আম এ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। ছোট-বড় সবার পছন্দনীয় এই ফলটির উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। স্বাদ ও জনপ্রিয়তার জন্য আমকে বাংলাদেশে ফলের রাজা বলা হয়। পুষ্টি উপাদান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে অন্য কোনো ফলের সাথে আমের তুলনা হয় না। পাকা আম উচ্চমানসম্পন্ন ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ এবং খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। আম সাধারণত বাংলাদেশের সব এলাকায় আবাদ হয়, তবে উঁচু মান, স্বাদ ও অধিক উৎকৃষ্ট আম চাষের উপযোগী মাটি ও কৃষি জলবায়ুর জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সর্বাধিক আম আবাদ হয়। বর্তমানে কিছু কিছু পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চফলনশীল মানসম্পন্ন আমের চাষাবাদ হচ্ছে। আম ওই এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। বিবিএস, ২০১৭ অনুযায়ী দেশে ৩৭৮৪৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ১১.৬১ লক্ষ মেট্রিক টন তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা অনুযায়ী আম চাষাবাদের এলাকা ও উৎপাদন উভয়ই বেশি। তাদের মতে, ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয় এবং এর উৎপাদন ২১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৪০৩ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ৩.০ লক্ষ মেট্রিক টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে ২৩টি জেলায়। অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় নতুন নতুন জেলায় আম বাগান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিভিন্ন জেলায় আমের বর্তমান অবস্থা ভিন্ন ধরনের। কোনো জেলায় আম এখন মার্বেল আকারের, কোথাও আবার মটরদানাকৃতি আবার কোথাও কেবল গুটিবাঁধা সম্পন্ন হয়েছে। ভালোমানের আম উৎপাদনে ব্যবস্থা নিতে হবে এখন থেকেই। আমের গুটি বাঁধা সম্পন্ন হলেই একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার করতে হবে। মেঘমুক্ত ও রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে স্প্রে করলে তা বেশি কার্যকর হয়। তবে স্প্রে হতে সবচেয়ে বেশি সুফল পেতে সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে কোনো কোনো আম উৎপাদনকারী এলাকায় আম উৎপাদনে ককটেলের ব্যবহার করে থাকেন। ককটেল বলতে একাধিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও হরমোনের একত্রে নিম্নমাত্রার ব্যবহারকে বুঝানো হয়েছে। তাদের মতে, একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক কোনো একটি রোগ ও পোকামাকড় দমনে যথেষ্ট নয়। যদিও সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, এই ককটেল কখনও কার্যকরী হতে পারে না। তাদের মতে, যে কোনো বালাইনাশক যদি পরিমিত মাত্রায় কার্যকরী উপাদান থাকে এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় তাহলে নির্দিষ্ট বালাইনাশক নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট। এখন থেকে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত আমবাগানে বহুবার বালাইনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। আমের বৃদ্ধিকালীন বর্ষাকাল হওয়ায় বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। আর এসবের আক্রমণ থেকে আমকে রক্ষা করেতে বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়, যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। এখন সবার প্রচেষ্টা কিভাবে সবচেয়ে কম বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালোমানের আম উৎপাদন করা যায়। প্রথমেই যেটি আসে তা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা। আমবাগান সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। প্রতি বছর মরা ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে প্রুনিং ও ট্রেনিং করতে হবে। আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতিটি আমের মাছি পোকা দমনে বেশ কার্যকর। তবে সবাই মিলে একত্রে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়। সবশেষে বালাইনাশকের ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টিবহুল দেশে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো ততটা কার্যকর নয় ফলে চাষিরা বালাইনাশকের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। তবে বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কর্তৃক উদ্ভাবিত ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ভালোমানের আম উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। ধারাবাহিকভাবে সুফল পাওয়ায় এই প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যেই সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মাঠপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন করতে গিয়ে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোগ, পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সমস্যা। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই সব সমস্যাকে সমাধান করা যায়। ফ্রুট ব্যাগিং বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ ধরনের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায় এবং এর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকবে ব্যাগটি। এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রঙ এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের ব্যাগ এবং অন্য সব আমের জন্য দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ। বর্তমানে আমচাষিরা দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করছেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলসমূহ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।
ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময়
আমের প্রাকৃতিকভাবে ঝরা বন্ধ হলেই ব্যাগিং শুরু করতে হবে। তবে বারি আম-১, গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, বারি আম-৬ এবং বারি আম-৭ জাতের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৫৫ দিন বয়সে। এই সময়ে আম জাতভেদে মার্বেল আকার বা এর চেয়ে আকারে বড় হয়ে থাকে। তবে বারি আম-৩, ৪, ৮, ফজলি, হাঁড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা এবং গৌড়মতি আমের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৬৫ দিন হলেও ব্যাগিং করা যাবে। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে শুধু ফলে স্প্রে করতে হবে। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়। আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। যেমন-প্রথমবার আমগাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন আগে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি. লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফুটবে না এবং আম যখন মটর দানার মতো হবে তখন একবার। সুতরাং এর পরপরই আমে স্প্রে করে ব্যাগিং করার পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
যেসব এলাকায় আম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় না বা শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা পূরণে আমগাছ লাগানো হয়েছে এবং এসব গাছে সময়মতো স্প্রে করা হয় না বা সেই ধরনের প্রচলন এখনও এলাকায় চালু হয়নি ফলে প্রতি বছরই তাদের গাছে আম ধরে কিন্তু পোকা ও রোগের কারণে অধিকাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। এসব আমগাছে এই প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকর। এ ছাড়াও যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় এবং আম দেরিতে পাকে সেসব আমের জাত বিবর্ণ বা কালো রঙ ধারণ করতে দেখা যায় এবং মাছি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় নাবী জাত আশ্বিনাতে ১০০ ভাগ আমের মাছি পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়। যে সব বাগানে ঘন করে আম লাগানো হয়েছে এবং বর্তমানে গাছের ভেতরে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সে সব গাছে আমের মাছি পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাছি পোকা দমনের জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বা প্রচলিত আছে কোনোটিতেই এই মাছি পোকাকে শতভাগ দমন করা সম্ভব নয় বরং আক্রমণের হার কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়। আম রপ্তানির জন্য ভালো মানসম্পন্ন, রঙিন ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত আম প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে এই তিন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন আম রপ্তানিকারক দেশে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি দ্বারা সবচেয়ে কম পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহার করে ১০০% রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়াও ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের পর ১০-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়। সেই সাথে রঙিন, ভালো মানসম্পন্ন নিরাপদ আমও পাওয়া যায়। ব্যাগিং প্রযুক্তি হতে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করতে হবে। ব্যাগিং করার আগে আমগুলো কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে। ব্যাগিং করার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা আগে স্প্রে করতে হবে। তবে স্প্রে করার পরের দিনও ব্যাগিং করা যাবে যদি বৃষ্টিপাত না হয়। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা উচিত নয়। সঠিক নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে যে সব চাষি ব্যাগিং করছেন তারা বেশ ভালো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য এটি একটি সহজ ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছে।
আম বাগানে সেচ প্রয়োগ
ভালোমানের আম উৎপাদনে সেচের বিকল্প নেই। আমগাছে মুকুল আসার আগে সেচ না দেয়া উত্তম তবে মুকুল আসার পর সেচ দিতে তেমন বাধা নেই। তবে আমগাছে গুটিবাঁধার পর একটি নির্দিষ্ট ব্যবধানে সেচ প্রয়োগ করতে হবে। মাটির অবস্থা বুঝে মাসে এক থেকে দুইবার সেচ প্রয়োগ করলেই হয়। তবে অনেক আম উৎপাদনকারী দেশে জলীয় বাস্প আকারে আমগাছে পানি দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে একটি আমবাগানে মাসে ৩-৪ বার পানি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সেচের পানিও কম ব্যবহার হয়। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার জন্য প্রযুক্তিটি অত্যন্ত কার্যকর।
পরিশেষে, নিরাপদ, বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত আমের উৎপাদন বৃদ্ধি হোক এটি সবার প্রত্যাশা। আমাদের আমচাষিরা ভালোমানের গুণগতমানসম্পন্ন আম উৎপাদনে উপরোক্ত বিষয়সমূহ ভালোভাবে অনুসরণ করবেন তাহলেই ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হবে।
ড. মো. শরফ উদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আকবরপুর, মৌলভীবাজার, মোবা : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল :sorofu@yahoo.com
বাংলাদেশে তিন মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়- আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৯-১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের উৎপাদন করা হয়। যেহেতু আউশ ধানের আবাদ বৃষ্টি নির্ভর, সেহেতু এ ধান উৎপাদনের সেচ খরচ সাশ্রয় হয়। তাছাড়া উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান চাষ করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় আউশ ধানের চাষাবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান করছে। এতে অধিক সংখ্যক কৃষক আউশ ধান চাষে উৎসাহী হবেন বলে আশা করা যায়।
মৌসুম ও জাত
আউশ ধানের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫-৩০ চৈত্র (৩০মার্চ-১৫ এপ্রিল)। রোপা আউশের উফশী জাত হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৮২ ও ব্রি ধান৮৫ এবং বোনা আউশের উফশী জাত হিসেবে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৮৩ আবাদ করা যায়।
বীজতলা
দোঁ-আশ ও এঁটেল মাটি বীজতলার জন্য ভালো। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। যদি অনুর্বর হয় তাহলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১.০০-১.৫ কেজি হারে জৈবসার ছড়িয়ে দিতে হবে এর পর ৫-৬ সেমি. পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে এবং পানি ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে। আগাছা, খড় পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ৪০-৫০ সেমি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার বেডে ৮০-১০০ গ্রাম অঙ্কুরিত বীজ সমানভাবে বুনে দিতে হবে। জাতভেদে বীজের হার ৪০-৫০ কেজি/হেক্টর।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি চাষ ও মই দিতে হবে, যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। জমি উঁচু-নিচু থাকলে সমান করে দিতে হবে। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করুন। রোপা আউশে হেক্টরপ্রতি ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৫৫ কেজি টিএসপি, ৬ কেজি এমওপি এবং বোনা আউশে ১২০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করুন। টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করা হলে টিএসপি সারের সমপরিমাণ ডিএপি সার ব্যবহার করে প্রতি কেজি ডিএপি সার ব্যবহারের জন্য ৪০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া কম ব্যবহার করতে হবে। মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সার ব্যবহার করা উত্তম। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে (প্রথম কিস্তি জমি শেষ চাষের সময়, দ্বিতীয় কিস্তি চারা রোপণের ১৫ দিন পর, তৃতীয় কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে) এবং অন্যান্য সার জমি শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে ফলন বাড়ে এবং সারের কার্যকারিতা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। গুটি ইউরিয়া প্রতি চার গোছার মাঝখানে একটি করে প্রয়োগ করতে হয়। আউশ ধানের ১.৮ গ্রাম ওজনের গুটি ব্যবহার করুন। গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে আউশ মৌসুমে প্রতি হেক্টরে ৬৫ কেজি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়।
চারা রোপণ
সাধারণভাবে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। ১ হেক্টর জমিতে ৮-১০ কেজি বীজের চারা লাগে। সারিতে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. হবে।
পরিচর্যা
আউশের জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে প্রয়োজনে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করে ২-৩টি নিড়ানি দিতে হবে। অনুমোদিত আগাছানাশক ব্যবহার করেও আগাছা দমন করা যায়। জমিতে রসের অভাব হলে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০-১২ দিন ছিপছিপে পানি রাখতে হবে, যাতে নতুন শিকড় গজাতে পারে, এর পর কম পানি রাখলেও চলবে। সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে রোপা আউশের জমিতে ৮-১০ ফুট দূরে দূরে ধৈঞ্চার চারা রোপণ করতে হবে অথবা কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি/গাছের ডাল পুঁতে দিতে হবে। বাদামি গাছফড়িং দমনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। ধানের নিবিড় চাষাবাদের কারণে ফসলের পেকার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। এসব পোকার মধ্যে রয়েছে- মাজরা পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধী পোকা, লেদা পোকা, চুঙ্গি পোকা, ঘাসফড়িং, ছাত্রা পোকা, থ্রিপস্ ইত্যাদি। দশটি প্রধান রোগ ধানের ক্ষতি করে। এগুলো হচ্ছেÑ টুংরো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া, উফরা, ব্লাস্ট, খোলপোড়া, বাকানি, বাদামি রোগ ইত্যাদি। এসব পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনে সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ধানের ফলন বৃদ্ধি হবে এবং প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করতে হবে।
ফসল কর্তন
শতকরা আশি ভাগ ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। কাটা ধান স্তূপ না করে দ্রুত মাড়াইয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। খাবার ধান যথাসম্ভব শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ ধান ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে ১২% আর্দ্রতায় বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আউশ ধান কাটার উপযুক্ত সময় ১৫ শ্রাবণ-২০ ভাদ্র (৩০জুলাই- ৪ সেপ্টেম্বর)।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। এজন্য যে জমির ধান ভালোভাবে পেকেছে, রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সেসব জমির ধান বীজ হিসেবে রাখা। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় (ড়ভভ-ঃুঢ়ব) গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। যেসব গাছের আকার-আকৃতি, শিষের ধরন, ধানের আকার-আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং ধান পাকার সময় জমির আিধকাংশ গাছ থেকে একটু আলাদা সেগুলোই বিজাতীয় গাছ। সব রোগাক্রান্ত গাছও অপসারণ করতে হবে। এরপর ফসল কেটে মাঠে শুকনো স্থানে রাখতে হবে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে। বীজ ধান মজুদের সময় যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো-
* রোদে ৫-৬ দিন ভালোভাবে শুকানো যাতে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে। পুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দুইবার ঝেড়ে নেওয়া যেতে পারে।
* বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখতে হবে। বীজ রাখার জন্য প্লাস্টিকের ড্রাম উত্তম তবে বায়ুরোধী মাটি বা টিনের পাত্রে রাখা যায়। মাটি মটকা বা কলসে বীজ রাখলে গায়ে দুইবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকানো। আর্দ্রতা রোধক মোটা পলিথিনেরও বীজ মজুদ করা যেতে পারে।
* রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরা। পুরো পাত্রটি বীজ দিয়ে ভরে রাখা। যদি বীজে পাত্র না ভরে তাহলে বীজের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করা।
* পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। এবার এমন জায়গায় রাখা যেন পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে।
* টনপ্রতি ধানে ৩.২৫ কেজি নিম, নিশিন্দা বা বিষকাালি পাতার গুঁড়া মিশিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না। বীজের ক্ষেত্রে ন্যাপথলিন বল ব্যবহার করা যায় তবে অবশ্যই বীজ ধান প্লাস্টিক ড্রামে সংরক্ষণ করতে হবে।
মাহমুদ হোসেন
সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অব.) বিএডিসি; মোবাইল : ০১৮৩৭৩৫৩৯৭০ ই-মেইল : mahmood1945bd@gmail.com
পাট উৎপাদনে জমি নির্বাচন থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিচর্যা সময়মতো সম্পন্ন করতে হয়। পাটের ভালো ফলনের জন্য সার, পানি, আগাছা ও ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সার ব্যবস্থাপনা : সারের সঠিক মাত্রা নির্ধারণের জন্য মাটির উর্বরতা শক্তি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জমিতে কোন সার কতটুকু প্রয়োজন তা সঠিকভাবে জানা যায়। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাটের জমিতে সুষম সার প্রয়োগ করলে সাধারণ ফলনের চেয়ে একরপ্রতি ১০.৫ মণ বা বিঘাপ্রতি ৩.৫ মণ বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।
পাট ফসলে ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে এবং অন্যান্য সার এক কিস্তিতে জমি তৈরির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। জমিতে গোবর সার ব্যবহার না করলে দেশি পাটে শেষ চাষের সময় একরপ্রতি ৩৩ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং ৪.৫ কেজি জিংক সালফেট ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে বীজ বপন করতে হবে। একইভাবে তোষা পাটে একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ২১ কেজি টিএসপি, ২৪ কেজি এমওপি, ৩৮ কেজি জিপসাম এবং ৪.৫ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করে জমি তৈরি করতে হবে। পাট ফসলের বয়স ৪০-৪৫ দিন পর ২য় কিস্তির ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। উপরিপ্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হয় যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগের আগে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। উপরিপ্রয়োগকৃত ইউরিয়া যেন গাছের কচিপাতা বা ডগায় লেগে না থাকে সেজন্য সার ছিটানোর পর পাট কাঠি অথবা অন্য কিছু দিয়ে পাতায় বা ডগায় লেগে থাকা সার সরিয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য, প্রখর রৌদ্র বা বৃষ্টির সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ না করাই ভালো।
জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে গোবর সার প্রয়োগ করে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি একর জমিতে ৪৫-৬০ মণ গোবর সার ব্যবহার করলে দেশি পাটে শেষ চাষের সময় একরপ্রতি শুধু ১২ কেজি ইউরিয়া এবং তোষা পাটে ১৮ কেজি ইউরিয়া, ৪.৫ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে ২য় কিস্তিতে ইউরিয়া দেশি পাটে একরপ্রতি ৩৩ কেজি এবং তোষা পাটে ৪০ কেজি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা : বৃষ্টি না হলে জমিতে জোঁ অবস্থা আনার জন্য অনেক সময় হালকা সেচের প্রয়োজন হয়। পাট বৃষ্টিনির্ভর ফসল হওয়ায় পরবর্তীতে আর সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নালা কেটে জমিতে জমা পানি বের করে দিতে হবে। কেননা পাট ফসল দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া পাটের জমিতে অতিরিক্ত রস থাকলে আগাছার প্রকোপ বেড়ে যায়, ফলে নিড়ানির খরচ বেশি হয়। আবার প্রচ- খরা দেখা দিলে জমিতে হালকাভাবে সেচ দেয়া প্রয়োজন। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে প্রয়োগকৃত সার পাটগাছ ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারে না। ফলে ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সেচের পর জোঁ অবস্থা বুঝে নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হয়। এতে জমিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত রস জমা থাকে এবং পাট গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
আগাছা ব্যবস্থাপনা : আগাছা যেকোনো ফসলের চরম শত্রু। আগাছা পাট ফসলের খাদ্যে ভাগ বসায়, সেজন্য ইহা মাটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। ফলে ফসলের বৃদ্ধি দারুণভাবে ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যায়। বাংলাদেশের এলাকাভেদে প্রায় ১৩০ প্রজাতির আগাছা জন্মাতে দেখা যায়। এদের মধ্যে ২৭টি প্রজাতি আগাছা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ৭টি প্রজাতি পাট ফসলের বেশি ক্ষতি করে। এজন্য পাট ফসল বপনের আগেই জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে সময়মতো দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। সময়মতো আগাছা দমন না করা হলে নিড়ির খরচ অনেক বেড়ে যায়। পাটের আবাদে যে খরচ হয় তার একটি বড় অংশই নিড়ানির জন্য হয়ে থাকে। শস্য বিন্যাসে পরিবর্তন করেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন আলুর জমিতে পাট চাষ করলে নিড়ানির খরচ অনেক কমে যায়। পাট ফসল বপনের ৩০ দিনের মধ্যে চারা কিছুটা পাতলা করে ১ম নিড়ানির দিতে পারলে আগাছার প্রকোপ অনেক কম হয় এবং গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। তবে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে অবশ্যই প্রথম নিড়ানির কাজ শেষ করতে হবে। পরবর্তীতে আগাছার মাত্রা বুঝে ৭০-৮০ দিনের মধ্যে ২য় নিড়ানির দিতে হবে। মোট কথা পাট ফসলে সময়মতো আগাছা দমন করা খুবই গুরুত্বর্পূণ।
পাট মূলত গ্রীষ্মকালীন ফসল। এ সময় পরিবেশের তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে। এই আবহাওয়ার কারণে পাট ফসলে বিভিন্ন রকম রোগ দেখা দেয়। প্রতি বছর নানা ধরনের রোগের আক্রমণে পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। ক্ষতির পরিমাণ শতকরা ২০-৪০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। মূলত ছত্রাক, ভাইরাস ও কৃমিকীট দ্বারা রোগগুলো সৃষ্টি হয়। সময়মতো রোগ নির্ণয় ও দমনের ব্যবস্থা করে পাটকে রক্ষা করা যেতে পারে।
এ পর্যায়ে পাটের বিভিন্ন রোগ নিয়ে আলোচনা করব।
চারা-মড়ক : বীজ বপনের পর প্রথম অবস্থায় যে রোগ দেখা দেয় তা হচ্ছে চারা মড়ক। পাট গাছে যখন ১ ইঞ্চি থেকে ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা হয় তখন এ রোগ দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত চারার গোড়ায় কালো দাগ ধরে চারা মারা যায়। এটি এক ধরনের ছত্রাকবাহিত রোগ। জমিতে এ রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিলে ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম মিশিয়ে চারা গাছে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া পটাশ সার জমিতে প্রয়োগ করে ভালোভাবে জমি নিড়িয়ে দিলে রোগ কম হয়। জমি যেন ভেজা স্যাঁতসেঁতে ও পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঢলে পড়া রোগ : এ রোগে গোটা গাছ ঢলে পড়ে ও মরে যায়। ছোট ও বড় উভয় অবস্থায় পাটগাছ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ফুল আসার সময় থেকে তোষা পাটে এ রোগ বেশি হয়। আক্রান্ত জমিতে পানি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। গাছের গোড়া পরিষ্কার রাখতে হবে। আক্রান্ত ক্ষেতে ২-৩ বছর তোষা পাটের পরিবর্তে দেশি পাটের আবাদ করা যেতে পারে।
কাণ্ড পচা রোগ : পাটের সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হলো কাণ্ড পচা রোগ। এ রোগের কারণে শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে। এটি একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। চারা যখন ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা হয় তখন থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স পর্যন্ত পাটগাছ এ রোগে আক্রান্ত হয়। গাছের পাতা ও কা-ে গাঢ় বাদামি রঙের দাগ দেখা দেয়। এ দাগ গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত যেকোনো অংশে দেখা দিতে পারে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দাগি জায়গাগুলোতে অসংখ্য কালো বিন্দু দেখা যায়। এ কালো বিন্দুগুলোতে ছত্রাক জীবাণু থাকে। এরা বাতাসে বা বৃষ্টির পানির মাধ্যমে আশপাশের গাছে সংক্রমিত হয়। কখনো আক্রান্ত স্থানে গোটা গাছই ভেঙে পড়ে।
কালো পট্টি রোগ : কালো পট্টি রোগের লক্ষণ প্রায় কাণ্ড পচা রোগের মতোই। তবে এতে কাণ্ডে কালো রঙের বেষ্টনীর মতো দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থানে ঘষলে হাতে কালো গুঁড়ার মতো দাগ লাগে। সাধারণত গাছের মাঝামাঝি বয়স থেকে এ রোগ বেশি দেখা যায়।
শুকনা ক্ষত রোগ : এ শুধু দেশি পাটে দেখা যায়। চারা অবস্থায় এ রোগ চারা মড়কের সৃষ্টি করে। বড় গাছের কাণ্ডে কালচে দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থান ফেটে যায়। এ রোগে আক্রান্ত গাছ মরে না, তবে আক্রান্ত অংশ শক্ত হয়। তাই পাট পচানোর পরেও আক্রান্ত স্থানের ছাল পাটকাঠির সাথে লেগে থাকে। এর ফলে আশ নিম্নমানের হয়।
কাণ্ড পচা, শুকনা-ক্ষত ও কালো পট্টি এ তিনটি রোগই বীজ, মাটি ও বায়ুবাহী। তাই এদের প্রতিকারের ব্যবস্থাও একই রকমের।
১. পাট কাটার পর জমির আগাছা আবর্জনা ও পরিত্যক্ত গাছের গোড়া উপড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করতে হবে। বীজ শোধনের জন্য ভিটাভ্যাক্স-২০০ (প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম) এর ব্যবহার যথেষ্ট সুফল দেয়। এ ছাড়া কাঁচা রসুন বাটা দ্বারা বীজ শোধন করা যায়। সেক্ষেত্রে ১২৫ গ্রাম বাটা রসুন ১ কেজি পাটবীজে মিশিয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শোধন করা সম্ভব না হলে বপনের আগে বীজ কড়া রোদে শুকাতে হবে।
৩. জমিতে চারা অবস্থা থেকে শুরু করে পূর্ণ অবস্থা পর্যন্ত যখনই রোগের প্রকোপ দেখা দেবে তখনই রাসায়নিক ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ গুলিয়ে ৩-৪ দিন পর পর ২-৩ বার করে জমিতে ছিটাতে হবে।
৪. রোগমুক্ত পাটগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
৫.জমিতে সব সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আগা শুকিয়ে যাওয়া রোগ : ঝড়ে বা অন্য কোনো কারণে গাছে আঘাত লাগলে এ রোগ বেশি হতে পারে। রোগে আক্রান্ত অংশ বাদামি রঙের হয় এবং আগা থেকে নিচে শুকাতে থাকে। ফুল আসার পর সচরাচর এ রোগ দেখা দেয়। তোষা পাটে এ রোগ বেশি হয়। রোগ দেখা দিলেই ডাইথেন এম-৪৫ নামক ছত্রাকনাশক ওষুধ ২০ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে গুলিয়ে ২/৩ দিন পরপর অন্তত ২ বার গাছে স্প্রের করতে হবে।
গোড়া পচা রোগ : যেসব দেশি পাটের ক্ষেতে পানি নিষ্কাশন করা যায় না, সেসব স্থানে গাছের পরিণত বয়সে সাদা তুলার আঁশের মতো এক ধরনের ছত্রাক গাছের গোড়ায় রাতারাতি বেড়ে ওঠে। দিন কয়েক পর সরিষার দানার মতো বাদামি রঙের জীবাণুর দানাও দেখা যায়। এ রোগের ফলে গাছের গোড়া পচে যায় এবং গাছ ভেঙে যায়। জমিতে এ রোগ দেখা দিলে গাছ কেটে আঁশ সংগ্রহ করা উচিত। ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩৫-৪০ গ্রাম মিশিয়ে গাছের গোড়ায় পর পর দুইদিন প্রয়োগ করলে রোগের ব্যাপকতা কমে যায়।
শিকড়ে-গিট রোগ : এ রোগে আক্রান্ত গাছের শিকড়ে ছোট-বড় অনেক গিট দেখা যায়। এ গিটের ভেতর এক প্রকার কৃমিকীট বা নেমাটোড অবস্থান করে এবং গাছের ক্ষতি করে। এ রোগের কারণে গাছের বাড় কমে যায় এবং ফুল কম ধরে। এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য রাসায়নিক ওষুধ ফুরাডান-৫ প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি হারে প্রয়োগ করে নিড়ানি এবং চূড়ান্তভাবে গাছ পাতলা করে দিতে হবে।
পাতার হলদে সবুজ ছিট পড়া পাতার মোজাইক রোগ : মোজাইক আক্রান্ত পাট গাছ থেকে সংগৃহীত বীজ বপনের ফলে এ রোগ হয়ে থাকে। গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে পাতায় হলুদ-সবুজ ছিট দাগ পড়ে। আক্রান্ত গাছের বাড়-বাড়তি কমে যায় এবং আঁশের পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। পরাগায়ণের মাধ্যমে এবং সাদা মাছি নামক এক ধরনের ছোট মাছির মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে থাকে। জমিতে আক্রান্ত চারা দেখা মাত্র গোড়াসহ উপড়ে ফেলতে হবে। সাদা মাছি মরার জন্য মাঝে মাঝে পাটক্ষেতে ডায়াজিন-৫০ প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলিলিটার পরিমাণ ওষুধ ৩০-৪০ দিন বয়সের গাছে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার ছিটাতে হয়।
পাতায় সাদা গুঁড়া পড়া : পাতার ওপর হালকা পাউডারের মতো অসংখ্য ছাতা রোগের জীবাণু থাকে। এ রোগ পাট মৌসুমের শেষে বীজ সংগ্রহের জন্য রাখা পাট গাছে দেখা যায়। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই থিওভিট বা কোনো গন্ধক জাতীয় ওষুধ ৩০ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটানো উচিত।
কৃষিবিদ মোঃ জ্যাবলুল তারেক
বিজ্ঞানী ও পাট গবেষক, পাটের কৃষি পরীক্ষা কেন্দ্র, জাগীর, মানিকগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭২২-৭৪৮২২৪, ই-মেইল :zablulbarj@gmail.com
দেশি খেজুরকে কেউ কেউ বুনো বা জংলি খেজুর নামে ডাকেন। কেননা এটা কেউ চাষ করে না, জঙ্গলের গাছ। এজন্য হয়তো এর ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে Wild Date Palm. দেশি খেজুর এ দেশের একটি অন্যতম প্রাচীন ফল। এ দেশেই উৎপত্তি, এ দেশেই বিস্তার। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের সিলভেসট্রিস ল্যাটিন শব্দের অর্থই হলো জংলি। এ দেশের বন জঙ্গলেই গাছটি প্রধানত জন্মে থাকে। সাধারণত পতিত অনুর্বর জমিতে, বাঁধের ধারে, পুকুর পাড়ে, জমির আইলে, বাড়ি ও বাগানের চারদিকে, পথের দুই পাশে সারি করে খেজুর গাছ লাগানো হয়। তবে তা ফলের জন্য নয়, রসের জন্য। গাছের মিষ্টি রস জ্বাল দিয়ে তা থেকে গুড়পাটালি তৈরি করা হয়। এ দেশে খেজুরকে গুড় উৎপাদনকারী ফসল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শীতের দিনে নলেন গুড়ের স্বাদ সবার কাছেই লোভনীয়। খেজুর যেহেতু অন্যান্য ফসলের মতো ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় না, বসতবাড়ি, মাঠ, রাস্তার ধারে জন্মে। তাই ঠিক কতটুকু জমিতে খেজুরের আবাদ হচ্ছে তার হিসাব কষা মুশকিল। বিগত ২০১৬-১৭ সালে এ দেশে মোট খেজুর রসের উৎপাদন ছিল ১৬৯০৫৬ টন। মোট ৫১৩২ একর জমির খেজুর গাছ থেকে তা আহরিত হয়েছিল বলে নিরূপিত হয়েছে। একই বছরে দেশি খেজুরের উৎপাদন ছিল ৩৮৯৩৯ টন (বিবিএস ২০১৮)। সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ আছে রাজশাহী, নাটোর ও যশোরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশি খেজুরের চাষ সম্প্রসারণে ইতোমধ্যে একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
উদ্ভিদতাত্ত্বিক বর্ণনা
খেজুর গাছ অ্যারিকেসি পরিবারের Phoenix গণভুক্ত। ফিনিক্সগণের ১৪টি প্রজাতির গাছ পৃথিবীতে রয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রজাতির ফসল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। Phoenix sylvestris (L.) Roxb. জড়ীন. প্রজাতি দেশি বা জংলি খেজুর ও Phoenix dactylifera L. খ. প্রজাতির গাছ আরবি খেজুর বা সৌদি খেজুর নামে পরিচিতি। প্রথমোক্ত প্রজাতির গাছ রস ও দ্বিতীয় প্রজাতির গাছ থেকে সুমিষ্ট ফল পাওয়া যায়। খেজুর গাছ একবীজপত্রী, এক লিঙ্গ বিশিষ্ট বৃক্ষ। অর্থাৎ পুরুষ ও মেয়ে গাছ আলাদা। মেয়ে গাছে ফল ধরে। শাখাহীন গাছ লম্বা হয় প্রায় ৪-১৫ মিটার। গাছের বাকল সদৃশ আবরণে পত্রবৃন্তের দাগ সব কাণ্ডকে জড়িয়ে থাকে। দেশি খেজুর গাছ বেশ দ্রুতবর্ধনশীল, শাখাবিহীন একটি কাণ্ড বিশিষ্ট গাছ। দেশি খেজুর গাছের গোড়াটা থাকে মোটা ও স্তূপের মতো শিকড় থাকে। কাণ্ডে পাতা ঝরে যাওয়ার পরও পত্রখোলের ভিত্তি অংশ কাণ্ডের সাথে লেগে থাকে যা খেজুর গাছকে বাড়তি সৌন্দর্য দান করে। পাতা পক্ষল, দণ্ডের দুই দিকেই হয়, অগ্রভাগ সুচাল, গোড়ায় তীক্ষ শক্ত কাঁটা। গাছের মাথায় পত্রগুচ্ছ নারিকেল-সুপারি গাছের মতো জন্মে। চৈত্র মাসে ফুল ফোটে। কাঁদিতে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটে। পুরুষ ফুল সাদা ক্ষুদ্রাকার। ফল হয় গ্রীষ্মকালে। ফল প্রায় ডিম্বাকৃতি, হলুদ রঙের, লম্বায় প্রায় ২.৫ সেন্টিমিটার। ভেতরে হালকা বাদামি রঙের একটি বীজ থাকে। বীজের ওপরে পাতলা আবরণের মতো শাঁস থাকে। কাঁচা শাঁস কইষট্যা-নোনতা। কিন্তু পাকলে তা বেশ মিষ্টি হয়। পাকা খেজুরের রঙ লালচে বাদামি থেকে খয়েরি হয়। পাকা খেজুর গ্রাম বাংলার শিশুদের কাছে খুব প্রিয়। বীজ দিয়েই খেজুরের বংশবৃদ্ধি হয়।
উৎপত্তি ও বিস্তার
দেশি খেজুর গাছের বিস্তৃতি পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে হিমালয়ের পশ্চিম থেকে শুরু করে ভারতবর্ষ থেকে নেপাল ও মিয়ানমার পর্যন্ত।
খেজুর গাছ বিক্ষিপ্তভাবে এ দেশের প্রায় সর্বত্রই জন্মে। এমনকি সুন্দরবন তথা উপকূলীয় অঞ্চলেও খেজুরের গাছ দেখা গেছে। তবে বেশি ও ভালো খেজুর গাছ জন্মে যশোর, নাটোর, রাজশাহী ও ফরিদপুর জেলায়।
ব্যবহার
দেশি খেজুরকে চিনি বা গুড় উৎপাদনকারী ফসল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খেজুর গাছের প্রধান ব্যবহার রস ও গুড় উৎপাদন করা। তবে এর ফলও খাওয়া যায়। দেশি খেজুুরের ফল খুব নিম্নমানের হওয়ায় তা ফল হিসেবে অনেকেই খায় না। দেশি খেজুরের ফলের শাঁস পাতলা, বিচি বড়, পাকা ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতা খুবই কম। তবু পাকা ফলের সুমিষ্ট গন্ধ ও মিষ্টি স্বাদ অনেককেই আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের। খেজুরের রস থেকে চোলাই মদ বা বিয়ার তৈরি করা যায়। স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত এই মদকে ‘তাড়ি’ বলা হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের মাথার দিকে কাণ্ড চেঁছে রস নামানো হয়। কোথাও কোথাও না ফোটা পুষ্পমঞ্জরির ডাটি কেটে রস নামানো হয়। রসের উৎপাদন গড়ে গাছপ্রতি ৫ লিটার। গাছের স্বাস্থ্য ভালো হলে রসের পরিমাণ আরো বেশি পাওয়া যায়। শীতকালে খেজুরগাছ থেকে রস পাওয়া যায়। শীতের সকালে খেজুরের টাটকা রস পান পল্লী বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। খেজুর গাছ কেটে রস নামানোর আগে গাছের পাতা ছাঁটাই করা হয়। এসব পাতার ফলক রোদে শুকিয়ে খেজুর পাতার নকশাদার পাটি ও হাতব্যাগ বা আরও কিছু কারুপণ্য বানানো হয়। খেজুরের পাতা দিয়ে গ্রাম বাংলায় পাটি, মাদুর, ঝুড়ি ইত্যাদি বানানো হয়। খেজুর গাছের কা- গৃহনির্মাণ সামগ্রী হিসেবে গ্রামে অনেকেই ব্যবহার করেন। ছোট নালা বা খালের ওপর সাঁকো বানানোয় এর কাণ্ড ব্যবহৃত হয়। কোনো কোনো স্থানে খেজুর গাছকে শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে উদ্যানে লাগানো হয়। খেজুর ফল হৃদরোগ, জ্বর ও পেটের পীড়ায় উপকারী। ফল বলবর্ধক। ফলে প্রচুর লৌহ জাতীয় খনিজ উপাদান আছে।
আবহাওয়া ও মাটি
শুষ্ক থেকে আর্দ্র যে কোনো স্থানে দেশি খেজুর গাছ জন্মাতে পারে। দেশি খেজুর গাছের জন্ম ও বৃদ্ধি লাভ সেখানে বেশি ভালো হয় যেখানে দিনের তাপমাত্রা ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। তবে তাপমাত্রা কমে গেলেও খেজুর গাছ বেঁচে থাকতে পারে। তরুণ গাছ হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমাত্রায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খেজুর গাছের জন্য বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৪০০-৭০০ মিলিমিটার দরকার হয়। খেজুর গাছের জন্য রোদেলা জায়গা চাই। বিভিন্ন ধরনের মাটিতে খেজুরগাছ জন্মাতে পারে। তবে মাটি অবশ্যই সুনিষ্কাশিত হতে হবে। তা না হলে গাছ টিকবে না। মাটির অম্লমান বা পিএইচ ৫.৫-৭.৫ হলে ভালো। লবণাক্ত মাটিতে খেজুর গাছ ভালো হয়।
চারা তৈরি
বীজ থেকে দেশি খেজুরের চারা তৈরি করা যায়। ভালোভাবে পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে কয়েক দিন রেখে দিলে ফল আরও পেকে খোসা ও শাঁস নরম হয়ে পচে যায়। তখন ফলগুলো চটকে পানিতে ধুয়ে নিলে বিচি পাওয়া যায়। সেগুলো পলিব্যাগে বা বীজতলায় বুনে চারা তৈরি করা যায়। গ্রীষ্মকালে শেষে চারা তৈরি করা যায়। বীজ গজাতে ২-৩ মাস লাগতে পারে।
চারা রোপণ
বাংলাদেশে অধিকাংশ খেজুরগাছ লাগানো হয় রাস্তার ধারে বা তৃণভূমিতে। বাণিজ্যিকভাবে বা বাগান আকারে খুব একটা খেজুরের চাষ করা হয় না। প্রধানত প্রাকৃতিকভাবেই এ দেশে খেজুরগাছ জন্মে থাকে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ লাগানো হয়। স্বভাবতই এসব গাছের কোনো পরিচর্যা করা হয় না বা করলেও খুব সামান্য যত্ন নেয়া হয়। পাখিরাই মূলত দেশি খেজুর গাছের প্রধান বিস্তারক। ফল খেয়ে সেসব ফলের বীজ পাখিরা দূরবর্তী স্থানে বিষ্ঠা ত্যাগের মাধ্যমে বিস্তার ঘটায়। কাঠবিড়ালিও এর বিস্তারক। বর্ষাকালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া এসব বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে খেজুরের চারা জন্মায়। বাংলাদেশে কৃষকরা সাধারণত চারা তৈরি করে না। তারা প্রাকৃতিকভাবে জান্মানো খেজুরের চারা তুলে এনে রোপণ করে। সাধারণত তারা ১৫-৪০ সেন্টিমিটার লম্বা ১-২ বছর বয়সী চারা তুলে এনে বাগানে, বাড়ির আঙিনায়, পতিত জমিতে বা রাস্তার ধারে লাগায়। সম্প্রতি নার্সারিতে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে কোনো কোনো এলাকায় খেজুর চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
খেজুরের চারা রোপণের জন্য আগেই গর্ত করে সার গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরে রাখতে হবে। দেখা গেছে, রোপণের সময় গর্তে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার দিলে পরবর্তীতে সেসব গাছ থেকে বেশি রস পাওয়া যায়। সবদিকে ৫০-৭৫ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত খুঁড়ে প্রতি গর্তের মাটির সাথে ৫-৭ কেজি গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ৩০০ গ্রাম এমওপি সার মাটির সাথে মেশাতে হবে। সার মাটি দিয়ে গর্ত ভরার সপ্তাহখানেক পর গর্তের মাঝখানে চারা রোপণ করতে হবে। জমির আইলে চারা লাগাতে হলে আইলের প্রশস্ততা বুঝে গর্ত করে জৈবসার দিয়ে চারা লাগাতে হবে। কৃষকরা বাগানে ঘন করে চারা লাগায়। তবে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪-৫ মিটার দেয়া ভালো। চারা অবশ্যই সারিতে রোপণ করা উচিত।
আগাছা ও সার ব্যবস্থাপনা
খেজুর বাগানে প্রচুর আগাছা জন্মে। বিশেষ করে উলু ঘাস। এসব আগাছা পরিষ্কার না করলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। এজন্য চারা রোপণের ১ মাস পর চারার গোড়া থেকে খানিকটা দূর পর্যন্ত আগাছা পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে সেখানে গাছপ্রতি ১৫০-২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার দিতে হবে। বর্ষার পর সার দিলে সেসব গাছের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। চারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে পরের বছর থেকে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের পরিমাণ গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়াতে হবে। গ্রামে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র সিকি ভাগ কৃষক শুধু বছরে একবার গাছের গোড়ার কিছুটা দূর দিয়ে মাটি খুঁড়ে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেন। এতে তাদের অভিজ্ঞতা হলো, ইউরিয়া সার দিলে সেসব গাছে রসের উৎপাদন বাড়ে।
বালাই ব্যবস্থাপনা
দেশি খেজুর গাছ অনেক ধকল সইতে পারে। সাধারণত এ গাছে তেমন বালাইয়ের আক্রমণ হয় না। তবে কখনো কখনো গাছে কিছু পোকা ও রোগের আক্রমণ দেখা দেয়, যার ফলে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে খেজুর পাতায় খোস পোকার আক্রমণ ঘটে। সাদা ও লাল দুই ধরনের খোস পোকা বা স্কেল ইনসেক্ট আক্রমণ করে। অল্প বয়সের খেজুরগাছ সাদা স্কেল পোকা (Parlatoria blanchardii) দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে গাছের বয়স ২-৮ বছরের মধ্যে সাদা খোস পোকার আক্রমণ হলে গাছের খুব ক্ষতি হয়। দানা দানা শক্ত সাদাটে রঙের চাকতি বা খোসের মতো পোকা পাতায় অনেকগুলো একসাথে কলোনি করে থাকে ও পাতা থেকে রস চুষে পাতাকে বিবর্ণ, দুর্বল ও শেষে মেরে ফেলে। পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা খোস পোকা উভয়ই পাতা থেকে রস চুষে খায়। তীব্র আক্রমণে পাতা হলদে হওয়ার পর মরে বাদামি হয়ে যায়। পাতার উভয় পিঠেই এরা আক্রমণ করে, তবে নিচের পিঠে বেশি থাকে। লাল খোস পোকাও (Phoenicococcus marlatti) একইভাবে ক্ষতি করে। এ পোকার রঙ গাঢ় গোলাপি বা লাল। এছাড়া গণ্ডার পোকা বা রাইনোসেরস বিটিল (Oryctes rhinoceros) খেজুর গাছের ক্ষতি করতে পারে। চকচকে কালো রঙের শক্ত দেহের এ পোকাদের গণ্ডারের শিঙের মতো শুঁড় আছে। পূর্ণবয়স্ক গণ্ডার পোকা খেজুর গাছের কচি পাতা খেয়ে সর্বনাশ করে। মাঝে মাঝে খেজুর পাতায় ছাতরা পোকার আক্রমণও দেখা যায়। এসব পোকা নিয়ন্ত্রণে অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। রোগের মধ্যে শিকড় পচা, হলদে মোজাইক, কৃমি রোগ, লিথাল ইয়েলোইং বা হলদে মরা, ব্রিটল লিফ ইত্যাদি রোগ গুরুত্বপূর্ণ। ছত্রাকজনিত রোগ হলে বোর্দো মিশ্রণ বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
রস আহরণ ও গুড় তৈরি
আবাহমান বাংলার শীতের এক অনন্য ঐতিহ্য খেজুরের রস। মরুদেশ আরবের খ্যাতি যেমন খেজুর দিয়ে, বাংলাদেশের খ্যাতি তেমন খেজুরের রস দিয়ে। এ দেশের প্রায় সব জায়গাতেই কম বেশি খেজুর গাছ আছে। তবে যশোরে পরিচিতি খেজুর গাছ দিয়ে। কথায় বলে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। অর্থাৎ যশোরের খ্যাতি খেজুর গাছ এবং খেজুরের রস দিয়ে। এমনকি যশোর জেলাকে প্রতীকী অর্থে কোথাও উপস্থাপন করার সময় সেখানে খেজুর গাছের ছবি যশোরের প্রতিনিধিত্ব করে।
সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু হয় যখন গাছে ১২-১৫টি পাতা থাকে। খেজুর গাছ এক বিশেষ পদ্ধতিতে চেঁছে তা থেকে রস নামানো হয়। যারা খেজুর গাছ কেটে এই রস নামানোর পেশায় নিয়োজিত তাদেরকে বলে ‘গাছি’। শীতের মৌসুম শুরু হলেই গ্রামে গ্রামে গাছিরা প্রথমে খেজুর গাছের মাথার পাতা ও পাতার খোসা কেটে পরিষ্কার করে কয়েক দিন রেখে দেয়। তারপর গাছের মাথার একপাশ থেকে ধারালো এক প্রকার বিশেষ দা-এর সাহায্যে গাছের বাকল চেঁছে তোলে। এই দাকে বলে ‘গাছি দাও’। তবে পাতা কাটার জন্য ‘কাটু দাও’ ব্যবহার করা হয়। একটা ছোট্ট কাঠি গাছের সাথে আড়াআড়ি বেঁধে গাছিরা পা রেখে দাঁড়ায়, একে বলে ‘পাতুই কাঠি’।
গাছি তার কোমরে একগাছি রশির সাহায্যে তার পেছনে তালপাতার তৈরি এক ধরনের বিশেষ পাত্র বেঁধে রাখে। তাকে বলে ‘ঠুঙ্গি’। ঠুঙ্গির ভেতরে এসব দাও থাকে। রশির সাথে ঝুলানো থাকে কলসির মতো একটি মাটির ‘ঠিলা’। চেঁছে বাকল তোলার পর রস নামতে শুরু করে। তখন সেখানে দুপাশ থেকে চেঁছে ফেলা জায়গার নিচে অগভীর একটা খাঁজ কেটে তার মাঝখানে পেনসিলের মতো একটি কঞ্চি চেরা কাঠি পুঁতে দেয়া হয়। কাঠির নিচে বেঁধে দেয়া হয় রসের ঠিলা। একদিনে আহরিত রস এই ঠিলা থেকে সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত সপ্তাহে তিন দিন গাছ কাটা হয়। বিরতি দিয়ে সপ্তাহের প্রথমে যে রস নামানো হয় সেটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের রস। একে ‘জিরান কাটের রস’ বলে, দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে ‘দো কাটের রস’, তৃতীয় দিনের রসকে বলে ‘ঝরা রস’। প্রথমোক্ত রস থেকে ভালো মানের গুড় ও পাটালি তৈরি হয়। ঝরা রস থেকে হয় ‘তোয়াক গুড়’ ও ‘ঝোলা গুড়’। রস উনুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করলে গুড় তৈরি হয়। জ্বাল দিয়ে ঘন করা গুড়কে পাত্রে ঢেলে ঠাণ্ডা করলে পাটালি হয়। পাত্রের আকার অনুসারে গুড়েরও বিভিন্ন নাম আছে। যদি সমতল পাতের মতো শক্ত গুড় হয় তাকে বলে পাটালি। যদি মাটির ছোট ছোট মুছিপাত্রে ঢেলে গুড় জমানো ও শক্ত করা হয় তাকে বলে মুছি পাটালি। ঠিলা বা মাটির কলসিতে ঢেলে নরম গুড় রাখলে তাকে বলে ঠিলার গুড়। জিরান রস থেকে উত্তম মানের গুড় তৈরি হয়।
ফল সংগ্রহ ও ফলন
সাধারণত গাছেই কাঁদিতে দেশি খেজুরের ফল পেকে ঝরে পড়ে, সংগ্রহ করা হয় না। সব ফল একসাথে পাকে না। কয়েক দিন ধরে পাকতে থাকে। ফল পাকার সময় গ্রীষ্মকাল। পাকা ফল পাখিরা খায়। ফল মাটিতে ঝরে পড়ে সেখানেই প্রাকৃতিকভাবে চারা তৈরি হয়। খাওয়ার জন্য ফলের রঙ সবুজ থেকে হলুদ হলে কাঁদির পাটি কেটে কাঁদিসহ সংগ্রহ করা হয়। ঘরে রেখে দিলে ২-৩ দিনের মধ্যে সেসব পরিপক্ব ফল পাকতে শুরু করে। পাকলে ফলের শাঁস নরম হয় ও লালচে মেরুন রঙ ধারণ করে। একটি গাছ থেকে ১০-২৫ কেজি ফল পাওয়া যায়, রস পাওয়া যায় ৫-৭ লিটার।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
উপপরিচালক (এলআর), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityun@yahoo.com