা-নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছের পোনা ছাড়তে হয়।
 ৩. নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সার ব্যবহার করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
 ৪. কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ : পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বিগহেড, সিলভারকার্প, কমনকার্পসহ প্রজাতির মাছ একত্রে চাষ করা যায়।

 

মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ
১. মাছ প্রক্রিয়াজাতের সময় হাত দিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না; মাছ ধরার পর মাছের আকৃতি অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে; বাক্সে বা পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে মাছ সাজাতে হবে।

 

পরিচর্যা
১. বর্ষার শেষে পুকুরের পানিতে লাল বা সবুজ সর পরলে তা তুলে ফেলতে হবে; পানির সবুজভাব কমে গেলে অবশ্যই পরিমাণমতো সার দিতে হবে; মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের অবস্থা দেখতে হবে; পুকুরে জাল টেনে মাছের ব্যায়াম করাতে হবে।

 

কৃষিবিদ হাসান রিয়াদুল আলম*

*পান্থনীড়, ফেনী

 

বিস্তারিত
ইঁদুর কাটে কাটুস কুটুস

তাইরে নাইরে বন্ধুরে, কুমড়া কাটে ইন্দুরে; তাইরে নাইরে বন্দুরে, কাঁথা কাটে ইন্দুরে; তাইরে নাইরে বন্ধুরে, কাগজ কাটে ইন্দুরে...
 

তাইরে নাইরে... ফারহান ইমতি আনমনে বলেই যাচ্ছে বিরতিহীন ক্যাসেট প্লেয়ারের মতো। থামছে না দেখে বড় বুবু প্রিয়ন্তি ইমতির রুমে এসে বলল- কিরে ইমতি পাগল হয়ে গেছিস নাকি। এসব আবল তাবল কি বকছিস। ইমতি তবুও থামছে না বলেই যাচ্ছে তাইরে নাইরে বন্ধুরে...
 

এবার মেঝ বোন অবন্তি মাকে ডাকতে ডাকতে বলছে মাগো দেখো ইমতি পাগল হয়ে বকবকাচ্ছে। ওমা মাগো চিৎকার শুনে ছোট বোন রূপন্তি আর মা এসে ইমতির রুমে হাজির।


ইমতি এক হেয়ালি যুবক। এসএসসি ভালোভাবে পাস করলে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বিভাগে পাস করার পর আর পড়ালেখায় সংযুক্ত থাকতে চাইল না। অনেক শাসন আদর করে অবশেষে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক পাস করল। এসএসসি পাসের পর টেলিভিশনে এক যুবকের কৃষিতে সাফল্য গাঁথার অনুষ্ঠান দেখে সেই যে মাথা বিগড়ালো আর ঠিক হলো না। গাছের চারা কলম রোপণ, বাগান করা, কলম-নার্সারি করা, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল পালন, কবুতর পালন, কোয়েল পালন, কম্পোস্ট তৈরি এসব করা তার নেশায় পরিণত হলো। প্রথম প্রথম সাংবাদিক বাবা জিএম কবীর ভুঁইয়া ও মা ফেন্সি কবীর নিষেধ করতেন, রাগ করতেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু না হওয়ার কারণে পরিবারের সবাই ইমতিকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর আশা ছেড়ে দিলেন। সঁপে দিলেন কৃষিবিদ আর কৃষি ভুবনের হাতে।


মধ্যবর্তী অবস্থার ভুঁইয়া পরিবারের কোনো কিছুর অভাব না থাকলেও পাগলা ইমতির পাগলামিতে প্রতিদিন, সপ্তাহে, মাসে কিছু কিছু বাড়তি আয় রোজগার আসতে থাকল। তার একটাই কথা বাজার থেকে বিষ কিনে খাব না। সুস্থ সবল দেহ চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। রাজকীয় মরণ চাই। ইমতি বলত তোমাদের বিষমুক্ত শাকসবজি ফলমূল খাওয়াব। প্রথম প্রথম বাড়ির এলাকার সবাই ব্যাপারগুলো তেমন পাত্তাই দিত না। সময়ের ব্যবধানে সবার মাথায় ইমতির পাগলামির ধনাত্মক প্রভাব ও অনুভূতি দারুণভাবে নাড়া দিতে লাগল। এলাকার লোকজন তার এসব দেখে নাম দিল পাগলা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীরা আসলে পাগলই হন। ইমতির আশ্চর্য দিক হলো কখন যে কি করে বসে কি বলে বসে কেউ ধারণাও করতে পারে না। পরবর্তীতে দেখা যায় পাগলামির আশ্চার্যপনার মধ্যেও একটি রহস্যমূলক শুভ সুন্দর সফলতা কল্যাণ লুকায়িত আছে। এসব কারণে এলাকায় তার একটি পাগলা বিজ্ঞানী সহযোগী ও অনুসারী দলও এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে।


আজকের ব্যাপারটি পরিবারের সবাইকে চমকে দিয়েছে। তাইরে নাইরে বন্ধুরে... এর রহস্য কি। রূপন্তি ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল এই ভাইয়া তোর কি হয়েছে। এগুলো কি বলছিস। আবার বুঝি তোর মাথা বিগড়ালো।


-নারে রূপন্তি, রহস্য খুউব রহস্য এত দিন বুঝবার পারি নাই। আইজ সব ফকফকা হইয়া গেল। অহন বুঝি আপুমনির মসলিন শাড়ি টুকরো করা দাদু ভাইয়ার কাশ্মিরী শালের জাল বানানো কৌশল আর তোর এত দামের লেহেঙ্গাকে কেটে কুটে ভুসি বানিয়েছে। এত ক্ষতি কিভাবে কেন করেছে। আর ঠেকাইতে পারব না ইন্দুর মামু। সোনার চান্দু যাইবা কই। তোমারে এবার দলবলসহ সার্জারি করমু খাসি করমু। সব টেকনিক শিক্ষা ফালাইছি কৃষি স্যারগো কাছে।


-কি হয়েছে খুলে বল ছোট ভাইয়া। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
 

-বুঝবি সব বুঝবি। আমার চোখের আন্ধার কাইট্টা গেছে। এবার আর থামাইতে পারবা না। নন্দিরহাটে এতক্ষণ কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাল্টিমিডিয়াতে ইন্দুর ভায়ার কাটুস কুটুস ছবি দেইখ্যা আইলাম। আহ কৃষি তথ্য সার্ভিসকে আমার হাজারো ধন্যবাদ, লাখো সালাম। এমুন একটা জব্বর ছবি বানাইছে। নায়ক নাই নায়িকা নাই কিন্তু দারুণ হিট ছবি। আমার সুযোগ থাকলে অগরে বড় একটা পুরস্কার দিতাম। তয় আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়া আইছি।
-ওই পাগলা সাক্ষী দেস না বৃত্তান্ত কস। খুলে বল শুনি। কি সিনেমা দেখলি। এত মাতাল হইলি কি দেখে অবন্তি ধমকের সুরে বলল।  


-বুবু রাগ কইরো না। অহন কমুনা কাইল্কা সন্ধ্যায় সব বুঝবা সূর্যের লাহান পরিষ্কার হইব আমাগো বাড়ির স্কুলে কাইল্কা সন্ধ্যায় ইন্দুর শো অইবে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের স্যারদের রাজি করাইছি। তোমরা শুধু একটু সামান্য মেজবানদারি করবা। মহিলাদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা অইব। হেডস্যার, চেয়ারম্যান কাকু যুব শক্তি সবাই থাকব। তোমরাও থাকবা। ইন্দুর শো অইব। হাঁ হাঁ হাঁ- তোর পাগলামির শেষ নাই । ইন্দুর আবার নাচবো গাইবো ক্যামনে। -সব রহস্য আজ নয় কাল সন্ধ্যায় বুঝবা তোমরা সবাই।


পর দিন সন্ধ্যায় ভুঁইয়া বাড়ির সামনে স্কুলের মাঠে শত নয়, হাজার লোক ইমতি পাগলার স্বেচ্ছাসেবীর দল সুশৃঙ্খলভাবে দর্শকদের বসাচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার পর সাদা পর্দায় অপারেটর ইয়াকুব পাঠান সাহেব টেস্ট করে ঠিক করে রেখেছেন। তথ্য সার্ভিসের কৃষিবিদ উমা আজাদী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর সিনেমা শুরু হলো।


হ্যামিলনের বংশীওয়ালা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন আর লাখ লাখ ইঁদুর তাকে অনুসরণ করে সাগরের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ ছন্দ পতন। ভরাট কণ্ঠে ভেসে ওঠল। না হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আর পাওয়া যাবে না। আমরাই এদের বংশ নিপাত করব সম্মিলিতভাবে সব পদ্ধতির সমন্বয়ে। আপনি জানেন কি ইঁদুর বছরে আমাদের ক্ষতি করে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনায়াসেই এত বিরাট ক্ষতি থেকে এদেশটাকে বাঁচাতে পারি। শুধু দরকার আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, চাষি, বধূ, মাতা, কন্যা, পুত্র, নেতাকর্মী সবাই মিলে।


আসুন দেখি ইঁদুর আমাদের কি কি ক্ষতি করে
-মাঠ ফসল, গোলার ফসল, আসবাবপত্র, বই খাতা দালান কোঠা, ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট, বাঁধ, জামাকাপড়, ফল, তরিতরকারি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন লাইন, সব জায়গার কেটেকুটে নাস্তানাবুদ করে দেয়। ইঁদুরবাহিত রোগের সংখ্যা ৪০ এর অধিক। রাজঘর থেকে কুঁড়েঘর, রিকশাভ্যান থেকে বিমান সবখানেই ইঁদুরের দৌরাত্ম্য। আমন ফসলের জমিতে প্রতি হেক্টরে ৬০-৬৫টি ইঁদুর থাকে। এরা মাঠে ফসলের ৮-১২%, গুদামজাত ফসলের ৩-৫% নষ্ট করে। প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্য নষ্ট করে তা দিয়ে পৃথিবীর অন্তত ২৫-৩০টি দেশের মানুষ আনায়াসে খেয়ে বাঁচতে পারে।


কারা এসব ক্ষতি করে?
১৭০০ প্রজতির ইঁদুরের মধ্যে ১২ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, খাটো লেজযুক্ত ইঁদুর, ঘরের ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, নরওয়ে বাদামি ইঁদুর, মোলায়েম লোমযুক্ত ইঁদুর, টিকা বা ছুঁচো আরও কত নাম এদের।


-ওমা দেখতে ক্যামন গো এসব। -চুপ কর অবন্তি আগে দেখ বলল প্রিয়ন্তি।
 

ইঁদুর কেন এত ক্ষতি করে?
ইঁদুরের চোয়ালে দুই জোড়া ছেদন দাঁত আছে। যেগুলো সারা জীবন বাড়ে। তাই ছেদন দাঁতকে ছোট রাখতে ইঁদুর দিনরাত কাটাকুটি করে। দাঁত বড় হয়ে এক মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে তারা এমন করে।

 

ইঁদুরের জন্ম বৃদ্ধি কৌশল
একজোড়া দম্পতি ইঁদুর বছরে ২৫০০-৩০০০টি ইঁদুরের একটি কলোনি তৈরি করতে পারে। কেননা, ইঁদুর প্রতি ১৮-২২ দিনে একবার অর্থাৎ বছরে ১৩-১৫ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার ৫-১৬টি বাচ্চা প্রসব করে। একবার বাচ্চা দেয়ার ২৪ ঘণ্টা পর আবার গর্ভধারণ করতে পারে। মাত্র ৯০ দিন বয়সী এটি বাচ্চা ইঁদুর গর্ভধারণ করতে পারে।


আরও শুনবেন ইঁদুর প্রতিদিন তার শরীরের ১০% ওজনের খাদ্য খায় এবং একই পরিমাণ নষ্ট করে। এরা বছরে ৫ লিটার প্রসাব করে। ১৫ হাজার বার পায়খানা করে যার ওজন ২ কেজির কম নয়। পশম ঝরে ৫ লাখের ওপর। লাফিয়ে ১ থেকে ১.৫ মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। ১০ মিটার ওপর থেকে পড়লেও শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। মাটির ১ মিটার গভীরে এবং ৫০ মিটারের বেশি লম্বা গর্ত তৈরি করতে পারে। ইঁদুর খুব চালাক প্রাণী। এদের শ্রবণ, ঘ্রাণ এবং বুদ্ধি শক্তি তীব্র। এরা ২-৫ বছর বাঁচে। একটি ইঁদুর বছরে ৫০ কেজি গোলাজাত ফসল নষ্ট করে আর ২০ কেজির মতো খাবার গর্তে নিয়ে জমা রাখে।
   

 সিনেমা চলাকালে মনু মৃধা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ক্যামনে ওদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ম্যাডাম অফিসার হেসে বললেন, এত ধৈর্য হারালে হবে না। একটু পরেই দেখতে পাবেন। -না আর থেমে থাকা যায় না। এত দিন তো বুঝতাম না। এবার বুঝলাম ক্যামনে এত ক্ষতি হয় বছরের পর বছর ইঁদুরের মাধ্যমে...।
 

দমনের আগে কিছু টিপস
আমাদের এ দেশে গড়ে ৩০-৩৫% কৃষক সক্রিয়ভাবে ইঁদুর দমন করে। কিন্তু শতভাগ নাগরিকের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ইঁদুর দমন সর্বোতভাবে কার্যকর হবে না ইঁদুর নিধনে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন কৌশলের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। তবেই বাজিমাত করা যাবে। যেমন বর্ষাকালে মাঠের সব ইঁদুর বাড়িঘরে, উঁচুস্থানে আশ্রয় নেয়। তখন ইঁদুর নিধন অভিযান বেশ কার্যকর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইঁদুরের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। বিড়াল, পেঁচা, গুঁইসাপ, ঈগল, বনবিড়াল, বাগদাশ, বেজি প্রচুর সংখ্যক ইঁদুর খেয়ে আমাদের উপকার করে। এজন্য এসবের লালন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পুনর্বাসিত করতে হবে। আমাদের দেশের সরকারি, বেসরকারি, নেতাকর্মী ছাত্র, শিক্ষক, সৈনিক, আনসার, ভিডিপি, পুরুষ, মহিলা সবাই মিলে ইঁদুরকে দেশের শত্রু ভাবতে হবে এবং আন্তরিকভাবে ইঁদুর দমনে সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই ইঁদুরের দৌরাত্ম্য কমবে, ক্ষতি কমবে।

 

হুঁ সিনেমার মানুষটা ঠিকই কইছে। সবাই মিল্লা ইন্দুর মারলে কাম অইব। একলা একলা তা অইব না। ভুঁইয়া বাড়ির বৃদ্ধ মুনি হেকিম আলী স্বগতোক্তি করল।
 

এবার শুনি ইঁদুর দমন সম্পর্কে-

আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার ম্যাডাম উমা আজাদী বললো দুইভাবে ইঁদুর দমন করা যায়। রাসায়নিক এবং অরাসায়নিক পদ্ধতি।
 

শুরুতেই অরাসায়নিক পদ্ধতি। ঘর দুয়ার ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ইঁদুর চলাচলের জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে। তা ছাড়া ফাঁদ পেতে, কল পেতে, বাঁশ দিয়ে, ইঁদুরের গর্তে পানি দিয়ে, গর্তে মরিচের ধোঁয়া দিয়ে, গর্ত খুঁড়ে, মাঠে জমির আইল পরিষ্কার রেখে।
 

আর গাছে টিনের পাত বসিয়ে, আঠা লাগিয়েও দমন করা যায়। একটা নতুন পদ্ধতি আছে অনুসরণ করতে পারলে দারুণ কার্যকর হয়। সেটি হলো কোন মতে দু-একটি ইঁদুর কৌশলে ধরে তার পায়খানার রাস্তা ভালোভাবে সেলাই করে ছেড়ে দেয়া। সেলাই করা ইঁদুর তাদের স্বভাব মতো শুধু খাবে। কিন্তু পায়খানা করতে পারবে না। পায়খানা না করতে পেরে সে পাগল হয়ে গিয়ে অন্য ইঁদুরকে কামড়িয়ে মেরে ফেলবে। এভাবেও ইঁদুর ধ্বংস করা যায়।
 

এবার দেখব রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন পদ্ধতি
বিষ প্রয়োগে ইঁদুর দমন করা যায় সহজে। বাজারে জিঙ্ক ফসফাইড সংবলিত বিষটোপ কিনতে পাওয়া যায়। আটা, রুটি, মুড়ি, খই, চালভাজা, চিঁড়া, বিস্কুট, শুঁটকি, এসবের সাথে মিশিয়ে ইঁদুর মারা যায়। বাজারে এখন অনেক কোম্পানির নিবন্ধিত ওষুধ পাওয়া যায়। কোন কিছুর সাথে মেশানো ছাড়াই এগুলো প্রয়োগ করতে হয়। ঘরের কোণে অন্ধকারে, ইঁদুর চলাচলের জায়গায়, অন্যান্য স্থানে সামান্য পরিমাণে রেখে দিতে হয়। ইঁদুর চালাক প্রাণী তাই আস্তে আস্তে খাবে। পরে দূরে গিয়ে মারা যাবে। রাসায়নিক ওষুধের মধ্যে আছে ল্যানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রোমোপয়েন্ট, ক্লেরাট, রেকুমিন, বা জিঙ্ক ফসফাইড সংবলিত যে কোনো ওষুধ অন্তত ৮০% কার্যকর হিসেবে প্রমাণ করেছে। একটি কথা, এসব ওষুধ বাচ্চা, অবুঝ শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী, হাঁস-মুরগির নাগালের বাইরে রাখবেন।

 

শেষ হলো ফিল্ম শো : ইঁদুর কাটে কাটুস কুটুস
প্রিয়ন্তি বুজি, আমাদের ইমতি পাগলা তো ভালোই ম্যানেজ করছে। আমরা তো চিন্তাও করতে পারুম না ইঁদুরের এসব কাজ- কারবার করে। মনে হয় আমাদের দায়িত্ব আছে সবাই মিলে ইঁদুর মারার। এবার শুনছিলাম ইঁদুরের কারণে আন্তর্জাতিক বিমান উড্ডয়নে কত দেরি হয়েছে, সংসদে সমস্যা হয়েছে। তা ছাড়া কয়েক বছর আগে ইঁদুরজনিত প্লেগ রোগের আক্রমণের আতঙ্ক কি মানসিক আর স্নায়ুবিক ঝড়ই না বয়ে গিয়েছিল সারা বাংলাদেশে। অবন্তি ঠিকই বলেছিস আমরা মেয়েরাও এ ব্যাপারে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারি।

 

-বুবু তুমি আমি দুইজনেই স্কুলে চাকরি করি। চল তোমার আমার স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের ইঁদুর নিধনে উদ্বুদ্ধ করি। প্রয়োজনে হেড স্যারকে বলে পরীক্ষায় ইঁদুর দমনের ওপর কিছু নম্বর রাখার ব্যবস্থা করি। তাছাড়া প্রত্যেককে ইঁদুর নিধনের এবং লেজ জমা দেয়ার পুরস্কার হিসেবে স্কুল ব্যাগ, বক্স, চকলেট, পেনসিল, ইরেজার, কলম খাতা, সাপনার, টিফিন বক্স, স্কুলব্যাগ এসব দিতে পারি।
এত টাকা পাবি কোথায়?

 

- কোনো সমস্যা নেই। বাবন ইচ্ছে করলে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করলে নিশ্চয় এ মহৎ কাজে এগিয়ে আসাবেন এবং স্পন্সর করে আমাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করবেন। -প্রিয়ন্তি বুবুু, অবন্তি বুবু, তোমরা কথা বন্ধ কর বললো রুপন্তি। এখন চেয়ারম্যান কাকু, হেড স্যার, সিনেমা অফিসার স্যার কিছু বলবেন। আমাদের পাগলা বিজ্ঞানী তো তারই ব্যবস্থা করছে বোধ করি। -হু, তুই ভালো করে শুন। আমি বাড়ি যাই। মাকে সাহায্য করি। ৩০-৩৫ জন মেহমান খাবেন। মা এতক্ষণ একাকী কত কষ্ট করেছেন। রূপন্তি তুই ইমতির সাথে আসিস আমি আর অবন্তি বাড়ি গেলাম । তুইও তাড়াতাড়ি আসিস। -আচ্ছা তোমরা যাও। আমি ইমতি ভাইয়ার সাথে আসছি।


সিনেমা শেষে কৃষি তথ্য সার্ভিসের টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্টে স্বপ্নীল ইশতি বলল- সুধীম-লী শেষ হলো ইঁদুর বিষয়ক সিনেমা। আশা করি আপনারা অনুধাবন করতে পেরেছেন ইঁদুর আমাদের কি ক্ষতি করে কিভাবে করে। আর এদের এসব ক্ষতির হাত থেকে আমরা ক্যামন করে আমাদের সম্পদ রক্ষা করব। আরেকটা কথা আপনারা সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমন করুন নিজেদের ফসল রক্ষা করুন, দেশকে এত বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করুন। আর মৃত ইঁদুরের লেজ উপজেলা অফিসে জমা দিয়ে জাতীয় পুরস্কারও পেয়ে যাবেন এ কথাগুলো বলেই ইমতি হেড স্যারকে বলল।
 

-স্যার ইঁদুরের সিনেমা তো শেষ হলো এবার আপনি সবার উদ্দেশে কিছু বলুন। -কি বলব সবই তো বলা হয়ে গেছে কৃষি তথ্য সার্ভিসের সিনেমায়। এখন সবাই মিলে কাজে লেগে যাওয়া দরকার। তা ছাড়া আমি কেন বলব। চেয়ারম্যান সাহেব আছেন জনগণের প্রতিনিধি, তোমার বাবা জিএম ভুঁইয়া সাহেব আছেন উনারা বলবেন। -না স্যার আপনি শিক্ষক, আমাদের মুরব্বি, অভিভাবক। আপনাকে আপামর সবাই সম্মান করে। তাই সবাই আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। স্যার আপনিই বলুন।
 

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হেড স্যার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন সম্মানিত এলাকাবাসী আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে। আমার পক্ষ থেকে এবার কথা বলবেন আমার প্রিয় ছাত্র এবং আপনাদের প্রিয় পাগলা বিজ্ঞানী ইমতি ভুঁইয়া। ইমতি থ মেরে গেল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তবুও স্যার যখন দায়িত্ব দিয়েছেন তখন কিছু বলতেই হয়।
 

- সম্মানিত সমাবেশ। আপনারা দেখলেন বুঝলেন ইঁদুর কাহিনী। হ্যামিলন পাব না, তেমন বংশীবাদকও পাবো না। আমাদের সবার সম্মিলিত আন্তরিকতায় আর প্রচেষ্টায় এ গ্রাম এবং এলাকা ইঁদুরমুক্ত করবই এই আমাদের প্রতিশ্রুতি।
 

-এই ইমতি আমার একটি কথা। এলাকাবাসী মনে করে ইমতিই আমাদের নন্দি গ্রামের বংশীবাদক। আমরা তোমার সাথে আছি। যত খরচ লাগবে সহযোগিতা লাগবে আমি দেব বললেন চেয়ারম্যান সাহেব। আর শুনুন আপনারা সবাই মিলে ইমতিকে সাহায্য করবেন। সম্মিলিতভাবে সময় মতো ইঁদুরের বংশ করে দেব ধ্বংস। ইঁদুর মুক্ত ইউনিয়ন করব, ইঁদুরমুক্ত দেশ গড়ব। ইঁদুরের বংশ করে দেব ধ্বংস।

 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
কবিতা (আশ্বিন ১৪২৪)

ইঁদুরের ক্ষতি নেই কোনো গতি
জাহাঙ্গীর সিফাত মেহেদী আলম*

ইঁদুর হলো চালাক প্রাণী ক্ষতি করে বেশি
কিছু আছে বিদেশী জাত কিছু আছে দেশি
মেরুদণ্ডী প্রাণী এরা বাচ্চা দেয় কত
সময় সুযোগে বাড়ে তারা গুণে হাজার শত
তিন বছর বাঁচে এরা তিন মাসেই গর্ভধারণ
ইঁদুর দমনে অভিযান চালাও কেউ করবে না বারণ
কোটি টাকার ফসল নষ্ট আরো কত কিছু
অসাবধানতার ফল এটা সবই বৃথা মিছু
কালো ইঁদুর গেছো ইঁদুর নেংটি ইঁদুরের জাত
ইুঁদর দমনে আছে যত কৌশল আর খাত
বিশেষজ্ঞগণ বলেন তবে কৌশল আছে রাসায়নিক আর অরাসায়নিক
ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সচেতন হবো সবাই দৈনিক
সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর বুদ্ধি কৌশল দিয়ে
সবাই মিলে মারব ইঁদুর যার যেখানে গিয়ে
ক্লের‌্যাট, স্টর্ম, ল্যানির‌্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট, রেকুমিন
জিংক ফসফাইড বিষটোপ কাটুস কুটুসের জম
খাদ্যশস্য গোলাজাতের ক্ষতি করে প্রচুর
১৫ শতাংশ গোলার ফসল নষ্ট করে ধনী কিংবা মজুর
একটি ইঁদুর এক রাতে ২শ’টি গমের কুশি
কেটে সাবাড় করে তারা আনন্দ আহলাদে খুশি
এ কারণে গমের ফলন অনেক যায় কমে
একবার কাটলে ফলন কমে যায় চিন্তা আসে মনে
একটি ইঁদুর এক বছরে ৫০ কেজি শস্য দানা নষ্ট করে
রক্ষা পেতে আমরা সবাই মারব ধরে ধরে
গর্ভকাল ১৯ থেকে ২৩ দিন কি আশ্চার্য কারণ
প্রসবের মাত্র ২ দিনের মধ্যে আবার বাচ্চা ধারণ
স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে এরা ২২৭৭ প্রকার জাতি
এর মধ্যে ২০-১৫ আপদ বলে চিহ্নিত আছে জ্ঞাতি
৫ শ’ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি করে এক বছর এরা
মাঠের ফসল গোলার ফসল ৭২৪ কোটি টাকা সারা
এশিয়ার ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাদ্য এরা নষ্ট করে ভাই
মাঠ ফসল বাড়িঘর আসবাবপত্র কিছু বাকি নাই
সাজসরঞ্জাম মালপত্র শেষ হলে কেমন করে থাকি
কষ্টের ফসল শেষ হয়ে যায় রইল কি আর বাকি
এমন কোনো দেশ নেই এ পৃথিবীর ইঁদুর নষ্ট না করে
ইঁদুরের ক্ষতিবিহীন সেথা নষ্ট ক্ষতির ভাবনা পরে
ইঁদুর যত ক্ষতি করে সারা বছর ধরে
সে ফসল দিয়ে ২০-২৫টি দেশের মানুষের খাদ্য জোগান চলে
ধান গম আলু আনারস কিছুই নেই বাকি
ইঁদুরের অত্যাচারের কবল থেকে বল কোথায় রাখি
ইঁদুর হলো জাতীয় শত্রু রক্ষা নাইরে তার
সবাই মিলে মারব ইঁদুর যার যার ক্ষমতা
দেশের মানুষের ক্ষতি পোষাতে ইঁদুরের যত বংশ
সবাই মিলে একসাথে করে দেবো ধ্বংস...

 

শত্রুর সাথে বন্ধুত্বের কারণ
 মো. আনোয়ার উদ্দিন**

স্বাধীন বাংলায় ঘোরে বেড়ায়
ভিন্ন ভিন্ন জাত।

সর্বময় নাপাক ইঁদুর জাত করে ডাকাতি
নাহি দেয় শান্তিতে খেতে ভাত।

সোনার বাংলায় খাদ্যের উৎস
গম আর ধান।

খাদ্য তালিকায় যাহার কারণ
বাঁচে জাতীয় প্রাণ।

প্রসিদ্ধ নাপাক জাত বলে
মোদের খাদ্য রাখি শুকনো মৌসুমে।

করে গর্ত পাকা ধান
রাখি কৌশলে।

জাতিকে টিকে রাখার তরে
শত্রু দলের সাথে দাওয়াতে বন্ধুত্ব।

কিছু ইঁদুর দমন বক্স, আটা,
জিংক- ফসফেট আর শুঁটকিই বরাদ্দ।

সারা বাংলায় ইঁদুর সম্প্রদায় বৈঠকে-হরতালে
মোরে করিলেও তিরস্কার।

 

*কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। **খানকায়ে কাদেরিয়া হামিদিয়া দরবার শরিফ, ৫৯৩ বড় মগবাজার, ঢাকা

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (আশ্বিন ১৪২৪)

 

মিজানুর রহমান, গ্রাম : খোয়াতপুর, উপজেলা : পাঁচবিবি, জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : ধানের মাজরা পোকার প্রতিকার করব কিভাবে?

উত্তর :  মাজরা পোকা ধান ফসলের একটি ক্ষতিকারক পোকা। তিন ধরনের মাজরা পোকার মধ্যে রয়েছে হলুদ মাজরা, কালো মাথা মাজরা এবং গোলাপি মাজরা। এ পোকার কীড়াগুলো কাণ্ডের ভেতর থেকে খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাছের ডিগ পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। এতে ডিগ পাতা মারা যায়। এ অবস্থাকে মরা ডিগ বা ডেডহার্ট বলা হয়। পোকার আক্রমণ হলে কাণ্ডের মধ্যে কীড়ার উপস্থিতি, খাওয়ার নিদর্শন এবং মল পাওয়া যায়। অথবা কাণ্ডের বাইরের রঙ বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কীড়া বের হওয়ার ছিদ্র পাওয়া যায়। শীষ আসার পর যদি  আক্রমণ করে তাহলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। একে সাদা শীষ, মরা শীষ বা হোয়াইট হেড বলা হয়। মরা ডিগ বা সাদা শীষ টান দিলে সহজেই উঠে আসে। মাজরা পোকা পাতার ওপরের অংশে, পাতার নিচের অংশে এবং পাতার খোলের ভেতরে দিকে ডিম পাড়ে। এ ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেললে ক্ষতি কমানো যায়। থোড় আসার আগ পর্যন্ত হাত জাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়। এছাড়াও ধান ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোর ফাঁদ বসিয়ে এ মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়। ক্ষেতের মধ্যে ডালপালা পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করে দিলে এরা পূর্ণ বয়স্ক মথ খায় ফলে মথের সংখ্যা কমে যায়। পরজীবী বা বন্ধু পোকা মাজরা পোকার ডিম নষ্ট করে কাজেই কীটনাশক প্রয়োগ যতটা সম্ভব বিলম্বিত করতে হবে। জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ মরা শীষ দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন কার্বোফুরান গ্রুপের কীটনাশক ফুরাডান ৫জি বা ব্রিফার ৫জি হেক্টরপ্রতি ১০ কেজি হারে অথবা ডায়াজিনন গ্রুপের কীটনাশক (সার্বিয়ন ৬০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ৩.৪ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। রোগাক্রান্ত জমির আমন ধান কাটার পর চাষ দিয়ে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
 

সিরাজুল ইসলাম, গ্রাম : কেসমত শোলাকিয়া, উপজেলা : বটিয়াঘাটা, জেলা : খুলনা
প্রশ্ন : শিম গাছের জাব পোকার প্রতিকার কি?

উত্তর : জাব পোকা শিমের একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক পোকা। এ পোকা গাছের নতুন ডগা, কচি পাতা প্রভৃতির রস চুষে খায় ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। আক্রমণ বেশি হলে গাছে শুটি মোল্ড ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত গাছ মারা যায়। এ পোকার আক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য জমি সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়। আক্রান্ত অংশ অপসারণ করে ফেলতে হবে। লেডি বার্ড বিটল প্রাকৃতিকভাবে জাব পোকা দমন করতে সহায়তা করে বলে এ বন্ধু পোকা লালন করতে হবে। ডিটারজেন্ট পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করেও আক্রমণ অনেক কমানো যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার এডমায়ার মিশিয়ে শেষ বিকালে স্প্রে করতে হবে।

 

আমিরুল ইসলাম, গ্রাম : বাঁশথুপি, উপজেলা : ক্ষেতলাল, জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : ধান ক্ষেতে ধানের গোছা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং গাছের গেড়া কালো হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার কি?

উত্তর : ক্ষেতে ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। চারা রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এবং বয়স্ক গাছে এ রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা গাছের গোড়া পচে যায়, পাতা নেতিয়ে পড়ে হলুদাভ হয়ে মারা যায়। রোগাক্রান্ত কাণ্ডের গোড়ায় চাপ দিলে আঠালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ বের হয়। বয়স্ক গাছে সাধারণত থোড় অবস্থা থেকে পাতাপোড়া লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর আক্রান্ত হয়ে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত অংশ প্রথমে জলছাপ পরে হলুদাভ হয়ে খড়ের রঙ ধারণ করে। পরবর্তীতে পুরো পাতা মরে শুকিয়ে যায়। আক্রমণপ্রবণ জাতের ক্ষেত্রে দাগগুলো পাতার খোলের নিচ পর্যন্ত যেতে পারে। একসময় সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায় বা পুড়ে খড়ের মতো হয়ে শুকিয়ে যায়। এ রোগ প্রতিহত করার জন্য সহনশীল জাত যেমন- বোরো মৌসুমে বিআর২, বিআর১৪, বিআর১৬ ও ব্রি ধান৪৫, আউশ মৌসুমে বিআর২৬ ও ব্রি ধান২৭ এবং আমন মৌসুমে বিআর৪, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৪৬ চাষ করা যেতে পারে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। চারা ওঠানোর সময় শিকড় যেন কম ছেঁড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোগ দেখা দেয়ার পর ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে ৫-৭ দিন পর আবার পানি দিতে হবে, একই সাথে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত পাঁচ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পটাশ সার এবং থিওভিট প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ধান কাটার পর জমিতে নাড়া ও খড় পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

 

শাহাদাৎ হোসেন, গ্রাম : বানিয়াপাড়া, উপজেলা : কুড়িগ্রাম সদর, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : ধানের ভাসমান বীজতলা কিভাবে তৈরি করব?

উত্তর : বন্যাকবলিত এলাকায় বীজতলা করার মতো জায়গা না থাকলে বা চারা তৈরির প্রয়োজনীয় সময় না থাকলে বন্যার পানি, নদী, বিল, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির ওপর কলার ভেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। এ ক্ষেত্রে কলাগাছ কেটে বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে জোড়া লাগাতে হবে। কলা গাছের ভেলার ওপর হোগলা বা চাটাই দিয়ে সেখানে মাটির প্রলেপ দিতে হবে। এছাড়া বাঁশ এবং বাঁশের চাটাইয়ের মাচা অথবা কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বেডের ওপর ২-৩ সেন্টিমিটার পরিমাণ মাটির পাতলা কাদার প্রলেপ দিয়ে ভেজা বীজতলা তৈরি করা যায়। বন্যার পানিতে যেন ভাসমান বেড ভেসে না যায় সেজন্য ভাসমান বীজতলার বেডকে দড়ির সাহায্যে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে হবে। এরপর মাটির আস্তরণের ওপর অঙ্কুরিত বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। এটি যেন পাখি বা অন্য কিছু নষ্ট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বীজের হার প্রতি বর্গমিটারে ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম হবে। পানিতে ভাসমান থাকার জন্য এ বীজতলায় সাধারণত সেচের দরকার হয় না তবে প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দেয়া যায়। এক বিঘা জমি রোপণের জন্য ৩৫ বর্গমিটার বা প্রায় এক শতক ভাসমান বীজতলা ব্যবহার করা যেতে পারে। চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে চারা উঠিয়ে মাঠে রোপণ করা যাবে। ভাসমান বীজতলায় তৈরি চারা অন্য স্বাভাবিক চারার মতো করেই রোপণ করতে হবে। এর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা ও ফলনও অন্য স্বাভাবিক চারার মতো।

 

মাসুদ রানা, গ্রাম : মাথাভাঙ্গা, উপজেলা : পোরশা, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : আম গাছের নতুন পাতার গোড়া থেকে পোকা কেটে দিচ্ছে। এর প্রতিকার কি?

উত্তর : গাছে আমের পাতা কাটা উইভিল পোকার আক্রমণ হয়েছে। এ পোকা গাছের কচি পাতা কেটে দেয়। আক্রমণের পরিমাণ খুব বেশি হলে গাছে ফল আসে না। এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা অপসারণ করে ফেলতে হবে। নতুন পাতা বের হওয়ার পর ফেনিট্রথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ মাটি ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। বাগানের মাটি মাঝে মাঝে চাষ দিয়ে দিতে হবে। ফল সংগ্রহ শেষে গাছের মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত এবং অতি ঘন ডালপালা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। এরপর একটি ছত্রাকনাশক ও একটি কীটনাশক দিয়ে পুরো গাছ ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

 

ফয়জুল রহমান, গ্রাম : চরপাঢ়া, উপজেলা : নান্দাইল, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : মাছ চাষ করতে চাই, প্রতি শতাংশে কতগুলো মাছের পোনা দেয়া যাবে?

উত্তর : চাষ পদ্ধতি ও মাছের প্রজাতির ওপর পোনার সংখ্যা নির্ভর করে। সাধারণত মিশ্রচাষে ৪০টি (৩/৪ ইঞ্চি সাইজের পোনা) : কাতলা ও সিলভার কার্প ২০টি,  মৃগেল ১০টি, রুই ১০টি। অথবা কার্প ও গলদা চিংড়ি মিশ্রচাষে : কার্প ৪০টি এবং চিংড়ি ১০-১৫টি। আধা নিবিড় পদ্ধতিতে কার্প মিশ্রচাষে : কাতলা ১০টি, সিলভার কার্প ১৫টি, রুই ১০টি, মৃগেল ১০টি, সরপুঁটি ২০টি ও গ্রাসকার্প ২টি। মনোসেক্স তেলাপিয়ার একক চাষে : ২০০-২৫০টি পোনা। থাই কৈ একক চাষে : ৩০০-৩৫০টি পোনা। পাঙ্গাশ মিশ্র চাষে : প্রতি শতকে পাঙ্গাশ ৬০-১০০টি, সিলভারকার্প ২টি, শিং ২০টি, মাগুর ২৫টি।

 

সহিদুল ইসলাম, গ্রাম : কালিকাপুর, উপজেলা : পটুয়াখালী সদর, জেলা : পটুয়াখালী
প্রশ্ন : পানির ওপর লাল স্তর সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে দূর করব?

উত্তর : এগুলো এক ধরনের প্লাংক্টন। এগুলোকে কাপড় দিয়ে টেনে পানি থেকে উঠিয়ে ফেলা ভালো, তাছাড়া পুকুরের পানিতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক যেন পৌঁছাতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ২-৩ বার (১০-১২ দিন পর পর) প্রয়োগ করা যেতে পারে। সুপ্রিয় পাঠক বৃহত্তর কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতিত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।

 

কৃষিবিদ ঊর্মি আহসান*

*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (এলআর), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি (আশ্বিন ১৪২৪)

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে হৈমন্তীয় শুভেচ্ছা। হেমন্তে সোনালি ধানের সম্ভার আর সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। কৃষক ব্যস্ত হয়ে পরে ঘাম ঝরানো সোনালি ফসল কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে আর সাথে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে। কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় যেসব কাজ করতে হবে তা হলো-
 

আমন ধান
আমন ধান পেকে গেলে রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিশিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।

 

গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়।  বেশি ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব, বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮ রোপণ করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।

 

আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেন্টিমিটার থেকে ১২০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।

 

ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১, বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ণ-১ এসব।

 

তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে টরি-৭, রাই-৫, কল্যাণীয়া, সোনালি, সম্পদ, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১০, বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১২, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৭ উল্লেখযোগ্য। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে টরি-৭, বারি সারিষা-৯ বা কল্যাণীয়া টিএস-৭২ রোপণ করুন। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসাম ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।

 

আলু
হালকা প্রকৃতির মাটি বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। ভালো ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো স্টেফি, এলগার, এটলাস, এজিলা. লেডি রোসেটা, কারেজ, এসটেরিক্স, ডুরা, প্রভেন্টো, জারলা, ডায়ামন্ট, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, গ্রানোলা, বিনেলা এসব। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি অলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।

 

মিষ্টিআলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টিআলু ভালো ফলন দেয়। তৃপ্তি, কমলা সুন্দরী, দৌলতপুরী, বারি মিষ্টিআলু-৪, বারি মিষ্টিআলু-৫, বারি মিষ্টিআলু-৬, বারি মিষ্টিআলু-৭, বারি মিষ্টিআলু-৮, বারি মিষ্টিআলু-৯, বারি মিষ্টিআলু-১০, বারি মিষ্টিআলু-১১, বারি মিষ্টিআলু-১২ ও বারি মিষ্টিআলু-১৩ আধুনিক মিষ্টিআলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫ টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।

 

ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এ সময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।

 

শাকসবজি
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশি-বিদেশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে।
এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
তাছাড়া লালশাক, মূলাশাক, গাজর, মটরশুটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।

 

অন্যান্য ফসল
অন্যান্য ফসলের মধ্যে এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কুসুম, জোয়ার এসবের চাষ করা যায়। সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবেও এসবের চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জমিতে পানি কচু বপন করতে পারেন।  সেচ নালা সংস্কার ও মেরামত করতে হবে।

 

প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোলট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে। গবাদিপ্রাণীর আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদিপ্রাণীকে খড়ের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদিপ্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদিপ্রাণীকে বাহিরে না রেখে ঘরের ভেতরে রাখতে হবে। তা নাহলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদিপ্রাণীকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

 

মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশীদ্বারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন। এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।


সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। শুকনো মৌসুম বলে এ সময় মাটিতে রস কম থাকে। তাই ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে আপনার জমির ফলন অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবকয়টি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। কৃষির যে কোনো সমস্যায় ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon